৪২. শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম বিবরণ

হেথা তিন রাণী চরু করিল ভক্ষণ।
কোটি সূর্য্য জিনি সেই তিনের বরণ।।
হইয়াছিলেন বৃদ্ধা শিরে পাকা কেশ।
চরুর ভক্ষণে যেন প্রথম বয়েস।।
বিধাতা সকল মায়া করেন ঘটন।
এককালে ঋতুমতী হৈল তিনজন।।
দশরথ জানিলেন এ সব সন্দর্ভ।
ঋতুর লক্ষণে জানা গেল সেই গর্ভ।।
এইমত তিন গর্ভ বাড়ে দিনে দিনে।
দুইমাসে গর্ভ জানা গেল সুলক্ষণে।।
চারিমাসে গর্ভেতে প্রতীত হৈল মন।
পঞ্চমাস গর্ভেতে শুনিল ত্রিভুবন।।
প্রথম গর্ভেতে লজ্জাযুক্তা অহর্নিশি।
বদন হইল যেন প্রভাতের শশী।।
কুচাগ্র হইল কাল উদর ডাগর।
মৃত্তিকার ভক্ষণেতে সদা সমাদর।।
ঘন ঘন হাই উঠে অলস নয়ন।
পাণ্ডুবর্ণ হৈল অঙ্গ খসে আভরণ।।
কৃষ্ণবর্ণ প্রকাশ হইল স্তনবোঁটে।
শরীরে না রহে বস্ত্র নিত্য বল টুটে।।
এইমত হইল সে গর্ভের বর্দ্ধন।
নয় মাস গর্ভবতী হৈল তিন জন।।
দেখি দশরথ রাজা আনন্দিত মন।
পঞ্চামৃত দিয়া কৈল গর্ভের শোধন।।
যে ছিল প্রাক্তন পুণ্য তাহারি কারণ।
কৌশল্যারে দেখা দেন প্রভু নারায়ণ।।
স্বপ্নে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শার্ঙ্গধারী।
চতুর্ভুজ রূপে দেখা দিলেন শ্রীহরি।।
পুত্রভাবে হরিকে করিল রাণী কোলে।
কহিলেন কৌশল্যারে ডাকিয়া মা ব’লে।।
পূর্ব্বেতে আমার সেবা করেছ আদরে।
সেই পুণ্যে জন্মিলাম তোমার উদরে।।
আপনি তোমার গর্ভে লয়েছি জনম।
পুত্র বলি স্তন দিয়া করহ পালন।।
এত বলি অদর্শন হৈল নারায়ণ।
কৌশল্যা বলেন কিবা দেখিনু স্বপন।।
কহিল সকল কথা দশরথ প্রতি।
মা বলিয়া আমাকে যে ডাকেন শ্রীপতি।।
শুনি দশরথ রাজা হরষিত মন।
ভাবে, বুঝি সত্য হবে অন্ধক-বচন।।
দীন দ্বিজগণেরে দিলেন কত স্বর্ণ।
এইরূপে দশ মাস হইল সম্পূর্ণ।।
প্রসব-সময় যত নিকট হইল।
দশরথ ভূপতির আনন্দ বাড়িল।।
এখন তখন রাণী হইবে প্রসব।
প্রজা সব গান করে সদা এই রব।।
যেই দিন ভূমিষ্ঠ হবেন নারায়ণ।
আকাশ যুড়িয়া বসিলেন দেবগণ।।
শুভগ্রহ সকল উদিত স্থানে স্থানে।
দশদিক মঙ্গল সকল তারাগণে।।
প্রথমে প্রথমা স্ত্রীর গর্ভের বেদন।
অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল নারীগণ।।
মধুচৈত্রমাস, শুক্লা শ্রীরাম নবমী।
শুভক্ষণে ভূমিষ্ঠ হলেন জগৎস্বামী।।
গর্ভব্যথা নাহি তার নাহিক শোণিত।
শুভক্ষণে শ্রীহরি হইল উপনীত।।
অন্ধকার ঘুচে যে জ্বালিলেক বাতি।
কোটি সূর্য্য জিনিয়া তাঁহার দেহ-জ্যোতি।।
শ্যামল শরীর প্রভু চাঁচর কুন্তল।
সুধাংশু জিনিয়া মুখ করে ঝলমল।।
আজানুলম্বিত দীর্ঘ ভুজ সুললিত।
নীলোৎপল জিনি চক্ষু আকর্ণ পূর্ণিত।।
কে বর্ণিতে হয় শক্ত রক্ত ওষ্ঠাধর।
নবনীত জিনিয়া কোমল কলেবর।।
সিন্দূরে মণ্ডিত রাঙ্গা চরণ সুন্দর।
কমল জিনিয়া প্রভু-নাভি মনোহর।।
সংসারের রূপ যত একত্র মিলন।
কিসে বা তুলনা দিব নাহিক তেমন।।
জয় জয় হুলাহুলি দিল নারীগণ।
সাবধানে করিলেক নাড়িকা ছেদন।।
কৌশল্যার দাসী সেই শুভবার্ত্তা নামে।
শুভ সমাচার দিল গিয়া রাজধামে।।
শুনি দশরথ পূর্ণ পুলক শরীরে।
অষ্ট আভরণ আরো দিলেন দাসীরে।।
পরম আনন্দে রাজা পাসরে আপনা।
কত ধন দিল দ্বিজে কে করে গণনা।।
আনন্দ-সাগরে রাজা ভাসে সেই ঠাঁই।
পুনরপি দিল দান কত শত গাই।।
গণক আনিয়া করিলেন শুভকাল।
পুত্রমুখ দেখিবারে যান মহীপাল।।
ইন্দ্র যেন চলিলেন শচীর মন্দিরে।
চন্দ্র যেন আসিতেছে রোহিণীর ঘরে।।
কৌশল্যা বসিয়া আছে নারায়ণ কোলে।
পুত্র দেখিবারে রাজা গেল হেনকালে।।
ধীরে ধীরে দশরথ পুত্র নিল বুকে।
এক লক্ষ চুম্ব তাঁর দিল চাঁদমুখে।।
দরিদ্র পাইল যেন নিধির কলস।
ততোধিক আনন্দিত রাজার মানস।।
অন্ধজন যেমন নয়ন লাভে হয়।
ততোধিক দশরথ পাইয়া তনয়।।
এতদিনে দশরথ মনেতে উল্লাস।
রামজন্ম রচিল পণ্ডিত কৃত্তিবাস।।