২৪. হনুমান কর্ত্তৃক লঙ্কা-দাহন

পর্ব্বত প্রমাণ ছিল সেই হনুমান।
ঘুচাইতে বন্ধন সে নেউল প্রমাণ।।
রাক্ষসের হাতে রহে সকল বন্ধন।
মাথা গুঁজি বাহিরায় পবন-নন্দন।।
হনুমানে বেড়ি ছিল যতেক রাক্ষসে।
তাহার বিক্রম দেখি পলায় তরাসে।।
হাতে গাছ হনুমান যায় রড়ারড়ি।
গাছের বাড়িতে মারে পাঁচ শত কুড়ি।।
কার প্রাণ লয় মারি লাঙ্গুলের বাড়ি।
লেজের অগ্নিতে কারো দগ্ধে গোঁপ দাড়ি।।
পলায় রাক্ষস সব উলটি না চাহে।
হাতে গাছ হনুমান রাজদ্বারে রহে।।
মহাবীর হনুমান চারিদিকে চায়।
লঙ্কাপুরী পোড়াইতে চিন্তিল উপায়।।
সব ঘর জ্বলে যেন রবির কিরণ।
হেন ঘরে অগ্নি বীর করে সমর্পণ।।
মেঘেতে বিদ্যুৎ যেন লেজে অগ্নি জ্বলে।
লাফ দিয়া পড়ে বীর বড় ঘরের চালে।।
পুত্রের সাহায্য হেতু বায়ু আসি মিলে।
পবনের সাহায্যে দ্বিগুণ অগ্নি জ্বলে।।
ঊনপঞ্চাশৎ বায়ু হয় অধিষ্ঠান।
ঘরে ঘরে লাফ দিয়া ভ্রমে হনুমান।।
এক ঘরে অগ্নি দিতে আর ঘর জ্বলে।
কে করে নির্ব্বাণ তার কেবা কারে বলে।।
অগ্নিতে পুড়িয়া পড়ে বড় ঘরের চাল।
অর্দ্ধেক স্ত্রী পুরুষের গায়ের গেল ছাল।।
উলঙ্গ উন্মত্ত কেহ পলায় উভরড়ে।
লেজে জড়াইয়া ফেলে অগ্নির উপরে।।
ছোট বড় পুড়িয়া মরিল এককালে।
রাক্ষস মরিল কত স্ত্রী লইয়া কোলে।।
কেহ বা পুড়িয়া মরে ভার্য্যা পুত্র ছাড়ি।
কাহারো মাকুন্দ মুখ, দগ্ধ গোঁপদাড়ি।।
লঙ্কা মধ্যে সরোবর ছিল সারি সারি।
তাহাতে নামিল যত রাক্ষসের নারী।।
সুন্দর নারীর মুখ নীরে শোভা করে।
ফুটিল কমল যেন সেই সরোবরে।।
দূরে থাকি দেখে হনুমান মহাবল।
লেজের অগ্নিতে তার পোড়ায় কুন্তল।।
সর্ব্বাঙ্গ জলের মধ্যে জাগে মাত্র মুখ।
অগ্নিতে পোড়ায় মুখ দেখিতে কৌতুক।।
ত্রাসে ডুব দিল যদি জলের ভিতরে।
জল পিয়া ফাঁপর হইয়া সবে মরে।।
স্ত্রীবধ করিয়া ভাবে পবন-নন্দন।
বধিলাম তিন লক্ষ নারীর জীবন।।
রত্নেতে নির্ম্মিত ঘর অতি মনোহর।
লেখাজোখা নাই যত পোড়ে রাজঘর।।
পর্ব্বত প্রমাণ অগ্নি চতুর্দ্দিকে বেড়ে।
হস্তী অশ্ব পোষাপক্ষী তাহে কত পোড়ে।।
কৌতুকেতে রাবণ ময়ূর পক্ষী পোষে।
লেজ পোড়া গেল, সে পেখম ধরে কিসে।।
স্বর্ণময়ী লঙ্কাপুরী তিলেকেতে পোড়ে।
রাজঘর পত্রঘর কিছু নাহি এড়ে।।
অন্য অন্য ঘর বীর পোড়ায় সকল।
বাঁচে কুম্ভকর্ণ বিভীষণের কেবল।।
ব্রহ্মাবরে বিভীষণের গৃহ নাহি পোড়ে।
কুম্ভকর্ণ-গৃহ বাঁচে গাছের আওড়ে।।
গৃহমধ্যে কুম্ভকর্ণ নিদ্রায় কাতর।
ঘরে অগ্নি লাগিলে মরিত নিশাচর।।
যুদ্ধ করি মরিবারে নির্ব্বন্ধ যে আছে।
তেঁই অন্য ঘর পোড়ে তার ঘর বাঁচে।।
সব লঙ্কা পোড়াইয়া করে ছারখার।
লঙ্কার সকল প্রাণী করে হাহাকার।।
হনুমান বলে সীতা করে হাহাকার।
হনুমান বলে সীতা হইল বিনাশ।।
হিতে বিপরীত করি একি সর্ব্বনাশ।
চতুর্দ্দিকে অগ্নি জ্বলে মরে সব প্রাণী।।
রক্ষা না পাইল বুঝি রামের ঘরণী।
কি করিনু ধিক্ ধিক্ আমার জীবনে।
বল বুদ্ধি বিক্রম আমার অকারণে।।
এই সীতা হেতু আমি পারাবার তরি।
হেন সীতা পোড়াইব কেন প্রাণ ধরি।।
কোন্ কর্ম্ম করি পোড়াইব লঙ্কাপুরী।
সেবক হইয়া পোড়াই রামের সুন্দরী।।
ত্রিভুবনে অপযশ রহিল আমার।
রক্ষা কর মায়ে মোর দেব দয়াধার।।
সাগরেতে কিম্বা করি আগুনে প্রবেশ।
এখানে মরিব আমি না যাইব দেশ।।
দেবগণ ডাকি বলে হনুমান শুনে।
সীতাদেবী রক্ষা পায় না পোড়ে আগুনে।।
তুমি লঙ্কা দগ্ধ কর মনের হরিষে।
ভস্ম করি ফেল লঙ্কা রাখিয়াছ কিসে।।
দেববাক্যে বানর সাহসে করি ভর।
লাফে লাফে পোড়াইল শত শত ঘর।।
পুড়িয়া মারিল যত রাক্ষস রাক্ষসী।
কৃত্তিবাস রচে লঙ্কা হয় ভস্মরাশি।।