২২. রঘুরাজার দানকীর্তি

দিলীপ রাজত্ব করে অযুত বৎসর।
পুত্রে রাজ্য দিয়া গেল অমর-নগর।।
পিতৃশ্রাদ্ধ করিলেন রঘু যশোধন।
ব্রাহ্মণে দিলেন দান ছিল যত ধন।।
অদ্যভক্ষ্য রঘুরাজা নাহি রাকে ঘরে।
মৃত্তিকার পাত্রে রাজা জল পান করে।।
বরদত্ত নামে এক ব্রাহ্মণ-নন্দন।
কশ্যপ মুনির ঠাঁই করে অধ্যায়ন।।
গুরুগৃহে বসতি করিয়া বহুদিন।
চতুঃষষ্টি বিদ্যাতে সে হইল প্রবীণ।।
গুরুরে দক্ষিণা দিতে কহিল তাহাঁরে।
কি দক্ষিণা দিব গুরু আজ্ঞা কর মোরে।।
গুরু বলে অল্প মাগি কর বিবেচনা।
চৌষট্টি বিদ্যার দেহ চৌদ্দ কোটি সোণা।।
দ্বিজ কহিলেন এই অসম্ভব কথা।
মনে ভাবে এতেক সুবর্ণ পাব কোথা।।
সবে বলে রঘুরাজ বড় পুণ্যবান।
তাঁর ঠাঁই আনি গিয়া মাগি স্বর্ণদান।।
সাত দিবসের তরে নিয়ম করিল।
গুরুকে বলিয়া শিষ্য বিদায় হইল।।
সাত পাঁচ ভাবিয়া সে দ্বিজ অকিঞ্চন।
অযোধ্যা-নগরে আসি দিল দরশন।।
ব্রাহ্মণে নিষেধ নাহি রঘুর দুয়ারে।
উত্তরিল গিয়া সে রঘুর অন্তঃপুরে।।
মৃত্তিকার পাত্রেতে করিছে জলপান।
দেখিয়া ব্রাহ্মণ পুত্র করে অনুমান।।
মৃত্তিকার পাত্রেতে করিছে জলপান।
কিরূপে করিবে চৌদ্দ কোটি স্বর্ণদান।।
দেখিয়া ব্রাহ্মণ-পুত্র যায় পাছু হৈয়া।
রাখিল ব্রাহ্মণে রঘু দ্বারেতে দেখিয়া।।
আপনি পাখালে রাজা তাঁহার চরণ।
বিবিধ মিষ্টান্ন দিয়া করায় ভোজন।।
কর্পূর তাম্বুল মাল্য দিলেন চন্দন।
জিজ্ঞাসা করেন করি পাদ-সম্বাহন।।
ব্রাহ্মণ বলেন, রাজা তুমি পুণ্যবান।
আসিয়াছি তব স্থানে লইবারে দান।।
দেখিলাম ঘটিয়াচে যে দশা তোমারে।
আপনার নাহি কিছু কি দিবা আমারে।।
তোমার অধীন রাজা ধরণী অশেষ।
ঐশ্বর্য্য তোমার দেখি মৃৎপাত্র শেষ।।
দেখি তব দশা ডর লাগিল আমারে।
এসেছি তোমার ঠাঁই ধন মাগিবারে।।
ভূপতি বলেন, তুমি কত চাহ ধন।
যাহা মাগ তাহা দিব ঠাকুর ব্রাহ্মণ।।
শুনিয়া রাজার কথা দ্বিজবর বলে।
লাড়ু দিয়া যেমন ভাণ্ডাও ছাওয়ালে।।
রাজা বলে যেবা মাগ না করিব আন।
বলিয়া না দিলে নাহি পাব পরিত্রাণ।।
শ্রীবিষ্ণু বলিয়া বিপ্র কাণে দিল হাত।
চৌদ্দ কোটি সোণা মাগি তোমার সাক্ষাৎ।।
রাজা বলে, এক রাত্রি থাক মহামুনি।
প্রাতঃকালে ধন দিব লৈয়া যেও তুমি।।
এত বলি ব্রাহ্মণে রাখিল নিজ ঘরে।
আপনি জিজ্ঞাসা করে সাধু সদাগরে।।
চৌদ্দ কোটি সোণা ধায় যেবা দিতে পারে।
চৌদ্দ দশ কোটি কালি শুধিব তাহারে।।
যোড়হাত করিয়া কহিছে প্রজাগণ।
তোমার নগরে নাই এক কোটি ধন।।
হেঁট মাথা করি রাজা ভাবিল আপদ।
হেনকালে তথা মুনি আইল নারদ।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিল রাজা বসিতে আসন।
মুনি বলে কেন রাজা বিরস বদন।।
রাজা বলে মহাশয় শুন কহি কথা।
ব্রাহ্মণ চাহিল ধন আজি পাব কোথা।।
লাগিলেন হাসিতে নারদ মহামুনি।
ইহার উপায় কহি শুনহ আপনি।।
বল, কালি কুবেরে করিব সম্ভাষণ।
ঘরেতে বসিয়া পাবে যত চাহ ধন।।
তারপরে গেলেন নারদ তপোধন।
অযোধ্যা-নগরে রাজা বাজায় বাজন।।
আজ্ঞা করিলেন রাজা পাত্র মিত্রবরে।
সবে সাজ যাইব কুবেরে দেখিবারে।।
শুনিয়া রাজার বাক্য সৈন্য অগণন।
রণসাজে এল ত্বরা করি আস্ফালন।।
দুর্দ্ধর্ষ সময়ে সবে ভীম পরাক্রম।
রাজা দেশে আসি সবে করিছে বিক্রম।।
কটক সাজিল বাজে দুন্দুভি বাজন।
কৈলাসে কুবের তাহা করেন শ্রবণ।।
কুবেরের দূত ছিল অযোধ্যা-ভুবনে।
জিজ্ঞাসা করিল সব পাত্র-মিত্রগণে।।
রণবাদ্য চারিধারে সৈন্যের সাজন।
হঠাৎ কিসের লাগি এত আয়োজন।।
পাত্র মিত্র বলে কি বেড়াও শুধাইয়া।
প্রমাদ পড়িবে কালি কুবেরে লইয়া।।
কে আছে নির্ব্বোধ হেন বিরোধ বাধায়।
রঘু সনে রণে পশি প্রাণ দিতে চায়।।
শুনিয়া ধাইয়া দূত চলিল অমনি।
কৈলাসে নারদ গিয়া কহিল তখনি।।
কি কর কুবের তুমি নিশ্চিন্ত বসিয়া।
তোমার উপরে রঘু আসিছে সাজিয়া।।
সুবর্ণ নাহিক রঘু রাজার ভাণ্ডারে।
চৌদ্দ কোটি স্বর্ণ বিপ্র চেয়েছে তাঁহারে।।
কপর্দ্দক নাহি আছে তাঁহার ভাণ্ডারে।
বিমুখ যে বিপ্রবরে করিবারে নারে।।
এত যদি বলিল নারদ মহামুনি।
কুবের বলেন আমি পাঠাই এখনি।।
সর্ব্ব কর্ম্ম পরিহরি অনুচর সনে।
কুবের আপনি নিজে বারে বারে গণে।।
ভারে ভারে স্বর্ণ যত রাখে থরে থরে।
রাতারাতি পাঠাইতে রঘুর গোচরে।।
আপনি কুবের ধন দিলেন গণিয়া।
দূত গিয়া ভাণ্ডারেতে দিল ফেলাইয়া।।
জানায় রঘুরে নিদ্রাভঙ্গে দূত আসি।
কুবের পাঠায়ে দেছে ধন রাশি রাশি।।
শুনিয়া এ হেন কথা রঘুর উল্লাস।
প্রভাতে উঠিয়া দ্বিজে করিল সম্ভাষ।।
বিনয়ে কহেন রঘু ব্রাহ্মণ-কুমারে।
ভাণ্ডার সহিত স্বর্গ দিলাম তোমারে।।
শ্রীবিষ্ণু বলিয়া মুনি ছুঁইল দুই কাণ।
চৌদ্দ কোটি মাত্র লব না লইব আন।।
ইহা ভিন্ন অন্য ধনে নাহি প্রয়োজন।
তব সম দাতা আর নাহিক রাজন।।
শুনিয়া দ্বিজের কথা গণিয়া তখন।
কোষাধ্যক্ষে স্বর্ণ দিতে বলিল রাজন।।
চৌদ্দ কোটি স্বর্ণ তারে দিলেন গণিয়া।
শত শত জনে বোঝা দিলেন বান্ধিয়া।।
পরম আনন্দে দ্বিজ লয়ে রাশি ধন।
উত্তরিল ত্বরা করি গুরুর সদন।।
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি আনন্দে তখন।
ধন লৈয়া গুরুকে করিল সমর্পণ।।
শিষ্যরে আনিতে হেরি চৌদ্দ কোটি সোণা।
গুরু বলে এত ধন দিল কোন্ জনা।।
শিষ্য বলে রঘুরাজা বড় পুণ্যবান।
করিলেন তিনি চৌদ্দ কোটি স্বর্ণদান।।
মুনি বলে বসি আমি গহন কাননে।
ধনতরে দস্যুগণ বধিবে জীবনে।।
এই ধন রাখ লয়ে ইন্দ্রের ভাণ্ডারে।
যজ্ঞকালে যেন ধন আনি দেন মোরে।।
শুনিয়া গুরুর বাক্য লইয়া সে ধন।
অমরাবতীতে যাত্রা করিল তখন।।
কাঞ্চন লইয়া গেল ইন্দ্রের সদনে।
সম্ভ্রমে উঠিল ইন্দ্র দেখিয়া ব্রাহ্মণে।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া পরে দ্বিজেরে সুধায়।
কি লাগি এসেছ হেথা কহ তা আমায়।।
দ্বিজ বলে গুরু পাঠাইলেন আমারে।
রঘু রাজা স্বর্ণদান দিল ভারে ভারে।।
সে মহামুনির ধন রাখহ ভাণ্ডারে।
এত বলি ধন তথা রাখে মুনিবরে।।
বাসব বলেন, বাপু সত্য কহ কথা।
উঞ্ছবৃত্তি করি সোণা পাইলেন কোথা।।
দ্বিজ বলে দক্ষিণা চাহিল স্বর্ণ গুরু।
আমাকে দিলেন রঘুরাজা কল্পতরু।।
রাম রাম বলি ইন্দ্র কাণে দিল হাত।
রঘু নাম না করিহ আমার সাক্ষাৎ।।
নিশাতে না যাই নিদ্রা রঘুর ভয়েতে।
অযোধ্যা নগরে সদা ভ্রমি ক্ষেতে ক্ষেতে।।
স্থানান্তরে নিয়া প্রভু রাখ এই ধন।
ধনের কারণে রঘু বধিবে জীবন।।
তাহারে চিনেছি আমি বহুদিন হতে।
তার সম বীর নাই এ তিন জগতে।।
ধন লৈয়া বরদত্ত গেল গুরুপাশে।
গুরু বলে রাখ নিয়া পর্ব্বত কৈলাসে।।
নিজ ধন দেখিয়া কুবের মনে হাসে।
গিয়াছে যাহার ধন আইল তার পাশে।।
রঘু ভূপতির যশ ত্রিভুবেন ঘোষে।
রচিলেন আদিকাণ্ড পণ্ডিত কৃত্তিবাসে।।