৩৯. দশরথ রাজার পুত্রেষ্টি যজ্ঞকরণ ও নারায়ণের চারি অংশে জন্মগ্রহণ

দশরথ রাজারে সুমন্ত্র ইহা বলে।
মুনিকে আনিতে রাজা দশরথ চলে।।
দশরথ লোমপাদ নৃপতির ঘরে।
চতুরঙ্গ সঙ্গে যান হরিষ অন্তরে।।
নৃপের পাইয়া বার্ত্তা লোমপাদ রাজা।
রাজ উপচারে যত্নে করে তাঁরে পূজা।।
মিষ্টান্ন প্রভৃতি দিয়া করায় ভোজন।
জিজ্ঞাসেন কোন্ কার্য্যে তব আগমন।।
দশরথ বলিলেন শুন মোর বাণী।
অযোধ্যায় লয়ে চল ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি।।
অন্ধকের উক্তি আছে যে অতীতকালে।
পুত্রবান হব আমি ঋষ্যশৃঙ্গ গেলে।।
এমত কহিলে দশরথ নৃপবর।
লোমপাদ লয়ে গেল মুনির গোচর।।
প্রণাম করেন দশরথ যোড়হাতে।
লোমপাদ পরিচয় লাগিল কহিতে।।
দশরথ এই রাজা শুনেছ আখ্যান।
তুমি কৃপা কর যদি হন পুত্রবান।।
শান্তা কন্যা বিবাহ যে দিয়াছি তোমারে।
সেই কন্যা জন্মেছিল ইহার আগারে।।
ইহার জামাতা তুমি তোমার শ্বশুর।
অপুত্রক তাপিত এ তাপ কর দূর।।
ধ্যানেতে জানিয়া মুনি মনেতে প্রশংসে।
এই ঘরে বিষ্ণু জন্মিবেন চারি অংশে।।
অন্ধক মুনির কথা কভু নহে আন।
এতেক জানিয়া মুনি করিল পয়াণ।।
তনয়া জামাতা সঙ্গে চাপি নিজ রথে।
অযোধ্যা আইল রাজা লোমপাদ সাথে।।
দেখে মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ হৃষ্ট যত প্রজা।
নির্ম্মঞ্ছন করে তাঁর সবে করে পূজা।।
বশিষ্ঠাদি আইল সকল মুনিগণ।
ঋষ্যশৃঙ্গ বলে কর যজ্ঞ আরম্ভণ।।
অশ্বমেধ যজ্ঞে কর বিষ্ণু-আরাধন।
যত মুনিগণে তুমি কর নিমন্ত্রণ।।
দশরথ নিমন্ত্রণ করে দেশে দেশে।
আমন্ত্রণ পাইয়া যতেক মুনি আসে।।
অগস্ত্য আসস্ত্য আর পুলস্ত পুলোম।
আইলাম বৈশম্পায়ন দুর্ব্বাসা গৌতম।।
জৈমিনী গোতম পিপীলিক পরাশর।
পুলহ কৌণ্ডিন্য মুনি এল নিশাকর।।
মার্কণ্ডেয় মরীচি ভরত ভরদ্বাজ।
অষ্টাবক্র মুনি ভৃগু কূর্ম্ম দক্ষরাজ।।
গর্গমুনি দধীচি আইল শরভঙ্গ।
পুজে রাজা মুনিগণে বাড়ে মনে রঙ্গ।।
পাতালের আইল কপিল মহাঋষি।
সগর-সন্তানে যে করিল ভস্মরাশি।।
বেদবান চক্রবান আইল সাবর্ণি।
জল ভিতরের আর মুনি মৎস্যকর্ণী।।
সনাতন সনক যে সনন্দকুমার।
সৌভরি আইল মুনি বিষ্ণু-অবতার।।
আইল বাল্মীকি যমুনার কূলে ধাম।
কশ্যপের পুত্র এল বিভাণ্ডক নাম।।
কতেক আইল মুনি নাম নাহি জানি।
রাজার যজ্ঞেতে এল তিন কোটি মুনি।।
তিন কোটি মুনি করে বেদ উচ্চারণ।
সবাকার বদনে নিঃসরে হুতাশন।।
পৃথিবীতে কেহ আছে এক পদে ভর।
কেহ অনাহারে আছে সহস্র বৎসর।।
মাথায় রচিত জটা বাকল বসন।
নারায়ণ কথা বিনা মুখে নাহি আন।।
এমত আইল তথা তিন কোটি মুনি।
সঙ্গে কত শিষ্য তার সংখ্যা নাহি জানি।।
মুনিগণ বাসার্থ দিলেন বাসাঘর।
পৃথিবীর রাজা এল অযোধ্যা নগর।।
মিথিলার আইল জনক রাজঋষি।
মল্ল মহারাজ এল রাজ্য যার কাশী।।
অঙ্গদেশ-অধিপতি লোমপাদ নাম।
রাজা বঙ্গদেশের আইল গনশ্যাম।।
মরীচিপুরের রাজা ভোজ পুরন্দর।
চম্পাপুর হইতে আইল চম্পেশ্বর।।
আইল তৈলঙ্গ রাজা তেজেতে অসীম।
আইল আটাশী কোটি যে ছিল পশ্চিম।।
মাগধ মগধ কোটি যে ছিল পশ্চিম।
লক্ষ কোটি রাজা এল ছাড়ি রাজপাট।।
উদয়াস্ত গিরিতে যতেক রাজা বৈসে।
দশরথ নিমন্ত্রণে সব রাজা আসে।।
মেদিনী ভুবনে বৈসে যত রাজগণ।
নানা রঙ্গে আইলেন সঙ্গ অগণন।।
প্রত্যেক কহিতে নাম নিতান্ত অশক্য।
রাজা যত আইল আটাশী কোটি লক্ষ।।
যত রাজা গেল দশরথের গোচরে।
রাজচক্রবর্ত্তী দশরথ সর্ব্বোপরে।।
আসিয়া করিল দশরথ সহ দেখা।
দিলেন বার্ষিক কর সমুচিত লেখা।।
যত ধন এনেছিল রাখিল ভাণ্ডারে।
প্রত্যেক প্রত্যেক বাসা দিল সবাকারে।।
যজ্ঞ করিছেন রাজা সরয়ূর তীরে।
মুনিগণ গেলেন রাজার যজ্ঞঘরে।।
একাশী যোজন ঘর অতি দীর্ঘতর।
দ্বাদশ যোজন তার আড়ে পরিসর।।
চারিক্রোশ বান্ধিয়াছে যজ্ঞের মেখলা।
শতেক যোজন উভে সেই যজ্ঞশালা।।
মুনিগণ বৈসে গিয়া ঘরের ভিতরে।
শুভক্ষণে শুভলগ্নে যজ্ঞারম্ভ করে।।
স্বস্তিকাদি অগ্রেতে করয়ে মুনিগণ।
সঙ্কল্প করিল তবে অজের নন্দন।।
দাণ্ডাইল দশরথ যোড় করি হাত।
কহিতে লাগিল সব মুনির সাক্ষাৎ।।
ছোট বড় নাহি জানি তুল্য সর্ব্বজন।
আজ্ঞা কর কারে আগে করিব বরণ।।
ব্রহ্মার তনয় আর কুলপুরোহিত।
উহার বরণ আগে শাস্ত্রের বিহিত।।
বশিষ্ঠেরে বরিয়া ঘুচাও অভিমান।
বড় ছোট কেহ নহে সকলি সমান।।
ভাল ভাল বলিয়া সকল মুনি বলে।
বস্ত্র অলঙ্কার রাজা দিলেন সকলে।।
সকলে করিল এককালে বেদধ্বনি।
মুনি-মুখে নিঃসরিল পাবক তখনি।।
সেই অগ্নি পবিত্র করিল মুনিগণ।
অগ্নির কুণ্ডেতে লয়ে করিল স্থাপন।।
আপত তণ্ডুল তিল যব রাশি রাশি।
একে একে দিল ঘৃত সহস্র কলসী।।
একবর্ষ যজ্ঞ করে রাজা দশরথে।
দেবতার ভয় হেথা হইল স্বর্গেতে।।
শ্রীবিশ্বশ্রবার পুত্র রাজা দশানন।
হীনজ্ঞানে লঙ্কাতে খাটায় দেবগণ।।
মহেন্দ্র বলেন ব্রহ্মা কোন্ বুদ্ধি করি।
এইকালে জন্ম কি হে লবেন শ্রীহরি।।
পুত্রের লাগিয়া দশরথ যজ্ঞ করে।
তাঁর পুত্র হৈলে তব দশানন মরে।।
এই যুক্তি করিয়া যতেক দেবগণ।
ক্ষীরোদ সমুদ্রে গেল যথা নারায়ণ।।
চারি মুখে ব্রহ্মা গিয়ে করেন স্তবন।
কত নিদ্রা যান প্রভু দেব নারায়ণ।।
পদতলে লক্ষ্মীদেবী করিছেন স্তুতি।
অনন্তশয্যায় শুয়ে আছেন শ্রীপতি।।
সকল দেবতা গিয়া দাণ্ডাইল কূলে।
দেখিল যেমন মেঘ ভাসিছে সলিলে।।
শুইয়া আছেন হরি অনন্ত উপরে।
বাসুকি সহস্র ফণা তদুপরে ধরে।।
সেবকগণের প্রতি প্রভু দেহ মন।
তোমার নিদ্রায় নিদ্রা চেতনে চেতন।।
বিপত্তি করহ দূর শ্রীমধুসূদন।
চারি মুখে ব্রহ্মা যদি করিল স্তবন।।
ক্ষীরোদ উঠিয়া বসিলেন নারায়ণ।
চারিদিকে দেখিলেন যত দেবগণ।।
বসিয়া শ্রীহরি করিলেন এক শব্দ।
সে শব্দে হইল লোক চারিপদ মুগ্ধ।।
হরি করিলেন চারিদিকে নিরীক্ষণ।
ম্লান দেখিলেন সব দেবের বদন।।
মলিন দেখিয়া জিজ্ঞাসেন নারায়ণ।
তোমা সবাকার শত্রু হৈল কোন্ জন।।
বিধাতা বলেন শুন দেব পুরন্দর।
তুমি গিয়া কহ কথা প্রভুর গোচর।।
আমি বর দিয়াছি দুর্দ্দান্ত রাবণেরে।
তুমি গিয়া কহ দুঃখ প্রভুর গোচরে।।
দেবগুরু বৃহস্পতি যোড় করি হাত।
প্রভুর আগেতে করিলেন প্রণিপাত।।
অবধান করহ ঠাকুর ভগবান।
আপনি জানহ যত দেবতার মান।।
আগম নিগম তুমি ভারত পুরাণ।
অনাথের নাথ তুমি কর পরিত্রাণ।।
বিশ্বশ্রবা মুনি-পুত্র রাজা দশানন।
পাইল ব্রহ্মার বর করি আরাধন।।
তার তেজে স্বর্গে দেব রহিতে না পারে।
দেবের দেবত্ব হরে দুষ্ট দুরাচারে।।
ঘুচাইল যমের যতেক অধিকার।
সূর্য্যের উদয় নাই সদা অন্ধকার।।
চন্দ্রের কতেক কব নাহি তার জ্যোতি।
বহুকাল প্রভু স্বর্গে অন্ধকার রাতি।।
বরুণের ঘুচিল অগাধ যত জল।
নির্ব্বাণ হইল অগ্নি নাহিক প্রবল।।
কুবেরের হরে ধন পাইল তরাস।
গ্রহগণ অধিকার হইল বিনাশ।।
সম্বরিল পবন পাইয়া মহাভয়।
সমুদ্রের বেগ অতি মন্দ মন্দ বয়।।
ছাড়ে বীণা নারদ, বীণায় ছাড়ে গীত।
অমঙ্গল স্বর্গে যত হৈল বিপরীত।।
বসন্তাদি অধিকার, ছাড়ে ছয় ঋতু।
নিত্য ভয় পাই সবে রাবণের হেতু।।
ব্রহ্মার বরেতে সেই হইল দুর্জ্জয়।
তারে বর দিয়া ব্রহ্মা নিজে পান ভয়।।
তারে বর পেয়ে লঙ্ঘে তাঁহার বচন।
স্বর্গ হৈতে খেদাড়িয়া দিল দেবগণ।।
কাড়িয়া লইল সে দেবের কন্যা যত।
দেবের শরীরে অপমান সহে কত।।
ত্রিভুবনে রহিতে কোথাও নাহি স্থান।
যথা যাই তথা সেই করে অপমান।।
নিবেদন মহাশয় তোমার চরণে।
রাবণে বধিয়া রাখ দেব-দেবীগণে।।
শুনিয়া প্রভুর ক্রোধ অন্তরে বাড়িল।
ঘৃত পেয়ে অগ্নি যেন প্রজ্জ্বলিত হৈল।।
বিনতা-নন্দনে হরি করেন স্মরণ।
চক্রহাত লয়ে পক্ষে করি আরোহণ।।
কহিলেন দেবগণে ভয় নাহি আর।
রাবণেরে এখনি যে করিব সংহার।।
গরুড়ে চড়িয়া চলিলেন জগন্নাথ।
একালে কহেন ব্রহ্মা প্রভুর সাক্ষাৎ।।
আমি বর দিয়াছি যে পূর্ব্বে রাবণেরে।
এখন করিলে রণ রাবণ না মরে।।
নরের উদরে যদি লও হে জনম।
নর-বানরের হাতে তাহার মরণ।।
প্রভুর সাক্ষাতে ব্রহ্মা কহেন এ কথা।
জন্মের নামেতে প্রভু হেঁট করে মাথা।।
বরের সময় ব্রহ্মা হন আগুয়ান।
বিপদে পড়িলে বলে রক্ষ ভগবান।।
কতবার দুঃখ পাব ললাটে লিখন।
পৃথিবীতে যাব স্বর্গ করিয়া ত্যজন।।
পুনশ্চ হরিরে ব্রহ্মা কহেন বচন।
দুষ্ট রাবণের ক্রিয়া করহ শ্রবণ।।
হাতে অস্ত্র সূর্য্যদেব লঙ্কার দুয়ারী।
ইন্দ্র মালা গাঁথি দেন, চন্দ্র ছত্রধারী।।
আপনি ত অগ্নিদেব করেন রন্ধন।
মন্দ মন্দ বাতাস করেন সমীরণ।।
বরুণ বহিয়া জল দেন নিতি নিতি।
করেন মার্জ্জন গৃহ নিজে বসুমতী।।
শুনিলে যমের কথা হইবেক হাস।
কাটিয়া আনেন তার ঘোটকের ঘাস।।
শনিদৃষ্টে ত্রিভুবন ভস্ম হৈয়া উড়ে।
কাপড় ধুইয়া দেন শনি লঙ্কাপুরে।।
জগতের কর্ত্তা আমি ব্রহ্মা মহামুনি।
পড়াই বালকগণে লঙ্কাতে আপনি।।
রাবণের আগে দেব-গায়ক নারদ।
রাবণ ভুবন জিনি করেছে সম্পদ।।
জন্ম নিতে হরি যদি হইলা কাতর।
আপনার দৃষ্টি সব লহ চক্রধর।।
আর ব্রহ্মা আর ইন্দ্র করহ সৃজন।
আপনার সৃষ্টি সব লহ নারায়ণ।।
এতেক বলিল ব্রহ্মা করুণ বচন।
প্রভু ভক্তবৎসল দিলেন তাহে মন।।
হে ব্রহ্মণ্ ইহার উপায় বল মোরে।
কোন্ বংশে জন্ম লব বল কার ঘরে।।
কাহার উদরে আমি লইব জনম।
আমারে বা আপত্য বলিবে কোন্ জন।।
ব্রহ্মা বলে জ্ন্ম লবে দশরথ-ঘরে।
সূর্য্যবংশ-পুণ্যেতে কৌশল্যার উদরে।।
বিধাতার বচনে বলেন চক্রপাণি।
দশরথ কৌশল্যা উভয়ে আমি জানি।।
পূর্ব্বেতে আমার সেবা করেছে বিস্তর।
জন্মিব তোমার ঘরে দিয়াছি এ বর।।
নরের গর্ভেতে আমি লইব জনম।
বানরীর গর্ভে জন্ম লহ দেবগণ।।
আমি হর হই, হও তোমরা বানর।
রাবণ মারিতে যেন হইও দোসর।।
ব্রহ্মাবাক্যে স্বীকার করেন নারায়ণ।
পদতলে পড়ি লক্ষ্মী যুড়িল ক্রন্দন।।
তব অবতার হবে পৃথিবী-মণ্ডলে।
তোমা দরশন আমি পাব কত কালে।।
আমারে ছাড়িয়া কোথা যাইবে শ্রীহরি।
বিচ্ছেদ যন্ত্রণা আমি সহিতে না পারি।।
লক্ষ্মীর রোদরেতে কান্দেন কম্বুগ্রীব।
ব্রহ্মারে জিজ্ঞাসে কোথা লক্ষ্মীরে রাখিব।।
শুনিয়া সে বাক্য ব্রহ্মা নিবেদন করে।
ইনি নাহি গেলে কি রাবণ রাজা মরে।।
অযোনিসম্ভবা উনি জন্মিবেন চাষে।
জনকের ঘরে জন্ম মিথিলার দেশে।।
এতেক বলিল যদি ব্রহ্মা তপোধন।
আদিকাণ্ড গান কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।।