১৭. সুপার্শ্ব পক্ষী কর্ত্তৃক রাবণের লঙ্কা-গমনে বাধা দান

রামে জানাইতে সীতা ফেলেন ভূষণ।
সীতার ভূষণ-পুষ্পে ছাইল গগন।।
আভরণ গলার ফেলেন সীতাদেবী।
সে ভূষণে সুশোভিতা হইল পৃথিবী।।
ছিঁড়িয়া ফেলেন মণি মুক্তার সে ঝারা।
হিমালয় শৈলে যেন বহে গঙ্গাধারা।।
শ্রীরাম বলিয়া সীতা করেন ক্রন্দন।
অন্তরীক্ষে হাহাকার করে দেবগণ।।
জানকী বলেন, কোথা শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
এ অভাগিনীরে দেখা দেহ এইক্ষণ।।
ঋষ্যমূক নামে গিরি অতি উচ্চতর।
পঞ্চ পাত্র সহিত সুগ্রীব তদুপর।।
নল নীল গবাক্ষ ও পবন-নন্দন।
জাম্বুবান সুগ্রীব বসেছে দুইজন।।
পক্ষী যেন বসিয়াছে পর্ব্বতের মাঝ।
ডাকিয়া বলেন সীতা শুন মহারাজ।।
শ্রীরামের নারী আমি সীতা নাম ধরি।
গায়ের ভূষণ ফেলি গলার উত্তরী।।
রামের সহিত যদি হয় দরশন।
তাঁহাকে কহিও, সীতা হরিল রাবণ।।
হেনকালে সুগ্রীবেরে বলে হনুমান।
সীতা রাখি রাবণের করি অপমান।।
এই যুক্তি দশানন শুনিল আকাশে।
সীতা লয়ে পলাইল শ্রীরামের ত্রাসে।।
সীতা লৈয়ে দক্ষিণেতে চলিল রাবণ।
দৈবে পথে সুপার্শ্বের সহ দরশন।।
সম্পাতির নন্দন, সুপার্শ্ব নাম তার।
বিন্দ্যাচলে থাকি ভক্ষ্য যোগায় পিতার।।
জটায়ুর মরণ সুপার্শ্ব যদি জানে।
রাবণেরে মারিত সে দিন সেই ক্ষণে।।
শূকর মহিষ হস্তী যত পায় বনে।
সহস্র সহস্র জন্তু ঠোঁটে করি আনে।।
সাগরের জলজন্তু যখন সে ধরে।
তিন ভাগ জল তারে আচ্ছাদন করে।।
এক ভাগ সাগরের জল মাত্র রয়।
এমন বৃহৎকায় বিহঙ্গ দুর্জ্জয়।।
জটায়ুর ভ্রাতুষ্পুত্র, গরুড়ের নাতি।
অন্তরীক্ষে উড়িয়া আইসে শীঘ্রগতি।।
পাখসাট মারে পাখী, ঝড় যেন বহে।
ত্রাসেতে রাবণ মাথা তুলি ঊর্দ্ধে চাহে।।
শ্রীরাম বলিয়া সীতা করেন ক্রন্দন।
শুনিলা যে পক্ষিরাজ উপর গগন।।
পাখসাট মারে পাখী, তর্জ্জে গর্জ্জে ডাখে।
দুই পক্ষ দিয়া রাবণের রথ ঢাকে।।
তার প্রতি ডাক দিয়া বলে দেবগণ।
সীতারে হরিয়া লয়ে যায় দশানন।।
দেবতার বাক্য ‍শুনি পক্ষী কোপে জ্বলে।
রথশুদ্ধ গিলিবারে দুই ঠোঁট মেলে।।
রথমধ্যে দেখে পক্ষী আছেন জানকী।
ভাবে নারীহত্যা করি হব কি পাতকী।।
রথকান বন্দী করি রাখে পাখা দিয়া।
রাবণ বলিল তারে বিনয় করিয়া।।
রাবণ আমার নাম বসতি লঙ্কায়।
তোমার না আছে কোন শত্রুতা আমায়।।
করিয়াছে রাঘব আমার অপমান।
সহোদরা ভগিনীর কাটে নাক কাণ।।
ভাই খর দূষণের রাম মহা অরি।
সেই ক্রোধে হরিলাম রামের সুন্দরী।।
ত্রিভুবনে খ্যাত তুমি বিক্রমে দুর্জ্জয়।
তব ঠাঁই পক্ষিরাজ মানি পরাজয়।।
সুপার্শ্ব করিয়া ক্ষমা ছাড়িল তখন।
সেইক্ষণে রথ লয়ে চলিল রাবণ।।
এই সব কথা কিছু না জানেন সীতা।
সমুদ্র দেখিয়া হন ভয়েতে মূর্চ্ছিতা।।
দেখিয়া সমুদ্রতীর রাবণে উল্লাস।
জলনিধি উত্তরিল করিয়া প্রয়াস।।
ভাবেন জানকী দেখি সাগর অপার।
কৃপার আধার রাম কিসে হবে পার।।
অধোমুখে জানকী কান্দেন আশঙ্কায়।
উত্তরিল দশানন তখন লঙ্কায়।।
রথ হৈতে সীতারে নামায় লঙ্কেশ্বর।
কোথায় রাখিব বলি চিন্তিত অন্তর।।
শত্রুতা হইল রাম লক্ষ্মণের সনে।
নিন্দ্রা নাহি যাবৎ না মারি দুই জনে।।
রাজা বলে, শুন বলি চৌদ্দ নিশাচর।
সাগরের পারে থাক সতর্ক-অন্তর।।
রাজার নিকটে বলে চৌদ্দ নিশাচর।
এতেক রাক্ষস মারে রাম একেশ্বর।।
কেমনে যুঝিব রাম লক্ষ্মণের সনে।
কি করিতে পারি মোরা বীর যত জনে।।
রাক্ষস হইয়া এত ভয় হয় নরে।
ধিক্ ধিক্ তো সবারে, যা রে স্থানান্তরে।।
রাবণের কোপ দেখি পলায় তরাসে।
লঙ্কা ছাড়ি বীরগণ গেল অন্য দেশে।।
রাবণের নাহি নিদ্রা নাহিক ভোজন।
সীতারে রাখিব কোথা, ভাবে সর্ব্বক্ষণ।।
সীতারে প্রবোধ-বাক্যে কহে দশানন।
লঙ্কাপুরী দেখ সীতা তুলিয়া বদন।।
চন্দ্র সূর্য্য দুয়ারে আসিয়া সদা খাটে।
মোর আজ্ঞা বিনা কেহ না আসে নিকটে।।
চারিভিতে সাগর মধ্যেতে লঙ্কাগড়।
দেব দৈত্য না আইসে লঙ্কার ভিতর।।
দেব দানবের কন্যা আছে মোর ঘরে।
দাসী করি রাখিব তোমার সে সবারে।।
নানা ধনে পূর্ণ দেখ আমার ভাণ্ডার।
আজ্ঞা কর, সীতাদেবী সকলি তোমার।।
তোমার সেবক আমি, তুমি তো ঈশ্বরী।
আজ্ঞা কর সীতা লয়ে যাই অন্তঃপুরী।।
সীতার চরণে পড়ে করিয়া ব্যগ্রতা।
কোপ না করিহ মোরে চন্দ্রমুখী সীতা।।
রাবণের বাক্যে সীতা কুপিত অন্তরে।
বিমুখী হইয়া বলিলেন ধীরে ধীরে।।
রাম ধ্যান, রাম প্রাণ, শ্রীরাম দেবতা।
রাম বিনা অন্য জনে নাহি জানে সীতা।।
শুনিয়া সীতার বাক্য নিরস্ত রাবণ।
তাঁর কাছে নিযুক্ত লয়ে অশোক-কাননে।।
সীতারে বেড়িল গিয়া যত চেড়ীগণে।
সূর্পণখা আসি বলে নিষ্ঠুর বচন।
গলে নখ দিয়া বেটীর বধিব জীবন।।
কাটিল দেবর তোর মোর নাক কাণ।
সেই কোপে তোর আজি বধিব পরাণ।।
খান্দা মুখে গঞ্জে খান্দি সভয় অন্তরে।
রাবণের ডরে কিছু বলিতে না পারে।।
সশোকা থাকেন সীতা অশোক কাননে।
হৃদয়ে সর্ব্বদা রাম, সলিল নয়নে।।
জানকীর দুঃখে দুঃখী সদা দেবগণ।
ইন্দ্রেরে ডাকিয়া ব্রহ্মা বলেন বচন।।
লঙ্কামধ্যে থাকিবেন সীতা দশমাস।
এতদিন কেমনে করেন উপবাস।।
জানকী মরিলে সিদ্ধ না হইবে কাজ।
এই পরমান্ন লৈয়া যাহ দেবরাজ।।
ব্রহ্মার বচনে ইন্দ্র গেলেন তখন।
জানকী আছেন যথা অশোক কানন।।
বাসব বলেন সীতা না ভাবিহ চিতে।
আমি ইন্দ্র আসিয়াছি তোমা সম্ভাষিতে।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ গেল মৃগ মারিবারে।
রাবণ হরিল তোমা পেয়ে শূন্য ঘরে।।
সাগর বাঁধিয়া রাম সৈন্য করি পায়।
রাবণেরে মারিয়া করিবেন উদ্ধার।।
শোক পরিহর সীতে, স্থির কর মন।
পরমান্ন আনিয়াছি তোমার কারণ।।
জানকী বলেন, লঙ্কা নিশাচরময়।
ইন্দ্র যদি হও, তবে দেহ পরিচয়।।
সীতার বচনে ইন্দ্র ভাবিলেন মনে।
সহস্রলোচন হইলেন ততক্ষণে।।
ইন্দ্রকে দেখেন সীতা সহস্রলোচন।
তাঁহার প্রতীত মনে জন্মিল তখন।।
দিলেন সীতাক ইন্দ্র পরমান্ন সুধা।
যাহা ভক্ষণেতে হরে তৃষা আর ক্ষুধা।।
আগে পরমান্ন দেন রামের উদ্দেশে।
আপনি ভক্ষণ সীতা করিলেন শেষে।।
পায়স ভক্ষণে তৃপ্তি কি হবে তাঁহার।
রামের বিরহানল জ্বলে অনিবার।।
মহেন্দ্র বলেন, সীতা না হও বিকল।
প্রতিদিন আমি যোগাইব সুধাফল।।
সীতারে আশ্বাস করি যান পুরন্দর।
অন্তরে জানকী দুঃখ পান নিরন্তনর।।
লঙ্কাতে রহেন সীতা অশোক-কাননে।
বনে রাম আইলেন শূন্য নিকেতনে।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের বড় অভিমান।
অরণ্যেতে গান রাম শোকের নিদান।।
স্থানের প্রধান সে ফুলিয়ায় নিবাস।
রামায়ণ গান দ্বিজ, মনে অভিলাষ।।