৪৯. শ্রীরামের শাস্ত্র ও অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা

পঞ্চবর্ষ গত হলে হাতে দিল খড়ি।
পড়িতে পাঠান রাজা বশিষ্ঠের বাড়ী।।
কখগ আঠার ফলা বানান প্রভৃতি।
অষ্ট শব্দ পাঠ করিলেন রঘুপতি।।
ব্যাকরণ কাব্য শাস্ত্র পড়িলেন স্মৃতি।
অবশেষে পড়িলেন রাম চতুঃশ্রুতি।।
কোন শাস্ত্র নাহি হয় তাঁর অগোচর।
চৌদ্দ দিনে চতুঃষষ্টি বিদ্যাতে তৎপর।।
বিদ্যা পড়ি করিলেন গুরুকে প্রণাম।
অস্ত্রবিদ্যা সেইক্ষণে শিখিলেন রাম।।
প্রাতঃকালে চারি ভাই যান মালঘরে।
মল্লবিদ্যা শিখিল সকলে সমাদরে।।
গুলি দাঁড়া নিয়া রাম লাঠরি খেলান।
রামের বিক্রমে সব মালের পয়ান।।
রাম সঙ্গে কোন মাল নাহি ধরে তাল।
সুমেরু পর্ব্বতে যান করিতে সাতাল।।
সূর্য্যবংশী বালক ধনুক তাল জানে।
ফুলধনু হাতে রাম বেড়ান কাননে।।
ধনু হাতে করি রাম যারে এড়ে বাণ।
ত্রিভুবনে তাহার নাহিক পরিত্রাণ।।
দশরথ রাজার বিপক্ষ যত ছিল।
রামের বিক্রম দেখি সবে পলাইল।।
যতনে খেলেন রাম ফুলধনু হাতে।
একদিন বনে গেল লক্ষ্মণ সহিতে।।
মৃগ চাহি দুইজন বেড়ান কানন।
তখন মারীচ সঙ্গে হইল মিলন।।
কোন্খানে ছিল সে মারীচ নিশাচর।
মৃগরূপ হৈয়া গেল রামের গোচর।।
মৃগ দেখি রামের কৌতুক হৈল মন।
ধনুকে অব্যর্থ বাণ যুড়িল তখন।।
ছুটিল রামের বাণ তারা যেন খসে।
মহাভীত মারীচ পলায় মহাত্রাসে।।
শ্রীরামের বাণশব্দে ছাড়িল সে বন।
জনকের দেশে গেল মিথিলা ভুবন।।
রামের বিক্রম দেখি দেবগণ ভাষে।
এতদিনে রাবণ মরিবে অনায়াসে।।
সূর্য্য অস্ত গেল তথা খেলার বিরাম।
রণশ্রান্ত লক্ষ্মণেরে দেখিলেন রাম।।
মলিন হইয়া গেল লক্ষ্মণের মুখ।
দেখিয়া শ্রীরাম পান অন্তরেতে দুঃখ।।
একদিন দুঃখে ভাই হইল এমন।
কেমনে মারিয়া বৈরী রাখিবা ব্রাহ্মণ।।
আমলকী ফল পাড়ি দেন তাঁর মুখে।
ক্ষুধা তৃষ্ণা দূরে গেল খান মনঃসুখে।।
হেনকালে দেখেন নিকটে সরোবর।
নানা পক্ষী জলে আছে করে কলস্বর।।
এমন সময়ে ব্রহ্মা কন পুরন্দরে।
জন্মেন আপনি হরি দশরথ-ঘরে।।
নররূপী আপনাকে বিস্মৃত আপনি।
রাবণ মারিতে মাত্র অবতীর্ণ তিনি।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ তিনি থাকিবেন বনে।
ফল মূলাহারে যুদ্ধ করিবে কেমনে।।
মৃণাল ভিতরে তুমি রাখ গিয়া সুধা।
সুধাপানে রামের না লাগিবেক ক্ষুধা।।
এই আজ্ঞা পাইলেন দেব পুরন্দর।
রাখিয়া গেলেন সুধা মৃণাল ভিতর।।
হেনকালে লক্ষ্মণেরে বলেন শ্রীরাম।
মৃণাল তুলিয়া আন করি জলপান।।
লক্ষ্মণ আনিয়া দিল শ্রীরামের হাতে।
দুই ভাই সুধা খান মৃণাল সহিতে।।
ক্ষুধা তৃষ্ণা দূরে গেল সুস্থ হৈল মন।
বৃক্ষপত্র পাতিয়া যে করিলা শয়ন।।
পরিশ্রমে সুনিদ্রা হইল বৃক্ষতলে।
আছেন শ্রীরাম যেন শুয়ে মাতৃকোলে।।
না দেখিয়া শ্রীরামেরে হইয়া কাতর।
আস্তে ব্যস্তে গেল রাণী রাজার গোচর।।
হেথা রাজা বহুক্ষণ রামে না দেখিয়া।
মনে সুখ নাহি যেন অজ্ঞান হইয়া।।
সবারে বিদায় দিয়া গেলেন আবাসে।
রামেরে দেখিব বলি কৌশল্যার পাশে।।
দুইজন পথেতে হইল দরশন।
চিন্তিত হইয়া রাণী জিজ্ঞাসে তখন।।
প্রস্তুত আছয়ে ঘরে খাদ্য নানাবিধি।
বহুক্ষণ রামে কেন না দেখি সন্নিধি।।
দশরথ বলে রাণী কি কহিলা কথা।
দেখিতে না পাই রাম তারা গেল কোথা।।
বুঝি রাম আছে বা কৈকেয়ী-আবাসে।
ধেয়ে গিয়া উভয়ে কৈকেয়ীরে জিজ্ঞাসে।।
আজি আমি দেখি নাই শ্রীরামের মুখ।
প্রাণ নাহি রহে মোর বিদরিছে বুক।।
কৈকেয়ী বলিল আমি কিছু নাহি জানি।
আজি হেথা নাহি দেখি রাম গুণমণি।।
আজি বুঝি ভুলিয়া রহিল কোনখানে।
লক্ষ্মণ যে স্থানে আছে রাম সেই স্থানে।।
ভরতের সহিত হেথা মিলি শত্রুঘ্ন।
অযোধ্যা-নগরে ভ্রমে ভাই দুইজন।।
যেই যেই বালক খেলায় তাঁর সনে।
তাহারে জিজ্ঞাসে রাম আছে কোন্ খানে।।
শুনিয়া সকলে কহে শুন রাজরাণী।
কোথা রাম কোথায় লক্ষ্মণ নাহি জানি।।
কৌশল্যা সুমিত্রা আর কৈকেয়ী কামিনী।
ডম্বুর হারায়ে যেন ফুকারে বাঘিনী।।
হৃদে হানে দশরথ ভালে মারে ঘাত।
কোথা গেলে পাব আমি রাম রঘুনাথ।।
অন্ধক মুনির শাপ ঘটিল এখন।
রাম না দেখিয়া মম না রহে জীবন।।
পুত্রশোকে মৃত্যু আজি সৃজিল বিধাতা।
রামে নাহি দেখি যদি মরণ সর্ব্বথা।।
দিবসে সকল দেখি ঘোর অন্ধকার।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে বুঝি না দেখিব আর।।
এইমত কান্দে রাণী বেলা অবশেষে।
হেনকালে দুই ভাই অযোধ্যা প্রবেশে।।
বনপুষ্প ভূষিত ধনুক বামহাতে।
নাচিতে নাচিতে যান লক্ষ্মণের সাথে।।
ভরত শত্রুঘ্ন গিয়া কহে কৈশল্যারে।
হের মাতা, আইলেন রাম পুরদ্বারে।।
তার মুখে এই বাক্য শুনিতে শুনিতে।
বাহির হইল রাণী শ্রীরামে দেখিতে।।
ধেয়ে দশরথ রাজা রামে করে বুকে।
এক লক্ষ চুম্ব দিল তার চাঁদমুখে।।
অন্ধকের শাপ মনে করে ধুক্ ধুক্।
কি জানি বা হন কবে বিধাতা বিমুখ।।
কৌশল্যা ধাইয়া গিয়া রামে কৈল কোলে।
এক লক্ষ চুম্ব দিল বদন-কমলে।।
দরিদ্রের নিধি তুমি নয়নের তারা।
পলকে প্রলয় ঘটে যদি হই হারা।।
ভরত শত্রুঘ্ন তবে দেখেন শ্রীরাম।
দুই ভাই আসি রামে করিল প্রণাম।।
মায়ের আলয়ে রাম করিল ভোজন।
রাজরাণী হইলেন সুস্থির তখন।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের মধুর ভণিত।
শ্রীরামের অরণ্য-বিহার সুললিত।।