০১. নারায়ণের শ্রীরাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন চারি অংশে প্রকাশ বিবরণ

গোলোক বৈকণ্ঠপুরী সবার উপর।
লক্ষ্মী সহ আছেন তথায় গদাধর।।
তথায় অদ্ভুত বৃক্ষ দেখিতে সুচারু।
যাহা চাই, তাহা পাই, নাম কল্পতরু ।।
দিবা নিশি তথা চন্দ্র সূর্য্যের প্রকাশ।
তার তলে আছে দিব্য বিচিত্র আবাস।।
নেতপাট সিংহাসন উপরেতে তুলি।
বীরাসনে বসিয়া আছেন বনমালী।।
মনে মনে প্রভুর হইল অভিলাষ।
এক অংশ চারি অংশে হইতে প্রকাশ।।
শ্রীরাম ভরত আর শত্রুঘ্ন লক্ষ্মণ।
এক অংশে চারি অংশ হৈলা নারায়ণ ।।
লক্ষ্মীমূর্ত্তি সীতাদেবী বসেছেন বামে।
স্বর্ণছত্র ধরেছেন লক্ষ্মণ শ্রীরামে।।
চামর ঢুলান তাঁরে ভরত শত্রুঘ্ন।
যোড়হাতে স্তব করে পবন-নন্দন ।।
এইরূপে বৈকুণ্ঠে আছেন গদাধর।
হেনকালে চলিলা নারদ মুনিবর।।
বীণাযন্ত্র হাতে করি হরি-গুণ গান।
উত্তরিলা গিয়া মুনি প্রভু-বিদ্যমান।।
রূপ দেখি বিহ্বল নারদ নাচে ধীরে।
বসন তিতিল তাঁর নয়নের নীরে।।
হেন রূপ কেন ধরিলেন নারায়ণ।
ইহা জিজ্ঞাসিব গিয়া যথা পঞ্চানন।।
ভাবী ভূত বর্ত্তমান শিব ভাল জানে।
এ কথা কহিব গিয়া মহেশের স্থানে।।
এতেক ভাবিয়া যাত্রা করে মুনিবর।
উত্তরিলা প্রথমেতে ব্রহ্মার গোচর ।।
বিধাতারে লয়ে যান কৈলাস-শিখরে ।
শিবকে বন্দিয়া পাছে বন্দিলা দুর্গারে।।
নিরখিয়া দুইজনে তুষ্ট মহেশ্বর।
জিজ্ঞাসা করেন তবে তাঁদের গোচর।।
কহ ব্রহ্মা, কহ হে নারদ তপোধন।
দোঁহে আনন্দিত আজি, দেখি কি কারণ।।
বিরিঞ্চি বলেন, শুন দেব ভোলানাথ।
দেখিলাম গোলোকে অপূর্ব্ব জগন্নাথ।।
দেখিতাম পূর্ব্বেতে কেবল নারায়ণ।
চারি অংশ দেখি এবে কিসের কারণ।।
ব্রহ্ম-বাক্য শুনিয়া কহেন বৃত্তিবাস।
সেইরূপ ইহকালে হইবে প্রকাশ।।
যে রূপে আছেন হরি গোলক ভিতর।
জন্ম নিতে আছে ষাটি হাজার বৎসর।।
রাবণ রাক্ষস হবে পৃথিবী-মণ্ডলে।
তাহারে বধিতে জন্ম লবেন ভূতলে।।
দশরথ-ঘরে জন্মিবেন চারিজন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ আর ভরত শত্রুঘ্ন।।
এক অংশ নারায়ণ চারি অংশ হৈয়া।
তিন গর্ভে জন্মিবেন শুভক্ষণ পাইয়া।।
জানকী সহিত রাম লইয়া লক্ষ্মণ।
পিতৃসত্য পালনার্থ যাইবেন বন।।
সীতা উদ্ধারিবে রাম মারিয়া রাবণ।
লব কুশ নামে হবে সীতার নন্দন।।
মনুষ্য গো-হত্যা আদি যত পাপ করে।
একবার রামনামে সর্ব্ব পাপে তরে।।
মহাপাপী হয়ে যদি রামনাম লয়।
সংসার-সমুদ্র তার বৎস পদ হয়।।
হাসিয়া বলেন ব্রহ্মা, শুন ত্রিলোচন।
পৃথিবীতে হেন পাপী আছে কোন্ জন।।
ধূর্জ্জটি বলেন, মম বাক্যে দেহ মন।
মধ্যপথে মহাপাপী আছে এক জন।।
তারে গিয়া রামনাম দেহ একবার।
তবে সে নিতান্ত মুক্ত হইবে সংসার।।
বিধাতা নারদ মুনি ভাবে দুইজন।
পৃথিবীতে মহাপাপী আছে সে কেমন।।
চ্যবন মুনির পুত্র নাম রত্নাকর।
দস্যুবৃত্তি করে সেই বনের ভিতর।।
বিরিঞ্চি নারদ দোঁহে সন্ন্যাসী হইয়া।
রত্নাকর কাছে দোঁহে মিলিল আসিয়া।।
বিধাতার মায়া হৈল রত্নাকর প্রতি।
সেই দিনে সেই পথে কারো নাহি গতি।।
উচ্চ বৃক্ষে চড়িয়া সে চতুর্দ্দিকে চায়।
ব্রহ্মা নারদেরে পথে দেখিবারে পায়।।
ভাবে মনে রত্নাকর লুকাইয়া বনে।
সন্ন্যাসী মারিয়া বস্ত্র লইব এক্ষণে।।
বিধাতা নারদ দোঁহে যান সেই পথে।
লোহার মুদগর তোলে ব্রহ্মারে বধিতে।।
ব্রহ্মার মায়াতে তার মুদগর না চলে।
মায়ায় মুদগর বদ্ধ তার করতলে।।
না পারে মারিতে তবে ভাবে মনে মন।
ব্রহ্মা জিজ্ঞাসেন বাপু তুমি কোন জন।।
রত্নাকার বলে, তুমি না চিন আমারে।
লইব তোমার বস্ত্র মারিয়া তোমারে।।
ব্রহ্মা বলে, মোরে মারি পাবে কত ধন।
করিয়াছ যত পাপ কহিব এখন।।
শত শত্রু মারিলে যতেক পাপ হয়।
এক গো বধিলে তত পাপের উদয়।।
এক শত ধেনু বধ যেই জন করে।
তত পাপ হয় যদি এক নারী মারে।।
এক শত নারী হত্যা করে যেই জন।
তত পাপ হয় এক মারিলে ব্রাহ্মণ ।।
এক শত ব্রহ্মবধে যত পাপোদয়।
এক ব্রহ্মচারী বধে তত পাপ হয়।।
ব্রহ্মচারী মারিলে পাতক হয় রাশি।
সংখ্যা নাই কত পাপ মারিলে সন্ন্যাসী।।
যেই পথ দিয়া গতি করেন সন্ন্যাসী।
আড়ে দীর্ঘে চারি ক্রোশ সম বারাণসী।।
সে পাপ করিতে যদি থাকে তব মন।
করহ এতেক পাপ কহিনু এখন।।
শুনিয়া কহিল দস্যু রত্নাকর হাসি।
মারিয়াছি তোমা হেন কতেক সন্ন্যাসী।।
ব্রহ্মা বলিলেন, যদি না ছাড়িবে মোরে।
ভাল স্থল দেখিয়া হে বধহ আমারে।।
যথা কীট পতঙ্গাদি পিপীলিকা গন্ধে।
লোভে না আইসে মৃত খাইতে আনন্দে।।
মারিলে দণ্ডের বাড়ি পড়িব ভূমিতে।
পিপীলিকা দণ্ডের বাড়ি পড়িব ভূমিতে।।
ব্রহ্মা বলিলেন পাপ কর কার লাগি।
তোমার এ পাতকের কেহ আছে ভাগী।।
রত্নাকর বলে, যত লয়ে যাই ধন।
মাতা পিতা পত্নী আমি খাই চারিজন।।
যেবা কিছু বেচি কিনি চারিজনে খায়।
আমার পাপের ভাগী চারিজনে হয়।।
শুনিয়া হাসিয়া ব্রহ্মা কহিলেন তবে।
তোমার পাপের ভাগী তারা কেন হবে।।
করিয়াছ যত পাপ আপনার কায়।
আপনি করিলে পাপ আপনার দায় ।।
জিজ্ঞাসা করিয়া তুমি আইস নিশ্চয়।
তোমার পাপের ভাগী তারা যদি হয়।।
নিতান্ত আমারে বধ কর তবে ‍তুমি।
এই বৃক্ষতলেতে বসিয়া থাকি আমি।।
হরিষ বিষাদে দস্যু লাগিল কহিতে।
বুঝিলাম এই যুক্তি কর পলাইতে।।
ব্রহ্মা বলে সত্য কহি, না পলাব আমি।
মাতা পিতা পত্নী সুধাইয়া এস তুমি।।
অতঃপর যায় দস্যু ফিরে ফিরে চায়।
ভাবে বুঝি ভাঁড়াইয়া সন্ন্যাসী পলায়।।
প্রথমে পিতার কাছে করে নিবেদন।
আদিকাণ্ড গান কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।।