৩৮. বানরসৈন্য সহ শ্রীরামচন্দ্রের সেতুবন্ধন দর্শন ও শিবপূজা

যে পর্ব্বত এনেছিল পব্ন-নন্দন।
দশ যোজন তাহাতে যে হইল বন্ধন।।
কুড়ি যোজন বান্ধা গেল অলঙ্ঘ্য সাগর।
আসিয়া দেখিয়া যায় যত নিশাচর।।
কাষ্ঠবিড়াল সব আইল তথাকারে।
লাফ দিয়া পড়ে গিয়া সাগরের তীরে।।
অঙ্গেতে মাখিয়া বালি ঝাড়য়ে জাঙ্গালে।
ফাঁক যত ছিল তাহা মারিল বিড়ালে।।
যাতায়াত করে সদা বীর হনুমান।
বিড়ালেরে চারিদিকে ফেলে দিয়া টান।।
কান্দিয়া কহিল সবে রামের গোচর।
মারিয়া পাড়য়ে প্রভু পবন-কুমার।।
হনুমানে ডাকিয়া কনেহ প্রভু রাম।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেন কর অপমান।।
যেমন সামর্থ্য যার বান্ধুক সাগর।
শুনিয়া লর্জ্জিত হৈল পবন-কুমার।।
সদয় হৃদয় বড় প্রভু রঘুনাথ।
কাষ্ঠবিড়ালের পৃষ্ঠে বুলাইল হাত।।
চলিল সবাই তবে জাঙ্গাল উপর।
হনুমান বলে শুন সকল বানর।।
কাষ্ঠবিড়ালেরে কেহ কিছু না বলিবে।
সাবধান হয়ে সবে জাঙ্গালে চলিবে।।
পর্ব্বত আনিয়া দেয় পবন-নন্দন।
কুড়ি দিনে বান্ধা গেল সত্তর যোজন।।
লঙ্কাপুরে প্রবেশিয়া বীর হনুমান।
প্রাচীন ভাঙ্গিয়া সব কৈল খান খান।।
বহিয়া আনিয়া তাহা সকল বানর।
নবতি যোজন বান্ধে প্রবল সাগর।।
লাফ দিয়া যায় তায় কপি যোড়া যোড়া।
লঙ্কার ভাঙ্গিয়া আনে পর্ব্বতের চূড়া।।
আড়ে ওড়ে থাকিয়া রাক্ষস দেয় উঁকি।
মালসাট মারে বানর দেখায় ভাবকি।।
আনন্দে করয়ে নল সাগর বন্ধন।
একমাসে বান্ধা গেল শতেক যোজন।।
উত্তরের জাঙ্গাল ঠেকিল দক্ষিণ কূলে।
রাম জয় বলিয়া বানর সব বুলে।।
জাঙ্গাল বান্ধিল বিশ্বকর্ম্মার নন্দন।
সকল দেবতা করে পুষ্প-বরিষণ।।
জাঙ্গাল সমাপ্ত করি নল বীর চলে।
প্রণাম করিল গিয়া রাম-পদতলে।।
ভূমি লুটি ঘন ঘন করি প্রণিপাত।
যোড় হস্ত করি বলে শুন রঘুনাথ।।
জাঙ্গাল সমাপ্ত করি বান্ধিনু সকল।
রক্ষক রহিল হনুমান মহাবল।।
এত শুনি সন্তুষ্ট হইয়া রঘুনাথ।
নলে আশীর্ব্বাদ করি পৃষ্ঠে দেন হাত।।
ধন নাই, নল কিবা করিব প্রসাদ।
এখন লহ রে বাপু মোর আশীর্ব্বাদ।।
সীতার উদ্ধার করি যাব অযোধ্যায়।
অমূল্য রতন নানা দিব হে তোমায়।।
নল বলে, তাহে কার্য্য নাহি নারায়ণ।
ব্রহ্মার বাঞ্ছিত দেহ অমূল্য রতন।।
কমলা যাঁহারে সদা করেন সেবন।
যাঁহা লাগি যোগী হৈলা দেব পঞ্চানন।।
মোর শিরে দেহ রাম চরণ তোমার।
ইহা হৈতে অমূল্য-রতন নাহি আর।।
শুনিয়া সন্তুষ্ট রাম কমললোচন।
নলের মাথায় দিলা দক্ষিণ চরণ।।
প্রসাদ লইল নল ভূমি লোটাইয়া।
রামজয় বলি কপি বেড়ায় নাচিয়া।।
শ্রীরাম বলেন, শুন মিত্র কপিরাজ।
জাঙ্গাল দেখিতে চল সাগরের মাঝ।।
রামজয় বলি উঠে সূর্য্যের নন্দন।
আগে আগে চলিলেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
সুগ্রীব চলিল আর রাজা বিভীষণ।
অঙ্গদ-চলিল সঙ্গে যত বীরগণ।।
চিত্র বিচিত্র দেখিয়া জাঙ্গাল বন্ধন।
বলে ধন্য নল বিশ্বকর্ম্মার নন্দন।।
দেবতা অসুর নাগ দেখি চমৎকার।
হেন বুঝি সাগর পরিলা গলে হার।।
শ্রীরাম বলেন, নল শুনহ বিশেষ।
দেউল গঠিয়া দেহ পূজিতে মহেশ।।
এত শুনি নল বীর হইয়া সত্বর।
দেউল গঠিল সেই জাঙ্গাল উপর।।
পর্ব্বত আনিয়া দেয় পবন-নন্দন।
চিত্র ও বিচিত্র করে দেউল গঠন।।
শ্বেতবর্ন শিব গঠি তাহার ভিতর।
নল জানাইল গিয়া রামের গোচর।।
শ্রীরাম বলেন তবে পবন-কুমারে।
শ্বেতপদ্ম সহস্র আনিয়া দেহ মোরে।।
এত শুনি চলে বীর পবন-নন্দন।
কৈলাসেতে যথা কুবেরের পদ্মবন।।
তাহার মধ্যেতে আছে এক সরোবর।
ফুটিয়াছে পদ্ম সব জলের উপর।।
তুলিয়া সহস্র পদ্ম পবন-নন্দন।
আনিয়া দিলেন বীর যথা নারায়ণ।।
শিবপূজা করিতে বসেন ভগবান।
কৈলাস ছাড়িয়া শিব হন অধিষ্ঠান।।
দুই হাত রামের ধরিলা ত্রিলোচন।
দুইজন হরষিত প্রেম-আলিঙ্গন।।
শিব বলে, প্রভু তুমি পূজা কর কার।
রাম তুমি ইষ্টদেব হও যে আমার।।
শ্রীরাম বলেন, তুমি মোর ইষ্ট হও।
রাবণ বধিতে তুমি পুষ্প জল লও।।
শিব বলেন, মোর সেবক দশানন।
সীতা চুরি কৈল তার হউক মরণ।।
তোমার বাণেতে হবে সবংশে সংহার।
বড় প্রিয় সেবক আছিল লঙ্কেশ্বর।।
না চিনিল ইষ্টদেব প্রভু রঘুবর।
আপন মরণ সেই কৈল সারোদ্ধার।।
আয়ুশেষ হৈল জানকীর চুলে।
শাপ দিলা সীতা তারে মনের আকুলে।।
এই হেতু হবে তার সবংশে সংহার।
শীঘ্র চলি যাহ রাম সাগরের পার।।
এত বলি দুই জনে করিলা প্রণাম।
কৈলাসে গেলেন শিব বলি রাম নাম।।