০১. বানরগণের সাগর পার হওনের কথোপকথন

পিতা পুত্রে পক্ষিরাজ গেলেন উত্তর।
অঙ্গদ কটক সহ দক্ষিণ-সাগর।।
তর্জ্জন গর্জ্জন করে, ছাড়ে সিংহনাদ।
সাগরের ঢেউ দেখি গণিল প্রমাদ।।
তমোময় দেখা যায় গগন-মণ্ডল।
হিল্লোল কল্লোল করে সমুদ্রের জল।।
সিন্ধুজলে জলজন্তু কলরব করে।
জলেতে না নামে কেহ মকরের ডরে।।
এক এক জলজন্তু পর্ব্বত প্রমাণ।
জগৎ করিবে গ্রাস হয় অনুমান।।
সাগর দেখিয়া সবে পাইল তরাস।
সবাকারে অঙ্গদ করিতেছে আশ্বাস।।
বিষাদে বিক্রম টুটে বিষাদেতে মরি।
বিষাদ ঘুচালে ভাই সর্ব্বত্রেতে তরি।।
সুখে নিদ্রা যাও আজি সমুদ্রের কূলে।
সাগর তরিব কালি অতি প্রাতঃকালে।।
সাগরের কূল চাপি রহিল বানর।
রহিবারে পাতা লতায় সাজাইল ঘর।।
সাগরের কূলে তারা বঞ্চে সুখে রাতি।
প্রভাতে একত্র হৈল সর্ব্ব সেনাপতি।।
যোড়হাতে দাণ্ডাইল অঙ্গদের আগে।
অঙ্গদ কহিছে বার্ত্তা শুন বীরভাগে।।
দৈবদোষে লঙ্ঘিলাম রাজার শাসন।
কোন্ বীর ঘুচাইবে এ ঘোর বন্ধন।।
ব্রহ্মার হাতের সুধা ছলে কোন্ জনে।
ইন্দ্রের হাতের বজ্র কোন জন আনে।।
প্রখর সূর্য্যের রশ্মি কোন্ জন হরে।
চন্দ্রের শীতল রশ্মি কে আনিতে পারে।।
এ কর্ম্ম করিতে পারয়ে যে আকৃতি।
দেখাইয়া বিক্রম সে রাখুক খেয়াতি।।
আনিলে সীতার বার্ত্তা সবে হই সুখী।
তাহার প্রসাদে গিয়া পত্নী পুত্র দেখি।।
এত যদি বলিলেন, কুমার অঙ্গদ।
নীরব হইয়া সবে গণিল আপদ।।
ছিল যত সৈন্য সঙ্গে সামন্ত প্রচুর।
বার বার জিজ্ঞাসেন অঙ্গদ ঠাকুর।।
রাজপুত্র অঙ্গদ জিজ্ঞাসে বারে বার।
উত্তর না দাও কেন একি ব্যবহার।।
অঙ্গদের বোলে সবে সাগর নেহালে।
মহা ঢেউ উঠে পড়ে আকাশ-পাতালে।।
অঙ্গদ বলেন কেন করিছ বিষাদ।
কোন্ বীর লবে এসে রাজার প্রসাদ।।
কোন্ বীর সুগ্রীবে সত্যে করিবে পার।
কোন্ বীর করিবে রামের উপকার।।
কোন্ বীর করিবে জ্ঞাতির অব্যাহতি।
সীতা অন্বেষিয়া আজি রাখহ খেয়াতি।।
অঙ্গদের বচন লঙ্ঘিতে কেহ নারে।
আপন বিক্রম সবে কহে ধীরে ধীরে।।
গয় নামে সেনাপতি যমের নন্দন।
বলে সে ডিঙ্গাইব এ দশ যোজন।।
গবাক্ষ বানর বলে তার সহোদর।
পারি কুড়ি যোজন লঙ্ঘিতে এ সাগর।।
শরভ নামেতে বলে মুখ্য সেনাপতি।
চল্লিশ যোজন লঙ্ঘি আমি শরিৎপতি।।
তার সহোদর বলে সে গন্ধমাদন।
আমি লঙ্ঘিবারে পারি পঞ্চাশ যোজন।।
মহেন্দ্র বানর বলে সুষেণ-কুমার।
লঙ্ঘিবারে পারি ষাটি যোজন সাগর।।
দেবেন্দ্র তাহার ভাই বলে এই সার।
সত্তরি যোজন লঙ্ঘি আমি পারাবার।।
পুত্র বিশ্বকর্ম্মার বলিছে মহাবীর।
অশীতি যোজন লঙ্ঘি সাগর গভীর।।
অগ্নিপুত্র কপি বলে বীর অবতার।
নবতি যোজন লঙ্ঘি সাগর পাথার।।
তারক বানর বলে রাজার ভাণ্ডারী।
দ্বি-নবতি যোজন যে লঙ্ঘিবারে পারি।।
ব্রহ্মপুত্র ভল্লুক করিয়া অনুমান।
হাসিয়া উত্তর করে মন্ত্রী জাম্বুবান।।
যৌবন কালের বল টুটয়ে বার্দ্ধক্যে।
যৌবন কালের কথা শুনহ কৌতুকে।।
বলিরে ছলিতে হরি হইয়া বামন।
তিন পায়ে জুড়িলেন এ তিন ভুবন।।
পৃথিবীতে যত বীর আছিল প্রবীণ।
তারা সবে তাঁর পায়ে করে প্রদক্ষিণ।।
জটায়ু পক্ষীর সঙ্গে উড়িয়া অপার।
বিষ্ণুপদ প্রদক্ষিণ করি তিনবার।।
পূর্ব্বে যেই শক্তি ছিল টুটিল এখন।
তথাপি লঙ্ঘিব পঞ্চ-নবতি যোজন।।
লঙ্ঘিলে যোজন পাঁচ ভাবি আমি লাজ।
এত যদি বলিলেন মন্ত্রী জাম্বুবান।
অভিমানে জ্বলে মহাবীর হনুমান।।
কহেন অঙ্গদ-বীর অঙ্গ কোপে জ্বলে।
সাগর তরিতে পারি আপনার বলে।।
এক লাফে স্বর্ণপুরী পড়ি গিয়া লঙ্কা।
আসিবারে নাহি পারি তাহা করি শঙ্কা।।
ভোগে রাখিলেন পিতা না দিলেন শ্রম।
তেকারণে নাহি জানি, আপন বিক্রম।।
সাগর তরিতে কেবা আছে সেনাপতি।
দেখাইয়া বিক্রম রাখহ নিজ খ্যাতি।।
অঙ্গদের কথা শুনি জাম্বুবান হাসে।
বীর তুমি, হেন কথা কহ কি আভাসে।।
বালির বিক্রম বাপু ত্রিভুবনে জানে।
তাহার হইতে তব বিক্রম বাখানে।।
একবার কোন্ কথা, তুমি শতবার।
আসিতে যাইতে পার সাগরের পার।।
রাজা হয়ে কেন হে করিবে এত শ্রম।
তুমি গেলে কটকের না রবে জীবন।।
তুমি কটকের মূল মোরা সব ডাল।
সে মূল থাকিলে ফল পাবে সর্ব্বকাল।।
ঝড়ে বৃক্ষ ভাঙ্গিলে পল্লব নাহি রয়।
যদি মূল থাকে পত্র পুনরায় হয়।।
কার উপকার না করিল তব বাপ।
কোন্ বীর লঙ্ঘিবেক তোমার প্রতাপ।।
সকল বানর তব ঘরের সেবক।
সকলে হইবে তব কার্য্যের সাধক।।
বসি আজ্ঞা কর তুমি বানরের রাজ।
সেবক হইতে তব সিদ্ধ হবে কাজ।।
অঙ্গদ বলেন ধীরে কি করি েইহার।
সাগর তরিতে কেহ না করে স্বীকার।।
সাগর লঙ্গিতে পারি আসিতে সংশয়।
বিলম্ব হইলে করি সুগ্রীবের ভয়।।
সংশয় জীভন মম নিশ্চয় মরণ।
সাগর লঙ্ঘিব আমি দেখ বীরগণ।।
সকল বানর কহে করি যোড়হাত।
তুমি কেন লঙ্ঘিবে হে বানরের নাথ।।
রাজপুত্র রাজা তুমি বাসবের নাতি।
নিজে মহামতি তুমি বুদ্ধে বৃহস্পতি।।
ভুলিয়াছি বালিকে যে তোমা দরশনে।
এক তিল নাহি বাঁচি তোমার বিহনে।।
জাম্বুবান বলে ছাড় জঞ্জাল বচন।
যে সাগর লঙ্ঘিবে তা করহ শ্রবণ।।
অভিমানে মৌনভাবে বীর হনুমান।
কটকের মধ্যে আছে নকুল প্রমাণ।।
কটকেতে হনুমানে কেহ নাহি দেখে।
জাম্বুবান কহিতেছে দেখিয়া তাহাকে।।
কার মুখ চাহ তুমি বীর হনুমান।
আমার বচন বাছা কর অবধান।।
হনুমান জাম্বুবান উভয়ে সম্ভাষ।
সুন্দরাকাণ্ডেতে গীত গায় কৃত্তিবাস।।