৩১. দশরথ রাজার প্রতি অন্ধকের শাপ বিবরণ

দেখি দুই অন্ধে রাজার সন্দেহ অন্তরে।
যাইতে নারেন অগ্রে পাছু যান ধীরে।।
কহিল অন্ধক মুনি করিয়া বিশ্বাস।
কিবা মাতা পিতা সঙ্গে কর উপহাস।।
দেখিতে না পায় মুনি বসিলেন ধ্যানে।
সকল বৃত্তান্ত মুনি ক্ষণেকেতে জানে।।
চক্ষু ভাসে নীরে, করে করাঘাত শিরে।
বলে রাজা মারিয়াছে পুত্রে এক তীরে।।
মুনি বলে আইস দশরথ নরপতে।
মৃতপুত্র আনিলে আমাকে দেখাইতে।।
আর কিবা দশরথ শাপিব তোমাকে।
এইমত তব প্রাণ যাক পুত্রশোকে।।
পুত্রশোকে মরিব আমরা দুই প্রাণী।
পুত্রশোকে যে যন্ত্রণা জানিবা আপনি।।
মুনি শাপ দলি যদি রাজার উপর।
দশরথ কহিছেন প্রফুল অন্তর।।
শুভমস্তু মুনি বাক্য না হইবে আন।
দেখিয়া পুত্রের মুখ যায় যাক প্রাণ।।
তোমা দেখি যেন মুনি বিষ্ণুর সমান।
তোমার বচন সত্য হবে নহে আন।।
তব শাপে মুনি মম হরিষ অন্তর।
শাপ নহে, হইল আমার পুত্র বর।।
অন্ধ বলে দশরথ বঞ্চিত সন্তানে।
পুত্রশোকে শাপ দিনু, বর করি মানে।।
ধ্যান করি জানিল অন্ধক তপোধন।
ইহার ঘরেতে জন্মিবেন নারায়ণ।।
যাহ রাজা তোমারে দিলাম আমি বর।
চারি পুত্র তোমার হবেন গদাধর।।
মম শাপে পুত্রশোকে তোমার মরণ।
পুত্র হৈলে একাদশ বৎসর জীবন।।
ব্যর্থ নাহি হয় কভু মুনির বচন।
মুনির শাপেতে অন্ধ আমার লোচন।।
পূর্ব্বকথা কহি রাজা তাহে দেহ মন।
যে শাপে হইল মম অন্ধ এ লোচন।।
ত্রিজট মুনির দুই চরণ ডাগর।
মাগিতে আইল ভিক্ষা মম পিতৃঘর।।
মুনিরে দেখিয়া পিতা উঠিল তখন।
পাদ্য অর্ঘ্য দেন তাঁরে বসিতে আসন।।
জিজ্ঞাসা করেন তাঁরে কেন আগমন।
মুনি কহে আইলাম ভিক্ষার কারণ।।
গতকল্য হতে আমি আছি উপবাসী।
ভোজন করাহ মোরে তুমি মহাঋষি।।
অতিথি বলিয়া পিতা করান ভোজন।
বিদায় হইয়া মুনি যান তপোবন।।
পিতা আসি কহেন আমারে এই কালে।
দণ্ডবৎ করহ মুনির পদতলে।।
গোদা পা দেখিয়া তাঁর ঘৃণা হৈল মনে।
এমন পায়ের ধূলা লইব কেমনে।।
লইলাম নয়ন মুদিয়া পদধূলি।
আশীর্ব্বাদ দিল মুনি এবমস্তু বলি।।
ব্যর্থ না হইল সেই মুনির বচন।
ইহাতে হইল অন্ধ আমার লোচন।।
সেইমত করিলেক আমার গৃহিণী।
দোঁহারে করিয়া অন্ধ ঘরে গেল মুনি।।
আমার শাপের রাজা পাইলে প্রমাণ।
শাপে বর হইল, হইবে পুত্রবান।।
এই সত্য দশরথ করিবে পালন।
ঋষ্যশৃঙ্গ আনি কর যজ্ঞ আরম্ভণ।।
শ্রীফল পাইয়াছিলাম ভ্রমিতে কানন।
এই ফল করিলাম তোমাকে অর্পণ।।
এই ফলে জন্মিবেন দেব চক্রপাণি।
চরুর ভিতরে এই ফল দিও তুমি।।
পুনশ্চ কহেন মুনি তাঁরে মৃদুস্বরে।
কোথা আছে সিন্ধুপুত্র আনিদেহ মোরে।।
মৃতপুত্র দশরথ দিলেন ফেলিয়া।
পুত্র কোলে করি মুনি কান্দে লোটাইয়া।।
নয়নবিহীন মুনি দেখিতে না পায়।
কোলেতে করিয়া হস্ত শরীরে বুলায়।।
জন্মিলা যে পুত্র তুমি তপের সঞ্চারে।
তোমার মরণে মৃত্যু ঘটিল আমারে।।
অন্ধের নয়ন তুমি হয়েছিলে জানি।
ফল দিতে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় দিতে পানি।।
গরুনিন্দা নাহি করি নহে সন্ধ্যাবাদ।
দধির সংযোগে রাত্রে নাহি খাই ভাত।।
জন্মাবধি আমি পাপ কর্ম্ম নাহি জানি।
তবে কেন সিন্ধুপুত্র ত্যজিল পরাণী।।
পূর্ব্বজন্মে কার কি করেছি বিঘটন।
গুরুনিন্দা করেছি হরেছি স্থাপ্যধন।।
এতেক বলিয়া মুনি নারায়ণে ডাকে।
নারায়ণ মন্ত্র জপি মরে পুত্রশোকে।।
পতিব্রতা নাহি জীয়ে পতির মরণে।
অন্ধকী ছাড়িল প্রাণ অন্ধকের সনে।।
তিন মৃত লয়ে রাজা গেল সরোবরে।
অগুরু চন্দকাষ্ঠ আনিল সাদরে।।
করিলেন চিতা রাজা উত্তর শিয়রে।
তিনজনে শোয়াইব চিতার উপরে।।
দুইজন দুই দিকে পুত্র মধ্যখানে।
পোড়াইল তিনজনে বেষ্টিত আগুনে।।
চিতা নিবাইয়া সেই সরোবর-তীরে।
কান্দিয়া গেলেন রাজা অযোধ্যা-নগরে।।
মুনি হত্যা করি রাজা অজের নন্দন।
অমনি কান্দিয়া গেল বশিষ্ঠ ভবন।।
গিয়াছেন বশিষ্ঠ তপস্যা করিবারে।
বামদেব পুত্র তাঁর আছেন আগারে।।
সকল বৃত্তান্ত রাজা কহিলেন তাঁরে।
মুনিহত্যা করিয়াছি বনের ভিতরে।।
প্রায়শ্চিত্ত ইহার করাহ মহাশয়।
কিরূপে হইব মুক্ত কিসে পাপক্ষয়।।
মুনি বলে, অকালেতে নাহি যজ্ঞদান।
এই পাপে কেমনে পাইবে পরিত্রাণ।।
বিচার করিয়ে মুনি আগম পুরাণ।
বাল্মীকি যে মন্ত্র জপি পাইলেন ত্রাণ।।
তিনবার বলাইল সেই রামণাম।
পাইলেন ভূপতি সে পাপের বিরাম।।
রাজা মুক্ত হইয়া গেলেন নিজ ঘর।
আইলেন সন্ধ্যায় বশিষ্ঠ মুনিবর।।
ফল মূল ভক্ষণে মুনির সুস্থ মন।
পিতা পুত্রে কথাবার্ত্তা কন দুইজন।।
পিতারে কহেন বামদেব নীতিক্রমে।
দশরথ আসিয়াছিলেন এ আশ্রমে।।
অন্ধক মুনির পুত্র সিন্ধু বলে যারে।
মারিলেন রাজা শব্দভেদী শরে তারে।।
দীনভাবে কহিলেন রাজা এ বচন।
মুনিহত্যা পাপ মোর কর বিমোচন।।
যোগ যোগ স্নান দান নাহি বলিলাম।
তিনবার রাজারে বলানু রামনাম।।
জল ফেলাইয়া যেন দিল তপ্ত তৈলে।
কুপিয়া বশিষ্ঠ মুনি পুত্র প্রতি বলে।।
এক রামনাম কোটি ব্রহ্মহত্যা হবে।
তিনবার রামনাম বলালি রাজারে।।
মোর পুত্র হৈয়া তোর অজ্ঞান বিশাল।
দূর হবে বামদেব হবি রে চণ্ডাল।।
লোটাইয়া ধরিল সে পিতার চরণ।
কেমনে হইব মুক্ত কহ বিবরণ।।
না থাকে মুনির মনে কোপ বহুক্ষণ।
বলিলেন তাহারে বশিষ্ঠ তপোধন।।
যেই রামনাম তুমি বলালে রাজারে।
তিনি জন্মিবেন দশরথের আগারে।।
গঙ্গাস্নানে রঘুনাথ যাবেন যখন।
আগুলিও তুমি পথ রামের তখন।।
তাঁহার চরণপদ্ম করিহ স্পর্শন।
তখনি হইবে মুক্ত চণ্ডাল-জনম।।
বলিলেন এরূপ বশিষ্ঠ মহামুনি।
গুহক চণ্ডাল হৈয়া রহিলেন তিনি।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ।
আদিকাণ্ডে গাইলেন অন্ধকোপাখ্যান।।