৩১-৩৫. আকাশে মেঘ করিয়াছে

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আকাশে মেঘ করিয়াছে। নিবিড় ঘনকৃষ্ণ মেঘের স্তর সারা আকাশ ছাইয়া ফেলিয়াছিল।

করিমা ছাদের উপর দাঁড়াইয়া একাকী আকাশের দিকে চাহিয়া মেঘের খেলা দেখিতেছিল। ঝটিকা-প্রবাহ মেঘগুলিকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিতেছিল।

দিবসের আলো ম্লান হইয়া আসিল। করিমা দেখিল–আকাশের বিরাট গম্ভীর মূর্তি বজ ও বিদ্যুতের লীলা। তার মনে হইল–জীবন যেন কিছু নয়। মানুষের সম্মুখে কি ভয়ানক পরীক্ষা! এই জড়দেহ চূর্ণ হইলে কী ক্ষতি! আত্মা, প্রেম ও মহত্ত্বের সহিত মিলাইয়া দেওয়াই ঠিক।

করিমা মনে মনে নিজকে প্রশ্ন করিল–জীবনের উদ্দেশ্য কী? কোথায় মানুষের শেষ? কোনোদিকে মানুষের গতি?

করিমা ভাবিল–জীবন কি হাহাকারময়? কোথায় মানুষের শান্তি? আকাশে-বাতাসে দুপুরে-নিশীথে কেবল বেদনার প্রতিধ্বনি উঠে।

সে আরও ভাবিল–এই পৃথিবীতে কত অন্তহীন নরনারী! সৃষ্টির প্রথম হইতে অনন্ত মানুষের ধারা বহিয়া চলিয়াছে–অনন্ত যুবক-যুবতী প্রেম ও হাসির আনন্দে বাঁচিয়া থাকে–তার পর তারা চলিয়া যায়।

তার মনে হইল–মানুষের দুঃখ অন্যায় ও অজ্ঞানতায়। করিমা আবার ভাবিল–অন্যায় করিয়া মানুষ কী করিয়া বাঁচে? মানুষে মানুষে পার্থক্য কী? একটা মানুষের বেদনা আর একটা মানুষের মনে সমানভাবে বাজে না কেন?–মানুষের সুখ কোথায়? কেমন করিয়া এই লক্ষ্য মানুষকে সুখী করা যায়?

মানুষ কেন পাপ করে? পাপে মানুষ কেমন করিয়া শান্তি পায়? পরকে আঘাত করে কেমন করিয়া মানুষ কাল কাটায়? কেমন করিয়া সে হাসে? কী বিস্ময়!

কত জননীর বুক ভাঙ্গিয়া অনন্ত শিশু আকাশে বাতাসে মিশিয়া আছে। কত প্রেমিক প্রেমিকা কোনো অনন্তে ভাসিয়া চলিয়া গিয়াছে।

তার মনে হইল–মানুষের সুখ কেবল পুণ্যে ও জ্ঞানে। করিমা আবার ভাবিল–এই ভীম প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়াইয়া মানুষ তার দীনতা বুঝুক। আত্মা তার গোপন কথার সাহিত পরিচিত হউক।

উদ্দাম বাতাস অবগুণ্ঠিতা করিমার চোখে-মুখে আসিয়া লাগিতে ছিল। অসংযত অঞ্চলখানি করিমা গায়ের সঙ্গে আঁটিয়া লইল।

দূর পূর্ব-আকাশের মেঘগুলি হিমশীতল বাতাসের সহিত যুঝিয়া যুঝিয়া সরিয়া যাইতেছিল। এই উদ্দাম ও ভয়াবহ প্রকৃতির চাঞ্চল্য করিমার কানের কাছে কি যেন বলিয়া যায়–কাহার সন্ধান যেন দিয়া যায়। তার মন যেন কেমন হইয়া উঠে। একটা দারুণ সীমাহীন হাহাকার ও বেদনা তার মনকে বিব্রত করিয়া তুলে। সে খানিক কাঁদিতে চায়। মৃত্যুর ভিতর দিয়া সে এক তৃপ্তির রাজ্যে চলিয়া যাইতে ইচ্ছা করে। ঊর্ধ্বে আরো সে চায় মহাকাশে বিদ্যুতের মতো সে ছুটিয়া খেলিয়া বেড়ায়।

সন্ধ্যার ছায়া করিমার চক্ষদ্বয়কে আরও ছায়াময় করিয়া তুলিল। করিমা ছাদ হইতে ধীরে ধীরে নিচে নামিল।

.

সেদিন বাতাসের বিরাম ছিল না। শেষ রাত্রে করিমা বাহিরে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন মেঘের অন্তরালে তারাগুলি অস্পষ্ট হইয়া জ্বলিতেছিল।

বাতাস সুপ্ত পৃথিবীকে যেন মথিত করিয়া দিতেছিল।

করিমা ধীরে ধীরে ছাদের উপর উঠিল। অমলিন মেঘের ভিতর দিয়া শেষরাত্রের স্নান আলো ফুটিয়া উঠিয়াছিল। অস্পষ্ট আলোস্তরের উপর দিয়া করিমা দূর প্রান্তরেখার দিকে চাহিয়া রহিল।

মেঘগুলি ধীরে ধীরে আবার জমাট বাঁধিতেছিল?

অব্যক্ত বেদনায় করিমার আত্মাখানি কাঁদিতে লাগিল। তার মনে হইতেছিল, কিছু না, এ পৃথিবীর সবই নশ্বর! মন তাহার এই প্রকৃতির উন্মাদনার ভিতর দিয়া কাহার পানে ছুটিতে লাগিল। কোথায় তিনি?

আকাশ হইতে বৃষ্টি ঝরিতেছিল। করিমা ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। বেশি দূর নহে। বাম পার্শ্বে রায়াহনের দোকান।

করিমা দোকান-ঘরের সম্মুখে যাইয়া দাঁড়াইল। পাথরের মূর্তির মতো বৃষ্টি ও বাতাসের মধ্যে প্রায় অর্ধঘণ্টা করিমা দাঁড়াইয়া রহিল।

অস্ফুট মৃদুস্বরে কপালে হাত উঠাইয়া করুণ বেদনায় বলিয়া উঠিল–ওগো প্রিয়তম–তোমায় সালাম! তাহার পর সে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরিয়া গেল।

.

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দিল্লী হইতে একখণ্ড পত্র পাইয়া রায়হান দুঃখ ও বেদানয় একেবারে নুইয়া পড়িলেন। পত্র পড়িয়া রায়হান অরোধ করিতে পারিলেন না।

এখখানা মানি অর্ডারের ফরম ভর্তি করিয়া রায়হান তখনই দিল্লীর ঠিকানায় একখানা দীর্ঘ পত্র লিখিলেন। পত্রখানি এই রূপ।

ওদেমপুর
প্রিয় দিদি,

তোমার পত্র আমাকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছে। হর্ষ ও বিষাদ চিত্ত গভীরভাবে স্পর্শ। করিয়াছে। যাহা আশা করি নাই, যাহা ভাবিতেও শিহরিয়া উঠি তাহা প্রত্যক্ষ করিলাম।

এই করুণ ও দুঃখ পূর্ণ ঘটনায় কী লিখিব, কী কহিব, কিছুই বুঝিতেছি না।

আমি আসিতেছি–খবর যখন দিয়াছ তখন আর ভয় নাই। প্রথমে যদি আমাকে তোমার সন্ধান জানিবার সুযোগ দিতে তাহা হইলে এত বিভ্রাট ও লাঞ্ছনার মধ্যে পড়িতে না। ব্যথিতের সেবায় শেষ কপর্দক পর্যন্ত ব্যয় করা আমার জীবনের উদ্দেশ্য। জাতি তোমার যায় নাই। যারা তোমার উপর অত্যাচার করিয়াছে–তাহাদের জাতি গিয়াছে। কুড়িটি টাকা পাঠাইলাম।

রায়হান তখনই পত্রখানি হাতে লইয়া ডাকঘরের দিকে গেলেন।

পত্র ডাকে দিয়া ফিরিয়া আসিবার সময় পথে তাহার দেখা হইল নগেন ঘোষের সহিত।

রায়হান সাদরে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কি খুড়ো, কোথায় গিয়েছিলেন?

