০১-০৫. ডোবা থেকে এক বদনা পানি

রায়হান (উপন্যাস)
লুৎফর রহমান

প্রথম পরিচ্ছেদ

মা বলিলেন–“আমেনা, ডোবা থেকে এক বদনা পানি নিয়ে এস তো মা।”

আমেনা বদনা হাতে লইয়া ডোবায় পানি আনিতে গেল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফিরিয়া আসিল।

মা বলিলেন–“লক্ষ্মী মেয়ে–চাঁদ মেয়ে। আচ্ছা, ঘর থেকে লবণ আর মরিচ নিয়ে এস দেখি।”

আমেনা দৌড়াইয়া গিয়া ঘর হইতে মরিচ ও লবণ লইয়া আসিল। হাটের দিন খোরশেদ যে মাছ আনিয়াছিল তাহারি কয়েকখানা অবশিষ্ট ছিল। আমেনার মা ঠিক করিলেন বেগুন আর সেই মাছ রান্না হইবে।

ওমেদপুরে মজিদ মিঞার স্ত্রী আজ তিন বৎসর হইল বিধবা হইয়াছেন। মজিদ মিঞা যখন মারা যান তখন তার বিধবা পত্নী নফিসার এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ের নাম আমেনা। আমেনার বয়স এখন এগার–বড় লক্ষ্মী। শিক্ষার গুণে মেয়ে মার কথা অমান্য করতে জানে না।

পিতার মৃত্যুকালে খোরশেদের বয়স ছিল পনর। এখন তার বয়স আঠার হইয়াছে। ইংরেজি স্কুলে সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে। উনুনে ফুঁ দিয়া নফিসা মেয়েকে আবার কহিলেন–তরকারি কখানা কুটে নাও তো মা!

আমেনা ঘাড় নাড়িয়া বেগুন কুটিতে বসিল। বেগুন কুটিতে কুটিতে আমেনা শিশুর সরলতায় জিজ্ঞাসা করিল–“ভাই কোথায় গিয়েছে, মা?”।

নফিসা বিরক্ত হইয়া কহিলেন–“জালেম, গিয়াছে আবদুল হামিদের কাছে। বইয়ের পড়া কোন্‌খানে তা নাকি তার মনে নাই। আবদুল হামিদের কাছে থেকে পড়া শুনে আসবে। স্কুল তো বাড়ি নয়, মাষ্টার মাও নয়, বোনও নয়। সেখানে তো আর দুরন্তপনা খাটে না। পড়া না করলে মাষ্টার বেত মারেন। সে ভয় তার আছে।”

মা যে পুত্রের উপর বিরক্ত ছিলেন সেটা মিথ্যা নয়। বাড়িতে তার দৌরাত্ম মাঝে মাঝে এত ভয়ানক হইত যে নাফিসাকে সেজন্য চোখের জল ফেলিতে হইত। ছোট বোন আমেনা দিনের মধ্যে অন্তত দুইবার ভাইয়ের হাতে কিল-চড় খাইত।

আমেনা কিল-চড় খাইয়াও ভাইয়ের উপর রাগিত না। খানিক কাঁদিয়া আবার সেই ভাইকে ভাই বলিয়া ডাক দিত। সেই ডাকে নির্ভরশীলতা কানায় কানায় মাখান।

পাড়ার ছেলেরা সেদিন সকালবেলায় ডোবায় বড়শি ফেলিয়া মাছ ধরিয়াছিল। আমেনা তাহা দেখিয়াছিল। যখন দুপুরবেলা, মা শুইয়াছিলেন, তখন সে চুপে-চুপে ভাইয়ের ছিপ লইয়া সেইখানে গেল। ইচ্ছা, সেও মাছ ধরিবে। বড়শিতে যে টোপ গাঁথিতে হয় তা সে জানে না। খালি বড়শি ফেলিয়া প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা করিয়াও যখন সে দেখিল মাছ ধরে না তখন সে বিরক্ত হইয়া বড়শি ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। বড়শি চুরি করিয়া যে কী বিপদে পড়িতে হইবে তা সে একটুও তখন ভাবে নাই।

ইহারই মধ্যে খোরশেদ আসিয়া উপস্থিত। সন্ধ্যাবেলা, খোরশেদ পড়িতে না বসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল–“মা, ভাত হয়েছে?”

