ফুলবর্ষিয়া

ফুলবর্ষিয়া

মেঘের গুড়গুড় শব্দে চমকে উঠল শিউবচন। আচমকা একটা ঝড়ো হাওয়ায় তার ঘামে ভেজা চন্দনে লেপা শরীরটা জুড়িয়ে গেল। সামনের খতিয়ানের পাতাগুলি বেহিসাবির মতো ফড়ফড়িয়ে উঠল হাওয়ায়।

সে মুখ তুলে দেখল, উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে কালো মেঘ যেন হাজার ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে তীব্র বেগে ছুটে আসছে। কালো ধুলোর মতো সে মেঘ আকাশ ছাইছে, হিলিবিলি বিজলির মালা ঝলকাচ্ছে, সোঁ সোঁ শব্দে মাথা খুঁড়ছে দূরের গাছগাছালি।

শিউবচনের বিস্মিত মুখে ছড়িয়ে পড়ল অসহ্য খুশির আবেগ। তখনও হিসাবের মাঝপথে বুড়ো আঙুল তার কড়ে আঙুলের রেখায় ঠেকে ছিল। তাড়াতাড়ি খতিয়ান গুছিয়ে বেঁধে সে উঠে দাঁড়াল। কাল বৈশাখীর আকাশের দিকে তাকাল যেন সে বহুদিন পরে তার আরাধ্য দেবতার দেখা পেয়েছে। আচমকা, অপ্রত্যাশিত ভাবে।

দেখল ঝড়ের মাতন লেগেছে গঙ্গার বুকে। আর বেশিদিন নয়; এবার গঙ্গার টলটলে জল হয়ে উঠবে লাল, শুকনো খরো মাটির বুক ভাসিয়ে উঠে আসবে অনেক দূরে, উঁচুতে এই শিউবচনের নৌকার কাছে। শুকনো ডাঙায় আটকানো নাও ভাসবে, শুরু হবে তার সারা বছরের হাপিত্যেশ করা ব্যবসা, জেলা থেকে জেলায়, গ্রাম থেকে শহরে। নাও ভাসবে ইট, বালি, টালি, চুন, সুরকি আরও কত কী নিয়ে। বর্ষাকালে যে সব মালপত্র নিয়ে কারবার চলে সবই।

সে তাকাল তার নৌকার দিকে। আহা, নৌকা তো নয়, মস্ত বড় একটা বাড়ি বসানো রয়েছে গঙ্গার ধারের মাঠে। বারো জন মাঝি আর দুটো দাঁড়ি একে সামলায়। গাব ফলের মাড় দিয়ে নিকনো ছই চকচক করছে। ছই নয়, বাড়ির ছাদ। শক্ত কাঠে চওড়া পালিশ করা মাস্তুল উঠে গিয়েছে আকাশে। মাথায় তার তে-কোনা লাল নিশান। বজরংবলীর নিশান। বছরে ছ-সাত মাস তার এই নৌকার খোলেই কেটে যায়। বাদ-বাকি সময় নৌকো ভাড়া খাটে। তখন অদূরের ওই সাধুবাবাদের আড্ডার কাছে ছোট একটা ছিটে বেড়ার ঘরে সে আশ্রয় নেয়।

আর আছে তার গোটা পঞ্চাশ মাঝারি পিপে। এগুলি সে বারোমাসই ভাড়া খাটায়। কিন্তু আসল ব্যবসা তার নৌকা ভাড়া খাটানো। তাই বর্ষার প্রথম সঙ্কেতে তার মুখে চোখে ঝলকে উঠেছে খুশি। হাসিতে বেরিয়ে পড়েছে তার ফোগলা দাঁত। গোঁফদাড়িহীন কামানো কালো মুখে রেখায় রেখায় ছড়িয়ে পড়েছে লুব্ধ হাসির ঢেউ। কপালেও হিলিবিলি বিজলির মতোই রেখা এঁকে বেঁকে উঠছে। এ তো মেঘগর্জন নয়, সে শুনছে টাকার ঝনঝনানি।

বয়স হয়েছে শিউবচনের। তার কালো গায়ের লোমে পাক ধরেছে। কুঁচকে গিয়েছে চামড়া। কিন্তু পোষ্টাই হাড়ে তাকে এখনও শক্ত বলে মনে হয়। সব সময় সে ঝুঁকে দাঁড়ায়। চলেও ঝুঁকে। সে জন্য মাথাটা তার নুয়ে থাকে। তাকাবার সময় চোখ দুটো এমন ভাবে তোলে মনে হয় একটা কালো জাম্বুবান। চোখ দুটো তার অদ্ভুত। এতটা গর্তের মধ্যে ঢোকানো যে চট করে দেখাই যায় না। নজর করলে দেখা যায় সেখানে শাদা অংশ নেই, শুধু দুটো কালো মণি। সে চোখে একটা উদগ্র ও হকচকানির ভাব সবসময় লেগেই আছে।

এই শিউবচনের টাকার প্রতি লোভ অপরিসীম, তবু ভকত বলে তার খ্যাতি আছে। নিজের ব্যবসাগত কাজ বাদ দিলে সারা দিন কাটে তার সাধুদের সঙ্গে। বাইরের লোকালয়ের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই। কখনও গাঁজা খেয়ে, ধর্মালোচনা করে কিংবা রামায়ণ মহাভারত পড়েই তার দিন কেটে যায়। শুধু ভক্তি নয়, সাধুদের প্রতি তার একটা দুর্বলতাও আছে। বিদেশে বাংলার এই নিরালা গঙ্গার ধারে থেকে সে যে টাকা রোজগার করে সেই টাকা দিয়ে মাঝে মাঝে সাধুদের অসম্ভব দাবি মেটাতে ও কোনও সঙ্কোচ বোধ করে না। মনে মনে কোনও সময় আপত্তি থাকলেও নিজেকে চেপে রাখতে পারে না সে। অথচ নিজের জন্য এক পয়সা খরচেও দারুণ কার্পণ্য তার। এবং সাধুদের অনেককে দেখা যায়, তাকে রীতিমতো ঠাট্টা বিদ্রূপ করে, হাসাহাসি করে তাকে নিয়ে। কিন্তু একটা অদৃশ্য শিকলে যেন সে বাঁধা রয়েছে এখানে। কোনও কোনওদিন সাধুদের সঙ্গে ঝগড়া হলে সে বুক চাপড়ায়, এমনকী চেঁচিয়ে একাকার করে। অথচ কোনওদিন চলে যায় না। শুধু ভগবানকে অভিযোগ জানিয়ে সে শান্ত হয়ে যায়।…

কাল বৈশাখীর ঝড়ের ঝাপটার সঙ্গে বড় বড় ফোঁটায় জল নেমে এল। কিন্তু কীসের ভাবনায় যেন শিউবচন বিভোর হয়ে গিয়েছে। হাসি নেই, তার সারা মুখে একটা সোহাগের স্নিগ্ধতা দেখা দিল। তার একমাত্র মা-মরা ছেলের কথা মনে পড়েছে তার। দশ বছর সে তাকে দেখেনি। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবার সময় ছেলেকে সে তার শালির কাছে রেখে এসেছিল। তখন ছেলের বয়স দশ। তারপর আর কোনওদিন দেখা হয়নি।

ভাবতে ভাবতে বেদনায় ও নিঃশব্দ কান্নায় তার মুখটা বোবা জানোয়ারের মতো বিকৃত হয়ে উঠল। তার মরা বউয়ের কথাও মনে পড়েছে। বউ মরার পর থেকেই সে সাধুদের পিছনে ঘুরত। কিন্তু ঠিক সাধু সে হতে পারেনি। পয়সা রোজগারের প্রতি একটা টান তার থেকে গিয়েছিল। অথচ সমাজ জীবনে ফিরে যেতেও পারেনি। জীবনের কোথায় তার একটা অসামঞ্জস্য প্রকট হয়ে রয়েছে যাতে সে ঘরেও যেতে পারেনি, ঘাটেও পুরোপুরি আসতে পারেনি।

আজকে এই মুহূর্তে ছেলের কথা মনে হতেই তার বুকটা টনটনিয়ে উঠল। এমন করে ছেলের বিরহ তার আর কোনওদিন বাজেনি। হঠাৎ সে স্থির করে বসল, ছেলেকে সে একবার তার কাছে নিয়ে আসবে, ব্যবসার কাজকর্ম শেখাবে তাকে। শেষ পর্যন্ত ছেলে ছাড়া তার আছেই বা কে?

নৌকার ভিতরে যেতে যেতে সে হাঁক দিল, ফুলবর্ষিয়া! বর্ষিয়া রে!

ঝড়ের সোঁ সোঁ শব্দের মধ্যে সাধুদের আস্তানার দিক থেকে একটা মেয়েলি গলা ভেসে এল, যাই।

পরমুহূর্তেই একটা খিলখিল হাসি ঝড়ের শব্দের সঙ্গে উধাও হয়ে গেল।

দেখা গেল একটি মেয়ে ছুটে আসছে নৌকার দিকে। হাওয়ার দাপটে উড়িয়ে নিচ্ছে তার কাপড়, সাজি মাটি মাখা এলোচুল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার চোখে মুখে, ধুলোয় চোখ বুজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি মই বেয়ে সে নৌকার খোলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

 তার সারা গা খোলা। শুধু বুকের কাছে হাত দিয়ে আঁচল চেপে ধরেছে। দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা মেয়েটির। মাজা মাজা রং। ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখে ও পাতলা ঠোঁটের কোণে তার অদ্ভুত অবজ্ঞা ও বিদ্রুপের হাসি চমকাচ্ছে। বয়স প্রায় উনিশ কুড়ি। সে ঠিক সুন্দরী নয়, কিন্তু একটা অসহ্য সৌন্দর্যের ধার তার সর্বাঙ্গে। তার উপর সাজি মাটি মাখা এলোচুলে ও বাঁকা হাসিতে সৌন্দর্য তার বন্য হিংস্রতা পেয়েছে। সাপের মতো বেড় দেওয়া রয়েছে তার গলায় রূপার হাঁসুলি।

সাধুদের আস্তানায় কিংবা শিউবচনের মতো প্রায় বুড়ো ব্যবসায়ীর নৌকার খোলে সে একেবারে মূর্তিমতি বেমানান। পথের মাঝে বিপথের ধাঁধার মতো।

তেজী গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলল সে, চিল্লিয়ে মরছ কেন? ক্যা হুয়া?

শিউবচন তখন ছেলেকে আমন্ত্রণের আনন্দে মশগুল। এক মুহূর্ত সে হাঁ করে লুব্ধ চোখে ফুলবর্ষিয়াকে দেখে বলল, জলদি একটু কাগজ দে। চিঠি লিখব।

মরণ! তোমার আবার আছে কে যে চিঠি ভেজবে?

অমনি রাগে কুঁচকে উঠল শিউবচনের মুখটা। কিন্তু কিছু বলল না। ভাবল হারামজাদি ওই জোয়ান খচ্চর সাধুগুলির কাছে আসকারা পেয়ে বড্ড বেড়ে উঠেছে। ওকে কড়া হাতে সজুত না করলে হবে না।

কিন্তু ভাবা পর্যন্তই। একটু পরেই সে কথা ভুলে যাবে শিউবচন। না গেলেও মুখে অন্তত আনবে না।

ছোট একটা কুলঙ্গি থেকে এক টুকরো কাগজ শিউবচনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ফুলবর্ষিয়া এক মুহূর্ত কী ভাবল। তারপরে হঠাৎ চুল এলিয়ে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে গুনগুন করে উঠল :

অব দিন্ বিদ যাতি, কিষেন্ কা ভেট না মিলল হো।

শিউবচন তার গর্তের ভিতরে ক্রুদ্ধ চোখ দুটো দিয়ে তাকে দেখে নিল। তারপর দোয়াতের ভেতর কলম ডুবিয়ে নিয়ে মাত্রাহীন দেবনাগরী ভাষায় লিখে চলল, মেরা পয়ারে বেটা রামবচন…

বাইরের হাওয়ার ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ছে ছইয়ের বেড়ায়। ডাঙার বাঁশের ঠেকো দিয়ে রাখা নৌকাটা ঝড়ে দুলছে যেন জলে ঢেউ কেটে চলার মতো।

ফুলবর্ষিয়া তখনও গুনগুন করছে। ও হচ্ছে শিউবচনের আর এক কীর্তি। মেয়েটা মুলুক থেকে এসেছিল বছর তিনেক আগে তার স্বামীর সঙ্গে। ভিতরে শহরে একটা বস্তিতে সে থাকত। স্বামী কাজ করত চটকলে। দু বছর পরে স্বামী মরে যেতে ওর ভাসুর তিনশো টাকায় বিক্রি করে দেয় শিউবচনের কাছে।

শিউবচন নিজে মনে করে ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেছে। একটা চিরাচরিত কৈফিয়তও দিয়েছিল সে; বিদেশে পড়ে আছি, বয়সও হয়েছে, দেখাশোনা করার একটা লোক না হলে আর চলে না।

অবশ্যই আওরতলোকের কথাই বলছে সে। সেইদিন থেকে আর একটা নতুন রকমের লোভানি ফুটে উঠল তার চোখে। সকলের অগোচরে রাখা তার জমানো টাকার পুঁটলিটা যেমন করে সে হাতে নিয়ে দেখে, ফুলবর্ষিয়ার দিকে তাকালে তেমনি একটা লোলুপতায় চকচক করে ওঠে তার মণি দুটো।

ফুলবর্ষিয়া প্রত্যহ ভাসুরের মার ও নির্জলা উপোসের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল বটে কিন্তু যেমন শান্তশিষ্ট ঘরওয়ালি বহুর মতো ঘোমটা টেনে সে এসেছিল, দু মাস না যেতে দেখা গেল সে নির্লজ্জ আর অবাধ্য হয়ে উঠেছে। মুখে যার রা ছিল না সে হয়েছে মুখরা ও বিদ্রূপভাষিণী। বিশেষ করে শিউবচনের প্রতি তার ঘৃণা ও অবজ্ঞার সীমা নেই। গঙ্গার ধারের সাধুঘাটের দেবলোকের নির্জনতা তার হাসিতে চমকে উঠে নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। দিনে রাত্রে সে হাসি এক অশরীরী সত্তার মোহ ও ভয় ছড়িয়ে দিল জায়গাটাতে।

কিন্তু আশ্চর্য! এ ব্যাপারে সাধুরা কেউ আপত্তি করেনি। তাদের ভাবখানা যেন নতুন একটা খোরাক পেয়ে খুশি হয়েছে তারা। বিদ্রূপ ও দৌরাত্ম্যের মাত্রাটা বাড়ল শিউবচনের উপর। এমনকী ফুলবর্ষিয়ার তিক্ততাটা টের পেয়ে, সাধুরা সুযোগ পেলেই তাকে লেলিয়ে দেয় শিউবচনের বিরুদ্ধে। আর পিছনে দেয় হাততালি।

তারপর দিনই শিউবচন গাড়ি ভাড়ার টাকা আর চিঠি পাঠিয়ে দিল ছেলের নামে। প্রায় দিন দশেক বাদে ছেলে এসে হাজির হল এখানে।

.

ভর দুপুরে রামবচন এসে যখন দাঁড়াল তখন তাকে বোঝা যায় যে, সে অপরিচিত এবং বিদেশি হৃষ্টপুষ্ট শক্ত কালো জোয়ান। শুধু রাত্রি জাগা নয়, তার সারা শরীরে ও চোখে মুখে বিহারের রুক্ষতা। ইতিমধ্যেই মোটা কালো ঘন গোঁফ তাকে গম্ভীর করে তুলেছে। অপরিচিত পরিবেশে ও কৌতূহলে চোখের দৃষ্টি কিশোরের ঔৎসুক্যে ভরা। গলায় একটা লোহার মাদুলি। ছেড়া কামিজের ফাঁক দিয়ে বুকের মাংসপেশি দেখা যাচ্ছে। মাথায় গামছা বাঁধা। লাঠির ডগায় ছোট একটা পুঁটলি।

সাধুদের আস্তানার অদূরেই সে থমকে দাঁড়াল। রাস্তাটার দুপাশে ঝোপঝাড়। এদিকে ওদিকে কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে ফুলের সমারোহ। বটের তলায় ঘুমোচ্ছে কয়েকজন সাধু। বাঁ দিকের মাঠের ওপর নৌকা। জোয়ারের ভরা গাঙ বয়ে চলেছে উত্তরে। চারিদিক নিঝুম।

এমন সময় চমকে দিয়ে বুনো ঝোপের জঙ্গল নড়ে উঠল আর তার ভেতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল ফুলবর্ষিয়া। গায়ে জামা নেই, আঁচল তেমনি চেপে ধরা। রামবচনকে দেখেই সে থমকে দাঁড়াল। চকিতে তার চোখে আলো ফুটে উঠল। দেখেই সে বুঝে নিয়েছে, এ এক আনকোরা, মুলকি আদমি। আর শিউবচনের ছাপও রয়েছে জোয়ান মানুষটার মুখে।

সে ঠোঁট টিপে হেসে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল, কী হো মরদ, কোথা থেকে আসছ? রামবচনের অজ পাড়াগেঁয়ে মন একটু ভড়কে গেল। কিন্তু ফুলবর্ষিয়ার চাউনি যেন তীরের ডগায় রং মাখিয়ে ছুড়ে মারল তার বুকে। তবু হাসতে সাহস পেল না সে। বারকয়েক গোঁফ হাতিয়ে সে বলল, মু থেকে আসছি।

মুলক কঁহা বটে?

বিহার।

আচ্ছা। সংশয় কাটল খানিক ফুলবর্ষিয়ার। তার বাঁকা চোখের তীব্র ক্ষুধার্ত দৃষ্টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল রামবচনকে। তারপর কী মনে করে সে তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে শরীর ঢাকল। পর মুহূর্তেই ফিক করে একটু হেসে বলল, তা এধারে কোথা যাওয়ার মন করেছ?

সঙ্কোচের মধ্যেও একটু রঙের ছোঁয়া লেগেছে রামবচনের অপরিচিত চোখে। এবার বারকয়েক গোঁফে পাক দিয়ে, আর খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল, আমি শিউবচনের বেটা রামবচন। বাপ আমার কারবারি। এই গঙ্গা কিনারে..।

হাঁ? কথার মাঝেই বলে উঠল ফুলবর্ষিয়া, বহুত শরিফ আদমির লেড়কা দেখছি বটে তুমি? বলেই সে নিঝুম দুপুরকে চমকে দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপরই চিলের মতো চিৎকার করে উঠল, আরে হেই হো বেপারি, এ শিউবচন বাবুজি…।

তার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল সাধুদের। রামবচন বিস্মিত মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইল এ বে-শরম আজব অওরতের দিকে।

শিউবচন চিৎকার শুনে দিবানিদ্রা ছেড়ে হাঁকপাঁক করে উঠে পড়ল ছইয়ের উপর, কী হয়েছে অ্যা, ক্যা হুয়া?

আমাকে পাকড়ে নিয়ে যাচ্ছে এ পরদেশি, সে আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। রামবচনকে বলল, চলে এসো জোয়ান, তোমার বাপের গদিতে তোমাকে দিয়ে আসি। বলে সে নৌকার দিকে এগিয়ে গেল। শিউবচনকে বলল, লাও, দেখো কে এসেছে। পহচান সাকতা কি নাহি?

শিউবচন মই বেয়ে তাড়াতাড়ি ঘাটে নেমে পড়ল। রামবচন তার দিকেই আসছিল। সেদিকে একবার হাসি ও বিস্মিত সংশয়ে তাকিয়ে শিউবচন দু-হাত বাড়িয়ে দিল, রামবচন, আমার ব্যাটা না তুই? বলে সে রামবচনের একটা হাত চেপে ধরল। চোখের গর্তের ভেতর থেকে তার জল গড়িয়ে এল। কিন্তু একটা হতাশা মনের কোন ফাঁক দিয়ে এর মধ্যেই ঢুকে পড়েছে তার। এতবড় একটা গম্ভীর কঠিন পুরুষের কথা সে চিন্তাই করতে পারেনি। তবু তাকে হাত ধরে সে তুলে নিয়ে এল নৌকায়। বসাল পাটাতনের উপর–বোস বেটা বোস।

রামবচনের মুখে কোনও কথা নেই। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছে। এতবড় নাও আর তার বাপ। থেকে থেকে তার চোখ জোড়া ছইয়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকা ফুলবর্ষিয়ার উপর গিয়ে পড়ছে। ঠিক ভেবে উঠতে পারছে না, আওরতটা কে। ওর চাপা হাসি, তেরছা চাউনি তার মোটা। চামড়ায় বারবার বিধছে। কিন্তু লজ্জা ভয় সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে।

শিউবচন তাড়াতাড়ি নিজের হাতে তামাক সেজে বারকয়েক হুঁকোয় টান দিয়ে রামবচনের দিকে খানিকটা বাড়িয়ে দিল। রামবচন অবলীলাক্রমে হুঁকোটা নিল। মাথার থেকে গামছাটা খুলে গম্ভীরভাবে হুঁকো টানতে লাগল।

শিউবচন তার মনটা খোলবার চেষ্টা করল। বলল, ওহো বেটা, কতদিন তোকে দেখিনি।

ছেলে আরও মোটা গলায় জবাব দিল, দেখতে মন চায়নি তাই দেখোনি।

একটু যেন কুঁকড়ে গেল শিউবচন। বলল, নহি নহি বেটা, কতদিন ভেবেছি, একবার আমার রামুয়াকে দেখে আসি কিন্তু বেটা একদম ফুরসত পাইনি। এ শালার কাজ বড় ঝামেলার।

খবরটাই কি একটু নিয়েছিলে? একেবারে কাটা কাটা প্রশ্ন রামবচনের। ফলে কথা জোগায় না বাপের মুখে। বোঝা গেল আসলে বাপের প্রতি অভিমান হয়েছে তার। এতদিন বাদে কাছে পেয়ে সেটা প্রকাশ হয়ে পড়ছে।

আবার বলল রামবচন, আমি তো ভেবেছিলাম, মরে ধরে গেছ কোথাও।

কথাটা শুনে যেন আঁতকে উঠল শিউবচন। খালি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, হে ভগবান!

তারপর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। বলল, বেটা, তুই আমার উপর গোসা করেছিস।

 রামবচন হুঁকোটা হেলান দিয়ে রেখে বলল, গোসা আবার কী, তোমার শরীরে একটু মায়া দয়া নেই। সেই মাসির কাছে দিয়ে এলে, বাস একেবারে বেপাত্তা। আর আমি শালা..

বলতে বলতে ফুলবর্ষিয়ার দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেল সে।

ফুলবর্ষিয়া তেমনি হাসছে। নীরব হাসির দমকায় কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর।

শিউবচন উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কেন, মাসি তোকে পালেনি, দু-বেলা খেতেও দেয়নি?

রামবচনের গলায় এবার আর একটু ছেলেমি রাগ ও দুঃখ ফুটে উঠল, মাসির বয়ে গেছে। তুমি চলে গেলে মেসো নোকর বলে তুলে দিয়ে এল দীনদয়াল বাবুসাহেবের বাড়ি।

হাঁ? আরে রাম রাম! হে ভগবান কত দুঃখ দিয়েছ এই বাচ্চাকে!

কিন্তু তার বুকের মধ্যে জ্বলতে লাগল। রাগ হতে লাগল যখন সে দেখল রামবচনের বিস্মিত মুগ্ধ চোখ কিছুতেই ফুলবর্ষিয়ার দিক থেকে ফিরছে না। ইচ্ছে হল চোখ দুটো গেলে দেয়।

পরমুহূর্তেই তার রাগটা গিয়ে পড়ল ফুলবর্ষিয়ার উপর। অমনি সে পেছন ফিরে খ্যাঁক করে উঠল–এই হারামজাদি, কার রূপ দেখছিস এখানে বসে বসে? যা চুলা ধরা, রুটি বানা! ছোঁড়াটাকে খেতে দিতে হবে না?

চকিতে একবার ফুলবর্ষিয়ার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। পরমুহূর্তেই আবার তেমনি হেসে অবিশ্বাস্য রকম শান্ত মেয়ের মতো ছইয়ের মধ্যে ঢুকে গেল সে।

রামবচন বিস্মিত অনুসন্ধিৎসু চোখে বাপের দিকে তাকাল। শিউবচন ছেলের দিক থেকে তাড়াতাড়ি চোখ দুটো নামিয়ে নিল। তারপর বলে উঠল, যাক বেটা, অনেক দুঃখ ধান্দা করেছিস। এবার আমার সঙ্গে একবার লেগে যা। এতেও দুঃখ আছে, তখলিফ পোয়াতে হবে অনেক। পয়সা কামাতে গেলে সে তো জরুর হবে। কিন্তু পয়সা যখন ট্যাঁকে আসবে তখন ফুর্তিতে দিল চুকচুক করবে। হাঁ, অ্যায়সা চিজ পয়সা। তবে হ্যাঁ, আপনা কলিজার থেকেও তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নইলে ফুড়ৎ…শালা আশবানের চিড়িয়া বনে যাবে। বোকার মতো অবাক হয়ে রামবচন তার বাপের গর্তে ঢোকা লুব্ধ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল। তার অনেক দিনের আগের একটা ঝাপসা চেহারার কথা মনে পড়ে। দশ বছর আগের ক্ষীণ স্মৃতি। তার সেই বাবা। দিনরাত ভগবান ভগবান করত, লোকজনকে ভারী মিঠে বুলি বলত, পরের উপকারও করত। এখনও লোকে তাকে দেখিয়ে বলে : শিউবচন ভকতের দুঃখী লেড়কা এটা।

কিন্তু আজকের এ মানুষটা, তার এ বাপটা এবং তার খানিকটা শহুরে ঢঙের কথাবার্তায় যেন অচেনা মনে হতে লাগল। এমনকী চেহারাটাও কী রকম কুৎসিত মনে হতে লাগল তার। তবে হ্যাঁ, প্রত্যেকটি কথা সে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। বাঁচবার হালচাল তাকে বুঝে নিতে হবে। বইকী।

 শিউবচন তখনও বলে চলেছে, তবে হ্যাঁ, পয়সা ধরে রাখতে জানতে হয়। ধর্মের পথে থাকলেই পয়সা থাকবে। খবরদার আওরতের পেছনে কখনও টহল দিসনে, ফিরেও তাকাসনে। ও শালার। জাতই খারাপ। শহরের সব কিছুই খারাপ। কিন্তু জেগে ঘুমোবে, কিছুই দেখবে না আর…

কিন্তু শিউবচনের কী রকম অস্বস্তি হচ্ছে তার এতবড় গুঁফো গম্ভীর ছেলেকে উপদেশ দিতে। এইটুকুন সময়ের মধ্যেই ওর সরল রুক্ষ চাউনিটাকে কী রকম ভয় লাগছে তার। বিশেষ ওর এই না। হাসা, আর গোঁফ মোচড়ানোর বহরটা অসহ্য। নিজেও সে গোঁফ রাখবে কিনা, তাই মনে হতে। লাগল। তারপর হঠাৎ বলল, আর…আমি তোর বাপ, তোর জনমদাতা। ঈশ্বরের নিয়ম বাপের হুকুমে ব্যাটা চলে। তাই বলছি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ো না। বলে রামবচনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে থেমে গেল। কথাটাতে যেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সে প্রকাশ করে ফেলেছে। কিন্তু আসলে রামবচন খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলি বোঝবার চেষ্টা করছিল।

তারপর শিউবচন তাকে তার ব্যবসার ব্যাপারটা একটু বোঝাবার চেষ্টা করে বলল, যা গঙ্গায় গিয়ে স্নান করে আয়, পেট ভরে খা। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলে রাখি বাবা, আমার জমানো একটা আধলাও নেই। রোজগার হবে, তবে আমাদের আবার একটু সুখ হবে।

বোঝা গেল রামবচন ব্যবসার কথা কিছুই বোঝেনি। আর এই বিশ বছর পর্যন্ত বয়সে, পয়সা হাতে নেওয়া কাকে বলে সে জানে না। দীনদয়ালের বাড়িতে নোকর থেকেছে, চাষি রাখালের কাজ করেছে, যখন যা পেয়েছে খেয়েছে আর বিচুলি ঘরে পড়ে থেকেছে। হিসেব-টিসেবের বালাই তার নেই, জানেও না। সুতরাং, ওই জিনিসটার প্রতি কৌতূহল থাকলেও মোহ নেই।

ও সব দিকে ভাবার তার কিছু নেই। কিন্তু ওই লেড়কি মানে আওরতটা কে আর বাপের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা কী জিজ্ঞেস করতে তার বাধছে। অবশ্য এরকম সাঙ্ঘাতিক বেশরম জেনানা সে খুব কমই দেখেছে কিন্তু তার এতদিনের নির্লিপ্ত বদ্ধ প্রাণের দরজাটায় যেন কুড়োল মেরে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে।

স্নান করতে যাওয়ার আগেও তার সঙ্গে কয়েকবার চোখাচোখি হয়ে গেল ফুলবর্ষিয়ার। এর মধ্যেই জেগে ঘুমোবার পালা এসে পড়ল তার। অর্থাৎ, ফুলবর্ষিয়ার মন রাঙানো মুখটা কেবলি ভাসতে লাগল তার চোখে।

স্নান করতে করতে একটা শব্দে সে চমকে ফিরে দেখল খানিকটা দূরেই বাসন ধুচ্ছে সেই মেয়েটা। জোয়ারের স্রোতে বুঝি বাসনই ভেসে যায়, তবু ঘাড় কাত করে তেমনি হেসে হেসে দেখলে রামবচনকে। চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি হাসির ঝঙ্কার তুলে আঁচল উড়িয়ে সে পালাল। অমনি ধ্বকধ্বকিয়ে উঠল রামবচনের বুকের মধ্যে। তার অবশ শরীর জোয়ারের টানে ভাসিয়ে নিয়ে গেল খানিকটা। যেন হঠাৎ পাগলা বাতাসের ধাক্কা লেগেছে।

স্নান করে ফেরবার পথে সাধুদের গাছতলায় গিয়ে নমস্কার করল সে। আশীর্বাদ করল সাধুরা। জিজ্ঞেস করল দু চার কথা। তারপর একটা ল্যাংড়া সাধু মাথায় জটা আর দাড়ির ভেতর থেকে আধ বোজা চোখে তাকিয়ে মাতালের মতো হেসে বলল, তা লেড়কা দেখছি বেশ জোয়ান। তোর মায়ি তোকে বেশ যত্ন উত্ন করছে তো?

মা? হাঁ করে তাকিয়ে রইল রামবচন। কয়েকজন সাধু হেসে উঠল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। আবার বলল সেই সাধুটা, ওই যে ছুকরি, শিউবচনের ঘরওয়ালি না কী বলে..

বলে আবার তারা হেসে উঠল। এবং এ রকম একটা খারাপ ব্যাপারে সাধু ব্যক্তিদের মতো লোকেরও হেসে উঠবার কী থাকতে পারে ভেবে পেল না রামবচন। অপমানে কুঁকড়ে গেল তার পেঁয়ো মনটা। এখনও তার গায়ে বিহারের অজ গাঁয়ের গন্ধ লেগে রয়েছে তবু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তার মনটা অনেকখানি তিক্ত হয়ে উঠল।

ফিরতে গিয়েও সে কয়েকটা কথা শুনতে পেল তার বাপ আর ফুলবর্ষিয়ার সম্পর্কে। হঠাৎ ফুলবর্ষিয়ার প্রতি মনটা শুধু বিমুখ নয়, ঘৃণায় ও রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ঘরওয়ালি নয়, একটা রেণ্ডি বিশেষ ছুকরিটা। তাই অমন ছেনালের মতো ঢলে ঢলে হাসছিল।

একে গেয়ো, তায় খানিকটা গোঁয়ার। নৌকায় যখন ফিরল, তখন সারা মুখটা থমথম করছে। বাপের প্রতিও কেমন একটা ঘৃণা ধরে গেল। লোকটা বাইরে বাইরে এ সবই করে বেড়িয়েছে তা হলে। তাই ছেলের উপরেও দরদ ছিল না।

 শিউবচন ভাবছিল, ছেলের কাছে কী একটা কৈফিয়ত খাড়া করবে সে ফুলবর্ষিয়ার জন্য। কিন্তু মুখ দেখে তার সাহস হল না। আর ফুলবর্ষিয়ার কাণ্ডটা দেখে ভেতরে ভেতরে রাগের মাত্রা চড়ছিল। ভাবল, শালা এবেলা দুটো ছাতু খেতে চাইলে হুঁড়ির দিতে ওবেলা হত। আর এখন কাজ করছে যেন মন্তর দেওয়া ডাইনি। এর মধ্যেই আটা মেখে উনুন ধরিয়ে দিব্যি রুটি সেঁকতে বসে গিয়েছে। যেন ওর কতকেলে ভাতার এসেছে!

আশ্চর্য! এরই মধ্যে কখন সে আঁট করে বেঁধেছে চুল। খোঁপায় দিয়েছে কৃষ্ণচূড়া, কাপড় পরেছে বদলে। বুকের কাছাকাছি শাড়ির পাড়ের উপর নেমে এসেছে হাঁসুলি। কিন্তু পিঠ ঘাড় আর হাত তার তেমনি খোলা।

দূরের খেয়াঘাটের কাছ থেকে অনেক গলার স্তিমিত স্বর ভেসে আসছে। গাছে গাছে ভিড় লেগেছে পাখির। ঢলে পড়ছে বেলা। গঙ্গার ঢেউহীন জোয়ারের জল নিঃশব্দ। চলেছে এক টানা। বৈশাখের মেঘহীন দিগন্তহীন আকাশের গায়ে কৃষ্ণচূড়ার মাথাগুলি যেন রক্তাম্বরী কিশোরী।

ঝকঝকে মাজা থালায় গরম গরম রুটি, লঙ্কা আর পেঁয়াজ কুচো নিয়ে এল ফুলবর্ষিয়া। রামচনকে দিতে গিয়ে চোখাচোখি। আরও কাছাকাছি। আবার সেই মর্মঘাতী কটাক্ষ!

হঠাৎ হেঁড়ে গলায় খেঁকিয়ে উঠল রামবচন, হট যা হিয়াসে। বেওকুব খারাব আওরত।

উনুনের আগুন থেকে তামাক সাজছিল শিউবচন। সে চমকে একেবারে হা হা করে ছুটে এল। কী হয়েছে?

কিন্তু কেউ-ই কিছু বলল না। রামবচন ফিরিয়ে নিল তার ক্রুদ্ধ মুখটা। আর ফুলবর্ষিয়া শক্ত হয়ে বেঁকে দাঁড়াল যেন একটা ধারালো বাঁকা তলোয়ারের মতো। চোখে তার ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে। আগুন।…এক মুহূর্ত। তারপর সে তিক্ত হেসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল; পেঁয়ো ভূত, গোঁয়ার উল্লুক…। বলেই শিউবচনকে একটা ধাক্কা দিয়ে, নৌকা কাঁপিয়ে দুপদাপ করে নেমে সাধুদের আস্তানার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শিউবচন খালি বলল, হে ভগবান!

কিন্তু রামবচন একটি কথাও বলল না। সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েছে, কিন্তু রাগের মাত্রাটা তাতে কমেনি। একবার সে তার বাপের দিকে তাকাল। কথা তত দূরের কথা রাগের মাত্রাটা আরও চড়ল।

হতভম্ব শিউবচন ভেবেছিল হয়তো কিছু বলবে ছেলেটা। তা হলে একটা কৈফিয়ত সে দিতে পারবে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। রামবচন বেমালুম থালাটা তুলে নিয়ে গঙ্গামুখো হয়ে খেতে আরম্ভ করল। শিউবচন মনে মনে বলল শালা লেড়কা নয়, যেন আমার বাপ! কিন্তু খুশি হয়েছে। সে মনে মনে। বুঝে নিয়েছে, ফুলবর্ষিয়া হারামজাদি আর পেখম খুলতে পারবে না এখানে। বড় শক্ত ঠাঁই।

কোন ফাঁকে মেঘ করে এসেছে ঈশান কোণে। আমচকা হাওয়া উঠল। তোলপাড় হয়ে উঠল গঙ্গার জল। ভীত পাখির কিচির মিচির।

সাধুদের আস্তানার দিক থেকে ভেসে এল ফুলবর্ষিয়ার তীক্ষ্ণ গলার হাসির ঝঙ্কার। রামবচন চমকে মাঝ গঙ্গার দিকে তাকাল। মনে হল সেখান থেকে হাসিটা শোনা গেল, পরমুহূর্তেই কানে এল। বিদ্রূপপূর্ণ মেয়েলি গলায়, আরে, একটা গাড়োল আর একটা গেঁয়ো ভূত। তারপরে আবার হাসি।

হাসি আর ধূলি ঝড়। ঝাপসা হয়ে গেল ওপারের হুগলি জেলা। কিম্ভুতাকৃতি হয়ে উঠল পর্তুগিজ গির্জাটা। মাঝ গঙ্গায় উথালি-পাথালি নৌকা।

.

দেখতে দেখতে খর জ্যৈষ্ঠের অগ্নিদাহ নিভিয়ে নেমে এল জল। আষাঢ় পড়তে পড়তেই ঋতুমতী গঙ্গার লাল জল ফেঁপে ফুলে উঠল। জল উঠে এল মাঠে। ভাসল শিউবচনের নৌকা। পেল্লায় নৌকা। ভেতরের খোলটা যেন একটা গুদাম ঘর। মাঝির দল আর নৌকা-ভাড়াটে ব্যবসায়ী। শিউবচনের ঘরকন্না উঠে গেল সাধুদের আস্তানার পেছনের চালায়।

কাজের শুরু। শিউবচন একটা একটা করে কাজ বুঝিয়ে দেয় রামবচনকে। কিন্তু ছেলে যে। এদিক থেকে একেবারে বিষহীন, তা সে জানত না। রামবচনের ধারণা বারো আনায় এক টাকা হয়। বোঝো! শুরু হয় পাখি পড়ানো–চার পয়সায় এক আনা, যোলো আনায় এক টাকা, পাঁচ গণ্ডায় এক কুড়ি।

আর পাঁচ কুড়িতে কত?

রামবচন বলে, একশো।

শিউবচন বলে, বা বেটা বেশ। আর ষোলো আনায়?

এক টাকা।

বাহবা বাহবা। ওই ষোলো আনাটি ঠিক বুঝে নিতে হবে, বুঝেছ বাবা? নইলে সব গণ্ডগোল। বলে আবার জিজ্ঞেস করে, এক এক খেপ মারতে লাও যদি মাঝ পথে থেমে কোথাও মাল তোলে তবে?

রামবচন না হেসেই গম্ভীরভাবে বলে, বুঝতে হবে ফাঁকি দিয়ে দোবারা মাল তুলছে।

তাতে কী হল?

তোমাকে ফাঁকি মারা হল।

আমাকে কী রে ব্যাটা, তোকে নয়?

রামবচন আরও গম্ভীর হয়ে বলে, ওই হল।

বাহবা ব্যাটা। ইংলিশে না কী বলে কথাটা? হ্যাঁ, ফাস্টকিলাশ। বলে শিউবচন হাসে।

নৌকা সে মাসকাবারি ভাড়া খাটায় না। সেরকম খাটায়, নৌকা যাদের বাড়তি কারবার। সে। খাটায় এক এক খেপ, যাকে বলে সে টিরিপ মারা; তারপর সাধুদের পেসাদি কলকের গাঁজায় দম দিয়ে জুলজুলে চোখে খোঁজে ফুলবর্ষিয়াকে। কিন্তু কখনও একটি পয়সা সে রামবচনের হাতে দেয় না। রামবচনের তাতে কিছু যায় আসে না। বরং হিসেব শেখার কৌতূহলটা তার মন্দ লাগে না।

.

কিন্তু হার মানেনি ফুলবর্ষিয়া। সেদিন মনে হয়েছিল, বুঝি সে রাগ করেছে। করুক। তবু কামাই নেই তার নিরন্তর হাসির। তবু রামবচন যেদিন থেকে শুনেছে তার বাপের কেনা অন্তত সেদিন থেকে যেটুকু বা রং তার মনে লেগেছিল, সেটুকু চাপা দিয়ে রেখেছে।

এখন আকাশে সারাদিন মেঘ। মেঘ আর নিরন্তর বর্ষণ। গোমড়ামুখো দিন। কখনও মুষলধারে কখনও ইলশেগুঁড়ি, নয়তো ছিচকাঁদুনের কান্নার মতো। যেন কান পচে যায়।

 সকলেই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে, ঝিমোয়। বেজায় দমে যায় রামবচন। তার ভোলা প্রাণটা আটকা পড়ে গেছে। সত্য, সে দীনদয়ালের বাড়িতে নোকর ছিল, কিন্তু কেমন করে তার দিন কেটে যেত, টের পেত না। মোষ চরানো, খাওয়ানো, ঘরে বাইরে কাজ আর ইয়ার দোস্তের সঙ্গে এটা সেটা আবোল তাবোল বকা, এই করে কেটে যেত। আর এখানে? কথায় বলে সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। সুখ সে পেয়েছে কিনা, কিন্তু স্বস্তি নেই এতটুকু। পাওয়ার হিসাব পরে, চায় কী সে? ভাবে, কোদাল কোপালেও হত। বসে থাকা যেন মরে থাকা।

তার উপরে সারাদিন মেঘে মেঘে কালো দিন। আর ফুলবর্ষিয়ার হঠাৎ হাসির ঝঙ্কার। সে হাসিতে মেঘ নড়ে, শিউরে ওঠে বনপালা, ভরা গঙ্গার লাল জলে ঢেউ ওঠে, সোহাগি আকাশ ঝরঝর। করে জল ঢালে।

কেন, কীসের হাসি? রামবচন মনে মনে বলে, হাসি নয়, হাসির ব্যায়ো। যেন একটা সর্বনাশের নেশা জড়ানো। অবাক। রামবচনের দিকে অষ্টপ্রহর তার সেই নিষ্পলক বাঁকা চোখের নজর। কখনও ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে হঠাৎ ভেসে ওঠে তার চোখ, কখনও আচমকা ঝোপ ঝাড়ের ভেতর থেকে কিংবা গঙ্গার ঢালু জমির আড়াল থেকে ঝলকে ওঠে তার হাসি মুখ। ওই চোখ জোড়া যেন ছায়ার মতো দিবারাত্র রামবচনের পিছে পিছে ফিরছে।

কখনও হঠাৎ গায়ের কাছে এসে পড়া নয়তো আঁচলের ঝাপটা মারা, তারপর দুর্জয় শয়তানিতে ভরা চোখে চকিত কটাক্ষ ও শ্লেষ ভরে হেসে ওঠা।

 কিন্তু রামবচন আর গায়ে মাখে না। মাখতে গেলেও চলে না।

ফুলবর্ষিয়ার এ সব ব্যাপার চোখে পড়লেই শিউবচন খ্যাপা মোষের মতো ছুটে এসে চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে দেয়, ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেয় ঘরের মধ্যে নয়তো কষে থাপ্পড় হাঁকে।

অমনি ফুলবর্ষিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে কালনাগিনীর মতো ফণা তোলে। তীব্র গালাগাল ও চিৎকারে

লকলকিয়ে ওঠে তার জিভ, এমনকী হাত তুলতে যায় শিউবচনের উপরে। রামবচন নির্লিপ্ত ঘৃণায়। চুপ করে থাকে।

কী বিচিত্র মনোবৃত্তি। অমনি সাধুরা ওদের পরস্পরকে উসকে দিতে থাকে। হাসাহাসি করে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু শিউবচন যেন কেঁদে ফেলবে এমনি ভাবে চুপ হয়ে যায়।

তারপরে সে হঠাৎ ছেলের দিকে ফিরে বলে এ সব কী হচ্ছে আঁ? তুই ছেলে হয়ে রামবচনের চোখে রক্ত উঠে আসে। একেবারে মুঠি পাকিয়ে বলে, এই, দেখো বাপ বলে খাতির নেই। মিছে বলবে তো

শিউবচন দু পা পেছিয়ে বলে, মারবি, অ্যাাঁ? তারপর কেঁদে ওঠার মতো চিৎকার করে ওঠে, আমার ছেলে কি না তুই বল শালা। ওরে কুত্তা, ওরে শুয়োরের বাচ্চা, ওরে ঢ্যামনা, বাপের অওরতের সঙ্গে

ফের ঝুটা বলছ!

তীব্র গলায় রামবচন খেঁকিয়ে উঠতেই চুপ হয়ে যায় আবার সে। ঝুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফুলবর্ষিয়ার রকম দেখেই তার সন্দেহ জন্মেছে।

এ সব ছাড়াও রাত্রি আসে প্রত্যহ একই জঘন্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে, অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। রামবচন চালার বাইরের সামান্য জায়গায় খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে রোজই শোনে।

প্রথম থেকেই ফুলবর্ষিয়া চাপা গলায় ফুঁসতে থাকে, আমি খেতে চাইনে, পরতে চাইনে। তোর সুখের কবুতর বনবার মুখে ঝাড়।

শিউবচন তোতলার মতো মিঠে মিঠে বুলি বলে। তারপর রেগে বলে, ও, বাইরের ছোঁড়ার খাটিয়ায় যাবার মন করছে বুঝি?

পরিষ্কার গলায় উচ্চারিত হয় করেই তো।

আমি ঘুমোলে বোধ হয় রোজই

ফুলবর্ষিয়ার গলায় ঢেউ দিয়ে ওঠে, তাই তো।

হঠাৎ ফুঁসে ওঠে শিউবচন, আজকে দুটোকেই শালা কেটে গঙ্গার কোলে দিয়ে আসব।

 শ্লেষে বিধিয়ে ওঠে ফুলবর্ষিয়ার গলা, আরে আমার মরদ রে।

পরমুহূর্তেই শিউবচন ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে ওঠে, হে ভগবান, হে রামচন্দ্র

 ফুলবর্ষিয়া বলে, যেন খানিকটা আকুল হয়েই, তার চেয়ে আমাকে ছেড়ে দাও, রেহাই দাও। আমি তোমার তিনশো রুপায়া শোধ দিয়ে দেব। যেমন করে হোক।

বাইরের খাটিয়ায় রামবচনের প্রাণের মধ্যে ওই কথাগুলোই অন্যরকমে উথালি পাথালি করে ওঠে, আমি চলে যাব, ভেগে যাব এই নরক থেকে। সে উঠে চলে যায় গঙ্গার ধারে।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। অন্ধকার। কী এক অদৃশ্য আলোতে যেন গঙ্গার ঢেউ চকচকিয়ে ওঠে। বোঝা যায় ভাটার টান চলছে। এদিকে ওদিকে জোনাকি জ্বলে। নৈঃশব্দের মধ্যে গঙ্গার একটানা কুলকুল ধ্বনি।

কোথায় যাবে রামবচন? এ দেশ চেনে না, খেটে খাওয়ার জায়গা চেনে না, হাতে একটা আধলা কড়িও নেই। কোথায় পালাবে? পালিয়ে পেট চালাবে কী করে? আর এই ফুলবর্ষিয়া অসহ্য করে তুলেছে তার জীবনটাকে। যা হবার নয়, তাই দিয়ে ও একটা মরদের বুকে জ্বালা ধরায় কেবলই! কেন?

কোনও কোনও দিন ফুলবর্ষিয়া রাত্রে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে যায়। শিউবচনও তার পিছন ছোটে কুকুরের মতো। এমনই পাগলের মতো ছোটে যে, ছেলের কথাটা তার মনেও থাকে না। থাকলেও লজ্জা করে না।

যেমন ঘৃণা তেমনই কৌতূহলও হয় তার। জীবনে এরকম ব্যাপার সে আর কোনওদিন দেখেনি। আর অসহ্য লাগে তার বাপের অবিশ্বাস।

কয়েকদিন আগে কী কারণে সে চালা ঘরটায় ঢুকতে গিয়ে দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দেখেছিল, তার বাবা কোলের কাছে কী নিয়ে দেখতে দেখতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে। হাসিতে হা হয়ে গিয়েছে মুখটা। গর্তে ঢাকা চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। অবাক হয়ে রামবচন দেখল টাকার থলি একটা।

কিন্তু শিউবচন ছেলেকে দেখেই ত্রাসে অস্ফুট আর্তনাদ করে থলিটা কোলের মধ্যে হাত চাপা দিয়ে রাখল। যেন এখুনি ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে।

ছেলে ভাবে, তবে এ লোকটা তখন তাকে পেয়ারে বেটা বলে ডেকে নিয়ে এসেছিল কেন? জীবনে তো সবই হারিয়েছিল। কেন আবার দেখল সে তার বাপকে আর কেন বা তার মতো একটা গেঁয়ো নোকরের প্রাণে বারবার রং ছুড়ে মারছে ফুলবর্ষিয়ার মতো অওরৎ।

আর এই সাধুগুলি শুধু তার বাপ আর ফুলবর্ষিয়াকেই উসকায় না তাকেও আবার উসকে দিতে চায় ওদের দু জনের বিরুদ্ধে। গুড় ছাড়া প্রায়ই চুরি করে ঘরের থেকে এটা সেটা নিয়ে যায়। ঘটি কাপড় এমনকী কোনও সময় ছাতুর ঠোঙাও। বাপ তার ভগবানকে দোষে আর সে কিছু বলতে গেলে হাত ধরে রাখে।

তখন সাধুরা রামবচনকেই বিদ্রূপ করে হেসে ওঠে।

 লোকে বলে এটা সাধুঘাট। রামবচনের মনে হয় নরকের কারখানা। তাই এখান থেকে মনটা তার কেবলই পালাই পালাই করে।

কিন্তু পালাবার পথ নেই। কেবল তখনই রামবচন একটু মুক্তি পায় যখন নৌকায় করে ভিন জায়গায় চলে যায় সে। দূরের খেপ হলেই তাকে নৌকায় যেতে হয়। কখনও দু দিন, তিনদিন এক সপ্তাহও বাইরে নদীর বুকে ও খালে বিলে দিন কেটে যায় তার। মাঝিদের সঙ্গে গল্প করে, তামাক খেয়ে, কখনও হাল ধরে বা বৈঠা টেনে তার দিন কাটে। ভাবে, মালিকের ছেলের চেয়ে মাঝি হওয়া ভাল ছিল।

তবু জলের বুকে দিনের পর দিন ঘুরতে বারবার তার মনে হয়, কী যেন সে ফেলে এসেছে পিছনে। তার হুঁকোর ধোয়া ডিঙিয়ে দূর আকাশের বুকে কিম্ভুতাকৃতি মেঘ ফুড়ে হঠাৎ হেসে ওঠে একটা মুখ। আচমকা তার কানে রিনরিন করে ওঠে একটা খিলখিল হাসির ধ্বনি। আর কেবল মনে পড়ে যায় ফেলে আসা গাঁয়ের কথা, বিচুলি ঘরটার সোদা গন্ধ।

আবার ফিরে এসে নৌকা থেকে নামতে না নামতেই সে শুনতে পায় ফুলবর্ষিয়ার হাসি। কেবল ওর মুখটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।

.

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল রামবচনের। কে যেন গোঙাচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখল চালা ঘরটার বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে। দরজা বন্ধ। কৌতূহল হলেও কোনওদিন সে উঁকি দেয় না। আজকে হঠাৎ সে উঁকি দিল।

উঁকি দিয়ে ধড়াস করে উঠল তার বুকের মধ্যে। দেখল, ফুলবর্ষিয়া খালি গায়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছ আর শিউবচন যেন একটা আদিম জানোয়ারের মতো ওর উপর ঝুঁকে পড়েছে। হাত বোলাচ্ছে ওর গায়ে আর সেদিন টাকার থলিটা নিয়ে বসার মতো কালো মুখটার ভাঁজে ভাঁজে হাঁ করা মুখটা হাসিতে বিস্ফারিত। বেরিয়ে পড়েছে চোখ দুটো। গলা দিয়ে বোধ করি চাপা গোঙানির মতো একটা উল্লাসের শব্দ বেরুচ্ছে।

কেমন যন্ত্রণা করে উঠল রামবচনের বুকের মধ্যে। শক্ত হয়ে উঠল তার হাতের মুঠি। ইচ্ছে করল, দরজাটা ভেঙে ঘরে ঢুকে গলা টিপে এখুনি ওই শব্দটা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তা না করে সে ছুটে গেল জলের কাছে। যেন উড়ে যাওয়ার জন্য তাকায় ওপরের দিকে।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশেও পরিষ্কার ভেসে ওঠে ওপারের পর্তুগিজ গিজার মাথার ক্রশটা। ফিসফিসে বৃষ্টি। ছপছপ শব্দ জলের। হঠাৎ দু একটা টিমটিমে আলো ভেসে উঠছে গঙ্গার বুকে। বর্ষার মরশুমে সারারাত্রি ঘোরে জেলেরা।

একটু পরেই ফুলবর্ষিয়ার গলার তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে আসে, ফের? হট যা পিশাচ, কমিনা। টুক করে বাতিটা যায় নিভে আর অন্ধকার যেন টিপে টিপে হাসতে থাকে শিউবচনের কান্নার ফোঁস ফোঁস শব্দে।

তবুও ভোরবেলা দরজা খুলেই ফুলবর্ষিয়া রামবচনের দিকে তাকিয়ে টিপে টিপে হাসে। লজ্জা হয়, তবু রামবচন অবাক হয়ে আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

 চোখের কোল বসে গেছে ফুলবর্ষিয়ার। ক্লান্ত মুখটা শুকনো। চোখের চাউনিটা আজকাল তার আরও ধারালো হয়েছে। যেন কীসের জ্বালায় জ্বলে। বাঁকা হাসিটা থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে ওঠে। কেঁপে কেঁপে ওঠে রামবচনের বুকের মধ্যে। মনে পড়ে এর মধ্যে কতদিন ফুলবর্ষিয়া কতদিন গভীর রাত্রে নিশব্দে উঠে এসেছে তার খাটিয়ার কাছে। রামবচনের গায়ে তার নিশ্বাস লেগেছে। হয়তো সন্ত্রস্ত আলতো স্পর্শে শিউরে উঠেছে বুকের মধ্যে। তার অজ পাড়াগেঁয়ে প্রাণে কোনও পালিশের মুখোশ ছিল না। আগুন জ্বলেছে বুকে। তবু ও মরার মতো পড়ে থেকেছে। বাপের মুখটা মনে করে থিতিয়ে গিয়েছে তার উত্তেজনা।

কিন্তু আশ্চর্য! ফুলবর্ষিয়া তাকে কোনওদিন জাগিয়ে দেয়নি। সে দেখেছে, তারপরে ফুলবর্ষিয়া চলে গিয়েছে গঙ্গার কিনারে, যেখানটায় সে গিয়ে দাঁড়ায় রাত্রে। হাওয়ায় তার চুল আর শাড়ি ওড়ে। কী করে সে ওখানে দাঁড়িয়ে?

আজ সকালের দিকে খানিকক্ষণ আকাশটা থমকে থেকে হঠাৎ প্রবল বর্ষণ শুরু করল। তার সঙ্গে সামুদ্রিক হাওয়ার প্রচণ্ড ঝড়। দিন রাত্রি একাকার হয়ে উঠল অন্ধকারে। দ্রুত বৈঠার চাড়ে জেলেরা সব ঘাঁটিতে নৌকা বাঁধতে লাগল।

বর্ষার গঙ্গার রূপ গেল বদলে। উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলে উঠল। খেপে উঠল গৈরিক বসনা রুদ্র সন্ন্যাসিনী। একটানা গোঁ গোঁ শব্দের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠল চালা ঘর। দুমড়ে গেল শত শত বছরের পুরনো বট গাছটা।

শিউবচন ভীত কণ্ঠে তাকিয়ে বলল, হায় রাম! এ যে সাইকোলেন।

সাইকোলেন! একটা নতুন কথা শুনে রামবচনও পৃথিবীর রুদ্রমূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল।

আজ আর নৌকা ভাড়া দিল না শিউবচন। মাঝিরা শুয়েছিল নৌকার মধ্যে। তাদের হেঁকে ডেকে গাছের সঙ্গে নৌকা বাঁধবার হুকুম দিল সে। তবে তার লোকসান গেল না। শহরের এক কারবারি এসে তার পিপেগুলি ভাড়া নিয়ে গেল। গাঁজার কলকে নিয়ে গিয়ে সে বসল সাধুদের আড্ডায়।

রামবচন বেরিয়ে পড়ল ঝড়ের মধ্যে। মাঝিদের সঙ্গে সেও লেগে গেল নৌকা বাঁধতে। সত্যি, ঝড়ের টানে পাঁচমনি নোঙর সরে গিয়েছে। অতবড় চৌদ্দমাল্লই নৌকাটাকে যেন কোন জলদৈত্য হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। দুটো মোটা কাছি দিয়ে তাকে গাছের সঙ্গে সবাই বাঁধল।

মাঝিদের সঙ্গে কাজ করে রামবচন হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল। যেন দীনদয়ালের চারটে খ্যাপা। মোষের পেছনে সে এতক্ষণ ছুটেছে।

খালি গায়ে জল নিয়ে সে ঘরে ঢুকতেই অন্ধকার কোণ থেকে একেবারে তার গায়ের উপর এসে পড়ল ফুলবর্ষিয়া। একটা শুকনো গামছা বাড়িয়ে দিয়ে তেমনি গা ঘেষে দাড়িয়ে ফিক করে হেসে উঠল।

রামবচন চমকে উঠে একবার তাকে দেখেই বেরুবার জন্য পেছন ফিরল। কিন্তু ফুলবর্ষিয়া চকিতে তার হাত ধরে মুখে হাসির বিষ নিয়ে বলল, কী, ভয় করে না ঘেন্না করে? মানুষ বলে। সমঝাও না নাকি?

রামবচন হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু ফুলবর্ষিয়া আবার বলল, তোমার ওই পিশাচ বাপের তিনশো টাকার কেনা বাঁদি, তাই বুঝি…

কথা আটকে আসছে। তবু ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসিটুকু জিয়নো থাকে। রামবচন মুখ তুলে বলতে যাচ্ছিল, তুমি আমার বাপের অওরত।

ঠিক সেই মুহূর্তেই শিউবচন একবারে তাদের দুজনের মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে চিৎকার করে উঠল। প্রথমেই ফুলবর্ষিয়াকে দু হাতে জাপটে ধরে সে সরিয়ে নিয়ে গেল, হারামজাদি, রেণ্ডি কাঁহিকা, আজ দেখাচ্ছি তোকে।

তারপরেই রামবচনের দিকে খেঁকিয়ে উঠল, কীরে শুয়োরের বাচ্ছা, বড় যে গোঁফ পাকিয়ে পাকিয়ে ভালগিরি ফলাস। মনে করেছিস আমি শালা কিছু জানি না?

রামবচন গম্ভীর হয়ে বলল, বাজে বকো না।

বাজে বকো না? আরও খেপে ওঠে সে। চিৎকার করে বলে, আরে বেহায়া, বেজন্মা, তোর লজ্জা করে না?

রামবচন হঠাৎ মাথা তুলে হিসিয়ে উঠল, খবরদার। চুপ হয়ে যাও।

তোর ভয়ে? তুই অওরত নিয়ে ফুর্তি করবি আর আমি…

কথা শেষ করার আগেই রামবচন তাকে এক ধাক্কায় ঘরের বেড়ার ধারে মাটিতে ফেলে দিল, বাবাগিরি ফলাতে এসেছিস বুড়ো খচ্চর কোথাকার। টাকা দে, আজই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। থুক দিই তোর সুখের ভাতে। নীচ কাঁহিকা!

শিউবচন ততক্ষণ চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়েছে, হে ভগবান, আমার খেয়ে আমাকে ঠ্যাঙাচ্ছে হায় রাম, এ বেহায়ার মাথায় তুমি বাজ ফেলো। ওকে মার ডালো মার ডালো।

ফুলবর্ষিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসিটা আরও দুর্জয় হয়ে উঠল। আড় চোখে বারেক বাপ বেটাকে দেখে নাকের পাটা ফুলিয়ে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

একটা চকিত বিরতির পর সামুদ্রিক ঝড়ের গোঙানি দ্বিগুণ তীব্র হয়ে চালা কাঁপিয়ে ছুটে গেল। সেই সঙ্গে ভেসে এল সাধুদের গাঁজার নেশা ধরা অট্টহাসি। যেন কোথায় একদল দানব মেতে উঠেছে এই দুর্যোগের সুযোগে।

 রামবচন শান্তভাবেই গা হাত পা মুছে কাপড় ছাড়ল! শিউবচন তখনও ফোঁস ফোঁস করছে। তারপর হঠাৎ উঠে বসে ভাঙা গলায় বলতে আরম্ভ করল, তুই আমাকে মারলি। আমি চিরকাল সাধুদের পিছে ঘুরেছি, ধর্মের সাধনা করেছি। একটা অওরত দেখে তুই আমাকে খারাপ ভেবেছিস। কিন্তু আমার কী আছে? কুছ নহি কুছ নহি, ভগবান কা চরণো মে সব দে দিয়া।

বলে সে আচমকা রামবচনের সামনে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াল। চকিতে একবার সেদিকে দেখেই রামবচন ঘৃণায় ভয়ে কণ্টকিত হয়ে চোখে হাত চাপা দিল। সে দেখল, লোকটার পৌরুষ একটা অর্ধস্ফুট ইঙ্গিত মাত্র, সেখানে আর কিছু নেই। তার ইচ্ছে হল এখুনি কিম্ভূতকিমাকার জন্তুটার গলা টিপে সে নিকেশ করে দেবে। মনে হল তার সামনে কোনও মানুষ নেই, একটা অপদেবতা রয়েছে।

বাইরে ঝড়ের গোঙানি আর ঝাপটার শিস।

 শিউবচন কাপড় পরে একঘেয়ে গলায় বলে যেতে লাগল, তোর মায়ের মরার পর আমি শুধু এরই সাধনা করেছি। আমার গুরু আমাকে শিখিয়েছে আর আমি বছরের পর বছরে পুরুষত্বের এই চিহ্ন গায়েব করে সিদ্ধিলাভ করেছি। কাহে? না ফিন আমার ঘরে মন টানতে পারে, আবার আমি সংসারে ফিরতে পারি।

কিন্তু রামবচন ভাবছে, তবে লোকটা অওরত কিনেছে কেন? সংসার চায় না তো লোকটা এমন অর্থগধু কেন? ছেলেকে পর্যন্ত সে একটা পয়সা দিয়ে বিশ্বাস করতে চায় না।

 রামবচনের মনে হল তার জ্বর হয়েছে, মাথাটা ভারী হয়ে গিয়েছে। হয়তো বমি হবে এখুনি। সে তাড়াতাড়ি বারান্দার খাটিয়াতে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।

শিউবচনের গর্তে ঢাকা চোখ দুটোতে একটা অর্থপূর্ণ খুশি ফুটে উঠল। সে বলতে লাগল, বুঝে দেখ আমি এখন পাপের ঊর্ধ্বে। ফুলবর্ষিয়া আমার কাছে খালি পুতলা, শুধু গুড়িয়া কি খেলা…।

বলতে বলতে তার চোখে লোলুপতা ফুটে উঠল। সেই পুতুল খেলার স্বপ্নেই বোধ করি সে বিহ্বল বোবা জানোয়ারের মতো হাঁ করে নিঃশব্দে হেসে উঠল। বলল, সেই পুতুলকে আমি তিনশো টাকায় কিনেছি। সাধুরা সব জানে, কিন্তু কিছু বলে না। অন্য কেউ যদি ওকে ছিনিয়ে নেয়, সেই পাপীকে ভগবান রেহাই দেবে না, কভি নহি। ভগবান উসকো মারেগা।

বলে সে আরও কয়েকবার রামচনকে দেখে গাঁজার তৃষ্ণায় বেরিয়ে গেল। শত্রুকে ঘায়েল করার জয়ের চাপা হাসি তার মুখে।

.

ঝড়। সমস্ত পৃথিবী যেন একটা সর্বনাশা খ্যাপামিতে মেতে উঠেছে, অন্ধকার হয়ে গেছে। সকাল না দুপুর না সন্ধ্যাকাল কিছু বোঝার উপায় নেই।

রান্না হয়নি। সাধুদের পূজার প্রসাদ নিয়ে এল ফুলবর্ষিয়া রামবচনের জন্য। রামবচন চোখ তুলে তাকাল ফুলবর্ষিয়ার দিকে অদ্ভুত নিষ্পলক চোখে। দৃষ্টি তার বিচিত্র, বেদনাচ্ছন্ন ও বিস্মিত। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম সে ফুলবর্ষিয়ার দিকে এমন করে তাকাল।

বাঁকা হেসে তাকাতে গিয়ে থমকে গেল ফুলবর্ষিয়া। হঠাৎ কেঁপে গেল ঠেটি। এই প্রথম রামবচনের নিষ্পলক অনুসন্ধিৎসু চাউনি দেখে তার মতো মেয়ের দুর্জয় চোখের দৃষ্টি নেমে গেল। আচমকা ওই চোখ ফেটে বেরিয়ে এল জল। কেবল ফিসফিস করে বলল, দেখো না, এ পাপের দিকে চেয়ে দেখো না।

তারপরে ছুটে ঘরের কোণে গিয়ে সে ফুপিয়ে উঠল। টন টন করে উঠল রামবচনের বুকটা।

গভীর রাত। সারাদিনের পর রাতকে হাতে পেয়ে ঝড় যেন আরও খেপে উঠেছে। গোঁ গোঁ শব্দটা শোনাচ্ছে তীব্র হুঙ্কারের মতো। ঢেউ ভাঙার শব্দ গঙ্গার অন্ধকার বুকে। উত্তর ধারে শিউবচনের নৌকাটা একটা বৃহৎ জলচর জীবের মতো দুলছে।

ঘুম নেই রামবচনের। একটা চটের আড়াল দিয়ে বাইরের খাটিয়ায় শুয়েছে সে।

হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হল। তারপর বেরিয়ে এল ফুলবর্ষিয়া। আলতো করে গায়ে হাত দিল রামবচনের। শিউরে উঠল রামবচন, তবু নিঃসাড়ে পড়ে রইল। নিশ্বাস লাগছে ফুলবর্ষিয়ার। তার এলো চুল এসে ঠেকেছে গায়ে। কয়েক মুহূর্ত। ফুলবর্ষিয়া চটের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে গেল। তুমুল ঝড় ও বৃষ্টি। তার মধ্যেই সে গঙ্গার ধারে ঠিক সেইখানটাতে গিয়ে দাঁড়াল পশ্চিম মুখো হয়ে। তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল।

রামবচন উঠে আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে, তেমনই পশ্চিম মুখো হয়ে। একটু পরে ফিরে ডাকল, ফুলবর্ষিয়া!

ফুলবর্ষিয়া টের পায়নি! চমকে ফিরে একেবারে দু হাতে সাপটে ধরল রামবচনের চওড়া শরীরটা। কান্না তার দ্বিগুণ হয়ে উঠল।

রামবচন বলল, ফুলবর্ষিয়া, আমি চলে যাব।

কোথায়?

মূলুক।

রুপায়া কোথা মিলবে?

একটু চুপ করে থেকে রামবচন বলে, পয়দল যাব। যদি মরে যাই, তবু।

ঝড়ের ঝাপটাতে বৃষ্টির চাবুক পড়ছে তাদের গায়ে। যেন উড়িয়ে নিতে চাইছে। ফুলবর্ষিয়া। বলল, দেশে নয়, আমার সঙ্গে তুমি চলল। চলো আমরা চলে যাই।

কোথায়?

দূরের শহরে।

আমি কিছু চিনি না।

আমরা চিনে নেব।

কী করব?

কারখানায় নোকরি ধরব আমরা দু জনে। আমরা ঘর করব।

কবে যাব?

আজ এখুনি চলো যাই।

অন্ধকারের মধ্যে একবার রামবচন ফুলবর্ষিয়ার মুখটা দেখবার চেষ্টা করল। দুটো ব্যাকুল চোখে আলো আঁধারের খেলা। তারপর ফিরে তাকাল অন্ধকারের চালাটার দিকে। ঘৃণায় জ্বলে উঠল তার। চোখ দুটো।

চল! চল! প্রকৃতির চেয়ে উদ্দাম ঝড় হয়ে উঠল ফুলবর্ষিয়া নিজে। ঝড়ের তীব্র হুঙ্কার যেন তাদেরই হৃদয়ের উল্লাস। হাওয়ার চেয়েও আগে আগে তারা এগিয়ে চলল। অন্ধকারে দুটো মূর্তি একটা হয়ে গেল। পিছনে পড়ে রইল শুধু একটা কুৎসিত ভয়াবহ বিকৃত অতীতের কঙ্কাল।

ভোরবেলা শিউবচন ঘুম থেকে উঠে দেখল ফুলবর্ষিয়া নেই। বাইরে এসে দেখল রামবচনের খাটিয়া শূন্য। ধ্বক করে উঠল তার বুকের মধ্যে। এদিক ওদিক দেখে ছুটে ঘরে এসে একটা কোণ থেকে পাথর সরিয়ে বের করল টিনের বাক্স। খুলে দেখল, টাকার থলিটা আছে। সেটাকে বুকে করে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সে সাধুদের কাছে গিয়ে পড়ল, হায় ভগবান কুত্তা দুটো ভেগে। গেছে।

অ্যাঁ। সাধুরা হাসতে গিয়ে হঠাৎ চুপ করে একেবারে বিমর্ষ হয়ে গেল। শব-খেকো কুকুরের মতো জুলজুলে চোখে তারা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। আজকে আর তারা হাসতে পারল না।  বাইরে একটানা ঝড়। সমুদ্রের ঝড় আর মুষলধারে বর্ষণের ঝাপটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *