১১-১৫. ইহার পর এক বৎসর

একাদশ পরিচ্ছেদ

ইহার পর এক বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। পুত্রকে একদিন নফিসা বলিলেন–“বাবা খোরশেদ, হামিদ যখন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তখন আমেনাকে তার হাতে দেওয়ায় বাধা কী? হামিদের মা বার বার গোপনে আমাকে একথা বলেছেন। হামিদ আমেনাকে বিয়ে করবার জন্য ভারি উৎসুক। তোমার মত না হলে কী করে কী হবে, বল? তুমি তো আর ছোট নও। জাতির গৌরব করে আর কী হবে, বল?”

খোরশেদ। মা, তুমি কী পাগল হলে?হমিদ বি-এ পাশ করলেও তো আমার বোনকে বিয়ে করতে পারে না। লোকের কাছে তাতে আমাদের মাথা হেঁট হবে। চিরকাল আমরা আমাদের বংশ মর্যাদা রেখে এসেছি। আমা হতে তা নষ্ট হলে আমার মনে ভয়ানক দুঃখ হবে। এ কাজে আমার জাত থাকবে না।

নফিসা। এই যে বংশমর্যাদার বড়াই, এটা বাবা কিছু নয়। মাংসহীন শুকনো হাড় নিয়ে টানাটানি করলে কী হবে? তোমার মামু জোনাব মিঞা বংশের বড়াই করে দুই-মেয়েকে হাতি করে রেখেছিলেন। ত্রিশ বছর উতরে গিয়েছিলো তবুও বিয়ে দিলেন না। এটা কি

ভদ্রতা? দেশে কি একটা মানুষও নাই যে তার মেয়ের উপযুক্ত হতে পারে? তাই যদি তিনি মনে করেন তাবে তার এদেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়া উচিত ছিল। বাবা! বেশি বড়াই করা ভালো নয়। আল্লার আলমে শুধু আমরাই ভদ্রলোক একথা মনে করো না!

খোর–উপযুক্ত বর না পেলে মেয়েকে কি লোকে ফেলে দেবে? অসভ্য লোকের মধ্যে কি মার্জত রুচি ব্যক্তিরা বাস করতে পারে? পদে পদে তাদিগকে অপদস্ত ও আহত হতে হয়।

নসিফা –তাই বলে কি চিরকাল মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে রাখতে হবে? ভদ্রলোক তুমি কাদিগকে মনে কর? পুরোনো লোকের মধ্যে যারা উচ্চশ্রেণীর বংশ বলে দাবি করে তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বহু নীচতা আছে। আমার মনে হয় তাদের ভদ্রতা তাদের মনের মধ্যে না থেকে কায়দায় যেয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক শিক্ষিত যুবকেরা সেইসব পুরোনো ভদ্রলোকদের চেয়ে বড়।

খোর–কথায় আছে–বাঘের বাচ্চা বাঘ হয় শেয়ালের বাচ্চা শেয়াল। যাই বলেন, হামিদের সঙ্গে আমেনার বিয়ে হতে পারে না। আমার তা হলে মুখ দেখাবার যো থাকবে না। আমি এতে কোনো মত দিতে পারি না। আপনার কোনো বুদ্ধি নাই, কারণ মেয়ে মানুষ আপনি।

নফিসা–হামিদ কোন্ দিক্ দিয়ে মন্দ? সে কি আমেনার ভাই খোশেদের চেয়ে ছোট? তুমি কি তার চেয়ে শিক্ষিত? তুমি কি তা চেয়ে উন্নত ও ভালো লোকের সঙ্গে মিশতে পার?

খোর–হ্যাঁ মা, লেখাপড়া শিখে সে একটু ভদ্র হয়েছে। কত চাষার ছেলে লেখাপড়া শিখে ভদ্র হচ্ছে–আসলে তারা চাষা।

নফিসা–তবে কোথায় আমেনার বিয়ে দিতে চাও? যে ছেলেটার কথা তুমি বলছিলে আমি তাকে পছন্দ কত্তে পাচ্ছিনে।

খোরশেদ-এ-বংশের সঙ্গে সম্বন্ধ করলে আমাদের যে মর্যাদা আছে তার চেয়ে আরো বেড়ে যাবে। ভদ্রলোকেরা আমাকে বেশি করে ডেকে বসাবে। তা ছাড়া আমারও ভালো ঘরে বিয়ে হবে। আশরাফ শ্রেণীতে ভালো রকমে সাবেত হতে পারে। একটু ভালো হসব নসব না করতে পারলে কি আর ভালো হয়!

নফিসা মনে মনে হাসিলেন। ক্ষণেক নিস্তব্ধ থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“ছেলেটির নাম কী?”

খোর–বর্ধমানের করিমপুর নিবাসী মুন্সী নজীর মোহাম্মদ কাজীর পুত্র এনায়েত আলী একটি পাত্র। যেমন রূপ তেমনি গুণ। তার তেজ কী? নজীর সাহেবের গরু, ঘোড়া সারা মাঠে খেয়ে বেড়ায়, কোনো বেটার সাধ্য নাই কিছু বলে। এক চাড়াল-বেটা ছোটলোক, তার গরু দিয়েছিল খোয়াড়ে–লোকটির নাকি খালি মাত্র একখানা ঘর-পরণের কাপড় ছেঁড়া-বিনা চিকিৎসায়, পয়সার অভাবে তার ছেলেটি নাকি মারা গিয়েছিল–মাঠে মাত্র তার তিন বিঘা জমি, তাইতে তার বুকের এত বল–সে দিয়েছিল আবার নজির সাহেবের গরু খোয়াড়ে। তার থোড় ধান নাকি তোমার বেয়াইয়ের ঘোড়াতে পয়মাল করে দিয়েছিল। নজীর সাহেব হাটের মধ্যে তাকে জুতা-পেটা করেছিলেন। সারা বর্ধমান জেলার মধ্যে তাদের সমকক্ষ তোক আর নাই। মানুষকে জুতাপেটা করবার জন্য তাদের একখানা প্রকাণ্ড দালান আছে।

নফিসা–সাত নদী পার সেই দূরদেশে গিয়ে কি আমেনা সেখানে থাকতে পারবে?

খোর–ঐটি হচ্ছে মা তোমার বোকামি। যত দূরদেশ হয় তত কদর বাড়ে। লোকে জিজ্ঞাসা করবে বোনের বিয়ে হয়েছে কোথায়?–আমি বলবো বর্ধমানে। দূরদেশের নাম করতে কেমন গৌরব বোধ হয়, বলুন, দেখি–হুঁগলী, বর্ধমান, বীরভূম, রাজশাহী, ঢাকা। কেমন শোনা যায়! আরো যখন জিজ্ঞাসা করবে–বিয়ে হয়েছে কোন্ বংশে? বলবো বর্ধমানের জমিদার কাজী নজীর মোহাম্মদের পুত্র এনায়েত মিঞার সঙ্গে। অতি উচ্চ বংশ শরীফ খানদান। লোকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকবে।

নাফিসা–এত কোনা-কানাচের সংবাদ কোথা থেকে সংগ্রহ করলে? যেতে তিন দিন লাগে। আমরা গরীব মানুষ–তাদের সঙ্গে আমাদের মিল হবে না। নিজের অবস্থাকে গোপন করে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, পরে বিপদ হবে।

খোর–ঘটকের নিকট থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। বিয়ে যদি এক বার দিয়ে ফেলতে পরি–তবে আর ভয় নাই। কে আমাদের প্রকৃত অবস্থার কথা জানতে পারবে? ঘটক শাহাদত মিঞা তাদের কাছে বলেছেন আমরা জমিদার। ঘটক আমাদেরই লোক।

নাফিসা–বড়লোক যখন ছিলাম তখন ছিলাম–এখন আমরা গরিব মানুষ। এসব জাল-জুয়াচুরি দিয়ে কাজ কী বাবা?

খোরশেদ ক্রোধে মাকে নানা অকথা বলিল; মা তার ছোট ঘরের মেয়ে। তাকে বিয়ে করে খোরশেদের বাপের অনেক কলঙ্ক হয়েছিল! ইত্যাদি।

.

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

কয়েক দিন পর খোরশেদ করিমপুরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কলিকাতা হইতে অল্প দামে কেনা এক স্যুট, পুরানো সাহেবি পোশাক, পরিয়া খোরশেদ নজীর মিঞার বৈঠকখানায় সম্মুখে পায়চারি করিতেছিল। সঙ্গে ছিলেন শাহাদাত মিঞা। এই ভদ্রলোক উপায়ান্তর না দেখিয়া সম্প্রতি কয়েক বৎসর হইতে এই ব্যবসা আরম্ভ করয়াছেন। দুই বৎসর পূর্বে বর্ধমানে কাপড়ের ব্যবসা করিতে আসিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে নজীর মিঞার সঙ্গে তাহার যথেষ্ট বন্ধুত্ব জন্মিয়াছিল বৈঠকখানার সম্মুখে আর কেউ ছিল না। শুধু শাহাদাত আর খোরশেদ।

নজীর মিঞা, খোরশেদ ও পুরাতন বন্ধু শাহাদত মিঞাকে যথেষ্ট সম্ভ্রমের সহিত গ্রহণ করিয়াছিলেন। বস্তুত তাঁহাদেরই আহারের জন্য বাড়ির ভিতর তিনি পোলাও-কালিয়া কোর্মার ব্যবস্থা করিতেছিলেন। এনায়েত আলী সম্বন্ধীর সহিত আলাপ করিতে লজ্জাবোধ করিয়া ঘরের মধ্যে বসিয়াছিল। বয়স তাহার পঁচিশ-মধ্য ইংরেজি স্কুলে নাকি ফাস্ট ক্লাশে পড়ে।

শাহদাত বলিল–“আরে বাপু এসেছি যখন তখন ইনশাআল্লাহ কাজ হাসিল করে যাবোই যাবো।”

খোরশেদ–খোদার মরজি, আর আপনার দোয়া। বোন আমার বড় হয়েছে। বিয়েটা কোনো গতিকে হয়ে গেলেই হয়। তার পর আর ভয় নাই।

শাহদাত–তোমার বুদ্ধি হয়েছে বাবা। সেয়ানা ছেলে, বই থুয়ে কোথায় পালাবে? কোনো রকমে বিয়েটা হলেই কাজ ফতে।

খোরশেদ-জমিদার বলেই বোধ হচ্ছে। বিয়ে যদি হয় তা হল দেশে খুব নাম হবে, তার আর কোনো ভুল নেই। এমন নসর আমার বাপও করে যেতে সক্ষম হন নাই। খোদার কলম কে রদ করবে? তার অনুগ্রহে সব হয়।

শাহদাত–আরে বাবা এত বড় জমিদার আর এ-তল্লাটে নেই, তবে কিনা একটু কৃপণ। অনেক কিছু চার্জ করবে। কিছুতেই পেছপাও হয়ো না। লেখাপড়া শিখে আর কে নাম করতে পারে? ভদ্রলোকদের সহিত কাজ-কর্ম করে যা হয়।

একটু নিস্তব্ধ থাকিয়া শাহাদত পুনরায় বলিল–“বি. এ. পাশ করে যা না হতো এই বিয়ের দ্বারা তোমার তা হবে। সম্মানের চূড়ান্ত। কপাল তোমার। বাবা, তোমার বিয়ের ঘটকালিও আমি করবো।”

খানা তখন প্রস্তুত হইয়াছিল। নজির মিঞা বাহিরে আসিয়া বৈঠকখানায় দস্তরখানা পাতিবার জন্য ভূত্যকে আদেশ দিলেন। খাঞ্চায় খাঞ্চায় আহার সামগ্রী আসিল।

শাহাদাত খোরশেদ যথেষ্ট আদব-কায়দার সহিত জানু ভাঙ্গিয়া উপবেশন করিলেন। ব্যঞ্জনের বহর দেখিয়া খোরশেদ শাহাদত মিঞার গা টিপিয়া কহিল–“একেবারে শরীফ!

নজির হাসিয়া কহিলেন–“শাহাদম মিঞা, সামান্য কিছু প্রস্তুত হয়েছে।” খোরশেদের দিকে চাচিয়া বলিলেন ”বাবা খোশেদ, আপনারা তো বড়লোক। গরিব মানুষের বাড়ির সামান্য নুন-ভাত খেয়ে দেশে যেয়ে বদনাম করবেন না। কাজ যদি হয় তবে গরিবের বাড়ি আপনাদের মতো লোকের পায়ের ধুলো পড়বে। নয় তো এই শেষ।”

খোরশেদ আপনার অনুগ্রহ হলেই হতে পারে।

নজির–আমার এনায়েত যেমন ছেলে তেমন ছেলে এদেশে নেই। কী করি–খরচ পত্র আর কুলিয়ে ওঠে না। বাবার জন্য এ পর্যন্ত আমার পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। বইয়ের খরচ লেগেছে এবার দুশো টাকা।

শাহাদত বলিলেন–তা তো লাগবেই–তিনি বুঝি ফাস্ট ক্লাশ পড়ছেন?

নজির–হ্যাঁ ভাই ফাস্ট ক্লাশে পড়ছে। বড় তেজী ছেলে। সেদিন তর্ক করে সে স্কুলের হেডমাস্টারকে হারিয়ে দিয়েছিল। এ-দেশের কোনো মাস্টার আর তাকে পড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। তাকে কলকাতায় পাঠাতে চাই। কিন্তু একা তো আর খরচ চালাতে পারি নে।

শাহাদাত–আপনি খুব ভালো মতলব এটেছেন। পাড়া গাঁয়ে থাকলে ছেলেপিলে বোকা হয়। কোথায় কলকাতার শহর আর কোথায় পল্লীর মহাকুমার স্কুল। রাজধানীর ছেলেপিলের মনে জোর কত! সেখানে পড়াশুনাই বা হয় কত চমৎকার! মুখে তাদের রাতদিন ইংরেজি লেগেই আছে। তাদের খরচ-পত্র সম্বন্ধে কী ভাবনা? আল্লার রহমে একরকম হয়েই যাবে। কোনো দিন কাজ কি বেঁধে থাকে?

নাজির–আর এক কথা–দেশীয় স্কুলের মাস্টার বেটারা একেবারে জোচ্চোর। ইচ্ছে। করে ছেলেদিগকে ফেল করে দেয়। পাশ যেন তাদের বাবার ঘরের তালুক। উপর ক্লাশে তুলে দিতে যেন ব্যাটাদের পুত্রশোক হয়। খোশা-মোদ না করলে আর কারো পাশ হবার

যো নেই। এনায়েত এমন তেজী ছেলে তবুও বছর বছর তাকে তুলে দেবার জন্য মাস্টারদের খোশামদ করতে হয়েছিল।

খোরশেদভাই সাহেব কত নম্বর পেয়েছিলেন? নজির–ছেলে খুব ভালোই লিখেছিল। ঐ যে বল্লাম, ভালো লিখলে কী হবে?

রাত্রি হইয়া গিয়াছে দেখিয়া সকলে আহারাদি শেষ করিলেন। আহার করাইলেন এনায়েত আলী।

অতঃপর বিবাহের কথা আরম্ভ হইল। নজির মিঞা কহিলেন–“লেখাপড়া জানা। মেয়েরা বড় বেহায়া। আশাকরি, আমার ভাবী পুত্র বধূ এই পড়ার ধার ধারেন না।”

খোরশেদ–“কিছু না, আমার ভগ্নি একেবারে বোকা। দুই পয়সা আর দুই পয়সা কত হয় তা সে জানে না।“

অতঃপর শাহাদাত মিঞা কহিলেন–“বন্ধু! আপনার কাছে কি কোনো কথা ভাড়িয়ে বলা যায়। মেয়ে সম্বন্ধে যা বলেছি তার একবর্ণও মিথ্যা নয়। ভদ্ৰপরিবারে কি লেখাপড়ার চর্চা করে মেয়েদিগকে ব্রাহ্ম-খ্রিস্টান করে তোলা হবে? ছিঃ ছিঃ, তাতে কি ভালো মানুষের ইজ্জত থাকে?”

অতপর বহু কথার পর ঠিক হইল ছেলেকে মাসে-মাসে কন্যাপক্ষকে, বেশি নয়, ১০ টাকা করিয়া পড়ার খরচ দিতে হইবে। গহনা খোরশেদকেই দিতে হইবে। রূপার গনহার আবশ্যকতা নাই–সব কয়খানিই সোনার হইবে।

খোরশেদ তাহাতেই স্বীকৃত হইল। আরও কথা হইল নজির মিঞা, বেশি নয়–২শত বরযাত্রী লইয়া যাইবেন। বাছা বাছা কুটুম্বকে উপঢৌকন ও রেল ভাড়া খোরশেদ দিবে।

বিবাহ সম্বন্ধে আরও আবশ্যক-অনাবশ্যক বহু কথা হইল। সর্বশেষ খোরশেদ গল্পচ্ছলে কহিল–তাহাদের মতো জমিদার তাহাদের দেশে আর কেই নাই। তাহাদের বাড়িতে যে দশজন চাকরানী খাটে, তাহাদের পরনে হামেশা কাজ করবার বেলায়ও দশ বিশ টাকা দামের শাড়ি থাকে।

নজির মিয়া মনে মনে আনন্দ লাভ করিলেন। ভাবিলেন যা-হোক, এতদিন পর একঘর কুটুম্ব পাওয়া গেল। –প্রত্যাবর্তনকালে খোরশেদ কলিকাতা হইতে কতকগুলি চীনা বাসন ও গিল্টি করা গহনা ক্রয় করিয়া আনিল। ভদ্রলোকের বাড়িতে চীনামাটিও কাঁচের বাসন থাকা দরকার, খোরশেদের ধারণা ছিল এই রকম। বিবাহের দিন বরযাত্রীরা সাদা কাঁচের পাত্রগুলি দেখিয়াই খোরশেদের শরীফত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইবে আর কি!

.

এয়োদশ পরিচ্ছেদ

প্রখর সূর্যত্তাপে ধরণী উষ্ণশ্বাস ফেলিতেছিল।

খোরশেদ কয়েকটা ডাব এবং এক বদনা দুধ লইয়া শ্যামসুন্দরের বাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইল। রূপ ও গৌরবে গিরি পথেই দাঁড়াইয়াছিল। সে জল আনিতে যাইতে ছিল। হাতে তাহার স্বর্ণবলয়, বাহুতে অনন্ত, কপালে টিপ।

বাতাস তাহার অঞ্চল উড়াইয়া দিয়াছিল। খোরশেদকে দেখিয়াই সে থমকিয়া দাঁড়াইল শিরায় শিরায় তাহার বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। কী বিড়ম্বনা!

গিরির সুগঠিত দেহের দিকে খোরশেদ তাকাইল না। সে সোজাসুজি শ্যামসুন্দরের বাড়ির দিকে চলিয়া গেল। সে হয় তো গিরিকে দেখিতে পায় নাই।

গিরি দ্রুতপদে জল আনিতে চলিয়া গেল।

শ্যামসুন্দর খোরশেদকে দেখিয়া কহিলেন–“এই দুপুর রোদে কষ্ট করবার কী দরকার?” খোরশেদ ব্যথভাবে কহিল–“বাড়ির কাজ তো বিশেষ কিছু নেই কাকা! দিদিমণির, আপনার এবং কাকীর জন্যে কচি ডাব এনেছি মাত্র।”

বিনোদিনী খোরশেদকে বসিতে দিয়া, তাহার গায়ে বাতাস করিতে লাগিলেন। খোরশেদ মনে মনে হাসিল।

শ্যামসুন্দর কহিল—”বোনের বিয়ে তো হয়ে গেল। বেশ ভালো ঘরই বটে। সে দেশে ভদ্রলোক বেশি না মোসলমানই বেশি?”

খোরশেদ সহজভাবে উত্তর করিল–“মুসলমান ভদ্রলোকই বেশি।”

বিনোদিনী কহিলেন–“তুমি কবে যাবে বাবা?”

খোরশেদ–এই দুই চার দিনেই যাব। প্রথমে রাচির ট্রেনিং-এ কিছুদিন থাকতে হবে; তারপর কোনো জায়গায় স্থায়ী হবে।

বিনোদিনী–এখন কত করে পাবে?

খোরশেদ–যত দিন ট্রেনিং-এ থাকবে ততদিন বেতন ৫০ টাকা, তারপর থানায় স্থায়ী হলে বেশি।

বিনোদিনী–আর জন্মে তুমি আমার ছেলে ছিলে। তোমাকে দেখতে ঠিক হিন্দুর মতো।

এমন সময় গিরি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। মুখে তার হাসি-চোখে একটা স্নিগ্ধ সন্তোষ। অঞ্চল তাহার খোরশেদের গায়ে লাগিয়া গেল।

খোরশেদ কথা বলিল না।

শ্যামসুন্দর কী কাজে বাহিরে গেলেন। মাতা তনয়াকে বলিলেন–“গিরি! তোমার দাদাকে কিছু জলখাবার দাও।”

খোরশেদ আপত্তি জানইলেও গিরি তাহার হাত ধরিয়া ঘরের মধ্যে লইয়া গেল।

উঠানে এমন সময় একটি মুসলমান ভিখারিনী আসিয়া আল্লা ও মোহাম্মাদের নাম করিয়া ভিক্ষা চাহিলে, কিন্তু তাহার কাথায় কেহ উত্তর দিল না।

নানাবিধ মিষ্টান্ন দিয়া গিরি অনুরোধ করিয়া খোরশেদকে আপ্যায়িত করিল।

জল লইতে বাহিরে আসিয়া গিরি দেখিল ভিখারিনী রান্নাঘরের ডোয়ার উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

গিরির মা চিৎকার করিয়া বলিলেন–“ওমা, মুসলমান ঘর ছুঁয়ে হাঁড়ি বাসন নষ্ট করলে গো! আজ আর খাওয়া হবে না গিরি, মাগীর চুল চেপে ধর। যা, যা, মুসলমানের হাই দেখ।”

ভিখারিনী অপ্রস্তুত হইয়া বাহির হইয়া গেল। গিরি খোরশেদকে ডাকিয়া কহিল–“খোরশেদ, দেখ তো দাদা, ছোট লোকের হাই!”

তখন সন্ধ্যা। খোরশেদ কথা না বলিয়া গিরি ও বিনোদিনীর কাছে বিদায় প্রার্থনা করিল।

গিরি অবাক হইয়া বলিল–“না দাদা, আজ তুমি যেতে পারবে না, আজ থাক, কাল যাবে।”

বিনোদিনী কহিলেন–“ওমা–সেকি কথা! এই এলে, আবার এখনই যাবে? তুমি কি আমাদের পর?

শ্যামসুন্দর বাহির-বাড়ি হইতে গাভীর দড়ি ধরিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তিনিও বিস্মিত হইয়া বলিলেন–“না, না, আজ থাক্। পরের বাড়ি তো নয়।”

অগত্যা চাকরটি বাড়ি ফিরিয়া গেল। খোরশেদের যাওয়া হইল না।

কথায় কথায় রাত্রি তখন এগারটা হইয়া গিয়াছিল।

শ্যামলাল ঘোষপাড়ায় শালিসীতে গিয়াছিলেন। কখন ফিরিয়া আসিবেন ঠিক ছিল না।

গ্রীষ্মতিশয্যে খোরশেদ অনেকক্ষণ ধরিয়া বাহিরে গাছ তলায় বাসিয়াছিল। মুক্তমাঠ হইতে শীতল বাতাস ধীরগতিতে প্রবাহিত হইতেছিল। চন্দ্রালোকে রজনী হাস্যময়ী। জোছনা-বাতাসে বেদনাবিধুর প্রণয় তরল তরঙ্গাকারে উচ্ছলিত। প্রাণময় প্রকৃতির কণ্ঠ হইতে যেন সঙ্গীতধ্বনি শোনা যাইতেছিল।

পেছন হইতে খোরশেদকে চমকিত করিয়া গিরি কহিল–“কী ভাবছ?”

অতঃপর সে খোরশেদের পার্শ্বে বসিয়া পড়িল। গিরির উজ্জ্বল ললাটে শুভ্র জোছনা সুষমা রচনা করিতেছিল। কী কমনীয় মাধুরীমাখা মুখখানি!

খোরশেদ স্তব্ধ বিস্ময়ে গিরির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

গিরি শান্ত নম্র স্বরে কহিল–“এই মোহিনী প্রকৃতির অনন্ত পুলকের মধ্যে ইচ্ছা হয় বাতাসের উপর খেলিয়া বেড়াই। আর সঙ্গে থাকে আর একজন।”

খোরশেদ–“কে সে?”

“যাকে ভালবাসা যায় সেই প্রাণের দোসর।”

“ঠিক বলেছ। আমিও তাই ভাবছিলাম।”

“বন্ধু ও সাথী বিহনে জীবন বৃথা। এই মাধুরী-মহিমা, এই আলোক বাতাস সবই প্রাণহীন পাথরের স্তূপ।”

“ঠিক গিরি! জীবন আমার দুঃখময়। এ দুঃখের অবসান হবে না।”

“নিশ্চয়ই হবে। দেবতার দয়া হলে তোমার দুঃখের পথে সুখের ফুল ফুটবে।”

“তুমি যা বলছো গিরি, ঠিক বলছো?”

“হ্যাঁ ঠিক বলছি।”

“ছাই, প্রাণের আবেগে কী সব কথা বলে ফেলেছি! তুমি যে আমার দিদি।”

“ছিঃ ও কথা বলো না।”

তাহার পর তাহারা মৌন হইয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। প্রায় এক ঘণ্টা অন্তর মৌনতা ভাঙ্গিয়া জড়িত কণ্ঠ গিরি কহিল–“খোরশেদ, তুমি আমাকে ভালবাস?”

খোরশেদ সহজ স্বরে উত্তর করিল–“হ্যাঁ ভালবাসি।” গিরির সারা অঙ্গ স্পন্দিত হইয়া উঠিল। চক্ষু তাহার মুদ্রিত হইয়া আসিতেছিল।

সে সহসা মূৰ্ছিত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।

.

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

দুইটি বড় বড় রাস্তা আড়াআড়িভাবে গ্রামখানিকে মাঝখান দিয়া বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। গ্রামের ভদ্র শ্রেণীর ইচ্ছা ও উৎসাহেই রাস্তা প্রস্তুত হইয়াছিল। কৃষক ও ভদ্র সকলে মিলিয়া স্বহস্তে গ্রামবাসীদের সুবিধার জন্য সড়কদ্বয় প্রস্তুত করিয়াছিলেন। গ্রামকে প্রদক্ষিণ করিবারও একটা সড়ক ছিল।

দুইটি রাস্তার সঙ্গমস্থলে গ্রাম্য সভাগৃহ। ছোট একখানা চার-চালা ঘর। মাঝখানে পার্টিশন দেওয়া। আগে এই পার্টিশন ছিল না। স্ত্রীলোকেরাও যাহাতে পর্দা রক্ষা করিয়া গ্রাম্য সভায় যোগদান করিতে পারেন–এই উদ্দেশ্যে কয়েক মাস হইতে পার্টিশন বসান হইয়াছে।

করিমা তাঁহার চিন্তার কথা রায়হানকে বলিয়াছিলেন–নারীকে যদি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প শিখান যায় তাহা হইলে তাহার এত দরবস্থা থাকে না।

রায়হানও বহুদিন হইতে নারীর দৈন্য-দুর্দশার কথা ভাবিয়া আসিতে ছিলেন। করিমার নারী হৃদয়ে তাহার নিজের চিন্তার ধ্বনি পাইয়া তিনি খুবই উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন এবং ইচ্ছা করিলেন গ্রামস্থ ভ্রমণ্ডলীর সাহায্য লইয়া তিনি এক নারী-শিল্প-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিবেন। সেখানে সর্বশ্রেণীর নারী শিল্প শিক্ষা করিতে পারিবে।

করিমার উপর রায়হানের শ্রদ্ধাভাব জন্মিয়া গেল। করিমা যে সাধারণ নারী নহে, ইহাও তিনি বুঝিলেন। তাহার বিশ্বাস হইল, করিমা ও তিনি একসঙ্গে কাজ করিলে সমবেত চেষ্টায় নারীর মঙ্গল করিতে তাহার খুবই সুবিধা হইবে।

সভা বসিবার পূর্বে রায়হান গ্রামস্থ মুরব্বীদের সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহার ও করিমার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিয়া সহানুভূতি লাভ করিয়াছিলেন।

অদ্য গ্রাম্যসভায় এই বিষয়ের আলোচনা হইবার কথা।

নারী এবং পুরুষদের জন্য উভয় প্রকোষ্ঠেই ঢালা ফরাস পাতা হইয়াছিল। যথাসময়ে সভার কার্য আরম্ভ হইল।

সভাপতি হইলেন হামিদের পিতা সভাপতির আজ্ঞায় রায়হান কহিলেন, “উপস্থিত। মহিলাবৃন্দ এবং দ্ৰ মহোদয়গণ! অদ্যকার সভার উদ্দেশ্য কি তাহা আপনারা অনেকেই জানেন। তথাচ সর্বসাধারণের সুবিধা ও মত জানিবার জন্য আমি কিছু বলিতে চাই। আমাদের দেশের হিন্দু এবং মুসলমান রমণীদের দুর্গতি ভাষায় প্রকাশ করা সুকঠিন।”

“জ্ঞানের দিক দিয়ে যেমন ইহারা দরিদ্র, তেমনি মর্যাদায়ও ইহারা দরিদ্র। অন্ধতা, মূর্খতা, সহায়শূন্যতা ও দারিদ্র্য আমাদের নারীজাতিকে পশু করিয়াছে। নারীর কোনো শিক্ষার আবশ্যকতা নাই–এ কথা যিনি বলেন তাহাকে কয়েকদিন তাহা অপেক্ষা একজন হী প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে বাস করিতে অনুরোধ করি। তিনি বুঝিতে পারিবেন তাহার জীবনে কতখানি অশান্তি উপস্থিত হইয়াছে। নারী নারী বলিয়াই সে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পাইবে ইহা যেন কেহ মনে না করেন। নারী যে মানুষ-মানুষ রূপেই সে অধিক। করিয়া আমাদের প্রেম লাভ করিবে। তাহার মনুষ্যত্ব তাহার নারীত্বকে সমুজ্জ্বল করিয়া তুলিবে। মনুষ্যত্ব দূরে ফেলিয়া শুধু নারীত্ব আমাদের মন আকৃষ্ট যেন না করে।

“অশিক্ষিতা নারীর দ্বারা জীবন কোনোকালে সরস হয় না এবং পদে পদে বিড়ম্বনা ভোগ করিতে হয়, সে যত বড় সুন্দরী সম্পদশালিনী হউক না কেন, নারীর কাছে কি আত্মা নাই? নারী হইয়া জন্মিয়াছে বলিয়াই কি বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান-জ্ঞান বঞ্চিত থাকিয়া মনুষ্যত্ব ও ইসলামকে অস্বীকার করিবে? আহা, যাহার মধ্যে জ্ঞান নাই সে যে বড় দীন। যাহার অর্থ নাই সে দরিদ্র নহে–যে জ্ঞানান্ধ তাহার কাছে সহস্র প্রাণহীন স্বর্ণমুদ্রা থাকিলেও সে বড় দরিদ্র, এ কথা আমরা কবে বুঝিব? দেশবিখ্যাত জননায়কের ভগ্নি হইয়া জন্মিয়াছিলেন। বলিয়াই কি তিনি চিরদুঃখিনী-অন্ধ, পরমুখাপেক্ষী ও মর্যাদাশূন্য হইয়া থাকিবেন? এটা অন্যায় ও অত্যাচার। মমতাই রূপ, নারী মমতাহীন, অন্ধ ও দুর্বল,তাহার রূপের কোনো মূল্য নাই। সে সাময়িক বিলাসের পাত্র–তাহাকে শক্তি দেওয়া হউক, তাহাকে রূপময়ী করিয়া তোলা হউক।”

“যে স্বামী বা পিতা স্ত্রীকে বা কন্যাকে অলঙ্কার বা অর্থ দান করিলেন, তিনি কিছুই দিলেন না। স্বামী যদি স্ত্রীকে অলঙ্কারের পরিবর্তে জ্ঞান দান করিতেন তাবে তাহার মূল্য অধিক হইত। জীবনের এত আপনার জন, যাহাকে নয়নে নয়নে রাখতে চাই, সর্বদা যাহার। মঙ্গল কামনা করি, সেই চারু সঙ্গিনীকে সকল দান অপেক্ষা মহৎ দান হইতে দূরে রাখলাম। বন্ধুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা নিষ্ঠুরতা আর নাই। প্রিয়তমার জড়দেহ লইয়া টানাটানি করিলাম, কিন্তু তাহার আত্মা আমারই সম্মুখে দুর্গন্ধ কীটময় রহিয়া গেল, তাহা আমি দেখিলাম না। কেননা, আমি তাহাকে ভালবাসি!–আত্মা তাহার আমার সম্মুখে রুধিরাপুত হইল, আমার চক্ষু দিয়া এক ফোঁটা জলও বাহির হইল না। এই মানবজন্ম আর কি আসিবে?”

“যে সব নারী বিধবা হইয়া অপরের গলগ্রহ তাহাদের কষ্টের সীমা থাকে না। নারী যদি হস্তপদের পূর্ণ ব্যবহার শিখে তাহা হইলে তাহাকে আর এত পরমুখাপেক্ষী হইতে হয় না। দেশের, সমাজের, এমন কি স্বামীর কাছে সে সম্মান লাভ করে। নারীকে শিক্ষা দিতে হইবে। তাহাকে স্বাধীনভাবে জীবিকার্জনের পথ দেখাইতে হইবে। দেশের অনেক নারী দুঃখে, দারিদ্র্যে ও বিপদে পড়িয়া পাপ পথে বাহির হয়। তাহাদের অন্ন যদি থাকিত, যদি দুষ্ট শয়তানদের ছলনা বুঝিবার মতো জ্ঞান তাহাদের থাকিত, তাহা হইলে তাহারা পাপের পথে যাইত না। নারী একবার পাপ করিলে তাহাকে সংসার ও সমাজ হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হয়। এইসব সমাজতাড়িতা নারী অন্নসংস্থানের পথ না পাইয়া, হৃদয়ের দীনতা লইয়া নিজকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না। পুরুষের মতো হারান সম্মান ফিরাইয়া আনিবার শক্তি তাহাদের নাই। ফলে তাহারা লম্পট মানুষের বিলাসপুত্তলি হয়। না হইয়াও তাহারা পারে না। এইসব নারীদের যদি কোনো দাঁড়াইবার স্থান থাকিত, তাহা হইলে তাহারা নিজের ও বাংলার বুকে এত আগুন জ্বালাইত না।”

“অসহায় ও নিরাশ্রয় নারীদের জন্য আমরা আমাদের গ্রামে একটি বিদ্যালয় খুলিতে চাহিতেছি। এই কার্যের প্রতি সকলেরই সহানুভূতি আকর্ষিত হইয়াছে–ইহা সুখের কথা।”

অতঃপর পরদার অন্য ধার হইতে করিমা কহিলেন ”সভাপতি এবং উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী! নারীদের দুঃখে যে আপনারা বিচলিত হইয়াছেন ইহা খুবই আশা কথা। গত কয় বৎসর ধরিয়া নারীদের অবস্থার কথা যতই চিন্তা করিয়াছি ততই ব্যথায় অবনত হইয়া পড়িয়াছি। নারী আর সুনামের মহিমায় বাঁচিতে পারিতেছে না। মনে হও তাহাকে অবাধ্য ও বিদ্রোহী হইতে হইবে। সে কাহারও নিকট দয়া পাইতে চায় না। লজ্জহীনার মতো হয়তো তাহাকে ন্যায্য দাবি বুঝিয়া লাইতে হইবে।”

 “বঙ্গের নারীর অপরিসীম দুঃখের একমাত্র কারণ অবরোধ প্রথা (পর্দা নহে)। মূর্খতা ও মিথ্যা লজ্জার প্রশংসা। নারী কাঁদিলেও তাহার রূপ ফুটিয়া উঠে–অশ্রুবিন্দুগুলি মুক্তাবিন্দু বলিয়া অনুমিত হয়–এ কথা, এ ভালবাসা আর আমরা শুনিতে চাই না। পেটে আমাদের অন্ন নাই-পরণে বসন নাই–আত্মায় শুভদ্রতা। নাই–চক্ষু আমাদের শরমে মুদ্রিত-নারী নিরাপদ ওয়েটিং রুমে দাঁড়াইয়া বা অন্ধকারে ছুরি দিয়া সতীত্ব রক্ষা করিবে না–সে পুরুষের মতো আলোকে দাঁড়াইয়া সকলের সম্মুখে নীরব ভাষায় বলিবে–আমাদের ব্যক্তিত্বের মর্যাদা আছে। আমরা এত নির্ভরশীল হইতে পারি না। আমরা মাথা হাত ও পায়ের সম্পূর্ণ ব্যবহার চাই।”

 “অত্যধিক শরমের প্রশংসায় আমরা মনুষ্যহীন হইয়া পড়িয়াছি। দারুণ বিপদে পড়িয়াও আমরা চিৎকার করিয়া জোর করিয়া দেশের মানুষকে বলিতে পারি না আমাদিগকে রক্ষা কর। দেশে বহু মেয়েচুরির কথা শুনিতে পাই, কিন্তু কই, পুরুষ-ছেলেকে তো কেউ চুরি করিতে সাহস পায় না? ভিতরে যদি তাহাদের শিক্ষার শক্তি থাকিত তাহা হইলে কি তাহাদিগকে প্রাণহীন বস্তুর মতো লুকাইয়া রাখিতে সাহস পাইত? পুরুষের মতো সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিত। পুরুষ হাজার বার পাপ করিলেও তাহার দোষ হয় না, নারী একবার পাপ করিলে সে ঘৃণিত, লাঞ্ছিত ও সংসার হইতে তাড়িত হয় কেন? সে কি অনুতাপ করিতে জানে না?”

“যে হৃদয় জ্ঞানের আলোক পায় নাই–যেমন সদা নির্ভরশীল, পরমুখাপেক্ষী ও শক্তিহীন সে হৃদয়ই নহে। ইসলাম ক্রীতদাসকে স্বাধীন করিয়া দিয়া পূণ্য অর্জন করে, আর ইসলাম কি নারীকে অন্ধ, শক্তিহীন এবং ক্রীতদাসীর জীবন গ্রহণ করিতে অনুমোদন করিতে পারে?”

একজন জিজ্ঞাসা করিলেন–“নারীদের জন্য যে বিদ্যালয় খোলা হইবে তাহাতে কী কী বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইবে?

রায়হান বলিলেন–“শ্রদ্ধেয়া করিমা বিবি মেয়েদের এবং মহিলাদের নৈতিক ও মানসিক উন্নতির জন্য পরিশ্রম করিবেন। শিল্প-শিক্ষয়িত্রী যত দিন না পাওয়া যায় ততদিন আমি নিজে ছাত্রীদিকে সেলাইয়ের কাজ শিক্ষা দিব। আমার দুইশত টাকা মূল্যের দুইটি মেশিন পূর্বেই এই বিদ্যালয়ের জন্য দান করিয়াছি। যত শীঘ্র সম্ভব পুস্তক বাঁধাই শিক্ষা। এবং মিস্ত্রীর কাজ মহিলাদিগকে শিক্ষা দিতে চাই।”

অতঃপর আরও কয়েকজন ভদ্রলোক অনুষ্ঠানকে প্রশংসা করিয়া বক্তৃতা প্রদান করিলেন। শ্রোতামণ্ডলীর চাহনি ও ভাবে ক্রমশ অধিকতর সহানুভূতির চিহ্ন দেখা যাইতে লাগিল।

একজন দাঁড়াইয়া বলিলেন–“মহিলা কেন, ছেলেদের জন্যও শিল্প-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক।”

রায়হান বলিলেন–“ছেলে বিদ্যা লাভ করিয়া শক্তিমান পুরুষ হইবার যথেষ্ট সুযোগ পায়। সে অরণ্যে প্রবেশ করিয়া শার্দুলকে সমরে আহ্বান করে। নারী দুর্বলতাহাকেই অধিক সুযোগ দেওয়া কর্তব্য।”

সর্বশেষে করিমা বিবির পিতা সভাপতি রূপে কহিলেন–“উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী এবং স্নেহের পুত্র-কন্যাগণ! আজ আমি কী বলব, বুঝিতেছি না। আনন্দে চিত্ত ভরিয়া উঠিয়াছে। যাহা ভাবিতে পারি নাই তাহা আজ প্রত্যক্ষ করিলাম। নবীন পুত্র-কন্যাদের ভিতর মানুষের জন্য যে এমন বেদনা বোধ জন্মিয়াছে ইহা ভাবিয়া আমি পুলকিত হইতেছি। দুঃস্থ সহায়শূন্য রমণীদের জীবন দেখিয়া সত্যসত্যই মনে হয় ইহারা সংসারের আবর্জনা বিশেষ। হস্ত পদ থাকা সত্ত্বেও কে ইহাদিগকে নিজীব জড়পদার্থ করিয়া তুলিয়াচে তাহা বুঝিতে। পারিতেছি না। প্রিয়তম কল্যাণীয় রায়হান মিঞা এবং আমার কন্যা কল্যাণীয়া করিমা ও অন্যান্য বক্তারা যাহা বলিয়াছেন তাহাই আমাকে পুনরায় বলিতে হইবে।”

“আমি জানি, এক ভদ্রলোক একদা মক্কাশরীফ অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল পূণ্য লাভ করা। তিনি যে দিন উৎসব করিয়া যাত্রা করিলেন ঠিক সেই দিন তাহারি গৃহপার্শ্বে এক বৃদ্ধা অনশনে কাল কাটাতেছিল।”

“দেশের রমণীদের জীবন ভারস্বরূপ এ-কথা খুবই সত্য। কন্যা বলিয়া বাল্যকালে তাহাকে এক পার্শ্বে বসিতে হয়, অল্প খাইতে হয়–জগতের সকল সৌন্দর্য ও জ্ঞান তাহার দৃষ্টির সম্মুখ হইতে সরাইয়া লওয়া হয়। বিবাহের পর অনুন্নত আত্মা লইয়া স্বামীগৃহ হইতে তাহাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হইতে হয়। যদি কোনো কারণে সে স্বামীগৃহ হইতে ফিরিয়া আসে তাহা হইলে জীবন অন্ধকারময়। মনে হয়, খুবই ভয়ানক।”

“আর এ কথা–বহু বালিকা দুষ্ট লোকের ষড়যন্ত্রে পতিতাদের হস্তে পড়ে। আহা! অনিচ্ছা সত্ত্বেও কত কুসুম-কলিকা বালিকা পাপের পথে পড়িয়া আছে, কে তার খবর রাখে? এইসব বালিকার ফিরিবার পথ নাই। সমস্ত বিশ্ব তাহাদিগকে দূর করিয়া দেয়–অপমান ও লজ্জা ছাড়া তাহাদের ভাগ্যে আর কিছু থাকে না। এই সব বালিকার বাহুতে যদি শক্তি থাকিত–যদি তাহাদের পুরুষের ন্যায় নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিবার ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে তাহারা সেই সব পৈশাচিক স্থানে বাস করিতে বাধ্য হইত না। স্ত্রীলোকে অনেক সময় স্বামীর গৃহের তাচ্ছিল্য ও লাঞ্ছনার ভয়ানক পরিণামের কথা বলিয়া থাকে। তার কারণ স্ত্রীলোকদের সত্যসত্যই রূপ ছাড়া গর্ব করিবার আর কিছু নাই। একেবারেই তাহার আবর্জনা বিশেষ-পরমুখাপেক্ষী, অত্যন্ত নির্ভরশীল। কে কবে দীনহীন দরিদ্রকে ভালবাসে? কুরূপা নারীও সম্পদশালিনী হইলে তাহাকে সকলেই ভালবাসে।”

“নারীকে যখন পুরুষের সহিত বসবাস করিতে হয় তখন তাহাকে অনেক পরিমাণে পুরুষে সমকক্ষ করিত হইবে, নচেৎ নারীর ভাগ্য ফিরিবে না।”

“পুরুষ সারাজীবন পাপ করিয়া বৃদ্ধকালে দেশমান্য ঋষি হইতে পারেন–আর নারী যদি একটু পথভ্রষ্টই হয় তবেই তাহার সর্বনাশ। বিধাতার দুয়ার তাহার সম্মুখে রুদ্ধ। কী অন্যায়–কী বেদনা! নারী কি মানুষ নহে? পাপী নারীর কথা কেহ আলোচনা করিতেও লজ্জা বোধ করেন। পুরুষ তাহার পাপী লম্পট পিতার চরণধূলি মাথায় লইয়া স্বর্গে যাইবার। ব্যবস্থা করে! কিন্তু অনুতপ্তা পতিতা নারীকে কেহ স্থান দেয় না। এই সব অত্যাচারিত বালিকা ও নারীর জীবনের মূল্য কে দিবে? একটি জীবনের দুঃখের দাম তো সমস্ত বিশ্ব দিলেও শুধবার নয়।”

“আমরা আমাদের নারী-আশ্রমে কী করিতে চাই? আমরা সর্ব প্রথম নারীকে জ্ঞান দিতে চাই। যাহার মধ্যে জ্ঞান আছে সে যে অবস্থায়ই পড়ুক না কেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে। বিশ্বের সম্মুখে নিজের মর্যাদাকে সে গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হইবে। জ্ঞানী মরিবার নয়–সে মাথা নত করিবার নয়। মনে হয় পুরুষ অপেক্ষা নারীর অধিক শিক্ষা আবশ্যক। শিক্ষিতা মাতৃদলের মহিমায় অতি অল্পসময়ে যে কোনো জাতি উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হইতে পারে। বঙ্গদেশের সমস্ত পুরুষের বিদ্যালয় ও কলেজের পুরুষ ছাত্রদের পরিবর্তে যদি মহিলাদিগকে উচ্চ শিক্ষিতা করা যাইত, তবে বাঙালি অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হইতে পারিত। কতকগুলি শব্দ বা অভিধান মানুষ গঠন করে না। ভাবই শক্তির নিঝর। শিক্ষিতা নারী গৃহের কাজ করিতে করিতে সন্তানকে অতি শিশু বয়সেই মহৎ, গরীয়ান ও শক্তিমান করিয়া তুলিতে পারিতেন।”

“বহু রমণী সমাজ-অত্যাচারে গৃহ ছাড়া হয়। জগতের কোথায়ও তাহাদের স্থান হয়। লম্পট ও বদমাইস পুরুষদের জন্য অট্টালিকা।–শিক্ষিত ও বড় লোকের শ্রদ্ধা, উচ্চ আসন এবং উপাসনা মন্দির পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

আহা! নারী বলিয়াই কি নারীকে পশু অপেক্ষা ঘৃণিত অবস্থায় রাখিতে হইবে? আমাদের এই শিল্পাগারে সকল শ্রেণীর ও জতির রমণীদের আশ্রয়স্থল হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষার সহিত নানাবিধ শিল্পকার্য শিক্ষা দিয়া আত্মনির্ভরশীল করিয়া দেওয়া হইবে। দর্জির কাজ, মিস্ত্রীর কাজ, পুস্তক বাঁধাই, বস্ত্রবয়ন, আরও বিবেচনা মতো অন্যান্য বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইলে তাহাদিকে অসহায় অবস্থায় কাল কাটাইতে হইবে না–পেটের জন্য রূপ বিক্রয় করিতে হইবে না। মূর্খতা, দারিদ্র ও অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা রমণীর জীবন দুঃখময় করিয়া তুলিয়াছে। তাহারা পুরুষের হাতের খেলনা–ইচ্ছা হইলে পুরুষ কাছে স্থান দেয়, অথবা ফেলিয়া দেয়। মানুষের এ-অধোগতি বাস্তবিকই অসহ্য। আমি এই মহাকার্যে আমার বাৎসরিক ১২,০০০ টাকা আয়ের সম্পত্তি দান করিলাম।”

.

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

ইহার পর এক বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে। নৈহাটির সন্নিকট মহেন্দ্র নগরের থানা নদীর ধারে অবস্থিত। রাত্রিকালে থানার বারান্দা হইতে মিলের অসংখ্য প্রদীপশ্রেণী দৃষ্ট হয়।

থানার অধীন গ্রামগুলিতে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। স্থানে স্থানে দুই এক ঘর দরিদ্র মুসলমান পরিবার বাস করে। তাহারা অনিচ্ছায় অনেকটা হিন্দু ভাবাপন্ন।

থানার পার্শ্ব দিয়া পূর্ব-পশ্চিম অভিমুখে একটি প্রকাণ্ড রাস্তা। রাস্তার পার্শ্বেই বাজার। বাজারে হিন্দু-মুসলমান দুই শ্রেণীর লোকই সমাগত হয়। খোরশেদ আজ ছয় মাস হইতে এখানকার দারোগা। বড় দারোগা যিনি তিনিও মুসলমান।

সেদিন শনিবার বৈকাল বেলা খোরশেদ ও বড় দারোগা সাহেব থানার বারন্দায় বসিয়া আলাপ করিতেছিলেন, এমন সময় চারিজন চৌকিদার একটি মৃতদেহ লইয়া তাহাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল।

মৃতদেহের মাথায় একটা রক্ত সিক্ত টুপি লাঠির আঘাতে মাথাখানি দুই ভাগ হইয়া গিয়াছিল।

খোরশেদ ভীত ও বিস্ময়ে কুরসি ছাড়িয়া দুই পদ পেছন হাটিয়া কহিল–“কী ভয়ানক!–কে মুসলমানের রক্ত এমনভাবে ফেলতে সাহস করেছে?” তারপর হাঁকিয়া কহিল–“চৌকিদার ব্যাপার কী? বল।”

বড় দারোগা আবুল হোসেন মিঞা বলিলেন–খুবই দুঃখের বিষয়, তবে বিস্মিত হলে চলবে না। সবে দারোগা হয়েছেন, কিছুদিন খুন-জখম দেখে একটু বিস্মিত হবেনই। হৃদয় শক্ত হলে আর এ বিস্ময় থাকবে না।

খোরশেদ। দারোগা সাহেব, মুসলমানের উপর জুলুম দেখলে চিরকালই যেন আঘাত পাই। মুসলমানকে নিষ্পেষিত হতে দেখে মন শক্ত করে রাখব? অসম্ভব।

আবুল হোসেন। মুসলমানের দুর্দশা দেখে মন শক্ত করে রাখতে বলছি না। মুসলমান হয়ে তা কি বলতে পারি? কিন্তু সে যদি অন্যায় কাজ করে–পরের মাথা ভাঙ্গতে গিয়ে নিজের মাথায় আঘাত পায়?

খোরশেদ। মুসলমান অন্যায় করলেও সে মুসলমান। সে যদি চুরি করে তা হলেও আমি ক্রুদ্ধ হই না। সে যদি বিধর্মীকে হত্যা করে তাকে আমি ধন্যবাদ দেই। হিন্দুকে জব্দ করাই মুসলমানের ধর্ম। শয়তান-প্রতিম কলিকাতার মুসলমান গুণ্ডাকে আমি ভালবাসি। হিন্দু ঋষি হলেও আমার শ্রদ্ধালাভ করবে না।

আবুল হোসেন। এ সব আলোচনা এখন থাক। আপনাকে এখনই ঘটনা স্থলে যেতে হবে। চৌকিদার, তোমাদের এজাহার বল।

চৌকিদার ফেলারাম মুচি বলিল–বাবু, হুজুর! এই যে মড়া দেখতে পাচ্ছেন, এ মড়া হচ্ছে আজিজ মিঞার। গত রাত্রে কে বা কারা আজিজকে হত্যা করে গিয়েছে তার ঠিকানা নেই।

মহেন্দ্রনগরের থানা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে ঠাকুর জমিদারদের কাছারী। আজিজ তাহাদের এক প্রজা। সে হুগলীতে কিছুদিন পড়িয়া ছিল এবং এবং ইসলাম-প্রচারক মৌলবী হালিমুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে বহু দেশ ঘুরিয়া বহুলোকের সহিত মিশিয়া এবং বহু কথা শুনিয়া বিলক্ষণ জ্ঞান অর্জন করিয়াছিল। সামান্য লোকের পুত্র হইলেও আজিজের আত্মসম্মান জ্ঞান জন্মিয়াছিল। শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সদ্ব্যবহার ও স্পর্শে মন উন্নত হইয়া গিয়াছিল।

জমির খাজনা দিবার জন্য আজিজ কাছারীতে নায়েব গণেশ মুখার্জির কাছে গিয়াছিল। নায়েব মহাশয় আলবোলাটা নিতেছিল, তখন অজিজ মিঞা যাইয়া সেখানে উপস্থিত হইল। নয়েব আজিজের বেপরোয়া ভাব দেখিয়া জ্বলিয়া গেল। কারণ আজিজ আভূমি নত হইয়া নায়েবকে সেলাম করিয়া ছিলেন না।

নায়েব সম্মান নষ্ট হইবার ভয়ে অজিজের দিকে চাহিল না। একখানা চেয়ার ছিল। আজিজ কাহারও অনুমতি না লইয়া সেখানে বসিয়া পড়িল।

নায়েব অগ্নিশর্মা হইয়া কহিল–ছোটলোক, নেড়ে!–কাল তোর বাবা কাছারীর মেজে ঝট দিয়ে গেল, আজ তুই সেই কাছারীর কুরসিতে এসে বসেছিস।

আজিজ বলিল–তা ঠিক নায়েব মশায়। কাল তোমার বাবাও দুর্লভ তিলির ভাত বেঁধে আর মাঠে ধান কুড়িয়ে ফিরত। তার বেটা তুমি ও নায়েব হয়ে বড় মানুষ হয়েছ। তুমি না একটু চিটে গুড়ের জন্য বেদনগাছির বাজারে নারকেলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে? বেশি দিনের কথা নয়!

নায়েব ক্রোধে আজিজের কান ধরিয়া মাথায় হস্তস্থিত রুল দিয়া এক প্রচণ্ড আঘাত করিল।

আজিজ মাথার কাপড় জড়াইয়া কাছারিগৃহ পরিত্যাগ করিয়া আসিবার সময় বলিয়া আসিল–কাফের, ইসলামের অর্থ তুমি কী বুঝবে! এ গণ্ডিতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র বলে কোনো কথা নেই–আশরাফ-আতরাফ বলে কোনো কিছু নেই-ইসলাম শুধু আত্মাকে চিনে–আত্মার গৌরব-বলে বড়। ইসলাম বড়-ছোট বলে কোনো সার্টিফিকেট কাহারো গলায় বেঁধে দেয় না। চরিত্র, মনুষ্যত্ব ও জ্ঞানের ঐশ্বর্যে সে মহারাজা। যে ইসলামের এ-কথা মানে না সে অন্ধ মানুষের কাছে যত আসনই পাক না কেন, সে হীন। হিন্দু মানুষের মনষ্যত্বকে অবহেলা করতে সঙ্কোচ বোধ করে না। ইসলাম সৌধ মনুষ্যত্বের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ঊর্ধ্ব দিকে অঙ্গুলি তুলিয়া অধিকতর দৃপ্তকণ্ঠে কহিল–নায়েব, যদি বেঁচে থাকি তোমার একজনের পাপের জন্য সমস্ত হিন্দুসমাজকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করব।

আজিজ আর দাঁড়াইতে পাড়িল না। চাঁদর দিয়া মাথায় রক্তস্রোত রুদ্ধ করিয়া কোনো রকমে সে বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। তার একই স্ত্রী যুবতী ও সুন্দরী–নাম তার গুল।

গুল স্বামীর কণ্ঠের কাছে মুখ লইয়া কহিল–কী সর্বনাশ! এ দশা কে করিল? তাহার পর উচ্চঃস্বরে চিৎকার করিল। তাহার পর পাগলিনীর ন্যায় এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরিয়া কাহাকেও না পাইয়া স্বামীকে আসিয়া কহিল–কেউ তো বাড়ি নেই। ওগো বসো, আমিই না হয় ডাক্তার আনতে যাই।

আজিজ কহিল–না প্রিয়ে, হাদীস শরীফে আছে স্ত্রীলোকের বাড়ির বের হতে নেই, তা ছাড়া হিন্দু আমাকে মেরেছে–একথা লোকসমাজে জানান অপমানজনক।

সেই রাত্রিতেই আজিজের মৃত্যু হইল। প্রতিবেশী কলিমুদ্দীন, হাফেজ এবং বেদার মৌলবী আসিয়া কহিল–হিন্দুর অত্যাচার অসহ্য হয়ে পড়েছে। খোদার মরজি কালবশে গোলাম বাদশাহ্ হয়েছে। বাদশাহ্ গোলাম হয়েছে। সবুর!

সে রাত্রে বা পর দিন আজিজকে মাটি দিতে কেহ সাহস পাইল না।

আজিজের মুত্যু যে একটু দোষের মৃত্যু!

আজিজের পত্নীর কাছে যাইয়া খোরশেদ যথাসময়ে শুনিল দুপুর রাতে তার স্বামীর মৃতদেহ তার বিছানার পার্শ্বে পড়ে ছিল। সে আর কিছু বলিল না।

চৌকিদার, দফাদার, গ্রামের লোক সকলেই কহিল, তাহারা আর নূতন কিছু জানে না।

খোরশেদ গোপনে চৌকিদারের নিকট হইতে যাহা শুনিল তাহাতে সে একেবার স্তম্ভিত হইয়া গেল। তদারক হইতে ফিরিয়া আসিয়া সে ভারিতেছিল মুসলমান বিশেষ দীনদার লোকের পত্নী যে অসতী হইতে পারে তা এই জানিলাম। এমন কিছু যে সম্ভব তা সে কখনও ইহার পূর্বে ভাবিতে পারে নাই। সে ইচ্ছা করিল রিপোর্টে এইসব কলঙ্কের কথা লিখিয়া উপরিস্থ কর্মচারীকে যা–তা একটা স্বজাতির বিরুদ্ধে মন্তব্য লিখে মাথা হেঁট করিব না; ব্যাপরটা চাপা দিতে হইবে।

তখন দুপুর রাত। খোরশেদের ঘুম হইতেছিল না। সে ভাবিতেছিল, ছিঃ মুসলমানের ঘরেও অসতী স্ত্রীলোক সম্ভব! এখানে তালাক নেকাহ্ সবেরই তো ব্যবস্থা আছে।

তখন থানায় সকলেই সুপ্ত। গ্রামখানি নিথর নিস্তব্ধতায় সাড়াহীন। দুই একটি পাখি আর্তচিৎকারে মৌন বিশ্বের কাছে বেদনা জানাইতেছিল।

সহসা খোরশেদ শুনিল তাহারই জানালা পার্শ্বে রমণীকণ্ঠে মৃদু ভগ্ন স্বরে কে যেন ডাকিতেছে–ছোট বাবু! ছোট বাবু! স্বর বড় করুণ ও বেদনাব্যঞ্জক।

অন্ধকারে তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া খোরশেদ সহানুভূতি-মাখাস্বরে কহিল–কে কে, ভিতরে এস।

টেবিলের উপরকার মোমের বাতিটি জ্বালাইয়া খোরশেদ বিস্ময়ে দেখিল–একটি মুসলমান যুবতী তাহারই সম্মুখে দণ্ডায়মান। চক্ষু, তার জল সিক্ত। মুখে একটা আশ্চর্য গৌরব ও লালিত্য।

যুবতী খোরশেদের প্রশ্নের বা অনুমতির অপেক্ষায় রহিল না। করুণ ভাষায় সে কহিল–দারোগা সাহেব! মুসলমানই মুসলমানের বেদনা বুঝে। নায়েব আমার স্বামীকে তার কাছারির ভিতর হত্যা করেছে।

খোরশেদের পায়ের কাছে এক থলি টাকা রাখিয়া যুবতী কহিল–এই নিন সে টাকা। সে আর দাঁড়াইল না। খোরশেদকে বিমূঢ় করিয়া দিয়া সে অন্ধকারে মিশিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *