৩৩. কুবের কর্ত্তৃক বিভীষণকে রামের শরণ লইতে উপদেশ

এখানেতে নিজ স্থানে থাকি পশুপতি।
সকল বৃত্তান্ত জানি কন শিবা প্রতি।।
শুন প্রিয়ে রাবণ-অনুজ বিভীষণ।
করিতেছে সখার নিকটে আগমন।।
সীতা ফিরি দিয়া রাম সঙ্গে মিলিবারে।
বলেছিল সেই রাবনেরে বারে বারে।।
সেহ তাহা না শুনি করেছে অপমান।
এই লাগি তারে ছাড়ি আসিছে এখান।।
হইয়াছে তার মন শ্রীরামে ভজিতে।
কিন্তু করিতেছে পুনঃ নানা শঙ্কা চিতে।।
সেই যে সংশয়চ্ছেদ করিবার আশে।
আসিতেছে মোর প্রিয় সুহৃদের পাশে।।
যদি সখা না পারেন তারে বুঝাইতে।
তবে পড়িবেক সেই সঙ্কট-নদীতে।।
অতএব চল যাব আমিহ সেথায়।
রাম কাছে পাঠাইতে হইবে তাহায়।।
যদি কেহ রামচন্দ্রে করহ আশ্রয়।
তবে মোর কতই পরমানন্দ হয়।।
দেখ দেখ সংসার অসংখ্য জীবময়।
তার মধ্যে হিতে রত কেহ কেহ হয়।।
তার কোটি মধ্যে এক জন ধর্ম্মপর।
তার কোটি মধ্যেতে মুমুক্ষু এক নর।।
তার কোটি মধ্যে এক জন হয় মুক্ত।
তার কোটি মধ্যে এক রাম ভক্তিযুক্ত।।
হেন রামভক্ত যদি হয় কোন জন।
তাঁর গুণে কত লোক পায় বিমোচন।।
অতএব সতত বাসনা মোর সনে।
ভজুক সকল লোক শ্রীরাম-চরণে।।
তাহে বিভীষণ গেলে রাম সন্নিকটে।
হইবে তাহাঁর কত হিত এ সঙ্কটে।।
অতএব খণ্ডি তার সকল সংশয়।
পাঠাইব প্রভু কাছে অদ্যই নিশ্চয়।।
এত কহি নন্দীরে কহেন ত্রিলোচন।
শীঘ্র সাজাইয়া বৃষ কর আনয়ন।।
তবে নন্দী গিয়া বৃষে করিলা সাজন।
করিলেক প্রভুর অগ্রেতে আনয়ন।।
তবে মহাদেব উঠি শিবা-করে ধরি।
আরোহণ করিলেন বৃষের উপরি।।
হইল যেরূপ শোভা সেকালে তাঁহার।
তাহা ভাবি মন সুখী না হয় কাহার।।
এইরূপে পার্ষদ সহিত পঞ্চানন।
গমন করিলা নিজ সখার ভবন।।
দূর হৈতে তাঁরে নিরখিয়া ধনপতি।
অগ্রসর হইয়া আইলা শীঘ্রগতি।।
বৃষাকপি বৃষ হৈতে নামিয়া ভূতলে।
আলিঙ্গন করিলা কুবেরে কুতূহলে।।
তবে দুই জনে কর ধরাধরি করি।
বসিলা যাইয়া দিব্য আসন উপরি।।
শিবা আর যাবতীয় শিবভক্তগণ।
যথাযোগ্য স্থানেতে বসিলা সুখী মন।।
তবে পশুপতি নিজ সখার সহিত।
করিলেন প্রেম আলাপন যে উচিত।।
হেনকালে চারি মন্ত্রী সহ বিভীষণ।
করিলেন কৈলাস ভূধরে আগমন।।
দিব্য মণি সুবর্ণে রচিত সে নগর।
বিশ্বকর্ম্মা বিনির্ম্মিত পরম সুন্দর।।
সে নগরী মাঝে প্রবেশিয়া বিভীষণ।
করিলেন কুবেরের সভায় গমন।।
দূর হৈতে বিভীষণে দেখি পশুপতি।
কহিলেন সুখী মনে কুবেরের প্রতি।।
সখে দেখ রাবণ অনুজ বিভীষণ।
করিতেছে তোমার নিকট আগমন।।
এই কহেছিল রাবণেরে ন্যায় রীতে।
সীতা ফিরি দিয়া রাম সহিত মিলিতে।।
