৩০. বিভীষনের বক্ষঃস্থলে রাবণের পদাঘাত

এত যদি বিভীষণ রাবণেরে বলে।
কুপিয়া রাবণ রাজা অগ্নি হেন জ্বলে।।
বিভীষণ মম জ্যেষ্ঠ, আমি ত কনিষ্ঠ।
আমি অধর্ম্মিষ্ঠ বড়, সে বড় ধর্ম্মিষ্ঠ।।
মানুষ বেটার ভয়ে কাঁপে বিভীষণ।
হেন ভাই না রাখিব আপন ভবন।।
বিভীষণে দূর কর যুক্তি করি সার।
যুদ্ধ বিনা গতি নাই কিসের বিচার।।
এত যদি ক্রোধ করি বলিল রাবণ।
আরবার বলিতেছে সাধু বিভীষণ।।
নিশাচর রাজ তব যথা জ্ঞান বল।
কহিলে তাহারি যোগ্য বচন সকল।।
প্রকটেও ঈশ্বরে না চিনে অজ্ঞ-জন।
অন্ধ যেন জানিতে না পারয়ে রতন।।
রহিয়াছে চক্ষু কিন্তু দেখিতে না পায়।
পেচক যেমন সূর্য্যমণ্ডলে দিবায়।।
ইহাতেও নাহি মানি তোমার দূষণ।
যে হেতু নিজেরে প্রভু করয়ে গোপন।।
প্রণাম করি যে তাঁর শকতি মায়ায়।
নয়ন আগেও সেই ঢাকি রাখে তায়।।
থাকুক সে সব কথা এখন তোমারে।
কহি আমি না মজাও তুমি আপনারে।।
আনিয়াছ সীতা কাল-ভুজঙ্গিণী ঘরে।
রাখিলে সসৈন্যে যাবে শমন নগরে।।
এ হেন সুন্দর রাজ্য এ হেন সম্পদ।
নিজ দোষে কেন আনি ঘটাও বিপদ।।
চিরকাল তপ করি পেয়েছ এ রাজ্য।
কিছুকাল ভোগ কর ছাড়িয়া অন্যায্য।।
যদি কহ তুমি কেন কহ কুবচন।
তার অভিপ্রায় কহি করহ শ্রবণ।।
জিজ্ঞাসিলে মন্ত্রণা কহিতে হয় হিত।
অন্যথা কহিলে হয় পাপ উপস্থিত।।
অতএব কহিতেছি তব হিত কথা।
কদাচিৎ ইহা নাহি করহ অন্যথা।।
ধার্ম্মিক শ্রীরাম দেখ সর্ব্বলোকে কয়।
অধার্ম্মিক সঙ্গে থাকা জীবন সংশয়।।
দেখ এক হস্তী প্রবেশিলে বনে।
সকলের ক্ষতি করে ক্ষমা নাহি মানে।।
ক্ষেত্রের শস্যাদি খায় ঘর দ্বার ভাঙ্গে।
খাদ্যলোভে পোষা হস্তী মিলে তার সঙ্গে।।
দুষ্টের সঙ্গেতে হয় শিষ্টে অপরাধ।
হস্তীর বন্ধন হেতু উপযুক্ত ব্যাধ।।
স্বভাবেতে ব্যাধজাতি জানে নানা সন্ধি।
শতহাত দড়ি দিয়া হস্তী করে বন্দী।।
যেখানেতে হস্তী সব চরে নিরন্তর।
ভক্ষ্য-দ্রব্য উপহার রাখয়ে বিস্তর।।
খাইবার লোভে হস্তী গলা বাড়াইল।
গলায় লাগিয়া দড়ি সবাই পড়িল।।
দুষ্টের মিশালে হয় শিষ্টের বন্ধন।
সেইমত তব পাপে মজে পুরীজন।।
যেইমাত্র এই কথা কহে বিভীষণ।
মহাকোপে উন্নত্ত হইল দশানন।।
দন্ত কড়মড় করি ছাড়িয়া হুঙ্কার।
বিকট নিনাদে কহিতেছে আরবার।।
একি একি একি রে দুর্ম্মতি বিভীষণ।
ধরিয়াছে বুঝি তোর চিকুরে শমন।।
চৌদ্দ চতুর্যুগ হৈল আমার জনম।
ইতিমধ্যে শুনি নাই হেন দুর্ব্বাচন।।
করিয়াছি কলহ ইন্দ্রাদি দেব সনে।
কেহ পারে নাই কহিবারে কুবচনে।।
তাহা শুনাইলি তুই ক্ষুদ্র হয়ে মোরে।
কিন্তু তার ফল এই দেখাই তোমারে।।
এত কহি খরতর খড়্গ করি করে।
লম্ফ দিয়া পড়িলেন ভূতল উপরে।।
তার পদাঘাতে লঙ্কা করে টলমল।
ক্রোধ দেখি অতি ভীত রাক্ষস সকল।।
তবে সেই দশানন মহাবেগে চলে।
পদাঘাত কৈলা বিভীষণ-বক্ষঃস্থলে।।
বিভীষণ অচেতন হইয়া তাহায়।
পড়িল ধরণীতলে ছিন্ন তরুপ্রায়।।
তাহা দেখি যাবতীয় নিশাচরগণ।
হাহাকার করে সবে অতি দুঃখী মন।।
তাহা দেখি দেবগণ আর সুরপতি।
পরস্পর কহিতেছে এ সব ভারতী।।
বিভীষণ-অঙ্গে করি চরণ-অর্পণ।
গেল গেল গেল এবে নিশ্চয় রাবণ।।
বরঞ্চ সহেন রাম নিজ তিরস্কার।
ভক্ত-অপমান সহ্য না হয় তাঁহার।।
এখানে প্রহস্ত উঠি ধরি দশাননে।
সান্ত্বনা করিয়া বসাইল সিংহাসনে।।
হস্ত হইতে কাড়িয়া লইল খড়্গখান।
কোষে আচ্ছাদিয়া রাখিলেন অন্য স্থান।।
বিভীষণ-মন্ত্রী চারিজন নিশাচর।
তুলি বসাইল তাঁরে আসন উপর।।
ক্ষণকাল পর্য্যন্ত তাবৎ সভাজন।
রহিলা নিঃশব্দ হয়ে পুত্তলী যেমন।।