৫৮. শ্রীরাম কর্ত্তৃক তাড়কা রাক্ষসী বধ ও অহল্যার উদ্ধার

গুরুর চরণে রাম করিলেন নতি।
রামে লৈয়া বিশ্বামিত্র করিলেন গতি।।
তাড়কার বনে আসি দিল দরশন।
মুনি বলিলেন শুন ভাই দুইজন।।
এই পথে যাই ঘর তৃতীয় প্রহরে।
এই পথে তিন দিনে যাই মম ঘরে।।
তিন প্রহরের পথে কিন্তু ভয় করি।
তাড়কা রাক্ষসী আছে মহাভয়ঙ্করী।।
তাড়িয়া ধরিয়া খায় যত জীবগণ।
কোন্ পথে যাই বল শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
করিলেন রাম গুরু-বাক্যের উত্তর।
তিন দিন ফেরে কেন যাব মুনিবর।।
যদি সে রাক্ষসী পথে আইসে খাইতে।
বিচারে নাহিক দোষ তাহারে মারিতে।।
রামেরে কহেন বিশ্বামিত্র মুনিবর।
ও পথের নামে মোর গায়ে আসে জ্বর।।
তোমার বাসনা রাম না পারি বুঝিতে।
মোরে নিয়া যাহ বুঝি রাক্ষসের দিতে।।
যখন রাক্ষসী মোরে আসিবে তাড়িয়া।
আমারে এড়িয়া দোঁহে যাবে পলাইয়া।।
গুরুর বচনে হাসিলেন প্রভু রাম।
বিফল ধনুক ব্যর্থ ধরি রাম নাম।।
এক বাণ বিনা যে দ্বিতীয় বাণ ধরি।
তোমার দোহাই যদি তিন বাণ মারি।।
এইমত রঘুনাথ প্রতিজ্ঞা করিতে।
চলিলেন মুনি সে তাড়কা দেখাইতে।।
উভয় ভ্রাতার মধ্যে থাকি মুনিবর।
দূর হৈতে দেখালেন তাড়কার ঘর।।
কর বাড়াইয়া তার ঘর দেখাইয়া।
অতি ত্রাসে মুনিবর যান পলাইয়া।।
শ্রীরাম বলেন ভাই মুনির সহিত।
শীঘ্র যাহ গুর এক যান অনুচিত।।
লক্ষ্মণ বলেন রামে যোড় করি হাত।
থাকুক সেবক সঙ্গে প্রভু রঘুনাথ।।
শুনিয়া সে সব কথা বড়ই বিষম।
একেলা কেমনে রাম করিবে বিক্রম।।
শ্রীরাম বলেন, ভাই ভয় নাহি মনে।
কি করিতে পারে ভাই রাক্ষসীর প্রাণে।।
সকল রাক্ষসী যদি হয় এক মেলি।
লঙ্ঘিতে না পারে মম কনিষ্ঠ অঙ্গুলি।।
গেলেন মুনির সঙ্গে লক্ষ্মণ তখন।
তাড়কার প্রতি রাম করেন গমন।।
বাম হাঁটু দিয়া রাম ধনু মধ্যখানে।
দক্ষিণ হস্তেতে গুণ দিলেন সে স্থানে।।
আঁটিয়া সে পীতবস্ত্র বান্ধিলেন রাম।
বামহাতে ধনুর্ব্বাণ দুর্ব্বাদলশ্যাম।।
প্রথমে দিলেন রাম ধনুকে টঙ্কার।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে লাগিল চমৎকার।।
শুয়েছিল রাক্ষসী সে সুবর্ণের খাটে।
ধনুক টঙ্কার শুনি চমকিয়া উঠে।।
বসিয়া রাক্ষসী সেই একদৃষ্টে চায়।
দূর্ব্বাদল-শ্যামরূপ দেখিল তথায়।।
উঠিয়া বলিল, সেই রাম বিদ্যমান।
ডাকিয়া বলিল, আজি লব তোর প্রাণ।।
ব্রাহ্মণের চর্ম্ম তার গায়ের কাপড়।
চলিতে তাহার বস্ত্র করে মড়মড়।।
ব্রাহ্মণের মুণ্ড তার কর্ণের কুণ্ডল।
মনুষ্যের মুণ্ডমালা গলার উপর।।
বসিতে আসন নাই ভাবে মনে মন।
ইহার চর্ম্মেতে হবে বসিতে আসন।।
রক্ত মাংস মুনির শরীরে নাহি পাই।
অস্থি চর্ম্ম সার মাত্র শুধু হাড় খাই।।
অপূর্ব্ব ইহার মাংস দিলেন বিধাতা।
হাসিলেন রাম, শুনি তাড়কার কথা।।
তাম্রবর্ণ দেখি তার গায়ে লোমাবলী।
দন্ত গোটা দেখি যেন লোহার শিকলি।।
বদন ব্যাদান করি আইলি খাইতে।
পাঠাইব তোরে আজি যমের ঘরেতে।।
মনুষ্য খাইয়া চেড়ী দেশ কৈলি বন।
তোর ডরে পথে নাহি চলে সাধুজন।।
শুনিয়া রামের বাক্য কুপিয়া অন্তরে।
নিকটে আসিয়া সে বিকটাকার ধরে।।
রামকে খাইতে চায় ডরে নাহি পারে।
শালগাছ উপাড়িলা আনিল হুঙ্কারে।।
শালগাছ উপাড়িয়া ঘন দিল পাক।
দূর দূর করিয়া তাড়কা দিল ডাক।।
তাহা দেখি রঘুনাথ এড়িলেন বাণ।
বাণাঘাত করিলেন গাছ খান খান।।
গাছ কাটা দেখিয়া কাঁপিয়া গেল মনে।
শিংশপার গাছ ধরি ঘন ঘন টানে।।
শিংশপার গাছ তোলে রামে মারিবারে।
তার মুখ ভেদিলেন রাম এক শরে।।
তথাপি তাড়কা যায় রামে গিলিবারে।
মহাবীর তবু ভয় নাহি করে তারে।।
বাণের উপরে বাণ শব্দ ঠনঠনি।
বর্ষাকালে বিদ্যুতের যেন ঝনঝনি।।
শ্রীরামেরে ডাকিয়া বলিল দেবগণ।
বজ্রবাণে তাড়কার বধহ জীবন।।
বজ্রবাণ এড়ে রাম বজ্রের হুড়ুকে।
নির্ঘাৎ বাজিল বাণ তাড়কার বুকে।।
বুকে বাণ বাজিতে হইল অচেতন।
তাড়কা পড়িল গিয়া পঞ্চাশ যোজন।।
বিপরীত ডাক ছাড়ি ছাড়িলেক প্রাণ।
শব্দ শুনি বিশ্বামিত্র হৈল হতজ্ঞান।।
পাঠাইয়া তাড়কারে যমের সদন।
করিলেন রাম মুনির চরণ বন্দন।।
চেতন পাইয়া বলে গাধির নন্দন।
তাড়কা মারিলা বাছা কৌশল্যা-জীবন।।
শ্রীরাম বলেন, গুরু কি শক্তি আমার।
তাড়কারে বধিলাম প্রসাদে তোমার।।
মুনি বলিলেন শুন কৌশল্যা-নন্দন।
নিকটেতে দেখি গিয়া তাড়কা কেমন।।
তাড়কা দেখিতে মুনি করেন পয়ান।
মরেছে তাড়কা, তবু মুনি কম্পমান।।
তাড়কারে দেখিয়া ভাবেন মুনি মনে।
এমন বিকট মূর্ত্তি না দেখি নয়নে।।
তাড়কা মারিয়া রাম রাজীবলোচন।
পবনের জন্মভূমি করেন গমন।।
বিশ্বামিত্র কহে, শুন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
এইখানে হৈল ঊনপঞ্চাশ পবন।।
পবনের জন্মভূমি পশ্চাৎ করিয়া।
অহল্যার তপোবনে গেলেন চলিয়া।।
মুনি বলিলেন রাম কমললোচন।
পাষাণ উপরে পদ করহ অর্পণ।।
শুনিয়া বলেন রাম মুনির বচনে।
পাষাণেতে পদ দিব কিসের কারণে।।
মুনি বলিলেন শুন পুরাতন কথা।
সহস্র সুন্দরী সৃষ্টি করিলেন ধাতা।।
সৃজিলেন তা সবার রূপেতে অহল্যা।
ত্রিভুবনে সৌন্দর্য্য না ছিল তার তুল্যা।।
করিলেন অহল্যাকে বিবাহ গৌতম।
গৌতমের শিষ্য ইন্দ্র অতি প্রিয়তম।।
একদিন গৌতম গেলেন তপস্যায়।
গৌতমের বেশে ইন্দ্র প্রবেশে তথায়।।
অহল্যা গৌতমজ্ঞানে করে সম্ভাষণ।
আজি কেন সকালে ঘরেতে আগমন।।
ইন্দ্র বলে, তব রূপ হইল স্মরণ।
কেমনে করিব প্রিয়ে তপস্যাচরণ।।
মদন দহনে দগ্ধ হয় মম হিয়া।
নির্ব্বাণ করহ প্রিয়ে আলিঙ্গন দিয়া।।
পতিব্রতা নাহি লঙ্ঘে পতির বচন।
তখন শয়ন-গৃহে করিল গমন।।
গুরুপত্নী বলিয়া না করিল বিচার।
ধর্ম্মলোপ করিল বাসব অহল্যার।।
তপস্যা করিয়া মুনি আইলেন ঘরে।
অহল্যা আসন দিল অতি সমাদরে।।
গৌতম বলেন, প্রিয়ে জিজ্ঞাসি তোমারে।
শৃঙ্গারলক্ষণ কেন তোমার শরীরে।।
অহল্যা বলেন, প্রভু নিবেদি তোমারে।
আপনি করিয়া কর্ম্ম দোষহ আমারে।।
এ কথা শুনিয়া মুনি হেঁট কৈল তুণ্ডে।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে গৌতমের মুণ্ডে।।
জানিলেন ধ্যানেতে গৌতম মুনিবর।
জাতিনাশ করিল আসিয়া পুরন্দর।।
ইন্দ্র ইন্দ্র বলিয়া ডাকেন মুনিবর।
পুঁথি কাঁখে করিয়া আইল পুরন্দর।।
দিনান্তে অভুক্ত মুনি কুপিত অন্তরে।
দ্বিগুণ জ্বলিয়া কহিলেন পুরন্দরে।।
তোকে পড়াইলাম যে আমি শাস্ত্র নানা।
এতদিনে ভাল দিলি গুরুর দক্ষিণা।।
জাতি নষ্ট কৈলি তুই ওরে পুরন্দর।
যোনিময় হউক তোর সর্ব্ব কলেবর।।
অহল্যাকে শাপিলেন ক্রোধে মুনিবর।
কাননেতে তোর তনু হউক প্রস্তর।।
অহল্যা চরণে ধরি কহিল তখন।
কতকালে হবে মোর শাপ বিমোচন।।
অহল্যাকে কাতরা দেখিয়া তপোধন।
কহিলেন, যবে রাম দশরথ-ঘরে।
বিশ্বামিত্র লয়ে যাবে যজ্ঞ রাখিবারে।।
তোমার মাথায় পদ দিবেন যখন।
তখনি হইবে মুক্ত, না কর ক্রন্দন।।
ইহা শুনি লক্ষ্মণ বলেন শুন মুনি।
কেমনে দিবেন পদ, উনি যে ব্রাহ্মণী।।
বিশ্বামিত্র কহিলেন শুন রঘুবর।
ব্রাহ্মণী নহেন উনি এখন প্রস্তর।।
এ কথা শুনিয়া রাম কমললোচন।
তদুপরে করিলেন চরণ অর্পণ।।
তাহাতে হইল তার শাপ বিমোচন।
আহ্লাদিত শুনিয়া গৌতম তপোধন।।
অহল্যাকে দেখিয়া সানন্দ মহামুনি।
পুনর্ব্বার করিলেন পুষ্পের ছাউনি।।
শুন সবেওরে ভাই হৈয়া এক মন।
আদ্যকাণ্ডে গাইল অহল্যা-বিবরণ।।