২৮. সম্পাতির সহিত হনুমানের পরিচয় এবং শ্রীরামের বার্ত্তা কথন

গরুড়ের সন্তান বিখ্যাত পক্ষিজাতি।
বৈসে বিন্ধ্য-পর্ব্বতের শিখরে সম্পাতি।।
বানর-কটক মাথা তুলি ঊর্দ্ধে দেখে।
অনুমান করে এই খাইবে সবাকে।।
অঙ্গদ উঠিয়া বলে শুন হনুমান।
আমার বচন তুমি কর অবধান।।
সীতার উদ্দেশে আইলাম সর্ব্বজন।
সীতা লাগি হারাইব বিদেশে জীবন।।
কোন্ জন না করিল শ্রীরামের কাজ।
সীতা লাগি মরিল জটায়ু পক্ষিরাজ।।
প্রাণ দিল পক্ষিরাজ করিয়া সমর।
অনায়াসে স্বর্গে গেল গরুড়-কোঙর।।
রাম-বনবাস হেতু সীতার হরণ।
সীতা লাগি বিদেশেতে মরে কপিগণ।।
সম্পাতি বলেন, কে জটায়ুর মৃত্যু কহে।
সোদরের মৃত্যু শুনি মম প্রাণ দহে।।
বিধির বিপাকে পাখা পুড়িয়া বিনাশ।
উড়িয়া যাইতে নারি তোমাদের পাশ।।
তোমাদের মুখে শুনি জটায়ু-বিনাশ।
আজি শোকে হইলাম নিতান্ত নিরাশ।।
কপিগণ বলে, পক্ষী বড়ই সেয়ান।
নিকটে আসিতে চাহে লইতে পরাণ।।
নড়িতে চড়িতে নারে জরাতে দুর্ব্বল।
সম্মুখে পাইলে গিলিবেক করি ছল।।
হনুমান বলে ভাই অবশ্য মরণ।
এ বৃদ্ধ পক্ষীকে আমি জিজ্ঞাসি কারণ।।
হনুর বচনে সবে দিব অনুমতি।
আনিলেক ধরাধরি করিয়া সম্পাতি।।
পক্ষিরাজে বসাইল বানর-সমাজ।
যোড়হাত কহিল অঙ্গদ ‍যুবরাজ।।
বালি সুগ্রীবের জান দুই সহোদর।
কতকাল কোন্দল করিল পরস্পর।।
পিতৃসত্য পালিতে শ্রীরাম আইল বন।
সঙ্গে গোড়াইল তাঁর জানকী লক্ষ্মণ।।
সীতা সহ দুই ভাই ভ্রমে বনে বন।
শূন্য ঘর পেয়ে সীতা হরিল রাবণ।।
সীতার লাগি ভ্রমেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
পথে সুগ্রীবের সঙ্গে হইল মিলন।।
সুগ্রীবের দিলেন আপন পরিচয়।
আপন দুঃখের কথা দুইজনে কয়।।
অগ্নিসাক্ষী করি দুইজনে সত্য করে।
পরস্পর উপকার করে পরস্পরে।।
দুইজনে সত্য বদ্ধ হইল মিলন।
সেই হেতু করি মোরা সীতা অন্বেষণ।।
রাম সত্য পালেন মারিয়া মোর বাপে।
সুগ্রীবের রাজ্য দেন দুর্জ্জয় প্রতাপে।।
পিতা মারিলেন মনে হইলেন দুঃখী।
বনে বনে ফিরি আমি দেখ তার সাক্ষী।।
বানর আইল যত ছিল দেশে দেশে।
রামকার্য্য সাধিবারে সুগ্রীব-আদেশে।।
এক মাস নিয়ম করিল মহাশয়।
মাসেকের বাড়া হৈলে না জানি কি হয়।।
পরিচয় দিলাম আমরা কপিগণ।
এখন শুনহ জটায়ুর বিবরণ।।
জটায়ু পক্ষীর শুন মরণের কথা।
রাবণ হরিয়া নিল শ্রীরামের সীতা।।
জটায়ু নামেতে পক্ষী গরুড়-নন্দন।
পর্ব্বত হইতে শুনে সীতার ক্রন্দন।।
হাত পা আছড়ে সীতা রথের উপরে।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ বলি কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।।
পক্ষী বলে এই বেটা লঙ্কার রাবণ।
সীতারে হরণ করি করিছে গমন।।
অনেক কালের পক্ষী হইয়াছে জরা।
দুই পাখা মেলিয়া পোহায় তথা খরা।।
সীতার ক্রন্দন পক্ষী তথা হৈতে শুনি।
ভাবিতে লাগিল সে প্রমাদ মনে গণি।।
আকাশে উড়িয়া পক্ষী চারিদিকে চায়।
রাবণের রথে সীতা দেখিবারে পায়।।
জটায়ু বলেন, সীতা এসেছেন বনে।
সেই সীতা লয়ে যায় পাপিষ্ঠ রাবণে।।
দুই পাখা পসারিয়া আগুলিল বাট।
রাবণেরে গালি পাড়ে মারে পাখসাট।।
আকাশে থাকিয়া দেখে রাম বহুদূর।
আঁচড় কামড়ে তার রথ কৈল চূর।।
রাবণ মারিল তারে ঘন ঘন শর।
জটায়ুর শরীর সে করিল জর্জ্জর।।
রামের অপেক্ষা করি যুঝিল বিস্তর।
তথাপি না আইলেন তথা রঘুবর।।
বৃদ্ধকালে জটায়ুর টুটিয়াছে বল।
দুই পাখা কাটিয়া পাড়িল ভূমিতল।।
আসিয়া করেন রাম তার অগ্নিকাজ।
রাম-দরশনে মুক্ত হৈল পক্ষিরাজ।।
কহিলাম জটায়ুর মৃত্যুর-কাহিনী।
জটায়ুর কে হও আপনি কহ শুনি।।
সম্পাতি শুনিয়া জটায়ুর বিবরণ।
ভাই ভাই করিয়া কান্দিল বহুক্ষণ।।
আমার ভাইকে মারি বেটা থাকে সুখে।
পাখা নাই কি করিব মরি মনোদুঃখে।।
যৌবনে যখন ছিল পাখা সে আমার।
শুনহ বানরগণ বলি সারোদ্ধার।।
জটায়ু সম্পাতি এই দুই সহোদর।
বলে মহাবলী মোরা গরুড়-কোঙর।।
দুই ভাই প্রতিজ্ঞা যে করিলাম এই।
সূর্য্য যে ছুঁইতে পারে বীর বটে সেই।।
প্রভাত হইল যবে অরুণ-উদয়।
সূর্য্যেরে ধরিতে যাই করিয়া নিশ্চয়।।
জ্ঞাতি বন্ধু সকলে দেখিয়া সবিস্ময়।
এক লক্ষ যোজন উপরে সূর্য্যোদয়।।
এক লক্ষ যোজন উড়ি উঠিয়া আকাশে।
দিবাকরে ধরিতে গেলাম তার পাশে।।
চৌদিকে চাপিয়া উঠে সূর্য্য মহাশয়।
দিক ও বিদিক নাই সব অগ্নিময়।।
প্রভাত হইতে দুই প্রহর উড়িয়া।
দুই ভার মারি সূর্য্য-তেজেতে পুড়িয়া।।
তাহাতে জটায়ু ভাই হইল কাতর।
মৃতপ্রায় হেন দেখি ভাই সহোদর।।
রাখি জটায়ুর পাখা নিজ পাখা দিয়া।
আমার উভয় পাখা গেল ত পুড়িয়া।।
এ পর্ব্বতে পড়িলাম দৈবের নির্ব্বন্ধ।
এই সে কারণে আমি হইয়াছি বন্ধ।।
সাত দিন নাহি খাই সলিল ওদন।
হেনকালে সর্ব্বজ্ঞ আইল একজন।।
স্নান করে সর্ব্বজ্ঞ সে সরোবর-জলে।
সিংহ ব্যাঘ্র গণ্ডার চরিছে তার কূলে।।
পর্ব্বত প্রমাণ দেখি জন্তু সে সকল।
ধরিয়া খাইবে মোরে গায়ে নাহি বল।।
দূরে গিয়া রহিলাম বটবৃক্ষ-তলে।
সিংহ মহিষাদি জন্তু গেল হেনকালে।।
স্নান করি সে সর্ব্বজ্ঞ সরোবর-জলে।
আমার সম্মুখে সেই আইল হেনকালে।।
প্রসিদ্ধ সর্ব্বজ্ঞ সেই নিশাকর নাম।
পথে দেখা পাইয়া যে করিনু প্রণাম।।
ব্যথায় কাতর আমি শব্দ নাহি মুখে।
আমারে কাতর দেখি দ্বিজ ধ্যানে দেখে।।
সর্ব্বজ্ঞ বলেন পক্ষিরাজ প্রাণরক্ষ।
হারাইয়া পাবে তুমি আপনার পক্ষ।।
দশরথ রাজ্য করিবেন বহুদিন।
তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম হবেন প্রবীণ।।
পিতৃসত্য পালিতে যাবেন তিনি বন।
শূন্য ঘরে তাঁর সীতা হরিবে রাবণ।।
কপিগণ করিবেক সীতার উদ্দেশ।
তার দরশনে তব খণ্ডিবেক ক্লেশ।।
থাক এই পর্ব্বতে পাইবে তার দেখা।
রাম নাম বলিতে উঠিবে দুই পাখা।।
বিংশতি অধিক পঞ্চদশ বৎসর।
তবে সে দেখিবে তুমি সকল বানর।।
এতকাল রাম লাগি আছ হে জীবন।
এত দিনে তব সনে হৈল দরশন।।
অঙ্গদ বলেন তোমা দেখে পাই ভয়।
সত্য কহ পক্ষিরাজ বৃত্তান্ত নিশ্চয়।।
রাবণের কোন্ দেশ, কোথা তার ঘর।
তার দেশ যেতে কত যোজন সাগর।।
পক্ষিরাজ বলে আমি হই গৃধ্র জাতি।
পূর্ব্বেতে দক্ষিণদিকে ছিল মম গতি।।
কহিব শুনিবে যত জানি বিবরণ।
সম্প্রতি যুড়াও কর্ণ কহি রামায়ণ।।
রামের প্রসঙ্গে পুনঃ হবে পক্ষোদয়।
পক্ষোদয়ে ভক্ষ্য লাভ প্রাণ রক্ষা হয়।।