এসো

এসো – ইমদাদুল হক মিলন
প্রথম প্রকাশ – বইমেলা ২০০১

০১.

বিকেলবেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছিল সুমি।

এমন নিঃশব্দ কান্নাও কাঁদে মানুষ! চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে, বুকের ভেতর চাপ ধরা কষ্ট, তবু কান্নায় কোনও শব্দ নেই। যেন সুমি কোনও রক্ত মাংসের মানুষ নয়, সুমি এক কলের পুতুল। চাবি দিলে যে পুতুল কেবল কাঁদে। চোখের জলে কেবলই বুক ভাসায়।

বাবার মৃত্যুর পর থেকে বিকেলের দিকটায় এভাবেই কাঁদে সুমি।

এসময়কার বিকেলের আকাশ কী রকম দুখজাগানিয়া। ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে বুকের ভেতর উথলে উঠে প্রিয়জন হারানো হাহাকার।

মৃত্যুর পর কোথায় চলে যায় মানুষ!

ওই আকাশে!

সুমি যখন কঁদছে অমি তখন তার রুমে। অমির হতদরিদ্র রুমে একটাই চোখে পড়ার মতো জিনিস। কম্পিউটার। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে অমি সেই কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। মনজুড়ে অমিরও চলছে বাবার জন্য হাহাকার। নিজের অজান্তেই যেন কম্পিউটার স্ক্রিনে অমি এক সময় লিখল, বাবা, এভাবে কেন মরে গেলে!

তারপর সেই লেখার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল অমি।

যে মানুষটার জন্য এভাবে কাঁদছে দুজন মানুষ, এ বাড়ির ড্রয়িংরুমে তাঁর একটি বাঁধানো ছবি আছে। টেন টুয়েলভ সাইজের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ছবি। ছবিটি একাত্তর সালের। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন করে, ঢাকায় ফিরে লক্ষ্মীবাজারের কালাম স্টুডিওতে গিয়ে তুলেছিলেন ছবিটা। তখনও অস্ত্র জমা দেননি মুক্তিযোদ্ধারা। কাঁধে ছিল তাঁর স্টেনগান।

বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার মাথায় তখন লম্বা চুল, মুখময় দাড়ি গোঁফ। গোলা বারুদের ঝাঁজে টকটকে লাল চোখ কারও কারও, যুদ্ধের ক্লান্তি শরীরময়। তারপরও অসম্ভব উজ্জ্বল মুখ একেকজনের। এই ঔজ্জ্বল্য যুদ্ধ জয়ের। স্বাধীনতার।

মাসুদ সাহেবের মুখেও আছে সেই প্রখর ঔজ্জ্বল্য। স্বাধীনতার পর ঊনত্রিশ বছর কেটে গেছে, সেই ঔজ্জ্বল্য একটুও ম্লান হয়নি। ছবির দিকে তাকালে এখনও সেদিনকার মানুষটিকে পরিষ্কার দেখা যায়। ছবিতে আছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি আর কোথাও নেই।

আজ বিকেলে স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটাই মনে হলো পারুর। ছবিতেই আছেন মাসুদ সাহেব, স্মৃতিতে আছেন, বাস্তবে কোথাও নেই।

একথা ভেবে ছেলে এবং মেয়ের মতো পারুও কেঁদে ফেললেন। অদূরের ভাঙা সোফায় যে সেলিম বসে আছে সে কথা মনেই হলো না তার।

কিন্তু পারুকে চোখ মুছতে দেখে উঠে দাঁড়াল সেলিম। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।

সেলিমের স্বভাব হচ্ছে কথা শুরুর আগে মৃদু একটা গলা খাকারি দেয়া।

এখনও দিল। দিয়ে বলল, আপনিও যদি এভাবে কান্নাকাটি করেন তাহলে সুমি অমিকে সামলাবে কে? এভাবে ভেঙে পড়া ঠিক হচ্ছে না।

সেলিমের কথাটা যেন শুনতেই পেলেন না পারু। তবে পাশে সেলিমকে দেখে আঁচলে চোখ মুছলেন। ধরা গলায় বললেন, এই ছবিটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ছবিটার দিকে কখনও কখনও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বলতেন, আমার জীবনের সবচে বড় অহংকার, আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।

সেলিম বিনীত গলায় বলল, এসব কথা এখন থাক।

এবারও তার কথা যেন শুনতে পেলেন না পারু। আগের মতো করেই বললেন, সারাটা জীবন তাকে যুদ্ধ করেই যেতে হলো। আজকালকার দিনে এত সৎ মানুষ হয় না। স্বাধীনতার পর ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। লাইসেন্স, পারমিট, পাকিস্তানিদের বাড়ি দখল, দোকান, জমি দখল। লক্ষ লক্ষ টাকা কামাবার সুযোগ সে সময় পেয়েছেন। কোনও সুযোগ কখনও নেননি। নিলে আমাদের চেহারা আজ অন্যরকম থাকত। এত নিঃস্ব অবস্থায় আমাদেরকে ফেলে, প্রায় বিনা চিকিৎসায় …।

কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ভেঙে এল পারুর। শব্দ করে কেঁদে ফেললেন তিনি।

পারুর এই অবস্থা দেখে সেলিম একটু দিশেহারা হলো। মৃদু গলা খাকারি দিয়ে বলল, এখন এসব ভেবে আপনি যদি এমন করেন, মানে আপনাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার নেই, তারপরও বলি, আপনি শান্ত না হলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।

পারু চোখ মুছতে মুছতে বললেন, শান্ত আমি কেমন করে হই বাবা? আমার অবস্থাটা তুমি একটু ভাব! অন্য সমস্যাগুলো না হয় বাদ দিলাম, তোমার সঙ্গে যে সুমির এনগেজম্যান্ট হয়ে আছে, বিয়ের ডেট হয়ে আছে, এই অবস্থায় মেয়েটিকে আমি বিয়ে দেব কেমন করে!

এই চিন্তাটা আরও কয়েকদিন পরে করুন। মানে আমি বলছিলাম যে সময় তো আছে।

কী এমন সময় আছে? দুআড়াই মাস। চোখের পলকে কেটে যাবে। সুমির বাবা বেঁচে থাকলে কোনও না কোনও ভাবে গরিবী হালে ব্যবস্থা একটা হতোই। তিনি যা পারতেন আমি তো তা পারব না। থাকার মধ্যে এইটুকু একটা বাড়ি। দুপয়সা সাহায্য করার কেউ নেই। তারপরও তুমি আমাকে বল আমি কিছু ভাবব না?

সেলিম মাথা নীচু করল। অবস্থাটা আমি বুঝি। তারপরও আপনাকে এইসব সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আমারই বা কী করার আছে! পড়াশুনো শেষ করে বছর দুয়েক হলো ব্যাংকের এই চাকরিটায় ঢুকেছি। আমরাও মধ্যবিত্ত। ফ্যামিলির অবস্থা তেমন ভাল না।

সেলিমের কথায় পারু একটু লজ্জা পেলেন। না না, তোমাকে আমি কিছু করার কথা বলছি না। আমার মেয়ের সৌভাগ্য যে তোমার মতো ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে। আজকালকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায় না। তোমার মতো শিক্ষিত, এম বিএ করা ছেলে, ব্যাংকে অত ভাল চাকরি কর, তোমার মতো ছেলেরা বিয়ে করার জন্য বড়লোকের মেয়ে খোঁজে। বড়লোকরাও মেয়ের জন্য তোমার মতো পাত্র খোঁজে। সেখানে তুমি আমাদের মতো একটা ফ্যামিলিতে …….।

কথা শেষ করলেন না পারু।

সেলিম বলল, টাকা পয়সা এবং সামাজিক প্রতিপত্তির মোহ সবার থাকে না। প্রথম কথা হলো আপনাদের সবাইকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। বিষয়টিকে আমি খুব সম্মানের মনে করেছি।

এই বাড়ির কাজের বুয়ার নাম শিরিন। বহুদিন ধরে আছে। ফলে বাড়িতে কে এলে চা বিসকুট দিতে হবে, কী করতে হবে, সব তার জানা। বলতে হয় না কিছুই।

মাত্র কদিন আগে বাড়ির কর্তা মারা গেছেন। এই অবস্থায় বাড়িতে কাউকে আপ্যায়নের কোনও ব্যাপার নেই। তারপরও সেলিম এসেছে দেখে সেলিমের জন্য চা করেছে সে, যত্ন করে চা বিসকুট এবং একগ্লাস পানি নিয়ে এসেছে ড্রয়িংরুমে। এসে দেখে সেলিম এবং পারু খুবই মন খারাপ করা ভঙ্গিতে কথা বলছে। দেখে আর দাঁড়ায়নি। ট্রেটা ভাঙাচোরা সেন্টার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চলে গেছে।

দুজন মানুষের কেউ শিরিনকে দেখতে পায়নি।

এই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শিরিন ভেবেছে কাজটা সে ঠিকই করেছে। দুদিন পর বাড়ির জামাই হবে যে, এনগেজম্যান্ট হয়েছে, অর্ধেক জামাই তো সে হয়েই আছে, বাড়ির অবস্থা যাই হোক চা বিসকুট তাকে দিয়ে পারা যাবে না। সেই গানের মতো। ঠাকুর জামাই এল বাড়িতে।

সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাই যেন চায়ের ট্রেটা চোখে পড়ল পারুর। ব্যস্ত হলেন তিনি। চা খাও বাবা, চা খাও। আহা কোন ফাঁকে দিয়ে গেছে শিরিন, বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দাঁড়াও, শিরিনকে ডাকি। গরম করে দিতে বলি।

সেলিম অমায়িক গলায় বলল, দরকার নেই। আপনি ব্যস্ত হবেন না। চা এখন আমি খাব না। আমি বরং সুমির সঙ্গে একটু দেখা করি।

হ্যাঁ, যাও বাবা, যাও। ওকে একটু সান্ত্বনা দাও। দিনরাত কান্নাকাটি করছে।

সেলিম তারপর সুমির রুমের দিকে চলে গেল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তখনও কাঁদছে সুমি।

সেলিম এই রুমের দরজায় টুকটুক করে নক করল। চমকে দরজার দিকে তাকাল সুমি। তারপর চোখ মুছল।

সেলিম বলল, আসব?

সুমি আবার চোখ মুছল। তারপর মাথা নাড়ল।

সেলিম ভেতরে ঢুকল। যথারীতি গলা খাকারি দিয়ে বলল, দশ বারো দিন পার হয়ে গেছে তারপরও চোখের পানি ফুরাচ্ছে না তোমার?

সুমি ভেজা গলায় বলল, বাবার জন্য চোখের পানি আমার কোনও দিনও ফুরাবে না।

কিন্তু মৃত্যু এমন এক অমোঘ নিয়তি, মানুষের সাধ্য নেই মৃত্যুকে এড়িয়ে থাকার। কখনও না কখনও মৃত্যু আসবেই।

এসব বইয়ের কথা। সবাই জানে।

তারপরও এসব কথাই সারাজীবন ধরে বলতে হয়। মানুষকে সান্ত্বনা দেয়ার নতুন কোনও ভাষা আসলে তৈরি হয়নি। পুরনো কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হয়। তাছাড়া মৃত্যুও তো একটা পুরনো বিষয়। পৃথিবীর শুরু থেকে আছে, পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত থাকবে।

কিন্তু কী এমন বয়স হয়েছিল বাবার? মানুষ তো আশি নব্বই একশো বছরও বাঁচে!

একশো তিরিশ চল্লিশ বছর বাঁচার রেকর্ডও মানুষের আছে। আবার জন্ম মুহূর্তেও মরে যায় কোনও কোনও মানুষ। মাতৃগর্ভে মরে যায়।

একটু থামল সেলিম। সুমি, তোমার মনে হতে পারে তর্ক বিতর্ক করার জন্য কথাগুলো আমি বলছি। আসলে তা নয়। আসলে অনেক কথা বলে তোমার মন আমি অন্যদিকে ঘুরাতে চাচ্ছি। তোমরা সবাই মিলে যে রকম কান্নাকাটি করছ, এভাবে চললে তোমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বে। অসুস্থ হলে বিপদ আরও বাড়বে। মন শক্ত কর, শক্ত হয়ে দাঁড়াও।

সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি চাই, সত্যি আমি চাই মন শক্ত করতে, শক্ত হয়ে দাঁড়াতে। পারি না। আমার শুধু কান্না পায়।

বলে আবার একটু কাঁদল সুমি। ওড়নায় চোখ মুছল।

সুমির দিকে তাকিয়ে সেলিম বলল, কিন্তু তুমি বড়। তোমার দায়িত্ব অনেক। মায়ের কথা না হয় ভাবলে না, একমাত্র ভাইটির কথা তো ভাববে! তোমরা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করলে ওইটুকু ছেলের মনের অবস্থা কী হয় ভাব তো! তাছাড়া চারমাস পর ছেলেটির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা!

ডানহাতখানা মায়াবি ভঙ্গিতে সুমির কাঁধে রাখল সেলিম। শক্ত হও, শক্ত হও।

এই হাতের স্পর্শে সুমির কান্না আরও গম্ভীর হলো।

.

০২.

অমির জানালায় অনেকদিনের পুরনো পর্দা।

ছেঁড়াখোঁড়া কোণা ঝুলে পড়েছে। তবুও পর্দা। পুরোপুরি না হলেও আলো কিছুটা ঠেকিয়ে রাখে। সকালবেলার রোদ, রাতেরবেলা লাইটপোস্ট থেকে আসা আলো এই পর্দার ফাঁক ফোকর দিয়ে অমির রুমে ঢোকেই।

আজ রাতেও ঢুকেছে।

সেই আলোর দিকে এখন তাকিয়ে আছে অমি। রাত গম্ভীর হয়েছে। কিন্তু চোখে ঘুম নেই তার। বাবার কথা মনে পড়ছে।

বাবার কথা মনে পড়লেই কম্পিউটারটার দিকে তাকায় অমি।

এখনও তাকাল। তারপর বিছানা থেকে নামল, নেমে লাইট জ্বালল। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল রুম। কম্পিউটারটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।

ধীর পায়ে কম্পিউটারের সামনে এসে দাঁড়াল অমি। প্রিয়জনকে আদর করার ভঙ্গিতে কম্পিউটারের গায়ে হাত বুলাতে লাগল।

ঠিক তখুনি নিজের রুম থেকে বেরিয়েছে সুমি।

রাতেরবেলা প্রায়ই পিপাসা পায় তার। এজন্য বিছানার পাশে এক বোতল পানি রাখে। আজ রাখতে ভুলে গিয়েছিল। পিপাসায় ঘুম ভাঙার

পর পানির বোতল না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং স্পেসে এসেছে। সে। ফ্রিজ খুলে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়েছে। তারপরই দেখতে পেয়েছে অমির রুমের দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। সেই দরজা দিয়ে আলো আসছে।

সুমি খুব অবাক হলো।

এত রাতে অমির রুমে আলো জ্বলছে কেন? দরজাই বা খোলা কেন? নিজের রুমে না ঢুকে নিঃশব্দে অমির রুমের দরজা ঠেলল সুমি। ভেতরে ঢুকল। কিন্তু আমি তা টেরই পেল না। আগের ভঙ্গিতে কম্পিউটারের গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

সুমি এসে অমির পাশে দাঁড়াল। তুই এখনও ঘুমোসনি?

অমি চমকাল। ও, আপা! না ঘুমোইনি। শুয়েছিলাম কিন্তু ঘুম আসেনি।

উঠে বাইরে গিয়েছিলি?

না।

তাহলে দরজা খোলা ছিল কেন? একথা শুনে মুখটা করুণ হয়ে গেল অমির। বন্ধ করতে মনে ছিল না।

সুমি আঁতকে উঠল। সর্বনাশ! আমাদের যে রকম বাড়ি, যে কোনও দিক দিয়ে চোর ঢুকে যাবে। এমনিতেই এত বড় বিপদ আমাদের, তার ওপর আরও বিপদ ঘটে যাবে। যদি কম্পিউটার চুরি হয়ে যায়?

আর এমন হবে না।

হ্যাঁ কিছুতেই যেন এমন না হয়। কোনও কোনও ফ্যামিলিতে মা বাবা ভাইবোন কেউ মারা যাওয়ার পর একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে। বাদলভাইদের ঘটনাটা জানিস না?

না, কী হয়েছিল?

বাদলভাইর মা যেদিন মারা গেলেন সে রাতে শটসার্কিট হয়ে বাদলভাইর ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার পুড়ে গেল না?

তাই নাকি? আমি শুনিনি তো!

হ্যাঁ, বাদলভাইর ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার পুড়ে গেছে তো। আবার সব ফার্নিচার নতুন করে বানিয়ে তবে ফ্ল্যাটে উঠেছেন তারা।

যে রাতে শটসার্কিট হয় সে রাতে বাদলভাইরা কোথায় ছিলেন?

ফ্লা্যাটেই ছিলেন। ধোয়া এবং আগুনে যখন সবদিক ভরে গেছে তখন কোনও রকমে বাচ্চাকাচ্চা এবং ভাবীকে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরুতে পেরেছিলেন।

ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙেছিল। ওমা, ওরকম ধোঁয়া আর আগুনে কারও ঘুম না ভেঙে পারে!

তারপর হঠাৎ করে বাদলভাইদের কুকুরটার কথা মনে পড়ল অমির। কবে যেন শুনেছিল ছোট্ট সুন্দর একটা কুকুর আছে বাদলভাইয়ের। বিদেশি কুকুর, ছবির মতো দেখতে। কুকুরটা নাকি খুবই প্রিয় তাদের।

সেই কুকুরটার কথা সুমিকে জিজ্ঞেস করল অমি। আপা, বাদলভাইদের কুকুরটা তখন কোথায় ছিল? কুকুরটার কোনও ক্ষতি হয়নি তো?

সুমি বলল, না। কুকুরটাকে চট করে কোলে নিয়েছিল বাদলভাইর ছোটমেয়ে অর্চি। কুকুর কোলে নিয়েই বেরিয়েছিল।

শুনে কী রকম একটা হাঁপ ছাড়ল অমি।

সুমি বলল, বাদলভাইরা বড়লোক মানুষ, ফ্ল্যাটের সবকিছু পুড়ে গেছে, তিন চারলাখ টাকার নাকি ক্ষতি হয়েছে, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমরা তো অতি গরিব এবং অসহায়, তার ওপর বাবা নেই, আমাদের সংসারে এখন যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সবাই মিলে মারা পড়ব।

তারপরই সুমি খেয়াল করল অমি কম্পিউটার অন করেনি।

তাহলে কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে সে কী করছিল!

প্রশ্নটা অমিকে করল সুমি। তুই তো কম্পিউটার অন করিসনি। কী করছিলি?

অমি মাথা নীচু করে বলল, কিছু না।

মানে?

কম্পিউটারে হাত বুলাচ্ছিলাম।

কেন?

মনে হচ্ছিল বাবাকে ছুঁয়ে দিচ্ছি।

গলাটা কেমন ধরা ধরা অমির, বোধহয় চোখও ছলছল করছে। কিন্তু মাথা নীচু করে রেখেছে বলে ভাইর চোখ দেখতে পেল না সুমি।

অমি বলল, তোর মনে আছে আপা, আমার কম্পিউটারের শখ দেখে বাবা কোথা থেকে টাকা পয়সা ধার করে কম্পিউটার কিনে আনল! তখন কম্পিউটারের দামও বেশি ছিল।

ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে কখন জলে ভরে গেছে সুমির চোখ। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছল সে। আমরা দুজন ছিলাম বাবার জান। কোনও কিছু চাইলে যেমন করে হোক বাবা তা এনে দিতেন। যত কষ্ট হতো, এনে দিতেন। এটা বোঝার পর কোনও কিছুর শখ হলেও বাবাকে আমি তা বলতাম না।

একথা শুনে অমি আরও কাতর হলো। আমার তাহলে কম্পিউটারের শখ হওয়া ঠিক হয়নি আপা। কম্পিউটারের জন্য বাবাকে নিশ্চয় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

খুবই মায়াবি হাতে অমির কাঁধের কাছটা ধরল সুমি। এসব ভেবে মন খারাপ করিস না। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়।

বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে সুমি, অমি ডাকল। আপা।

সুমি ঘুরে দাঁড়াল। কী?

বাবা এভাবে কেন মরে গেল?

শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল সুমির। প্রায় ছুটে এসে অমির মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরল সে। ভাইবোন দুজনে মিলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

গভীর রাতের নির্জনতা ছাড়া এই কান্না কেউ টের পেল না।

.

০২.

কিছু বাজার যে করতে হয় আম্মা?

নিজের বিছানায় অসহায় মুখে বসে আছেন পারু। শিরিনের কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকালেন।

শিরিন বলল, ঘরে কিছু নাই। ফ্রিজ খালি।

পারু আনমনা গলায় বললেন, ডিম রান্না করো।

শিরিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ডিমই বা পামু কই?

পারু চমকালেন। ডিমও নেই?

না। একটাও নাই।

তাহলে কয়েকটা ডিম নিয়ে এসো।

ডিমের কাম কী, টেকা দেন, বাজারই কইরা নিয়াসি। বাজার আমি চিনি। করতে পারুম।

নিজের বালিসের তলায় খুচরো খাচরা টাকা রাখার স্বভাব আছে। পারুর। শিরিনের কথা শুনে বালিস তুললেন তিনি। না, টাকা পয়সা তেমন নেই। একটা মাত্র বিশ টাকার নোট পড়ে আছে। সেই নোটটাই শিরিনের হাতে দিলেন তিনি। ডিমই নিয়ে এসো।

টাকা হাতে নিয়ে পারু বলল, আইচ্ছা।

তারপর দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। একটা কথা কইতে চাইছিলাম আম্মা।

বল।

কইতে একটু শরমও করে, আবার না কইয়াও পারি না। মরা বাড়িতে এই হগল কথা কওন ঠিক না।

পারু বুঝে গেলেন শিরিন কী বলতে চাইছে। বললেন, তোমার বেতনের কথা?

জ্বে। এই তো আপনে বুইজা গেছেন। তিনমাস ধইরা দেন না। পোলাডা গেরামে থাকে আমার মার কাছে। ইসকুলে পড়ে। তিনমাস ধইরা তার কোনও খরচা দিতে পারি নাই।

পারু কাতর গলায় বললেন, আমি সব জানি। আর কয়েকটা দিন দেরি কর।

শিরিন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। জ্বে আইচ্ছা, হেইডা করুমনে। আপনের অসুবিদাঁড়া আমি বুজি আম্মা। সাহেব আঁথকা মইরা গেলেন, অসুবিদা তো একটু হইবই। আপনেগ তো আর কোনও রুজি রোজগারের মানুষ নাই। তয় টেকার লগে কয়েকটা দিনের ছুট্টিও আমারে দিয়েন। পোলাডারে একটু দেইখা আসুমনে।

শিরিন আর দাঁড়াল না।

শিরিন চলে যাওয়ার পর খানিক কী ভাবল পারু তারপর সুমির রুমে এসে ঢুকল।

জানালার কাছে পুরনো বেতের চেয়ার নিয়ে বসে আছে সুমি। কোলের ওপর মলাট ঝুলে পড়া, খুবই জীর্ণ একটা অ্যালবাম। সেই অ্যালবাম ঘেঁটে বাবার সঙ্গে তার এবং অমির ছবি দেখছে। মার সঙ্গে বাবার ছবি দেখছে।

খুব বেশি ছবি নেই তাদের। তবু যা দুচারটা আছে সেইসব ছবি ঘিরে কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি।

কোনও কোনও ছবি দেখে চোখ ছলছল করছিল সুমির।

পারু এসব খেয়াল করলেন না। অসহায় গলায় বললেন, কী করি এখন বল তো?

সুমি চোখ তুলে তাকাল। কী হয়েছে?

ঘরে টাকা পয়সা কিছু নেই। বাজার করার টাকাটা পর্যন্ত নেই।

সুমি উঠে দাঁড়াল। অ্যালবামটা বিছানার ওপর রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবার মৃত্যুর দিনই বুঝেছিলাম, দশ পনের দিন পরই এই অবস্থা হবে আমাদের। যেখানে যা কিছু ছিল নার্সিংহোমেই তো গেছে।

তারপরও প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই …..।

পারুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, এরচে’ বেশি কিছু আমাদের করার ছিল না মা। সিভিয়ার হার্টএ্যাটাক।

তবু টাকা পয়সা থাকলে, বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে ….।

এবারও তার কথা শেষ করতে দিল না সুমি। বলল, এসব এখন আর ভেব না। এখন ভাব অন্য সমস্যার কথা।

ভেবে কী করব বল! পাশে দাঁড়াবার মতো একজন মানুষ নেই, যে কিছুটা সাহায্য করবে, পরামর্শ দেবে।

সুমি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যি কী দুর্ভাগা আমরা। একজুন মাত্র মাঝারি ধরনের বড়লোক আত্মীয় আছে, বাদলভাই, পুরো ফ্যামিলি নিয়ে তিনি ইমিগ্রান্ট হয়ে গেছেন কানাডায়। আর যা দুচারজন আত্মীয় স্বজন আছে তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ। তোমার। দিককারও, বাবার দিককারও। ওরা আমাদেরকে কী সাহায্য করবে, চিরকাল বাবার কাছেই সাহায্যের জন্য আসা যাওয়া করেছে।

এসব কথা ভাল লাগছিল না পারুর।

অধৈর্যের গলায় তিনি বললেন, কিন্তু এখন কী করব? বুয়ার তিনমাসের বেতন বাকি, মাসের প্রথম দিক এখন, কত রকমের বিল দিতে হবে। টেলিফোন বিল, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস, পানি। মাসের বাজার। সুমি, এইসব টেনশানে তোর বাবার কথাও আমি ভাবতে পারছি না।

মার অস্থিরতা দেখে তার একটা হাত ধরল সুমি। তুমি এত নার্ভাস হয়ো না মা। ব্যবস্থা কিছু না কিছু একটা হবেই।

কী ব্যবস্থা হবে? আমি তো কোনও পথ দেখছি না।

তারপর হঠাৎ করেই যেন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল তার। টেলিফোনটা বিক্রি করে দিই?

সুমি অবাক হলো। মানে?

তোর বাবার অসুখের সময় পাশের বাড়ির মিতুর মা আমাকে বলেছিল, টাকা পয়সার খুব দরকার হলে আমাদের টেলিফোনটা তারা কিনতে পারে। আমাদের ফোনটা পেলে ওদের সুবিধা হলো ট্রান্সফার করার টাকা বেঁচে যায়।

সুমি চিন্তিত হলো। কিন্তু বাড়িতে একটা ফোন থাকবে না?

ফোন দিয়ে এখন আর আমরা কী করব বল? কাকে ফোন করব, কে আমাদেরকে ফোন করবে?

বাবা অনেক কষ্ট করে ফোনটা এনেছিল। বাবার নামে ফোন।

তাতো আমি জানিই। উপায় না দেখেই ভাবছি। নয়তো ঘরের জিনিস কে বিক্রি করতে চায়, বল?

দুচারটা দিন যাক। আর একটু ভেবে …..।

সুমির কথা শেষ হওয়ার আগে মা ভেঙেপড়া গলায় বললেন, এই দুচারদিই বা চলবো কী করে? সামান্য গয়নাগাটি যা ছিল আমার, সব তো আগেই গেছে। তোদের নিয়ে এখন আমার না খেয়ে মরতে হবে।

পারু ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

তারপর চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।

মা বেরিয়ে যাওয়ার পর উদাস হয়ে খানিক কী ভাবল সুমি, তারপর গলার চেনটা আলতো করে ধরল।

.

০৪.

টেলিফোন বিলগুলো খুবই যত্নে একটি ক্লিপ ফাঁইলে রেখে দিয়েছেন মাসুদ সাহেব। যখনই বিল আসতো, বিল পরিশোধ করার পর কাউন্টার পার্ট রেখে দিতেন ফাঁইলে। সেই ফাঁইলটা নিয়ে আজ দুপুরের পর বসেছেন পারু। একটা একটা করে বিল চেক করছেন, কোনও মাসের বিল বাকি পড়েছে কিনা দেখছেন।

টেলিফোনটা বিক্রি করতে হলে বিল ক্লিয়ার থাকতে হবে।

এসময় বিষণ্ণমুখে অমি এসে ঢুকল এই রুমে। ফোনটা সত্যি বিক্রি করে ফেলবে মা?

মুহূর্তের জন্য ছেলের দিকে তাকালেন পারু। এছাড়া কী করব, বল?

তারচে’ না হয় আমার কম্পিউটারটা …..। মানে কম্পিউটার তো আমাদের তেমন দরকার নেই। কম্পিউটারের চেয়ে টেলিফোন বেশি। দরকারি।

ফাঁইল রেখে উঠে দাঁড়ালেন পারু। তোর অত শখের জিনিস। কত কষ্ট করে তোর বাবা কিনে দিয়েছিলেন! তাছাড়া পুরনো কম্পিউটার সেভাবে বিক্রিও করা যায় না। আর ফোনের ব্যাপারটা হলো, তোর বাবাই যখন নেই, ফোন দিয়ে আমরা আর কী করব?

অমি আমতা গলায় বলল, আর একটা কথা বলব?

বল।

তুমি রাগ করবে না তো?

না।

কম্পিউটার টাইপিংটা আমি খুব ভাল শিখেছি। বেশ ভাল স্পিড আমার। ইচ্ছে করলে যে কোনও জায়গায় কাজ পাব আমি। কোনও পত্রিকা অফিসে, কিংবা কোনও প্রেসে।

কিন্তু মাস চারেক পর তোর পরীক্ষা।

পার্টটাইম কাজ নেব। ওই কাজ করেও পরীক্ষা দেয়া যাবে। কোনও অসুবিধা হবে না। দেড় দুহাজার টাকা আমি রোজগার করতে পারব।

অমির কথা শুনতে শুনতে জলে চোখ ভরে এলো পারু। দুহাতে ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন তিনি। মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ভাঙাচোরা গলায় বললেন, কী কপাল আমার! এইটুকু ছেলেকে রোজগারের কথা ভাবতে হচ্ছে। না না, তুই এসব ভাবিস না বাবা। তুই এসব ভাবিস না। তুই মন দিয়ে পড়াশুনো কর। পরীক্ষা দে। আমি তো বেঁচে আছি। যা করার আমি করব।

মায়ের বুকে অমি তখন নিঃশব্দে কাঁদছে।

বাইরে থেকে ফিরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল সুমি, মায়ের রুমের দিকে চোখ পড়তেই এই দৃশ্যটা দেখতে পেল। নিজের রুমে আর গেল না সে। মায়ের রুমে এসে ঢুকল। কী হয়েছে?

পারু বললেন, কিছু না।

তারপর বুক থেকে আলগা করলেন অমিকে। যা, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস গিয়ে, যা।

অমি কোনওদিকে তাকাল না। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।

এবার সুমির দিকে তাকালেন পারু। তুই হঠাৎ কোথায় চলে গেলি? আমাকে কিছু বলেও গেলি না।

সুমি কেমন চটপটে হয়ে গেল। আমার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম।

কেন?

ওই যে তুমি বললে ঘরে কোনও টাকা পয়সা নেই।

পারু অবাক হলেন। ধার আনতে গেলি?

সুমি আগের মতোই চটপটে গলায় বলল, না মানে ও আমাকে ফোন করল তো, কথায় কথায় বললাম, তোর কাছে কিছু টাকা হবে?

বান্ধবীর নাম কী?

ওকে তুমি চিনবে না। আমাদের বাড়িতে কখনও আসেনি।

পারু গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কী?

টিংকু, টিংকু। কথায় কথায় বললাম তোর কাছে হাজার পাঁচেক টাকা হলে আমাকে দে। পাঁচ হাজার হয়নি। সাড়ে চার হাজার হয়েছে। তাই দিয়ে দিল।

হাতের ব্যাগ খুলে টাকাটা বের করল সুমি। পারুর হাতে দিল। বুয়ার বেতনটা দিয়ে দাও, আর বাজার টাজার….।

টাকা হাতে নিয়ে পারু বললেন, ফেরত দিতে হবে কবে?

যখন ইচ্ছে দিলেই হবে। কোনও তাড়া নেই।

টাকা হাতে আলমারির দিকে মুখ ফিরিয়েছেন পারু, হঠাৎ যেন তার মনে হলো সুমির গলাটা ফাঁকা ফাঁকা। চেনটা নেই। সঙ্গে সঙ্গে সুমির গলার দিকে তাকালেন তিনি।

সত্যি তো! চেনটা তো নেই।

বললেন, তোর চেন কোথায়?

সুমি একটু চমকাল। গলার কাছটায় হাত দিল। আছে।

পরে যাসনি?

না। মানে খুলে রেখে গেছি।

কেন?

যা ছিনতাই টিনতাই হয় রাস্তায়!

পারু গম্ভীর হলেন। কোথায় রেখেছিস চেন? যা নিয়ে আয়।

কেন?

আমি দেখব।

তুমি হঠাৎ আমার চেন নিয়ে পড়লে কেন? আছে আমার রুমে। পরে দেখাব তোমাকে।

পারুর মুখটা করুণ হলো। কেন অযথা মিথ্যে বলছিস?

মিথ্যে বলছি মানে?

যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।

সুমি জোর গলায় বলল, কী বুঝে গেছ তুমি? কী?

চেন বিক্রি করে এই টাকাটা তুই এনেছিস।

সঙ্গে সঙ্গে উদাস হয়ে গেল সুমি। হ্যাঁ, এছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই করার ছিল না মা।

পারুর চোখ আবার জলে ভরে এলো।

মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর কাঁধে হাত দিল সুমি। সুমি এত মন খারাপ করছ কেন? টাকা হলে চেন আবার কিনে নেয়া যাবে। প্রয়োজনে এই সমস্ত জিনিস সবাই বিক্রি করে।

পারু চোখ মুছে বললেন, এরপর কী বিক্রি করবি?

মায়ের কাঁধ থেতে হাত নামিয়ে সুমি চঞ্চল গলায় বলল, এখন ওসব ভেবে লাভ নেই। আমার খুব খিদে পেয়েছি। বুয়াকে বল খাবার রেডি করতে।

সুমি নিজের রুমের দিকে চলে গেল।

.

০৫.

আজ সকালে শিরিন নিজে বাজার করেছে।

শাক সবজি মাছ মশলা, মনখানেক চাল, মাসখানেক চলার মতো আটা অর্থাৎ যা যা লাগে সংসারে। এখন ব্যস্ত হাতে সেসব গুছিয়ে গুছিয়ে রাখছে। কোনওদিকে খেয়াল নেই তার। পারু এসে যে দরজার সামনে দাঁড়ালেন, তাঁর ডানহাতে যে মুঠো করে ধরা কিছু টাকা, শিরিন তা খেয়ালই করল না।

কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে শিরিনকে খানিক দেখলেন পারু, তারপর ডাকলেন, বুয়া।

চমকে দরজার দিকে তাকাল শিরিন।

মুঠো আলগা করে টাকাটা শিরিনের দিকে এগিয়ে দিলেন পারু। তোমার তিনমাসের বেতন।

টাকার দিকে ফিরেও তাকাল না শিরিন। ব্যস্ত হাতে কাজ করতে করতে বলল, এখন তো কাম করতাছি। রাখেন আপনের কাছে। পরে নিমুনে।

পারু বললেন, কাজ এখন রাখ।

ক্যান?

কথা শোন। কথা আছে।

শিরিন কাজ থামাল। বলেন।

পারু আবার টাকা এগিয়ে দিলেন। এটা রাখ।

আঁচলে হাত মুছে টাকাটা নিল শিরিন, আঁচলেই গিঁট দিয়ে রাখল। রাখতে রাখতে বলল, আইচ্ছা নিলাম। এইবার কন, কী কথা?

এ মাসের তো আর কয়েকটা দিন বাকি আছে, এখন থেকে তুমি কাজ খুঁজতে শুরু কর।

শিরিন চমকাল। জ্বে?

হ্যাঁ, যাতে পহেলা তারিখ থেকে লেগে যেতে পার।

এবার যেন কথাটা পুরো বুঝল শিরিন। বিব্রত গলায় বলল, ক্যান, আপনে কি আমারে ছাড়ায়ে দিলেন নাকি? আমি কি কাম খারাপ করি, আ আমার কোনও বদস্বভাব আছে?

আরে না। কাজ খুবই ভাল কর তুমি। তুমি মানুষও ভাল। তোমার মতো লোক আমি কোথায় পাব। এতদিন ধরে আছ, এত বিশ্বস্ত।

তাইলে আমার অসুবিদা কি?

অসুবিধা তোমার না, আমাদের। তুমি তো সবই জানো। বাড়িতে কাজেরা বুয়া রাখা এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব না। মাসে তিনশো টাকা বেতন আমি কোত্থেকে দেব?

শিরিন নির্বিকার গলায় বলল, না দিতে পারলে দিবেন না।

পারু অবাক। তোমার তাহলে চলবে কী করে?

আল্লায় চালায় নিব। এই নয়শো টাকা মার কাছে পাড়াইয়া দিয়া কমু, আর দিতে পারুম না। যেমনে পার আমার পোলারে মানুষ কর, না পারলে এতিমখানায় দিয়া দেও।

শিরিনের কথা শুনে পারুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কেন আমাদের জন্য নিজের এত ক্ষতি তুমি করবে?

কিয়ের ক্ষতি? না আমার কোনও ক্ষতি হইতাছেনা তো! আপনেগো আমার ভাল লাগে এর লেইগা আমি এই বাড়ি ছাইড়া যাইতে চাই না। মানুষের ভাল লাগার একটা দাম আছে না!

কিসের ভাললাগা? আমাদের বাড়ি ভাল লাগার কি কোনও কারণ। আছে? বাড়ির খাওয়া ধাওয়া ভাল না, একদিন বাজার হবে একদিন হবে না! এরকম বাড়িতে তুমি কেন থাকবে, বল?

পারুর কাছে সামান্য এগিয়ে এসে শিরিন বলল, সাফ কথা শোনেন আম্মা। আপনেরা খাইলে আমি খামু, আপনেরা না খাইলে আমি খামু না। আর আপনে এত ভাইঙ্গা পড়ছেন ক্যান? বিপদে পড়া ভাল মানুষের জন্য আল্লাহপাকের দরবার থিকা ফেরেশতা নাইমা আসে। আইসা বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ায়। আপনেগ পাশেও দাঁড়াইবো। ডরায়েন না। ভাল মানুষের লেইগা আল্লাহ আছে।

শিরিন যে মুহূর্তে এসব কথা বলছে ঠিক তখুনি ঢাকার জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে নামল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমান।

.

০৬.

নিজের রুম থেকে বেরিয়েই মার মুখোমুখি পড়ে গেল অমি।

কিচেন থেকে বেরিয়েছেন পারু। অমিকে দেখে দাঁড়ালেন। কোথায় যাচ্ছিস?

বাইরে।

বাইরে কোথায়?

অমি একপলক মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নীচু করল। তেমন কোথাও না।

পারু অবাক হলেন। মানে?

আবার চোখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাল অমি। মা, বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন, কখনও যেন কারও সঙ্গে মিথ্যে কথা না বলি। মিথ্যে বলার অবস্থা হলে কথাটা আমি এড়িয়ে যাই।

এড়াবার দরকার নেই। সত্য কথা বল।

কম্পিউটারের কাজ নিতে চাইলাম, তুমি রাজি হলে না। এজন্য আমি টিউশনি খুঁজছি। দুটো টিউশনি পেলে বারো থেকে পনেরোশো টাকা। দু জায়গায় দুঘণ্টা পড়াব। ভালমতো খুঁজলে টিউশনি আমি পেয়ে যাব। নিজের পড়াশুনোরও কোনও অসুবিধা হবে না। আজকাল অনেকেই টিউশনি করে।

পারু নির্বিকার গলায় বললেন, তুইও করিস। তবে পরীক্ষার পর।

এখন অসুবিধা কী?

এখন টিউশনি করলে পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। এখন যে কয়েকটা মাস আছে ঘরে বসে ভাল মতো পড়াশুনো কর যাতে রেজাল্ট খুব ভাল হয়।

অমি চুপ করে রইল।

পারু বললেন, যা ঘরে যা।

আবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল অমি। কিন্তু মা, সংসারের এই অবস্থা …..।

অমির কথা শেষ হওয়ার আগেই পারু বললেন, ওসব তোকে ভাবতে হবে না। ভাবব আমি।

অমি আর কথা বলল না। নিজের রুমে গিয়ে ঢুকল।

তারপরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন পারু। একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ল তাঁর।

ঠিক এরকম একটি দীর্ঘশ্বাস মনজুরও পড়ল।

খানিক আগে ইমিগ্রেশান ইত্যাদির ঝামেলা শেষ হয়েছে। হ্যাঁন্ডব্যাগ নিয়ে লাগেজ আসার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে মনজু।

লাগেজ আসতে শুরু করেছে বেশ খানিক আগে। কিন্তু মনজুরটা এখনও আসেনি।

একটি মাত্র সুটকেস তার। আর সঙ্গে একটা ব্যাগ। এই নিয়ে চলে এসেছে।

মনজুর পরনে জিন্স। পায়ে বুট। চুলগুলো বিদেশীদের ভঙ্গিতে ছাটা। মুখখানি খুব মায়াবি তার। এই মায়াবি মুখ প্লেন জার্নিতে ক্লান্ত। তবু ক্লান্তিটা মনজু টের পাচ্ছে না। বুকে তার অদ্ভুত এক উত্তেজনা।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে কোন হোটেলে যাবে মনজু?

মনজু যখন একথা ভাবছে ঠিক তখুনি তার সুটকেসটা বেরিয়ে এল। একটু এগিয়ে গিয়ে সুটকেসটা মনজু নামাল। তারপর একহাতে ব্যাগ, অন্যহাতে সুটকেস টানতে টানতে গ্রীন চ্যানেলের দিকে হাঁটতে লাগল। দীর্ঘশ্বাসটা তখনই পড়ল তার।

কেন?

মনজুর কি মনে হলো জীবনে প্রথম নিজের দেশে ফিরল সে কিন্তু কেউ তাকে রিসিভ করতে এল না!

ইমিগ্রেশান এরিয়ার বাইরে বড় বড় সব হোটেলের কাউন্টার। যে কোনও একটা কাউন্টারে গিয়ে যে কোনও হোটেলে রুম বুক করতে পারে মনজু। হোটেল কাউন্টার থেকে গাড়িও ব্যবস্থা করে দেবে।

কিন্তু মনজু তা করল না। ব্যাগ সুটকেস নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

বাইরে প্রচুর স্কুটার, ইয়েলোক্যাব। ড্রাইভাররা ডাকাডাকিও শুরু করল। এইসব গাড়ির সঙ্গে দালালও থাকে। দুচারজন দালালও লাগল মনজুর পেছনে। কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দিল না, কারও দিকে ফিরে তাকাল না। একটি ইয়েলোক্যাবের সামনে তার বয়সী, ভদ্রগোছের এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা আপনার?

জ্বী!

যাবেন?

কোথায়?

কোনও একটা হোটেলে।

কী ধরনের হোটেল? সোনারগাঁও, শেরাটন! নাকি পূবাণী?

এগুলো তো বড় হোটেল?

জী।

আমি যেতে চাইছি মাঝারি ধরনের কোনও একটা হোটেলে। আপনার চেনা তেমন কোনও হোটেল আছে?

জ্বী আছে।

কোথায়?

শান্তিনগরে।

কী নাম?

হোয়াইট হাউজ।

সুন্দর নাম।

হোটেলটাও সুন্দর।

ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধমুখে হাসল মনজু। আপনি বলছেন?

ড্রাইভারও হাসল। জ্বী স্যার।

চলুন তাহলে।

সুটকেসটা কেরিয়ারে তুলল ড্রাইভার। হ্যাঁন্ডব্যাগটা সঙ্গে রাখল মনজু। গাড়ি ছুটতে লাগল।

কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার, গাড়িতে চড়েই মনজুর খুব ইচ্ছে করল এককাপ চা খেতে। এসময় আচমকা কেন চায়ের তেষ্টা পেল তার, কে জানে!

তবে একই সঙ্গে একই ধরনের কাজ প্রায়ই ঘটে পৃথিবীতে। ইয়েলোক্যাবে বসে মনজুর যখন চায়ের তেষ্টা পাচ্ছে পারু তখন এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসেছেন।

বারান্দায় উদাস হয়ে বসে আছে সুমি। চা হাতে পারু তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নে।

সুমি খুবই অবাক হলো। হঠাৎ চা?

এ সময় মাঝে মাঝে চা খেতেন তোর বাবা। আমার হাতের চা। আজ মনে হলো ওরকম এককাপ চা আমি তোর জন্য করি।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুমি বলল, নিজের জন্য করলেও পারতে।

তারপর চায়ে চুমুক দিল। চুমুক দিয়ে বলল, মা, ভেবে দেখলাম টেলিফোনটা বিক্রি করে ফেলাই ভাল।

পারু চুপ করে রইলেন।

সুমি আবার চায়ে চুমুক দিল। হাজার তিরিশেক টাকা পেলে কয়েকটা মাস মোটামুটি চলা যাবে।

পারু গম্ভীর গলায় বললেন, টেলিফোন আমি বিক্রি করে ফেলেছি।

সুমি চমকালো। কী?

হ্যাঁ। তিরিশ হাজারই দাম।

কার কাছে বিক্রি করলে?

ওই তো পাশের বাড়ির ওদের কাছে। তোকে বলেছিলাম না।

সুমি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, টাকা দেবে কবে?

দিন দশেক পর। টাকা দিয়ে তারপর ফোন নেবে।

পারু আর দাঁড়ালেন না।

চায়ের কাপ হাতে সুমি তখন কী রকম স্তব্ধ হয়ে আছে।

.

০৭.

হোয়াইট হাউস হোটেলের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মনজু বলল, প্রথমে ক্যাব থেকে, আই মিন ইয়েলোক্যাব থেকে আমার লাগেজ আনতে বলুন।

রিসেপসনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে একজন বেয়ারাকে ডাকল। মনজুর লাগেজ আনতে বলল।

মনজু বলল, এখন রুম।

রিসেপসনিস্ট বিনীত গলায় বলল, আপনি একা, স্যার?

হ্যাঁ একা। কিন্তু রুম লাগবে ডাবল বেডের।

জ্বী?

জ্বী। তবে দুজন শোয়ার এক বিছানা নয়। সিঙ্গেল দুটো বেড। মাঝখানে স্পেস থাকতে হবে।

রিসেপসনিস্ট চোখ তুলে তাকাল।

মনজু হাসল। একা থাকব কিন্তু বিছানা দরকার দুটো।

ওকে স্যার।

আপনি কি অন্যকিছু ভাবছেন?

নো স্যার। নো।

আসলে এক বিছানায় থাকতে আমার খুব বোর লাগে। রাতের। অর্ধেকটা এক বিছানায়, বাকি অর্ধেকটা আরেক বিছানায়।

বলেই কেলানো একটা হাসি হাসল মনজু। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

রিসেপসনিস্ট হাসল। নো প্রবলেম স্যার। ওরকম রুম আমাদের আছে।

তাহলে আর দেরি কেন? দিয়ে ফেলুন একটা।

এসি রুম, না ননএসি?

অফকোর্স এসি। নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকি। গরমের সময় বেজায় গরম, আর শীতের সময় …।

রিসেপসনিস্ট যুবকটা একটু বেশি স্মার্ট। মনজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মুখের কথা যেন কেড়ে নিল। বেজায় শীত।

মনজু বলল, নো নো। ডিরেক্ট বরফ।

ও।

শুনুন, রুমটা আমার অনেকদিনের জন্য লাগবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যতদিন থাকব।

তারপর আচমকা বলল, আপনি অংক কেমন জানেন?

রিসেপসনিস্ট ভড়কে গেল। জ্বী?

আড়াইমাসে কতদিন হয় বলুন তো?

রিসেপসনিস্ট ক্যালকুলেটর বের করতে যাবে, মনজু বলল, এত কষ্টের দরকার নেই। আমিই বলছি। পঁচাত্তর দিন। সেভেনটি ফাঁইভ ডেইজ। আপনাদের হোয়াইট হাউজ আমার পছন্দ হয়েছে। আমার যা পছন্দ হয়, আমি তার শেষ পর্যন্ত দেখি।

আবার সেই কেলানো হাসি হাসল মনজু। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মনজু তারপর রুমে এল। রুমে এসে টের পেল তার খুবই ক্লান্ত লাগছে এবং খুবই খিদে পেয়েছে। ক্লান্তি কাটাবার জন্য এখন হেভি একটা গোসল দরকার। গোসলের পর সম্পূর্ণ বাঙালি ভুঁড়িভোজ। তারপর ঘুম। কাল সকালে ফ্রেস মানুষ মনজু।

তাহলে মনজুর এখন কী করা উচিত? প্রথমে গোসল নাকি খাবারের অর্ডার?

খাবারের অর্ডারই আগে দেয়া উচিত। অর্ডার দিয়ে বাথরুমে ঢুকবে। বেরিয়ে আসতে আসতে খাবারও এসে যাবে।

গুড আইডিয়া।

মনজু টেলিফোন তুলল। কে ফোন ধরল না ধরল ভাবলই না। বলল, সুটকিভর্তা হবে?

যে ফোন ধরেছিল সে একটু ভড়কে গেল। জ্বী?

এত অবাক হচ্ছেন কেন? সুটকিভর্তা লোকে খায় না? লইট্টা মাছের সুটকি, ঘইনা মাছের সুটকি, চ্যাপা শুঁটকি।

ওপাশের লোকটি বলল, আপনি স্যার কোথায় ফোন করেছেন?

মনজু একটু থমকাল। এটা কি হোয়াইট হাউজ হোটেলের কিচেন?

জ্বী।

তাহলে তো ভুল জায়গায় ফোন করিনি।

কিন্তু আমি আপনার কথা স্যার বুঝতে পারিনি। কী সব চ্যাপা ফ্যাপা বলছেন। আমি তো এই ধরনের নামই কখনও শুনিনি।

কী? নাম শোনেননি? আপনি কি ভাই আজারবাইজানে থাকেন, না বাংলাদেশে?

লোকটি গম্ভীর গলায় বলল, বাংলাদেশেই থাকি।

মনজু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আর আমার জন্য আমেরিকায়। এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি। তারপরও মিনিমাম তিন প্রকারের সুটকির নাম জানি।

এবার লোকটা যেন একটু লজ্জা পেল। জ্বী স্যার, জ্বী।

মনজু গম্ভীর গলায় বলল, এই হোটেলে সুটকি সার্ভ করে না?

না।

ও। এত লাটবেলাটের হোটেলে তো আমি তাহলে থাকব না। বাংলাদেশে এসেছি, বাঙালি খাবার যখন যা ইচ্ছে খাব। না পেলে অন্য জায়গায় চলে যাব। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

একটু থামল মনজু। রিসেপসনে ফোন করে বিল পাঠাতে বলুন আর সোনারগাঁও হোটেলে সিঙ্গেল দুটো বেডের একটা রুম বুক করতে বলুন। আপনাদের এখানে আমি থাকব না। এক্ষুনি চলে যাব।

ও পাশের লোকটি বলল, আপনি স্যার রাগ করবেন না।

জ্বী?

আইয়্যাম সরি স্যার।

হ্যাঁ, অত্যন্ত বিনীতভাবে বলুন, সরি স্যার। বলেছেন? ওকে। সুটকি এরেঞ্জ করুন।

বলে বেশ শব্দ করে ফোন নামিয়ে রাখল মনজু।

.

০৮.

রাতেরবেলা পারুর হঠাৎ মনে হলো বাড়ির দলিলপত্রগুলো একটু বের করা দরকার। কী জানি কখন কোন প্রয়োজন হয়! জরুরি কাগজপত্র হাতের কাছে রাখা ভাল।

অবশ্য সবকিছু হাতের কাছেই রেখেছেন মাসুদ সাহেব। এইসব ব্যাপারে তিনি খুবই গোছালো স্বভাবের ছিলেন। টেলিফোন বিলের আলাদা ফাঁইল, সিটি করপোরেশানের ট্যাক্সের আলাদা ফাঁইল। গ্যাস পানি ইলেকট্রিসিটি এসবের আলাদা আলাদা ফাঁইল। সুমি অমি পারু এবং নিজের জন্যও আলাদা ফাঁইল ছিল, ফাঁইলের ওপর নাম এবং বিষয় লেখা। যার যত প্রেসক্রিপশান আছে, রক্ত মল মূত্র ইত্যাদি যতবার পরীক্ষা করা হয়েছে, সে সবের প্রতিটি রিপোর্ট অত্যন্ত যত্নে ফাঁইল করা। এমন কি এই বাড়ি তৈরি করার সময় প্রতিদিন কোন খাতে কত খরচ হয়েছে, কী কী কেনা হয়েছে, ক্যাসমেমোসহ সব ফাঁইল করে রেখেছেন তিনি। বইয়ের দোকানের ব্যাপারেও ছিল একই ব্যবস্থা।

কিন্তু বাড়ির দলিল পরচার ফাঁইলটা পেলেন না পারু।

ফাইলগুলো রাখা আছে তাদের বেডরুমের একমাত্র আলমারিতে। একে একে সব ফাঁইল নামালেন পারু। একটা একটা করে ঘাঁটলেন কিন্তু দলিলের ফাঁইলটা নেই।

পারু একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন।

কোথায় গেল ফাঁইলটা?

এই আলমারি ছাড়া অন্যকোথাও থাকার কথা নয়। সাধারণত মাসুদ সাহেবই হাতাহাতি করতেন ফাঁইলপত্র। প্রয়োজনে বের করে, কাজ সেরে আবার জায়গামতো রেখে দিতেন। এসব ফাঁইল অন্যকোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তাহলে?

তারপর ঘরের ভেতর সম্ভাব্য যত জায়গা আছে খুঁজলেন পারু।

না নেই।

ফাইলটা কোথাও নেই।

পারু খুবই অস্থির হয়ে পড়লেন। আবার নামালেন ফাঁইলের স্থূপ, আবার ঘটতে লাগলেন।

এই বাড়িতে রাতের খাবার আটটার দিকে খাওয়ার নিয়ম। নিয়মটা মাসুদ সাহেব চালু করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরও নিয়মটা চালু আছে। আটটা বাজলেই টেবিলে খাবার এনে রাখে বুয়া। সুমি অমি এসে বসে। সবার শেষে আসতেন মাসুদ সাহেব এবং পারু। মাসুদ সাহেব নেই, এখন পারু আসেন সবার শেষে।

কিন্তু আজ প্রায় সোয়া আটটা বেজে গেল, তিনি আসছেন না।

সুমি অমি দুজনেই অবাক হলো।

অমি বলল, আমরা বসে আছি কিন্তু মা আসছে না! ব্যাপার কী? কী করছে?

ডালের পেয়ালা রাখতে রাখতে শিরিন বুয়া বলল, কী জানি খুঁজতাছে।

সুমি একটু চিন্তিত হলো। কী খুঁজছে?

তা জানি না।

অমি উঠে দাঁড়াল। আমি যাই, মাকে ডেকে আনি।

সুমিও উঠল। আমিও যাই, দেখি কী খুঁজছে।

বুয়া বলল, ভাত তরকারি তো ঠাণ্ডা হইব।

সুমি বলল, ঢেকে রাখ।

দুভাইবোন তারপর পারুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দুজনেই থতমত খেয়ে গেল।

খুবই বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছেন পারু, তার চারদিকে ছড়ানো ছিটানো ফাঁইলপত্র।

সুমি বলল, এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে?

পারু হতাশ গলায় বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে।

অমি বলল, মানে?

বাড়ির দলিলপত্র কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।

শুনে আঁতকে উঠল সুমি। বল কী?

হ্যাঁ।

কোথায় ছিল?

তোর বাবা নিজ হাতে সব ফাঁইল করে রেখেছিলেন। মানে একটা ফাঁইলে সব গুছানো ছিল। ফাঁইলটাই পাচ্ছি না।

অমি বলল, ভাল করে খুঁজেছ?

পারু একটু রেগে গেলেন। ভাল করে মানে? এরচে’ ভাল করে আর কী খুঁজব! কোনও জায়গা বাকি রাখিনি। তাছাড়া ফাঁইলগুলো থাকে সব এক জায়গায়। আমার আলমারিতে।

সুমি গম্ভীর গলায় বলল, লাস্ট কবে ফাঁইলটা তুমি দেখেছ?

তা বলতে পারব না। আর আমি তো কখনও ওই ফাঁইল ধরিওনি। তোর বাবা রেখেছিলেন। তবে একদিন ফাঁইল খুলে দলিলপত্র আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

অমি বলল, কবে?

অনেকদিন আগে।

সুমি বলল, তারপর ফাঁইলটা তুমি আর দেখনি?

না।

আছে কি নেই, বোঝনি?

না।

রুমে ঢুকে ধপ করে পারুর বিছানায় বসে পড়ল অমি। এখন কী হবে?

দলিলপত্র না পেলে খুব বিপদ হবে। কাগজপত্র ছাড়া বাড়ির কোনও দাম নেই।

সুমি বলল, কিন্তু দলিলপত্র হারালে সেগুলো জোগাড়েরও নিশ্চয় কোনও ব্যবস্থা আছে।

আছে।

তাহলে এত ঘাবড়াবার দরকার কী?

কিন্তু সে সব অনেক ছুটোছুটির ব্যাপার। অনেক টাকা পয়সা খরচের ব্যাপার। আমরা ওসব কেমন করে করব? কে আছে আমাদের? কে সাহায্য করবে?

একটু থামলেন পারু। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, সংসার কীভাবে চলবে তারই ঠিক নেই, তার ওপর এই বিপদ। আমার খুব অস্থির লাগছে।

সুমি এসে পারুর সামনে দাঁড়াল। এখন অস্থির হয়ে লাভ নেই। দলিলের ফাঁইল যাবে কোথায়? নিশ্চয় বাড়িতে আছে। বেশি অস্থির হয়ে খোজাখোজি করলে অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় জিনিসটা পাওয়া যায় না। চল, খেতে চল। খেয়েদেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ঘুমাবে। সকালে উঠে আবার খুঁজবে। আমি এবং অমিও তোমার সঙ্গে থাকব, দেখবে ঠিক পেয়ে যাবে।

মেয়ের কথায় ভরসা পেলেন পারু। বললেন, তুই বলছিস?

হ্যাঁ।

বলেই পারুর হাত ধরল সুমি। চল।

পারু উঠে দাঁড়ালেন।

কিন্তু পরদিন সকালেও ফাঁইলটা পাওয়া গেল না। তিনজন মানুষ তন্ন। তন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজল, এমন কি বুয়াও খুঁজল তাদের সঙ্গে।

না, ফাঁইলটি কোথাও নেই।

শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে নিজের বিছানায় বসলেন পারু। হাহাকারের গলায় বললেন, কোন বিপদ এলো আমার সংসারে? মানুষটা চলে গেল। সংসার অচল। এই অবস্থায় হারাল বাড়ির দলিল।

সুমি অমি দুজন দাঁড়িয়ে আছে পারুর দুপাশে। তাদের অবস্থাও পারুর মতোই।

তবু মেয়ের দিকে তাকালেন পারু। সুমি, আমি তো চোখে কোনও পথ দেখছি না মা! তুই বলেছিলি দলিল নিশ্চয় পাওয়া যাবে। তোর ভরসায় রাতে ঘুমাতেও পারলাম। কিন্তু …….।

পারুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না মা। আমাদের বাড়ি থেকে কখনও কিছু হারায়নি। এত ইম্পরটেন্ট জিনিস কী করে হারাবে?

আমি পাগল হয়ে যাব মা। আমার খুব অস্থির লাগছে। আমি আর পারছি না।

পারুর পাশে বসে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল সুমি। তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না। বস। তোমার সঙ্গে অন্যকিছু কথা আছে আমার।

তারপর অমির দিকে তাকাল সুমি। অমি, যা তোর রুমে যা। পড়তে বোস গিয়ে। আমি আর মা দেখছি কী করা যায়।

অমি চলে যাওয়ার পর দরজার সামনে দাঁড়ানো বুয়ার দিকে তাকাল সুমি। বুয়া, তুমিও যাও।

আইচ্ছা।

বুয়া চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুমি বলল, মা, বাড়ির দলিল বাবা অন্য কোথাও নিয়ে রেখে আসেনি তো?

কথাটা শুনে পারু যেন কেঁপে উঠলেন। অন্য কোথায় রেখে আসবে?

কোনও ব্যাংকে কিংবা কারও কাছে? মানে বাড়ির দলিল রেখে বাবা কারও কাছ থেকে টাকা পয়সা আনেনি তো?

পারু দৃঢ় গলায় বললেন, না, প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে না জানিয়ে তিনি কোনওদিন কিছু করেননি। অমন হলে অবশ্যই তিনি আমাকে বলতেন। আমি জানতাম।

কিন্তু বছরখানেক আগে বইয়ের দোকানটা যখন ছেড়ে দিলেন বাবা, বাবার কিছু লায়াবেলিটিস ছিল। কিছু ধারদেনা ছিল। তার আগে হুট করে

অমিকে কম্পিউটার কিনে দিল, তারও আগে টেলিফোন আনল!

এসবের জন্য তাকে বাড়ির দলিল রেখে টাকা আনতে হবে কেন? বইয়ের দোকানটা তো ভালই চলতো। ভালই রোজগার করতেন তিনি।

আমার মনে হয় না।

মানে?

দোকান উঠে যাওয়ার পরও প্রায়ই কোত্থেকে যেন কিছু কিছু টাকা আনতেন বাবা।

আরে ওসব তো কাজের টাকা।

কী কাজ?

মানে রোজগারের টাকা আর কী?

তখন কী রোজগার ছিল বাবার?

বাংলাবাজারের পাবলিসারদের সঙ্গে কী কী কাজ করতেন।

সেটা খুবই সামান্য কাজ। প্রুফ দেখা।

প্রুফ দেখে টাকা তো পেতেন।

অতি সামান্য টাকা। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে, বাবা টাকা আনতেন বেশ ভালই।

একটু থামল সুমি। তারপর বলল, মা, তুমি কি বাবাকে কখনও জিজ্ঞেস করেছ তার রোজগারটা কী? কোত্থেকে টাকা পয়সা পায় সে?

না।

কেন?

আমি জানতাম কোনও অসৎ কাজ তিনি কখনও করবেন না। আর পুরুষ মানুষদের রোজগার নিয়ে মহিলাদের তেমন না ভাবাই ভাল।

সুমি মাথা নাড়ল। না। কথাটা বোধহয় ঠিক না। যাই হোক, দলিল যে বাড়িতে নেই তা আমি বুঝে গেছি। কোথায় আছে, কার কাছে আছে, খুঁজে বের করতে হবে।

.

০৯.

আজকের দিনটা আমি শুধু ঢাকা শহরে ঘুরব।

মনজুর কথা শুনে হোটেল রিসেপসনিস্ট চোখ তুলে তাকালো। কালকের রিসেপসনিস্টদের একজনও এখন নেই। শিফট ভাগ করা কাজ। এখনকার শিফটে অন্য রিসেপসনিস্ট।

খানিক আগে নিজের রুম থেকে বেরিয়েছে মনজু। সকালবেলা গোসল করে ফ্রেস হয়েছে। তারপর সুন্দর একটা জিনসের প্যান্ট পরেছে, ঘিরঙের টিশার্ট পরেছে। পায়ে বুট, চোখে সানগ্লাস। মনজুকে দেখতে হলিউডের নায়কদের মতো লাগছে।

সে আজ শুধু ঢাকা শহরে ঘুরবে শুনে রিসেপসনিস্ট হাসি মুখে বলল, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, স্যার?

প্রথমে একটাই কাজ করবেন, আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলবেন।

ওকে স্যার।

বলুন ঠিক আছে।

ঠিক আছে।

এবার আপনাদের হোটেলের একটা কার্ড দিন।

রিসেপসনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে কার্ড দিল।

কার্ডটা কেন নিলাম জানেন?

না স্যার। যদি হারিয়ে যাই, কার্ডে লেখা এডড্রেস দেখে ফিরে আসব।

জ্বী স্যার।

আচ্ছা গেন্ডারিয়া এলাকাটা কোথায় বলুন তো?

পুরনো ঢাকায়।

তা আমি জানি। না না আজ যাব না। হয়তো কাল কিংবা পরশু যাব। যাওয়ার ব্যবস্থাটা কী বলুন তো?

রিকশা কিংবা বেবিট্যাক্সি।

বেবিট্যাক্সি মানে অটোরিকশা?

জ্বী স্যার।

ইয়েলোক্যাব যাবে না?

সাধারণত পুরনো ঢাকার দিকে যেতে চায় না। আপনি অবশ্য আর একটা কাজ করতে পারেন।

কী?

রেন্টেকার নিতে পারেন।

আপনারা ব্যবস্থা করে দেবেন?

অবশ্যই।

আর যদি হেঁটে যাই?

রিসেপসনিস্ট হাসল। দূর হবে।

কতদূর?

তা একজাক্টলি বলতে পারব না।

বিশ কিলোমিটার?

না না এত হবে না। এখান থেকে পাঁচ সাত কিলোমিটার হবে।

এ এমন কিছু না। আমার ইচ্ছে হলে আমি হেঁটে চলে যেতে পারি। আবার একটা মার্সিডিজ নিয়েও যেতে পারি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

বলে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে হাসল মনজু। শুনুন।

রিসেপসনিস্ট ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, জ্বী স্যার।

আপনাদের কিচেনে বলে রাখবেন, বাংলাদেশের নানা রকমের টুকটাক টুকটাক খাবার যখন তখন আমি চাইতে পারি। যেমন করে হোক সেগুলোর ব্যবস্থা যেন করে দেয়।

জ্বী স্যার।

আমি কিন্তু না শুনে অভ্যস্ত নই। এবং টাকা পয়সার ব্যাপারে একদমই ভাবি না।

কিন্তু কী ধরনের আইটেম আপনি চাইতে পারেন?

এক মুহূর্তও ভাবল না মনজু। বলল, এই ধরুন বইচা মাছের চচ্চড়ি।

রিসেপসনিস্ট বেশ অবাক হলো। বইচা মাছটা কী স্যার?

মনজু মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। আপনি বাংলাদেশি না?

জ্বী, অবশ্যই।

বইচা মাছ চেনেন না?

না স্যার।

চেনা উচিত ছিল।

মাছটা বোধহয় কমন নয়।

তা ঠিক। আনকমন মাছ।

দেখতে কেমন?

খলিসা মাছ চেনেন?

জ্বী তা চিনি স্যার। তবে খলিসা খুব রেয়ার হয়ে গেছে। আজকাল তেমন পাওয়া যায় না।

তাই নাকি?

জ্বী স্যার।

এটা খুবই দুঃখের কথা। এইসব মাছ বাংলার ঐতিহ্য। হারিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। যাহোক, খলিসার বাচ্চা সংস্করণ হচ্ছে বইচা। অথবা বইচা আলাদা একটা প্রজাতিও হতে পারে।

মনজু আর দাঁড়াল না। লবির দিকে পা বাড়াল।

নিজের কাজে ব্যস্ত হতে হতে রিসেপসনিস্ট আপনমনে বলল, হোটেলে কাজ করলে কত রকমের পাগল যে দেখতে হয়!

কথাটা শুনে ফেলল মনজু। সে আবার ফিরে এলো।

মনজুকে ফিরতে দেখে রিসেপসনিস্ট নার্ভাস হয়ে গেল। গোপনে সে একটা ঢোক গিলল।

মনজু নির্মল মুখ করে হাসল। পাগল নই, প্রেমিক। দেশপ্রেমিক।

স্যার!

নার্ভাস হবেন না। আমি আপনাকে কিছু বলব না। লোকের পেছনে কথা বলা বাঙালিদের একটা ত্রুটি। আমি নিজে যেহেতু একশো ভাগ। বাঙালি সেহেতু এই ত্রুটিটাকে আমি ত্রুটি মনে করছি না। বরং ত্রুটিটাকেও আমি পছন্দ করি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

মনজু আর দাঁড়াল না।

.

১০.

বারান্দার লাইটটা আজ কেন যে জ্বালেননি পারু!

অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন। সুমি যাচ্ছিল মায়ের রুমের দিকে। বারান্দাটা অন্ধকার দেখে সুইচ টিপে লাইট জ্বাললো। জ্বেলেই চমকে উঠল। এ কি? তুমি এখানে অন্ধকারে বসে আছ কেন?

পারু উদাস গলায় বললেন, এমনি।

এই বারান্দায় দুতিনটি ভাঙাচোরা বেতের চেয়ার আছে। একটায় বসে আছেন পারু, তার পাশের চেয়ারটায় বসল সুমি। তোমার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু ওসব নিয়ে এখন আর কথা বলে লাভ নেই। আমার এক বান্ধবীর বাবা আছেন উকিল। দলিলপত্র হারিয়ে গেলে কী করতে হয় তাঁর সঙ্গে আলাপ করে আমি জেনে নেব।

পারু কথা বললেন না।

সুমি বলল, আমি তোমাকে অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করি।

কী কথা?

তুমি হঠাৎ বাড়ির দলিল খুঁজতে শুরু করেছিলে কেন?

পারু গম্ভীর গলায় বললেন, বাড়ি বিক্রি করে ফেলব।

সুমি যেন আকাশ থেকে পড়ল। কী?

হ্যাঁ। এছাড়া বাঁচার উপায় নেই। গেন্ডারিয়ার সবচাইতে কমদামী এলাকায় দেড়কাঠার ওপর এই বাড়ি। আট ন’লাখ টাকার বেশি বিক্রি করা যাবে না। এই টাকা থেকে তোর বিয়ে দেব।

তারপর?

বাকি টাকা ব্যাংকে রাখব। পারিবারিক সঞ্চয়পত্র আছে, সেটা কিনব। তাতে যা ইন্টারেস্ট আসবে, আমার আর অমির চলে যাবে।

তোমরা থাকবে কোথায়? বাসা ভাড়া নেব।

কী?

হ্যাঁ। দেড় দুহাজার টাকায় ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নেব। তাছাড়া অমি টিউশনি করবে। কিছু টাকা সেও রোজগার করবে। অমির পড়াশুনো শেষ হলে আমার আর চিন্তা কী? অমি চাকরি বাকরি করবে, দিন চলে যাবে।

পারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

মায়ের দীর্ঘশ্বাসটা যেন বুকে এসে লাগল সুমির। মন খারাপ করা গলায় বলল, তারচে’ আমার বিয়ের চিন্তাটা যদি বাদ দাও।

চমকে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন পারু। মানে?

এই অবস্থায় বিয়ের চিন্তা বাদ দেয়াই ভাল মা। আমি এমএ পরীক্ষা দিয়েছি, কিছুদিনের মধ্যেই রেজাল্ট বেরুবে। চেষ্টা করলে ভাল একটা চাকরিও পাব। আমি একা চাকরি করে তোমাদের দুজনকে নিয়ে ভালই চলতে পারব। তারপর অমি যখন দাঁড়িয়ে যাবে তখন না হয়….।

সুমির কথা শেষ হওয়ার আগেই পারু বললেন, তখন আর বিয়ের বয়স থাকবে না।

না থাক।

ভাল পাত্রও পাওয়া যাবে না।

না যাক।

না না এসব কোনও কথা নয়। সেলিমের সঙ্গে সব ঠিকঠাক হয়ে আছে। তোর বাবাই করে গেছেন সব।

তাতে কী?

না না এ হবে না।

কেন হবে না মা?

নিজেদের সুবিধার জন্য তোর জীবন আমি নষ্ট করতে পারব না।

তোমাদের জীবন নষ্ট করে আমার জীবন ভাল করবার দরকার কী?

এসব কথা বাদ দে। সেলিমের সঙ্গে বিয়ে তোর ডেট মতোই হবে। আমি যা প্লান করেছি তাই করব।

সুমি কাতর গলায় বলল, এটা ঠিক হবে না মা।

পারু দৃঢ় গলায় বললেন, অবশ্যই ঠিক হবে। তুই ওই উকিল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দলিলের কপি তোলার চেষ্টা কর।

ওসবের জন্য তো টাকা লাগবে মা।

টাকা দেয়া যাবে।

কোত্থেকে?

টেলিফোন বিক্রির টাকা থেকে।

পারু টেলিফোন শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিংস্পেসের সামনে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল।

একবার।

দুবার।

পারু উঠছেন না দেখে সুমি গিয়ে ফোন ধরল। হ্যালো, স্লামালেকুম।

ওপাশ থেকে ভারি ধরনের পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল। ওয়ালাইকুম সালাম। সালামের ভঙ্গিতেই বুঝেছি তুমি মাসুদ সাহেবের মেয়ে। ভাল  আছ মা?

ভদ্রলোকের কথা বলার ধরন অমায়িক। ভাল লাগল সুমির। বলল, জ্বী আছি। কিন্তু আপনাকে ঠিক….।

আমাকে তোমার চেনার কথা না মা। আমার নাম মকবুল। জায়গা জমি বাড়িঘর এসব কেনা বেচার বিজনেস করি। তোমার বাবার সঙ্গে খুবই চেনা জানা ছিল কিন্তু যাওয়া আসাটা তেমন ছিল না।

জায়গা জমি কেনাবেচা কথাটা শুনেই বুকটা ধ্বক করে উঠেছে সুমির। কিছু একটা বলতে যাবে সে তার আগেই মকবুল সাহেব বললেন, তোমার বাবা মারা গেছেন জানি। কয়েকদিন ধরেই ভাবছি ফোন করব। তারপরে ভাবলাম, থাক, কয়েকদিন পরেই করি। শোকটা তোমরা একটু সামলে ওঠ। এখন তোমাদের মনের অবস্থা কেমন মা?

সুমি বলল, এই আর কী! সবাই মিলে সামলে ওঠার চেষ্টা করছি।

তাহলে তো মা কাজের কথাটা আমি বলতে পারি।

জ্বী বলুন।

তোমরা কি মা জানো যে তোমার বাবা বাড়ির দলিল রেখে গত দেড় বছরে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে লাখ তিনেক টাকা নিয়েছেন?

শুনে সুমি একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। না, না তো!

হ্যাঁ মা। প্রতিলাখে মাসে চারহাজার টাকা ইন্টারেস্ট। সবমিলে অংকটা মা প্রায় সাড়ে চারলাখে দাঁড়িয়েছে।

সুমি কোনও রকমে বলল, ও।

মকবুল সাহেব বললেন, তিনি আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন তোমাদেরকে আমি যেন এসব না জানাই।

বুঝলাম। কিন্তু টাকা তিনি কীভাবে শোধ করবেন বলেননি?

তাতো বলেছেনই।

কীভাবে?

বাড়ি বিক্রি করে।

জ্বী?

হ্যাঁ মা।

কিন্তু বাড়ি বিক্রির কথা বাবার মুখে কখনও শুনিনি।

তাই নাকি?

জ্বী। কখনও ভাবতেও দেখিনি।

আমাকে অবশ্য বলেছিলেন আমিই যেন বাড়িটা নিয়ে নেই। বাজারে যে হিসেবে দাম আছে সেই দামে নিয়ে, নিজের টাকাটা কেটে রেখে বাকি টাকা দিয়ে দেব। আমি মা এখনও সেই শর্তে রাজি আছি। তুমি একটা কাজ কর মা, তোমার মাকে নিয়ে যে কোনওদিন আমার এখানে আস। কীভাবে কী করা যায় আমরা আলোচনা করি।

জ্বী আচ্ছা।

তাহলে আজ রাখি মা।

সুমি মৃতের গলায় বলল, জ্বী আচ্ছা।

মকবুল সাহেব ফোন নামিয়ে রাখলেন। কিন্তু সুমি তখনও ফোন ধরে রেখেছে। সে যেন এখন আর মানুষ নয়, সে যেন এখন এক পাথর।

এদিকে মেয়েকে এতক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন পারু। সুমির কথায় ব্যাপারটা তিনি আঁচ করেছেন। এখন তাকে ফোন ধরে পাথর হয়ে থাকতে দেখে ভাঙাচোরা গলায় বললেন, ফোন ধরে দাঁড়িয়ে কী লাভ? নামিয়ে রাখ।

সুমি অসহায় ভঙ্গিতে ফোন নামিয়ে রাখল।

পারু বললেন, যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। কিন্তু দুঃখ একটাই, আমার কাছে কেন তিনি এসব লুকিয়ে গেছেন? আর এতগুলো টাকা এনেই বা কী করেছেন?

সুমি আগের মতোই অসহায় গলায় বলল, তুমি যেটাকে বাবার রোজগার মনে করেছিলে ওটা রোজগার ছিল না মা। ইন্টারেস্টে টাকা এনে সংসার চালিয়েছেন বাবা। টেলিফোন, কম্পিউটার সব ওই টাকার। বইয়ের দোকানে লস হয়েছিল। সব ওই টাকা থেকে ম্যানেজ করেছেন।

কোন ফাঁকে চোখ ভেঙে কান্না নেমেছে পারুর। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, আজ মনে হচ্ছে তিনি একা মারা যাননি, আমাদেরকেও

মেরে রেখে গেছেন।

পারু আর দাঁড়ালেন না। চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।

সুমি তখন একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে।

.

১১.

বেচারাম দেউড়ির গলির ভেতর মকবুল সাহেবের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। এই বাড়ির নীচতলার একটি রুমে তাঁর অফিস।

অফিস মানে নিজের বসার জন্য চেয়ার টেবিল, লোকজনের জন্য টেবিলের সামনে তিনটে হাতছাড়া চেয়ার আর একসেট গাবদা গোবদা সোফা। আদ্যিকালের কালো ভারি ধরনের একটা টেলিফোন সেট আছে টেবিলের ওপর। আজকাল এরকম টেলিফোন সেট আর দেখা যায় না।

মকবুল সাহেবের টেবিলের সামনে বসে এই টেলিফোন সেটের দিকে তাকিয়ে আছে সুমি। সকালবেলাই এই অফিসে চলে এসেছে সে।

মকবুল সাহেব বললেন, এক কাপ চা খাও মা?

সুমি বলল, জ্বী না, এখন খাব না।

আমারই অবশ্য ভুল হলো।

সুমি চোখ তুলে তাকাল।

মকবুল সাহেব বললেন, জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল তুমি নাশতা করেছ। কী না! তা না জিজ্ঞেস করে চায়ের কথা বললাম।

সুমি মাথা নীচু করল। আমি নাশতা করে বেরিয়েছি।

তাহলে খাও এক কাপ চা।

না। নাশতার সঙ্গে চাও খেয়েছি। বেশি চা খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই।

মকবুল সাহেব ভদ্রলোক বেশ অমায়িক ধরনের। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, মুখে কাঁচাপাকা বেশ ঘনদাড়ি। তবে দাড়ি তেমন লম্বা নয়। মাঝারি মতো, সুন্দর করে ছাটা। মাথায় সাদা একখানা টুপি আছে। মুখটা মায়াবি ধরনের।

এই মুখ আরও মায়াবি করে তিনি বললেন, আমি বুঝেছিলাম তোমার মা আসবেন না। তিনি নিশ্চয় খুব দুঃখ পেয়েছেন।

সুমি উদাস গলায় বলল, জ্বী।

মকবুল সাহেব কথা বললেন না। ড্রয়ার থেকে একটা ফাঁইল আর লম্বা ধরনের মোটা একটা খাতা বের করলেন। ফাঁইলটা সুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই তোমাদের দলিলের ফাঁইল।

ফাঁইলটা ধরল না সুমি। মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে দেখল। ফাঁইলের ওপর বাবার হাতের লেখাটা ফুটে আছে। দেখে সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

সেই দীর্ঘশ্বাস টের পেলেন না মকবুল সাহেব। লম্বা মোটা খাতাটা খুলে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলেন। তারপর একটা পৃষ্ঠায় এসে থামলেন। খাতাটা সুমির দিকে এগিয়ে দিলেন। আর এই যে দেখ তোমার বাবা সই করে টাকা নিয়েছেন।

অপলক চোখে বাবার সই করা পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে রইল সুমি। তারপর আগের মতোই উদাস গলায় বলল, আপনি যে মিথ্যে বলেননি তা আমি জানি।

না না মিথ্যে বলব কেন? মিথ্যে বলা, ছল চাতুরি এসব আমি কোনওদিন করিনি, করবও না। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। তোমাদের ওইটুকু সম্পত্তির জন্য মিথ্যে বলার কোনও দরকার আমার নেই।

জ্বী তাতো বটেই।

তবে মা, আমি ব্যবসায়ি মানুষ। টাকা খাঁটিয়ে টাকা রোজগার করি। এক্ষেত্রে আমার কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।

অপলক চোখে মকবুল সাহেবের মুখের দিকে তাকাল সুমি। আমরা তাহলে কী করব এখন?

কী করবে মা, তা আমি কী করে বলব!

না মানে আপনার সাজেসান চাচ্ছি। আমাদের অবস্থা তো আপনি জানেনই, এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আমাদের?

বলব?

জ্বী বলুন।

আমার কথা আবার অন্যভাবে নেবে না তো?

না না, প্রশ্নই ওঠে না।

বুদ্ধিমানের কাজ হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার টাকাটা শোধ করে দেয়া। নয়তো যতদিন যাবে ইন্টারেস্ট বাড়বে, এবং চক্রবৃদ্ধি হারে। তাতে তোমাদের আরও ক্ষতি হবে। তুমি কী মা চক্রবৃদ্ধি হার জিনিসটা বোঝ?

জ্বী বুঝি।

তাহলে তো তোমাকে আর বোঝাবার কিছু নেই।

জ্বী।

তবে মা, এক্ষেত্রে একটা হেলপ অবশ্য তোমাদেরকে আমি করতে পারি।

বাড়িটা আপনিই নিয়ে নেবেন। আপনার টাকা এডজাস্ট করে বাকিটা আমাদেরকে …..।

কারেক্ট। বাহ তুমি তো খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। বলবার আগেই সব বুঝে যাও। হ্যাঁ, এটা করাই তোমাদের জন্য সব চাইতে ভাল হবে।

আমি তাহলে আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।

অবশ্যই অবশ্যই। তবে যাই কর, তাড়াতাড়ি করো। কারণ যতদিন যাবে, ওই যে চক্রবৃদ্ধি হার।

সুমি উঠল। না না দেরি করব না। দিন সাতেকের মধ্যে আপনাকে আমি জানাব।

মকবুল সাহেবও উঠলেন। ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।

.

১১.

পারু নির্বিকার গলায় বললেন, আমার মতামতের কোনও দরকার নেই। তুই যা ভাল বুঝিস কর।

সুমি কাতর গলায় বলল, সবকিছু আমার ওপর চাপাচ্ছ কেন?

যেহেতু আমার কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই। এজন্যই চাপাচ্ছি।

ডাইনিংস্পেস থেকে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেলেন পারু।

সুমির তখন এত অসহায় লাগছে! কী করবে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে তার। এই অবস্থায় সুমি কি একটু সেলিমের সঙ্গে কথা বলবে!

সেলিমের অফিসে ফোন করল সুমি।

সব শুনে সেলিম বলল, তোমার মায়ের খুব অভিমান হয়েছে। এটা খুব অস্বাভাবিক নয়। এতবড় একটা ব্যাপার যেহেতু তার কাছে তোমার বাবা লুকিয়ে গেছেন, অভিমান তার হতেই পারে।

সুমি বলল, এখন এরকম অভিমানের কোনও মানে নেই। যে মানুষ চলে গেছেন তার ওপর অভিমান করে কী হবে!

তবু অভিমান অভিমানই।

এই ধরনের অভিমানকে আমার ছেলেমানুষি মনে হয়।

সেলিম চুপ করে রইল।

সুমি বলল, কিন্তু আমি কী ডিসিসান নিই বল তো?

আমি কী বলতে পারি, বল!

সুমি কেমন বিরক্ত হলো। কী বলবে মানে? আমার সমস্যাটা শেয়ার করবে না? হেলপ করবে না আমাকে?

অবশ্যই।

বল তাহলে কী করা উচিত আমার!

অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, বাড়ি বিক্রি ছাড়া তো কোনও উপায় দেখছি না।

ঠিকই বলেছ।

আর মকবুল সাহেবের কাছে বিক্রি করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আমারও তাই মনে হয়।

এবং আর একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ভদ্রলোক তোমাদেরকে ঠকাবেন না।

এটা আমিও মনে করি। কারণ তিনি লোক ভাল। তবে হানড্রেট পার্সেন্ট ব্যবসায়ি।

তা তো কেউ কেউ হতেই পারেন।

সেলিম একটু থামল। আর দু একটা কথা বলব?

বল।

বিয়েটা ডেট মতোই হওয়া উচিত আমাদের।

কেন?

আমি দু একটা জায়গায় বলে রেখেছি, রেজাল্ট বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি হয়ে যাবে তোমার। তুমি যা বেতন পাবে, পুরো টাকাটা তুমি তোমার মাকে দিতে পারবে। আমাদের সংসারে একটি পয়সাও তোমাকে খরচ করতে হবে না। তারপর আমি আছি, আমিও তোমার মা এবং ভাইকে দেখব।

সেলিমের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল সুমি। বলল, খুব ভাল লাগল তোমার কথা শুনে। মনটা ভাল হয়ে গেল।

তখুনি কলিংবেল বাজল।

সুমি বলল, কে যে এল। রাখি এখন। পরে কথা বলব।

ঠিক আছে।

টেলিফোন রেখে ছুটে গিয়ে গেট খুলল সুমি। খুলে থতমত খেল।

ঝকঝকে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। ধপধপে সাদা টিশার্ট আর আকাশি রংয়ের জিনস পরা। চোখে সানগ্লাস। পায়ে বুট। গা

থেকে সুন্দর পারফিউমের গন্ধ আসছে।

সুমিকে দেখেই সানগ্লাসটা খুলল সে। মিষ্টি হেসে বলল, হাই।

তারপরই যেন নিজেকে সামলালো। দুঃখিত। স্লামালেকুম।

আপনি …….?

আগে বলুন, এটা মাসুদ সাহেবের বাড়ি তো?

জ্বী।

সঙ্গে সঙ্গে কী যে খুশি হলো যুবক! মুহূর্তে উজ্জ্বল মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে গল তার। থ্যাংকস গড। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। তিনি আছেন?

সুমির মুখ ম্লান হয়ে গেল। গভীর দুঃখের ছায়ায় আচ্ছন্ন হলো মুখ।

ব্যাপারটা খেয়াল করল যুবক। চিন্তিত গলায় বলল, কী হয়েছে?

বাবা, বাবা গত মাসের একুশ তারিখে, সিভিয়ার হার্টএটাক…

কথা শেষ করতে পারল না সুমি। জলে চোখ ভরে এল। চোখের জল সামলাতে অন্যদিকে মুখ ফেরাল সে।

যুবক ততোক্ষণে একেবারেই নিভে গেছে। কোনও রকমে সে শুধু বলল, ওহ, গড!

সুমি আবার তার দিকে তাকাল। কিন্তু আপনাকে ঠিক …….।

না না চিনবার কথা নয়। আমার নাম মনজু। মনজুর রহমান। নিউইয়র্কে থাকি। আচ্ছা, আপনার মা বাড়িতে আছেন? আমি কি তাঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?

আসুন।

সুমির পিছু পিছু তাদের ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকল মনজু।

সুমি বলল, আপনি বসুন। আমি মাকে ডাকছি।

জ্বী আচ্ছা।

মিনিটখানেকের মধ্যে পারুকে নিয়ে এই রুমে ফিরে এল সুমি। এই আমার মা।

সঙ্গে সঙ্গে মনজু তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। কেমন আছেন আপনি?

পারু বললেন, এই অবস্থায় কেমন থাকা যায় বলো? কিন্তু বাবা …..।

আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলবেন আসলে কেমন করে যে পরিচয়টা দেব? আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা।

কী নাম তার?

আপনি বোধহয় তাকে চিনবেন না। তাছাড়া এতকাল আগের ঘটনা।

তবু নামটা বল।

আতিকুর রহমান। মাসুদ চাচা এবং বাবা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সুমি কেমন উত্তেজিত হলো। গোয়ালিমান্দ্রার যুদ্ধে গুলিতে একটা পা …। হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা আমাকে একদিন তার কথা বলেছিলেন।

সুমির দিকে তাকাল মনজু। তাহলে তো আপনার জানার কথা। গুলিতে ডানপাটা একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বাবার। পাকিস্তানিদের আক্রমণে নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য পিছু হটছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বাবার দিকে ফিরে তাকাবার সময় ছিল না কারও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাসুদ চাচা আমার মৃতপ্রায় বাবাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আমার। বাবার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন।

সুমি বলল, সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। একটি পাকিস্তানিও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

পারু বললেন, তোমার বাবা বেঁচে আছেন?

জ্বী আছেন এবং শরীরও খুব ভাল তাঁর।

কোথায় আছেন?

নিউইয়র্কে। স্বাধীনতার পর পর ট্রিটম্যান্টের জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। সেই সময়ও বাবাকে পাঠাবার জন্য মাসুদ চাচা অনেক চেষ্টা তদবির করেছিলেন। সব মিলে আমার বাবার জীবনে মাসুদ চাচার ভূমিকার কোনও তুলনা হয় না।

সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পা কি পুরোপুরি ভাল হয়ে গিয়েছিল তার?

না। কেটে বাদ দিতে হয়েছে। বাবা ক্রাচে ভর দিয়ে চলেন। তবে বাবার পায়ের অভাবটা পূরণ করে দিয়েছেন আমার মা।

পারু বললেন, তোমার মা কোথাকার মানুষ?

আমেরিকান বাঙালি। ওখানেই জন্মেছেন।

ও।

তারপর পারু বললেন, তুমি চা খাবে তো, বাবা?

জ্বী না।

সুমি বলল, আপনার মায়ের কথা বলুন।

মা ছিলেন নার্স। ট্রিটম্যান্টের জন্য যে হাসপাতালে ছিলেন বাবা, সেই হাসপাতালের নার্স। পরে বাবার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বাবা আমেরিকাতেই থেকে গেলেন।

আর কখনও দেশে ফেরেন নি?

না।

কেন?

দেশে কেউ ছিল না আমাদের।

আত্মীয় স্বজন কেউ না?

না। আমার দাদা দাদী আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমার একজন ফুফু ছিলেন, সেই ফুফুকে বাবা পরে আমেরিকায় নিয়ে যান। আমার সেই ফুফুও নিউইয়র্কেই থাকেন। তার দুটো ছেলে। ফুফার একটা গ্রোসারিশপ আছে। নিজের সুন্দর বাড়ি। অবস্থা বেশ ভাল।

পারু বললেন, খুব ভাল লাগল বাবা। খুব খুশি হয়েছি। তোমার বাবা পুরনো দিনের কথা মনে রেখেছেন। দেশে এসে তুমি আমাদের খোঁজ খবর নিতে এসেছ। আজকাল কে কার কথা মনে রাখে, বল?

মনজু কথা বলল না। সুমি বলল, কিন্তু আপনি আমাদের ঠিকানা পেলেন কী করে?

বাবা বলে দিয়েছিলেন গেণ্ডারিয়া এলাকাতেই আছেন আপনারা। যুদ্ধের সময় যে বাড়ি ছিল হয়তো সেই বাড়ি এখন আর নেই। তবু খুঁজলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে।

কিন্তু আগের সেই বাড়ি তো নেই।

তবু পেয়ে গেলাম। খুব একটা খুঁজতে হয়নি। ইচ্ছে এবং চেষ্টা থাকলে সব হয়।

পারু বললেন, চা খেতে চাইছ না কেন?

সুমি বলল, চা না হয় অন্য কিছু একটু খান। এভাবে খালি মুখে বসে আছেন!

ঠিক আছে।

সুমি উঠতে যাচ্ছিল, পারু বললেন, তুই বোস। আমি যাচ্ছি।

পারু চলে যাওয়ার পর মনজু বলল, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমার অন্যরকমের কিছু ঝামেলা আছে।

সুমি বলল, কী রকম?

বাবা আমাকে বলেছেন পুরনো ঢাকায় বিকেলবেলা ঘন দুধের চা আর ডালপুরি, অসাধারণ টেস্টি। ভাবছিলাম আপনাদের এখান থেকে বেরিয়ে কোনও একটা রেস্টুরেন্টে বসে ওরকম চা আর ডালপুরি খাব। এজন্যই চাটা খেতে চাইনি।

মনজুর কথা শুনে চঞ্চল হলো সুমি। আগে বলবেন তো! ও রকম চা আর ডালপুরি আপনাকে আমি আনিয়ে দিচ্ছি।

উঠে দ্রুত পায়ে মায়ের রুমের দিকে চলে গেল সুমি।

সুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর মনজুও উঠল। উঠে মাসুদ সাহেবের ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার দুর্ভাগ্য আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো না। স্বপ্ন ছিল, আমার বাবাকে যিনি বাঁচিয়েছেন, পায়ে হাত দিয়ে তাকে একবার সালাম করব। আমার কৃতজ্ঞতা জানাব। সেদিন যদি আমার বাবাকে আপনি না বাঁচাতেন, আমার তাহলে এই পৃথিবীতে আসা হতো না। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া হতো না।

ঠিক তখুনি ডাইনিংস্পেসে টেলিফোন বাজল। পারু টেলিফোন ধরলেন। হ্যালো। জ্বী। হা হা বলুন। আমি সুমির মা। ওয়ালাইকুম সালাম।

ড্রয়িংরুম থেকে মনজু সব শুনতে পাচ্ছিল।

পারু বললেন, ও মকবুল সাহেব। জ্বী জ্বী চিনেছি। আপনার ওখান। থেকে এসে সুমি আমাকে সব বলেছে। কী? সাতদিনের মধ্যে জানাবে বলেছে? না না সাতদিনের দরকার নেই। আপনি এখনই শুনুন। বাড়ি আপনিই নিয়ে নেবেন। আপনার পাওনা টাকা রেখে বাকিটা আমাদেরকে দিয়ে দেবেন। দু একদিনের মধ্যেই সুমি এবং তার জামাইকে আমি আপনার ওখানে পাঠাব। ওরা সব ফাইনাল করে আসবে। জ্বী না, এখনও বিয়ে হয়নি। এনগেজম্যান্ট হয়েছে, বিয়ের ডেট হয়েছে। জ্বী আচ্ছা।

ড্রয়িংরুম থেকে সব কথাই শুনেছে মনজু। শুনে কী রকম স্তব্ধ হয়ে আছে।

এসময় ট্রেতে চা এবং ডালপুরি নিয়ে সুমি এল। যখন সেন্টারটেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখছে সুমি তার হাতের এনগেজম্যান্ট রিংটা দেখতে পেল মনজু। তখনও আগের মতোই স্তব্ধ, আনমনা ভাব তার।

সুমি বলল, এই আপনার ওরকম চা আর ডালপুরি।

মনজু কথা বলল না।

সুমি অবাক হলো। কী হয়েছে?

মনটা একটু খারাপ।

কেন?

আপনার হাতের আংটি দেখে।

সুমি ভুরু কুঁচকালো। আমার আংটি দেখে আপনার মন কেন খারাপ হবে?

না মানে বুঝে গেছি আমার কোনও সম্ভাবনা নেই।

জ্বী?

মনজু হাসল। সিনেমা নাটকে তো এমনই হয়। বাবার বন্ধুর ছেলেতে মেয়েতে ….। হয় না?

সুমিও হাসল। আপনি খুব মজা করে কথা বলেন।

যত মজাই করি কিন্তু আপনার আমার কোনও সম্ভাবনা নেই।

তারপর একটু থেমে বলল, রাগ করলেন নাকি? না না রাগ করবেন না। মনের কথা মনে আমি লুকিয়ে রাখতে পারি না। বলে ফেলি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

সুমি হাসল। চা এবং ডালপুরি দুটোই ঠাণ্ডা হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে বসল মনজু। একটা ডালপুড়ি নিয়ে কামড় দিল, সঙ্গে এক চুমুক চা। এবং খেয়ে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। আহা, সত্যি অতুলনীয় খাবার। বাবার মুখে কত টুকটাক বাঙালি খাবারের কথা যে শুনেছি। এবার

একে একে সব খেয়ে যাব।

আবার ডালপুরিতে কামড় দিল মনজু। চায়ে চুমুক দিল। আচ্ছা, কচুরলতি, গাঠি, কচুরমুখি এসব আপনি চেনেন?

সুমি অবাক হলো। ওমা, চিনব না কেন?

ওসবের যত রকমের আইটেম করা যায়, করে আমাকে একদিন খাওয়াবেন তো!

তারপর আবার নির্মল মুখ করে হাসল মনজু। সীমা লংঘন করছি না তো?

কী রকম?

মানে প্রথম দিনই এত অধিকার নিয়ে কথা বলছি! আসলে আপনাদেরকে আমি খুব আপন মনে করছি। আমার নিজের মানুষ মনে করছি। যতদিন দেশে আছি ঘুরে ফিরে আপনাদের এখানে আমি আসব। বিরক্ত হলেও আসব।

কথা বলতে বলতে দুটো ডালপুরি এবং এক কাপ চা শেষ করেছে। মনজু। এবার উঠে দাঁড়াল।

তাকে দাঁড়াতে দেখে সুমি বলল, আমরা কখনই বিরক্ত হবে না। আপনি আসবেন।

তারপর আচমকা মনজু বলল, ভদ্রলোক কী করেন?

কোন ভদ্রলোক?

মানে আপনার যার সঙ্গে হবে।

সুমি হাসল। ও।

আপনি তো আমার চে’ ছোট হবেন, ছোটবোনের জামাইকে কি দুলাভাই বলা যায়? আচ্ছা, বললেই বা কী হয়!

সুমি আবার হাসল। না কিছুই হয় না। ইচ্ছে করলেই বলা যায়। তবে তার আগে ছোটবোনটিকে তুমি করে বলতে হয়?

মনজু সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল। ভুল বললি। তুই করে বলতে হয়।

তারপর আদেশের গলায় বলল, শোন, দুলাভাইর নামধাম অফিস ইত্যাদি সব লিখে দে তো। চট করে একটা সারপ্রাইজ দিয়ে আসব।

দিচ্ছি।

সঙ্গে তোদের এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটাও দিবি। যখন তখন ফোন করব।

কথাটা শুনে হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল সুমির। ফোন নাম্বারটা দিতে পারছি না।

কেন?

ফোনটা আর আমাদের নেই।

মানে?

ফোনটা আমরা বিক্রি করে ফেলেছি। দুতিন দিনের মধ্যে ট্রান্সফার হয়ে যাবে।

মনজু একটু থতমত খেল। তারপর সামান্য সময় কিছু ভেবে বলল, ঠিক আছে। দুলাভাইর অফিসের এডড্রেস দে।

সুমি এডড্রেস লিখে দিল।

.

১২.

খুবই একাগ্রতা নিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সেলিম। কী একটা জটিল হিসেব বের করার চেষ্টা করছে।

এ সময় তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল মনজু। খুবই উফুল্ল গলায় বলল, স্লামালেকুম দুলাভাই। ভাল আছেন?

চমকে মনজুর মুখের দিকে তাকাল সেলিম। তারপর ঠোঁট টিপে হেসে নির্বিকার গলায় বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। জ্বী ভাল আছি। বসুন।

সেলিমের এরকম নির্বিকার ভাব দেখে মনজু অবাক হলো। আপনার সমস্যাটা কী?

কিসের সমস্যা?

আমার সাইজের একটা লোক দুলাভাই দুলাভাই করছে আর আপনি একটুও অবাক হচ্ছেন না!

কম্পিউটার অফ করে হাসল সেলিম। আপনি বোঝেননি কেন অবাক হচ্ছি না?

না।

সুমি আমাকে সব বলেছে।

ও এই কথা। আচ্ছা মুরগির কলিজা গিলা দেয়া সিঙারা কোথায় পাওয়া যাবে বলুন তো?

তারপরই নিজেকে সামলালো মনজু। থাক, লাঞ্চ আওয়ার হয়ে গেছে। চলুন হাজির বিরিয়ানী খেয়ে আসি।

বলেই নির্মল মুখ করে হাসল। বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আসলে আমার যাকে ভাল লাগে আমি তার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

আমার সঙ্গেও মিশবেন। কোনও অসুবিধা নেই।

আপনাকে আমার খুব ভাল লাগল।

ধন্যবাদ।

এরপর একটা এবং আছে।

কী?

আপনার কাছে আমি একটা হেলপ চাইব।

কী ধরনের?

চলুন বিরিয়ানী খেতে খেতে বলব।

সেলিম উঠল। তবে আমার একটা কথা আছে।

বলুন।

বিরিয়ানীর বিলটা আমি দেব।

তা তো দেবেনই। দুলাভাই সঙ্গে থাকলে শ্যালকরা কি কখনও বিল দেয়?

না তা দেয় না।

তাহলে?

অবশ্য বাঙালি সভ্যতায় এই প্রথম একটা অভিনব ব্যাপার ঘটছে।

কী বলুন তো?

হবু স্ত্রীর বড়ভাইও শ্যালক সেজেছে। হওয়া উচিত সমুন্দি।

মনজু হাসল। না আমি আপনার শ্যালক হয়েই থাকতে চাই।

বিরিয়ানী খেতে খেতে মনজু যা বলল শুনে চোখ স্থির হয়ে গেল সেলিমের। কোনও রকমে সে বলল, আপনি এসব কেন করতে চাচ্ছেন?

মনজু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি মনে করছি এটা আমার কর্তব্য।

কর্তব্য মনে করবেন কেন? ওরা তো আসলে আপনার কেউ না।

এক অর্থে কেউ না, আরেক অর্থে খুব আপন। সেই যুদ্ধের দিনে মাসুদ চাচা না বাচালে আমার বাবা বেঁচে থাকতেন না, আমার এই পৃথিবীতে আসা হতো না। আপনাদের মতো কতো ভাল মানুষ চারদিকে, এইসব মানুষের সঙ্গে দেখা হতো না।

কিন্তু আমি এসব সামাল দেব কেমন করে?

সামাল দেয়াটা আপনার পক্ষেই সব চাইতে সহজ। আপনাকে শুধু। বলতে হবে আপনি সব করছেন।

কেউ বিশ্বাস করবে না।

কেন?

আমিই যদি সব করব এতদিন করিনি কেন?

এসবের কোনও একটা অজুহাত বের করবেন।

বলেই সেলিমের একটা হাত ধরল মনজু। আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে যিনি বাঁচিয়েছিলেন সেই মহান মুক্তিযোদ্ধার পরিবারটিকে বাঁচাতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

সেলিম অপলক চোখে মনজুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

১৩.

পারু চিন্তিত গলায় বললেন, তুমি এতকিছু সামাল দেবে কেমন করে?

সন্ধের পর সুমিদের বাড়ি এসেছে সেলিম। অফিস থেকে সরাসরিই এসেছে। এসেই কিছু কথা বলেছে। শুনে পারু ওই কথা বললেন।

পারুর কথা শুনে সেলিম বলল, আমি সামাল দিতে পারব।

কীভাবে?

ব্যবস্থা আছে।

কী ব্যবস্থা?

শেষ কথাটা বলল সুমি। সে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে।

সেলিম সুমির দিকে তাকাল। তোমাদের ফ্যামিলির অবস্থা দেখে এসব নিয়ে অফিসে কথা বলেছিলাম আমি।

কবে?

বেশ কয়েকদিন আগে।

তারপর?

বলেছিলাম লাখসাতেক টাকা হলে সব মিটে যায়। মকবুল সাহেবের টাকা শোধ করা যায়, বিয়ের খরচ, তোমার চাকরি বাকরি না হওয়া পর্যন্ত সংসার খরচ।

সাত লাখ টাকার কথা শুনে পারু একেবারে আঁতকে উঠলেন। সাত লাখ টাকা কি মুখের কথা?

সেলিম বলল, কিন্তু টাকাটা আমি এরেঞ্জ করেছি।

সুমি বলল, কীভাবে?

অফিস আমাকে লোন দেবে।

পারু বললেন, এত টাকা লোন দেবে?

জ্বী দেবে।

টাকা তুমি শোধ করবে কেমন করে?

মাসে মাসে বেতন থেকে কেটে নেবে।

সুমি কী রকম চিন্তিত চোখে সেলিমের দিকে তাকিয়ে রইল।

পারু বললেন, না না। আমাদের জন্য এত বড় ঝামেলায় জড়াবার। দরকার নেই তোমার। তারচে বাড়ি চলে যাক। তাছাড়া তোমাদের বাড়িতে ব্যাপারটা জানাজানি হলে ….।

সেলিম দৃঢ় গলায় বলল, কেউ জানবে না। এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।

তারপর সুমির দিকে তাকাল সেলিম। সুমি, টেলিফোনটা যারা কিনতে চেয়েছে তাদেরকে মানা করে দিও। আর মকবুল সাহেবের ফোন নাম্বারটা দাও।

সুমি তখনও আগের মতো চোখ করে সেলিমের দিকে তাকিয়ে আছে।

.

১৪.

দুদিন পর সকালবেলা মকবুল সাহেবের অফিসে এসে ঢুকল মনজু এবং সেলিম।

মকবুল সাহেব ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

সেলিম বলল, আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।

মকবুল সাহেব ব্যস্ত হলেন। ও আচ্ছা। বসুন, বসুন।

ওরা দুজন মকবুল সাহেবের মুখোমুখি বসল।

সেলিম বলল, কাগজপত্রগুলো সব রেডি আছে?

জ্বী। হাতের কাছেই আছে।

ড্রয়ার থেকে ফাঁইলটা বের করলেন, সেই মোটা খাতাটা বের করলেন।

এসবের দিকে ফিরেও তাকাল না মনজু। আচমকা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল মকবুল সাহেবের দিকে। আমি মনজু। সুমির ভাই।

মনজুর হাত ধরলেন মকবুল সাহেব। মাসুদ সাহেবের এতবড় ছেলে আছে বলে তো জানতাম না!

আমি তার ছেলে নই, তার সহযোদ্ধার ছেলে।

তাই বলুন।

তারপর সেলিমের দিকে তাকালেন মকবুল সাহেব। চেক এনেছেন বাবা?

সেলিম বলল, জ্বী।

মনজু বলল, তবে অংকটা এখনও লেখা হয়নি। একজাক্ট ফিগারটা…।

চারলক্ষ বেয়াল্লিশ হাজার। চক্রবৃদ্ধি হার।

কোনও অসুবিধা নেই।

তারপর একটু থামল। আপনি আমার বাবার বয়সী। আপনাকে চাচা বলতে পারি?

মকবুল সাহেব বিগলিত হলেন। নিশ্চয়, নিশ্চয়। চা দিতে বলি। চা খান বাবা।

মনজু হাসল। খেতে পারি, তবে দোকানের চা। সঙ্গে নিমাকপারা। বাবা বলেছেন পুরনো ঢাকার দোকানের চায়ের সঙ্গে নিমাকপারা অসাধারণ লাগে।

কোনও অসুবিধা নেই। এখুনি আনিয়ে দিচ্ছি।

মতি নামের অল্প বয়েসি একটা কাজের ছেলে আছে মকবুল সাহেবের। মতিকে ডাকলেন তিনি। মতি, মতি।

ভেতর থেকে ছুটে এল মতি। জ্বী।

সালুর দোকান থেকে কেটলি ভরে চা আন আর দশটাকার নিমাকপারা।

সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল মতি।

মনজু বলল, আপনাকে খুব ভাল লেগেছে চাচা। আপনি লোক ভাল।

হ্যাঁ বাবা। লোক আমি খারাপ নই।

একাত্তর সালে কোথায় ছিলেন?

গ্রামে ছিলাম বাবা। বিক্রমপুরের ইছাপুরা গ্রাম।

মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?

অস্ত্র কাঁধে নিয়ে যুদ্ধ করিনি, অর্থাৎ সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা না। তবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যতটা সম্ভব সাহায্য করেছি।

এটা আপনি না বললেও আমি বুঝতাম।

মকবুল সাহেব অবাক হলেন। কী ভাবে?

মাসুদ চাচাকে টাকা দিয়ে যেভাবে সাহায্য করেছেন তাতে বোঝা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আপনার গভীর ভালবাসা আছে।

এই কথাটা ধরল সেলিম। কিন্তু টাকা তো ইন্টারেস্টে দিয়েছেন!

মুখ ঘুরিয়ে সেলিমের দিকে তাকাল মনজু। যেভাবেই হোক, দিয়েছেন তো!

তারপর আবার মকবুল সাহেবের দিকে তাকাল মনজু। চাচা, মাসুদ চাচার ফ্যামিলি সম্পর্কে আপনি সবই জানেন। তাঁর মৃত্যুতে খুবই বিপাকে পড়েছে পরিবারটি। যে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে, জীবন দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন আপনাদেরকে, সেরকম এক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার আজ বিপর্যস্ত। সেই পরিবারটিকে আপনি একটু সাহায্য করতে পারেন না?

মকবুল সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে মনজুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মতি এসময় চা এবং নিমাকপারা নিয়ে এল।

এক মুঠো নিমাকপারা মুখে দিয়ে এক চুমুক চা খেল মনজু। তারপর পকেট থেকে চেক বই বের করল। চক্রবৃদ্ধি হারে কত টাকা বললেন?

মকবুল সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, সব হিসাব তো আপনি উলট পালট করে দিয়েছেন বাবা। আপনার কথা শুনে একাত্তর সালে ফিরে গেলাম। সেই দুর্দিন থেকে যারা আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করে দিয়েছেন সেরকম এক মুক্তিযোদ্ধার পরিবার বিপদে পড়েছে, আমি অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করব। আপনি আমার মূল টাকাটাই দিন বাবা। তিনলাখ। ইন্টারেস্ট বাদ।

মনজু মুগ্ধ গলায় বলল, গ্রেট।

.

১৫.

হোয়াইট হাউস হোটেলের লবিতে বিষমুখে বসে আছে সুমি।

প্রায় ছুটতে ছুটতে তার সামনে এল মনজু। তুই হঠাৎ আমার হোটেল? রিসেপসান থেকে ফোন করেছে, এক মহিলা মানে ভদ্রমহিলা দেখা করতে চান। শুনে আমি তো হতভম্ব। আমার কাছে আবার ভদ্রমহিলা কে? এই, তুই কি ভদ্রমহিলা নাকি? বলতে পারলি না তুই আমার বোন!

সুমি কথা বলল না। অপলক চোখে মনজুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মনজু অবাক হলো। কী ব্যাপার? এত গম্ভীর হয়ে আছিস কেন?

সুমি গম্ভীর গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

সুমির কথা বলার ধরনে কী যে মুগ্ধ হলো মনজু! বলল, তুই যে আমাকে তুমি করে বলছিস এবং সত্যি আপন ভেবেছিস এতেই আমি খুশি। এখন যদি তুই আমার সঙ্গে রাগারাগিও করিস, আমি কিছু মনে করব না। বল, কী কথা?

তুমি আগে আমার সামনে বস।

মনজু বসল।

সুমি বলল, এসব তুমি কী করেছ?

কথাটা প্রথমে বুঝতে পারল না মনজু। বলল, কী করেছি?

তারপরই চমকাল। সর্বনাশ! দুলাভাই কি তোকে সব বলে দিয়েছে? না না এটা তো ঠিক করেনি।

সে বলেনি।

তাহলে?

মকবুল সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন।

তাই বল।

কিন্তু আমাদের জন্য এতটা তুমি কেন করলে?

শোন, মানুষের জীবন আসলে এক যুদ্ধক্ষেত্র। বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেকেই যুদ্ধ করছে। কখনও দেশের জন্য, কখনও জীবনের জন্য। যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সহযোদ্ধাকে সাহায্য করা। যে সাহায্য তোর বাবা আমার বাবাকে করেছিলেন।

এতকাল পর তুমি সেই ঋণ শোধ করলে?

ঋণ শোধ নয়। জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত হওয়া কিছু যোদ্ধার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

একটু থামল মনজু। শোন, আজই ফিরে যেতে হচ্ছে। রাত সাড়ে এগারোটায় ফ্লাইট।

সুমি চমকাল, কী?

হ্যাঁ। বাবা ফোন করেছিলেন। আমাকে ছাড়া নাকি ভাল লাগছে না। আমাকে নাকি খুব মিস করছেন। এজন্য হঠাৎ করেই …।

মার সঙ্গে দেখা করে যাবে না?

অবশ্যই। চল এখুনি যাই।

চল।

তার আগে দুলাভাইকে একটা ফোন করি। আজ তো ছুটির দিন। তাকেও আসতে বলি।

দরকার নেই। সে এমনিতেই আসবে।

বাস্তবিকই সুমিদের বাড়ি এসে সেলিমকে দেখতে পেল মনজু। ড্রয়িংরুমে বসে আছে। তার সঙ্গে গল্প করছেন পারু এবং অমি।

এই রুমে ঢুকে মনজুর চলে যাওয়ার কথা বলল সুমি।

শুনে পারু বললেন, আমাদের বিপদ যখন কাটল তখনই তুমি চলে যাচ্ছ বাবা? তোমাকে একবেলা খাওয়াতেও পারলাম না।

মনজু সেই নির্মল ভঙ্গিতে হাসল। আরেকবার যখন আসব তখন রোজই খাব। কারণ তখন তো আমি এই বাড়িতেই থাকব।

তারপর পারুর পাশে গিয়ে বসল সে। আপনাকে একটা অনুরোধ করব।

কী বাবা?

যদি কখনও কোনও প্রয়োজনে আমার কথা আপনাদের মনে হয়, একটু কষ্ট করে আমাকে শুধু একটা ফোন করবেন। দেখবেন আমি এসে ঠিকই হাজির হয়েছি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

পারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হ্যাঁ বাবা, করব।

তারপর অমির দিকে তাকাল মনজু। তোকে আমার বলার কথা একটাই, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবি। মনে রাখবি তুই একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

অমি মাথা নীচু করে বলল, আমি মনে রাখব।

মনজু তারপর সেলিমের দিকে তাকাল। বেশ নাটকীয়ভাবে বিদায় নিচ্ছি, না? শেষ নাটকটা আপনার সঙ্গে করছি দুলাভাই। সময় থাকলে আপনার বিয়েটা খেয়ে যেতাম। তারপরও উইস করছি, বিবাহিত জীবন সুখের হোক।

সেলিম মৃদু কণ্ঠে বলল, ধন্যবাদ।

সুমি ততোক্ষণে চোখ মুছতে শুরু করেছে।

মনজু এসে তার সামনে দাঁড়াল। কাঁদছিস কেন?

তারপর বলল, আচ্ছা কাঁদ। ভাল করে কাঁদ। ভাই দূরে চলে গেলে বোনদের একটু কাদা উচিত।

সবশেষে মাসুদ সাহেবের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়াল মনজু। হাত তুলে আর্মি কায়দায় স্যালুট করল ছবির মানুষটাকে।

.

১৬.

এতরাতে এয়ারপোর্টে আসবে সুমি এবং সেলিম মনজু তা কল্পনাই করেনি। অবাক গলায় বলল, কিরে তুই আবার এখানে এসেছিস কেন? এতরাতে দুলাভাই বেচারাকেও কষ্ট দিচ্ছিস।

সেলিম বলল, না। কিসের কষ্ট?

সুমি বলল, তোমাকে আমি একটা কথা বলতে এসেছি।

কী কথা?

মানুষ যখন খুব কষ্টে থাকে, দুঃখ বেদনা কিংবা আসময়ের মধ্যে থাকে তখন মনে মনে সে শুধু চায় তার কষ্টটা কেটে যাক, দুঃখ বেদনা একদম চলে যাক জীবন থেকে। অসময় কেটে গিয়ে সুসময় দেখা দিক। মনে মনে সে শুধু সুসময়কে ডাকে, সুখ এবং আনন্দকে ডাকে। আজকের পর থেকে জীবনের যে কোনও কষ্টের মুহূর্তে, দুঃখ বেদনা এবং অসময়ে আমি কেবল তোমাকে ডাকব। মনে মনে বলব, এসো, এসো তুমি। আমার কষ্ট কাটিয়ে দিয়ে যাও। দুঃখ বেদনা কাটিয়ে দিয়ে যাও। আমার অসময়কে ঠেলে দাও সুসময়ের দিকে। এসো, এসো তুমি।

মনজুর একটা হাত ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল সুমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *