৫৯. শ্রীরামচন্দ্র কর্ত্তৃক তিন কোটি রাক্ষস বধ ও মুনিগণের যজ্ঞ সমাধান এবং হরধনু ভাঙিবার জন্য শ্রীরামচন্দ্রের মিথিলায় গমন

শ্রীরাম বলেন প্রভু করি নিবেদন।
কেমনে হইল মুক্ত সহস্রলোচন।।
মুনি বলিলেন শুন দশরথ-সুত।
হইলেন বাসব সহস্র যোনিযুত।।
লজ্জাযুক্ত হইলেন দেব পুরন্দর।
কি হবে উপায় সব ভাবেন অমর।।
অশ্বমেধ করিলেন তখন বাসব।
যোনি ছিল, ঘুচিয়া হইল নেত্র সব।।
এইরূপে কথাবার্ত্তা কহিতে কহিতে।
তিন জনে চলিলেন গঙ্গার কূলেতে।।
পাষাণ হইল মুক্ত কৈবর্ত্ত তা শুনে।
নৌকাখানি লইয়া সে পলাইল বনে।।
কৈবর্ত্তকে ডাকিয়া কহেন তপোধন।
না আইলে ভস্ম আমি করিব এখন।।
এত শুনি কৈবর্ত্তের উড়িল পরাণ।
আসিয়া মুনির কাছে দিল দরশন।।
মুনি বলিলেন বলি কৈবর্ত্ত তোমারে।
গঙ্গায় করহ পার এ তিন জনারে।।
কাতরে কৈবর্ত্ত কহে করিয়া বিনয়।
নৌকাখানি জীর্ণ মম শত ছিদ্রময়।।
তবে যদি আজ্ঞা কর মোরে তপোধন।
স্কন্ধে লয়ে করি পার যাহ তিন জন।।
কোথা হৈতে আইল এ পুরুষ সুন্দর।
পায়ের পরশে মুক্ত করিল প্রস্তর।।
এ কথা শুনিয়া আমি সভয় অন্তর।
চরণ-ধূলিতে মুক্ত হইল পাথর।।
নৌকা মুক্ত হয় যদি লাগে পদধূলি।
দিক দিয়া পুষিব আমি মম পোষ্যগুলি।।
করিবেক গৃহিণী আমারে গালাগালি।
বলিবে মুনির বোলে নৌকা হারাইলি।।
যদি বল, শ্রীরামের চরণ ধোয়াই।
নতুবা লাগিলে ধূলি তরণী হারাই।।
তরণীতে ত্বরায় করেন আরোহণ।
ধোয়াইল কৈবর্ত্ত শ্রীরামের চরণ।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্র এই তিনে।
পাটনী করিয়া পার গেল ভব জিনে।।
শ্রীরাম বলেন শুন প্রাণে লক্ষ্মণ।
ইহার সমান নাহি দেখি অকিঞ্চণ।।
শুভদৃষ্টে শ্রীরাম চাহেন তার পানে।
হইল সুবর্ণজয়ী তরণী তৎক্ষণে।।
হইলেন গঙ্গা পার শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
কত দূরে মিথিলা জিজ্ঞাসেন তখন।।
মুনি বলিলেন রাম চলহ সত্বর।
এখন মিথিলা আছে তিন ক্রোশান্তর।।
পার হয়ে যান রাম সহিত লক্ষ্মণ।
কহিলে লাগিল দেখি মুনি-পত্নীগণ।।
দ্বাদশ বর্ষের রাম শিরে পঞ্চঝুঁটি।
মারিবেন রাক্ষস কেমনে তিন কোটি।।
কোন্ ভাগ্যবতী পুত্র ধরিয়াছে গর্ভে।
কত শত পুণ্য সে যে করিয়াছে পূর্ব্বে।।
মুনিগণ আইলেন করিতে কল্যাণ।
আশিস্ করেন সবে হাতে দুর্ব্বা ধান।।
শ্রীরামের নিরখিয়া যত মুনিগণ।
আনন্দ-সাগরে মগ্ন সহ তপোধন।।
সে দিন বঞ্চিয়া সুখে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
প্রাতঃকালে মুনিরে করেন নিবেদন।।
যে কার্য্য করিতে আইলাম দুই ভাই।
সেই কার্য্যে অনুমতি করহ গোসাঞি।।
মুনিরা বলেন, শুন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
এখনি করিব যজ্ঞ সকল ব্রাহ্মণ।।
আমরা যখন করি যজ্ঞ আরম্ভণ।
রক্তবৃষ্টি করে দুষ্ট তাড়কা-নন্দন।।
না পারি করিতে ক্রোধ আমরা ব্রাহ্মণ।
যদি ক্রোধ করি হয় ধর্ম্ম উল্লঙ্ঘন।।
শ্রীরাম বলেন, প্রভু করি নিবেদন।
অবিলম্বে কর যজ্ঞ-ক্রিয়া আরম্ভণ।।
শুনিয়া রামের কথা তপস্বী সকলে।
খোলা কুশ লইয়া গেলেন যজ্ঞস্থলে।।
কেহ ব্যাঘ্রচর্ম্মে বৈসে, কেহ কুশাসনে।
বসিলেন পূর্ব্বমুখ হইয়া আসনে।।
বেদপাঠ করিতে লাগিলেন সকলে।
মন্ত্রের প্রভাবেতে আপনি অগ্নি জ্বলে।।
যজ্ঞের যতেক ধূম উড়য়ে আকাশে।
দেখিয়া রাক্ষসগণ মনে মনে হাসে।।
আমরা জীয়ন্তে থাকি মুনি যজ্ঞ করে।
তিন কোটি নিশাচর সাজিয়া চল রে।।
তিন কোটি লইয়া মারীচ নিশাচর।
সাজিয়া আইল তারা যজ্ঞের ভিতর।।
সঙ্গেতে শ্রীরামেরে জানান মুনিগণ।
আসিছে রাক্ষসগণ কর নিরীক্ষণ।।
দেখিলেন রঘুবীর নিশাচরগণ।
ব্যপিয়াছে বসুমতী না যায় গণন।।
কুৎসিত বচন বলে বৃক্ষতলে বসি।
ফল-মূল কাড়ি লয় ভাঙ্গিছে কলসী।।
ঠারে ঠোরে কহেন সকল মুনিগণ।
সময় এসেছে তব কমললোচন।।
ধরিলেন বিশ্বম্ভর মূর্ত্তি নারায়ণ।
নির্ব্বংশ করিতে দুষ্ট নিশাচরগণ।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ করে ধরি ধনুর্ব্বাণ।
আকর্ণ পূরিয়া বাণ করেন সন্ধান।।
পাদপ পাথর লয়ে আইল বিস্তর।
ভয়ঙ্কর কলেবর যত নিশাচর।।
কটাক্ষেতে নিক্ষেপ করেন রাম শর।
তাহাতে পড়িল এক কোটি নিশাচর।।
এক কোটি পড়ে যদি রণের ভিতর।
দুই কোটি আইল লইয়া ধনুঃশর।।
হীরা বাণ জীরা বাণ অতি খরধার।
মারেন ইন্দ্রের বাণ কৌশল্যা-কুমার।।
কুরূপা সুরূপা বাণ পাশুপত আর।
রাক্ষস উপরে পড়ে বলি মার মার।।
গলাতে নির্ম্মিত মণি মাণিকের কাঁঠি।
রাম-বাণে পড়িল রাক্ষস দুই কোটি।।
শ্রীরামেরে আশীর্ব্বাদ করে মুনিগণ।
সবে বলে জয়ী হক শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
ব্রাহ্মণের আশিসে না হয়, হেন নাই।
মার মার করিয়া যুঝেন দুই ভাই।।
বরুণাস্ত্র পাশ বায়ু বাণ কালানল।
এড়িলেন বহু রাম সমরে অটল।।
মারিলেন শ্রীরাম গন্ধর্ব্ব নামে শর।
রামময় দেখিল সকল নিশাচর।।
আপনা আপনি সব কাটাকাটি করে।
সকল দেবতা দেখি হাসয়ে অম্বরে।।
শ্রীরাম করেন যুদ্ধ কাঁপাইয়া মাটি।
রাম-বাণে পড়িল রাক্ষস তিন কোটি।।
তিন কোটি পড়ে যদি রণের ভিতর।
রামের উপরে মারে চোখ চোখ শর।।
নিরন্তর বাণ মারে নিশাচরগণ।
সহিষ্ণুতা কত করিবেন দুই জন।।
হইলেন জর্জ্জর বাণেতে রঘুবীর।
শোণিতে প্লাবিতে অতি শ্যামল শরীর।।
আশীর্ব্বাদ করেন সকল দ্বিজচয়।
হউক রামের জয়, রাক্ষসের ক্ষয়।।
ব্রাহ্মণের আশীর্ব্বাদে বাড়িল যে বল।
মার মার করিয়া গেলেন রণস্থল।।
আকর্ণ পূরিয়া বাণ মারেন রাঘব।
বরিষয়ে বর্ষায় যেমন মেঘ সব।।
অর্দ্ধচন্দ্র বিশিখের কি কহিব কথা।
তাহাতে কাটেন রাম দুই পাত্র মাথা।।
দুই পাত্র পড়ে যদি রণের ভিতর।
মারীচ রুষিল তবে তাড়কা কোঙর।।
কোথা গেল রাম, কোথা গেল বা লক্ষ্মণ।
তিন কোটি রাক্ষস মারিল কোন্ জন।।
শ্রীরাম বলেন তাড়কার হন্তা যেই।
তিন কোটি রাক্ষস মারিল রণে সেই।।
মারীচ শুনিয়া তাহা কুপিল অন্তরে।
ঘন ঘন বাণমারে রামের উপরে।।
রামের উপরে বাণ পড়িতেছে নানা।
বৈশাখ মাসেতে যেন পড়য়ে ঝঞ্ঝনা।।
মহাবীর রামচন্দ্র না হন কাতর।
শরবৃষ্টি করেন যেমন জলধর।।
মারীচের রক্ষা করে ভাবি দেবগণ।
মারীচ মরিলে নহে সীতার হরণ।।
বজ্রবাণ বলি রাম করিল স্মরণ।
আসিয়া সে বজ্রবাণ দলি দরশন।।
শ্রীরামের বজ্রবাণ বজ্র সে হুড়ুকে।
নির্ঘাত পড়িল দুষ্ট মারীচের বুকে।।
বুকে বাণ বাজিয়া নাটাই যেন ঘুরে।
ডানা ভাঙ্গা পক্ষী যেন উড়ে ধীরে ধীরে।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে যায় মারীচ কাতর।
সাত দিনে উত্তরিল লঙ্কার ভিতর।।
বহু জীব খাইয়া মারীচ লঙ্কাবাসী।
বিবেক সংসার ত্যজি হইল সন্ন্যাসী।।
কহে, যদি মরিতাম বালকের বাণে।
কি করিত দস্যুবৃত্তি, কি করিত ধনে।।
শিরে জটা ধরিয়া বাকল পরিধান।
শয়নে স্বপনে করে রামময় ধ্যান।।
বটবৃক্ষতলে তপ কৈল আরম্ভণ।
রাম বিনা মারীচের অন্যে নাহি মন।।
হেথা যজ্ঞ মুনিরা করিল সমাধান।
আশিস্ করেন রামে দিয়া দূর্ব্বা ধান।।
যজ্ঞ অবশেষে যেই ফল-মূল ছিল।
খাইতে সে সব ফল শ্রীরামেরে দিল।।
সে রাত্রি বঞ্চেন রাম মুনির আশ্রমে।
প্রভাতে একত্র হন মুনিগণ ক্রমে।।
সভাতে বসিয়া যুক্ত করে সর্ব্বজন।
সামান্য মনুষ্য নহে রাম নারায়ণ।।
যিনি যজ্ঞেশ্বর, যজ্ঞ রাখিলেন তিনি।
দশরথ-পুণ্যফলে অবতীর্ণ ইনি।।
রাক্ষসের ভয় কর কি কারণ আর।
রাক্ষস বধার্থে হরি স্বয়ং অবতার।।
করিলেন এই পণ জনক ভূপতি।
রাম বিনা তাহাতে না হবে অন্য কৃতী।।
বিশ্বামিত্র বলেন শুনহ রঘুবর।
মিথিলাতে হইবে সীতার স্বয়ম্বর।।
করেছেন প্রতিজ্ঞা এ জানকীর পিতা।
হরধনু ভাঙ্গিবে যে তাকে দিবে সীতা।।
কত শত ভূপতি আইসে আর যায়।
দেখিয়া হরের ধনু হারিয়া পলায়।।
দেখিলাম যে তোমারে বীর বলবান।
মনে বুঝি ধনুক করিবা দুইখান।।
শ্রীরাম বলেন আজ্ঞা কর যে এখন।
তাহা করি, তব আজ্ঞা লঙ্ঘে কোন্ জন।।
এ কথা কহেন যদি কৌশল্যা-নন্দন।
রামেরে লইয়া যান সকল ব্রাহ্মণ।।
হাতে ধনু করি যান শ্রীরাম লক্ষণ।
আগে পাছে চলিলেন সকল ব্রাহ্মণ।।
বিশ্বামিত্র বলিলেন শুন রঘুবর।
অগ্রেতে গমন করি জনকের ঘর।।
এ কথা শুনিয়া রাম বলেন তাঁহারে।
আগে নিয়া বার্ত্তা দেহ জনক রাজারে।।
বিশ্বামিত্রে দেখিয়া উঠিল সর্ব্বজন।
আইস বলিয়া দিল বসিতে আসন।।
মুনি বলিলেন শুন জনক রাজন।
তব ঘরে আইলেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
তাড়কারে মারিলেন হেলায় যে জন।
অহল্যার করিলেন শাপ বিমোচন।।
কৈবর্ত্তকে তারিলেন সুকৃপা দর্শনে।
তিন কোটি রাক্ষস মরিল যাঁর বাণে।।
সেই রাম দ্বাদশ বৎসর বয়ঃক্রম।
লক্ষ্মণ তাঁহার ভাই দুই অনুপম।।
এ কথা শুনিয়া রাজা রাজসভা-জন।
কহিল সীতার বর আইল এখন।।
আইল সমস্ত লোক করিতে দর্শন।
বন্ধু-কর ধরিয়া ধাইল অন্ধ-জন।।
সবে বলে দেখিব লক্ষ্মণ আর রাম।
মিথিলার সব লোক ছাড়ে গৃহকাম।।
উভ করি বান্ধিয়াছে শিরে পঞ্চঝুঁটি।
গলাতে নির্ম্মিত মণি-মাণিক্যের কাঁঠি।।
বিশ্বামিত্র লৈয়া যান জনকের ঘরে।
অনুব্রজে রামেরে লইল সমাদরে।।
উল্লাসেতে কহেন জনক নৃপবর।
আইল সীতার বর এত দিন পর।।
কৌশিক বলেন শুন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
জনকেরে প্রণাম করহ দুই জন।।
গুরুবাক্য অনুসারে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
করিলেন শ্রীরাম রাজাকে সম্ভাষণ।।
আলিঙ্গণ দিলেন জনক দোঁহাকারে।
ভাসিলেন তখন আনন্দ-পারাবারে।।
মহাযোগী জনক জানেন অভিপ্রায়।
গোলোক ছাড়িয়া হরি দেখি মিথিলায়।।
ধূর্জ্জটি দুর্জ্জয় ধনু আছে যেইখানে।
সভাসহ গেল সেই স্বয়ম্বর-স্থানে।।
হেনকালে জনক বলেন কুতূহলে।
সভায় বসিয়া কথা শুনেন সকলে।।
যে জন শিবের ধনু ভাঙ্গিবারে পারে।
সীতা নামে কন্যা আমি সমর্পিব তাঁরে।।
এ কথা শুনিয়া রাম কমললোচন।
ধনুকের সন্নিকটে করেন গমন।।
হেনকালে সীতাদেবী সহ সখীগণ।
অট্টালিকা পরে উঠি করে নিরীক্ষণ।।
জানকী বলেন, সখী করি নিবেদন।
কোন্ জন রাম বা লক্ষ্মণ কোন্ জন।।
সীতারে দেখায় সখীগণ তুলি হাত।
দূর্ব্বাদলশ্যাম ঐ রাম রঘুনাথ।।
রামেরে দেখিয়া সীতা ভাবিলেন মনে।
পাছে হে বিরিঞ্চি করে বঞ্চিত এ ধনে।।
দেবগণে প্রার্থনা করেন সীতা মনে।
স্বামী করি দেহ রাম কমললোচনে।।
বাসনা পূরাও মম দেব গণপতি।
হর-হরি-সূর্য্য দেব দেবী ভগবতী।।
দেব-দেবী স্থানে সীতা করেন প্রার্থনা।
রামে পতি করে দিয়া পূরাও বাসনা।।
পিতার কঠিন পণ, রাম শ্যাম-তনু।
কি প্রকারে ভাঙ্গিবেন মহেশের ধনু।।
সীতার মানস জানি হৈল দৈববাণী।
পাবে রামে, গৃহে যাও জনক-নন্দিনী।।
দেবতার বাক্য কভু নায় খণ্ডন।
শ্রীরাম-সীতার বিভা কৃত্তিবাস কন।।