২৬-৩০. সেই রাত্রে মুর্ছা হইতে উঠিয়া

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

সেই রাত্রে মুর্ছা হইতে উঠিয়া গিরির মনের ভাব সহসা পরিবর্তন হইয়া গেল। চমকিতা গিরি ভাবিল, কাজ ভালো হইতেছে না। ইহার পর হইতে সে খোরশেদের নিকট হইতে নিজেকে একেবারে দূর করিয়া লইল।

কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা! কিছুদিনের মধ্যে গিরির জন্য এমন কিছু ঘটিল, যাহাতে তাহার। জীবন খুবই বিচিত্র হইয়া পড়িল এবং তাহার জ্ঞান ও চিন্তা নূতন গতি প্রাপ্ত হইল।

সুখ, উল্লাস ও গর্বের ভিতর সহসা একদিন কলেরার দৌরাত্মে বাপ-মাকে শ্মশানে রাখিয়া আসিয়া গিরি এক পাশে দাঁড়াইয়া কেবল কাঁদিতেছিল আর নিজের অদৃষ্টের কথা ভাবিতেছিল।

বেদনায় তাহার কয়েক দিন কাটিয়া গেল। অতঃপর নিকটেই দূর সম্পর্কীয় এক কাকার বাড়িতে চলিয়া গেল।

দুঃখের বিষয়, কাহারো অনুগ্রহে কোনো কালে বাচিতে হয় নাই। বাল্যকাল হইতে সে বাপ-মায়ের আদর-সোহাগ পাইয়া আসিয়াছে। পরের বাড়িতে পরের মন যোগাইয়া চলা যে কী বিড়ম্বনা তা সে এতদিনে বুঝিতেছিল।

বাপ-মায়ের মৃত্যুকালেই গিরি খুব সেয়ানা হইয়া পড়িয়াছিল এবং যত দিন যাইতেছিল ততই যেন তাহার বিবাহ বয়স উতরিয়া যাইতেছিল। বিবাহ যে হইবে এইরূপ কোনো আশা সে দেখিতেছিল না।

এমন জীবন যে সম্ভব তা গিরি কোনোদিন ভাবে নাই। তাহার জীবনটা বাহির হইতে কোনো স্নেহ-মমতার অভাবে একেবারে নুইয়া পড়িতেছিল। তার সেই কাকার বাড়িতে সে একটা পরের মেয়ে ছাড়া কিছু নয়।

দুঃখ, বেদনা ও জীবনের এই দুরবস্থার মধ্যে গিরি মনে পড়িতে লাগিল খোরশেদের কথা। কত বড় একটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা তাহাদের মধ্যে বিদ্যমান, তাহা সে প্রথমে ভাবে নাই। খোরশেদ যুবক–সে যুবতী। তর্ক, ন্যায় ও বিচার ডিঙ্গাইয়া মন তাহার খোরশেদের কাছে নত হইয়া পড়িয়াছিল।

কিন্তু যখন সে বুঝিতে পারিল, তাই এই প্রণয়ের কোনো মীমাংসা হইবে না, তখন সে খোরশেদকে দূরে দূরে রাখিয়া নিজেকে সামলাইয়া লইল। খোরশেদ ইহাতে কতখানি বেদনা পাইয়াছিল তাহা সে জানে না।

গিরি এখন কেবল ভাবে–এই দুঃখ-বেদনার মাঝে কে বাঁচিতে পারে? খোরশেদের কথা তার মনে পড়ে। মাঝে মাঝে গিরি বলিয়া উঠে

কীসের ধর্ম?–এত অত্যাচার ও অবিচার যে ধর্মে প্রশ্রয় দেয় সে ধর্মকে অবলম্বন করে কে থাকতে পারে?

প্রথম প্রথম সে মুসলমানকে খুব ঘৃণা করিত। খোরশেদকে যে সে মনে স্থান দিয়াছিল মুসলমান রূপে নয়–হিন্দুরূপে। সে যে মুসলমান এ কথা মনে করিতে সে প্রথম প্রথম ভুলিয়া যাইত।

এই দুর্দিনে যখন সে বুঝিল তার বিবাহের কোনো সম্ভাবনাই নাই তখন তার মনে আসিতেছিল খোরশেদের কথা। সে এখন মুসলমানকে শ্রদ্ধার চোখে দেখিতে শিখিয়াছে। প্রেম, মায়া ও মমতাহীন হিন্দুধর্মকে আর সে জড়াইয়া থাকিতে পারিতেছে না। সে তো মানুষ।

খোরশেদ কি সত্যিই তাহাকে ভালবাসে? গিরি নূতন করিয়া ভাবিল–ভালবাসে।

এমনি করিয়া চিন্তায় চিন্তায় দিনগুলি কাটিয়া যাইতেছিল। তার চাচার মেয়েগুলির বিবাহ হইয়া গেল, তাহার হইল না। হইবার সম্ভাবনাও ছিল না। তবে চাচা প্রতিবেশীদের কথার বাণে অনেক সময় বিবাহের জন্য একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিতেন। কিন্তু যখন অর্থের কথা ভাবিতে হইত তখন সকল উৎসাহ দমিয়া যাইত। গিরির বিবাহ দিবার তার ইচ্ছা ছিল না তা নয়–অবস্থা এমন হইয়া দাঁড়াইল যে সে ইচ্ছার কোনো মূল্য রহিল না।

চাচি গোপনে স্বামীকে কহিলেন–নিজের ঘাড়ে যখন এতগুলি মেয়ে তখন পরের মেয়ে ঘাড়ে লইবার সময় অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে দেখা উচিত ছিল।

সে রাত্রে গিরির ঘুম হইতেছিল না। অনেক রাত্রে চোখ বুজিয়া সে শুনিল-বারান্দার অন্ধকারে চাচা স্ত্রীর সহিত তারই বিষয়ে কী যেন বলিতেছেন। সে উৎকর্ণ হইয়া শুনিল চাচা কহিলেন–“গিরির বিয়ে দেওয়া তো বড় বিপদ হল। তার বাবার কালের যে কয় বিঘা জমি আছে তাই বিক্রি করে ফেলি। তাতে ৭০০ টাকা হবে, বাকি আমরাই দেই।”

চাচি বিরক্তির সহিত কহিল–“গহনার দেড়টি হাজার টাকা কে দেবে?”

“তার মায়ের গহনা তো আছে। আর বেশি কী লাগবে?”

“ও মা!” বলিয়া চাচি বলিল–“সে গহনা না আমার ছোট মেয়ে নিশার গায়ে গিরি পরিয়ে দিয়েছিল? গহনার উপর নিশার মায়া হয়ে যায় নি? কি করে তার গা থেকে সেগুলি খসাবো?”

“নিশা ডবল ডবল গহনা দিয়ে কী করবে?”

“যে জিনিস নিশা অনেক দিন ধরে নিজের জিনিসের মতো করেই পরেছে–তার আর খসান যায় না। জমি বেচে ফেলার কথা বলছো তাই-বা কী করে সম্ভব? ধর গিরির বিয়ে হল–সেই যদি বিধবা হয়ে আমাদের ঘাড়ে ফিরে চাপে তাহলে উপায়?”

গিরি সব শুনিল। সে নড়িল না শুধু নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। একাকী ঘরের মাটির উপর একখানা ছিন্ন কাথার উপর সে শুইয়া ছিল। একবার সে জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকাইল। নিশীতে আজ সে তাহার বেদনা স্পষ্টভাবে বুঝিল। কেমন তার এই দুঃখ-বেদনা? মানুষের দুঃখ-বেদনা হয়, সে কয়দিনের জন্য! দুঃখের কি কোনো মীমাংসা নাই? সে আরও দুঃখকে জয় করিয়া সে কি পুরুষের মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না? নারী বলিয়া একাকী আপনার মতো সে শুকাইয়া মরিবে? পরের জীবন নয়, শুধু নিজের জীবনকে বাঁচাইয়া রাখিবারও কি তার সামর্থ্য নাই?

গিরি ভাবিল–নিরাশা, বেদনা ও অবহেলার মাঝে সে তার এক মুহূর্তও সেখানে তিষ্ঠিতে পারে না।

গিরি যতই চিন্তা করিতে লাগিল খোরশেদ ততই অভিনব বেশে তার মনের ভিতর দেখা দিতে লাগিল। তার মনে হইল, খোরশেদের প্রতি সে অবিচার করিয়াছে। খোরশেদ মুসলমান–তাতে ক্ষতি কী? খোরশেদ তার অতি আপনারা। এ সংসারের দরদ বুঝিবার কেউ যদি থাকে তবে সে খোরশেদ। তার সমাজতার ধর্ম-কাহারো তার বেদনা বুঝিবার ক্ষমতা নাই।

.

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

সেদিন খোরশেদ অফিসেই ছিল। বড় দারোগা আবুল হোসেন মিয়া নিজের সেরেস্তায় বসিয়া ডাইরি লিখিতেছিলেন। এমন সময় একজন হিন্দু আসিয়া বড় দারোগার সম্মুখে দাঁড়াইল।

লোকটির দেহ কাঁপিতেছিল।

তাহার মাথায় একটি চুলও ছিল না। আবুল হোসেন মিয়া লোকটিকে উপবেশন করিতে কহিয়া সমাচার জিজ্ঞাসা করিলেন। সে কহিল, “আমার নাম রমণী। বাড়ি সোনাপুর। গতরাত্রে আমার একটা গহনার বাক্স চুরি গিয়াছে। আমার সর্বস্ব তাতে ছিল।” তাহার পর কাঁদিয়া কহিল–“আমার সর্বনাশ হয়েছে। শুনেছি হুজুর সদাশয় ব্যক্তি। দীন দুঃখীর প্রতি আপনার দয়া আছে। এ গরিবকে হুজুর রক্ষা না করলে আর উপায় নাই। গরিবের মা-বাপ আপনি।”

দারোগা সাহেব কহিলেন–আপনি কাকে সন্দেহ করেন?”

“কাকে সন্দেহ করবো? সে কথা বলতে আমার ভয় হয়।”

“কোনো ভয় নাই। অসঙ্কোচে সব কথা বলুন।”

“বাড়ির কাছে এক ঘর দুর্দান্ত মুসলমান আছে। জানেন তো বাবু, মুসলমানেরা ভয়ানক লোক। তাদের উপরেই আমার সন্দেহ হয়। সেই বেটারা ছাড়া আর কেউ এ কাজ করতে সাহস পায় নাই। দোহাই আপনার! তারা যেন কোনো কিছু শুনতে না পায়, তা হলে অর্থের সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রাণও যাবে।”

বেলা হইয়া গিয়াছিল বলিয়া আবুল হোসেন স্নান করতে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন–“পার্শ্বের কামরায় এক বাবু বসে আছেন। সেখানে যেয়ে আপনি আপনার এজাহার দিন, তিনিই তদারকে যাবেন।”

খোরশেদ নবাবি কায়দায় আরাম কেদারায় বসিয়া আলবোলা টানিতেছিল। লোকটি ‘বাবু’ বলিয়া প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকিল। খোরশেদ কথা কহিল না। অনেকক্ষণ পরে

ওষ্ঠ ভিজাইয়া বিকৃত কণ্ঠে আবার সে কহিল বাবু।

নল হইতে মুখ তুলিয়া খোরশেদ অবজ্ঞার সহিত বলিল–“বারন্দায় বসে থাক, সুযোগ মতো ডাক দিব। হাতে কত কাজ আছে দেখতে পাও না?” আর কথা না বলিয়া লোকটি ভয়ে বারান্দায় জানালার নিচে বেড়া হেলান দিয়া বসিয়া পড়িল।

খোরশেদ কেদারায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল। বড় দারোগা আহারের পর পান চিবাইতে চিবাইতে ঘুমাইয়া গিয়াছেন, তখনও উঠেন নাই। থানার সকলেই আহার করিয়া কেহ নিদ্রিত কেহ গল্প ও হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। খোরশেদ আগেই খাইয়া আসিয়াছিল।

বেলা তখন শেষ। রমণীমোহন তখনও খায় নাই। ক্ষুধা ও মানসিক বেদনায় নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া মাথায় রেশমি চাঁদরখানি পুঁজিয়া দিয়া সে ঝিমাইতেছিল।

সূর্যের ম্লান আলোক-বন্যায় থানা–ঘরের অঙ্গখানি ধৌত হইতেছিল। বেলা শেষের করুণ ছায়া মানুষের মনকে তখন সন্ধ্যাসঙ্গীত শুনাইবার আয়োজন করিতেছিল।

রমণীমোহন হঠাৎ তাহার মাথার একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করিল। ছিঃ ছিঃ! কে যেন জানালা দিয়া তাহার মাথায় থুতু ফেলিয়াছে। রাম, রাম, বলিয়া জানালার পার্শ্বে বসিয়া আছে বলিয়া সে নিজের বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে দিতে সরিয়া বসিতেছিল, সহসা। স্কন্ধের উপর খানিকটা আগুন পড়িল। সে বাপরে বলিয়া উচ্চস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। চীৎকার শুনিয়া বড় দারোগা সাহেব বাসা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। সিপাইরা ঘটনাস্থলে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“বেটা, কী হয়েছে?

রমণী গ্রামে ভদ্রসন্তান বলিয়াই পরিচিত ছিল। এমন দুর্দশা ও অপমানের মধ্যে সে কখনও পড়ে নাই।

সে বড় দারোগাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল–“দারোগা বাবুকে যেন আমার মাথায় থুতু ও হুঁকার জল ফেলিয়া দিয়াছে”।

খোরশেদ আরামে বসিয়া তখনও হুঁকা টানিতেছিল। বড় দারোগার সাড়া পাইয়া সে বাহিরে আসিয়া কহিল–“ওখানে যে একটা মানুষ বসিয়া আছে তা বুঝি নি। অত লক্ষ্য না করিয়া হুঁকার একটু জল ফেলিতে গিয়া টিকা ফেলিয়া দিয়াছিলাম। কাজটা বড় খারাপই হয়েছে।”

আজিজ মিয়া বিরক্ত হইয়া কহিলেন ”আপনি তো সাহেব, বেশ ভদ্রলোক। অফিসিয়াল ওয়ার্ক আপনি এইভাবে করছেন? এজাহার নেওয়া হয়েছে”?

খোরশেদ নিঃসঙ্কোচে রমণীর দিকে একটা রুক্ষ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া কহিল–“হয়েছে”।

.

অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ

তদারক হইতে রমণীর ঘরণীকে তস্কর সাব্যস্ত করিয়া খোরশেদ অনেক রাত্রে নিস্তব্ধ বাসার প্রবেশপথে দাঁড়াইয়া ঝিকে ডাক দিল। ঝি ত্রস্তভাবে দরজার কাছে আসিয়া মৃদুভীত স্বরে কহিল–“বাবা! একটা মেয়ে আপনার সন্ধানে এসেছেন। তিনি বিশেষ কোনো কথা বল্লেন না। সঙ্গে কেউ ছিল না।”

খোরশেদ অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“কোথায় তিনি?–কোন্ সময়ে এসেছেন? আর কেউ কি জানতে পেরেছেন?

“না–সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনি এসেছেন। বেহারারা দরজায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পেছন রাস্তা দিয়ে তারা এসছিল। ও বাসার ঝি আর খুকিরা এসেছিল, উনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন না।”

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া চেয়ারে উপবিষ্ট গিরির পাণ্ডু মুখচ্ছবির দিকে খোরশেদ নির্বাক স্থিরনেত্রে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল।

গিরি উঠিল না–দাঁড়াইল না, কোনো কথা কহিল না। সে শুধু করুণ নেত্রে খোরশেদের দিকে তাকাইয়া রহিল।

খোরশেদ কাপড় খুলিল না। স্বেদবিন্দুগুলি শুভ্র ললাটে শুকাইয়া গেল। ঝি দরজার ধারে অগ্রসর হইতেছিল, খোরশেদ তাহাকে চলিয়া যাইতে কহিল। খোরশেদ জিজ্ঞাসা করিল–“গিরি–কেন আসিয়াছ?”

অকম্পিত স্বরে গভীর আবেগে গিরি কহিল–“তোমার কাছে আসিয়াছি।”

“স্ত্রীলোকের পক্ষে এরূপভাবে পথে বাহির হওয়া ঠিক নয়, তা জান?”

“না।”

“আমার কাছে কেন এসেছ?” গিরির কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ রুদ্ধ হইয়া আসিল। সবই কী ভুল!

সে কহিল–“চন্দ্রকরোজ্জ্বল রজনীকে বুকে দাঁড়িয়ে তুমি যা বলেছিলে তা আমার মনে ছিল। সেই পুকুর ঘাটের পরিচয়টুকু তোমাকে জীবনের বড় আপন করে তুলেছিল। এসেছি আপন মানুষের কাছে–তোমার প্রশ্ন অতি নিষ্ঠুর। তুমি বিশ্বাসঘাতক নও তো?”

খোরশেদ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল–“সে কী কথা? তুমি কী বলছো?”

“গত জীবনের প্রণয় ও ভালবাসার কথা কি ভুলে গেছ! সংসারে আর আমার আপন। বলতে কেউ নাই। আমার দুঃখ ও বেদনার কোনো খবর তুমি নাও নাই। আমি তোমার কাছে এসেছি!”

“কেন?”

গিরির চক্ষু দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সে অতি কণ্ঠে কহিল–“আমি তোমাকে ভালবেসেছি–যেমন তুমি আমাকে ভালবেসেছিলে।”

“আমি কখনও তোমাকে ভালবাসি নি!”

মিথ্যা কথা–তুমি আমার কৃপা ভিক্ষা করিছিলে–তুমি আমাকে ভালবেসে পাগল হয়েছিলে–মন তোমার দিকে গড়িয়ে পড়লেও আমি আমাকে রোধ করেছিলাম। আমি হিন্দু, তুমি মুসলমান!”।

“এখন তো তাই আছি–আমি যার জন্যে পাগল হয়েছিলাম সে কথা জীবনে কাকেও বলবো না। তোমাকে ভালবাসি বলেছিলাম, তার অর্থ-প্রতিশোধ।”

আবেগমাখা কণ্ঠে গিরি কহিল–“আমার বাল্যজীবনে হাসি-খেলার মতো তুমি এত বড় ভুলের দাগ কেটে দিয়েছিলে!”

আড়ষ্ঠ কণ্ঠ বাম হস্তে চাপিয়া ধরিয়া গিরি মাটির দিকে নত হইয়া কহিল–“ভগবান! আমার কী হবে” তাহার সমস্ত মুখখানি রক্তহীন কাগজের মতো হইয়া গেল। সম্মুখে প্রদীপের উজ্জ্বল আলোকে খোরশেদ ঠিক তেমনি ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মানসিক ভাব তলাইয়া দেখিতে গিরি সাহস পাইল না।

খোরশেদ কহিল–কে তোমাকে এখানে আসতে বলেছে?

”আমার বিশ্বাস!”

“তোমার বিশ্বাস তোমাকে ভুল পথে টেনে এনেছে। তোমার সহিত ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু করি নাই। গুরুতর ক্ষতি করা ছাড়া আমা: আর কোনো উদ্দেশ্যে ছিল না।” অনেকক্ষণ উভয়েই স্তব্ধ হইয়া রহিল। খোরশেদ সহজ কণ্ঠে কহিল–“তুমি আমাকে ভালবাস?”

“এখন বাসিতেছি। এখন তাতে কোনো ময়লা নাই। আগে ভীত হয়েছিলাম।”

“কারণ?”

“বাপ-মা মরে গেছেন। পরের কৃপার পাত্র হয়ে থাকতে হচ্ছিলো। তুমি তা জান। পরের বাড়ির বেদনা, অসম্মান ও ঔদাসীন্য আমাকে ভেঙ্গে ফেলেছে। তুমি অনেক কথাই জান।”

“জানি।”

নারীর স্বভাব আমাকে জানিয়ে দিয়েছে–“হিন্দু ধর্ম নারীর জন্য নয়। আমি মুসলমান হতে চাই। তুমি আমার আশ্রয় ও অবলম্বন।”

খোরশেদ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“ধর্ম পরিত্যাগ করতে চাও! তোমার সমাজে কু-সংস্কার ঢুকেছে তাই বলে কী তোমার ধর্ম মিথ্যা!”

“তা হলে হিন্দু হয়েই তোমায় আমি মেনে নিলাম?”

“মুসলমানের পক্ষে হিন্দুকে বিবাহ করা লজ্জাজনক। সমাজে আমার স্থান হবে না।”

“বাইরে মুসলমান হলেও ভিতরে ভিতরে হিন্দু থাকবো।”

“সেটা পাপ।”

“তা হলে আমি মুসলমান হব।”

“কোন্ বিশ্বাসে?”

“যে ধর্মে মানুষকে এমন করে হত্যা করবার অবাধ বিধান আছে, সে ধর্মে আমি কিছুতেই থাকতে চাই না। হিন্দুর নির্মম অত্যাচারে শত শত নারী পথে বেরিয়েছে।” গিরি আবেগে কাঁদিয়া কহিল–“ওগো, আমায় রক্ষা করে। হিন্দু ধর্মে মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারে না। মুসলমান ধর্মে নতুন কিছু বিধান নাই। হিন্দুর লক্ষ্য ঈশ্বর, মহামানুষ মোহাম্মদের মহামানবতাকে স্বীকার করলে তার ক্ষতি হবে না। হিন্দু যদি মুসলমান হয় তা হলে তার। পতন হবে না।”

খোরশেদ সহজ স্পষ্ট স্বরে কহিল–“গিরি ক্ষমা কর। তোমাকে ঘরে স্থান দিলে আমার কলঙ্ক হবে। তুমি চলে যাও। মুসলমান হলেও তুমি হিন্দু। ছেলেমেয়ে তাদের সঙ্গে সামজ-সম্বন্ধ করতে ঘৃণা বোধ করবে। দেশময় কলঙ্ক হবে। যাও দেরি করো না।”

গিরির বুকের ভিতর কে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। তাহার ইচ্ছা হইল সে তাহার দেহটাকে কাটিয়া ছিন্ন ভিন্ন করিয়া ফেলে। সে তাহার অবস্থার কথা ভাবিয়া শিহরিয়া উঠিল। তাহার আরও ইচ্ছা হইল, এই পৃথিবীটাকে সে চূর্ণ করিয়া ফেলে। মিথ্যা শাসন, মিথ্যা বিধানকে দলিয়া দেয়।

সহসা গত জীবনের সোনালি স্বপ্নকে ফিরাইয়া আনিয়া সে কহিল–“খোরশেদ! তুমি যদি আমায় ভালবাস, তাহলে পৃথিবী তোমার ও আমার কাছে সুন্দর হয়ে উঠবে। তোমার প্রতারণার কথা ভুলে যাও।”

খোরশেদ নিষ্ঠুরভাবে কহিল–“আমি তোমায় ভালবাসতে পারি না।”

“আমি হিন্দু, তাই ভালবাসতে ভয় পাও? কিন্তু জেনো, আমার ভিতরে এমন কিছু আছে যা সারা ত্রিভুবন খুঁজেও তুমি পাবে না।”

“প্রেমের জন্য যে ধর্ম পরিত্যাগ করতে চায় সে নরাধম। ইসলামের তুমি কি দেখেছ?”

“স্বীকার করি। খোরশেদ ক্ষমা করো। তুমি জানো–কেউ আমার নাই; সংসারের উপর একটা ভার ছাড়া আর কিছু নই। প্রথম জীবনে আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম–বোধ হয় বিবাহের জন্য নয়। মানুষের স্বভাবকে যে ধর্ম অস্বীকার করে সে ধর্ম ধর্মই নয়! তাই তোমার হাত ধরতে চাই। পর হয়েও কি তোমার কাছে থাকতে পারবো না?”

খোরশেদ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া কহিল–“যেভাবে তুমি থাকতে চাও, সেটাও আপত্তিজনক। মুসলমান হলেও তোমায় আমি এভাবে আপন বলে স্বীকার করতে পারতাম না। তুমি যাও, তোমাকে যেতে হবে। থানার লোকে জানতে পারলে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। ঊষার অনেক আগে তুমি চলে যাও। আমার চাকরি নষ্ট করো না”।

“যখন এসেছি তখন আর আমি কোথায় যাব? জাতি আমার নাই, জাত থাকলেও অবশ্য কোনো লাভ ছিল না। আবার বলি পরের মতো, বোনের মতো, অতিথি হয়েও কি তোমার কাছে থাকতে পারবো না? পৃথিবীর সব দুয়ারই কি আমার সম্মুখে রুদ্ধ হয়ে যাবে?”

খোরশেদ–“তা তো আপত্তিজনক।”

গিরি আর কিছু কহিল না–বিদায় প্রার্থনা করিল না। মৌন-নির্বাক হইয়া সে বাসা ঘরের উঠান অতিক্রম করিয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইল।

.

উনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

রোজার মাসে খোরশেদের উচ্ছলতা অনেকটা কমিয়া গিয়াছে। সে অনেকটা সংযমী হইয়াছে।

।একটা বহুদিনের পুরানো ডাকাত সম্প্রতি রামগড় অঞ্চলে কোনো দুরভিসন্ধিতে গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া খোরশেদ ছদ্মবেশে ট্রেন চড়িয়াছিল। পায়ে একজোড়া পামসু, পরনে পাজামা গায়ে মলমলের পিরহান, মাথায় একটা কিস্তি টুপি, হাতে বিলেতি ব্যাগ।

তাহাকে একজন পীরসাহেব বলিয়া মনে হইতেছিল। গাড়ির ভিতর অনেকে তাহার সঙ্গলাভের জন্য ব্যস্ত হইল। অনেক যুবক বৃদ্ধ তাহার পদধূলি গ্রহণ করিল।

খোরশেদ গম্ভীরভাবে সকলের কাছে স্বীয় ধর্মের মহিমা কীর্তন করিতেছিল। একজন, খ্রিস্টান সেখানে বসিয়াছিল। সে কহিল–“পীর সাহেব, ধর্ম সম্বন্ধে যাই বলেন, খ্রিস্টান ধর্মের মতো ধর্ম নাই। আপনি এবং আপনার শিষ্যবর্গ অন্ধকারে পড়ে আছেন। আমরা আলোক রাজ্যের সন্ধান পেয়েছি।”

খোরশেদ বিরক্ত হইয়া কহিল–“তুমি অন্ধ। খোদা তোমাকে নরকগামী করবেন।”

একজন ঠাকুর বলিলেন–“হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম–সবই এক, রাম রহিমে কোনো পার্থক্য নাই।”

খোরশেদ গম্ভীরভাবে কহিল–“কাফের ছাড়া অন্য কেহ এ কথা বলতে সাহস পায়।” রাত্রি ১০টা পর্যন্ত সে যাত্রীদের সহিত পীরের মতো বহু বচসা করিল।

যখন দেরাজপুর স্টেশনে ট্রেন থামিল তখন রাত্রি এগারটা। খোরশেদের গাড়িখানি। তখন প্রায় খালি। সে বিছানা পাতিয়া শুইবার চেষ্টা করিতেছিল। এমন সময় একটা যুবতী পার্শ্ব-প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিল। বাম হস্তে একটা ক্যাশবাক্স, দক্ষিণ হস্তে একটা টিফিন বাক্স লইয়া যুবতীর সঙ্গে একটা বৃদ্ধ উঠিল।

যুবতী কহিল–“কলিকাতা হতে রামগড় একেবারে কম দূর নয়। রোজার সময় আরও বেশি কষ্ট হয়।”

খোরশেদ কৌতূহলপর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“তোমরা কোথায় যাবে?”

বৃদ্ধা কহিল–“আপনার বেশ দেখে মনে হচ্ছে আপনি সংসারবিরাগী পুরুষ। তাড়াতাড়িতে পুরুষের গাড়িতে উঠে পড়েছি। রোজার মাসে আপনার ন্যায় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়া আমাদের নসিবে ছিল।”

পীর সাহেব কহিলেন–“তোমার মুনিব কোন গাড়িতে আছেন, দেখে উঠিয়ে দিয়ে গেলেই তো ভালো হতো।”

যুবতী নম্রভাবে অথচ লজ্জাহীনার মতো কহিল–“মৌলানা সাহেব, আমাদের কোনো মুনিব নাই। আপনি পবিত্র পুরুষ, আমাদের সঙ্গে কথা বল্লে আপনার পাপ হতে পারে। আমরা পতিতা।”

খোরশেদ বিছানা হইতে উঠিয়া বিস্ময়ে কহিল–“তোমরা পতিতা! মুখে রমজান মাসের মহিমা কীর্তন, এ তো কোনোকালে শুনি নি?”

যুবতী বলিল–“দয়া করে যখন কথা বলেছেন তখন উত্তর করলে খোদার কাছে পাপী হবো না।”

খোরশেদ অধিকতর বিস্ময়ে বাধা দিয়া কহিল–“তোমরা মুসলমান?”

যুবতী কহিল–“হ্যাঁ হুজুর, আমরা মুসলমান।”

খোরশেদ অবাক হইয়া গেল। বক্ষ তার অপরিসীম অকৃত্রিম দুঃখে ভাসিয়া যাইতেছিল। অস্পষ্ট বেদনা-ভরা স্বরে সে বলিয়া উঠিল–“ইসলামের প্রতি এই অবমাননা? ইসলাম তো নারীকে যথেষ্ট সুবিধা দিয়াছে। তবে এ পিপ কেন?”

খোরশেদ আর কোনো কথা কহিল না।

রাত্রি যখন দুইটা তখন বৃদ্ধা ও যুবতী পর দিবসের রোজার জন্য কিছু খাইয়া লইল। খোরশেদ সবই দেখিল।

০ ০ ০ ০

গন্তব্যস্থানে যাইবার আর বেশি দেরি ছিল না। স্টেশন হইতে নামিয়া সোজাসুজি থানায় যাইয়া যাহা করিবার তাহা করিতে হইবে।

খোরশেদ একটা চুরুট ধরাইয়া শেষ রাত্রের আমোদকে আরও বাড়াইয়া তুলিতেছিল, আর ভাবিতেছিল, ইসলামের মধ্যে পতিতা।

সহসা যুবতী জিজ্ঞাসা করিল–“হুজুর, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমার ভুল হতে পারে।”

খোরশেদ কহিল,–“বল।”

যুবতী বলিল–“কয়েক বৎসর আগে রামপুর জেলার মহেন্দ্রনগরের থানায় ঠিক আপনার মতো দেখতে এক দারোগা ছিলেন। তিনি মুসলমানকে বড় ভালবাসতেন। সে বড় দুঃখের কথা। আমি তাকে পিতা বলে জানতাম। আকৃতির এমন আশ্চর্য সাদৃশ্য আর কোথাও দেখি নাই।”

খোরশেদ বলিয়া উঠিল–“আমিই সেই দারোগা।”

যুবতী সহসা আকুল আবেগে উন্মাদিনীর মতো খোরশেদের পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

খোরশেদের মাথার ভিতর সহসা একটা অস্পষ্ট স্মৃতি জাগিয়া উঠিল। সে বিস্মিত সহানুভূতিতে কহিল–“কি কথা, খুলে বল দেখি বাপু।”

যুবতী বলিল, “আমি আজিজ মিঞার বৌ।” খোরশেদ সহসা একটা দারুণ অস্বচ্ছন্দতায় গাড়ির বেড়ার উপর পড়িয়া গেল।

যে রাত্রে আজিজ-পত্নী থানায় খোরশেদের সহিত দেখা করে, জমিদারদের প্ররোচনায় বরকন্দাজদের সাহায্যে সেই রাত্রেই তাহাকে সরাইয়া ফেলা হয়। এই কাজটা গোপনেই সিদ্ধ হইয়াছিল। ফলে জমিদারেরা নিষ্কণ্টক হইতে পারিয়াছিল।

খোরশেদ একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া যুবতাঁকে জিজ্ঞাসা করিল, “তাহলে কী করা যায়?”

যুবতী কহিল–“আপনি আমার পিতা। পিতার সঙ্গে পথের মাঝে দেখা হয়েছে, আর আমি আপনাকে ছাড়বো না। আমাকে রক্ষা করবেন। আমার গত সম্মান ফিরিয়ে দেবেন। তা হলেই আমি মানুষের মাঝে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে সাহস পাবো।”

খোরশেদ আগ্রহে কহিল–“তাহলে আর দেরি করে দরকার নেই তোমার সঙ্গে যে সব জিনিস আছে, এগুলি বাইরে ফেলে দাও। আমি আর টাউনে নামবো না, তোমায় নিয়ে। একেবারে দেশে যাবো। তোমার ভয় নাই, কোনো কথা আমা হতে প্রকাশ হবে না। আমাদের গ্রামে একটা শিল্প-বিদ্যালয় আছে, সেখানে বহু মেয়ে পড়ে এবং কাজ শেখে। তোমার সব খরচ আপাতত আমি বহন করবো। সেখানে কাজ শিখে সংসারে তুমি স্থান। করে নিতে পারবে।”

অসময়ে রায়হান সন্ধ্যাকালে একখানা পাল্কিসহ খোরশেদকে উপস্থিত হইতে দেখিয়া –বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না। খোরশেদকে সম্ভাষণ জানাইয়া সহসা একটা কথা মনে করিয়া রায়হান উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন–“খোরশেদ গিরিকে পেয়েছ?”

খোরশেদ স্থিরভাবে কহিল–“না।”

ক্লান্ত খোরশেদ মাটির উপর বসিয়া পড়িয়া কহিল–“রায়হান ভাই, একটু বসতে চাই, কিছু থাকলে এনে দাও; আমাকে এখনই ফিরতে হবে! নইলে ডিসমিস্ হবার সম্ভাবনা।”

ঘরের ভিতরে চেয়ারখানি টানিয়া দিয়া রায়হান বলিলেন–“বল কী? বাড়ি যাবে না? গুরুতর কিছু হয়েছে নাকি? পাল্কির ভেতর ইনি কে? এ তাড়াতাড়ির অর্থ কী?”

খোরশেদ কহিল–“এর জন্য আমি এসেছি। এর কেউ নেই। তোমার স্কুলের ইনি একজন ছাত্রী।”

.

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আমেনা রায়হানকে কহিল–“ওস্তাদ সাহেব, এ-সব কী শুনছি?”

রায়াহন–“কোন্ সম্বন্ধে কথা বলছো?”

“আমার বেয়াদবি মাফ করবেন, জীবনে আপনাকে যতটা আপনার মনে করি এমন আর কাউকে মনে করি না। আমার বিশ্বাস আমার মনের কথা আপনাকে বল্লে আপনি আমাকে আরও অধিক করে ভালো জানবেন।”

“নিশ্চয়ই–আমি তোমার ওস্তাদ নই,আমি তোমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু। কী কথা? নির্ভয়ে বলো!”

“আমার যেন কেমন বোধ হয়। এতকাল পরে আমি লজ্জাহীন ও ছোট বলিয়া প্রতিপন্ন হব। মনের ভাব ব্যক্ত করতে অনুমতি চাই।”

“তুমি কি কখনো আমার কাছে কোনো কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করেছ? ওস্তাদের কাছে কোনো কথা গোপন রাখতে নাই।”

“একটা অতীত কথা যা অত্যন্ত বেদনাব্যঞ্জক। আপনার নিকট হতে গোপন করে রেখেছি। সে অনেক দিন আগেকার কথা। সে কথা বলতে আমি পারি না। বর্তমানে একটা নূতন কথা এসে জুটেছে তাই বলতে চাই।”

“আচ্ছা, এখনকার যে কথা তাই বল।”

“আমাকে বিবাহ দিবার জন্য মা পীড়াপীড়ি কচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করি, কে কে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন? এই সমস্ত কথা মাকে জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ বোধ করি। আপনাকেও জিজ্ঞাসা করতাম না যদি আপনি অন্য কেউ হতেন।”

“আমেনা আমার প্রিয় শিষ্যা! এ কি তুমি অন্যায় মনে কর?”

“আপনি আমার ওস্তাদ। কেমন করে বলবো!”

“করি–খুবই অন্যায় মনে করি,–যিনি এই কার্যে লিপ্ত হবেন তিনি আমার মনের উপর খুবই অত্যাচার করবেন। তিনি অত্যাচারী, আমার কেউ নয়।”

“সে যদি অত্যাচারী হয় তবে সে আমি।”

আমেনার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। মুখ ফিরাইয়া কাপড়ে চোখ ঢাকিয়া আর্তকণ্ঠে সে কহিল–“গুরু গুরু, আমায় ক্ষমা করুন, আমায় অভয় দিন, বলিব কী? আমি যে ছাত্রী, আপনি যে আমার গুরু!”

রায়হান সংযতকণ্ঠে কহিলেন–“বল।”

আমেনা দুই হাত এক সঙ্গে তুলিয়া ঊর্ধ্ব দিকে চাহিয়া বলিল–“এমন কোনো কথা নাই যা ওস্তাদের কাছে বলা যায় না।”

আমেনার চক্ষু ঊর্ধ্ব দিকেই নিবদ্ধ রহিল। হাত দুখানি মাটির উপর নামাইয়া দিয়া সম্মুখদিকে একটু নত হইয়া শীতল রক্তহীন মুখে সে কহিল–ওগো গুরু, ওগো ওস্তাদ! তখনও আমার বিবাহ হয় নাই যখন আপনার পায়ে নিজের সবকিছু সুখ-দুঃখ রেখেছিলাম। একবারও কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করলে না। আমার জীবন ও আত্মার গুরু আপনি আমার সুখ ও দুঃখে আপনার অনুভূতি আছে। একবার ভুল হয়েছে, আর যেন না হয়। আমি অবিবাহিতা থাকব।”

মুহূর্তে রায়হানের সম্মুখে একটা নূতন পৃথিবী ভাসিয়া উঠিল। যে কথা আমেনা কোনোকালে প্রকাশ করিতে চাহিয়াছিল না, কথা প্রসঙ্গে তাহা বলিয়া ফেলিয়া সে রায়হানকে স্তব্ধ করিয়া দিল। রায়হান বিচলিত হইয়া পড়িলেন। নিজকে সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া রায়হান ধীর সংযত কণ্ঠে বলিলেন,–“প্রিয় আমেনা তুমি ভিতরে ভিতরে এতকিছু করে বসে আছে। তোমার সঙ্গে আমার কি সম্বন্ধ তা জান?”

“জানি, ভালো করে জানতাম ও জানি।”

রায়হানের দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। আর্দ্র কণ্ঠে রায়হান কহিলেন–“শিশু তুমি, বুঝে নিজেকে এত প্রশ্রয় দিয়েছ। ওস্তাদের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা গভীর নহে বুঝলাম। কই, একদিনও তো তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করো নাই?”

আমেনা কুণ্ঠায় কহিল–“জিজ্ঞাসা করি নাই”

”এমন কিছু নাই যা গুরুর কাছে জিজ্ঞাসা না করা যায়।”

“আমার অপরাধ হয়েছে?”

রায়হান বলিলন–“হ্যাঁ, তোমার অপরাধ হয়েছে।”

আমার ভুল ও সত্য আপনার কাছে নিবেদন করলাম–আপনার আজ্ঞা মাথায় পেতে নেবো। শাস্তি যদি দিতে হয় দিন।”

“তা হলে তুমি আমার যথার্থ ছাত্রী। হৃদয়ে অসীম আনন্দ লাভ করলাম।“ রায়হান দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন–“আমার আজ্ঞা মাথায় পেতে নেবে?”

আমেনা উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহজভাবে কহিল–“আমার গুরু ভক্তি মিথ্যা নহে।”

“ভালো তাহলে তোমায় বিবাহ করতেই হবে। কোনো কথা বলতে পারবে না। কিছু ভাবতে পারবে না।”

“প্রতিজ্ঞা করলাম তাই করবো–কিন্তু একটা কথা; প্রতিবাদ নয়।”

“বল।”

একবার তো বিবাহ হয়েছিল–আর কেন? মা কি আমায় ভার মনে করেছেন? তাহলে আমি আপনার কাছে যাই। জীবন সেবার দ্বারা কাটিয়ে দেব। তাতেই চিত্তে সুখ ও সান্ত্বনা আসবে। বিশ্বে আমার কোথাও শান্তি নাই। আপনি ছাড়া কেউ আমায় চেনে না।

“আবদুল হামিদ শিক্ষিত যুবক। আত্মা তার অন্ধ নহে। সেখানে অত্যাচার ও অসম্মানের কোনো ভয় নাই। সে তোমায় চিনবে–তোমার মনে সেখানে মর্যাদা হবে।”

ওড়নার আঁচল ধরিয়া আমেনা দেয়ালে মক্কা শরীফের ছবির দিকে চাহিয়া বলিল–“আপনার আজ্ঞা এই”?

“হ্যাঁ।”

পায়ের দিকে মুখ করিয়া অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া আমেনা মৃদু স্বরে কহিল”এক মুহূর্তও ভাবতে দেবেন না? আপনার আজ্ঞা যেন আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করতে পারি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *