৩৪. বিভীষণের সহিত শ্রীরামচন্দ্রের মিত্রতা ও বিভীষণের অভিষেক

এইরূপে প্রণাম করিয়া পঞ্চাননে।
পরে প্রণমিলা শিবা আর বৈশ্রবণে।।
তবে চারিজন মন্ত্রী সঙ্গেতে লইয়া।
চলিলা শ্রীরাম-কাছে আনন্দিত হৈয়া।।
আকাশে রামের পাশে যায় বিভীষণ।
সাগরকূলেতে থাকি দেখে কপিগণ।।
সম্ভমে বানর-সৈন্য করে তোলাপাড়া।
পাদম পাথর লয়ে সবে হয় খাড়া।।
মহাবল পরাক্রান্ত দেখিতে ভীষণ।
সবে বলে মার মার এই ত রাবণ।।
অন্তরীক্ষে থাকি বলে আমি বিভীষণ।
রামের চরণে আমি লইব শরণ।।
কহে বিভীষণের সংবাদ দূতগণ।
বসিলেন মন্ত্রণা করিতে মন্ত্রিগণ।।
সুগ্রীব বলেন, শুন এ নহে উচিত।
ছল করি যদি আর করে বিপরীত।।
জাম্ববান পাত্র বলে বুদ্ধে বৃহস্পতি।
বৈরীরে নিকটে আনা নহে মম মতি।।
হেনকালে কহে আসি বীর হনুমান।
এই বিভীষণ মোরে দিলা প্রাণদান।।
মিত্রতা বিভীষণ মোরে দিলা প্রাণদান।।
মিত্রতা যদ্যপি হয় রাম-বিভীষণে।
বিভীষণ সহায়ে সংহারিব রাবণে।।
শ্রীরাম বলেন, শুন সুগ্রীব ভূপতি।
অন্য রূপ না ভাবিহ বিভীষণ প্রতি।।
আপনার দোষ মিত্র না দেখ আপনি।
তোমাতেই মিত্রতার সাক্ষী আমি জানি।।
কাতর হইয়া যেবা লইল শরণ।
পরলোক নষ্ট, যদি না করে পালন।।
পুরাণের কথা কহি কর অবধান।
শিবি নামে রাজা ছিল ধর্ম্ম-অধিষ্ঠান।।
পলায় কপোত পক্ষী সাঁচানের ডরে।
ত্রাসেতে পড়িল শিবি-নৃপতির ক্রোড়ে।।
যত্ন করি নরপতি ঘুঘু-পক্ষী রাখে।
প্রাচীরে সাঁচান পক্ষী নৃপতিরে ডাকে।।
আপনার ভক্ষ্য আমি করিব আহার।
হেন ভক্ষ্য রাখ রাজা নহে ব্যবহার।।
রাজা বলে, পক্ষী মম লভিল শরণ।
তোমার স্বমাংস দিয়া করাব ভোজন।।
সাঁচান বলিল যদি কর পরিত্রাণ।
আপন গায়ের মাংস মোরে দেহ দান।।
রাজভোগে মাংস তব অত্যন্ত সুস্বাদ।
এ মাংস খাইলে মোর ঘুচে অবসাদ।।
শুনি সাঁচানোর কথা রাজার উল্লাস।
তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়া নিজ গায়ের কাটে মাস।।
তিলার্দ্ধ নাহিক স্থান সর্ব্ব অঙ্গ কাটে।
ভোজন করায় তারে যত ধরে পেটে।।
বহিয়া শিবির গাত্র রক্ত বহে স্রোতে।
আপন গায়ের রক্তে সিংহাসন তিতে।।
সেই ত পুণ্যেতে রাজা গেল স্বর্গবাস।
শরণাগতেরে না রাখিলে সর্ব্বনাশ।।
বিভীষণ থাক যদি আইসে রাবণ।
হইলে শরণাগত করিব পালন।।
রামের আজ্ঞায় কপি গেল অন্তরীক্ষে।
বিভীষণে আনিবারে রামের সমক্ষে।।
সুগ্রীব রাজার আগে করে সম্ভাষণ।
পরম আনন্দে কোল দিল দুইজন।।
বিভীষণ সুগ্রীব চলিল রাম স্থানে।
বিভীষণ পড়ে গিয়া শ্রীরাম-চরণে।।
রাবণের ভাই আমি নাম বিভীষণ।
তোমার চরণে আমি লইনু শরণ।।
শ্রীরাম বলেন, বলি শুন বিভীষণ।
মন্ত্রণা করিয়া বুঝি পাঠায় রাবণ।।
শুনিয়া রামের কথা কহে বিভীষণ।
তোমার চরণে মাত্র লইব শরণ।।
ইহা ভিন্ন যদি অন্য দিকে ধায় মন।
তবে যেন হই আমি কলির ব্রাহ্মণ।।
হইব কলির রাজা সহস্র তনয়।
এই তিন দিব্য প্রভু করিনু নিশ্চয়।।
তিন দিব্য করিল রাক্ষস বিভীষণ।
এই তিন দিব্য শুনি হাসেন লক্ষ্মণ।।
হেনকালে শ্রীরামেরে বলেন লক্ষ্মণ।
বহুদিনে শুনিলাম অপূর্ব্ব কথন।।
এক পুত্র হেতু লোক করে আরাধন।
সহস্র পুত্রের বর মাগে বিভীষণ।।
রাজা হইবার তরে তপ করি মরে।
হেন দিব্য করে প্রভু তোমার গোচরে।।
শ্রীরাম বলেন, অল্পবুদ্ধি রে লক্ষণ।
বড় দিব্যে লক্ষ্মণ আমার পরিতোষ।।
কলির ব্রাহ্মণ ভাই শুন তার দোষ।
লোভ মোহ কাম ক্রোধ এই মহাপাপ।
সেই সব পাপে বিপ্র পায় বড় তাপ।।
প্রতিগ্রহ করিবেন উদর কারণ।
প্রতিগ্রহ মহাপাপ নাহিক তারণ।।
এই সব পাপে যেবা করে অনাচার।
সে পুত্রের পাপে সব মজিবে সংসার।।
কলির রাজা, প্রজা যদি না করে পালন।
সে পাপে রাজার হয় অকালে মরণ।।
আর সব দোষ আছে তাহা কব পাছে।
বিভীষণে রাজা করি আগে রাখ কাছে।।
সর্ব্ব সেনাপতি আন সাগরের বারি।
লঙ্কার রাজত্ব দেহ বিভীষণোপরি।।
শ্রীরামের আজ্ঞা যেন পাষাণের রেখ।
সেইক্ষণে বিভীষণে করে অভিষেক।।
শ্রীরামের বচন লঙ্ঘিবে কোন্ জন।
বিভীষণ রাজা হৈল জগতে ঘোষণ।।
ছত্রদণ্ড দিল তাঁরে স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী।
অভিষেক করি দিল রাণী মন্দোদরী।।