১৬-২০. আমেনা যখন দেখিল

ঘোড়শ পরিচ্ছেদ

আমেনা যখন দেখিল সংসারটা তার বিশ্বাস ও কল্পনাকে একেবারেই ছাই করিয়া দিয়াছে তখন সে একেবারে মৌন হইয়া গেল।

শ্বশুরবাড়িতে আমেনার সঙ্গে ছিল মাত্র একখানা কবিতার বই। বাক্সের মধ্যে কাপড়ের নিচে সেখানাকে সে লুকাইয়া রখিয়াছিল। দুপুররাতে মানুষ যখন চেতনাহীন হইয়া পড়িত তখন সে দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া একটা মেটে প্রদীপ জ্বালিয়া করুণ ঝঙ্কারের মধ্যে আপনাকে হারাইয়া ফেলিত। আহা! মানুষের জীবন কী ভয়ানক ও যন্ত্রণাপ্রদ! কেবল আঁখিজল ও বেদনা লইয়া মানুষের জীবন ধারার সৃষ্টি–আমেনা ভাবিত। আমেনা স্বপ্নেও ভাবে নাই তাহাকে এমন করিয়া বিসর্জন দেওয়া হইবে। সীতাকে অরণ্যে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছিল সে কথা আমেনা”সীতার বনবাস’ পড়িয়া জানিয়াছিল। তার ভাই কি তাহাকে সাগরে ফেলিয়া দিয়া মুক্তি লাভ করিলেন? সত্য সত্যই যদি সাগরে ফেলিয়া দেওয়া হইত তাহা হইলে তাহাকে এমন অসম্মানও বেদনার মধ্যে বাচিতে হইত না। আমেনা আপন। মনে এইসব কথা ভাবে।

এমন আশ্চর্য বিবাহ সে কোনোকালে দেখে নাই। সে বুঝিয়াছে তাহার ভাই সত্য সত্যই একটা হৃদয়হীন প্রতারক। সে একটা প্রতারকের ভগ্নি! এ বেদনা-এ অসম্মান তাহাকে মাথা পাতিয়া লইতে হইবেই তো।

বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ি আসিয়া যখন গিলিট-করা গহনাগুলির ছলনা ধরা পড়িল তখন বাড়ি সুদ্ধ লোক একেবারে অবাক! কেবল অবাক হইল না তার চাচিশাশুড়ী। শ্বশুর প্রতারণার অপমানে গর্জিয়া পুত্রকে ডাকিয়া কহিল–এই হারামজাদি মাগীকে এখনই তালাক দিয়ে পথে তুলে দাও।

আমেনা বিস্ময়-বেদনা স্তব্ধ হইয়া গেল। অশ্রুহীন দুটি করুণ আঁখি নত করিয়া সে নির্জনে শ্বশুরের পা ধরিয়া স্বরে কহিল–তাহার ভাই ইতর ও ছোটলোক হইলেও সে ভালো হইয়া তাহার শোধ দিবে। তাহার মাথায় যেন বিপুল অসম্মান চাপান না হয়।

দুপুর-রাতে স্বামীর হাত ধরিয়া সে কাঁদিয়া কহিল–স্বামীন! গহনা দিয়া তোমাকে যতটুকু না পূজা করিতাম, প্রেমভরা হৃদয় দিয়া তার চেয়ে ভালো করে তোমায় পূজা করবো।

স্বামী হুঁকায় একটা কড়া দম দিয়া তাহাকে ঘর হইতে সেদিন বাহির করিয়া দিয়াছিল। আহা! সারা রাত্রি বারান্দায় শীতের ভিতর আমেনা দাঁড়াইয়া কাঁদিয়াছিল। স্বামী ঘরের ভিতর হইতে কহিতেছিল–ডাক্তারী পড়তে যাচ্ছি। তোর ভাই যদি ওয়াদা মতো মাসে মাসে টাকা না দেয় তবে আর আশা নাই। জানিস, আমি পিতৃভক্ত। পিতার ক্রোধকে উপেক্ষা করে সামান্য নারীকে ভালবাসতে পারি না।

আমেনা বলিয়াছিল স্ত্রীলোক তো কর্তব্যানুরোধে স্বামীর কথাকে মায়ের কথা অপেক্ষা অধিক মূল্যবান মনে করে।

এনায়েতুল্লা লেপ ফেলিয়া কথার উপর কথা বলার অপরাধে আমেনাকে প্রহার করিয়াছিল।

যাহা হউক, বিবাহের পর খোরশেদ এনায়েতুল্লাকে এক পয়সাও দেয় নাই। জমি বিক্রয় ও স্ত্রীর গহনা বন্ধকের কথা বলিয়া আমেনার শ্বশুর নজির মিঞা পুত্রের কাছে মাসে মাসে ৫০ টাকা করিয়া পাঠাইতেছিল।

পিতার সুপুত্র এনায়েত কলিকাতায় কী করিতেছিল তাহা বলিতে লজ্জা করে। দুঃখ, বেদনা, অপমান, অসম্মানে শ্বশুরবাড়িতে আমেনার প্রায় এক বছর কটিয়া গেল।

বৈশাখ মাসে অনবরত কয়েকদিন ধরিয়া প্রকৃতি বাদল কুক্কটিকা সমাচ্ছন্ন। একখানি পত্র হাতে লইয়া আমেনাকে চমকিত করিয়া সহসা নজির মিঞা পুত্রের ঘরে প্রবেশ করিয়া বধুকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন–“দেখ মেয়েটি! তোমার উপর আমরা বিশেষ অসন্তুষ্ট না। হইলেও, এই জুয়াচুরির প্রতিশোধ নেবার জন্য তোমাকে কষ্ট দিব। আজ হতে তুমি ঐ ঘোড়ার ঘরে থাকবে। ছালা পেতে শোবে। খাপরায় খাবে, হাঁড়িতে পানি ঢেলে মুখ হাত ধোবে। বুঝলে?”

আমেনা মাথা নত করিয়া মৃদুস্বরে অতি দুঃখ কহিল,–“বুঝলাম।”

“শুধু বুঝলে হবে না–আমার কথা বেদের কথা!” আমেনা চোখের জল ঘোমটার আবরণে ঢাকিয়া রাখিয়া মাটির দিকে চাহিয়া কহিল–“আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য। ভাই প্রতারণা করেছেন–জামাইকে আদনা চিজ থালাখানাও দেওয়া হয় নাই। আমাকে মেটে বাসনে খেতে দেবেন তাতেই আমার চলবে।”

“তোমার ধৈর্য-সহিষ্ণুতায় আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। আমার এইসব কথায় তুমি একটুও কাঁদছ না। আমি চাই প্রতিশোধ–তোমার বুকে আগুন জ্বালাতে। আমার কথা ও ব্যবহারে একটুও বেদনা বোধ করো না। এতে যে বেশি করে আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ হবো তা তুমি জান?”

“তা জানি না, বুঝতে চেষ্টা করেও বুঝতে পাচ্ছি না।”

“দেখ, তুমি থিয়েটারি কথা সাধারণত বলে থাক। ভালো মানুষের তো এ লক্ষণ নয়? তোমার কথাগুলি পরিষ্কার বাধুনি দেওয়া। আমার সন্দেহ হয়, তুমি বেহায়া। যা তোমরা জবানি দিয়ে তোমার দুর্গতির কথা তোমার ভাই ও মায়ের কাছে লিখবো–আজই লিখবো।”

“আমি নিজের হাতেই এসব কথা লিখে দিতে রাজি আছি।”

নজির বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া কহিল–“কী ভয়ানক! হায়, আমার বাপ দাদার জাতি গেল! তুমি কি লেখাপড়া জান? জুয়াচোর শাহাদত না বলে ছিল–মেয়ে লিখতে-পড়তে জানে না–একেবারে শরীফজাদি! এতকাল এ কথা গোপন রেখেছো? এ কথা লোকে শুনলে কী বলবে! বেশ! লেখ। তোমার দুঃখময় কাহিনী নিজ হাতে লিখে দাও, চিঠিখানা আজই তোমার ভায়ের কাছে পাঠাব।

দোয়াত কলম আনা হইল! শ্বশুরের হুকুমে আমেনা কাগজ-কলম লইয়া লিখিল :

বর্ধমান
বখেদমতেষু,
অসংখ্য আদাব জানিবেন। মায়ের ও আপনার কোনো সংবাদ না পাইয়া বড় চিন্তিত আছি। আমি বোধ হয় খুব সুখে আছি৷এই আপনাদের বিশ্বাস।তাই এই দীর্ঘ সময়ে আমার কাছে, একখানা পত্র লেখাও দরকার মনে করেন নি।

সত্য কথা বলিতে কি৷আমি সুখেই আছি! শ্বশুর-শাশুড়ির অসীম দয়া ও মমতায় আমি ভাগ্যবতী। তা হলেও আমার ইচ্ছা করে এখানকার আমার অতি প্রিয়তম আত্মীয়দের সংবাদ আপনারা লয়েন। আমি খুব সুখে আছি, আমার জন্য একটুও চিন্তা করিবেন না।

আপনার ফিদবী।
আমেনা।

পত্রখানি আমেনার হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া নজির পড়িয়া দেখিল। উহার প্রতি ছত্র নজিরের প্রতিহিংসাপরায়ণ চিত্তকে আরো জ্বালাময় করিয়া তুলিল। সে কী চায়? সে চায়। তার পুত্রবধুর দুঃখ তাহার আত্মীয়-স্বজনের মনে ও মুখে কালি ফুটাইয়া তোলে এবং এই করিয়া সে তার মনে সান্ত্বনা লাভ করে।

নজির চিঠিখানা শতভাগে ফাড়িয়া ফেলিল। সে ইচ্ছা করিল, সে নিজেই একখানা চিঠি লিখিবে। তাতে থাকিবে আমেনার দুঃখ-দুর্গতির কথা।

সেই দিন হইতে আমেনাকে একখানা পুরোনো সেঁতসেঁতে কোণার ঘরে বাস করিতে দেওয়া হইল। বাপের বাড়ি হইতে সে কোনো বিছানা আনে নাই, সেই কথা জানাইয়া তাহাকে বিছানা দেওয়া হইল একখানা পুরোনো ছালা। আমেনা ভিখারিনী–সে মেয়ে মানুষ।

সেদিন উঠানে বসিয়া দাসীদের সঙ্গে আমেনা মাছ কুটিতেছিল। দাসীদের জন্য এক এক খানা আসন দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু আমেনা খালি মাটিতেই বসিয়া কাজ করিতেছিল।

আমেনার শাশুড়ি তাহাকে বলিলেন–“কুয়া থেকে ঘড়া দশেক পানি তুলে নিয়ে আয়। সেখানে এখন কেউ নাই।”

আমেনা বাক্য ব্যয় না করিয়া ঘড়া লইয়া পানি আনিতে গেল।

দেউড়ীর ধারেই গোয়াল-ঘর। দূরে বাড়ির চাকর মধু গোয়ালঘরে গাই দুটিকে জাব ঠিক করিয়া দিতেছিল।

আমেনা মাথায় ঘোমটা দিয়া খোদাকে ধন্যবাদ দিয়া পানি তুলিতে লাগিল।

এক ঘড়া-দুই-ঘড়া-চার ঘড়া-আমেনা আর পারে না। আঙুল ফাটিয়া তাহার রক্ত বাহির হইয়া পড়িল।

মধু দূর হইতে লক্ষ্য করিতেছিল–এই অবহেলিতা মলিন বসনা বৌটির অবস্থা। কৃষক হইলেও সহানুভূতির আবেগে স্থান কার ও পাত্র বিবেচনা না কারিয়া সে দৌড়াইয়া আসিয়া আমেনার হাত হইতে রশি লইয়া কহিল–ভাবিজান, আপনি সরুন, পানি আমি তুলে দিচ্ছি–এতগুলি চাকরানী থাকতে আপনার এই কষ্ট!

আহা! মধুর একটা সেয়ানা ভগ্নি এই সেদিন অনাদর ও অবহেলায় শ্বশুড় বাড়িতে প্রাণত্যাগ করেছিল।

দেউড়ীর ওধার হইতে কে একজন বলিয়া উঠিল–“আকাশ থেকে বজ্রাঘাত হোক! ওমা, সে কি! ছিঃ! ছিঃ! মধু বৌয়ের হাত ধরে!”

সত্যিই যেন বজ্রাঘাত হইল–আমেনা মূৰ্হিতা হইয়া কাদা ও পানির মধ্যে পড়িয়া গেল। মধু ভীত হইয়া কাহাকেও কিছু না বরিয়া সে স্থান হইতে পলায়ন করিল।

.

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

একটি সুন্দর-আকৃতি দরবেশ কোথা হইতে আজ সাতদিন হইল থানার সম্মুখে আড্ডা লইয়াছেন। দরবেশ কাহারও সঙ্গে কথা বলেন না। খোরশেদ অনেক বার চেষ্টা করিয়াছে। তাঁহার সহিত কথা বলে, কিন্তু বারে বারেই সে বিফল মনোরথ হইয়াছে।

নিশীথকালে একবার কথা বলিতে চেষ্টা করিয়া দেখিবার জন্য খোরশেদ এই সময়ে তাঁহার কাছে আসিয়াছে।

সে সন্তর্পণে দরবেশের সম্মুখে যাইয়া বসিল। ফকির তখন চোখ বুজিয়া তসবি গণিতেছিলেন।

খুব শঙ্কার সহিত খোরশেদ করজোড়ে ফকিরের সম্মুখে বসিয়া থাকিল। একটু একটু বাতাস থাকিয়া থাকিয়া সাধুর অগ্নিকুণ্ডকে দ্যুতিময় করিয়া তুলিতেছিল।

দূরে বারান্দায় একটা সিপাই এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।

প্রায় এক ঘণ্টা অতীত হইলে–ফকির ধীরে ধীরে চোখ খুলিয়া দেখিলেন, একটা যুবক তাঁহার সম্মুখে উপবিষ্ট।

খোরশেদ ফকিরের পদধূলি লইয়া কহিল–শাহ্ সাহেব, একটা নিবেদন।

খোরশেদকে অবাক করিয়া ফকির জিজ্ঞাসা করিলেন কি নিবেদন বাবা।

খোরশেদ আহ্লাদিত হইয়া কহিলেন–এই পাপীর সঙ্গে আপনি কথা বল্লেন! এ আপনার অনুগ্রহ।

ফকির আবার জিজ্ঞাসা করিলেন–কী কথা বলতে চাও?

খোরশেদ–বলতে ভয় হয়, অনুমতি দিলে বলতে পারি।

ফকির–আমাকে কি অনুপযুক্ত পাত্র বলে তোমার সন্দেহ হচ্ছে?

খোরশেদ–না, না, ওকথা বলে এ অধমকে লজ্জিত কচ্ছেন কেন?

ফকির–তবে বল।

খোরশেদ-জীবনের কোনো এক সময়ে একটি মেয়েকে আমি ভালবাসি। তাকে আমি পেতে চাই।

ফকির–আমি কী কত্তে পরি? খোরশেদ–আপনি দোয়া করলে আমার মোকসেদ হসিল হতে পারে।

ফকির-ফকিরদের কাজ মানুষকে উন্নত পথে টেনে আনা। প্রেম অপার্থিব জিনিস হলেও ফকিদের কাছে এই সব কাজে সাহয্য চাওয়া কর্তব্য নহে। খোদার কালাম এই সমস্ত কার্যে ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। যাকে ভালবাসতে এখনও তাকে ভালবাস–কেউ। তোমাকে নিষেধ করছে না। এই উদ্দেশ্যে কোনো অসাধারণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করার দরকার নাই।

বিধাতার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার বঞ্চিতকে লাভ করবে, নইলে নয়। পর স্ত্রীর রূপলাবণ্যের কথা চিন্তা করিয়া ব্যভিচার দোষে আত্মাকে কলঙ্কিত করিও না। তোমার বাঞ্ছিতা যদি অপরের ভার্যা হয়ে থাকে তবে বিশ্বাস করিও সে তারই পত্নী হবার জন্যে মতে এসেছিল–তোমার জন্য নহে; তুমি ভুল করে পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়েছিলে।

খোরশেদ–আমার প্রেমের প্রতিদান হবার কোনো আশা নাই, তবে আমি পর স্ত্রীর প্রতি আসক্ত নহি।

ফকির–কেন, এসলামীয় প্রথামত সামাজিক রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী তাকে লাভ, করিবার জন্য চেষ্টা করতে পার না?

খোরশেদ–তিনি আমাকে ভালবাসেন না ভালবাসবারও কোনো আশা নাই। হৃদয়ে অনুদিন অসীম জ্বালা অনুভব করি।

ফকির–যে তোমাকে ভালবাসে না, জোর করে তার ভালবাসা লাভ করতে যাওয়াও মূর্খতা এবং নিজের পক্ষে অপমানজনক। ব্যর্থ জীবনের বেদনা নিয়ে বাঞ্ছিতাকে দূর হতে সম্রম ও শ্রদ্ধার সহিত নমস্কার করে খোদার পথে নেবে পড়। খোদার পথে অসীম শান্তি পাবে। আত্মা তোমার সম্পদশালী হয়ে উঠবে। জোর করে কাকেও পেতে আশা করো না। তার অগোচরে নিজেকে বিক্রয় কর–ত্যাগে আত্মা তোমার বিরাট ও মহান হয়ে উঠবে।

খোরশেদ–আপনার কথা মেনে নেওয়া শক্ত। বুঝিতেছি না বলেই শক্ত। জোর করে কাকেও ভালবাসতে বাধ্য করা পাপ। আপনি ঠিক বলেছেন।

ফকির–তুমি যার জন্য পাগল তিনি হিন্দু না মুসলমান? খোরশেদ–যদি বলি হিন্দু, তাহা হলে কি আপনি সুখী হবেন?

ফকির–ছিঃ, এমন কথা বলছো! মুসলমান হিন্দু নারীর প্রেমে মুগ্ধ? এ-কথা বলতে লজ্জা হয় না?

খোরশেদ–ক্ষমা করবেন–আমি কোন হিন্দু নারীকে ভালবাসি নাই।

খানিক নীরব থাকিয়া খোরশেদ জিজ্ঞাসা করিল–মহাত্মন! কারো সঙ্গে কথা না বলে এমনভাবে জীবন যাপন করেন কেন?

সাধু বলিলেন–নিজের মহিমায় নিজে বিভোর হয়ে স্বাধীনচিত্তে বিশ্ববক্ষে ঘুরে। বেড়াই। মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ কাটিয়ে সদা স্বাধীন মাথা খোদার সামনে নত করি।

.

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

ক্রমে খোরশেদ উচ্ছল হইয়া পড়িয়াছে। সে সুরা সেবনের নিজের শরীর ও মানুষের উপর অত্যাচার করিয়া দিনগুলি কাটাইয়া দিতেছিল।

সেদিন একটু একটু করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল। খোরশেদের মস্তিক কখনও মদের নেশায় চঞ্চল। ঘোড়ায় তীক্ষ্ণ কষাঘাত করিয়া খোরশেদ সেই বৃষ্টির ভিতর বাহির হইল।

প্রায় দুই ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া সে এক হিন্দু পল্লীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাড়িগুলি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সব বাড়িতেই এক-একটা তুলসী গাছ।

সে একখানা ছোট কুটির সম্মুখে আসিয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিল? কুটিরখানি এক বিধবা স্ত্রীলোকের। দারোগা বাবুকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া একেবারে গড় হইয়া প্রণাম করিল।

খোরশেদ জিভ কাটিয়া কহিল–পাপ!–আমি হিন্দু নই। মুসলমান কাহারও সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত গ্রহণ করে না রমণী! ইহাতে খুশি না হয়ে বিরক্ত হলাম।

গ্রামের যিনি প্রধান তাহার হুকুমে একখানা চেয়ার আসিল। সাধারণ লোক, দুইজন সিপাই, তিনজন চৌকিদার এবং বিধবার কয়েকজন হিন্দু প্রতিবেশী খোরশেদকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

খোরশেদ রমণীকে জিজ্ঞাসা করিল–কবে তোমার ঘরে চুরি হয়েছে? সে কাঁদিয়া কহিল–বাবা! তুমি ধর্মাবতার! তুমি যদি আমাদিগকে রক্ষা কর, তা না হলে আমরা দরিদ্র প্রজা বাচি না! আমার মেয়ের কপালে যে কি আছে তা কে বলতে পারে? সে অনেক দিনের কথা বাবা! আমার উমাতারার বয়স ষোল বছর। এই ষোল বছর হল কালীর নামে ষাড় ছেড়ে দিয়েছি। আহ! ওরে সর্বনেশেরা! ওরে পোড়ারমুখোরা! কে এমন ভরা-পড়া কাজ কল্লি রে?

খোরশেদ–এখন শাপ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তুমি কার উপর সন্দেহ করো তাই বলো।

বৃদ্ধা যাদের উপর সন্দেহ করি তাদের নাম করবার যো নাই গো! তা হলে আমার মাথা কাটা যাবে–তুমি যা জান বাবা তাই করো। কোনো হিন্দু আমার ষাড় খায় নাই।

খোরশেদ–বিশ্বাস কী? অনেক হিন্দু আজকাল মুরগি খাওয়া আরম্ভ করেছেন, গরু খেতে আর বাকি কী?

রমণী সহসা ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল–কোথাকার দারোগা তুমি?–রাম! রাম!

খোরশেদ কোনো কথা কহিল না। শেষে কহিল–দেখো বুড়ি, আমার বিশ্বাস নিজের ষাঁড় তুমি নিজেই বিক্রয় করেছ। সমাজের চোখে ধুলো দিবার জন্যে তোমার এই কারসাজি। মিথ্যে মোকদ্দমার জন্য তোমাকে ২১১ ধারায় দেওয়া হবে।

রমণী কাঁদিয়া খোরশেদের সম্মুখে ভূমিতে মাথা ঠেকাইয়া কহিল–“দোহাই বাবা! আমাকে রক্ষা কর। আমাকে রক্ষা করবার জন্যেই ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছেন। আমি কিছু জানি নে বাবা, আমি কিছু জানি নে। যাক আমার ষাড়, কোনো প্রতিকারে আমার কাজ নেই। শুধু আমাকে রক্ষা কর।”

সিপাই একজনের ইঙ্গিতে, রমণী একজন ধোয়া কাপড়পরা হিন্দুকে লইয়া আঙ্গিনার এক পার্শ্বে গেল।

সিপাই আস্তে অথচ কঠিন উগ্রতায় কহিল–“বেটি, ২০টি টাকার যোগাড় দেখ।”

নাম তার জনার্দন। মুনিবের চাকর জনার্দনের উগ্র চোখের দিকে চাহিয়া স্বজাতির প্রতি সহানুভূতির আশায় হিন্দু ভদ্রলোকটি কহিলেন–“কিছু দয়া হবে না, সিপাই বাবু।”

সিপাই কহিল–“চুপ, দারোগা বাবুকে কিছু নজর না দিলে হচ্ছে না।” এই কথা বলিয়া সে সেখান হইতে সরিয়া গেল।

রমণী ভদ্রলোকটির হাত ধরিয়া কহিল–“তা হলে কি করি বাবু?”

চিন্তা করিয়া সহানুভূতিমাখা স্বরে ভদ্রলোক বলিলেন,–“গহনাপত্র কিছু আছে? কিন্তু কে এখন টাকা দেবে? খানিক নিস্তব্ধ থাকিয়া ভদ্রলোক আবার বলিলেন–যাক, বিপদকালে সবাই তোমাকে ফেল্লেও আমি তা পারব না খুড়ি।”

বৃদ্ধা চোখের জল ফেলিয়া কহিল–“এস জগদ্বন্ধু এস, বাড়ির ভিতর এস। স্বামীর কালের দুইখানা গহনা ছিল–সোনার। দাম দু’শ টাকা হবে। দারোগাকে কয় টাকা দিতে হবে?”

“অন্তত ৩০ টাকা।”

এই সময় খোরশেদ সিপাই-এর এবং সাধারণের উড়ো কথার সাহায্যে বদমাইসদের খোঁজ লইতেছিল।

জগদ্বন্ধু খুড়ির সহিত বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল।

ঘরের মধ্যে একটা পুরোনো বাক্স, তার নিচে আর একটা বাক্স, তার নিচে একটা পেটরা! একে একে বাক্সগুলি নাবাইয়া রমণী সেই পেটরাটি খুলিয়া ফেলিল। কতকাল সেটা সেখানে ছিল!

একধারে একটা ছোট বাটার ভিতর হইতে সে একছড়া ঝকঝকে হার বাহির করিল। জগদ্বন্ধু আগ্রহে হাত বাড়াইয়া কহিল–“ঐ বালা দুগাছিও বাইরে রাখ!”

বিধবা জগদ্বন্ধুর হাতে হার রাখিয়া অস্পষ্টভাবে বলিল–“এই বালা আর এই হার গড়াতে তোমার খুড়োর দুশো টাকা লেগেছিল। এই হচ্ছে তোমার কাকার স্মৃতিচিহ্ন।” বিধবার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।

জগদ্বন্ধু শান্তভাবে বলিল–“বিপদের সময় তোমাকে ফেলতে পারি না। খুড়ি, আমিই এই হার আর বালা নিচ্ছি। অন্যলোক হলে ২৫ টাকার বেশি দিতাম না। তোমাকে ৫০ টাকাই দিব।”

জগদ্বন্ধু হার ও বালা হাতে লইয়া কহিল–“খুড়োর কথা বলো না খুড়ি। অমন লোক আর হয় না। ভাগ্যে তোমার জন্য গহনা দুখানা রেখে গিয়েছিলেন–নইলে এ বিপদের সময় কী হতো?”

জগদ্বন্ধু হার ও বালা লইয়া গিয়া বাড়ি হইতে টাকা লইয়া আসিল। সিপাইকে একপার্শ্বে ডাকিয়া আনিয়া হাতে ৫ টাকা দিয়া কহিল,–“এক টাকা আপনার এবং বাকি চার টাকা দারোগা বাবুকে দিবেন।”

সিপাই হাসিয়া জগদ্বন্ধুকে সালাম করিয়া কহিল–“আপনারা কিছু না দিলে আমরা কী করে বাঁচি? আপনারা ভদ্রলোক কিনা! দুই-এক চশমখোর আছে, তাদের হাতে একটা পয়সাও গলে না।”

অতঃপর খোরশেদ সিপাহী তিনজনকে লইয়া সোজাসুজি ঠাকুরবাড়িতে আসিল। গদির উপর চারিজন হিন্দু তাস খেলিতেছিল। খোরশেদ কাহাকেও কিছু না বলিয়া ঘাম সিক্তকলেবরে তাহাদের পার্শ্বে ফরাসের উপর যাইয়া বসিল।

খেলোয়াড়দের একজন তখন তামাক খাইতেছিল। তাড়াতাড়ি সে কাটি ত্যাগ করিয়া কহিল–“দারোগা হলেও কারও ধর্মে হাত দিবার আপনার কোনো অধিকার নাই।”

বিস্মিত হইয়া খোরশেদ বলিল–“নিশ্চয়ই! কে কার ধর্মে হাত দিল?”

“এই তো হুঁকার জল নষ্ট করলেন!”

খোরশেদের অগোচরে একজন ইশারা করিয়া মৃদু চাপা স্বরে কহিল–“দারোগা হলে কী হবে? মুসলমান তো!”

সিপাই জনার্দন তাহা শুনিয়াছিল। ক্রুদ্ধ সর্পের ন্যায় তার বাবুর দিকে চাহিয়া সে কহিল–“শুনেছেন বাবু, হুকুম দেন, বেটার কান ধরে ঠিক করে দিই।”

শরৎ তাস ফেলিয়া সিপাইদের উপর উগ্র হইয়া কহিল–“কি রে বেটা,–পাজি। ভদ্রলোকের মর্যাদা বুঝি না?”

জনার্দন পশুর মতো কহিল–“সাবধান, শূয়ার কা বাচ্চা।”

শরৎ স্বপ্নেও ভাবে নাই, সামান্য একজন ৭ টাকার অশিক্ষিত সিপাই তাহাকে এরূপভাবে সম্বোধন করিবে। অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে জনার্দনকে অভিসম্পাত করিয়া সে নির্বাক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

খোরশেদ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহসা নিষ্ঠুরভাবে কহিল–“জনার্দন, রামচরণ, বলাই! আচ্ছা, তা হলে তোমরা এদের চারজনকেই বেঁধে থানায় নিয়ে এস।”

মেনু চৌকিদার এক পাশে দাঁড়াইয়াছিল। সহসা খোরশেদ তাহার পার্শ্বে লাথি মারিয়া বলিল–“বেটা হারামজাদা! দাঁড়িয়ে আছিস যে-পাকড়ো।”

সিপাই তিনজন এবং মেনু চারজনকেই গ্রেপ্তার করিল।

ব্যাঘ্র খাঁচায় পড়িলে যেমন সে গর্জিয়া উঠে, শরৎ এবং তাহর বন্ধুগণ তেমনি গর্জিয়া কহিল–“দেখ দারোগা, ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখ নাই। পাড়া গাঁয়ের হাবা পেয়েছ, কেমন? আমরাও আইন-কানুন জানি। বলি, আমাদের অপরাধ কী, দারোগা?”

খোরশেদ কহিল–“ষাড় চুরি করবার মজা টের পাবে!”

শরৎ ঘৃণায় মাটির উপর পদাঘাত করিয়া কহিল–“রাম! রাম!”

“হিন্দু হয়ে যাড় জবাই করে খেয়েছ সে কথা না বল্লেও তোমরা যে ষাঁড় অপরের কাছে বিক্রয় করেছ তার প্রমাণ আছে।”

জনার্দন শরতের ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতে বাইরে আনিল।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছিল। বড় দারোগা থানায় ছিলেন না। খোরশেদ যথাসময়ে গারদঘরে চারিজনকে আটকাইয়া বাহিরে আসিয়া জনার্দনকে একপার্শ্বে ডাকিয়া আনিয়া মৃদুস্বরে কহিল–“শীতের রাত্রি, গোটা তিনেক টাকা আদায় করে খানিক পরেই ছেড়ে দিও, তাতেই শিক্ষা হবে। আমি একটু বাইরে চল্লাম। ঘোড়ায় চড়ে গায়ে ব্যথা হয়েছে, একটু স্টিমুলেন্ট না হলে চলছে না।”

সন্ধ্যার তিনঘণ্টা পরে জনার্দন, রামচরণ ও বলাই আয়েস-আরামের সহিত আহারাদি করিয়া শরৎকে নিঃশব্দে গারদঘর হইতে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে লইয়া গেল।

জনার্দন কহিল–“দেখ বাবু, তোমাদের মাথার উপর কী বিপদ তা বুঝতে পাচ্ছ তো। সাক্ষী প্রমাণ ঢের আছে। আমরা এক-এক করে খাড়া করবো। দারোগা সাহেবকে প্রত্যেকে কিছু কিছু করে নজর দাও, তাহলে সব মুস্কিল আসান হয়ে যাবে।”

শরৎ–তোমরা আমাদিগকে বোকা পেয়েছ। দারোগার বাবা এলেও টাকা দিচ্ছি নে। মিথ্যা করে ভদ্রলোকদিগকে নাকাল কল্লে কী হয় তা পরে টের পাবে। তোমরা তো গরু, তোমাদিগকে আর কি বলবো। দেশের মানুষ হয়ে দেশের মানুষের বুক চিরে টাকা সংগ্রহ করিস, এর ফল আছে–আজ হোক, কাল হোক মূক-শক্তিহীন দেশের মানুষ একদিন না একদিন অত্যাচারী বিশ্বাসঘাতক রাজকর্মচারীর কাছে এর জবাব চাবেই চাবে। অত্যাচার করে সেরে যাবে কদিন? মহামান্য রাজা কি এ জন্য তোমাদিগকে নিয়োগ করেছেন? তোরা তো দেশের মানুষের চাকর। মুনিব চিরকাল ভৃত্যের অত্যাচার সহ্য করবে না।

রামচরণ শরতের মাথায় একটা প্রচণ্ড ঘুষি লাগাইয়া কহিল, “শালা, তোর হেঁয়ালী ফেলে রাখ। টাকা দিতেই হবে। প্রত্যেকের নিকট হতে ১০০ টাকা করে রাত্রেই চাই।”

বলাই শরতের টুটি ধরিয়া তার গোটা শরীরটা শূন্যে তুলিয়া ফেলিল। বন্ধ মুখের মধ্যে একটা গভীর বেদনাব্যঞ্জক শব্দ কাঁপিয়া উঠিল। শরৎ বেদনায় কাঁদিয়া উঠিল।

এক-এক করিয়া বাকি তিনজনকেও সেখানে আনা হইল। কিল, ঘুসি, লাথি ও অপমানের অত্যাচারে শরৎ এবং তাহার বন্ধুত্রয় শেষকালে স্বীকৃত হইল ৫০ টাকা করিয়া মোট দুইশত টাকা সেই রাত্রেই তাহারা হাজির করিবে, নহিলে তাহারা বুঝিল, চুরির অপরাধে তাহাদের ভাগ্যে জেল অনিবার্য।

বন্ধু তিনজনকে সেখানে রাখিয়া শরৎ টাকা আনিতে গৃহে গমন করিল।

রাত্রি তখন ৩টা। শীতে কয়েদিরা গারদঘরে কাঁপিতেছে, এমন সময় ছোট দারোগা গরম ওভারকোট ও শালে সর্বাঙ্গ জড়াইয়া সেই পথ দিয়া বাসায়া ফিরিতেছিল।

সিপাই তিনজন মনের আনন্দে গঞ্জিকা সেবন করিতেছিল। খোরশেদ রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল–“বাবুদের ছেড়ে দিয়েছিস? যাবার সময় দুই চার আনা বকশিস্ দিয়ে দিয়েছেন তো।”

জনার্দন সহসা খোরশেদের কানের কাছে আসিয়া চাপা গলায় কহিল–“বাবু দুই চার আনা নয়! দুশো টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করেছি। সে কি আর সহজে, ঘায়ের চোটে শালাদের নাক দিয়ে রক্ত বের করে ছেড়েছি। এক জন টাকা আনতে গিয়েছে। বাকি তিনজন গারদঘরে।”

“ওরে শালা!’ বলিয়া খোরশেদ জনার্দনকে লাথি মারিয়া কহিল–“পুলিশে কাজ কর বলে কি পশু হয়েছ? অপরাধটা কি যে তাদের উপর এই অত্যাচার? কী করেছে তারা, যে। এই টাকা? আন্ শালা-চাবি আন এখনি। গারদঘর খুলে ভদ্রলোকদের যেতে দে। ছিঃ! ছিঃ!–এই দারুণ শীতে!”

জনর্দান তাড়াতাড়ি গারদ ঘর খুলিয়া দিল।

.

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

খোতবা পাঠ করিয়া রায়হান কহিলেন–“আমাদের আশ্রমের পূর্ণ সাফল্যের জন্য কয়েকজন যুবককে বাহিরে যাইতে হইবে। সেই চারজন যুবকের চিন্তা নতুন ধরনের হওয়া চাই। চাকরি যারা করে তারাই ভদ্রলোক, বাকি লে ক সব ছোট,–এরূপ যাহারা ভাবে তাদের দ্বারা কাজ হইবে না। তাদের জানা চাই–জ্ঞী মানুষ যদি সামান্য কাজও করেন তাবে তার মর্যাদা কমবে না। আমি চাই সত্যের সেবক–সে নীচাশয় ও সঙ্কীর্ণ হৃদয় হইবে না। সে বিশ্বাস করিবে মানুষের মর্যাদার ভিত্তি মনুষ্যত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।

আমাদের শিক্ষালয়ে চল্লিশজন মহিলা আশ্রয় পাইয়াছে। করিমা খাতুন কোরান ও বাংলা শিক্ষা দেবার ভার লইয়াছেন। দুইটি সেলাইয়ের কল চলিতেছে। আমি নিজে তাহাদিগকে সেলাই শিখাইয়া থাকি।

আবুল কাসেম মিঞার একটি কন্যা, যুবতী বয়সে তিনটি পুত্রসহ বিধবা হন। তিনটি পুত্রই কলেরা রোগে প্রাণত্যাগ করে। বিমাতার গর্ভজাত ভাইরা তাহাকে সংসার হইতে তাড়াইয়া দেয়। একান্ত নিরাশ্রয় হইয়া অতি দুঃখে বালিকা এক ধনীর গৃহে আশ্রয় ভিক্ষা করে, কিন্তু তাহারাও তাহাকে কোনো কারণে স্থান দেন নাই। অতি দুঃখে, অতি বেদনায় এ কৃষকের ঘরে তাহার কাল কাটিতেছিল, আশ্রম তাহাকে গ্রহণ করিয়াছেন–শীঘ্রই সে। মাসে ত্রিশ টাকা পর্যন্ত উপায় করিতে পারিবেন।

এক হিন্দু জমিদারের পুত্রবধু গঙ্গাস্নানে গিয়াছিলেন। রান্নাঘাটের কতকগুলি বদমাইস ব্রাহ্মণ ভিড়ের ভিতর হইতে তাহাকে নিতান্ত নিরুপায় করিয়া ফেলে। যুবতীর আঁখিজল পাষণ্ডদের হৃদয়ে কৌতুক দিয়াছিল মাত্র। তাহারা যুবতীর সতীত্ব হরণ করে। সে অনেক কথা–তিন বৎসর পরে সে আমাদের আশ্রমের সন্ধান পাইয়া আশ্রয় ভিক্ষা করে। তাহাকে সেলাইয়ের কাজ শিক্ষা দিতেছি। শীঘ্রই সে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করিবার শক্তি লাভ করিবে। কোনো পিশাচের কৃপার পাত্র হইয়া তাহাকে থাকিতে হইবে না। স্বামী তাহাকে গ্রহণ করিবে কি না–এ প্রশ্ন তুলিবার কোনো আবশ্যকতা নাই।

৩বাহার বলিয়া একটি বিংশ বর্ষীয়া কৃষক যুবতী একটি কন্যা লইয়া পথে পথে ঘুরিত। ছয় বৎসর আগে তাহার স্বামী আসামে চলিয়া গিয়াছিল। মেয়েটির না ছিল অন্ন, না ছিল বস্ত্র। দুষ্ট বদমাইসের দৃষ্টি তাহার কাছে নিতান্ত অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। পুরুষ কিন্তু রমণী জাতের এই দীনতা ও ক্ষুধা সহ্য করিবার পরিবর্তে যে কোনো পাপ করিতে পারে। সেই যুবতাঁকে আমরা গ্রহণ করিয়াছি। ইচ্ছা করিয়াছি তাহাকে পুস্তক বাঁধাই শিখাইবাসে বিধাতার রাজ্যে বাঁচিয়া থাকিতে পারিবে।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া রায়হান আবার বলিলেন–একজন যুবককে কলিকাতার বয়ন-বিদ্যালয়ে পাঠাইতে চাই। সে ফিরিয়া আসিয়া ছাত্রীদিগকে বস্ত্রবয়ন শিক্ষা দিবে। প্রস্তুত কাপড় আমারাই পরিব। দেশের বহু নরনারী অনাহারে মরিতেছে, তাহাদিগকে আহার দিয়া বাচাইবার জন্য মানবের মঙ্গলকামী সহৃদয় দেশবাসীকে যদি একটু বিলাস পরিত্যাগ করিতে হয় তাহা তাহাদিগকে করিতে হইবে।

বস্ত্রবয়নে কোনো ছাত্রীর সম্মানহানি হইবে না। জোলা বলিয়া এসলামে কোনো স্বতন্ত্র জাতি নাই। একথা যিনি অবিশ্বাস করিবেন তিনি অন্যায় করিবেন। কোনো কর্মই বিশেষ করিয়া কতকগুলি লোকের জন্য হইতে পারে না। বাংলার হিন্দু-মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতির ভিতর এ নিয়ম নাই।

দেশের মানুষ যদি দেশের জিনিসপত্র ব্যবহার করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তাহা হইলে বহু মানুষকে সাহয্য করা হয়। ভাইকে সাহায্য করা কি ইসলাম গর্হিত কাজ মনে করে? কত টাকা বিদেশে চলিয়া যাইতেছে। এই টাকার মালিক যদি আমরাই হইতাম, তাহা হইলে, আমাদের সমাজ অনেক আগে শক্তিশালী হইয়া উঠিত। অর্ধাশনে ও অনশনে থাকিয়া বিদেশী বিলাস দ্রব্যে আত্মাকে শীর্ণ ও প্রাণহীন করিয়া সুন্দর হইতে চাহিতেছি।

বই বাঁধাই শিখিবার জন্য একজন যুবকের কলিকাতা যাওয়া আবশ্যক। মেয়েদিগকে কাঠের কাজ শিক্ষা দিবার জন্য একজন যুবককে কোনো আর্টিজন স্কুলে পাঠাইব। যা কিছু খরচ লাগিবে,সবই তিনি আশ্রম হইতে পাইবেন। ছাত্রীরা অস্ত্র ব্যবহারে এবং কাঠের কাজে সুদক্ষ হইয়া উঠিলে পুরুষ শিক্ষকের প্রয়োজন হইবে না। মেয়ে-শিক্ষক পাইলে আর কারও সাহায্য চাহিতাম না।

হামিদের পিতা এবং গ্রামস্থ অন্যান্য ভদ্রলোক আগ্রহের সহিত আশ্রমের সম্বন্ধে বক্তৃতা করিলেন।

করিমার শ্বশুর ভিন্ন গ্রাম হইতে সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। তিনি ওজস্বীতাময় বক্তৃতা দিয়া সকলকে প্রতিজ্ঞা করাইলেন, আশ্রমকে এক শক্তিশালী কেন্দ্র করিতে তাহারা বদ্ধপরিকর হইবেন। আশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে একটা মাইনর স্কুলেও চলিবে। গ্রামের সকল বালিকা-ইতর কি ভদ্র-বিদ্যালয়ে যোগদান করিবে এবং শিল্প করিয়া তাহারা জীবনকে নিরাপদ করিয়া লইবে।

দুইজন যুবক কহিলেন–আমরা আমাদের ভগ্নিদের শিল্প শিক্ষার্থে বিদেশে যাইতে প্রস্তুত আছি। রমণীর দুঃখ অসহনীয়। নারী বিপদে পড়িয়া অনিচ্ছায় পথে দাঁড়ায়। তাহাদিগকে আশ্রয় দিতে হইবেই। পাপী পুরুষকে উদ্ধার করিবার জন্য বহু মানুষ ব্যস্ত, নারী বলিয়াই নারীর সম্মুখে দুর্লঙ্ঘ্য বাধ তুলিয়া ধরা ঠিক নহে।

.

বিংশ পরিচ্ছেদ

দোকানের কাজে ক্রমশ উন্নতি হইতেছিল। অন্যান্য জিনিস বিক্রয়ের সঙ্গে চারজন দর্জি কাজ করিয়াও কুলাইয়া উঠিতে পারে না।

সন্ধ্যার পর রায়হান দোকান ঘরে বসিয়া খবরের কাগজগুলি দেখিতে ছিলেন। এমন সময় সুকুমার আসিল।

রায়হান মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কবে বাড়ি এলে, সুকুমার?”

সুকুমার উত্তর না দিয়াই রায়হানের পদধূলি গ্রহণ করিবার জন্য মাথা নত করিল। রায়হান যুবকের হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রীতির সহিত কহিলেন–“ভেবেছ তুমি আমার পদধূলি গ্রহণ করতে পারবে। তোমাকে এত ব্যক্তিত্বহীন করে পাপ করাইতে চাই না। অমন করে নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। তুমি জান না, ইসলাম কাকেও ব্যক্তিত্বহীন করতে চায় না? নত মাথা অপেক্ষা নত মন জ্ঞানীর চোখে সমধিক প্রিয়। অনন্ত মানুষকে মুক ও বধির করে একা বেঁচে লাভ কী?” সুকুমার। আপনি দেবতা, আমার মাথা আপনা আপনি আপনার পায়ের কাছে নত হয়ে পড়ে।

রায়হান–ঐ কথা বল্লে আমাকে অপমান করা হয়।

সুকুমার-আপনার অনুগ্রহে বেঁচে আছি। আপনাকে সম্মান করব না,কাকে সম্মান করব?

রায়হান–ভুল বুঝেছ! মাসে মাসে ১০টি করে টাকা পাও বলে আমরা কাছে তোমাকে হীন হতে হবে? দানের দ্বারা তোমার মনকে ছোট করতে চাই না। যদি তুমি ভয় কর, তা হলে তোমার স্টাইপেণ্ড আমি বন্ধ করব! ছোটকাল হতে এই হীন বিনয়ের জন্য তোমাকে ভালবাসি নাই। তোমার মৃতদেহ আমি চাই না–আমি চাই তোমার সকল জীবন-ভরা বিকাশ।

সুকুমার বলিল–“আমায় ক্ষমা করুন–শিক্ষা হয়েছে।” তাহার পর চৌকির উপর বিক্ষিপ্ত বইগুলির উপর তাকাইয়া বিস্ময়ে কহিল–“একি দাদা! বাংলায় সকল মাসিক যে আপনার কাছে! আমাদের কলেজ লাইব্রেরিতে মাত্র দুইখানি বাংলা পত্রিকা আসে। আর সব ইংরেজি। বড় কঠিন কিছু বুঝি না। দুই এক পাতা বুঝলেও ধৈর্য ধারণ করে বেশি পড়তে পারি না।”

রায়হান বলিলেন–“বিদেশী ভাষা, সে সব পড়ে মানুষ হওয়া কঠিন কাজ,জ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করবেন। শক্ত বলে বড় সহিত্যকে অবহেল করতে বলছি না। তবে দেশের প্রত্যেক লোককে বিদেশী সাহিত্য আলোচনা করতে হবে এরূপ ব্যবস্থা করা ঠিক নয়।”

সুকুমার কহিল–“যাদের সহিত্য নাই তারা খুব বড় হবে কী করে?”

রায়হান বলিলেন–“কতকগুলি লোক বেদেশী সাহিত্য থেকে রত্ন চয়ন করে জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করবেন। সাহেবেরা ২৪ ঘণ্টা বই পড়ে; তার অর্থ তারা তাদের মাতৃভাষায় আনন্দ লাভ করে।

বাঙালির যদি উন্নত সাহিত্য থাকত তারাও রাস্তা-ঘাটে জ্ঞান আলোচনা করতো। আইন প্রণয়ন ও সংস্কার সাধনের চিন্তা অপেক্ষা দেশী সহিত্য-উন্নতির কথা অধিক করে সরকারের ভাবা উচিত। তা হলে শাসনের উদ্দেশ্য অনেক আগে সিদ্ধ হয়।”

রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“অধ্যাপকেরা যে বক্তৃতা করেন তা তুমি কেমন বোঝ?”

সুকুমার আমার সন্দেহ হয় তাঁরা মুখস্থ করে এসে কথা বলেন–বক্তৃতা কালে তাঁদের অনেকেরই চিত্তের সহজ ভাব থাকে না। পাছে অধ্যাপক লজ্জা পান, এই ভয়ে কোনো কথা জিজ্ঞেস করি না। রায়হান বলিলেন–“মনের সহজ ভাব না থাকলে শ্রোতাকে সন্তুষ্ট করা যায় না। যদি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন তা হলে ভালো হয়। কথা ভিতর দিয়ে নিজেকে ভালো করে প্রকাশ করা যায়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *