তোমাকে

তোমাকে – ইমদাদুল হক মিলন

০১.

দোতলার সিঁড়িতে একটা পা মাত্র নামিয়েছেন হোসেন সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল মেয়ের কথা। সঙ্গে সঙ্গে পাটা তুললেন তিনি। নামলেন না।

তাকে থামতে দেখে পেছনের দলটাও থেমেছে। রঞ্জু, রঞ্জুর বউ ছবি এবং তাদের পাঁচ বছরের ছেলে টুপু।

হোসেন সাহেব ছবির দিকে তাকালেন। অপরা কই, বউমা?

বাবার কথায় রঞ্জুরও যেন বোনের কথা মনে পড়ল। তাই তো!

তারপর ছবির দিকে তাকাল রঞ্জু। অপরা যাবে না?

কী জানি?

হোসেন সাহেব বললেন, তুমি একটু ওর রুমে যাও তো বউমা। দেখ তো ব্যাপারটা কী!

ঠিক আছে। আপনারা নামুন, আমি দেখছি।

দ্রুত হেঁটে অপরার রুমে এসে ঢুকল ছবি।

কিন্তু অপরা রুমে নেই। খুবই মন খারাপ করা ভঙ্গিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

শৈবালের এই বারান্দা থেকে পরিষ্কার দেখা যায় সমুদ্র।

বিকেলবেলার সমুদ্রের দিকে উদাস,অপলক চোখে তাকিয়ে আছে অপরা। মুখ দেখে বোঝা যায় তার মন ভাল নেই।

ছবি এসে অপরার সামনে দাঁড়াল। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

অপরা বিষণ্ণ চোখে ছবির দিকে তাকাল। তাহলে কী করব?

কী করবে মানে? কক্সবাজার এসে বিকেলবেলা লোকে কী করে? তাড়াতাড়ি চল। সূর্য ডুবে যাবে।

আমি যাব না ভাবী।

কেন?

ভাল লাগছে না।

বল কী! সবাই মিলে এখানে বেড়াতে এলাম আর প্রথম দিনেই তোমার ভাল লাগছে না?

অপরা কথা বলল না।

ছবি যেন একটু বিরক্ত হলো। ভাল না লাগলে এসেছ কেন?

আসতে চাইনি। তোমরাই জোরাজুরি করলে!

সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে অপরার একটা হাত ধরল ছবি। এখনও সেই জোরাজুরিটা করছি। চল।

আমার সত্যি ভাল লাগছে না।

সমুদ্রতীরে চল, দেখবে ভাল লাগছে। সমুদ্র মানুষের মন বদলে দেয়।

অপরা মনে মনে বলল, আমারটা বদলাতে পারবে না।

তারপর ছবির সঙ্গে তার রুম থেকে বেরুল।

.

০২.

শৈবালের সামনের দিককার বাগানে বেশ একটা আড়াল দেখে দাঁড়িয়ে আছে দিপু। তার পরনে স্কীনটাইট ফেডেড জিনস আর আকাশি রংয়ের টিশার্ট। পায়ে বুট, চোখে সানগ্লাস। মুখে চুইংগাম আছে দিপুর। আর হাতে একটা ক্যামেরা। ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় কারও জন্য অপেক্ষা করছে সে।

কিন্তু চোখে সানগ্লাস থাকার ফলে বোঝা যাচ্ছে না কোনদিকে তাকিয়ে আছে সে।

দিপুর অদূরে শৈবাল থেকে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার পায়েচলা পথ। সেই পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন হোসেন সাহেব আর রঞ্জু। পাশে সবুজ ঘাসের মাঠ পেয়ে তাতে ছুটোছুটি করছে টুপু।

এসময় অপরাকে নিয়ে ছবি এসে দাঁড়াল হোসেন সাহেব এবং রঞ্জুর সামনে।

মেয়েকে দেখেই চঞ্চল হলেন হোসেন সাহেব। কোথায় ছিলি তুই? তাড়াতাড়ি চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রে সূর্য ডোবে খুব তাড়াতাড়ি। এই দেখবি নামতে শুরু করেছে, তারপরই দেখবি টুপ করে চলে গেছে পানির তলায়।

অপরা কোনও কথা বলল না। বাবার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।

ছবি চলে গিয়েছিল মাঠে, টুপুর কাছে। এখন টুপুর হাত ধরে সে আছে সবার পেছনে।

এই দলটিকে দূর থেকে ফলো করতে লাগল দিপু।

.

০৩.

সূর্য ডোবার এখনও অনেক দেরি।

ছবির কথা শুনে তার দিকে তাকাল রঞ্জু। দেরি হলেই তো ভাল। চল একটু নির্জনে যাই।

মুখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল ছবি। মানে?

রঞ্জু হাসল। আমি অন্যকিছু মিন করিনি। এই বীচটা এখন বাজারের মতো। দেখছ না কী পরিমাণ লোক। হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় মেলা বসেছে।

লোকের তো আসলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কী করবে? চান্স পেলেই কক্সবাজার চলে আসে।

আমি আসলে এসবই বলতে চেয়েছি।

হাত দিয়ে হিমছড়ির দিকটা দেখাল রঞ্জু। ওই দিকটা বেশ ফাঁকা। চল ওই দিকে যাই।

বাবা অপরা ওদেরকেও ডাক।

ওই তো ওরা আসছে। আমরা যেদিকে যাব ওরাও সেই দিকেই আসবে।

তখন যেন হঠাৎ করে ক্যামেরার কথা মনে পড়ল ছবির। আঁতকে উঠল সে। ক্যামেরা আননি?

রঞ্জু হাসল। কী মনে হয় তোমার?

কই, দেখছি না তো?

এই যে পকেটে।

প্যান্টের একদিককার পকেট দেখাল রঞ্জু। পকেটটা উঁচু হয়ে আছে।

ছবি বলল, বের কর। আমার দুএকটা ছবি তোল।

পকেট থেকে তার ছোট্ট ক্যামেরাটা বের করল রঞ্জু। সবাই আসুক, সবার ছবিই তুলি।

তাতো তুলবেই। এখন আমার দুএকটা তোল।

না থাক।

কেন?

দূর থেকে বাবা নিশ্চয় দেখবেন।

দেখলে কী হয়েছে?

আমার লজ্জা করবে।

কিসের লজ্জা?

বাবা ভাববেন ছেলেটা কী রকম নির্লজ্জ টাইপের। বাবার সামনেই নিজের বউর ছবি তুলছে।

একথা শুনে খুবই বিরক্ত হলো ছবি। আশ্চর্য কথা! বাবার সামনে নিজের বউর ছবি তুলতে পারবে না? লজ্জা করছে? কিন্তু বাবা বোনকে নিয়ে তো এক ফ্ল্যাটেই থাক তুমি। রাতে যখন বউ নিয়ে নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমাও তখন লজ্জা করে না? ছেলেটা যে হলো তখন বাবার কথা ভেবে তোমার লজ্জা হয়নি?

তারপর ধমকের সুরে ছবি বলল, তোল ছবি।

রঞ্জু আমতা আমতা গলায় বলল, ঠিক আছে। তুমি তাহলে একটু পানিতে নামো।

সমুদ্রজলে মাত্র পা ছুঁইয়েছে ছবি, হোসেন সাহেব অপরা এবং টুপু এসে দাঁড়াল রঞ্জুর পাশে। মাকে সমুদ্রে নামতে দেখে টুপু ছুটে গেল। আমিও তোমার সঙ্গে থাকব।

রঞ্জু বলল, হ্যাঁ তুমি টুপুকে ধরে দাঁড়াও। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।

হোসেন সাহেব সাবধানী গলায় বললেন, টুপুকে শক্ত করে ধরে রেখ বউমা। সমুদ্রের ঢেউ কিন্তু আচমকা এসে….।

কথাটা শেষ করলেন না তিনি।

কিন্তু এসবের কিছুই ভাল লাগছে না অপরার।

সে বাবার দিকে তাকাল। আমি একটু ওই দিকটায় যাই বাবা?

হোসেন সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। কোনদিকে?

হাত তুলে দূরের একটা বালিয়াড়ি দেখাল অপরা। মাঝখান দিয়ে ঝিরঝিরে একটি জলের ধারা বয়ে গেছে।

একেবারেই ফাঁকা নির্জন জায়গা।

হোসেন সাহেব বললেন, ঠিক আছে। যা।

অপরা হাঁটতে লাগল। এক সময় সেই বালিয়াড়িতে এসে সমুদ্রের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল।

সূর্য তখন আস্তেধীরে সমুদ্রজলের দিকে নামছে।

.

০৪.

বেশ অনেকটা দূর থেকে অপরাকে একা হয়ে যেতে দেখল দিপু।

দেখেই তার মাথায় একটা প্ল্যান এলো। হিমছড়ি থেকে একটি পরিবার নিয়ে ফিরছিল ভাড়ার হুডখোলা জিপ। যাত্রী নামতেই সেই জিপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল দিপু। জিপটা ভাড়া নিয়ে নিল। ড্রাইভারকে বলল, এক ঘণ্টার জন্য ভাড়া নেব। টাকা যা লাগে দেব। তবে আমার একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত?

ড্রাইভ করব আমি।

আর আমি কোথায় থাকব?

আমার পাশে।

আপনি ভাল চালাতে পারেন তো?

বোধহয় আপনার চে’ ভাল পারি।

তবে ঠিক আছে।

তারপর ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল দিপু। সামুদ্রিক হাওয়ার বেগে জিপ চালিয়ে দিল। এক টানে প্রায় অপরার কাছাকাছি।

অপরা তখনও তার মতো করে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। জিপ গাড়িটা এসে যে অদূরে থেমেছে, খেয়ালই করল না।

ড্রাইভিং সিটে বসেই ক্যামেরা তুলল দিপু। একটার পর একটা ছবি তুলতে লাগল অপরার।

কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানুষের সিক্সথ সেন্স খুব কাজ করে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। কেউ কোনও মেয়েকে আড়াল থেকে দেখছে কিংবা তাকে নিয়ে কিছু ভাবছে, বলছে, মেয়েরা যেন চট করেই তা টের পায়। মনের ভেতর থেকে কেউ যেন তাদেরকে কাণ্ডটার কথা বলে দেয়।

অপরাকেও যেন কেউ বলল, এই মেয়ে, দেখ, একজন তোমার ছবি তুলছে।

সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকাল অপরা। তারপর দিপুকে দেখে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল, পাগল হয়ে গেল। মুহূর্তে কোথায় উধাও হলো তার মনমরা ভাব, বিষণ্ণতা। অদূরে বাবা এবং ভাই ভাবী আছেন, টুপু আছে, কিছুই মনে রইল না তার। পাগলের মতো দিপুর দিকে ছুটতে লাগল সে।

কিন্তু দিপু একেবারেই নির্বিকার। অপরা তার দিকে ছুটে আসছে আর সে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের ভঙ্গিতে তার ছবি তুলতে লাগল।

দিপুর জিপের কাছে এসে আনন্দে উত্তেজনায় ফেটে পড়ে অপরা বলল, তুমি? সত্যি তুমি? তুমি কখন এলে? কী করে জানলে আমরা এখানে এসেছি?

দিপু আগের মতোই নির্বিকার। একটিও কথা বলল না। অপরা কথা বলছে আর সে ছবি তুলছে। যেন অপরার প্রতিটি শব্দকে ক্যামেরাবন্দি করতে চাইছে সে। প্রতিটি মুখভঙ্গিকে চিরস্থায়ী করে রাখতে চাইছে।

কিন্তু অপরার এসব একদম ভাল লাগছে না। অস্থির গলায় সে বলল, কথা বলছ না কেন? কী হয়েছে? এই, তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ? কিন্তু আমার কোনও দোষ নেই। হঠাৎ করে প্রোগ্রামটা হলো। আমি আসতে চাইনি।

দিপু তবু কথা বলল না।

দিপুর পাশে বসা জিপের মালিক কিংবা ড্রাইভার হতভম্ব হয়ে আছে। একবার দিপুর দিকে তাকাচ্ছে সে, আরেকবার অপরার দিকে।

এই ফাঁকে লাফ দিয়ে জিপ থেকে নামল দিপু। আবার ছবি তুলতে লাগল অপরার।

অপরা বলল, অনেকবার তোমাকে ফোন করেছি। কিছুতেই পাইনি। কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে বলে আসতে পারিনি, আমার যে কী মন খারাপ হয়েছে।

তারপর মিষ্টি করে হাসল সে। এখন মন ভাল হয়ে গেছে। এখন আমি খুব আনন্দ করব। সমুদ্র, সূর্যাস্ত, গভীর রাতে চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া সমুদ্র সব এনজয় করব। এই, তুমি উঠেছ কোথায়?

দিপু একেবারেই নির্বিকার। অন্যদিকে তাকিয়ে চুইংগাম চিবাতে লাগল।

অপরা অসহায় গলায় বলল, এমন করো না প্লিজ। আমার খুব খারাপ লাগছে। কথা বলো। প্লিজ কথা বলো।

দিপু তবু কথা বলল না।

.

০৫.

দূর থেকে হঠাৎ করেই এই দৃশ্যটা দেখে ফেললেন হোসেন সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জু এবং ছবিকে ডাকলেন। ওরা দেখল দৃশ্যটা।

হোসেন সাহেব বললেন, ছেলেটা কে?

রঞ্জু বলল, বুঝতে পারছি না।

ছবি বলল, নিশ্চয় অপরার পরিচিত। এখানে এসে হয়তো দেখা হয়ে গেছে।

রঞ্জ বলল, তাই হবে।

তারপর হোসেন সাহেবের দিকে তাকাল। বাবা, তুমি একটু সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়াও তো, তোমার একটা ছবি তুলি।

হোসেন সাহেব সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালেন।

রঞ্জু ক্যামেরা তুলল।

.

০৬.

অপরা বেশ রেগে গেছে।

গম্ভীর গলায় বলল, অনেক হয়েছে। আমি কিন্তু এখন রেগে যাব।

দিপু তবু কথা বলল না। চুইংগাম চিবাতে চিবাতে নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্যামেরা তুলল।

আচমকা ক্যামেরাটা ছিনিয়ে নিল অপরা। নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এত করে বলার পরও তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ না! কী করেছি আমি? কী করেছি? তোমার যেমন মন খারাপ হয়েছে, আমার হয়নি? মন কি তোমার একাই আছে? আমার নেই?

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল অপরা।

দিপু তবু নির্বিকার। আস্তেধীরে হেঁটে গিয়ে ক্যামেরাটা কুড়িয়ে আনল সে। তারপর জিপে চড়ল।

অপরা ছুটে এসে তার সামনে দাঁড়াল। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছ তুমি। অতিরিক্ত। আমি কিন্তু এখন চিৎকার করব। চিৎকার করে কাঁদব। আমাদের ফ্যামিলির সবাই আছে এখানে, আমি সবাইকে ডাকব। আমি কিন্তু কেলেংকারি করব।

দিপু এসবের কিছুই কেয়ার করল না। হাওয়ার বেগে জিপ চালিয়ে দিল।

অপরা পাগলের মতো জিপের পিছু পিছু ছুটতে লাগল। দিপু, যেও। যেও না। দাঁড়াও, প্লিজ দাঁড়াও।

.

০৭.

টুপু অবাক গলায় বলল, ফুপির কী হয়েছে মা?

সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ অপরার দিকে তাকাল। তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে গেল। বালিয়াড়ির ওপর হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে সে।

এই দৃশ্য দেখে প্রথমে ছুটল রঞ্জু। তার পিছু পিছু ছবি। সব শেষে হোসেন সাহেব এবং টুপু।

অপরাকে জড়িয়ে ধরে ছবি বলল, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?

হোসেন সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললেন, ছেলেটা কে?

রঞ্জু বলল, তোকে ডিস্টার্ব করেছে?

ততোক্ষণে নিজেকে সামলেছে অপরা। চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমরা যা ভেবেছ তা নয়।

হোসেন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, তাহলে কী? ব্যাপারটা কী?

ভাবীকে আমি সব বলব। তার কাছ থেকে জেনে নিও।

.

০৮.

শৈবালের সামনে এসে জিপ থেকে নামল দিপু।

মানিব্যাগ বের করল। কত?

পাঁচশো টাকা দেন।

দিপু একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিল।

ড্রাইভার অবাক। যা চাইলাম তাই দিলেন?

হ্যাঁ।

আপনে খুব অন্য ধরনের মানুষ।

হ্যাঁ। আসুন। খোদা হাফেজ।

কিন্তু আমার একটা কথা আছে।

কী কথা?

মানে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। করব, সাহেব?

না।

শুনেই না করে দিচ্ছেন?

এই প্রথম সানগ্লাসটা খুলল দিপু। মুখ থেকে চুইংগাম ফেলল। শুনতে হবে না। আমি জানি কথাটা কী?

বলেন তো কী?

আপনি জানতে চাইবন মেয়েটা আমার কে? কেন এভাবে আমি তার ছবি তুলোম। কেন আমি তার সঙ্গে একটাও কথা বললাম না।

জ্বী। কারেক্ট।

ওসব জানার আপনার কোনও দরকার নেই। আপনি আসুন।

হন হন করে হেঁটে সিঁড়ির দিকে চলে গেল দিপু।

দিপুর দিকে তাকিয়ে জিপঅলা হাসিমুখে বলল, বুঝছি। মাথায় ছিট আছে।

.

০৯.

শৈবালের সুইটগুলোতে সুন্দর লিভিংরুম আছে।

রাতেরবেলা হোসেন সাহেব রঞ্জু আর ছবি বসেছে লিভিংরুমে। হোসেন সাহেব বললেন, এখন বল বউমা, ব্যাপারটা কী? অপরা তোমাকে কী বলল।

ছবি মাথা নীচু করে বলল, ওদের দুজনের অনেকদিনের সম্পর্ক।

তাই নাকি?

জ্বী।

রঞ্জু বলল, ছেলেটার নাম কী?

নাম বলল ছবি।

হোসেন সাহেব বললেন, করে কী সে?

মাস্টার্স দেবে।

কোত্থেকে?

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।

সাবজেক্ট।

বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশান।

রঞ্জু বলল, ফ্যামিলি কেমন?

খুবই ভাল।

অবস্থা?

বিশাল। ধানমন্ডিতে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি মায়ের।

হোসেন সাহেব অবাক হলেন। মানে?

বাবা নেই। গার্জিয়ান হচ্ছেন নানা।

কী করেন তিনি?

বিজনেস।

কিসের?

শিপিং বিজনেস। প্রচুর টাকার মালিক। দিপুর মা তার একমাত্র সন্তান। দিপুও তার মা বাবার একমাত্র সন্তান।

রঞ্জু বলল, অর্থাৎ ঝামেলামুক্ত পরিবার।

ছবি বলল, হ্যাঁ একেবারেই ঝামেলামুক্ত।

হোসেন সাহেব বললেন, বুঝলাম। কিন্তু ছেলেটার স্বভাব চরিত্র আমার পছন্দ হয়নি।

ছবি অবাক হলো। স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে আপনি জানলেন কী করে?

না মানে এভাবে আমাদের পিছু পিছু কক্সবাজার পর্যন্ত চলে এসেছে। সীবিচে মেয়েটিকে ডিস্টার্ব করেছে।

ছবি হাসল। ডিস্টার্ব কিন্তু করেনি, মজা করেছে।

তারপর একটু থেমে বলল, বাবা, আমার কিন্তু দিপুকে খুব ভাল লেগেছে। অপরার জন্য ওর যে প্রচণ্ড টান, তা আমি বুঝতে পেরেছি।

হোসেন সাহেব কোনও কথা বললেন না।

.

১০.

শৈবালের দক্ষিণ দিকে যে সুন্দর পুকুর, ভোরবেলা সেই পুকুরের ঘাটলায় এসে বসে আছে অপরা। মুখটা বিষণ্ণ, চোখে উদাস দৃষ্টি।

নিজের রুম থেকে দৃশ্যটা দেখতে পেল দিপু। দেখে অপরার জন্য একেবারে পাগল হয়ে গেল। প্রায় ছুটে পুকুরঘাটে এল সে।

দিপুকে দেখে স্বরাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে রইল অপরা।

অপরার পাশে বসে তার একটা হাত ধরল দিপু। রাগ করেছ?

অপরা কথা বলল না।

দিপু বলল, তোমাদের বাড়িতে ফোন করে হতভম্ব হয়ে গেছি। আমি জানি না অথচ তুমি কক্সবাজারে। কাজের মেয়েটা বলল তোমরা পাজেরো নিয়ে গেছ। সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান করলাম। জিএমজিতে আমার এক সিনিয়র ফ্রেন্ড আছে, তাকে ফোন করে টিকিট ম্যানেজ করলাম। এবং তোমাদের আগে কক্সবাজার।

কিন্তু নাটকটা না করলেও পারতে।

কেন? কী হয়েছে?

সবাই তোমার কথা জেনে গেল।

আমি তো জানাতেই চেয়েছি।

কী?

হ্যাঁ। তোমাকে ছেড়ে আর একটি মুহূর্তও আমি থাকতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হয়। আমার খুব অস্থির লাগে।

দিপুর কথায় দিপুর জন্য আশ্চর্য এক মমতায় বুক ভরে গেল অপরার। ডান হাতে দিপুর গালটা একটু ছুঁয়ে দিল সে। আমারও লাগে। আমারও খুব কষ্ট হয়। রাতে ঘুম হয় না। শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। এখানে এসে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত খুব মন খারাপ ছিল।

একটু থামল অপরা। তারপর হৃদয়ের গভীর থেকে বলল, দিপু, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।

দুই করতলে দিপু তারপর অপরার মুখখানি তুলে ধরল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে অপরার মতো করেই বলল, আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব।

.

১১.

দিপুর রুমের একদিককার দেয়ালে সাইত্রিশটি ছবি পেস্ট করা।

একেকটি একেক সাইজের। ফলে দেয়াল প্রায় ভরে গেছে। আর দেয়ালটি দিপুর বিছানার মুখোমুখি হওয়ায় বিছানায় শুয়েই ছবিগুলো দেখতে পায় সে।

একজন মানুষেরই বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি। তবে একই পোশাকের, একই লোকেশানের।

লোকেশান হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রতীর। সময় পড়ন্ত বিকেল। সমুদ্রজলে শেষ সূর্যের আভা। বহুদূর সমুদ্রে আকাশ থেকে আস্তেধীরে নামছে দিন শেষের সূর্য।

বিছানায় শুয়ে দিপু এখন অপলক চোখে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। দিপুর মা রেখা এসে দরজায় নক করলেন। এই শব্দে চোখে পলক পড়ল দিপুর। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দিপু বলল, কে?

বাইরে থেকে রেখা বললেন, আমি।

ও মা! এসো।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন রেখা। ঢুকেই দেয়ালে পেস্ট করা ছবি দেখে অবাক হলেন। এ কি?

দিপু সরল গলায় বলল, কী আবার? দেখতে পাচ্ছ না, ছলি।

কিন্তু কার ছবি?

অপরার।

রেখা অবাক হলেন। অপরা কে?

দেখছ না একটি মেয়ে।

তা দেখছি। নাম অপরা?

হ্যাঁ।

অদ্ভুত নাম তো!

অদ্ভুত মানে?

অপরা। শুনলেই অপয়া মনে হয়।

দিপু গম্ভীর হল। বাজে কথা বলো না। অপরা মানে জান?

না।

যে পর নয়।

বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটা কে?

দিপু হাসল। আগেই তো বলে দিলাম যে পর নয়।

রেখা সরল গলায় বললেন, তারপরও আমি বুঝতে পারিনি।

বুঝতে পারনি?

না।

দিপু কেমন বিরক্ত হল। তুমি চট করে সব বুঝতে পার না কেন মা?

দিপুর পাশে বসলেন রেখা। পারছি না যখন, বুঝিয়ে বল।

তোমার বউ হবে।

একথায় মোটেই চমকালেন না রেখা। নির্বিকার গলায় বললেন, তাই নাকি?

হ্যাঁ।

রেখা কথা বললেন না। দিপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

দিপু বলল, কেন? তোমার পছন্দ হয়নি।

রেখা গম্ভীর গলায় বললেন, না।

কী?

হ্যাঁ পছন্দ হয়নি।

দিপু বেশ উত্তেজিত হলো। বিছানায় উঠে বসল। অপরাকে তোমার সত্যি পছন্দ হয়নি?

বললাম তো! সত্যি পছন্দ হয়নি।

আর ইউ সিওর?

সিওর না হয়ে কেউ পছন্দ অপছন্দর কথা বলে!

দিপু যেন নিভে গেল। স্নান গলায় বলল, কিন্তু মা, অপরা খুব সুন্দর। মেয়ে।

রেখা আগের মতোই নির্বিকার গলায় বললেন, আমার মনে হচ্ছে না।

আমি বলছি, সে সত্যি খুব সুন্দর মেয়ে।

হতে পারে। হয়তো ছবিগুলোই ভাল হয়নি। অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে যাদের ক্যামেরা ফেস ভাল না। এমনিতে দেখল মাথা খারাপ হয়ে যায় কিন্তু ছবি দেখলে বিরক্ত লাগে। মোটেই সুন্দর মনে হয় না।

হ্যাঁ কারও কারও ক্ষেত্রে এরকম হয়। কিন্তু অপরার ছবিগুলো কিন্তু আমার খুব ভাল লাগছে।

তুই তুলেছিস?

হ্যাঁ।

নিজের তৈরি ঘি সব গোয়ালাই ভাল বলে।

তাহলে অপরাকে তোমার সামনা সামনি দেখা উচিত।

দেখা।

তোমার কাছে নিয়ে আসব?

আনতে পারিস।

বলেই উঠলেন রেখা।

দিপু বলল, কিন্তু তুমি আমার রুমে এসেছিলে কেন?

কী যেন বলতে এসেছিলাম।

বল।

এখন আর মনে নেই।

বলে একেবারেই নির্বিকার ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন রেখা।

মায়ের আচরণে দিপু খুবই অবাক হলো।

.

১২.

সব শুনে অপরা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

দিপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার খুব ভয় করছে।

কেন?

ছবি দেখে মা আমাকে পছন্দ করেননি।

বাস্তবে দেখলে নিশ্চয় করবেন।

যদি না করেন?

আমার মনে হয় করবেন।

এজন্যই আমার ভয় করছে।

কিচ্ছু হবে না। তুমি চল।

নিজের অসম্ভব সুন্দর চোখ তুলে দিপুর দিকে তাকাল অপরা। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

সিওর।

যদি তোমার মা আমাকে পছন্দ না করেন তাহলে তুমি কী করবে?

দিপু একটু চিন্তিত হলো। বুঝতে পারছি না।

আমি বুঝতে পারছি।

কী বলো তো?

তুমি আমাকে …..।

কথাটা শেষ করল না অপরা।

দিপু আগের মতোই চিন্তিত গলায় বলল, মা চায়নি এমন কাজ আমি কখনও করিনি।

একথা আমি জানি। জানি বলেই বললাম।

অপরার এই কথাটি যেন শুনতেই পেল না দিপু। নিজের কাছে বলার মতো করে বলল, মাকে কখনও দুঃখ দিইনি আমি।

দিপুর মন অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য অপরা বলল, তোমার জন্য একটা সুসংবাদ আছে।

দিপু অপরার দিকে তাকাল। কী?

আমাদের বাড়ির সবাই তোমাকে দেখে মুগ্ধ।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তোমার ব্যাপারে কারও কোনও আপত্তি নেই।

বুঝলাম। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কোথাও না কোথাও একটা প্যাঁচ লেগেই যায়।

মানে?

এই যেমন আমার মায়ের দিকটায় লাগল। তবে মা যদি কিছুতেই রাজি না হয় তারপরও একটা পথ আমার আছে।

কী?

নানাকে ধরব।

তিনি তোমার কথা রাখবেন?

অবশ্যই। আমি হচ্ছি আমার নানার জান। তিনি কিছুতেই আমার কথা ফেলবেন না।

তারপর অপরার একটা হাত ধরল দিপু। চল।

অপরা আর কোনও কথা বলল না।

কিন্তু দিপুদের বাড়ির সিঁড়িতেই মঈনুল সাহেবের মুখোমুখি পরে গেল ওরা।

মঈনুল সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন। নিশ্চয় কোথাও বেরুচ্ছেন তিনি। পরনে ক্রিম কালারের সুন্দর স্যুট। ধপধপে সাদা শার্ট আর গাঢ় নীল রংয়ের টাই। পায়ে চকচকে জুতো। গা থেকে চমৎকার পারফিউমের গন্ধ আসছে। সব মিলিয়ে চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তিনি।

দিপু এবং অপরাকে দেখে নাকের দিকে নেমে আসা চশমাটা চোখের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি।

সঙ্গে সঙ্গে অপরাকে দিপু বলল, এই হচ্ছেন আমার নানা। মঈনুল চৌধুরী। শিপিং বিজনেস করেন।

অপরা নরম লাজুক ভঙ্গিতে সালাম দিল।

মঈনুল সাহেব বললেন, তোমাকে আমি ঠিক …..।

দিপু বলল, ও হচ্ছে অপরা?

অপরা?

হ্যাঁ।

বাহ খুব সুন্দর নাম। একেবারেই আনকমন।

তারপর দিপুর দিকে তাকালেন তিনি। তুই না বললেও আমি বুঝতে পারতাম ও হচ্ছে অপরা।

দিপুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। কী করে? মা তোমাকে বলেছে?

না। ওকে নিয়ে রেখার সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি।

দিপু হতাশ হলো। তাহলে?

ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায় ও অপরা।

তোমার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না নানু।

মঈনুল সাহেব হাসলেন। ওর মুখটা অতি আপন। এই ধরনের মুখের মানুষ কখনও পর হতে পারে না।

মঈনুল সাহেব অপরার দিকে তাকালেন। যাও উপরে যাও।

দিপু বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

আমার একটা মিটিং আছে।

মঈনুল সাহেব নেমে গেলেন।

.

১৩.

আলতো ভঙ্গিতে অপরার চিবুকে হাত দিলেন রেখা।

মুখখানি তুলে ধরলেন। তারপর মুগ্ধ চোখে অপরার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একটুখানি দূরে মুখে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিপু।

রেখা একবারও দিপুর দিকে তাকালেন না। মুগ্ধ গলায় অপরাকে বললেন, ছবির চে’ তুমি অনেক বেশি সুন্দর।

এই বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই বুকটা চিব ঢিব করছিল অপরার। মঈনুল সাহেবের কথায় প্রাথমিক ভয়টা তার কেটেছিল। এখন রেখার কথায় একেবারেই ভারমুক্ত হয়ে গেল সে। বুকের ঢিবঢিবানিটা বন্ধ হলো। মনটা আশ্চর্য এক ভাল লাগায় ভরে গেল।

রেখা বললেন, এমনও হতে পারে দিপু তোমার ছবিগুলো ঠিক মতো তুলতে পারেনি।

দিপুর মুখ থেকেও ততোক্ষণে টেনশান উধাও। অস্বস্তি কেটে যাওয়া গলায় বলল, আমি ছবি খুব ভাল তুলি মা।

এবার দিপুর দিকে তাকালেন রেখা। আবার কি সেই গোয়ালের উপমাটা দেব?

না না দরকার নেই।

অপরা ঠোঁট টিপে হাসল।

রেখা দিপুকে বললেন, তুই আর এখন কোনও কথা বলবি না।

দিপু বাধ্য শিশুর মতো বলল, আচ্ছা।

রেখা আবার অপরাকে নিয়ে ব্যস্ত হলেন। তোমাকে দেখে আমার মন ভরে গেছে মা। অনেকদিন পর বাড়িটা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। দিপুর বাবা বেঁচে থাকলে তিনি যে আজ কী খুশি হতেন!

দিপু ভুলে গেল মা তাকে কথা বলতে বারণ করেছেন। বেশ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, বাবা নেই তো কী হয়েছে? বাবার অভাব আমি কখনও ফিল করিনি। আমার তুমি আছ, নানু আছেন।

তারপর একটু থামল দিপু। মা, অপরাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?

এবার হাসিমুখে ছেলের দিকে তাকালেন রেখা। ছবি দেখেই পছন্দ হয়েছিল।

দিপু যেন আকাশ থেকে পড়ল। কী?

হ্যাঁ।

তাহলে যে বললে …..।

বাস্তবে দেখার জন্যই তোর সঙ্গে অমন ব্যবহার করেছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মতো ছুটে গিয়ে রেখাকে জড়িয়ে ধরল দিপু। আমার খুব ভাল লাগছে মা, খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, তোমাকে একটু কোলে নিই।

ধুৎ পাগল।

সত্যি। মনে হচ্ছে কোলে নিয়ে তোমাকে শিশুর মতো দোলাই।

দিপুর কাণ্ড দেখে অপরা তখন মুখ নীচু করে হাসছে।

দিপুর হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে রেখা বললেন, পাগলামো করিস না। ছাড়।

মাকে ছেড়ে দিল দিপু।

রেখা দরজার দিকে পা বাড়ালেন। অপরাকে বললেন, তুমি বসো মা। আসছি।

রেখা বেরিয়ে যাওয়ার পর অপরার সামনে এসে দাঁড়াল দিপু। বিশাল করে একটা হাঁপ ছাড়ল।

অপরা বলল, কী হল?

বুকের ওপর হাজারমনি একটা পাথর চেপেছিল। সেই পাথরটা নেমে গেছে।

অপরা মিষ্টি করে হাসল। আমারও একই অবস্থা।

আমি আমার মাকে খুব ভালবাসি। মাকে অত খুশি দেখে তাকে আমার কোলে নিতে ইচ্ছে করছিল।

তাতো শুনলামই।

আমি জানি তুমি শুনেছ। কারণ তোমার সামনেই তো বললাম।

তাহলে এখন আবার বলছ কেন?

অন্য কারণে।

কী কারণ?

এখন ইচ্ছে করছে তোমাকে কোলে নিতে।

যাহ।

সত্যি।

আমি কি শিশু যে আমাকে তুমি কোলে নেবে।

অপরার মুখের কাছে মুখ নিয়ে দিপু বলল, না তুমি শিশু নও। তুমি হচ্ছ আমার ভবিষ্যৎ শিশুর মা।

কিছুক্ষণ পরই এই রুমে ফিরে এলেন রেখা। তার হাতে ভেলভেটের ছোট্ট একটা অর্নামেন্ট বক্স। অপরার পাশে বসে বক্সটা খুললেন তিনি। ডায়মন্ডের সুন্দর একটা নাকফুল বের করলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে বিজনেসের কাজে বেলজিয়াম গিয়েছিলেন দিপুর বাবা। তুমি নিশ্চয় জানো ডায়মন্ড সবচে’ ভাল পাওয়া যায় বেলজিয়ামে। সেখান থেকে তিনটি ডায়মন্ড এনেছিলেন। তার একটি দিয়ে নিজেই এই নাকফুলটা করিয়ে ছিলেন। করিয়ে ছিলেন আমার জন্যই। কিন্তু আমার কখনও পরা হয়নি। তিনি মারা গেলেন, তারপর তো আর নাকফুল পরা যায় না। তখন থেকে ভেবে রেখেছি, এটা পরবে আমার ছেলের বউ।

দিপু অবাক গলায় বলল, কিন্তু অপরা পরবে কী করে?

রেখা বললেন, কেন? অসুবিধা কী?

ওর তো নাকে ফুটোই নেই।

অপরা লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নীচু করল। ফুটো একবার করিয়ে ছিলাম, বন্ধ হয়ে গেছে।

রেখা বললেন, নাকফুল ব্যবহার না করলে কখনও কখনও এমন হয়।

হাত বাড়িয়ে নাকফুলটা নিল অপরা। আর হবে না। নাক আমি আবার ফুটো করিয়ে নেব।

.

১৪.

দিপু বলল, নাক ফুলটায় তোমাকে খুব মানিয়েছে।

অপরা বলল, আমি জানি।

কে বলেছে?

ভাবী।

তার বলা আর আমার বলা এক হলো?

না তা নয়।

তাহলে?

এমনি বললাম।

অপরা মিষ্টি করে হাসল। এই নাকফুল পরার জন্য কী কষ্ট করেছি জান?

জানি।

কী বল তো?

নতুন করে নাক ফুটো করিয়েছ।

তাতে আমার কষ্ট হয়েছে না?

না হয়নি।

মানে?

আজকাল নাককান ফুটো করতে কোনও কষ্ট নেই। বিউটি পারলারগুলোতে গেলেই একধরনের স্প্রে করে, যেগুলো লোকাল এনেসথেসিয়ার কাজ দেয় তারপর সুট করে ফুটো করে ফেলে।

বাবা তুমি এত কিছু জানো?

জ্বী।

তারপরই কেমনে অস্থির হলো দিপু। ইস চোখের পলকে যদি পরীক্ষাটা হয়ে যেত, চারটা মাস যদি কেটে যেত।

দিপুর অস্থিরতাটা বুঝল অপরা। তারপরও বলল, তুমি এত অস্থির হয়েছ কেন?

তোমাকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করে না।

আমার করে?

তাতো আমি জানি না। আমি শুধু আমারটাই জানি।

আমার অবস্থাও তোমার মতোই।

এই, বিয়ের পর আমাদের প্রতিটি দিন কীভাবে শুরু হবে?

অপরার গলা স্বরাচ্ছন্ন হয়ে গেল। সকালবেলা উঠেই আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসব।

তারপর?

তুমি তখনও ঘুমে। কিন্তু আমি তোমাকে শব্দ করে ডাকব না। আলতো করে ছুঁয়ে দেব তোমার গাল।

তোমার স্পর্শে আমি চোখ মেলে তাকাব। চায়ের কথা ভুলে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকব। বুঝতেই পারব না দৃশ্যটি বাস্তব না স্বপ্ন।

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

তুমি আমাকে রান্না করে খাওয়াবে না?

আমি রাধতে পারি না।

আমার জন্য শিখে নিও।

নেব। প্রতিদিন খুব যত্ন করে তোমাকে খাওয়াবো।

তুমি আমার সঙ্গে খাবে না?

না।

কেন?

আমি খাব তোমার খাওয়া শেষ হলে।

দিপু আবার বলল, কেন?

তুমি খেতে বসেছ, অমনি চলে গেছে ইলেকট্রিসিটি। হাত পাখায় তখন আমি তোমাকে বাতাস করব।

আমার জন্য এত কষ্ট কেন করবে তুমি?

আমি যে তোমাকে ভালবাসি।

ভালবাসলে এত কষ্ট করতে হয়?

এটা যে কষ্ট একথা তোমাকে কে বলেছে?

দিপু কথা বলল না।

অপরা আগের মতোই স্বরাচ্ছন্ন গলায় বলল, রাতের বেলায় তোমার যেদিন ঘুম আসবে না, মাথায় হাত বুলিয়ে আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।

তাহলে তুমি ঘুমোবে কখন?

তুমি ঘুমোবার পর।

তখন তোমার নিজেকে একা মনে হবে না?

না। কারণ আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাখব যে।

আমার ওপর রাগ করে কখনও বাপের বাড়ি চলে যাবে না তো?

বাপের বাড়ি যাব না।

তাহলে?

গেলে চাচার কাছে চলে যাব।

দিপু অবাক হলো। তোমার চাচা আছেন নাকি?

হ্যাঁ আছেন।

কখনও বলনি তো!

বলা হয়নি।

কেন?

কারণ বাবা তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেননি।

বল কী?

হ্যাঁ।

কেন?

একমাত্র ছোটভাইর সঙ্গে জায়গা সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ হয়েছিল বাবার। বাবার অমতে চাচা তার অংশ বিক্রি করে কোনও এক মফস্বল শহরের পাশে গিয়ে স্কুল করেছেন।

স্কুল করা খারাপ কী?

বাবা হয়তো তা চাননি।

চাচার বাড়িও কি ওখানে?

হ্যাঁ।

সংসারে কে কে আছে?

অপরা হাসল। সংসারই নেই।

দিপু অবাক হলো। মানে?

চাচা বিয়েসাদি করেননি। স্কুলটাই তার জীবন।

তার মানে তোমাদের কারও সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

একজনের সঙ্গে আছে।

কার সঙ্গে?

বুঝতেই পারছ।

 তোমার সঙ্গে?

হ্যাঁ।

তোমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়?

না। তিনি আমাকে চিঠি লেখেন।

মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করল দিপু। তো আমার সঙ্গে রাগ করে তুমি সেই চাচার কাছে চলে যাবে?

অপরা মাথা নাড়ল।

তারপর বলল, কিন্তু এখন যে আমাকে একটু সোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।

কেন?

নোট নিতে হবে।

তা দিচ্ছি কিন্তু তুমি বাড়ি ফিরবে কী করে?

ওসব তোমার ভাবতে হবে না।

তাহলে কে ভাববে?

আরে বাবা, সোমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি কাছেই। রিকশা করে চলে যাব।

বুঝলাম। কিন্তু ভাবতে হবে না বলছ কেন? তোমার সবকিছু নিয়ে ভাবতে চাই আমি। তোমার বলা প্রতিটি কথা, প্রতিটি বিষয় এমন করে মনে গেঁথে থাকে আমার, তুমি যখন পাশে না থাকো তখন শুধু ওসবই ভাবি। আমার মাথা জুড়ে, মন জুড়ে, চোখ জুড়ে শুধু তুমি তুমি তুমি।

দিপুর চোখের দিকে তাকিয়ে গভীর মায়াবি হাতে তার গালটা একটু ছুঁয়ে দিল অপরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *