বিষ – ৪ (শেষ)

বুমবুমদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান ছিল আজ। নাচ গান নাটক আবৃত্তি মিলিয়ে রীতিমত জমজমাট ব্যাপার। নাটকে খরগোশ সেজেছিল বুমবুম। সাদা পোশাক পরে, লম্বা লম্বা কান লাগিয়ে সে বেজায় লম্ফঝম্প জুড়ল মঞ্চ জুড়ে। ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখে মিতিন তো হেসে বাঁচে না। মা ছেলে বাড়ি ফিরল রাত ন’টায়। ঢুকতে না ঢুকতে পার্থর সরব ঘোষণা— তোমার লাবণ্য কেসের ড্রপসিন তো পড়ে গেল গো?
মিতিন থমকে গেল— মানে?
— ক্যাচ কট কট। পুলিশ আসামী পাকড়াও করে ফেলেছে।
— কে আসামী?
— জামাই বাবাজীবন। রণজয় চৌধুরী। তুমি যাকে অ্যাপোলো বলেছিলে, সেই হারামজাদা। পার্থ চোখ নাচাল, এই তো এত ক্ষণ খবরে দেখাচ্ছিল। হুইস্কির গ্লাসে লাবণ্য ছাড়া যে দ্বিতীয় হাতের ছাপটি পাওয়া গেছে, সেটি শ্রীমান রণজয়েরই।
— তাই নাকি?
— শুধু তাই নয়, আরও অনেক কেলো বেরিয়েছে। মিস্টার অ্যাপোলো একটি আস্ত ক্যাসানোভা। বিয়ের আগে থেকেই নাকি শাশুড়ির সঙ্গে তার আশনাই ছিল। মেয়েকে বিয়ে করেও মোহব্বতে ছেদ পড়েনি। একই সঙ্গে দু’দিকে ডিউটি করে যাচ্ছিল। এভরি ফ্রাইডে নাকি জোর রংরলিয়া চলত শাশুড়ি জামাইয়ে। সারা দুপুর। তবে কথায় আছে না, জন জামাই ভাগ্না কেউ নয় আপনা…! পার্থ হ্যা হ্যা হাসল, ব্যাটা দিয়েছে শাশুড়িকে মোক্ষম দাওয়াই।
মিতিনের একটুও হাসি পেল না। গোমড়া মুখে বলল, তা শাশুড়ি-জামাইয়ের রিলেশনের গল্পটা কী ভাবে পিকচারে এল?
— কাজের মেয়েটা বলেছে। রণজয়ও কনফেস করেছে।
— খুনটাও?
— সেটা অবশ্য টিভিতে বলল না। তবে স্বীকার তো করতেই হবে। পুলিশের গুঁতো যখন পড়বে পিঠে…।
— বাপ-মেয়ের কী রিঅ্যাকশন? তাদের দেখাল খবরে?
— মুহ্যমান মুখে বসে আছে দু’জন। স্পিকটি নট। …ফ্যামিলিতে এমন একখানা রগরগে স্ক্যাণ্ডাল, ঠোঁটে আর বাক্যি ফোটে!
পার্থকে বেশ পুলকিত দেখাচ্ছে। ধীর পায়ে ঘরে এল মিতিন। সালোয়ার কুর্তা বদলে নাইটি চড়িয়ে নিল গায়ে। তার পর বাথরুম টাথরুম ঘুরে ফের এসেছে সোফায়। আরতি চা রেখে গেল, চুমুক দিচ্ছে কাপে, নিশ্চুপ মুখে।
পার্থ টেরিয়ে টেরিয়ে মিতিনকে দেখছিল। নাক কুঁচকে বলল, টিকটিকি ম্যাডাম হঠাৎ গুম? আপসেট? মিতিনের ঠোঁট নড়ল, একটু।
— রণজয় অ্যারেস্ট হল বলে? পার্থ খিকখিক হাসছে, না কি তোমার আগে পুলিশ কেসটা সল্‌ভ করে ফেলল, সেই শোকে?
— দুটোর কোনওটাই না। আমার ধারণা, কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে।
— হাসিও না তো। হুইস্কিতে আর্সেনিক, গ্লাসে হাতের ছাপ, চারটে অব্দি লাবণ্যর ফ্ল্যাটে রণজয়ের প্রেজেন্স, তাদের অবৈধ সম্পর্ক… আর কী চাই?
— কিন্তু মোটিভ?
— লাবণ্য নিশ্চয়ই আশনাইটা আর টানতে চাইছিল না। জামাই তাই রাগে…
— টেঁকে না। লাবণ্যর প্রেমে গদগদ থাকলে রণজয় মোটেই রুমকিকে বিয়ে করত না। হি হ্যাড লং টার্ম ইন্টেনশন। শ্বশুরের সম্পত্তি।
— সে দিক দিয়েও ভাবা যায়। রণজয়ই হয়তো নোংরা রিলেশনটা থেকে ছাড়ান পেতে চাইছিল, আধবুড়িটা রাজি হচ্ছিল না। হয়তো সে ভয় দেখিয়েছিল, মেয়ের কাছে রণজয়ের আসলি চেহারা ফাঁস করে দেবে। ওই খ্যাপা মহিলার পক্ষে যা আদৌ অসম্ভব নয়। আর জানাজানি হওয়া মানেই তো সর্বনাশ। এমারেল্ড টাওয়ারের দু’খানা ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে যাবতীয় অ্যাসেট মরীচিকার মতো ভ্যানিশ। অগত্যা মরিয়া হয়ে এই কুকীর্তি।
— এটা তাও মন্দ শোনাচ্ছে না। স্লো-পয়জনিংয়ের কমপ্লেনটাও এর সঙ্গে অনেকটা মেলানো যায়। মিতিন ঘাড় নাড়ল, তবু… এমন একটা বোকামি… আর্সেনিক মেশানো হুইস্কিটা ওভাবে ফেলে রেখে গেল? গ্লাস ধুয়ে জায়গা মতন রেখে দিলে তো সুইসাইড ছাড়া কিছু ভাবাই যেত না।
— এই সিলি ভুলগুলো করে বলেই না ক্রিমিনালরা ধরা পড়ে। পার্থ গলা ফাটিয়ে হাসল, আর তোমরা টিকটিকিরা তাদের ঘেঁটি পাকড়ে করেকম্মে খাও।
— যা খুশি বলতে পারো, আমি কিন্তু কনভিন্সড নই। মিতিন টেবিলে কাপ নামাল, এখনও বেশ কয়েকটা ফাঁক আছে। দু’একটা কো ইন্সিডেন্সও ভারী অদ্ভুত।
— যেমন? পার্থ ভুরু কুঁচকোল, তুমি কি এখনও লাবণ্য দেবীর হাজব্যাণ্ডকেই ধরে বসে আছ?
— আমি কাউকেই ধরে নেই। আবার কাউকে ছাড়ছিও না।
— বুঝেছি। পার্থ চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়েছে। লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, এমন অবশ্য হতেই পারে লোকটা জামাইকে ফাঁসিয়ে নিজে পাঁকাল মাছের মতো পিছলে গেল। অনিমেষবাবু যেন কখন আবার এসেছিল এমারেল্ড টাওয়ারে?
— অ্যাকর্ডিং টু হিজ স্টেটমেন্ট, অ্যারাউণ্ড পৌনে চারটে। দশ বিশ মিনিট এ দিক ও দিকও হতে পারে। সিকিয়োরিটির লোক ঠিক টাইম বলতে পারছে না।
— তা হলে সন্দেহ তো থাকেই। অফিস গিয়েও সে আবার ফিরেছিল কেন? বলেছে খুব টায়ার্ড ছিল, অথচ নিজের ফ্ল্যাটে না ঢুকে গাড়ি রেখে পার্কে গিয়ে বসে রইল?
— গ্লাসে কিন্তু তার হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি।
— রাইট। এইখানেই তো কেসটা গুলিয়ে যাচ্ছে।
— কেন মিছিমিছি মগজকে ট্যাক্স করছ? ছাড়ো না। বলেই মিতিন ঠোঁট কামড়ে দু’এক সেকেণ্ড ভাবল কী যেন, তার পর মোবাইলে চেনা নম্বর টিপছে।
— আরে, ম্যাডাম যে? ও প্রান্তে সুবীরের স্বরে উল্লাস, দেখেছেন তো নিউজ, চিড়িয়াকে খাঁচায় পুরেছি।
মিতিন গলা মোলায়েম করে বলল, কাজটা ঠিক হল কি? পরে পস্তাতে হবে না তো?
— কেন, কেন, কেন?
— কী বিষে লাবণ্যদেবীর মৃত্যু হয়েছে তা কিন্তু এখনও আননোন। আর্সেনিকে মুখ দিয়ে ও-রকম গ্যাঁজলা বেরোয় না।
— রাখুন তো আপনার থিয়োরি। হুইস্কির সঙ্গে পাঞ্চ করে পেটে কী রিঅ্যাকশন করেছে তার কি কোনও ঠিক আছে?
— তবু… ভিসেরা রিপোর্ট অব্দি ওয়েট করলে হত না?
— আহা, চার্জশিট তো তার পরেই ফ্রেম করব। নিশ্চিন্ত থাকুন, ভিসেরা আমাকে ডোবাবে না।
ডুবতে কিন্তু হলই সুবীর হালদারকে। পুরোটা না হলেও, অনেকটাই। পুজোয় কুলু মানালি বেড়াতে গিয়েছিল মিতিনরা, ফিরল দেওয়ালির মুখে মুখে। হপ্তাখানেক পরেই এক সন্ধেবেলা সুবীরের ফোন, ম্যাডাম কি বাড়িতে আছেন?
— আছি। কেন?
— আমি আসছি। জরুরি দরকার।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাড়ির সামনে পুলিশের জিপ। হন্তদন্ত পায়ে সুবীরের প্রবেশ। ধপাস করে সোফায় বসে বলল, আপনার প্রেডিকশনই ফলে গেল।
মিতিন মুচকি হাসল, লাবণ্য মজুমদারের ভিসেরা রিপোর্ট এসেছে বুঝি?
— আজই পেলাম। মহিলার লিভার কিডনিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে বটে, তবে তা নিতান্ত সামান্য। লিথাল ডোজ একেবারেই নয়।
— তা হলে পয়জনিংটা…?
— দু’ধরনের ওষুধের জয়েন্ট এফেক্ট। ষ্ট্রেঞ্জ কেস ম্যাডাম।
— ওষুধ? কী ওষুধ?
— নামগুলো হল…। বুকপকেট থেকে একখানা চিরকুট বার করল সুবীর। চোখ থেকে বেশ খানিক দূরে ধরে বিনা চশমায় পড়ছে, মনো অ্যামিনো অক্সিবেসড ইনহিবিটরস। আর অ্যামিট্রিপটিলিন…
— এগুলো তো মেন্টাল ডিপ্রেশনের মেডিসিন! রিভার্স গ্রুপ! হাইলি রিঅ্যাক্টিভ! দুটো একসঙ্গে পড়লে ঘণ্টাখানেক, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে যে কেউ মারা যাবে।
— তাই বুঝি? সুবীর মাথা চুলকোচ্ছে, তা হলে তো এটা সুইসাইডের কেসও হতে পারে। কিংবা মহিলা ভুল করে একসঙ্গে দুটো মেডিসিন…
— কিন্তু দুটো একসঙ্গে থাকবে কেন?
— কারেক্ট। সুবীর খাড়া হয়ে বসল, এই লাইনেও তো রণজয় চৌধুরীকে বাঁধা যেতে পারে। ব্যাটা নির্ঘাত আর্সেনিক মেশানো মদ গেলাতে না পেরে বাই ফোর্স ওই দুটো ওষুধ খাইয়ে…
— কেস গুছিয়ে সাজাতে পারবেন তো?
— খুব পারব। ওই ধিনিকেষ্টকে আমি ছাড়বই না। ভালমানুষ বাবা আর নিরীহ মেয়েটাকে যে কত যন্ত্রণা দিয়েছে… সাজা বাছাধনকে পেতেই হবে।
— রণজয় কি এখনও জেল কাস্টডিতে?
— বেরনোর জন্য হাঁকপাঁক করছে। ওর বাপ দাদারা হাইকোর্ট অব্দি বেল পিটিশন মুভ করেছিল, খারিজ হয়ে গেছে।
— রণজয়কে জেরা করে কিছু বের করা গেল?
— রিলেশনটা অ্যাডমিট করছে, কিন্তু মার্ডার চার্জটা মানছে না। এনিওয়ে, তুলি তো কোর্টে, তার পর দেখা যাবে।
ঢকঢক দু’গ্লাস জল খেয়ে চলে গেল সুবীর। মিতিন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে। মিনিট দশেক পর ফিরল ঘরে। পায়চারি করছে আপন মনে। হঠাৎই কী ভেবে নিজের স্টাডিরুমে এসে কাগজ কলম নিয়ে বসল। লিখছে, আঁকিবুঁকি কাটছে…। মোবাইল তুলে আচমকা ডায়াল করল অনিমেষ মজুমদারকে। জেনে নিল ডক্টর সেনের নাম্বার। ফের মোবাইলের বোতামে আঙুল। হ্যাঁ, পেল লাবণ্যর ডাক্তারকে। কথা সেরে অফ করে দিল ফোন। মাথা রাখল টেবিলে। ঘাড় গুঁজে বসে আছে মিতিন। বসেই আছে।
বাসস্টপ থেকে রুমকিকে দেখতে পেল মিতিন। স্কুলগেট পেরিয়ে এগিয়ে আসছে মন্থর পায়ে। জীবন্ত এক বিষাদপ্রতিমা যেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কলকল করছে চার পাশে, কোনও দিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই রুমকির। এমনই উদাস, এমনই সন্তপ্ত।
কাছে গিয়ে মিতিন মৃদু স্বরে ডাকল, রুমকি?
চমকেছে মেয়েটা। অবাক মুখে বলল, আপনি? এখানে?
— আপনার কাছেই এসেছি। স্কুল ছুটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
— দরকার আছে কোনও?
— হুঁ। …এমারেল্ড টাওয়ার তো কাছেই, চলুন না এগোতে এগোতে কথা বলি।
পড়ন্ত বেলা। হেমন্তের পেলব রোদ্দুর মায়া বিছিয়েছে পথে। টুপটাপ ঝরছে শুকনো পাতা। বাতাসে হাল্কা শিরশিরে ভাব। হাঁটতে হাঁটতে মিতিন নিচু গলায় বলল, আপনাকে একটা গল্প শোনাব। এক দুঃখী মেয়ের কাহিনি।
রুমকি ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল— হঠাৎ?
— এমনিই। ইচ্ছে করছে। গল্পটা বোধহয় আপনার চেনা চেনা লাগবে। বুনতে গিয়ে যদি কোথাও ফাঁকফোকর আসে, আপনি শুধরেও দিতে পারেন। আড়চোখে রুমকিকে দেখে নিয়ে মিতিন শুরু করল, নেহাতই মধ্যবিত্ত এক তরুণীর বিয়ে হয়েছিল এক ব্রাইট ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। স্রেফ রূপের জোরে। বিয়ের বছর দেড় দুই পর তাদের একটি মেয়ে হল। তার পর থেকেই মহিলা যেন কেমন বদলে যেতে থাকল। তার বর সাফল্যের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছে, রোজগার করছে এন্তার, বউকে স্বাচ্ছন্দ্য আর বিলাসের উপকরণ কিনে দিচ্ছে রাশি রাশি, কিন্তু বউয়ের জন্য খরচ করার সময় তার নেই।
স্বামীর সাহচর্য না পেয়ে পেয়ে, এক চোরা বুভুক্ষা থেকে, মহিলার মধ্যে জন্ম নিল এক অদ্ভুত বিকৃতি। স্বাভাবিক ঘরোয়া জীবন আর তার পছন্দ নয়, তার চাই নিত্যনতুন উত্তেজনা। চাই নেশা, চাই উদ্দামতা। ক্লাব। পার্টি। পুরুষমানুষ। একটু একটু করে সে চলে গেল স্বামীর হাতের বাইরে। নিজের মেয়ের দিকেও সে ফিরে তাকায়নি। মা নয়, সেই মেয়েটাকে নিয়েই আমার গল্প।
— কী গল্প?
— বলছি তো। …মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। তার এক দিকে কাজপাগল বাবা, অন্য দিকে তুমুল উচ্ছৃঙ্খল মা। দু’জনের মাঝখানে পড়ে সে একা, ভীষণ একা। শামুকের মতো খোলের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখে সে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও মিশতে পারে না। কলেজ টলেজ পাশ করে মেয়েটা মোটামুটি একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলে ডুবে থাকতে চাইল অন্য দুনিয়ায়। এমনই এক সময়ে মেয়েটির জীবনে এল এক অনিন্দ্যকান্তি পুরুষ। তার মা ই পরিচয় করিয়ে দিল ছেলেটার সঙ্গে। নেহাতই সাদামাটা চেহারার অন্তর্মুখী মেয়েটা স্বপ্নেও ভাবেনি এমন একটি রূপবান পুরুষ আসবে তার জীবনে।
ছেলেটা তার প্রতি সামান্য আগ্রহ দেখাতেই সে পাগলের মতো ভালবেসে ফেলল তাকে, আর বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে তো আত্মহারা। বেচারা তখন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, গোটা ঘটনাটাই একটা সাজানো ছক। তার মা চেয়েছিল মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে পুরোপুরি কব্জায় রাখতে। আর ছেলেটার টার্গেট ছিল সো কল্‌ড শ্বশুরের সম্পত্তি।
যাই হোক, বিয়ের পর দিব্যি চলছিল শাশুড়ি জামাইয়ের লীলাখেলা। তবে বাইরে বাইরে। নতুন একটি মেয়ে কাজে লাগার পর বাড়িতেই শুরু হয়ে গেল ফুর্তি। কাজের মেয়েটা সপ্তাহে এক দিন দুপুরে বেরিয়ে যায়, ঠিক সেই সময়টায়। কিন্তু কপাল খারাপ। কাজের মেয়েটা এক দিন কী কারণে যেন বেরিয়েও ফিরে এল, গোপনে দেখে ফেলল সমস্ত কীর্তিকলাপ। ব্যস, খবর পৌঁছে গেল মেয়ের কানে। অমনি আগুন জ্বলে উঠল তার বুকে। প্রতিহিংসার। ঘেন্না তো মাকে সে করতই, এ বার স্থির করল একেবারে শেষ করে দেবে। শুরু হল পরিকল্পনা মাফিক আর্সেনিক পয়জনিং। কেমিষ্ট্রির ছাত্রী সে, জানে চায়ের সঙ্গে কতটুকু করে মেশালে মা ধিকিধিকি মরবে, কিন্তু কাকপক্ষীটিও টের পাবে না।
তা সে মতোই চলছিল। তবে বিধি বাম। আচমকা এক বই পড়ে মার মনে ধন্দ জাগল। সেঁকো বিষের লক্ষণ কেন ফুটে উঠছে দেহে? মানসিক রোগী বলে ডাক্তারও যখন তাকে তেমন আমল দিল না, সে ছুটল ডিটেকটিভের কাছে। ডিটেকটিভ মাকে রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছে জেনেই মেয়ে প্রমাদ গুনল। সর্বনাশ, এ বার তো চক্রান্ত ধরা পড়ে যাবে!
আর সময় নষ্ট করল না মেয়ে। প্ল্যান মাফিক শুক্রবার স্কুল যাওয়ার আগে মার কাছ থেকে প্যাথোলজিকাল ল্যাবরেটরির রসিদটা চেয়ে নিল, রিপোর্টটা সে নিজেই আনবে। দুপুরে জানল, বাবা হঠাৎ ফিরে এসেছে। বাবার অবর্তমানেই কাজটা শেষ করার ইচ্ছে ছিল তার, কিন্তু তখন আর পিছনোর উপায় নেই। স্লো পয়জনিংয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে যে। অতএব পুরনো পরিকল্পনা মতোই চারটে বাজার মিনিট কয়েক আগে ফোন করল নিজের ফ্ল্যাটে, বর তখন আট তলায়, ধরল না।
সঙ্গে সঙ্গে বরকে মোবাইলে ফোন। বলল, লোক আসবে, তাকে বসাও। বর তড়িঘড়ি নেমে এল নীচে। ফ্ল্যাটে সে ফিরল কিনা বুঝে নিতে ফের নীচের ল্যাণ্ডলাইনে ফোন। হ্যাঁ, কাঁটা সরে গেছে, ময়দান ফাঁকা। এ বার মেয়ে সোজা গেল মায়ের ফ্ল্যাটে। জামাইয়ের সঙ্গে ব্যভিচার নিয়ে সরাসরি মাকে চার্জ করল। অমনি হিস্টিরিক হয়ে পড়ল মা। তাকে শান্ত করার জন্য মেয়ে পলকে নরম, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো ওষুধ খেতে দিল।
মার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সুবাদে সে জানত মানসিক অবসাদের ওই দুটো ওষুধ একসঙ্গে খেলে এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে মা মরবেই। তবু অপেক্ষা করল খানিক ক্ষণ। যত ক্ষণ না মার কনভালশন থামে। তার পর ঠাণ্ডা মাথায় সিংকে নামানো দুটো গ্লাসের একটাকে রুমালে জড়িয়ে তুলে এনে, তাতে ফের হুইস্কি ঢেলে, দুশো মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক মিশিয়ে রাখল সকলের দৃষ্টির সামনে। নিঃশব্দে নিজের ফ্ল্যাটে এসে ইনশিওরেন্সের এজেন্টের সঙ্গে কথা বলল, চাউমিন বানাল…।
সে অবশ্য জানতে পারেনি, তার বাবাও সে দিন ফিরেছিল ফ্ল্যাটে। খানিক আগেই। বউ আর জামাইকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। এখন অবশ্য বাবা মেয়ে দু’জনেরই হাড় জুড়িয়েছে। মহিলাও খতম, জামাইও শ্রীঘরে। একটানা বলে থামল মিতিন। দেখছে রুমকির প্রতিক্রিয়া। অনেক ক্ষণ পর রুমকির স্বর ফুটল, মেয়েটার এখন কী করা উচিত?
— সেটা মেয়েটাই ঠিক করুক। রুমকির কাঁধে হাত রাখল মিতিন। আলতো হেসে বলল, তবে এটুকু বলতে পারি, নিজে সারেণ্ডার না করলে মেয়েটাকে কোনও দিনই ধরা যাবে না।
নিঝুম হয়ে শুনল রুমকি। নিঃশব্দে অতিক্রম করল বাকি পথটুকু। এমারেল্ড টাওয়ারের গেটে পৌঁছে নির্জীব চোখে এক বার দেখল মিতিনকে। তার পর চলে গেল পায়ে পায়ে। পর দিন সকালে সুবীর হালদারের ফোন পেল মিতিন। এমারেল্ড টাওয়ারে আবার অস্বাভাবিক মৃত্যু। এ বার আট তলা নয়, তিন তলায়। ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে রুমকি।

[শেষ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *