৮. বারবাড়ির দিক থেকে দ্রুত হেঁটে

বারবাড়ির দিক থেকে দ্রুত হেঁটে আসছিল পারু।

উঠোনের মাঝামাঝি আসতেই নিজের ঘরের বারান্দা থেকে বর্ষা তাকে ডাকল। পারু।

পারু থমকে দাঁড়াল।

বারান্দা থেকে নেমে পারুর সামনে এসে দাঁড়াল বর্ষা। তোকে না বলেছিলাম ফুল তুলে আনতে?

পারু উচ্ছল গলায় বলল, এনেছি তো!

কোথায়?

তোমার ঘরেই রেখে দিয়েছি।

কই, আমি যে দেখলাম না!

পারু হাসল। তুমি হয়তো খেয়াল করনি।

কখন তুলেছিস?

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই।

ঠিক আছে, আমি এখানে দাঁড়াই, ফুলগুলো তুই নিয়ে আয়।

আচ্ছা।

পারু ছুটে চলে গেল।

কেন কে জানে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বর্ষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আশ্চর্য ব্যাপার, বর্ষার এই দীর্ঘশ্বাসটাই যেন মিনুর বুকে এসে লাগল। তিনি একটু কেঁপে উঠলেন।

ব্যাপারটা খেয়াল করলেন হাদি সাহেব। উতলা গলায় বললেন, কী হল?

মিনু বললেন, হঠাৎ বুকটা কেমন কেঁপে উঠল।

কেন?

কী জানি!

নাহিদ বলল, শরীর খারাপ লাগছে না তো?

না।

এমনি এমনিও অনেক সময় বুক কাঁপে মানুষের।

তারপর বাবার দিকে তাকাল নাহিদ। কী যেন বলছিলে বাবা?

হাদি সাহেব বললেন, শুভর কথা। হঠাৎ শুভ এল আমাদের বাড়িতে?

নাহিদ বলল, আসতে চায়নি, আমি নিয়ে এসেছি।

মিনু মুগ্ধ গলায় বললেন, ভাল করেছিস। শুভ খুব ভাল ছেলে। দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগে। মুখটা এত মায়াবী!

হাদি সাহেব বললেন, ছেলেটিকে আমার ভাল লেগেছে বিনয় এবং ভদ্রতার জন্য। হোটেলে যেদিন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল সেদিনই ব্যাপারগুলো আমি খেয়াল করলাম। আজকালকার এই বয়সি ছেলেমেয়েদের এত বিনয়, এত ভদ্রতা দেখা যায় না। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো কেমন যেন রুক্ষ। বিনয় ভদ্রতার ধার ধারে না।

তারপর একটু থেমে বললেন, শুভ কি কয়েকদিন থাকবে আমাদের এখানে?

নাহিদ বলল, হ্যাঁ বাবা, বেশ কিছুদিন থাকবে। আমরা দুজনেই রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি। রেজাল্ট বেরুবার পর চাকরি বাকরির চেষ্টা করব। এরকম ফ্রি সময় তো আর পাওয়া যাবে না, এজন্য শুভকে আমি বললাম, চল, মাসখানেক আমাদের বাড়িতে থেকে আয়।

নাহিদের কথা শুনে মিনু বললেন, মাসখানেক পর যখন চলে যাবে তখন আমার মনটা খুব খারাপ হবে। বাদল চলে যাওয়ার পর বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কাল থেকে মনে হচ্ছে, মানে শুভ আছে, মনে হয় বাদলই আছে। বাড়িটা আবার ভরে উঠেছে।

একথা শুনে নাহিদ যেন একটু বিরক্ত হল। সব সময় এভাবে ভেব না মা। তোমার কথা শুনে মনে হয় বাদলই তোমার সব ছিল। আমি তোমার কেউ নই, বর্ষা তোমার কেউ নয়।

মিনু হাহাকারের গলায় বললেন, না বাবা না। এভাবে বলিস না। মা বাবার কাছে প্রতিটি সন্তানই পাঁজরের একেকটি হাড়। একজন চলে যায় একটি হাড় ভেঙে যায়। সেই ভাঙা হাড়ের কষ্ট সারাজীবন থাকে।

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মিনু। আঁচলে চেপে চেপে চোখ মুছতে লাগলেন।

তখন হঠাই যেন বর্ষার কথা মনে পড়ল হাদি সাহেবের। তিনি একটু উদ্বিগ্ন হলেন। আমরা তিনজন এই ঘরে, বর্ষা কোথায়?

আঁচলে ফুল নিয়ে বর্ষা তখন বাদলের কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। খানিক দাঁড়িয়ে, কবরের দিকে তাকিয়ে আঁচলে হাত দিল। মুঠো মুঠো ফুল তুলে কবরে ছড়াতে ছড়াতে ফিসফিসে গলায় বাদলকে ডাকল। বাদল, বাদল! তুই কি ঘুমিয়ে আছিস? এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়? এই যে আমি ফুল নিয়ে এসেছি তুই দেখতে পাচ্ছিস?

কথা বলতে বলতে জলে চোখ ভরে এল বর্ষার। ধরা গলায় সে বাদলের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তুই কোথায় চলে গেলি? আমার কথা তোর মনে পড়ে না? আমাকে ছেড়ে তুই কেমন করে চলে গেলি? তোর জন্য আমি খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না। আমি কী করব তুই বলে দে।

বাদলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল বর্ষা।

দূর থেকে এই দৃশ্যটা দেখতে পেল শুভ।

হাঁটতে হাঁটতে মাঠের দিকটায় এসেছে সে। মাঠের এক কোণে বাদলের কবর। এখনও পাকা করা হয়নি। বাঁশের বেড়া দেয়া। সেই বেড়া দুহাতে ধরে কাঁদছে বর্ষা।

দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতর হু হু করে উঠল শুভর। নিজের অজান্তেই যেন বর্ষার পাশে এসে দাঁড়াল সে। বর্ষার কাঁধে হাত দিল।

চমকে শুভর দিকে তাকাল বর্ষা।

শুভ বলল, কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে হয় না। কাদলে যে মারা যায় তার আত্মা খুব কষ্ট পায়। তুমি চাও মৃত্যুর পরও কষ্ট পাক তোমার ভাই?

কথাটা শুনে বর্ষা একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। না না, আমি চাই না। আমি কিছুতেই চাই না বাদল আর কোনও রকমের কোনও কষ্ট পাক। অসুখে অসুখে অনেক কষ্ট সে পেয়েছে। অনেক কষ্ট। আমি চাই আল্লাহ ওকে সুখে রাখুন, ভাল রাখুন। কোনও কষ্ট যেন ওকে আর কখনও পেতে না হয়।

তাহলে কবরের সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে আর কখনও কাঁদবে না। দোয়া করবে। আল্লাহকে বলবে ওর আত্মাকে তিনি যেন সুখে রাখেন।

শুভ একটু থামল। তারপর বলল, বাড়ি চল।

বর্ষা কোনও কথা বলল না। ওড়নায় চোখ মুছে কবরের সামনে থেকে সরে এল।

.

শুভর বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে নাহিদ।

শুভর জন্য অপেক্ষা করছে।

একা একা কোথায় চলে গেল সে!

শুভ এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। নাহিদকে এই ঘরে দেখে অবাক হল। তুই এই ঘরে বসে আছিস?

নাহিদ উঠে বসল। বসে না, শুয়ে আছি।

শুভ হাসল। বুঝলাম কিন্তু কেন?

তোর জন্য।

আচ্ছা!

কোথায় গিয়েছিলি?

বাদলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল বর্ষা। ওকে নানা রকমের সান্ত্বনা দিলাম। তারপর তোদের গ্রামটা একটু ঘুরে দেখলাম।

কেমন লাগল?

নাহিদের পাশে বসল শুভ। আমার কাছে সব গ্রামই একরকম লাগে। স্নিগ্ধ সবুজ মায়াবি। একা একা ঘুরে বেড়ালে মন অন্যরকম হয়ে যায়।

তোর হয়েছে?

হ্যাঁ। তবে অন্য একটা কথাও মনে হয়েছে।

কী বলতো!

তোর সঙ্গে আমার এতদিনের বন্ধুত্ব কিন্তু আমি তোদের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুই জানি না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। খালুজান কী করেন রে?

নাহিদ হাসল।

হাসিটা খেয়াল করল না শুভ। বলল, এখানে আসার পর থেকে দেখছি সারাক্ষণই বাড়িতে বসে আছেন। কখনও কখনও কাছারি ঘরে গিয়ে বসছেন, কৃষক ধরনের কিছু লোকজন আসছে। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

এটাই তার পেশা।

মুখ ঘুরিয়ে নাহিদের দিকে তাকাল শুভ। মানে?

আমাদের গ্রামের চারপাশে যত ধানের জমি আছে সেগুলোর বেশির ভাগই আমাদের। যারা বাবার কাছে আসে তারা ওইসব জমি চাষ করে।

তার মানে বিশাল অবস্থা তোদের! তোরা হচ্ছিস এই এলাকার জমিদার!

ন তেমন বিশাল আর কই!

বিনয়ের দরকার নেই।

বিনয় করছি না। আমার বাবা হচ্ছেন অত্যন্ত নরম হৃদয়ের, দয়ালু ধরনের মানুষ। একটু কঠিন হলে অবস্থা আরও ভাল থাকত আমাদের।

বুঝেছি।

কী বুঝলি বল তো?

কৃষকরা এসে কেঁদেকেটে পড়লে অনেক কিছুই মাফ করে দেন তিনি।

রাইট।

এই ধরনের মানুষদের আমার খুব ভাল লাগে। অবশ্য তোরা সবাই বেশ নরম ধরনের। খালাম্মা খালুজান, তুই বর্ষা।

নাহিদ চুপ করে রইল।

যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন সুরে শুভ বলল, আচ্ছা শোন, এই পারু মেয়েটা কে রে? দেখে তো বাড়ির কাজের মেয়ে মনে হয় না!

আলতো করে চশমা খুলল নাহিদ। কাজের মেয়ে সে নয়।

তাহলে?

আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। বাড়ির অবস্থা ভাল না, এজন্য আমাদের এখানে থাকে। বাবা ওর জন্য পাত্র দেখছেন। আমরাই বিয়ে দিয়ে দেব।

একথার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে কেমন বদলে ফেলল শুভ। আর এই যে তোর হতভাগা বন্ধুটা বিয়ে করে ফেরার হয়ে আছে তার কী করবি?

নাহিদ হাসল। কী করতে হবে?

ণা না হাসি নয়, হাসি নয়। ওপরে ওপরে যত হাসি আনন্দেই থাকি, মনটা কিন্তু আমার ভাল না বন্ধু।

তা জানি।

পুরোটা মনে হয় জানো না। আমার কিন্তু সারাক্ষণই সেতুর কথা মনে হয়।

একটু উদাস হল শুভ। জানালার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, সেতু কী করছে, কেমন আছে কিছুই জানি না। ও জানে না আমার কথা। আমি যে তোদের এখানে চলে এসেছি…।

শুভর কাঁধে হাত দিল নাহিদ। এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। কয়েকদিন পর আমি ঢাকায় যাব, যেমন করে পারি সব খবর নিয়ে আসব।

কীভাবে নিবি?

দেখা যাক।

একটা সোর্স ছিল দোলন, কিন্তু ওর তো সেতুদের বাড়িতে যাওয়া নিষেধ!

এতকিছু তুই এখন ভাবিস না। যতদিন এখানে থাকবি, আনন্দে থাক। সেতু খুবই সিরিয়াস টাইপের মেয়ে। বিয়ে যখন একবার হয়ে গেছে, দুদিন আগে পরে সব ঠিক হবেই।

শুভ আর কথা বলল না। আনমনা হয়ে রইল।

.

মিনু বললেন, পারুর বিয়ের ব্যাপারে আর চেষ্টা করছ না?

হাদি সাহেব মাত্র শুতে যাবেন, স্ত্রীর কথা শুনে থমকালেন। কখন করব? বাদলকে নিয়ে এতবড় একটা ধকল গেল, ছেলেটা মারা যাওয়ার পর এখন যাচ্ছে বর্ষাকে নিয়ে। ছেলেমেয়ে নিয়ে টেনশান থাকলে অন্যকোনও দিকে মন দেয়া যায়?

স্বামীর পাশে বসলেন মিনু। বর্ষা এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে। এখন চেষ্টা করো।

পিঠের তলায় দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া হলেন হাদি সাহেব। কোথায় স্বাভাবিক হয়েছে? আমি তো ওর কোনও চেঞ্জ দেখছি না! বাদলের কবরের সামনে যাচ্ছে, কাঁদছে, চুপচাপ বসে থাকছে।

হয়তো আরও কিছুদিন এরকম থাকবে, তারপর ঠিক হয়ে যাবে।

হাদি সাহেব কীরকম আনমনা হলেন। বর্ষাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল!

চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকালেন মিনু। হঠাৎ একথা বললে যে!

মনে হল।

তুমি কি ওর বিয়ের কথা ভাবছ?

ভাবা উচিত না?

আগে পারুর বিয়েটা দাও, তারপর দেখা যাবে। বিএ পাসটা করুক বর্ষা।

হাদি সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তা কী আর হবে!

কেন হবে না?

মনে যে রকম আঘাত পেয়েছে, এই আঘাত কাটিয়ে পড়াশুনো চালানো খুব কঠিন। তারচে’ বিয়ে দিয়ে দিলে অবস্থাটা চেঞ্জ হতে পারে।

না, এখন এসব ভেব না।

কেন ভাবব না?

মাত্র কিছুদিন হল যে মেয়ের যমজ ভাই মারা গেছে সেই মেয়ের এখন বিয়ে হতে পারে না।

তা আমিও বুঝি। বর্ষার কথা ভেবেই বিয়ের চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছিল।

কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল হাদি সাহেবের। চোখ ভরে এল জলে। স্ত্রীর কাছ থেকে চোখের জল লুকোবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফেরালেন তিনি। মেয়েটির জন্য আমি খুব কষ্ট পাই। আমি চাই ও আবার আগের মতো হোক। হাসি আনন্দে ভরিয়ে রাখুক বাড়ি। এটা চাক আমার কাছে, ওটা চাক। গলা ছেড়ে গান করুক, ছুটোছুটি করুক।

মায়াবি হাতে স্বামীর একটা কাঁধ ধরলেন মিনু। তুমি মন খারাপ করো না। আমি বলছি, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ওকে ভাল করে বোঝাও। তুমি যা যা চাও জোর দিয়ে বল ওকে। আমার মনে হয় তাতে বেশ কাজ হবে।

স্ত্রীর কথা মনে রেখেই বুঝি পরদিন সকালে মেয়ের ঘরে এসে ঢুকলেন হাদি সাহেব।

বর্ষার ঘুম ভেঙেছে অনেক সকালে।

ঘুম ভাঙার পর মাথার কাছের জানালা খুলে দিয়েছে সে। বিছানায় বসে এখন ফাঁকা শূন্য দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাবার পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকাল।

হাদি সাহেব বললেন, নাস্তা খেয়েছ মা?

বর্ষা শান্ত গলায় বলল, খেয়েছি।

কথাটা শুনে হাদি সাহেব আনমনা হয়ে গেলেন। পাশে বসে অপলক চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বর্ষা বলল, কী হয়েছে বাবা? এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?

তোমাকে দেখছি।

আমাকে আবার দেখার কী হল?

আগে নাস্তা খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে তুমিও সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জিজ্ঞেস করতে, আমি নাস্তা খেয়েছি কি না!

বর্ষা কথা বলল না।

মেয়ের মাথায় হাত দিলেন হাদি সাহেব। যে চলে গেছে শুধু তার জন্যই তোমার মায়া? আমাদের জন্য মায়া নেই?

দুহাতে বাবার হাতটা ধরল বর্ষা। এমন করে বলো না বাবা, এমন করে বলো না। আমার কষ্টটা আরও বাড়ে। আর এই যে তুমি আমাকে তুমি তুমি করে বলছ, শুনে আমি যে কষ্ট পাচ্ছি তুমি তা বুঝতে পার?

পারি।

তোমার মুখে তুমি শুনলে নিজেকে খুব দূরের মনে হয়।

হাদি সাহেব ধরা গলায় বললেন, মৃত্যু আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে বাদলকে, আর বেঁচে থেকে তুই নিজে নিজে অনেক দূরে চলে গেছিস।

বর্ষা কাতর গলায় বলল, আমি কী করব বাবা? আমার কিছু ভাল লাগে না।

লাগতে হবে। বাদলের শোক তোকে ভুলতে হবে। তুই আগের মতো হয়ে যাবি। হাসবি, আনন্দ করবি। লেখাপড়া করবি, গান করবি। এভাবে জীবন চলে না মা। প্রত্যেক মানুষকেই একদিন মরতে হবে। একথা জেনেও আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের ধর্ম।

আমিও চেষ্টা করি বাবা। ভেতরে ভেতরে খুব চেষ্টা করি আগের মতো হতে। পারি না, কিছুতেই পারি না।

চেষ্টা করলে হয় না এমন কাজ মানুষের অভিধানে নেই। তুই আরও চেষ্টা কর।

বর্ষা তারপর হঠাৎ করেই কেমন শিশু হয়ে গেল। আধো আধো গলায় বলল, বাবা, তুমি আমাকে একটু আদর কর।

আয় মা আয়, আমার কাছে আয়।

বলে দুহাতে মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরলেন হাদি সাহেব। কোত্থেকে যে বুকফাটা এক কান্না এল তার। চোখের জলে গাল মুখ ভেসে গেল যেন নিজের অজান্তে।

.

কাছারি ঘরের বাইরের দিককার দরজা দিয়ে খুবই উচ্ছল ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল শুভ। বর্ষা ছিল ওদিকটাতেই। এখানে বেশ বড়সড় একটা বাগান। বাগান ছাড়িয়ে মাঠ। গাছপালা, ফুল আর সবুজ ঘাসে মনোরম হয়ে আছে জায়গাটা। এই পরিবেশে বর্ষাকে খুব অন্যরকম লাগল। বোধহয় এজন্যই শুভ তাকে ডাকল। এই, শোন।

বর্ষা অবাক চোখে শুভর দিকে তাকাল। আমাকে বলছেন?

শুভ সিরিয়াস মুখ করল। না তোমাকে না।

তাহলে?

হাওয়াকে বলেছি।

জ্বি?

হাওয়া মাঠ ফুলের বাগান, এদেরকে বলছি।

সঙ্গে সঙ্গে মুখ গম্ভীর হল বর্ষার। ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না। কী জন্য ডাকলেন, বলুন।

বর্ষার মুখভঙ্গি এবং কথা বলার ধরনে শুভ একেবারে বিব্রত হয়ে গেল। কোনও কারণ নেই। তুমি সবসময় মনমরা হয়ে আছ, ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু মজা করি, তোমার মনটা ভাল করি। তুমি বিরক্ত হবে এটা আমি বুঝতে পারিনি। তাহলে, তাহলে এভাবে তোমাকে ডাকতাম না। সরি।

শুভ মন খারাপ করে ভেতর বাড়ির দিকে চলে এল।

ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় কিছুক্ষণ বসে রইল তারপর খাটের তলা থেকে ব্যাগটা বের করে জামাকাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে নাহিদ এসে ঢুকল এই ঘরে। শুভকে জামাকাপড় গুছাতে দেখে অবাক হল। কী ব্যাপার? হঠাৎ জামাকাপড় গোছাচ্ছিস?

নাহিদের দিকে তাকাল না শুভ। গম্ভীর গলায় বলল, চলে যাব।

কোথায়?

শিলা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, তোমার পক্ষে এখন সবকিছুই সম্ভব। এই মুহূর্তে তুমি যদি বাড়ি থেকে বেরিয়েও যাও, আর কখনও এই বাড়িতে ফিরে না আস তাও আমি অবাক হব না।

না, তা আমি করব না। ওরকম প্ল্যান থাকলে আরও আগেই চলে যেতে পারতাম। চলে যাওয়া সবচে’ সহজ কাজ।

তা অবশ্য ঠিক।

এজন্যই ওই কাজটা আমি করব না। শুভকে আমার বর হিসেবে তোমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রপার সম্মানটা তাকে দিতে হবে।

কথাটা আমি একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই।

মানে?

মানে হচ্ছে তোমার বর হিসেবে শুভর সম্মান টম্মান কোনও ব্যাপার নয়, তুমি তোমার পৈতৃক সম্পত্তির শেয়ার না নিয়ে এখান থেকে যাবে না।

ওসব নিয়ে আমি ভাবছি না।

নিশ্চয় ভাবছ।

আসলেই ভাবছি না। কারণ বাবার প্রপার্টি থেকে আমাকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। ইচ্ছে করলেই কেউ তা পারবে না।

ইচ্ছে করলে পারবে।

কী করে?

আমি তোমাকে সেটাই বলতে চাই।

বল, শুনি।

তোমার ভাইরা ইচ্ছে করলে প্রপার্টি থেকে সম্পূর্ণই বঞ্চিত করতে পারে তোমাকে। তুমি যে রকম বাড়াবাড়ি করছ, বিরক্ত হয়ে তোমার ভাইরা যদি তাই করে, তখন তুমি কী করবে?

অদ্ভুত এক নির্মোহ চোখে শিলার চোখের দিকে তাকাল সেতু। শান্ত গলায় বলল, আমি কোনও প্রপার্টি চাই না। কিছু চাই না আমি। আমি শুধু শুভকে চাই।

সেতুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেল শিলা।

.

চায়ের কাপ হাতে মামুন সাহেবের রুমের দিকে যাচ্ছে আলী, হঠাই সামনে পড়ল লালু দিলু। আচমকা এই দুজনকে দেখে আলী কেমন ভড়কে গেল। তার ভড়কানো ভাবটা খেয়াল করল না লালু। গম্ভীর গলায় বলল, নাম কী?

আলী থতমত খেল। কার নাম?

তোর।

আমার? আমার নাম আলী আজম।

এই নাম রাখতে তোকে কে বলেছে?

জ্বি?

লালু একটু গলা চড়াল। এই নাম রাখতে তোকে কে বলেছে?

নামটা আমার বাবা রেখেছে।

যেই রাখুক, আজমের কোনও দরকার নাই। শুধু আলী। ঠিক আছে?

জ্বি।

তাহলে দুটো ঠাণ্ডা আর দুপ্যাকেট বেনসন নিয়ে আয়।

স্যার না বললে তো আনতে পারি না।

সঙ্গে সঙ্গে ধমকে উঠল লালু, তর স্যারের খেতাপুরি। যা নিয়া আয়।

লালু দিলু আর ফিরে তাকাল না, স্বপনের রুমে ঢুকল। ঢুকে চেয়ার টেনে স্বপনের মুখোমুখি বসল।

লালু বলল, কিছু মাল ছাড়তে হয় যে।

স্বপন বিরক্ত হল। কেন?

শোন কথা! কাজ করতে মাল লাগবে না!

কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। প্রায়ই এসে টাকা নিয়ে যাচ্ছ। এই পর্যন্ত কত টাকা নিয়েছ, হিসেব আছে?

অকারণে গলা মোটা করে লালু বলল, হিসাব কিতাব করে টাকা পয়সা আমি নেই না। দরকার হলেই আসব। লেকচার ছাড়া, যাকে বলে নিঃশব্দে, নিঃশব্দে টাকাটা দিয়ে দেবেন। আর যদি ইচ্ছা না হয় দেবেন না। কিন্তু লেকচার মারবেন না। লালু কারও লেকচারের ধার ধারে না।

লালুর কথা বলার ভঙ্গিতে স্বপন একেবারে চুপসে গেল। কোনও রকমে বলল, কিন্তু কাজটা করছ না কেন?

ঘাড় বাঁকা করে স্বপনের দিকে তাকাল লালু। মার্ডার করাটা আপনার কাছে কী মনে হয়? খুব সোজা?

তোমার জন্য তো সোজাই।

হলেও তার জন্য একটা চান্স দরকার। চান্সটাই পাচ্ছি না।

আঙুল নাচিয়ে টাকার ভঙ্গি করল লালু। ছাড়েন, তাড়াতাড়ি ছাড়েন।

এসময় দুগ্লাস ঠাণ্ডা কোক আর দুপ্যাকেট বেনসন সিগ্রেট ট্রেতে নিয়ে স্বপনের রুমে ঢুকল আলী। দেখে অবাক হল স্বপন। এসব আনলি কেন? আমি তোকে এসব আনতে বলিনি।

লালু বলল, আমি বলেছি।

কোকের গ্লাস হাতে নিয়ে ফুরুক করে চুমুক দিল লালু। এটা আমার নিয়ম। যখন যার কাজ করি তখন আমি তার বস। আমি যা বলব তাই করতে হবে।

আলীর সামনে লালুর এসব কথা, স্বপন কী রকম অপমান বোধ করল। আলীর দিকে না তাকিয়ে বলল, এই, তুই যা।

আলীও যেন একথা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল সে।

এবার লালুর দিকে তাকাল স্বপন। পিয়ন টিয়নদের সামনে এভাবে কথাগুলো না বললেও পারতে।

লালু নির্বিকার গলায় বলল, আপনার জন্যই বলেছি। আপনেরে একটু সাইজ করলাম। আজকের মালটা ছাড়েন। কাজ হয়ে যাবে।

পকেট থেকে বেশ কিছু পাঁচশো টাকার নোট বের করে লালুকে দিল স্বপন। দশ হাজার আছে।

টাকাটা নিয়ে পকেটে রাখল লালু।

স্বপন বলল, কাজটা তাড়াতাড়ি কর লালু।

করব।

তবে সাবধানে। আমি যে জড়িত কেউ যেন টের না পায়।

কাউয়ায়ও টের পাইব না।

তারপর আচমকা বলল, কিন্তু মার্ডারটা আপনি কেন করাচ্ছেন? পোলাটা কি আপনের বইনরে ভাগাইয়া নিয়া বিয়া করছে?

স্বপন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। কে বলল তোমাকে?

লালু সিগ্রেট ধরাল। কেউ বলে নাই। অনুমান করলাম। পোলাটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়া মার্ডারের কোনও কারণ পাই নাই। এইজন্যই জিজ্ঞাসা করলাম। অসুবিধা নাই। যে কারণে ইচ্ছা মার্ডার করেন, সেইটা আপনের ব্যাপার। আমার সঙ্গে মালের কনটাক্ট, আমার কাজ আমি করে দেব।

টেবিলের ওপর রাখা দুপ্যাকেট সিগ্রেট পকেটে নিয়ে উঠল লালু। নিঃশব্দে তার সঙ্গে উঠল দিলু।

তারপর মোটর সাইকেল চালিয়ে লালু এল শুভদের বাড়ির সামনে। পেছন থেকে নেমে দিলু বলল, এখানে আসলা কেন?

লালু নির্বিকার গলায় বলল, তোকে কোরবানি দিতে।

কী?

তোর মাথায় মগজ বলে তো কিছু নাই। কুকুর বিড়ালের ইয়ে দিয়ে, মানে বাহ্যি দিয়ে তোর মাথা ভর্তি। এজন্য আমার কোনও কাজেরই অর্থ তুই বুঝতে পারিস না।

এবার হে হে করে হাসল দিলু। বুঝছি।

কী, বল তো?

কেসটা রেকি করতে আসছ। রেগুলার মাল খাইতাছ। কিছুটা কাম না করলে কেমতে হয়।

দিলুর কথা শুনে খুশি হল লালু। কারেক্ট।

তখুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মালা। সুন্দর টাঙ্গাইল শাড়ি পরেছে। মুখে সামান্য প্রসাধন। দেখতে ভাল লাগছে তাকে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে চারদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগল মালা। রাস্তার ওপাশে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল লালু দিলু। মালা বেশ হকচকিয়ে গেল। আপনারা? কী, কী চান?

লালু নিঃশব্দে হাসল। কিছু না, কিছু চাই না। আমরা কোনও ছ্যাচড়া মাস্তান না। রাস্তায় একা একটা সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাকে একটু ইয়ে করা কিংবা ছিনতাই ফিনতাই আমরা করি না। আমরা খুবই প্রেস্টিজিয়াস জিনিস।

আরেকদিন আপনাদেরকে আমি দেখেছি। মোটর সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

এরপর গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।

কেন?

কথা শুনে মনে হল মোটর সাইকেল জিনিসটা আপনার পছন্দ হয়নি।

আমার পছন্দ অপছন্দে আপনাদের কী যায় আসে?

কিছুই যায় আসে না।

তাহলে?

আপনার সঙ্গে একটু খাজুইরা আলাপ করলাম।

তারপরই গলার স্বর নৃশংস করল লালু। শুভ আপনার কী হয়?

লালুর এ রকম গলা শুনে ভয় পেয়ে গেল মালা। কোনও রকমে বলল, আমার ভাই।

কোথায় সে?

মালা একটা ঢোক গিলল। তা আপনাকে বলব কেন?

বলার দরকার নাই। খুঁজে বের করে নেব।

লালু দিলু আর দাঁড়াল না। আয়েশি ভঙ্গিতে হেঁটে মোটর সাইকেলটার সামনে গেল। মুহূর্তে মোটর সাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে গেল।

.

মা আতঙ্কিত গলায় বললেন, কী বলছিস?

মালা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ মা, শুভকে খুঁজছিল, আমি ওদেরকে চিনেছি। আগেও একদিন আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

সর্বনাশ!

লালু দিলু চলে যাওয়ার পর যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে আর যায়নি মালা। ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢুকেছে। ঢুকে সোজা মায়ের রুমে। এখনও হাঁপাচ্ছে সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ভাগ্যিস নাহিদদের গ্রামে চলে গেছে শুভ, নয়তো বিপদ হয়ে যেত।

মা উতলা গলায় বললেন, এসব নিয়ে আর বসে থাকা যায় না।

বসে থাকা ঠিকও হবে না মা। ওরা নিশ্চয় শুভকে খুঁজে বের করে ফেলবে। পরিষ্কার বলে গেছে।

শাহিন অফিস থেকে ফিরুক, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি কী করা যায়।

শাহিন ফিরল সন্ধেবেলা। সব শুনে বলল, পুলিশের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছি না।

সুরমা অস্থির গলায় বলল, তুমি এতদিন যাওনি কেন? বলেছিলে না জিডি করবে।

ভুলে গিয়েছিলাম।

শুনে মা খুবই ক্ষিপ্ত হলেন। ভুলে গিয়েছিলি? কেমন ভাই তুই? ছোট ভাইর এরকম বিপদ আর তার কথা তুই ভুলে যাস?

শাহিন কাঁচুমচু গলায় বলল, শুভ এখানে নেই বলে ব্যাপারটা আমি তেমন গুরুত্ব দিই নি।

মালা বলল, এটা তুমি ঠিক করনি ভাইয়া। এখন ওরা যদি নাহিদদের গ্রামে গিয়ে শুভকে…

কথা শেষ হওয়ার আগেই মালাকে ধমক দিলেন মা। চুপ কর। অলুক্ষুণে কথা বলবি না।

সুরমা শাহিনের দিকে তাকাল। তারচে’ তুমি বরং এক কাজ কর।

চোখ তুলে সুরমার দিকে তাকাল শাহিন। কী?

সেতুর ভাইদের সঙ্গে দেখা কর। তাদেরকে বল এসব আপনারা ঠিক করছেন না। মাস্তান টাস্তানদেরকে ফেরান। আমার ভাইয়ের যদি কোনও ক্ষতি হয়, আপনাদেরকে আমরা ছাড়ব না। দেশে আইন আছে। আমরা আপনাদেরকে দেখে নের।

মা বললেন, এবং এও বলবি, আপনারা ভালয় ভালয় ব্যাপারটা মেনে নিন। আমার ভাই কোনও ফেলনা ছেলে না। আপনার বোনের জন্য এরচে’ ভাল পাত্র পাবেন না। আর বিয়ে যেখানে হয়ে গেছে সেখানে এত বাড়াবাড়িরই বা কী আছে!

শাহিন গম্ভীর গলায় বলল, আমি ওদের কাছে যাব না মা। মা অবাক হলেন। কেন?

ওদের কাণ্ডকারখানা যা দেখছি তাতে ওদের কাছে গেলে অপমান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর যাই হোক অপমান আমি হতে পারব না। তারচে’ আমি কাল থানায় যাব। পুলিশের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা আলাপ করব। নিশ্চয় তারা কোনও ব্যবস্থা নেবে।

মা দুঃখি মুখ করে বললেন, যা ভাল বুঝিস কর।

তারপর একটু থেমে বললেন, গুণ্ডাপাণ্ডাদের ব্যাপারে ভয় তো পাচ্ছিই তার ওপর মনও খারাপ লাগছে। এতদিন হল বাড়ি ছাড়া হয়ে আছে ছেলেটি। এতদিন ওকে না দেখে আমি কখনও থাকি নি। নাহিদদের বাড়িতে হয়তো সে ভালই আছে, তারপরও আমার মনটা কেমন করে। খেতে বসলে ছেলেটার কথা মনে হয়, ঘুমাতে গেলে মনে হয়। শুভর জন্য আমার কিছু ভাল লাগে না।

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মা। আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। করুণ গলায় বললেন, আল্লাহ, আমার ছেলেকে তুমি ভাল রেখ।

.

এখানে আসার পর থেকে বিকেলের দিকে শুভর মনটা কী রকম খারাপ হয়। কী রকম উদাস বিষণ্ণ লাগে।

দুপুরের পর আজ ছোটখাট একটা ঘুম দিয়েছিল সে। খানিক আগে ঘুম থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জানালা থেকে আকাশটা বড় অদ্ভুত দেখায়। একটু যেন বেশি নীল, একটু যেন বেশি সাদা। এই আকাশের দিকে তাকালে শুভ সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়।

আজও হয়েছিল।

এ সময় বর্ষা এসে দাঁড়াল তার পেছনে। শুভ টের পেল না।

এই প্রথম, বহুদিন পর বিকেলবেলা সুন্দর করে আজ সেজেছে বর্ষা। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। মুখে সামান্য প্রসাধন, ব্যান্ড দিয়ে সুন্দর করে চুল বেঁধেছে। নিজেকে আজ নতুন মানুষ মনে হচ্ছে বর্ষার।

কিন্তু সে যে এই ঘরে এল শুভ তা টেরই পেল না।

খানিক দাঁড়িয়ে শুভকে দেখল বর্ষা। তারপর কথা বলল, কী হয়েছে আপনার?

চমকে পেছন ফিরে তাকাল শুভ। ও তুমি! কখন এলে?

বেশিক্ষণ না।

তারপর আবার প্রশ্নটা করল বর্ষা। কী হয়েছে আপনার?

কিছু না।

তারপর কথা ঘোরাল শুভ। কী আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি এলে আর আমি তা টেরই পাই নি।

আপনি খুব আনমনা ছিলেন।

মনটা ভাল নেই।

কেন?

শুনলে তোমার মন খারাপ হবে।

শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে বর্ষা গম্ভীর গলায় বলল, আমার মন খারাপ হলে আপনার কী?

সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছল হওয়ার চেষ্টা করল শুভ। বল কী! তোমার মন খারাপ হলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। জানতে চাও কী সর্বনাশ হবে?

জানতে চাইছি।

বর্ষার বলার ভঙ্গিতে অবাক হল শুভ। তুমি খুব অন্যরকম ভঙ্গিতে কথা বল।

কী রকম?

আমার প্রশ্ন শুনে যে কেউ বলবে, আচ্ছা বলুন। তুমি বললে, জানতে চাইছি।

তাতে কী হয়েছে?

এভাবে কথা বলা অন্যের সঙ্গে মেলে না।

আমার কোনও কিছুই কি অন্যের সঙ্গে মেলে?

না, তা মেলে না।

আমি অতি সাধারণ একটি মেয়ে। দেখতে ভাল নই। বেঁটে। সামান্য গান গাইতে পারি কিন্তু গলা তেমন ভাল নয়। বিএ পড়ি, কিন্তু পাস করতে পারব কীনা জানি না। আমার সোকতাপ খুব বেশি। কোনও কিছুই ভুলতে পারি না।

বর্ষার চোখের দিকে তাকিয়ে শুভ বলল, এসবই তোমার সৌন্দর্য। তুমি জান না তুমি কী সুন্দর মেয়ে। তোমার মুখটা খুব মিষ্টি। চোখ দুটো সুন্দর। কী সুন্দর করে কথা বল তুমি। তোমার লম্বা হওয়ার দরকার নেই। তুমি যেটুকু লম্বা, ওই যথেষ্ট। তোমার মতো মেয়ের কখনও বয়স বাড়ে না। মুখের দিকে তাকালেই তোমার জন্য মায়া লাগে।

বর্ষা আচমকা বলল, আপনার লাগছে?

শুভ থতমত খেল, তারপর হাসল, আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।

বর্ষাও হাসল। শেষ করুন।

তোমার মন খারাপ হলে আমার কী সর্বনাশ হবে শোন। তুমি ছাড়া, মানে এই বাড়িতে তুমি ছাড়া আমার খোঁজ খবর নেবে কে? আমার মন খারাপ হলে কে জিজ্ঞেস করবে, কী হয়েছে আপনার? আমার চা এনে দেবে কে?

শুভর কথা শুনে অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা। শুভ তা খেয়াল করল না, বলল, একটা কথা বলব?

বলুন।

চল কোথাও বেরিয়ে আসি, বাড়িতে একদম ভাল লাগছে না।

বর্ষা আনমনা গলায় বলল, চলুন।

.

বড়ঘরের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার রাখা।

বিকেলবেলায় সেই চেয়ারে বসে আছেন হাদি সাহেব। দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে মিনু এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলেন হাদি সাহেব। কদিন ধরে মনটা খুব ভাল, বুঝলে।

হাদি সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। বাদলের মৃত্যুর পর বাড়িটা যে রকম গুমোট ধরে গিয়েছিল সেই ভাবটা কেটেছে।

নিজের কাপে চুমুক দিয়ে মিনু বললেন, ঠিকই বলেছ। বর্ষা একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রেয়াজ করছে। আজ দুপুরের পর দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে সাজছে। বাড়ির টুকটাক কাজ করছে। নাহিদ শুভর জন্য চা নিয়ে যাচ্ছে।

আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন। মেয়েটাকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম। বহুদিন কোনও কাজ করতে পারিনি। কাজগুলো আবার শুরু করতে হবে।

কী কাজ?

পারুর বিয়ের চেষ্টা করতে হবে। পুবপাড়ার একটা জমি নিয়ে ঝামেলা লেগে আছে। সেই ঝামেলা মিটাতে হবে। কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকায় ছোটখাট একটা বাড়ি করব ভেবেছিলাম, সেই কাজটাও শুরু করা দরকার।

কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মিনু বললেন, ঢাকার বাড়িটাই আগে করা উচিত।

কেন?

নাহিদ থাকবে ঢাকায়। বর্ষার বিয়ে হলে সেও নিশ্চয় ঢাকায়ই থাকবে। তখন আমরা দুজন এখানে একা একা পড়ে থাকব কেন? ছেলেমেয়ে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।

হাদি সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ঠিকই বলেছ, একজন চলে গেছে, বাকি দুজনকে আমিও আর চোখের আড়াল করতে চাই না।

মিনু আর কথা বললেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *