২৯. রাজা দশরথের পুনর্ব্বার শনির নিকটে গমন ও শনি কর্ত্তৃক গণেশের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণন এবং দশরথকে বরদান

পুনশ্চ গেলেন রাজা শনির ভবনে।
রাজারে দেখিয়া শনি অতি ভীত মনে।।
শনি বলে, দশরথ আইলা আরবার।
তুমি সে আমার দৃষ্টে পাইলা নিস্তার।।
দশরথ তুমি সূর্য্যবশের ভূষণ।
নিবেন তোমার ঘরে জন্ম নারায়ণ।।
রাজচক্রবর্ত্তী তুমি ধর্ম্ম-অবতার।
তেকারণে মোর দৃষ্টে পাইলা নিস্তার।।
মুদিয়া নয়ন শনি দশরথে বলে।
সম্মুখ ছাড়িয়া তুমি আইস পৃষ্ঠমূলে।।
কোপদৃষ্টে সুদৃষ্টে যাহার পানে চাই।
শরীরের কাজ থাক হৈয়া যায় ছাই।।
পূর্ব্বকথা কহি রাজা তাহে দেহ মন।
যেমতে শিবের পুত্র হৈল গজানন।।
জন্মিলেন গণপতি গৌরীর নন্দন।
দেখিতে গেলেন তথা যত দেবগণ।।
দেবগন বলে দেবী তোমার আদেশে।
আইল সকল দেব শনি না আইসে।।
দূত পাঠাইয়া দিল আমার গোচর।
দেখিতে গেলাম পুত্র কৈলাস শিখর।।
শুভদৃষ্টে গিয়া যেই মুখপানে চাই।
সবে বলে গণেশের মুণ্ড দেখি নাই।।
তা দেখিয়া দেবগণ হইল বিস্মিত।
পার্ব্বতীর মনোদুঃখ, মহেশ চিন্তিত।।
পার্ব্বতী বলেন, হেথা আছে দেবগণ।
আমার পুত্রের মুণ্ড নিল কোন্ জন।।
দেবগণ বলেন শুনহ বিশ্বমাতা।
শনির দৃষ্টিতে ভস্ম গণেশের মাথা।।
দেবতার বাক্য শুনি রুষিয়া ভবানী।
আমারে বধিতে যান হয়ে শূলপাণি।।
পলাইয়া যাই আমি স্থান নাহি পাই।
দেবতার আড়ালেতে তখনি লুকাই।।
শূলহস্তে আইলেন দেবী মহাকোপে।
পার্ব্বতীর কোপ দেখি দেবগণ কাঁপে।।
তখন দেবতাগণ করিছে স্তবন।
আপনি সৃজিলা শনি মার কি কারণ।।
তুমি আদ্যাশক্তি মাতা জগতের গতি।
তোমার মহিমা বলে কাহার শকতি।।
আপনি দিয়াছ বর পরম কৌতুকে।
শনি যারে দেখে তার মাথা নাহি থাকে।।
পাইয়া তোমার বর তোমাতে পরীক্ষা।
তুমি যদি মার তারে কে করিবে রক্ষা।।
শনিকে মারহ কেন বিধাতা বলেন।
স্থির হও জীয়াইব তোমার নন্দন।।
আজ্ঞা করিলেন ব্রহ্মা তবে পবনেরে।
মুণ্ড কাটি আন যেবা উত্তর শিয়রে।।
গঙ্গানীর খাইয়া ইন্দ্রের ঐরাবত।
উত্তর শিয়রে শুয়েছিল নিদ্রাগত।।
কাটিয়া তাহার মুণ্ড আনিল পবন।
রক্ত মাংস জীয়াইল, হৈল গজানন।।
শরীর নরের মত বদন করীর।
দেখিয়া হইল বড় দুঃখ পার্ব্বতীর।।
সকল দেবের পুত্র দেখিতে সুন্দর।
গজমুখ বসিবেক তাহার ভিতর।।
বিরিঞ্চি বলেন করি গণেশের রাজা।
আগে গণেশের পূজা পিছে অন্য পূজা।।
গণেশ থাকিতে যেবা অন্য দেব পূজে।
পূর্ব্ব ধর্ম্ম নষ্ট তার হয় সব কাজে।।
ঐরাবত-মুণ্ডে জীয়াইল লম্বোদয়।
হস্তীর শোকেতে কান্দি কহে পুরন্দর।।
উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া আর ঐরাবত হাতী।
এ সব সম্পদে মম নাম সুরপতি।।
আজ্ঞা করিলেন চতুর্ম্মুখ পবনেরে।
মুণ্ড কাটি আন যেবা পশ্চিম শিয়রে।।
পশ্চিম শিয়রে শুয়ে শ্বেতহস্তী যথা।
পবন কাটিয়া আনি দিল তার মাথা।।
প্রাণ পেয়ে ঐরাবত গেল নিজ ঘরে।
হেলায় আলস্য নাই পশ্চিম শিয়রে।।
দেবীরে বিদায় করি গেল দেবগণে।
গণেশের জন্ম শনি কহিল রাজনে।।
শুভদৃষ্টে কোপদৃষ্টে যার পানে চাই।
আমার দৃষ্টিতে কেহ রক্ষা পাবে নাই।।
মনুষ্য হইয়া তুমি এস বারে বার।
সূর্য্যবংশে জন্ম হেতু পাইলা নিস্তার।।
সূর্য্যবংশ-জাত আমি সূর্য্যের কুমার।
এক বংশে জন্ম তেঁই পাইলা নিস্তার।।
কি কারণে আসিয়াছ তুমি মম পাশ।
বর চাহ তোমার পূরাব অভিলাষ।।
তখন বলেন দশরথ যশোধন।
রোহিণীতে তব দৃষ্টে নহে বরিষণ।।
শনি বলে আজি হৈতে ছাড়িব রোহিণী।
অবিলম্বে দেশে চলি যাহ নৃপমণি।।
আজি হৈতে তব রাজ্যে হবে বরিষণ।
ঘুষিবে তোমার যশ এ তিন ভুবন।।
রোহিণী বৃষভ রাশি হবে যেই জন।
সেই রাজ্যে হবে না আমার আগমন।।
হইয়া রাজারে তুষ্ট শনি দিল বর।
চলিলেন রাজা ইন্দ্র নিকটে সত্বর।।
সভাতে বসিয়া ইন্দ্র লয়ে দেবগণে।
দশরথ বসিলেন তাঁর একাসনে।।
কহিলেন সে সব বৃত্তান্ত পুরন্দরে।
শনিকে প্রসন্ন করিলেন যে প্রকারে।।
শুনিয়া রাজার কথা দেবরাজ ভাষে।
এক্ষণে হইবে বৃষ্টি তুমি যাও দেশে।।
সাত দিন বৃষ্টি মাত্র ঝড় না করিব।
তোমার রাজ্যেতে জল যথাকালে দিব।।
বিদায় হইয়া রাজা গেলেন স্বদেশে।
আদিকাণ্ড গাইল পণ্ডিত কৃত্তিবাসে।।