নগেন আগ্রহে বলিলেন–“এই যে বাবা রায়হান, আপনাকেই খুঁজছি–একটি বিশেষ কথা। তিলিপাড়া হয়ে আসছি।”

রায়হান বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কি কথা খুড়ো?” পার্শ্বে ছায়াময় বৃক্ষতলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া নগেন কহিলেন–“তা হলে এই গাছতলায় একটু বসা যাক”।

রায়হান দ্বিরুক্তি না করিয়া নগেনের সহিত গাছের নিচে দূর্বার উপর উপবেশন করিলেন।

অনেকক্ষণ নিস্তদ্ধ থাকিয়ে নগেন কহিলেন–“আপনি সাধারণ মুসলমান নন! গ্রামের মধ্যে আপনি একজন ভদ্রলোক, তাই বলতে সাহস করছি।”

রায়হান বলিলেন–“মুসলমানের আবার সাধারণ অসাধারণ কী? সব মুসলমানই ভাই ভাই। গ্রামের মধ্যে শুধু আমিই কি ভদ্রলোক?”

নগের সঙ্কোচের সহিত কহিল–“আপনি খুব জ্ঞানী”।

রায়াহন বাধা দিয়া বলিলেন–“আমার চেয়ে সংসারে অনেক কিছু বেশি আপনি দেখেছেন। সুতরাং আমার চেয়ে জ্ঞানী আপনি বেশি।”

নগেন হাসিয়া কহিলেন–“কোরবানির আর কদিন বাকি?”

”আর মাত্র তিন দিন।”

“এটা বুঝি আপনাদের খুব বড় পর্ব?”

“পর্ব বলা যায় না। এ-দিন বড় ভয়ানক এবং পবিত্র।”

“কেমন?”

“মহাপুরুষ ইব্রাহিম খোদার জন্য ঐদিনের পুত্রকে কোরবানি করতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন।“

নগেন ভীত বিস্ময়ে মাথা উঁচু করিয়া বরিলেন–“বটে,তা হলে তো বড় ভয়ানক কথা।”

রায়হান শান্তভাবে কহিলেন–“হ্যাঁ, খুবই ভয়ানক কথা?”

”খোদার জন্য পুত্রকে কোরবানি করবার অর্থ কি?”

রায়হান বলিলেন–“ন্যায় ও সত্য ছাড়া খোদা আর কিছু নয়। ন্যায়ের জন্য পুত্রকে কেন, নিজকে পর্যন্ত বিশ্বের মহামানুষেরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। সব ধর্মেই বলে সত্য ও ন্যায়ের জন্য কষ্ট স্বীকার করাই আত্মার লক্ষ্য। এ কথা জানিয়ে দেবার জন্য খোদা প্রত্যেক মুসলানকে কোরবানি করতে আদেশ দিয়েছেন। কোরবানি মুসলমানের শ্রেষ্ট ধর্ম। পৃথিবীর সকল সভ্য জাতি কার্যত ইসলামের এই আদেশ পালন করে থাকেন। আপনাদের মহাশক্তির সম্মুখে জীব ও পুরোনো কালের নরবলির সহিত ইহার সম্বন্ধ আছে কি?”

“আমি তা জানি নে বাবা। পণ্ডিতেরা জানে।”

“আমি অনেক ঠাকুরকে বলির অর্থ জিজ্ঞাসা করেছি।”

বলির অর্থের কথা আলোচনা না করিয়া নগেন বলিলেন–“আচ্ছা, এই পর্বের আর এক নাম বুঝি বকুরিদ? বরি না কেটে আপনারা গরু কেন কাটেন?”

রায়হান কহিলেন–“গরু জবেহ অথবা কোরবানি করা হয়। গরু কাটা হয় বলতে নাই। বকর আরবি কথা। শব্দটির অর্থ ছাগ নহে।”

নগেন একটু রুষ্ট হইয়া বলিলেন–“গরু কোরবানি করে হিন্দুদের মনে ব্যথা দেবার দরকার কী?”

এই সমস্ত আলোচনার জন্য রায়হান প্রস্তুত ছিলেন না। বিস্ময়ে রায়হান বলিলেন–“আপনারা তো আর কোরবানি করেন না। গো উৎসর্গে যদি পাপ হয়–তবে সে আমাদেরই হয়। গরুর মৃত্যু দেখে বিরক্ত হন! আমরা আপনাদের প্রতিমা দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হতে পারি। মুসলমানের বিশ্বাস প্রতিমা পূজায় মানুষের আত্মা দৃষ্টিহীন হয় এবং মৃত্যু লাভ করে। চোখের সামনে মানুষের এই মৃত্যু মুসলমানকে দিবারাত্রি দেখতে হয়। মানুষকে মৃত্যু ও কুসংস্কার হতে বাঁচাবার জন্য মুসলমানের অস্তিত্ব। প্রতিমা পূজায় তার জীবনকে মিথ্যা করে দেওয়া হয়, তবুও সে অধীর-অত্যাচারী হয় না।”

একটু নীরব থাকিয়া রায়হান কঠিন স্বরে কহিলেন–“বড় বড় শহরে গো-হত্যা হয় তাতে কিছু বলা হয় না–পল্লীর নির্জন কুটির পার্শ্বে মুসলমান বাদ্য না বাজিয়ে নীরবে ধর্ম পালন করে তা ভেবে আপনাদের দরকার কী? গরু তো প্রাচীনকালে হিন্দুরাও খেতেন। গরু খাওযা শরীরের দিক দিয়া ক্ষতিজনক কিংবা পার্থিব কোনো স্বার্থসিদ্ধির অন্তরায় এর ভিতরে যদি কিছু সত্য থাকে তবে তাহা ধীরভাবে সকলের মাঝে প্রচার করলেই তো হয়। জোর করে মানুষের দ্বারা কি কোনো কাজ করান যায়?”

বিরক্তির সহিত রায়হান আবার বলিলেন–“কাহারও ধর্মকার্যে বাধা দেওয়া একেবারে অযৌক্তিক। একে অন্যের দাবি স্বীকার করি না বলেই ইংরেজ জাতিকে মধ্যস্থ মানতে হয়েছে।”

নগেন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“হুঁ।”

.

ত্রয়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ঈদের নামাজ পড়িয়া রায়হান মুরব্বীদিগকে যথারীতি সম্মান জানাইয়া যখন আমেনাকে দেখিতে গেলেন, তখন আমেনার সঙ্গে তাহার স্বামী হামিদও রায়হানের পদচুম্বন করিল।

রায়হান বাধা দিয়া হামিদের হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন–“পাগল নাকি? এসব পুরোনো দস্তুর আমি ভালবাসি না।”

হামিদ হাসিয়া বলিলেন–“স্ত্রীর ওস্তাদ। যার কৃপায় এই রহলাভ করেছি তাকে সম্মান জানাব না?”

রায়হান উপবেশন করিয়া বলিলেন–“পদচুম্বন করা জঘন্য ব্যাপার। মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর অত্যাচার আমি পছন্দ করি না।”

আমেনা কহিলেন–“মায়ের কাছে যেতে পাল্লাম না। মনে কষ্ট হচ্ছে। হয়তো মা কত ব্যথা পাচ্ছে।”

রায়হান বলিলেন–“এ কোনো কথা নয়। তোমার সুখেই তোমার মার সুখ। তাঁর কি স্বতন্ত্র সুখ আছে? তোমার মা সাধারণ শ্রেণীর স্ত্রীলোক নন। ঈদের দিন মায়ের কাছে না যেয়ে যে স্বামীর সুখ বর্ধন করতে ব্যস্ত আছ এতেই তার সুখ।”

একটা লোক আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে সংবাদ দিল–“কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলমানে দাঙ্গা বেধেছে। আপনারা আসুন।”

সহসা রায়হানের মুখ কাল হইয়া উঠিল। মৃদুস্বরে তিনি কহিলেন–“হিন্দু মুসলমানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের দুই জাতির কী হবে বলতে পারি না।”

হামিদ–হিন্দুর উপর বিশ্বাস আমি হারাচ্ছি। একটা মহাজাতির বিশ্বাস ও দাবিকে উড়িয়ে দেবার কী উৎকট আয়োজন!”

উভয়ে বিলম্ব করা সমীচীন নহে ভাবিয়া তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলাভিমুখে রওয়ানা হইলেন। হামিদ বলিলেন–“হিন্দুদের এই অন্যায় প্রতিবাদের কথা আগে যদি জানা যেতো তা হলে আইনের সাহায্যে তাহাদের দাম্ভিকতা অনেকটা রোধ করা যেতো। কী বিচিত্র! এতদিন তাদের ধর্মভাবের উদ্রেক হয় নাই!”

দূর হইতেই শোরগোল শোনা যাইতেছিল। রায়হান কথা কহিলেন না। দক্ষিণ হস্তে বুকখানি চাপিয়া ধরিয়া দ্রুত চলিতে লাগিলেন।

পল্লীর দক্ষিণপ্রান্তে একটা ছোট মাঠে উত্তেজিত হিন্দু-মুসলমান ভীষণভাবে এ উহাকে আক্রমণ করিতেছিল।

দারুণ উদ্বেগে জনতার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রায়হান দেখিলন, ভূতলশায়ী একটা মানুষের মাথা দিয়া রক্তধারা ছুটিতেছে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাহার মানব দুঃখকাতর হৃদয় কাঁদিয়া উঠিল। রায়হান উন্মাদের ন্যায় লোকটিকে বাঁচাইবার জন্য ছুটিলেন। হামিদ দুই হাত দিয়া রায়হানকে বুকের সহিত জড়াইয়া বাধা দিয়া কহিলেন–“এই উত্তেজিত জনসঙ্গের মধ্যে যাবেন না।”

রায়হান বিপুল বলে হামিদকে সরাইয়া ফেলিয়া ভীষণ রক্তবন্যার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। আহত মানুষটিকে বুকের মধ্যে লুকাইয়া রায়হান উচ্চেঃস্বরে কহিলেন–“ওগো মুসলমান ভাইগণ! হিন্দু হলেও সে যে আমাদের প্রতিবেশী! আমাদের সুখ-দুঃখের সহচর। আর মেরো না। যদি মারতে হয় আমার মাথায় মার।”

মুসলমানেরা স্তব্ধ হইয়া মুহূর্তের জন্য দমিয়া গেল। সুযোগ পাইয়া সহসা আহত যুবকটি রায়হানের বুকের ভিতর হইতে উঠিয়া দাঁড়াইল।

হাতে তার তীক্ষ্ণধার দীর্ঘ বল্লম-মূর্তি ভয়াবহ। সে তখন জ্ঞানশূন্য হইয়া গিয়াছিল। তাহার চিন্তা করিবার সময় ছিল না। উন্মত্ত অধীর-পিশাচের মতো সে রায়হানের বুকের ভিতর বল্লম চালাইয়া দিল। রায়হান তখন বলিতেছিলেন–“রমেশ, ভয় নাই, তোমায় বাঁচিয়েছি”–আর কিছু বলা হইল না। রায়হান মূৰ্ছিত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন।

হামিদের মাথায় যদি অকস্মাৎ বজ্রাঘাত হইত তাহা হইলে সে হয়তো তত উদ্বেলিত হইত না, যেমন সে হইল–এই অতি আকস্মিক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখিয়া।

ক্রোধে-দুঃখে সহসা হামিদের শিরায় শিরায় অসুরের শক্তি খেলিয়া গেল। হামিদ মাতা-পিতা-স্ত্রী-বন্ধু সব কথা ভুলিয়া গেল। ব্যাঘের আস্ফালনে সে কহিল–“যাও সকলে, আর কেন? কোনো হিন্দুর দেহ যেন আজ আর মাথায় না থাকে।” হামিদ নিজ হস্তগুলি চালাইতে আরম্ভ করিল।

রক্ত ও শবদেহে ক্ষুদ্র ময়দানখানি আচ্ছন্ন হইয়া গেল। অতঃপর আহত রায়হানকে হামিদ ও অন্যান্য মুসলমানগণ স্কন্ধে করিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে প্রত্যাগমন করিলেন। রায়হানের জীবনের কোনো আশা ছিল না। ধীরে ধীরে নিশ্বাস বহিতেছিল মাত্র।

.

চতুত্রিংশ পরিচ্ছেদ

রায়হান তিন দিন পর যখন চৈতন্য লাভ করিলেন তখন তাঁহার পার্শ্বে আমেনা, হামিদ, আমেনার মা নফিসা এবং রায়হানের চাচি। রায়হানের চাচি অশ্রু বিমোচন করিতেছিলেন।

যথাসময়ে ডাক্তার আসিয়াছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে বল্লম হৃদপিণ্ড বা ফুসফুস ভেদ করে নাই। অত্যধিক রক্তস্রাবে রায়হান অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, ১৫ দিনের ভিতর কী হয় ঠিক বলতে পারি না ঈশ্বরের অনুগ্রহ হইলে রোগী বাঁচবে। তবে তিন মাসের ভিতর রোগী বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারিবে না।

রায়হান চক্ষু মেলিয়া বলিলেন–“একটু গরম দুধ লইয়া আসুন”।

দুধ পান করিয়া অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইয়া কহিলেন–“এত চিন্তার কারণ কী? মানুষকে বিপদের ভিতর দিয়াই বেঁচে থাকতে হয়। ব্যস্ত হবেন না।”

অতঃপর হামিদের দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিলেন–“একটা কথা বলি। কী কী ঘটনা ঘটেছে একটু বল। রমেশ কি বেঁচে আছে? বেচারা না বুঝে আমাকে আঘাত করেছিল।”

হামিদ রায়হানের আরো পার্শ্বে আসিয়া রুক্ষস্বরে কহিল–“রমেশের কথা জিজ্ঞাসা কচ্ছেন? যে নরপিশাচ আপনার বুকে ছুরি হেনেছিল–সে শয়তানের কথা কেন? তার মতো হতভাগ্য কে আছে? প্রাণের মমতা না করে আপনি তাকে বাঁচালেন–অথচ আপনাকেই সে হত্যা করতে উদ্যত হল! মানুষ যে এত বড় নিমকহারাম থাকতে পারে তা জানতাম না।” একটু থামিয়া হামিদ পুনরায় কহিল–“হিন্দুকে আপনি তত ঘৃণা করেন না–তার ফল হাতে হাতে পেলেন। আমিও হিন্দুকে ঘৃণা করতাম না–কিন্তু এই ঘটনার পর আমার মত একেবারে বদলে গিয়েছে। কী ভয়ানক জাতি হিন্দু। ইহাদের কাহারও স্পর্শে কোনো মুসলমানের আসা উচিত নয়।”

রায়হান দুর্বলকণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করিলেন–“রমেশ বেঁচে আছে”?

হামিদ রুষ্ট অবজ্ঞায় বলিলেন–“আছে। আপনার উপর আঘাত করেই সে শৃগালের মতো মুখ ঢেকে পলায়ন করে। সমুচিত শিক্ষা দিবার জন্য তাকে ধরতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। ধরতে পারা যায় নাই। শুনেছি, সে সেই দিনই কলিকাতায় পলায়ন করেছে।”

রায়হান–গোলমাল থেমে গিয়েছে তো?

হামিদ দৃপ্ত হইয়া কহিল–“গোলমাল থামবে? প্রত্যেক হিন্দুর মাথা যেদিন কাটা পড়বে সেই দিন গোলমাল থামবে। কী পৈশাচিক ব্যবহার! মুসলমানের উপর কী অন্যায় অত্যাচার! তাহাদিগকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছি। আরও দিব।”

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রায়হান মৃদুভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আমার জ্ঞানশূন্য হবার পর গোলমাল কি আরও বেড়েছিল?”

হামিদ বলিলেন–“সেদিন ১৭ জন হিন্দুকে হত্যা করেছি। একজনের ছাড়া আর কারো মৃতদেহ ধরা পড়ে নাই।”

একটা দুর্দম্য বেদনা রায়হানের বুর্কখানাকে কাঁপাইয়া গেল। কোনোপ্রকার মানসিক ক্লান্তি শরীরের পক্ষে হানিজনক ভাবিয়া একটা দীর্ঘশ্বাসে রায়হান তাঁহার সমস্ত বেদানাটুকু বুকের ভিতর হইতে ঠেলিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিলেন।

শারীরিক এই অসুস্থতার ভিতর হামিদের এই সহানুভূতিও নিঃস্বার্থ সেবার মূলে রায়হান কেমন করিয়া বলিলেন–হামিদ, তুমি অন্যায় করেছ!

মৌন বেদনায় রায়হান পার্শ্ব ফিরিয়া শুইলেন। . আমেনা ধীরে ধীরে বাতাস করিতেছিল। এমন সময় পাল্কি হইতে অবতরণ করিয়া করিমা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

অভ্যাস মতো রায়হান উপস্থিত অক্ষমতা বিস্মৃত হইয়া উঠিয়া বসিতেছিলেন। করিমা ক্ষিপ্রভাবে রায়হানকে নিরস্ত করিয়া কহিলেন–“আপনার শারীরিক অবস্থার কথা আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন। একটুও নড়বেন না।”

রায়হান লজ্জিত হইয়া বলিলেন–“ক্ষমা করবেন, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”

অতঃপর আমেনাকে বলিলেন–“থাক বু আর দরকার নেই। তুমি আর কত খাটবে? তোমার শরীর খারাপ হবে। চাচি তো আছেন?”

নফিসা বলিলেন–“তুমি আর সে সব কথা ভেবো না, বাপু। মেয়েমানুষের কষ্ট করাতেই সুখ। সেবাতে তাদের আনন্দ।”

রায়হান অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়ে মৃদুস্বরে কহিলেন–“করিম! কতদিন আমাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে? বিদ্যালয়ের সব কাজ সেরে নেওয়া আপনার একার পক্ষে খুবই কঠিন হবে। আমেনা। শুন, সহরবানু তো লেখাপড়ায় খুব উন্নতি করেছে। পড়ার কাজ তাদের হাতে দিয়ে আপনি শুধু সেলাই শিক্ষা দিতে থাকুন। এখানে যে আয় হবে তাতে যদি মেয়েদের বোর্ডিং খরচ না পোষায় তা হলে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। শান্তিপুর থেকে সে ছেলেটি শীঘ্রই কাপড় তৈরি করা শিখে আসবে।”

করিমা ব্যথিত সুরে বলিলেন–“এখন আপনার কোনো কথা না বলাই ভালো। এখন আপনার নিরবচ্ছিন্ন শারীরিক ও মানষিক বিশ্রাম আবশ্যক।”

“এই সমস্ত কথা ভাবিয়াই আমি সুস্থ হব” বলিয়া রায়হান চুপ করিলেন।

.

পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দীর্ঘ চার মাস পর বিছানা হইতে উঠিয়া রায়হান হামিদকে যথেষ্ট আশ্বাস দিয়া দিল্লী চলিয়া গিয়াছেন। বলিয়া গিয়াছেন, যত শীঘ্র সম্ভব ফিরিয়া আসিবেন। রায়হানের দিল্লী যাইবার পর নির্জন নদীর ধারে আঁধারে দারোগা সাহেব একদিন হামিদ মিয়াকে বলিতেছেন–“আপনার বাঁচবার আশা নাই।”

হামিদ জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কোনো আশা নাই দারোগা সাহেব?” হয় দ্বীপান্তর, না হয় ফাঁসি।”

“না, কোনো আশা নাই। আইনের বই খুলে দেখুন। হয় দ্বীপান্তর, না হয় ফাঁসি।”

আঁধারে হামিদের শুষ্ক রক্তহীন মুখখানি দেখা যাইতেছিল না। ভবিষ্যতের বিভীসিকাময় মরণদৃশ্য তাহার বুকখানি স্পন্দিত করিয়া গেল।

ভাব ও করুণাহীন কঠিনতায় অভ্যস্ত দারোগাবাবু কহিলেন–“আপনার উৎসাহে কুড়িজন মানুষ খুন হয়েছে। আপনি নিজে পাঁচ জনকে হত্যা করেছেন। আইনকে অমান্য করতে কেউ পারে না।”

“আমি মুসলমান মুসলমানের উপকার করা কি আপনার কর্তব্য নহে? এই হত্যাকাণ্ডের মূল হিন্দুরা, তারা যদি মুসলমানদিগকে কোরবানি করতে বাধা না দিত তা হলে এ-ঘটনা কখনও ঘটত না।”

“মানুষ হত্যা কোনো রকমে সমর্থন করা যায় না।”

হামিদ স্তব্ধ হইয়া একবার আকাশের দিকে চাহিল। কঠিন ভায়বাহ মৃত্যুকে সে কেমন করিয়া আলিঙ্গন করিবে? মৃত্যু যে এত ভয়ানক তাহা সে কল্পনায়ও আনিতে পারে নাই। কতবার সে মৃত্যুকে উপহাস করিয়াছে। কর্তব্য ও মহত্ত্বের অনুরোধে মরণকে সে মহিমা ভরা বলিয়া সকলের কাছে ঘোষণা করিয়াছে। কিন্তু সে আজ নিজকে নির্দোষ মনে করিয়াও মৃত্যুকে উপহাস করিতে পারিতেছে না। সে বড় বিপন্ন।

সে যদি অপরাধীই হল তবে তাহার মরণে এত চাঞ্চল্য কেন? সে অপরাধকে কী দিয়া ঢাকিবে? দীর্ঘ পার্থিব জীবন অনুতাপ-বেদনার কঠিন আঘাতে সে কত রাঙা হইয়া উঠিবে! জীবনে তার অপরাধের ভার কমিবে কী?

এই আলো ও গানে-ভরা পৃথিবীকে কিনিয়া রাখিবার জন্য সে সব দিবে। সে পথের ফকির হইবে। সে আবার ভাবিল–একটুও কি আশা নাই?

কত সুন্দর এই পৃথিবী! হামিদ কত বইতে পড়িয়াছে–পৃথিবী কিছু নয়–মৃত্যুর ভিতর দিয়া আমরা অনন্ত জীবন লাভ করি। কিন্তু আজ তাহার একি দুরবস্থা।

হামিদকে নিস্তব্ধ দেখিয়া দারোগা সাহেব করিলেন–“একটা পথ আছে। কিন্তু তাহাতে আমার চাকরি না থাকতে পারে।”

একটু উৎসাহিত হইয়া হামিদ নত হইয়া দারোগার পা ছুঁইয়া কহিল–“একজনকে উপকার করতে যেয়ে আপনি না হয় বিপন্নই হবেন। খোদার কাছে আপনার গৌরব হবে।”

দারোগা হামিদকে বাধা দিল না। সোজা ও কঠিন হইয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল।

হামিদের কাতর কথায় একটু হাসিয়া দারোগা কহিল–“শুন, আমি তোমার স্ত্রীর রূপ ও গুণের কথা শুনেছি। তাকে যদি তুমি ত্যাগ করতে পার তাহা হলে নিজেকে বিপন্ন করে তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করতে পারি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *