০৮. শ্রীরামচন্দ্রের সহিত গুহকের সন্দর্শন ও জয়ন্ত কাকের এক চক্ষু বিদ্ধ করণ

যোড়হাত করি বলে সুমন্ত্র সারথি।
আমাকে কি আজ্ঞা কর করি অবগতি।।
শুনিয়া বলেন রাম কমললোচন।
রথ লৈয়া দেশে তুমি করহ গমন।।
তিন দিন রথে আসি পিতার আদেশে।
তিন দিন গত হৈল যাও তুমি দেশে।।
আর তিন দিনে যাবে অযোধ্যা-নগরে।
সকল কহিবা গিয়া পিতার গোচরে।।
বৃদ্ধ পিতা ছাড়ি আইলাম দেশান্তরে।
এমত দারুণ শোক কিমতে পাসরে।।
পিতৃসেবা না করিলাম থাকিয়া নিকটে।
কোথাও না দেখি হেন কোন জনে ঘটে।।
প্রাণের ভরত ভাই থাকে সে বিদেশে।
ভরতে আনিয়া রাজ্য করিবা হরিষে।।
যত দিন ভরত এ কথা নাহি শুনে।
তত দিন রবে মাতামহের ভবনে।।
মায়ের চরণে জানাইবে নমস্কার।
আমা হেতু শোক যেন না করেন আর।।
রাত্রি দিন সেবা যেন করেন পিতার।
মোরে পাসরিবে মাতা দেখিয়া সংসার।।
পরিহার জানাইবে কৈকেয়ীর প্রতি।
তাঁর কিছু দোষ নাই, এই দৈবগতি।।
পিতার চরণে জানাইহ সমাচার।
অস্থির হইলে তিনি মজিবে সংসার।।
তুমি হেন মহাপাত্র সুমন্ত্র সারথি।
ইষ্ট কুটুম্বের ঠাঁই জানাবে মিনতি।।
রামেরে সুমন্ত্র কহে করিয়া ক্রন্দন।
কতদিনে রাম পাব তব দরশন।।
বিদায় হইয়া যায় সুমন্ত্র কান্দিয়া।
অতি শীঘ্রগতি গেল রথ চালাইয়া।।
সুমন্ত্রে বিদায় দিয়া শ্রীরাম চিন্তিত।
মন্ত্রণা করেন সীতা লক্ষ্মণ সহিত।।
হেথা হৈতে অযোধ্যা নিকট বড় পথ।
এখানে থাকিলে নিতে আসিবে ভরত।।
সুমন্ত্র কহিবে, রাখি শৃঙ্গবের পুরে।
শুনিলে ভরত নিতে আসিবে সত্বরে।।
যাবৎ সুমন্ত্র পাত্র নাহি যায় দেশে।
গঙ্গা পার হৈয়া চল যাই বনবাসে।।
হুহকের প্রতি তবে বলেন শ্রীরাম।
চিত্রকূট শৈলে গিয়া করিব বিশ্রাম।।
দেখিয়া আতঙ্ক হয় গঙ্গার তরঙ্গ।
ঝাট পার কর, যেন সত্য নহে ভঙ্গ।।
সাত কোটি নৌকা তার গুহক চণ্ডাল।
আনিল সোণার নৌকা সোণার কেরাল।।
গুহ বলে, করিলাম তরণী সাজন।
এক রাত্রি হেথা রাম বঞ্চ তিন জন।।
এক রাত্রি থাকি রাম তোমার সহিত।
শ্রীরাম বলেন মিত্র এ নহে উচিত।।
এখানে রহিতে আজি মনে শঙ্কা পায়।
ভরত আসিয়া পাছে প্রমাদ ঘটায়।।
ঝাট পার কর বন্ধু, না কর বিলম্ব।
গুহ বলে, ঝাট পার করিব আরম্ভ।।
গুহের বাড়ীতে রাম করি অবস্থিতি।
বিদায় হইয়া যান চলি শীঘ্রগতি।।
প্রাতঃকালে গুহ নৌকা করিল সাজন।
পার হৈয়া কূলেতে উঠেন তিন জন।।
মাঝে সীতা, আগে পাছে দুই মহাবীর।
দুই ক্রোশ পথ বাহি যান গঙ্গাতীর।।
শ্রীরাম বলেন ভরদ্বাজের নিকটে।
আজি বাসা করি গিয়া থাকি নিঃসঙ্কটে।।
মুনিগণে বেষ্টিত বসিয়া ভরদ্বাজ।
তারাগণ মধ্যে যেন শোভে দ্বিজরাজ।।
হেনকালে সেখানে গেলেন তিন জন।
তিন জন বন্দিলেন মুনির চরণ।।
শ্রীরাম বলেন, শুন মুনি মহাশয়।
তিন জন তব ঠাঁই কহি পরিচয়।।
শ্রীদশরথের পুত্র মোরা দুই জন।
শ্রীরাম আমার নাম কনিষ্ঠ লক্ষ্মণ।।
পিতৃসত্য পালিতে হয়েছি বনবাসী।
জনক-কুমারী সীতা সহিত প্রেয়সী।।
রাম-কথা শুনি মুনি উঠেন সম্ভ্রমে।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া পূজা করেন শ্রীরামে।।
মুনি বলিলেন, তুমি বিষ্ণু-অবতার।
বিষ্ণু আরাধনে তপ করয়ে সংসার।।
যাঁর রূপ আরাধন করে মুনিগণে।
সেই বিষ্ণু আইলেন আমার ভবনে।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ লক্ষ্মী দেখি তিন জনে।
আপনারে ধন্য করি মানি এত দিনে।।
গঙ্গা যমুনার মধ্যে আমার বসতি।
বনবাস বাঞ্চ হেথা থাকিব সংহতি।।
শ্রীরাম বলেন, মুনি অযোধ্যা সন্নিধি।
অযোধ্যার লোকেরা আসিবে নিরবধি।।
হেথা হৈতে কোন স্থান হয় ত নির্জ্জন।
যমুনার পারে সে অদ্ভুত হয় বন।।
কহ মুনি, কোথায় করিব নিবসতি।
শুনি ভরদ্বাজ কহে শ্রীরামের প্রতি।।
যথা মুনিগণ বৈসে বটবৃক্ষতলে।
মৃগ পক্ষী বন্যজন্তু আছে কুতূহলে।।
নানা ফল মূল পাবে বড়ই সুস্বাদ।
তপোবন দেখি রাম ঘুচিবে বিষাদ।।
মুনি সকলের সঙ্গে থাক সেই দেশ।
ভরত তোমার তথা না পাবে উদ্দেশ।।
এই দেশে নাহি রাম নৌকার সঞ্চার।
ভেলা বান্ধি যমুনার হও তুমি পার।।
ত্রিশ হস্ত যমুনা আড়েতে পরিসর।
নিম্নতা না জানে লোক গভীর বিস্তর।।
এক রাত্রি রাম হেথা বঞ্চ তিন জন।
কালি তুমি যাইও, মুনির তপোবন।।
এথা হৈতে তপোবন উভয় যোজন।
দুই প্রহরের মধ্যে যাবে তিন জন।।
সেইখানে শ্রীরাম বঞ্চেন এক রাতি।
বিদায় হইয়া রাম যান শীঘ্রগতি।।
উভয় বীরের হাতে দিব্য ধনুঃশর।
মধ্যে সীতা, দুই পার্শ্বে দুই সহোদর।।
অগ্রে রাম যান, পাছে শ্রীরাম-রমণী।
সজল জলদ সহ যেন সৌদামিনী।।
জয়ন্ত নামেতে কাক ছিল সে আকাশে।
দেখিয়া সীতার রূপ আসে সীতা-পাশে।।
অচেতন হইল ধরিতে নারে মন।
দুই নখে আঁচড়ে, সীতার দুই স্তন।।
উড়িয়া চলিল কাক পাইয়া তরাস।
ছয় মাসের পথ গেল, পর্ব্বত কৈলাস।।
ডাকেন জনকসুতা ভয়ে উচ্চৈঃস্বরে।
শ্রীরাম বলেন, ভাই সীতাকে কে মারে।।
শুনিয়া রামের কথা কহেন লক্ষ্মণ।
সীতারে প্রহার করে আছে কোন্ জন।।
সুমিত্রা অধিক সীতা ঠাকুরাণী মা।
পলাইয়া গেল কাক আঁচড়িয়া গা।।
দেখিতে না পাই কাক, গেল কোন্ খানে।
বাণেতে বিন্ধিয়া তারে মারিব পরাণে।।
হেনকালে রামেরে বলেন দেবী সীতা।
আঁচড়িয়া গেল কাক, হয়েছি ব্যথিতা।।
কাক মারিবারে রাম পূরেন সন্ধান।
যে দেশে চলিল কাক, তথা যায় বাণ।।
কৈলাস ছাড়িয়া কাক স্বর্গপুরে যায়।
মারিতে রামের বাণ পাছু পাছু ধায়।।
ইন্দ্রের নিকটে কাক লইল শরণ।
রামের ঐষিক বাণ হইল ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ-বেশেতে গেল সে ইন্দ্রের ঠাঁই।
কহিলেক আমি যে জয়ন্ত কাক চাই।।
করিয়াছে মন্দকর্ম্ম বধিব জীবন।
রাখিবে যে জন কাক, তাহারি মরণ।।
রাখিতে নারিল কাকে দেব পুরন্দর।
আনিয়া দিলেন কাকে বাণের গোচর।।
জয়ন্তেরে দেখি রোষে শ্রীরামের বাণ।
বিন্ধিয়া করিল তার এক চক্ষু কাণ।।
শ্রীরামের কাছে দিল বিন্ধি এক আঁখি।
করুণাসাগর রাম না মারেন পাখী।।
শ্রীরাম বলেন, সীতা দেখ অপমান।
যে চক্ষে দেখিল সেই চক্ষু হৈল কাণ।।
অপমান পেয়ে কাক গেল নিজ দেশে।
রচিল অযোধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাসে।।