নফিসা কহিলেন–“পড়া না করেই ভাত বাবা? খানিক পড়–ইত্যবসরে মায়ে-ঝিয়ে রান্না করে নিয়ে আসি।”

“ভাত কোন্ দুপুরে খেয়েছি, তার পর বিকেলে দুটো মুড়ি ছাড়া আর কিছু খাই নাই। ক্ষুধাপেটে কি পড়া যায়?”

“খেলেই পড়া হয় না। খালি পেটে খুব পড়া হয়।”

“তুমি কচু বোঝ কি না? শাস্ত্রে বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি নাই–সেটা কি আর মিছে কথা?”

এই কথা বলিয়া খোরশেদ পড়িতে বসিল। মা পুত্রের কথায় উত্তর দিলেন না।

ইংরেজি বইটা খুলিয়া দুই একবার রিডিং পড়িয়া সে দেখিল ইংরেজি বড় সুবিধা বোধ হইতেছে না। বইখানা বিরক্তির সহিত বন্ধ করিয়া সে গ্রামার খুলিয়া বসিল। গ্রামারের পড়া ছিল কারকের অধ্যায়। ক্রিয়া কাহাকে বলে তাই যে বুঝিল না কারকের সে কি বুঝিবে? বিরক্ত হইয়া গ্রামার ফেলিয়া বাংলা পাড়িতে গেল। তাহাও সে অধিকক্ষণ পড়িতে পারিল না।

সহসা তাহার ইচ্ছা হইল, বড়শির ছিপখানা ঠিকমতো আছে কিনা একবার দেখিয়া আসে। অতঃপর ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্ধকারে সে ছিপ হাতড়াইতে লাগিল।

ছিপ সেখানে ছিল না। দুপুরে ছিপ লইয়া আমেনা মাছ ধরিতে গিয়াছিল। ফেরত আনিতে তাহার মনে ছিল না।

যথাস্থানে ছিল না দেখিয়া খোরশেদ চিৎকার করিয়া কহিল–“কে আমার ছিপ নিয়েছে রে?” রান্নাঘরে আমেনা তখন বাটনা বাটিতেছিল। ভাইয়ের গলার কঠিন আওয়াজ শুনিয়া সে নোড়া ফেলিয়া মুহূর্তের মধ্যে মাকে না বলিয়াই অন্ধকারে বাহির হইয়া গেল।

পাছ ফিরিয়া নাফিসা ঝাপির ভিতর মসলা খুঁজিতেছিলেন। ফিরিয়া দেখিলেন–মেয়ে বাটনা ফেরিয়া বাহিরে গিয়াছে।

“ও মা-আমেনা” বলিয়া তিনি ডাকিলেন।

আমেনা উত্তর দিল না।

নফিসা আবার ডাকলেন–“আমেনা!”

তবুও আমেনা উত্তর দিল না।

একটু শঙ্কিত হইয়া নফিসা উনুনে ভাত ফেলিয়া বাহিরে আসিলেন।

সহসা ডোবার ধার হইতে আমেনা আর্ত ও ভীতস্বরে চীৎকার করিয়া ডাকিল–মা, মা!

অত্যন্ত ভীত হইলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন চিৎকার করে, আমেনা ভয়ে তেমনি করিয়া চিৎকার করিতেছিল। সেই সময়ে রাস্তা দিয়া রায়হান যাইতেছিলেন। রায়হান চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

নফিসা প্রদীপ লইয়া বাহিরে দৌড়াইয়া গেলেন এবং দূর হইতেই ব্যগ্র আর্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?” ততক্ষণে রায়হান আমেনার স্বর লক্ষ্য করিয়া দৌড়াইয়া ডোবার ধারে আসিয়া ভীত অর্ধ-মূৰ্ছিতা আমেনার সিক্ত-শীতল দেহ কোলে লইয়া নফিসার দিকে আসিতেছিল।

আমেনার বসন সিক্ত। ধীরে ধীরে তাহার নিশ্বাস পড়িতেছিল।

মেঝের উপর পাটি পাতিয়া মা মেয়েকে শোয়াইলেন। রায়হান পার্শ্বে বসিয়া বাতাস করিতে লাগিল। নফিসা আমেনার মুখের কাছে মুখ লইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া ডাকিতে লাগিলেন–“মা আমেনা! মা আমেনা!”

কিয়ৎকাল পরে আমনো চক্ষু মেলিল। রায়হান জিজ্ঞাসা করিল–“কী আমেনা এমন করে চেঁচিয়ে উঠলি যে?”

বালিকা মৃদুস্বরে কহিল, দুপুরবেলা ভাইয়ের ছিপ নিয়ে ডোবায় ফেলে এসেছিলাম। ভাই এখন ‘ছিপ ছিপ’ করে চেঁচিয়ে উঠলো, তাই আনতে গিয়ে দেখলাম একটা সাদা মানুষ বাঁশঝাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে।”

খোরশেদ এতক্ষণ চুপ করিয়া তামাসা দেখিতেছিল। ছিপের সন্ধান পাইয়া সে বিরক্তির সহিত জিজ্ঞাসা করিল–“কিরে পাজি, তুই ছিপ নিয়েছিলি?”

নফিসা রুক্ষস্বরে বলিলেন–“পাজি, নচ্ছার, বের হ বাড়ি থেকে।” শুধু এই বলিয়াই তিনি নিরস্ত হইলেন না। তাহার পিঠে একটা চড় লাগাইয়া দিলেন।”

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রায়হানের বয়স পঁচিশের বেশি হইবে না। গ্রামের প্রান্তে তার একখানা দোকান। ছোটকালে পয়সার অভাবে ইংরেজি স্কুলে তার পড়া হয় নাই, যদিও জ্ঞানলাভের প্রতি তার বিপুল আগ্রহ ছিল। সেই যে বাল্যে ওস্তাদ সাহেবের পাঠশালায় সে প্রাইমারি পাশ করিয়াছিল, তারপর আর তার কোনো স্কুলে পড়া হয় নাই।

অনেক বৎসর পড়া ছাড়িয়া দিলেও, সে নজরের সম্মুখে যে বাঙালা বইখানা পাইত তাহাই আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করিত। আত্মার সন্দেহ দিকটা চাপা পড়ে যাওয়াতে রায়হানের ব্যবহার, কথা ও স্বভাব দিন দিন অধিকতর মার্জিত হইয়া প্রকাশ পাইতেছিল। গ্রামে রাস্তার পার্শ্বে তাহার একখানা দোকান ছিল।

দোকানে চাল, ডাল, চিড়ে, মুড়ি, গুড়, সরিষার তৈল, আরও অনেক রকম জিনিস পাওয়া যাইত। ক্রেতাদের সঙ্গে তার ব্যবহার খুবই মধুর। তার অভ্যাস–একবার ছাড়া দুইবার কোনো জিনিসের দাম না বলা। সে কাহাকেও কোনো জিনিস বাকি দেয় না। প্রথমে ইহার জন্য অনেকে তার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু সে কাহারও কথা শুনে নাই। এমন কি, গ্রামের অনেক ভদ্রলোক প্রথম প্রথম তার দোকান জোর করিয়া তুলিয়া দিবেন বলিয়াছিলেন, কিন্তু ভাগ্যে গ্রামের নসির মিঞা তার দিকে ছিলেন। নসির মিঞা মসজিদের ভিতর বলিয়া দিয়াছিলেন, গ্রামে দোকান থাকাতে সকলের পক্ষেই লাভ। বাকি লইলে দোকান থাকিবে না। নসির মিঞা গ্রামের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী লোক, অথচ অত্যাচারী নন।

কেউ কেউ সন্দেহ করিয়াছিল যে, সকলের সুবিধা নষ্ট করিয়া নসির নিজের সুবিধা করিয়া লইলেন। কিন্তু তিনি সে ধরনের লোক নন। তার ছেলে একদিন দোকানে বাকি জিনিস আনিতে গিয়াছিল–শুনিতে পাইয়া তিনি ছেলেকে মারিয়াছিলেন এবং ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন। ক্রমশ রায়হানের অনেক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বন্ধু জুটে গেল। আবদুল হামিদ তাদের একজন। ইদানীং কেউ কোনো জিনিস তার দোকান হইতে ধারে লইত না। সকলেই বুঝিয়াছিল ধার করিয়া জিনিস লইলে সেই ছোট দোকানের ছোট প্রাণটি দুই দিনেই বাহির হইয়া যাইবে।

সন্ধ্যাবেলা রাজভাষাখানা একটু পড়িয়া দোকানের দুয়ার বন্ধ করিয়া রায়হান ভাত খাইতে বাড়ি যাইতেছিল। আবদুল হামিদের বাহির-বাড়ির উপর দিয়াই তাহার পথ।

জোছনার আলোকের মধ্যে দাঁড়াইয়া হামিদের বিধবা বোন করিমা একটু বড় পেয়ারা গাছের মাথার দিকে চাহিয়াছিলেন। করিমার বয়স পঁচিশ। বর্ণ উজ্জ্বল গৌর, বৈধব্যের অবহেলায় কিঞ্চিৎ স্লান ও নিষ্প্রভ, তবুও কোনো অপরিচিত মানুষ সে মুখের দিকে যদি চাহিত, সে স্তব্ধ হইয়া যাইত।

রায়হান করিমাকে একাকী বাহির-বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া মাথা নত করিয়া চলিয়া যাইতেছিল। করিমা ডাকিয়া কহিলেন,–রায়হান, তুমি বড় লাজুক এবং তার ফলে অভদ্র।”

রায়হান বলিলেন–“আপনি আমার বাল্যবন্ধু হলেও বয়সকে মেনে চলতে হবে।”

“ছিঃ! এরূপ কথা বলা অন্যায়। এস আমাদের বাড়ির ভিতর।” রায়হান করিমার সহিত বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল।

হামিদ তখন পড়িতেছিল। রায়হানকে দেখিয়া সে কহিল, “রায়হান, আমার বাংলা পড়াটা বুঝিয়ে দিয়ে যাও তো।”

করিমার মা হাফিজা সেখানে ছিলেন। পুত্রের ধৃষ্টতার বিরক্ত হইয়া তিনি কহিলেন, “হামিদ, কথা বলতে জান না।” হামিদ অপ্রস্তুত হইয়া চুপ করিয়া রহিল।

মৌলবী সাজেদ আলী রিটায়াড় পুলিশ ইন্সপেক্টর। শেষ বয়সের পুত্র হামিদ আহ্লাদে একটু বেয়াদব হইয়া পড়িয়াছিল।

হাফিজা রায়হানকে বসিতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,–“দোকান কেমন চলছে বাবা?”

রায়হান সে কথার উত্তর না দিয়া কহিল–চাচি, হামিদ আমার এক বয়সের, অমন করে কথা বল্লেও বিশেষ দোষ হবে না।”

হাফিজা বলিলেন–“তুমি হচ্ছ করিমার বয়সের, যদি ও ওর বুয়াকে মানে তাহলে তোমাকেও মানতে হবে। সম্রম করে কথা না বলুক বাড়ির উপর মানুষ এলে বসতেও কি বলতে নেই? সোজাসুজি নাম ধরে নবাবের মতো হুকুম!”

হামিদকে একটু উৎসাহিত করিয়া তুলিবার জন্য রায়হান স্বইচ্ছায় তাহাকে খানিক বাংলা পড়াইয়া দিলেন। ঘরে পড়িয়া রায়হানের বাংলা ভাষার জ্ঞান জন্মিয়াছিল, সুতরাং অনায়াসে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র হামিদকে পড়াইতে সক্ষম হইলেন।

হাফিজা মেয়েকে বলিলেন–“রায়হানকে কিছু খেতে দাও।” তারপর একটু থামিয়া কহিলেন–“রায়হান, ছোটকালে তুমি এখানেই সারাদিন করিমার সঙ্গে খেলে খেলে কাটিয়ে দিতে।”

রায়হান আপত্তি করিলেন না।

করিমা ছোট একখানা কাঁসার থালায় কতকগুলি মুড়ি, কয়েকটা নারিকেলের নাড় –একটু হালুয়া এবং খানিকটা সর আনিয়া দিল।

মনের একটা দারুণ বেদনা, একটা ছোট চাপা দীর্ঘশ্বাসের আকারে করিমার বুকখানাকে সহসা কাঁপাইয়া গেল। তাহার উজ্জ্বল নীল চক্ষু একটু শিহরিয়া উঠিল। বাহিরে স্নিগ্ধ নীল ও উজ্জ্বল প্রকৃতির পার্শ্বে করিমার পেলব-গৌর দেহখানি স্বপ্নমাধুরী সৃষ্টি করিতেছিল। সে যখন দাঁড়াইল তখন বোধ হইতেছিল একখানা তরল, অতি সুন্দর কনক প্রতিমা জোছনার উপর দাঁড়াইয়া পৃথিবীর ললাটে একটা মাধুরীর টিপ কাটিয়া দিতেছে।

হাত ধুইয়া রায়হান বলিলেন–“চাচি! আবার এখনি আমাকে খেয়ে দোকানে যেতে হবে।”

হাফিজা বলিলেন–“আচ্ছা বাবা! তাহলে যাও।”

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বৈকালবেলা মৃদু মন্দ বাতাস বহিতেছিল। শেফালিকা গাছের তলায় দাঁড়াইয়া নীল অঞ্চলখানা উড়াইয়া দিয়া আমেনা একখানা শিলার উপর পা রাখিয়া তাহাতে মেহেদীর পাতার রঙ লাগাইতেছিল।

নীল বসনের নিচে রক্তরাঙ্গা কচি কুসুমগুচ্ছের মতো পা দুখানি স্বল্পসুষমা সৃষ্টি করিয়াছিল। সে বুঝিতেছিল না বৈকালবেলায় স্নান প্রকৃতির গায়ে কতখানি গৌরব সে ভরিয়া দিতেছে। কাল কেশগুচ্ছের পাশে তার কিরণময় মুখখানি যেন শ্যামল পল্লব-লতার ভিতরকার একটা লাল গোলাপ বলে ভ্রম হইতেছিল।

রায়হান দূর হইতে দেখিলেন শত সৌন্দর্যে ছোট বালিকা দেহটিকে ভরিয়া সুষমাময়ী আমেনা দাঁড়াইয়া আছে।

নজর পড়িতেই আমেনা একেবারে বিদ্যুৎবেগে বাড়ির ভিতর যাইয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিল।

নফিসা মেয়ের আকস্মিক চাঞ্চল্যে বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কিরে, কী হয়েছে?”

দরজার ওপাশে দাঁড়াইয়া আমেনা চাপা গলায় ফিক ফিক করিয়া হাসিতেছিল।

রায়হান নফিসাকে আদাব করিয়া মাটির উপর বসিয়া পড়িলেন।

নফিসা বিস্ময়ে কহিলেন–“রায়হানকে দেখে এত লজ্জা! শীগগির একখানা পাটি নিয়ে এসে তোমার ভাইকে বসতে দাও।”

রায়হান বলিলেন–“আমেনা হয়তো মনে করেছে আর কেউ।”

কেন অমন করিয়া ছুটিয়া পালাইয়া দরজার ধারে আসিয়া সে দাঁড়াইয়াছে তা আমেনা নিজেই ঠিক করিতে পারিতেছিল না। একটা সহজ ভাব মুখের উপর ফেলিয়া আমেনা রায়হানের সম্মুখে একখানা মাদুর পাতিয়া দিল।

নফিসা মেয়েকে বলিলেন–“তোমার ভাইয়ের পা চুম্বন করো।” একটু থামিয়া অন্যদিকে মুখ করিয়া পুনরায় কহিলেন–“রায়হানের কাছে আমেনা চিরজীবন ঋণী, সেই বিপদের কথা কখনো ভুলবো না। আর একটু হলেই মেয়ে আমার মরে যেতো।”

রায়হান মৃদু হাসিয়া বলিলেন–“থাক্। সালাম-শ্রদ্ধা না হলেও আমি ওকে ভালবাসি।” একটুখানি যে কোনো রকম আঘাত যেমন বেহালার তারে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সুরময় হইয়া বহিতে থাকে, রায়হানের মুখের কথাগুলি তেমনি করিয়া আমেনার মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া বাজিতে লাগিল। সে ভাবিল, মা ছাড়া আরও একটা মানুষ তাকে ভালবাসে, এ তো, সে জানে না। ভাই তাকে ভালবাসে না, যদিও সে নিজে ভাইকে খুব ভালবাসে।

মুখখানি একটু টানিয়া লইয়া মোহন হাসির আলোয় কপোল ও ওষ্ঠদ্বয় প্রভাময় করিয়া আমেনা কহিল–“আমিও আপনাকে খুব ভালবাসি।”

মা বালিকার সরলতা ভরা কথায় একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“তুই তোর রায়হান ভাইকে কেমন করে ভালবাসিস?”

আমেনা কহিল–“কেন মা, আপনাকে যেমন করে ভালবাসি?”

রায়হান হাসিয়া বলিলেন–আমি কি তোমার মা?

আমেনা কহিল-মাইয়ের মতো। ভাইয়ের মতো নয়।

নফিসা ও রায়হান আমেনার কথায় অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিলেন।

ছোট অবগুণ্ঠনের ভিতর ছোট মুখখানি অভিনব বলিয়া বোধ হইতেছিল। মৃদু হাসির ক্ষীণ তরঙ্গ মাঝে মাঝে আমেনাকে আরও নয়ন মোহন করিয়া তুলিতেছিল।

রায়হান বলিলেন–আমেনা, পড়ে থাক?

আমেনা ঘাড় নাড়িয়া বলিল–না।

নফিসা কহিলেন–ও পড়ে না।

রায়হান–কিছুই পড়ে না?

নফিসা–শুধু কোরান পড়েছে। এখন আর কিছু পড়ে না।

রায়হান–তাতে মনে একটু পবিত্রতার ভাব জেগে উঠতে পারে। কিন্তু তাতে মনের অন্ধকার দূর হতে পারে না। মনের অন্ধকার দূর না হলে কোরান পড়া বৃথা।

নফিসা–তুমি ঠিক কথা বলেছ বাবা। জ্ঞানের দ্বারা মনকে চাষ না করতে পারলে ধর্ম পালন হয় না। লোকের সঙ্গে উঠতে বসতে পারা যায় না। শিক্ষিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোকা হতে হয়।

রায়হান–তা হলে আমেনাকে একটু একটু পড়াবার ব্যবস্থা করুন না কেন?

নফিসা–তা করা দরকার। কেমন লেকের হাতে পড়ে তার ঠিক নাই। খোদার মরজি হলে আর বেশি দেরিও নাই। লেখাপড়া না শিখলে হয়তো তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হবে। তুমি ভালো কথা মনে করে দিয়েছ। বাবা! আমেনার আত্মার উন্নতির জন্য কোনো চেষ্টাই হচ্ছে না। ভালো বর খোঁজবার আগে মেয়েকেও ভালো করে তোলা চাই, এ আমি জানি।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া নফিসা আগ্রহের সহিত আবার কহিলেন–“রায়হান, তাহলে তুমিই একটু একটু করে পড়িয়ে যেও।”

রায়হান–আপনার অনুরোধ আমার কাছে আজ্ঞা বলেই মনে হবে। মেয়ের লেখাপড়ার আবশ্যকতা আপনি বুঝেছেন, এটা বড় আশ্চর্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে, তারা মেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে মোটেই চান না।

নফিসা–কী বল, ধর্মে নারী-পুরুষ সকলেরই জ্ঞান আহরণ করবার নির্দেশ আছে। যারা মুসলামান ধর্মের কিছু জানে না–তারা নারী কেন, পুরুষকেও জ্ঞান ও আলোক হতে দূরে রাখে। না বুঝে লক্ষ লক্ষ পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করলেও কোনো লাভ হয় না। পাপে ভরা

অন্ধকারময় কদর্য আত্মা দিয়ে কোরান পাঠ করলে কোনো লাভ হয় না, এ কথা আমি বুঝি।

রায়হান–বেশ, ক্ষতি স্বীকার করে আমি আজ হতে আমেনাকে পড়াবো। কিন্তু ঠিক যদি তাকে আমার কাছে পড়তে দিলেনই, তবে আজ হতে অন্তত চার বৎসর আমি তাকে জ্ঞান দান করবো।

নফিসা–বেশ। বিয়ের জন্য প্রথম ভাগ ও কতকগুলি ভাঙ্গা হাড়ির মতো অক্ষর তৈরি করতে শিখলেই হবে না। সে প্রথম ভাগ পড়েছে। দ্বিতীয় ভাগও শেষ করেছে। তুমি তাকে এখন ভালো ভালো কথা শিক্ষা দাও, মন যাতে তার উন্নত হয়।

আমেনা মিটমিট করিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসিতেছিল। রক্ত ওষ্ঠ দিয়া একটু একটু করিয়া সুধা ঝরিতেছিল।

রায়হান আমেনাকে জিজ্ঞাসা করিলেন–এখন থেকে তুমি আমার কাজ বাড়িয়ে দিলে। রোজ বিকালে পড়তে রাজি আছ?

