৫২. সকল রাজা ও রাবণের ধনুক তুলিতে অপারক হইয়া পলায়ন

ধনুকের কথা যদি গেল দেশে দেশে।
জানকী-বিবাহ হেতু রাজা সব আসে।।
পৃথিবীতে আর যত রাজা মহত্তর।
একে একে আসে সব জনকের ঘর।।
আসিয়া সকল রাজা অহঙ্কার করে।
সবারে পাঠায় দেন ধনুকের ঘরে।।
জনক বলেন যেবা তুলিবে ধনুক।
তাঁরে সীতা কন্যা দিব পরম যৌতুক।।
ধনুক তুলিতে যত রাজপুত্র যায়।
দেখিতে সকল লোক পশ্চাৎ গোড়ায়।।
ঘরের দ্বারেতে গিয়া উকি দিয়া চায়।
তুলিবার শক্তি কোথা দেখিয়া পলায়।।
কত রাজা রাজপুত্র উদ্যত হইয়া।
ধনুক তুলিতে যায় বস্ত্র কাছঠিয়া।।
প্রাণপণে তারা ধনু টানাটানি করে।
তুলিবার সাধ্য কিবা, নাড়িতে না পারে।।
সুমেরু পর্ব্বত যেন ধনুখান তারি।
দিবে কি তাহাতে গুণ নাড়িতে না পারি।।
লজ্জা পেয়ে রাজা সব পলাইয়া যায়।
হাততালি দিয়া সব বালক গোড়ায়।।
পলাইয়া যায় সবে আপনার দেশে।
বিবাহ করিতে অন্য রাজগণ আসে।।
পথিমধ্যে দেখা হয় যে সবার সনে।
ধনুকের পরাক্রম তারা সব শুনে।।
দেখিবার কাজ নাই শুনিয়া ডরায়।
শুনিয়া শুনিয়া পথে অমনি পলায়।।
প্রত্যেক কহিলে হয় পুস্তক বিস্তর।
তিন কোটি রাজা গেল মিথিলা নগর।।
ধনুক তুলিতে না পারিল কোন জন।
লঙ্কায় থাকিয়া শুনে লঙ্কার রাবণ।।
অকম্পন প্রহস্ত মারীচ মহোদর।
চারি পাত্র লয়ে রথে চড়ে লঙ্কেশ্বর।।
আইল সকলে তারা মিথিলা ভুবন।
জনক শুনিল রাবণের আগমন।।
জনক বলেন, শুন পাত্র মিত্রগণ।
রাবণ আইল আজি হইবে কেমন।।
স্বেচ্ছাতে বিবাহ যদি না দিব রাবণে।
কাড়িয়া লইবে সীতা রাখে কোন্ জনে।।
চলিল জনক রাজা রাবণে আনিতে।
দেখিয়া রাবণ রাজা লাগিল হাসিতে।।
প্রহস্ত ডাকিয়া বলে রাবণ রাজারে।
জনক আইল দেখ লইতে তোমারে।।
দেয়িখা রাবণ তারে ভূমিতলে উলি।
দুই বাহু পসারিয়া করে কোলাকুলি।।
বসাইল রাবণ্যেরে দিব্য সিংহাসনে।
মিষ্টালাপ করিলেন বসিয়া দুজনে।।
জনক বলেন আজি সফল জীবন।
কোন্ কার্য্যে মহাশয় তব আগমন।।
দশানন বলে রাজা তব কন্যা সীতা।
আমারে করহ দন আমি সে গ্রহীতা।।
জনক বলেন ইহা সৌভাগ্য লক্ষণ।
তোমা বিনা পাত্র আর আছে কোন্ জন।।
আনিলেন ভৃগুরাম ধনু একখান।
হেন বীর নাহি যে তাহাতে দেয় টান।।
তুলিয়া ধনুকখান ভাঙ্গ গিয়া তুমি।
ধনুকের ঘরে সীতা সমর্পিব আমি।।
শুনিয়া সে দশমুখে হাসিল রাবণ।
আমার সাক্ষাতে বল ধনুক বিক্রম।।
কৈলাস তুলেছি আমি পর্ব্বত মন্দর।
তাহাকে জিনিয়া কি ধনুক হবে ভার।।
আগে সীতা আনিয়া আমারে কর দান।
যাত্রাকালে ভাঙ্গিয়া যাইব ধনুখান।।
জনক বলেন কর প্রতিজ্ঞা পূরণ।
দেখুক সকল লোক ধনুক-ভঙ্গন।।
প্রহস্ত বলেন শুন রাজা দশানন।
যার যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না কর কখন।।
ধনুক ভাঙ্গিলে রাজা জানকীর দিবে।
ইচ্ছাধীনে নাহি দেয় বলে কাড়ি লবে।।
দশমুখ বলে মামা রাখি তব কথা।
ধনুক ভাঙ্গিলে যেন না হয় অন্যথা।।
অহঙ্কার করিয়া চলিল লঙ্কেশ্বর।
দেখাইতে চলিল জনক নৃপবর।।
শুনিয়া ধাইল সবে মিথিলা নগর।
সবে বলে জানকীর আজি এল বর।।
যুবা বৃদ্ধ শিশু এক নাহি রহে ঘরে।
কৌতুক দেখিতে গেল রাজার মন্দিরে।।
একাশী যোজন ঘর অতি দীর্ঘতর।
একাদশ যোজন তাহার পরিসর।।
ধনুক পড়িয়া আছে তাহার ভিতরে।
আসিয়া রাবণ রাজা দাণ্ডাইল দ্বারে।।
দ্বারেতে দাঁড়ায়ে বীর উকি দিয়া চায়।
দেখিয়া দুর্জ্জয় ধনু অন্তরে ডরায়।।
মনে ভাবে আমার ঘুচিল জারিজুরি।
যে দেখি ধনুকখানি পারি কি না পারি।।
অন্তরে আতঙ্ক অতি মুকে আস্ফালন।
ধনুক তুলিতে যায় বীর দশানন।।
আঁটিয়া কাপড় বীর বান্ধিল কাঁকালে।
কুড়ি হস্তে ধরিল সে ধনু মহাবলে।।
আঁকড়ি করিয়া সে ধনুকখান টানে।
তুলিতে না পারে আর চায় চারিপানে।।
নাকে হাত দিয়া বলে কি করি উপায়।
কি হইবে মামা ধুন তুলা নাহি যায়।।
প্রহস্ত বলিল শুন রাজা লঙ্কেশ্বর।
লোক হাসাইলা আসি মিথিলা নগর।।
চিন্তা না করিহ তুমি না করিহ ডর।
গাত্রে বল করি আর একবার ধর।।
পুনশ্চ ধনুকখান টানাটানি করে।
তথাপি ধনুকখান নাড়িতে না পারে।।
দশগ্রীব বলে ধনু নাড়িতে না পারি।
প্রাণ যায় মামা, তবু তুলিতে না পারি।।
কৈলাস তুলিনু মামা পর্ব্বত মন্দর।
তাহারে জিনিয়া মামা ধনুকের ভার।।
এই যুক্তি মামা গো তোমার ঠাঁই মাগি।
সবাই মিলিয়া তুলি ধনুখান ভাঙ্গি।।
প্রহস্ত বলিল শুন বীর দশানন।
তবেত সীতার বর হবে কোন্ জন।।
পার বা না পার আর একবার টান।
যাক প্রাণ রাখ মান, এই বাক্য মান।।
রাবণ বলিল মামা শুন মোর বাণী।
তুলিতে না পারি শীঘ্র রথ আন তুমি।।
ঈষৎ হাসিয়া বলে প্রহস্ত তাহারে।
রথ লয়ে এই আমি রহিলাম দ্বারে।।
আরবার রাবণ ধনুকখান টানে।
তুলিতে না পারে, চায় প্রহস্তের পানে।।
কাঁকালেতে হাত দিয়া আকাশ নিরখে।
মনে ভাবে পাছে আসি ইন্দ্র বেটা দেখে।।
বুঝিয়া প্রহস্ত রথ দিল যোগাইয়া।
লাফ দিয়া রথে উঠে ধনুকে এড়িয়া।।
পলাইয়া চলিল লঙ্কার অধিকারী।
সকল বালক দেয় তারে টিটকারী।।
লঙ্কায় শঙ্কায় গেল লঙ্কার রাবণ।
আকাশে থাকিয়া দেখে যত দেবগণ।।
শ্রীলক্ষ্মীপতির লক্ষ্মী লবে কোন্ জন।
তুলিবেন ধনুক কেবল নারায়ণ।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কি কহিব শিক্ষা।
আদিকাণ্ড গাইল সীতার হৈল রক্ষা।।