২২. ইন্দ্রজিৎ কর্ত্তৃক হনুমানের বন্ধন

শুনিয়া রাবণ রাজা লাগিল ভাবিতে।
যুঝিবারে কহিল কুমার ইন্দ্রজিতে।।
বড় বড় বীর যায় করিয়া গর্জ্জন।
বাহুড়িয়া না আইসে আমার সদন।।
অদ্যকার যুদ্ধে যাহ বাছা ইন্দ্রজিৎ।
তোমরা থাকিতে আমি যাই অনুচিৎ।।
পিতৃবাক্য শুনি বীর ইন্দ্রজিৎ ভাষে।
বানরে করিব বন্দী চক্ষুর নিমিষে।।
কি ছার বানর বেটা আমি মেঘনাদ।
যুদ্ধ জিনি আজি লব রাজার প্রসাদ।।
অঙ্গুলে অঙ্গুরী দিল বাহুতে কঙ্কণ।
সর্ব্বাঙ্গে পরিল বীর রাজ-আভরণ।।
স্বর্ণ নবগুণ পরে, পরে স্বর্ণপাটা।
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন কপালের ফোঁটা।।
এক হাতে ধরিয়াছে সর্ব্বাঙ্গ দাপনি।
আর হাত সারথিরে ডাকিছে আপনি।।
সারথি আনিল রথ সংগ্রামে অটল।
সাজাইল রথখান করে ঝলমল।।
কনক রচিত রথ বিচিত্র নির্ম্মাণ।
বায়ুবেগে অষ্ট ঘোড়া রথের যোগান।।
মাতঙ্গ বিংশতি কোটি তার অর্দ্ধ ঘোড়া।
তের অক্ষৌহিণী চলে ত্রিভুবন যোড়া।।
কটকের পদভরে কাঁপিছে মেদিনী।
রণবাদ্য বাজে কত, স্বর্গে লাগে ধ্বনি।।
এত সৈন্য লয়ে বীর চলিল সত্বর।
পাছে হৈতে ডাক দিয়া বলে লঙ্কেশ্বর।।
বালি সুগ্রীবের শুনিয়াছ যে কাহিনী।
তার পাত্র হনুমান সর্ব্বলোক জানি।।
সেই বা আসিয়া থাকে বীর-অবতার।
তুচ্ছ জ্ঞান না করিহ, যুঝিও অপার।।
পিতৃবাক্য শুনি বীর ইন্দ্রজিৎ হাসে।
বানরে বধিব আজি দেখ অনায়াসে।।
বসিয়াছে হনুমান প্রাচীর উপর।
সৈন্যসহ ইন্দ্রজিৎ গেলেন সত্বর।।
দেখি হনুমানের সে জ্বলিলেক কোপে।
গালাগালি পাড়ে বীর অতুল প্রতাপে।।
লতা পাতা খাইস্ বেটা পরিস্ কাছুটি।
মরিবারে হেথা আসি করিস্ ছটফটি।।
সুগ্রীবের কাল গেল ভ্রমি ডালে ডালে।
মরিবারে কি কারণে লঙ্কায় আইলে।।
রাক্ষসের গালি শুনি হনুমান হাসে।
গালাগালি পাড়ে বীর মনে যত আসে।।
ফল মূল খাই মোরা মুনি-ব্যবহার।
ডালে ডালে ভ্রমি যে, সে নহে অনাচার।।
আপনার অনাচার না দেখ আপনি।
রাবণের অনাচার ত্রিভুবনে শুনি।।
নারী দশ হাজার যদ্যপি আছে ঘরে।
তথাপি সে তোর বাপ পরদার করে।।
সতী স্ত্রী হরিয়া আনে যতি-তপস্বিনী।
শাপ গালি পাড়ে, তবু না ছাড়ে ব্রাহ্মণী।।
স্ত্রী লাগি পুরুষ মারে বিনা অপরাধে।
ব্রাহ্মণী হরিয়া আনে শৃঙ্গারের সাধে।।
করিলেক কত শত ব্রহ্মহত্যা পাপ।
অন্ত নাহি পাপ করে যত তোর বাপ।।
ত্রিভুবনে তোর যে বাপের বিসম্বাদ।
কতকাল থাকে আর পড়িল প্রমাদ।।
সর্ব্বদা না ফলে বৃক্ষ সময়েতে ফলে।
তোর বাপের ব্রহ্মশাপ ফলে এতকালে।।
এইরূপে দুইজনে হয় গালাগালি।
তার পর যুদ্ধ করে দোঁহে মহাবলী।।
নানা অস্ত্র ইন্দ্রজিৎ করে বরিষণ।
সব অস্ত্র লুফে ধরে পবন-নন্দন।।
হনুমান বলে বেটা তোর রণ চুরি।
দেখ তোরে আজিকে পাঠাব যমপুরী।।
জিনিতে না পারে কেহ উভয়ে সোসর।
দুই জনে যুদ্ধ করে দুইটি প্রহর।।
ইন্দ্রজিৎ বলে আমি পাশ-অস্ত্র জানি।
পাশ অস্ত্র ছাড়িয়া বানর বান্ধি আনি।।
রণেতে পণ্ডিত বীর জানে নানা সন্ধি।
এড়িলেন পাশ-অস্ত্র হনু হয় বন্দী।।
প্রাচীর হইতে বীর পড়িয়া ভূতলে।
ভাবে পারি পাশ-অস্ত্র ছিঁড়িবারে বলে।।
পাশ-অস্ত্র ছিঁড়িবারে নাহি লয় মনে।
রাবণের সঙ্গে দেখা করিব কেমনে।।
এতেক বলিয়া বীর পাশ নাহি ছিণ্ডে।
রাক্ষসে টানিয়া বান্ধে হাতে গলে মুণ্ডে।।
কেহ হাতে পায়ে বান্ধে, কেহ বান্ধে গলে।
গলা টানি বান্ধে কেহ লোহার শিকলে।।
রাক্ষসেরে আজ্ঞা দিল বীর ইন্দ্রজিৎ।
বাপের আগেতে লহ বানরে ত্বরিত।।
এত বলি ইন্দ্রজিৎ গেল আগুয়ান।
বড় বড় বীর গিয়া বেড়ে হনুমান।।
কোপে তোলপাড় করে হনু যথোচিত।
সত্তর যোজন বীর হয় আচম্বিত।।
সাত লক্ষ রাক্ষসেরা টানাটানি করে।
তথাপি তাহার এক রোম নাহি নড়ে।।
দেখি হনুমানের সে বিক্রম বিশাল।
চমৎকার হইলেক রাক্ষসের পাল।।
হনুমান বলে, তোরা বাজা রে দামামা।
রাজসম্ভাষণে যাব স্কন্ধে কর আমা।।
বড় বড় সাঙ্গী দিয়া হনুমানে বান্ধে।
দুই লক্ষ রাক্ষস তাহারে করে কান্ধে।।
রাক্ষসের কান্ধে বীর মনে মনে হাসে।
কত রঙ্গ করে বীর মনের উল্লাসে।।
যেই ভিতে হনুমান কিছু দেয় ভর।
রাখ রাখ বলি রাক্ষস উঠিয়া দেয় রড়।।
সাত লক্ষ রাক্ষসেরা টানাটানি করে।
অচল হইল হনু রাবণের দ্বারে।।
নাড়িতে না পারে তারে সবে পায় ত্রাস।
সত্বর কহিল বার্ত্তা রাবণের পাশ।।
কষ্টেতে হইল বন্দী সে দুষ্ট বানর।
না যায় শরীর তার দ্বারের ভিতর।।
হাসিয়া রাবণ তারে কহে সম্বিধান।
দ্বার ভাঙ্গি ঝাট আন দেখি হনুমান।।
রাজার আজ্ঞায় দূত আইল সত্বরে।
দ্বার ভাঙ্গি পথ করি আনিল তাহারে।।
সাত দ্বার ভাঙ্গে তারা এক দ্বার রয়।
অচল হইল হনু নাড়া নাহি যায়।।
আপন ইচ্ছায় গেল পবন-নন্দন।
পাত্র মিত্র সহ যথা বসেছে রাবণ।।
রাজার কুমারগণ বসি সারি সারি।
বসিয়াছে যেন সবে অমর-নগরী।।
চারিভিতে দেবকন্যা মধ্যেতে রাবণ।
আকাশের চন্দ্র যেন বেড়ি তারাগণ।।
রাবণ ব্রহ্মার বরে কারে নাহি গণে।
চন্দ্র সূর্য্য ভয়ে বসে রাবণ সদনে।।
তার দশ শিরে শোভা করে দশ মণি।
সম্মুখেতে পরিয়াছে সব্বাঙ্গ দাপনি।।
দেখিল বানর গিয়া রাবণ-সম্পদ।
ত্রাস পাইয়া হনুমান ভাবে রাম-পদ।।
রাবণের সম্পদ দেখিয়া তার হাস।
সুন্দরাকাণ্ডেতে গীত গায় কৃত্তিবাস।।