২৯. শ্রীরামের বৃত্তান্ত কথনে সম্পাতির পক্ষলাভ

হনুমান বলে শুন গরুড়-নন্দন।
মন দিয়া শুন বলি রামের কথন।।
পূর্ব্বকথা কহি শুন তাতে দেহ মন।
নারদের সঙ্গে যুক্তি কৈল নারায়ণ।।
সৃষ্টি করিলেন পিতামহ বহু ক্লেশে।
ভাবেন সতত লোক ত্রাণ পাবে কিসে।।
নারদেরে বিরিঞ্চি পাঠান পৃথিবীতে।
আপনার পুত্রকে দিলেন তার সাথে।।
দুইজন পৃথিবীতে বেড়ান-ভ্রমিয়া।
দৈবাৎ নিবিড় বনে উত্তরিল গিয়া।।
বাল্মীকি ছিলেন পূর্ব্বে ব্যাধ-অবতার।
দস্যুবৃত্তি করিতেন অতি দূরাচার।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় শূদ্র যারে দেখা পায়।
ফাঁসি দিয়া মারে তারে কে কোথা পলায়।।
এইরূপে দস্যুকর্ম্ম করে বনে বন।
নারদের সনে হৈল পথে দরশন।।
নারদ আর বিধি তাঁরা যান দুইজনে।
হেনকালে দেখে দস্যু সে দুই ব্রাহ্মণে।।
দস্যু বলে বিপ্র তোরা আর যাবি কোথা।
পড়িলি আমার হাতে কাটা যাবে মাথা।।
নারদ বলেন, আমি তপস্বী-ব্রাহ্মণ।
আমারে মারিবে তুমি কিসের কারণ।।
দস্যু বলে নিত্য আমি এই কর্ম্ম করি।
দস্যুকর্ম্ম করিয়া উদয় সদা ভরি।।
মাতা পিতা পত্নী পুত্র আছে যত জন।
ইহাতে সবার হয় উদর পূরণ।।
অবিরত দস্যুকর্ম্ম করি আমি খাই।
তেকারণে ফাঁস হাত বনেতে বেড়াই।।
কত গণ্ডা জিতেন্দ্রিয় যতি ব্রহ্মচারী।
যার দেখা পাই, তারে সেইক্ষণে মারি।।
নারদ বলেন, শুন দুর্ব্বুদ্ধি ব্রাহ্মণ।
তোমার পাপের ভাগ লয় কোন্ জন।।
তব পাপভাগী যদি হয় পিতা মাতা।
তবেত আমারে বধ করহ সর্ব্বথা।।
জিজ্ঞাসা করহ গিয়া আপনার ঘরে।
তোমার পাপের ভাগ কাহার উপরে।।
দস্যু বলে শুন বলি তপস্বী-ব্রাহ্মণ।
আমি ঘরে গেলে কি পালাবে দুইজন।।
নারদ বলেন, রাখ গাছেতে বান্ধিয়া।
পাপভাগী কেবা হয় আইস জানিয়া।।
তবে দস্যু দুইজনে করিল বন্ধন।
গাছেতে বান্ধিয়া ঘরে করিল গমন।।
বাপেরে কহিল, তুমি ঘরে বসে খাও।
আমার পাপের ভাগ তুমি নিতে চাও।।
পিতা বলে, যাহা দেও ঘরে বসে খাব।
তুমি পাপ কর তার ভাগ কেন লব।।
যে সে প্রকারেতে তুমি করিবে পালন।
পাপ-ভাগ লইতে না পারি কদাচন।।
বাপের শুনিল যদি নিষ্ঠুর বচন।
তবে গিয়া করিল মায়ের দরশন।।
দস্যু বলে, শুন মাতা করি নিবেদন।
মনুষ্য মারিয়া করি উদর পূরণ।।
আমি আনি দেই তুমি ঘরে বসে খাও।
আমার পাপের ভাগ তুমি নিতে চাও।।
জননী বলিল, শুন দুর্ব্বুদ্ধি নন্দন।
তোমার পাপের ভাগ লব কি কারণ।।
পুত্র হৈলে করে মাতা পিতার পালন।
গয়া পিণ্ড দান করে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ।।
সুপুত্র হইলে হয় কুলের দীপক।
মাতৃসেবা না করিলে বিষম নরক।।
যাহা যাহা আনি দিবে ঘরে বসে খাব।
তোমার পাপের ভাগ আমি কেন লব।।
যত যত পুত্র জন্মে ভারত-মণ্ডলে।
পুত্র-পাপ মায়ে লয় কোন্ শাস্ত্রে বলে।।
দশ মাস দশ দিন ধরিনু উদরে।
পুত্র হইয়া ডুবাইবে নরক ভিতরে।।
মায়ের শুনিল যদি নিষ্ঠুর বচন।
পত্নীর নিকটে গিয়া কহে বিবরণ।।
দস্যুকর্ম্ম করি আমি ঘরে বসে খাও।
আমার পাপের ভাগ তুমি নিতে চাও।।
স্বামীরে বলিছে বামা বিনয় বচন।
তোমার পাপের ভাগ লব কি কারণ।।
গৃহস্থের কর্ম্ম কার্য্য সকলি করিব।
যথা হৈতে আন তুমি ঘরে বসে খাব।।
নারীর শুনিল যদি এতেক বচন।
পুত্রের নিকটে গিয়া কহিল তখন।।
শুনিয়া বলিল পুত্র পিতার চরণে।
পাতকের ভাগ লব কিসের কারণে।।
আমি উপযুক্ত যবে হইব সংসারে।
শিরে মোট বহি আমি পালিব তোমারে।।
এখন আমার কর ভরণ পোষণ।
আমি পুত্র তোমাদের করিব পালন।।
এইমত জিজ্ঞাসা করিল বারে বার।
পাপভাগ লৈতে কেহ না করে স্বীকার।।
দস্যু বলে, তবে আমি কোন্ কর্ম্ম করি।
অধর্ম্ম করিয়া কেন লোক জন মারি।।
মনে মনে দস্যু বড় হইল নিরাশ।
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধেয়ে গেল তপস্বীর পাশ।।
আস্তে ব্যস্তে খসাইল মুনির বন্ধন।
প্রণাম করিয়া বলে বিনয় বচন।।
জিজ্ঞাসিয়া ঘরে জানিলাম সমাচার।
আমার পাপের ভাগী কেহ নহে আর।।
কি করিব, কোথা যাব, কি হবে উপায়।
মুনি বলে তবে কেন বধিবে আমায়।।
তোমার পাপের ভাগী কেহ না হইল।
যত পাপ করিলে সে তোমার থাকিল।।
চৌরাশী নরক-কুণ্ড আছে যমপুরে।
রৌরব-নরক আদি সব তব তরে।।
গলায় কাপড় দিয়া যোড়হাত বুকে।
কাতরে কহিলা দস্যু মুনির সম্মুখে।।
কৃপা কর কৃপাময় ধরি হে চরণ।
কি হবে আমার গতি, কহ বিবরণ।।
আর আমি দস্যুকর্ম্ম কভু না করিব।
হইয়া তোমর দাস সঙ্গেতে ফিরিব।।
তাহারে কহেন দয়াশীল মহামুনি।
সরোবরে স্নান করি আইস এখনি।।
তোমার নিমিত্ত এক করিব উপায়।
যাহাতে হইবা মুক্ত, পাপ দূরে যায়।।
আস্তে ব্যস্তে গেল দস্যু সরোবর তীরে।
পাপী দেখি উড়িল সলিল সরোবরে।।
স্নান করিবার জল যদি না পাইল।
আরবার দস্যু সে মুনির কাছে গেল।।
যোড়হাত করিয়া বলিল হে গোঁসাই।
করিতে গেলাম স্নান জল নাহি পাই।।
আমাকে আসিতে দেখি যত ছিল জল।
শুখাইল সরোবর যথা শুষ্ক স্থল।।
শুনিয়া নারদ মুনি করিয়া আশ্বাস।
কমণ্ডলু-জল ছিল, আপনার পাশ।।
দয়া করি সেই জল দিলেন তাহায়।
সেই জল দস্যু দিল আপন মাথায়।।
ব্রহ্মাপুত্র নারদের দয়া উপজিল।
অষ্টাক্ষর মহামন্ত্র তার কর্ণে দিল।।
ব্রহ্মাপুত্র আপনি করিল আদেশন।
দিবানিশি রামনাম করহ স্মরণ।।
পরম পাতকী সে বিধাতা তারে বাম।
রামনাম বলিতে বদনে আইসে আম।।
ভাবিলেন মহামুনি কি হবে উপায়।
রামনাম বদনে নাহি যে বাহিরায়।।
সেই বনে মরা এক তালগাছ ছিল।
হেরিয়া মুনির মনে দয়া উপজিল।।
বুদ্ধিজীবী মহামুনি জিজ্ঞাসেন তায়।
বল দেখি কোন্ বৃক্ষ ঐ দেখা যায়।।
শুনিয়া কহিল দস্যু যোড় করি কর।
মরা তালগাছ এক দেখি মুনিবর।।
শুনিয়া কহেন তারে নারদ প্রবীণ।
মরা মরা মন্ত্র জপ কর রাত্রি দিন।।
প্রণাম করিয়া দস্যু মুনির চরণে।
মরা মন্ত্র জপিতে লাগিল নিশিদিনে।।
মরা মন্ত্র বিনা তার মুখে নাহি আর।
দূরে গেল দস্যুবৃত্তি সদা সদাচার।।
নারদ বলেন মন্ত্র করহ স্মরণ।
এক বৎসরের পরে আসিব দুজন।।
ইহা বলি বিদায় হইল দুইজনে।
মরা মন্ত্র জপ করে দস্যু একমনে।।
অরণ্যে নিবাস করে মরা মন্ত্র জপি।
সর্ব্বাঙ্গ ঘিরিল তার উইচাপের টিপি।।
আসিয়া দেখেন মুনি বৎসরেক পরে।
এইখানে ছিল দস্যু গেল কোথাকারে।।
ধ্যান করি দেখেন নারদ তপোধন।
ঢিপির মধ্যেতে আছে সে দুস্য ব্রাহ্মণ।।
দেবরাজে আদেশ করিলেন তপোধন।
বাসব করিল পরে বৃষ্টি বরিষণ।।
মাটি হইতে বাহির হৈল সেইক্ষণে।
একচিত্তে মরামন্ত্র জপে মনে মনে।।
আশীর্ব্বাদ করিলেন তুষ্ট তপোধন।
মুনিরে প্রণাম করে সে দস্যু ব্রাহ্মণ।।
দিব্য কান্তি হইয়া মুনিরে করে স্তুতি।
তোমার প্রসাদে পাইলাম অব্যাহতি।।
কহিলেন তারে বাক্য মুনি গুণধাম।
উলটিয়া আরবার বল রামনাম।।
কাতর হইয়া কহে যোড়হাত বুকে।
রামনাম মহামন্ত্র নিঃসরিল মুখে।।
যত পাপ ছিল তার ভৌতিক শরীরে।
রামনাম স্মরণে সকল গেল দূরে।।
রামনাম স্মরণ করিল নিরন্তর।
তপস্যা করিল দশ হাজার বৎসর।।
মন দিয়া মুন এই অপূর্ব্ব কাহিনী।
মরা মন্ত্র জপিয়া বাল্মীকি হৈল মুনি।।
নারদের উপদেশ পাইয়া সে জন।
প্রকাশ করিল সপ্তকাণ্ড রামায়ণ।।