২৩. রাবণের নিকট হনুমানের পরিচয় দান ও রাবণ কর্ত্তৃক তাহার দণ্ডবিধান

দশানন বলিছে তোমার নাহি ডর।
সত্য করি কহ রে কাহার তুমি চর।।
স্বরূপেতে কহ যদি খসাব বন্ধন।
মিথ্যা যদি কহ তবে বধিব জীবন।।
হনুমান বলে, আমি শ্রীরামের দূত।
ভাঙ্গিলাম তোমার সে কানন অদ্ভুত।।
বন্ধন মানিনু তোমা দেখিবার মনে।
শ্রীরামের কথা কহি শুন সাবধানে।।
সবে শুনিয়াছ দশরথ মহীপতি।
জ্যেষ্ঠপুত্র রাম, তাঁর বধূ সীতা সতী।।
অগোচরে রাবণ হরিলে তুমি সীতে।
সুগ্রীবের মিত্রভাব তোমা অন্বেষিতে।।
যে বালি রাজার স্থানে তব পরাজয়।
হেন বালি মারিলেন রাম মহাশয়।।
তোর ব্রহ্ম-অস্ত্র মোর কি করিতে পারে।
বন্ধন মানিনু কিছু বলিবার তরে।।
রাম সুগ্রীবের যুক্তি আমি তাহা জানি।
কুম্ভকর্ণে আর তোরে বধিবেন তিনি।।
ইন্দ্রজিতে মারিবেন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
আর যত রাক্ষসে মারিবে কপিগণ।।
এই সত্য করিলেন সুগ্রীবের আগে।
আমি তোরে মারিলে তাঁহার সত্য ভাঙ্গে।।
মোর আগে ধরিয়াছ নব ছত্র দণ্ড।
লাঙ্গুলের বাড়িতে করিব খণ্ড খণ্ড।।
লইয়া যাইব তোরে গলে দিয়া দড়ি।
দশ মুণ্ড ভাঙ্গিব মারিয়া এক নড়ি।।
এতেক বলিল যদি পবন-নন্দন।
বানরে কাটিতে আজ্ঞা করে দশানন।।
কাট কাট বলি ঘন ডাকিছে রাবণ।
মাথা নোয়াইয়া বলে ভাই বিভীষণ।।
দূতকে কাটিলে রাজা বড় অনাচার।
আজি হৈতে ঘুচিবে দূতের ব্যবহার।।
আত্মকথা পরকথা দূত-মুখে শুনি।
কাটিতে এমন দূত অনুচিত বাণী।।
পরের বড়াই করে অপরাধী কিসে।
যার বড়াই করে তারে মারিতে আইসে।।
দূতের এক শাস্তি আছে মুড়াইতে মুণ্ড।
ইহা ভিন্ন দূতের নাহিক অন্য দণ্ড।।
এই যুক্তিবলে হনু পাইল জীবন।
লেজ-পোড়াইতে আজ্ঞা করিছে রাবণ।।
লেজ-পোড়াইয়া এরে পাঠাও সে দেশে।
লেজ পোড়া দেখি যেন জ্ঞাতি বন্ধু হাসে।।
এই আজ্ঞা করিলেন রাজা লঙ্কেশ্বর।
লেজ পোড়াইতে সবে আইল সত্বর।।
কুপিত হইল বীর পবন-নন্দন।
বাড়াইয়া দিল লেজ পঞ্চাশ যোজন।।
লেজ দেখি রাবণের হৈল বড় ডর।
ধর ধর ডাক ছাড়ে রাজা লঙ্কেশ্বর।।
হয়েছিল যে দুঃখ বালির লেজ টেনে।
লেজ দেখি রাবণের তাহা পড়ে মনে।।
তিন লক্ষ রাক্ষস চাপিয়া লেজ ধরে।
সবে মেলি লেজ ফেলে ভূমির উপরে।।
ত্রিশ মণ বস্ত্র সবে আনিল নিকটে।
এত বস্ত্র আনে এক বেড় নাহি আঁটে।।
লঙ্কার মধ্যেতে ছিল যতেক কাপড়।
ঘৃত তৈল দিয়া তাহা করিল জাবড়।।
কাপড় তিতিল, লেজ পড়িল ভূতলে।
লেজে অগ্নি দিতে সব দব্ দবাতে জ্বলে।।
লেজে অগ্নি দিল দেখি হনুমান হাসে।
আপন বুদ্ধিতে বেটা পড়ে সর্ব্বনাশে।।
জানকীর বরে অগ্নি নাহি লাগে গায়।
লেজে অগ্নি দিতে বীর চারিদিকে চায়।।
রাবণ বলিছে দুষ্ট কপি মহাবীর।
ইহারে ঝটিতি কর প্রাচীর বাহির।।
কুলি কুলি লৈয়া বেড়াও চাতরে চাতর।
স্ত্রী পুরুষ দেখে যেন লঙ্কার ভিতর।।
লেজে অগ্নি দিলেক কাঁকালে দিল দড়ি।
দেখিবারে সকলে আইল তাড়াতাড়ি।।
কেহ বলে স্বামী মৈল সংগ্রাম ভিতর।
কেহ বলে মরিল আমার সহোদর।।
কেহ বলে পড়িল বান্ধব বন্ধু জ্ঞাতি।
কেহ বলে পুত্র মোর পড়ে যোদ্ধৃপতি।।
ইষ্ট বন্ধু কুটুম্ব মারিল সবাকারে।
জর্জ্জর হইল সবে ইহার প্রহারে।।
ইটলি পাটাল মারে যে দেখে ডাগর।
শেল শূল মারে আর লোহার মুদগর।।
হনুমানে দেখিয়া সকলে কাঁপে ডরে।
ইহারে কে ধরে আমা সবার ভিতরে।।
ভাগ্যেতে ইহার ঠাঁই পাইনু নিস্তার।
দেখিবামাত্রেতে সব করিবে সংহার।।
শুনিয়া সবার যুক্তি বানরের হাস।
এখন যাইবি কোথা করি সর্ব্বনাশ।।
কুলি কুলি লৈয়া ফিরে নগরে নগর।
চেড়ী সব বার্ত্তা কহে সীতার গোচর।।
যে বানর সঙ্গে তুমি কহিলে কাহিনী।
লেজে অগ্নি গলে দড়ি করে টানাটানি।।
বার্ত্তা শুনি সীতাদেবী মৃত্যু হেন গণে।
অগ্নি জ্বালি পূজে সীতা বিবিধ বিধানে।।
কায়মনোবাক্যে যদি আমি হই সতী।
তবে তব ঠাঁই হনু পাবে অব্যাহতি।।
অগ্নি পূজি সীতাদেবী করিছে ক্রন্দন।
জানকীরে ডাক দিয়া বলে দেবগণ।।
ব্রহ্মা বলিলেন, ওগো শুন দেবি সীতে।
বানরের জন্যে তুমি না হও চিন্তিতে।।
তোমার বরেতে তার কারো নাহি শঙ্কা।
এখনি যে হনুমান পোড়াইবে লঙ্কা।।
কৌতুক দেখিতে আইলাম দেবগণ।
হরিষে বিষাদ তুমি কর কি কারণ।।
ক্রন্দন সম্বরে সীতা ব্রহ্মার আশ্বাসে।
রচিল সুন্দরাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাসে।।