০৫. ভরতকে রাজ্য দান ও শ্রীরামচন্দ্রকে বনবাস দেওনার্থে দশরথের নিকটে কৈকেয়ীর প্রার্থনা

কুঁজী বলে, কৈকেয়ী বিলম্ব নাহি সাজে।
রাম রাজা হইলে নহিবে কোন কাজে।।
যাবৎ না দেয় রাজা রামে সিংহাসন।
তাবৎ রাজার ঠাঁই কর নিবেদন।।
এক্ষণে আসিবে রাজা তোমা সম্ভাষণে।
যেরূপ কহিবা তাহা চিন্তা কর মনে।।
শুনিয় কুঁজীর বাক্য কৈকেয়ী সেকালে।
আভরণ ফেলাইয়া লুটে ভূমিতলে।।
হেথা দশরথ রাজা হরষিত মনে।
চলিলেন কৌতুকে কৈকেয়ী সম্ভাষণে।।
ভাবিলেন সম্ভাষিয়া আসিয়া সত্বর।
শ্রীরামে করিব আমি ছত্র দণ্ডধর।।
নাহি গেলে কৈকেয়ী করিবে অনুযোগ।
ধন জন বিফল আমার রাজ্যভোগ।।
দশরথ নৃপতির নিকট মরণ।
ঘরে ঘরে কৈকেয়ীরে করে অন্বেষণ।।
যে ঘরে কৈকেয়ীদেবী লোটে ভূমি পরে।
বিধির নির্ব্বন্ধ রাজা গেল সেই ঘরে।।
পূর্বজ্ঞানে গেল রাজা না জানে প্রমাদ।
গড়াগড়ি যায় রাণী করিছে বিষাদ।।
সরল হৃদয় রাজা এত নাহি বুঝে।
অজগর সর্প যেন কৈকেয়ী গরজে।।
দশরথ অতি বৃদ্ধ কৈকেয়ী যুবতী।
কৈকেয়ী বিহনে তাঁর আর নাহি গতি।।
কৈকেয়ী যুবতী নারী, দশরথ বুড়া।
বুড়ার যুবতী নারী প্রাণ হৈতে বাড়া।।
প্রাণের অধিক রাজা কৈকেয়ীরে দেখে।
প্রাণ উড়ে যায় রাজার কৈকেয়ীর দুঃখে।।
ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসেন কম্পিত অন্তরে।
বনে মৃগ কাঁপে যেন বাঘিনীর ডরে।।
কি হেতু করিলে ক্রোধ, বল কার বোলে।
কোন্ ব্যাধি শরীরে, লোটাও ভূমিতলে।।
ব্যাধি পীড়া হয় যদি তোমার শরীরে।
বৈদ্য আনি সুস্থ করি, বলহ আমারে।।
পৃথিবীমণ্ডলে আমি বসুমতী-পতি।
আমার সমান রাজা নাহি গুণবতি।।
শুনিয়া আমার নাম দেব ডরে কাঁপে।
ত্রিভুবনে দ্বারে খাটে আমার প্রতাপে।।
সকল পৃথিবী মধ্যে মম অধিকার।
ধন জন যত আছে সকলি তোমার।।
কোন্ কার্য্যে কৈকেয়ী করহ অভিমান।
আজ্ঞা কর তাহাই তোমারে করি দান।।
এত যদি কৈকেয়ী রাজার পায় আশ।
পূর্ব্বকথা তাঁর আগে করিল প্রকাশ।।
রোগ পীড়া নহে মোর পাই অপমান।
আগে সত্য কর, তবে পিছে মাগি দান।।
কৈকেয়ী প্রমাদ পাড়ে রাজা নাহি জানে।
সত্য করে দশরথ প্রিয়ার বচনে।।
মহাপাশ লাগে যেন বনে মৃগ ঠেকে।
প্রমাদ পড়িবে, রাজা পাছু নাহি দেখে।।
ভূপতি বলেন, প্রিয়ে নিজ কথা বল।
সত্য করি যদ্যপি তোমারে করি ছল।।
যেই দ্রব্য চাহ তুমি তাহা দিব দান।
আছুক অন্যের কাজ, দিতে পারি প্রাণ।।
কৈকেয়ী বলেন সত্য করিলা আপনি।
অষ্টলোকপাল সাক্ষী, শুন সত্যবাণী।।
নক্ষত্র ভাস্কর চন্দ্র যোগ তিথি বার।
রাত্রি দিবা সাক্ষী হও সকল সংসার।।
একাশদ রুদ্র সাক্ষী, দ্বাদশ আদিত্য।
স্থাবর জঙ্গম সাক্ষী যারা আছে নিত্য।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল শুনহ বাপ ভাই।
সবে সাক্ষী, রাজার নিকটে বর চাই।।
স্মরণ করহ রাজা যে আমার ধার।
পূর্ব্বে ছিল তাহা শোধি সত্যে হও পার।।
যুদ্ধে তব হয়েছিল ক্ষত কলেবর।
সেবিলাম, তাহে দিতে চেয়েছিলে বর।।
করিলাম পুনর্ব্বার বিস্কোট তারণ।
তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাহিলা রাজন।।
তবে আমি বলিলাম তোমার গোচর।
কুঁজী যবে বর চাহে তবে দিও বর।।
দুই বারে দুই বর আছে তব ঠাঁই।
সেই দুই বার রাজা এইক্ষণে চাই।।
এক বরে ভরতেরে দেহ সিংহাসন।
আর বরে শ্রীরামেরে পাঠাও কানন।।
চতুর্দ্দশ বৎসর থাকুক রাম বনে।
ততকাল ভরত বসুক সিংহাসনে।।
দুরন্ত বচনে রাজা হইল কম্পিত।
অচেতন হইলেন নাহিক সম্বিত।।
কৈকেয়ী বচনে যেন শেল বুকে ফুটে।
চেতন পাইয়া রাজা ধীরে ধীরে উঠে।।
মুখে ধূলা উঠে, রাজা কাঁপিছে অন্তরে।
হতজ্ঞান দশরথ বলে ধীরে ধীরে।।
পাপীয়সি আমারে বধিতে তব আশা।
স্ত্রী পুরুষ যত লোক কহিবে কুভাষা।।
রাম বিনা আমার নাহিক অন্য গতি।
আমারে বধিতে তোরে কে দিল দুর্ম্মতি।।
রাজ্য ছাড়ি যখন শ্রীরাম যাবে বন।
সেই দিনে সেইক্ষণে আমার মরণ।।
স্বামী যদি থাকে, তবে নারীর সম্পদ।
তিন কুল মজাইলি স্বামী করি বধ।।
স্বামী বধ করিয়া পুত্রেরে দিবি রাজ্য।
চণ্ডাল হৃদয় তুই, করিলি কি কার্য্য।।
এই কথা ভরত যদ্যপি আসি শুনে।
আপনি মরিবে, কি মারিবে সেইক্ষণে।।
মাতৃবধ ভয়ে যদি না লয় পরাণ।
করিবে তথাপি তোর বহু অপমান।।
বিষদন্তে দংশিলি রে কাল ভুজঙ্গিনী।
তোরে ঘরে আনিয়া মজিলাম আপনি।।
কোন্ রাজা আছে হেন কামিনীর বশ।
কামিনীর কথাতে কে ত্যজিবে ঔরস।।
দশ হাজার বর্ষ লোক জীয়ে ত্রেতাযুগে।
নয় হাজার বর্ষ রাজ্য করি নানা ভোগে।।
আর এক হাজার বৎসর আয়ু আছে।
পরমায়ু থাকিতে মজিলাম তোর কাছে।।
পরমায়ু থাকিতে বধিলে মম প্রাণ।
পায়ে পড়ি কৈকেয়ী করহ প্রাণদান।।
কৈকেয়ীর পায়ে রাজা লোটে ভূমিতলে।
সর্ব্বাঙ্গ তিতিল তাঁর নয়নের জলে।।
প্রভাতে বসিব কল্য সভা-বিদ্যমানে।
পৃথিবীর যত রাজা আসিবে যে স্থানে।।
অধিবাস রামের হইল সবে জানে।
কি বলিয়া ভাণ্ডাইব সে সকল জনে।।
ক্ষমা কর কৈকেয়ী করহ প্রাণ রক্ষা।
নিজ সোহাগের তুমি বুঝিলা পরীক্ষা।।
স্ত্রীবাধ্য না হয় কেহ আমার এ বংশে।
তোর দোষ নাহি, আমি মজি নিজ দোষে।।
স্ত্রীবশ যে জন তার হয় সর্ব্বনাশ।
গাইল অযোধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।