১২. বালির মৃত্যুতে তারার বিলাপ ও শ্রীরামের প্রতি তারার অভিশাপ প্রদান

রণে পড়ে বালিরাজ শ্রীরামের বাণে।
অন্তঃপুরে থাকি তাহা তারাদেবী শুনে।।
বস্ত্র না সম্বরে রাণী আলুয়িত কেশে।
অঙ্গদেরে লয়ে যায় বালির উদ্দেশে।।
পথে দেখে মন্ত্রিগণ পলাইছে ত্রাসে।
অশ্রুমুখী তারাদেবী সবারে জিজ্ঞাসে।।
তোমরা রাজার পাত্র ছিলে তাঁর সাথী।
তবে ছাড়ি যাও কেন রাখিয়া অখ্যাতি।।
কপিগণ বলে, শুন তারা ঠাকুরাণী।
দুই ভাই বিস্তর করেন হানাহানি।।
তুমি যত বলিলে হইল বিদ্যমান।
শ্রীরামের বাণে বালি হারাইল প্রাণ।।
চারিভিতে সৈন্য লৈয়া রাখ অন্তঃপুরী।
অঙ্গদেরে রাজা কর শোক পরিহরি।।
তারা বলে রাজ্য নিয়ে থাকুক অঙ্গদ।
স্বামী সঙ্গে যাব আমি এই সে সম্পদ।।
শিরে করে করাঘাত, বস্ত্র না সম্বরে।
রণস্থলে রাণী চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি করে।।
ধনুর্ব্বাণ ছাড়িয়া বসিয়া রঘুনাথ।
লক্ষ্মণ সম্মুখে তাঁর করি যোড়হাত।।
কারো মুখে নাহি শুনা যায় কোন কথা।
সকলে বসিয়া আছে হেঁট করি মাথা।।
বালির নিকটে তারা চলিল সত্বরে।
স্বামীর দুর্গতি দেখি হাহাকার করে।।
মেঘের গর্জ্জন তুল্য তোমার গর্জ্জন।
বড় বড় বীর সহে কে তোমার রণ।।
শ্রীরামের এক বাণে লোটাও ভূতলে।
একি অসম্ভব কর্ম্ম বিধি দেখাইলে।।
মম বাক্য না শুনিলে করিলে সাহস।
তোমার নাহিক দোষ, বিধাতা বিরস।।
মুদিলে নয়ন নাথ ত্যজিয়া আমায়।
তোমা বিনা অঙ্গদের না দেখি উপায়।।
চন্দ্র যান অস্ত, তার সঙ্গে যায় তারা।
তোমার হইল অন্ত কেন রহে তারা।।
রাজ্যলোভে সুগ্রীব করিল এই কাজ।
কান্দাইল কিষ্কিন্ধ্যার বিশিষ্ট সমাজ।।
এতেক বলিয়া কান্দে তারা কৃশোদরী।
তাহার ক্রন্দনে কান্দে কিষ্কিন্ধ্যা নগরী।।
বালক অঙ্গদ কান্দে মৃত্তিকা শয়নে।
পশু পক্ষী আদি কান্দে বালির মরণে।।
থাকুক অন্যের কথা, কান্দেন লক্ষ্মণ।
শ্রীরাম সুগ্রীব দোঁহে বিরস বদন।।
তারা বলে, রাম তব জন্ম রঘুকুলে।
আমার স্বামীকে কেন বিনাশিলে ছলে।।
সম্মুখে মারিতে যদি দেখিতে প্রতাপ।
লুকাইয়া মারিলে পাইলাম বড় তাপ।।
শ্রীরাম তোমারে সবে বলে দয়াবান।
ভাল দেখাইলে আজি তাহার প্রমাণ।।
একেবারে আমার করিলে সর্ব্বনাশ।
সুগ্রীবের প্রতি দয়া করিলে প্রকাশ।।
বিচ্ছেদ-যাতনা যত জান ত আপনি।
তবে কেন আমারে দিলে হে রঘুমণি।।
প্রভু শাপ না দিলেন সদয় হৃদয়।
আমি শাপ দিব তোমা, ফলিবে নিশ্চয়।।
সীতারে উদ্ধারিবে রাম আপন বিক্রমে।
সীতারে আনিবে ঘরে বহু পরিশ্রমে।।
কিন্তু সীতা না রহিবে সদা তব পাশ।
কিছুদিন থাকিয়া করিবে স্বর্গবাস।।
কান্দাইলা যেইরূপ কিষ্কিন্ধ্যানগরী।
কান্দাইয়া তোমারে যাইবে স্বর্গপুরী।।
আমি যদি সতী হই ভারত ভিতরে।
কান্দিবে সীতার হেতু কে খণ্ডিতে পারে।।
আমি শাপ দিলাম না হইবে খণ্ডন।
সীতার কারণে রাম হবে জ্বালাতন।।
সীতার কারণে তুমি প্রাণ হারাইবে।
এ জন্মের মত দুঃখে কাল কাটাইবে।।
বানরী হইয়া তারা রামেরে গরজে।
এতেক সম্পদ মোর তোমা হেতু মজে।।
ইহা মনে না করিহ, আমি নারায়ণ।
কর্ম্মমত ফলভোগ করে সর্ব্বজন।।
বিনা দোসে মারিলে যেমন কপীশ্বরে।
মারিবে তোমারে রাম সেই জন্মান্তরে।।
সতীর বচন কভু না হয় খণ্ডন।
যাহা বলি তাহা হবে নাহি বিমোচন।।
খেদে তারা কান্দে কোলে করিয়া বালিরে।
তারার ক্রন্দনে বালি বলে ধীরে ধীরে।।
শুন তারা প্রেয়সি, তোমারে আমি বলি।
আমি বহু রামেরে দিয়াছি গালাগালি।।
আমার বচনে বড় পাইলেন লাজ।
তুমি মন্দ বলিয়া সাধিবে কোন্ কাজ।।
সীতারে হরিয়া নিল লঙ্কার রাবণ।
রাবণের অপরাধে আমার মরণ।।
বিধির নির্ব্বন্ধ ছিল, রামের কি দোষ।
গালি দিলে শ্রীরাম হবেন অসন্তোষ।।
তারা প্রতি দিল বালি প্রবোধ বচন।
মৃত্যুকালে সুগ্রীবের করে সম্ভাষণ।।
বালি বলে, সুগ্রীব তুমি যে সহোদর।
তব সঙ্গে বিসম্বাদ হইল বিস্তর।।
তোমার বিবাদে মম এই ফল হয়।
তুমি রাজ্য কর, আমি মরি হে নিশ্চয়।।
তব দোষ নাহি, মোরে বিধাতা বিমুখ।
একত্র না হইল দোঁহার রাজ্যসুখ।।
রাজ্যভোগে বাড়াইলাম অঙ্গদ সুন্দর।
পদতলে লোটে পুত্র ধূলায় ধূসর।।
অঙ্গদেরে ভাই তুমি নাহি দিও তাপ।
আমার বিহনে তুমি অঙ্গদের বাপ।।
অঙ্গদের ভয়েতে অভয় দিও দান।
পালন করিও এরে পুত্রের সমান।।
আমি যদি থাকিতাম, হইত পালন।
এই লহ অঙ্গদেরে করি সমর্পণ।।
দারুণ রামের বাণে পোড়ে এ শরীর।
ক্ষণেক থাকিয়া প্রাণ হইবে বাহির।।
ইন্দ্র মালা দিয়াছেন পুত্রের সন্দেশ।
সুগ্রীবের দিই যে দেখুক এই দেশ।।
শ্রীরামের ঠাঁই বালি লয় অনুমতি।
সুগ্রীবের গলে দিল, ধরে নানা জ্যোতি।।
সুগ্রীবের মালা দিয়া পুত্রপানে চাহে।
মৃত্যুকালে অঙ্গদেরে পরিমিত কহে।।
বাড়িলে যেমন পুত্র আমার গৌরবে।
সেই মত বাড়াইবে তোমারে সুগ্রীবে।।
অহঙ্কার না করিহ আমার কথনে।
খুড়ার করিহ সেবা বিবিধ বিধানে।।
সুগ্রীবের বিপক্ষ যে, জানিও বিপক্ষ।
সুগ্রীবের যেই পক্ষ, সেই তব পক্ষ।।
অধর্ম্ম না করিহ, করিহ সেবাকর্ম্ম।
খুড়ার করিহ সেবা, পরাপর ধর্ম্ম।।
এত বলি বালিরাজা ত্যজিল পরাণ।
প্রেরণ করেন ইন্দ্র তখনি বিমান।।
কালের কুটিল গতি কে বুঝিবে স্থির।
রণস্থলে শয়ন করিল মহাবীর।।
বিমানে চড়িয়া গেল অমরাবতীতে।
হাহাকার করি তারা লাগিল কান্দিতে।।
শিরে করি করাঘাত ত্যজে আভরণ।
ক্ষণে হাহাকার করে, ক্ষণে অচেতন।।
ছিঁড়িল মুক্তার মালা, খসিল কবরী।
ধরিয়া রাখিতে তারে নারে সহচরী।।
পতি হারাইয়া তারা, নেত্রে ধারা বহে।
বলে, প্রভু তোমার বিহনে প্রাণ দহে।।
কোথায় রহিল তব রাজ্যপাট ধন।
কোথায় তোমার দিব্য রত্ন-সিংহাসন।।
সুগ্রীব হইল তব প্রাণের আপদ।
কোথায় রহিল তব প্রাণের অঙ্গদ।।
কোথায় রহিল তব এ রাজ্য সংসার।
তোমার বিহনে দেখি সব অন্ধকার।।
ত্রিভুবন কম্পমান তোমার বিক্রমে।
তোমার এমন দশা মম ভাগ্যক্রমে।।
রামের দারুণ বাণ বিদ্ধ বক্ষঃস্থলে।
সুগ্রীবের যত পাপ আমাতে তা ফলে।।
বুক হৈতে সুগ্রীব তুলিয়া নিল বাণ।
বালির রক্তেতে নদী বহে খরশান।।
কান্দিতে কান্দিতে তারা হইল কাতর।
পাত্র মিত্র মিলি দেয় প্রবোধ উত্তর।।
কান্দে মহাদেবী তারা, না মানে প্রবোধ।
হনুমান বলে কত করি অনুরোধ।।
শোক পরিহর রাণী, সম্বর ক্রন্দন।
এমনি কালের ধর্ম্ম, কে করে খণ্ডন।।
পরম ধার্ম্মিক বালি ইন্দ্রের সন্তান।
রামের প্রসাদে যাইলেন পিতৃস্থান।।
অঙ্গদেরে পালহ, পালহ সবাকারে।
সকলি তোমার রাণী যে আছে সংসারে।।
অঙ্গদ হইবে রাজা দেখিবে নয়নে।
পরিত্যাগ কর শোক, ধৈর্য্য ধর মনে।।
নেত্রনীর ঝরে যেন শ্রাবণের ধারা।
না কহিলে নহে, তেঁই কহে রাণী তারা।।
শুন বীর, রাজা যদি অঙ্গদ হইবে।
শ্রীরামের কি সাহায্য করিবে সুগ্রীবে।।
ভাল মন্দ পুত্রের যে নাহি মনে করি।
স্বামী সহ মরিলে সকল দায় তরি।।
নারীর গৌরব যত, স্বামী সব জানে।
কি করিতে পারে পুত্র স্বামীর বিহনে।।
পুত্রেরে বলিলে মন্দ, অবশ্য সে রোষে।
স্বামীরে বলিলে মন্দ, মনে মনে হাসে।।
সর্ব্ব-ধর্ম্ম-কর্ম্ম স্বামী, নারীর বিধাতা।
কামিনীর স্বামী হয় সুখ মোক্ষদাতা।।
স্বামীসেবা করিবেক, যদি হয় সতী।
স্বামী বিনা স্ত্রীলোকের আর নাহি গতি।।
স্বামী দাতা, স্বামী কর্ত্তা, স্বামী মাত্র ধন।
স্বামী বিনা গুরু নাহি, বলে জ্ঞানীজন।।
শত পুত্রবতী যদি স্বামীহীনা হয়।
তথাপি সকলে তারে অভাগিনী কয়।।
কান্দিতে কান্দিতে তারা হইল বিহ্বল।
তারার ক্রন্দনে হয় সুগ্রীব বিকল।।
রামনাম স্মরণেতে পাপের বিনাশ।
রচিল কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।