তাহা না শুনিয়া সে করেছে অপমান।
এই লাগি লঙ্কা ছাড়ি আসিছে এখান।।
ইচ্ছা হইয়াছে রামে করিতে আশ্রয়।
কিন্তু হৃদয়েতে আছে কিঞ্চিৎ সংশয়।।
এই লাগি আসিয়াছে তোমা জিজ্ঞাসিতে।
রামের নিকটে এরে পাঠাও ত্বরিতে।।
ইহ সেখানেতে গেলে বিবিধ প্রকার।
হইবেক শ্রীরামচন্দ্রের উপকার।।
ইঁহ যাবামাত্র সখা করি রঘুবর।
ইহারে করিবে রাজা রাক্ষস উপর।।
এইরূপে কুবেরে কহেন পঞ্চানন।
দেখিলা দূরেতে থাকি তাঁরে বিভীষণ।।
তাহে হয়ে অতিশয় আনন্দিত মতি।
কহিতে লাগিলা নিজ মন্ত্রীদের প্রতি।।
একি একি দেখিয়াছ মোর ভাগ্যোদয়।
সভামাঝে বসিয়া কৃপালু মৃত্যুঞ্জয়।।
যাঁহারে হেরিতে বাঞ্ছা করে দেবগণ।
যোগীগণ ধ্যান করে যাঁহার চরণ।।
মুনিগণ পরমার্থ জানিবার তরে।
ভক্তিভাবে নিরবধি সেবা করে যাঁরে।।
হেন প্রভু দেখিতে পাইনু অযতনে।
মনোরথ পরিপূর্ণ হলো এত দিনে।।
এইরূপ কহিতে কহিতে আগে গিয়া।
পড়িলেন তাঁহাদের পদে লোটাইয়া।।
মহাদেব আশীর্ব্বাদ কৈলা তাঁর প্রতি।
আলিঙ্গন করিলা সাদরে ধনপতি।।
তবে আজ্ঞা লয়ে বসিলেন বিভীষণ।
কুবের তাহার প্রতি কহেন বচন।।
আসিয়াছ পথে সুখে ভ্রাতা বিভীষণ।
কুশলে আছয়ে তব সব বন্ধুগণ।।
দেখিতেছি কিছু ম্লান তোমার বদন।
কহ কহ কি কারণে চিন্তাযুক্ত মন।।
কুবেরের এই বাক্য করিয়া শ্রবণ।
নিবেদন করিতে লাগিলা বিভীষণ।।
আমি করিয়াছি পথে ‍সুখে আগমন।
সম্প্রতি আছয়ে সুখে সব বন্ধুজন।।
কিন্তু এক দুঃখ হইতেছে উপস্থিত।
এই লাগি আইলাম এখানে ত্বরিত।।
দশানন জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের ভার্য্যারে।
হরিয়া আনিয়াছেন লঙ্কার ভিতরে।।
তাঁর দূত হয়ে এসেছিলা হনুমান।
সীতা ভেটি গিয়াছে দহিয়া লঙ্কাখান।।
সম্প্রতি যে রামচন্দ্র লয়ে কপিগণ।
করেছেন সাগর-কূলেতে আগমন।।
তাহা দেখি কহিলাম আমিহ দাদারে।
সীতা ফিরি দিয়া রাম সঙ্গে মিলিবারে।।
তাহা না শুনিয়া মোরে কৈল অপমান।
এ লাগি ত্যজিয়া লঙ্কা আইনু এস্থান।।
সম্প্রতি উচিত হয় মোর কি করণ।
যাহা আজ্ঞা কর, আমি লইনু শরণ।।
এত বিভীষণ-বাণী শুনি ধনপতি।
কহিবারে আরম্ভ করিলা তাঁর প্রতি।।
ইহা মোরা ভ্রাতঃ জানি পূর্ব্বেই হইতে।
তবু জিজ্ঞাসিনু তব বদনে শুনিতে।।
করিয়াছ যাহা তুমি এ অতি উচিত।
না হইবে ইথে কোন প্রকারে চিন্তিত।।
যাহ যাহ এইক্ষণে করহ গমন।
যেখানে আছেন রাম সুগ্রীব লক্ষ্মণ।।
তুমি যাবামাত্র রামচন্দ্র বরাবর।
সখা করিবেন তোমা প্রভু রঘুবর।।
আর সেই নিশাচর-রাজ্য অধিকারে।
করিবেন অভিষেক অদ্যই তোমারে।।
সবান্ধবে রাবণে করিয়া বিনাশন।
তোমা রাজ্য দিয়া রাম যাইবে ভবন।।
অতএব ত্যজি তুমি সকল সন্দেহ।
শ্রীরামের নিকটে যাইতে মন দেহ।।
রাম সঙ্গে মিলিয়া সকল নিশাচর।
সংহার করহ গিয়া ত্যজি সব ডর।।
রাবণ অধর্ম্মী দেব-দ্বিজ-দ্রোহকারী।
ত্রিভুবন সুখী কর তাহারে সংহারি।।
হইবে ইহাতে দেখি বিশ্বের মঙ্গল।
হবেন তোমারে তুষ্ট অমর সকল।।
আশীর্ব্বাদ করিবে তোমারে ঋষিগণ।
গাইবে তোমার যশ এ তিন ভুবন।।
কুবেরের মুখে শুনি এতেক বচন।
অধোমুখ হইয়া ভাবেন বিভীষণ।।
তাহা দেখি পরম দয়ালু শূলপাণি।
কহিতে লাগিলা তার অভিপ্রায় জানি।।
ভাবিতেছ অকারণে কিবা বিভীষণ।
কর নিজ অগ্রজের বচন পালন।।
যাহ যাহ শ্রীরামের নিকটে ত্বরিত।
করহ নিজের আর সংসারের হিত।।
এত বিরূপাক্ষ-বাণী শুনি বিভীষণ।
কৃতাঞ্জলি হইয়া করেন নিবেদন।।
যে আজ্ঞা করেছ প্রভু তোমরা দুজন।
কার সাধ্য করিবারে ইহার লঙ্ঘন।।
আমিও শ্রীরাম কাছে যাইব বলিয়া।
আসিয়াছি গৃহ ধন বান্ধব ত্যজিয়া।।
কিন্তু তাহে অনেক সংশয় করে মন।
অনুগ্রহ করি তাহা করিবে খণ্ডন।।
আমি যদি রাম কাছে যাই এইক্ষণ।
করিবেন সব লোক আমার নিন্দন।।
কহিবেক রাবণের বিপদ দেখিয়া।
বিভীষণ তারে ছাড়ি গেল দুষ্ট হৈয়া।।
তাহে পুনঃ যদি মোরে রাজ্য দেন রাম।
তবে দোষ ঘুষিবে সংসারে অবিরাম।।
বলিবে সকলে বিভীষণ রাজ্যলোভে।
বধিলেক সবান্ধবে অগ্রজে অক্ষোভে।।
অতএব এক্ষণে যাইতে নহে মন।
পরেতে করিব যে করিবে আজ্ঞাপন।।
এত কহি বিভীষণ বিরত হইল।
হাসি হাসি শিব তারে কহিতে লাগিল।।
একি একি বিভীষণ বড় চমৎকার।
হইতেছে এ সংশয় কিরূপ তোমার।।
কহিতেছি মোরা যাঁরে করিতে আশ্রয়।
তাঁহার ভজনে নাহি সময় নির্ণয়।।
বুঝি রামে আছে তব নর বলি জ্ঞান।
এই লাগি করিতেছ সংশয় বিধান।।
ইহা বোধ অতিশয় অনুচিত হয়।
শুন শুন কিছু তাঁর স্বরূপ নির্ণয়।।
সত্য সুখ-জ্ঞান ঘন-তনু রঘুপতি।
পরমাত্মা ভগবান কহে শ্রুতি যতি।।
জীবের নিয়ন্তা অবিচিন্ত শক্তিধর।
সৃষ্টি স্থিতি লয়-কর্ত্তা জগৎ-ঈশ্বর।।
কেহ তাঁরে ব্রহ্মা বলি করে উপাসন।
কেহ নারায়ণ বলি করয়ে ভজন।।
হয়েছেন তিনি লোকে সম্প্রতি প্রকট।
সাধিতে ভক্তের সুখ নাশিতে সঙ্কট।।
সময়-নির্ব্বন্ধ নাহি তাঁহার ভজনে।
করিবে তখনি, যবে ইচ্ছা হবে মনে।।
সেই ত তাঁহাতে ভক্তি হেন গুণ ধরে।
ইচ্ছা হবামাত্র সংসারের ত্যজ্য করে।।
তুমিত ত্যজিয়া আসিয়াছ বন্ধুজনে।
ইথে জানিতেছি ইচ্ছা হইয়াছে মনে।।
অতএব সংশয় করহ কি কারণ।
যাহ যাহ কর গিয়া শ্রীরামে সেবন।।
যাঁরে মোরা ধ্যান করি দেখি মনোরথে।
তিনি ভাগ্যগুণে রয়েছেন নেত্রপথে।।
ইহাতে সাক্ষাৎ দেখা-সুখ পরিহরি।
কেন ক্লেশ পাইবে অন্যত্র ধ্যান করি।।
এ লাগিয়া কহিতেছি আমি বার বার।
যাহ রাম নিকটেতে ত্যজিয়া বিচার।।
তবে যে বলিলে গালি দিবে লোকাবলী।
বিষাদ সময়ে বন্ধু ত্যাগ কৈল বলি।।
এ কথা ত কভু শুনিবার যোগ্য নয়।
ভকতি জন্মিলে কেবা কোথা গৃহে রয়।।
তাহে প্রভু রয়েছেন প্রকট হইয়া।
কিরূপে থাকিবে তাঁরে নেত্রে না দেখিয়া।।
আর দেখ রতি জন্মে যাঁহার ভজনে।
সেহ ত্যাগ করে গুণবান্ বন্ধুজনে।।
রাম-সেবা লাগি ত্যাজি দুষ্ট বন্ধুজন।
তুমিহ কিরূপে হবে নিন্দার ভাজন।।
বরঞ্চ তোমার এত যশ ত্রিভুবনে।
গান করিবেক সর্ব্ব স্থানে বিজ্ঞ-জনে।।
আর সে কহিলে যদি রাজ্য দেন রাম।
তবে দোষ ঘুষিবে সংসারে অবিরাম।।
এ কথাও উচিত না হয় শুনিবার।
যে হেতু রাজ্যের আশা নাহিক তোমার।।
যদি তুমি রাজ্য পাব বলিয়া যাইতে।
বরঞ্চ তোমারে তবে পারিত নিন্দিতে।।
তিনি যদি বলে রাজা করেন তোমারে।
ইথে কেন অপযশ গাইবে সংসারে।।
দেখ দেখি বধ করি প্রহ্লাদ-পিতারে।
নৃসিংহ প্রহ্লাদে রাজা কৈল বলাৎকারে।।
ইথে তাঁর বিগান করয়ে কোন্ জন।
বরঞ্চ করয়ে সবে যশঃ প্রশংসন।।
তাই বধ করি দশাননে শার্ঙ্গপাণি।
রাজ্য দিবে তোমা তাহে কি দোষ না জানি।।
মিতা যে কহিলা বধিবারে দশাননে।
তাহাতেও কোন দোষ নাহি লয় মনে।।
শান্ত ধর্ম্মনিষ্ঠ যাবতীয় মুনিগণ।
তাঁহারও দুষ্ট-বধে করে আয়োজন।।
দেখ বেণ নামে রাজা অধার্ম্মিক ছিল।
মুনিগণ তারে নানামতে শিখাইল।।
সেই যবে না শুনিল তাঁদের বচন।
হুঙ্কারে করিলা তারে তাঁহারা নিধন।।
তুমিও রাবণ বধে কর আয়োজন।
না হইবে কোনমতে অধর্ম্ম-ভাজন।।
তাহে পুনঃ হবে ইথে রাম উপকার।
জন্মিবে রামের প্রীতি সংসারের সার।।
রাম লাগি যদি কেহ করে পাপকর্ম্ম।
সেই হয় সর্ব্বাশাস্ত্রে সিদ্ধ মহাধর্ম্ম।।
অতএব সকল সংশয় পরিহরি।
যাহ রাম নিকটেতে তুমি ত্বরা করি।।
রামকার্য্য সাধ গিয়া করি প্রাণপণ।
তরিবে সকল দুঃখ পাবে প্রেমধন।।
মহেশের মুখে শুনি এতেক বচন।
অতি আনন্দিত চিত্ত হৈলা বিভীষণ।।
অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হইল নয়ন।
গদগদ ভাবেতে করেন নিবেদন।।
প্রভু অনুগ্রহ দৃষ্টি বলেতে তোমার।
সকল সংশয় নষ্ট হইল আমার।।
জানিতেছি কৃতার্থ যে করিলে আমারে।
আজ্ঞা দাও যাই এবে রামে দেখিবারে।।
এত কহি মহেশের অনুজ্ঞা লইয়া।
প্রদক্ষিণ কৈল তাঁরে ভকতি করিয়া।।
পুনঃ পুনঃ প্রণাম করেন পঞ্চাননে।
সুন্দরাকাণ্ডের গীত কবিবর ভণে।।