আমেনা হাসিয়া কহিল–কেন, সকল মানুষ যে সন্ধ্যাবেলা পড়ে?

রায়হান–সন্ধ্যাবেলা তোমার মাকে সাহয্য করতে হবে। একা তিনি অত কাজ করে। উঠতে পারেন না। সংসারের কাজও তোমাকে শিখতে হবে, শুধু বই পড়লে চলবে না।

হাতের কাজ শেখাও মেয়েদরে দরকার। তাছাড়া আমারও সময় হবে না। সন্ধ্যাকালে দোকান ছেড়ে আসতাম। এখন থেকে ঘণ্টাখানেক আগেই আসবো।

আমেনা–আমার পড়তে খুব ইচ্ছা করে। বাংলায় আমি পুঁথি লিখবো।

রায়হান বিস্মিত হইয়া বলিলেন–বটে, তোমার এত বড় কল্পনা! ছোট কালেই যার মনে এই ভাব সে খুব শিক্ষিতা হবেই হবে।

নফিসা বলিলেন–এটা খুব বিস্ময়ের কথা নয়। এমন দিন ছিল, যখন মুসলমান নারী কত বই লিখেছেন। বেশ তো, এরূপ কল্পনা খুব ভালো।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

স্কুলের ছুটির পর হামিদ, খোরশেদ ও রমেশ গ্রাম্য পথ ধরিয়া বাড়ি যাইতেছিল।

তখন বৈকাল বেলার হেমকর গাছের আগাগুলি সোনালি আভায় রাঙ্গা করিয়া তুলিয়াছিল এবং কুল-বধুরা মিত্রদের পুকুর হইতে জল লইয়া যাইতেছিলেন। তাহাদের হাসি ও কথায় পাতা আর গাছে-ঘেরা পুকুরপাড় মুখরিত হইয়া উঠিতেছিল।

স্কুল হইতে বাহির হইবার সময় চানা ও বুটওয়ালার কাছ থেকে খোরশেদ, হামিদ এবং রমেশ তিনজনেই এক পয়সা করে ছোলা ভাজা কিনিয়াছিল। লবণ আর মরিচের গুঁড়া মিশানো ছোলা খাইতে নাকি বেশ লাগে।

হামিদ বলিল–“সদর রাস্তা ছেড়ে এসেছিল। পানির তেষ্টাও খুব লেগেছে; আয় রমেশ, ঘাটে বসে ছোলা খাই।”

রমেশ বলিল–“বেশ! অনেকক্ষণ হতে আমারও জিভ দিয়ে জল ঝরছে।”

রমেশ তাদের সহপাঠী। অতঃপর তিন জনেই পুকুরধারে বসিয়া ছোলা চিবাইতে আরম্ভ করিল। রমেশ একটু দূরে বসিয়া খাইতেছিল। সে যে হিন্দু একথা খোরশেদের মনে ছিল না। খোরশেদ রমেশের দিকে অগ্রসর হইয়া অসঙ্কোচে কহিল–“রমেশ, তোরগুলি কেমন দেখি, এক মুঠ দে আমায়।”

খোরশেদ রমেশের কাপড়ের ভিতর হাত দিতেই রমেশ ঘৃণায় ক্রোধে সব বুট মাটিতে ফেলিয়া দিল।

হামিদ বিরক্ত হইয়া কহিল–“জান না ও হিন্দু। এত বৎসর একসঙ্গে পড়ে আসছ, ভুলে গেছ হিন্দুর আচারের কথা?”

খোরশেদ ততোধিক বিরক্ত হইয়া কহিল–“ফেলে রাখ তোমার আচার! হিন্দুর মুণ্ডুপাত ছাড়া আর কোনো ভালো কাজ নেই।”

মুখের কথা মুখেই রহিল। ক্রোধান্ধ খোরশেদ জুতা খুলিয়া রমেশের মুখে লাগাইয়া দিল।

হামিদ কাপড়ের ঝোলা ফেলিয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কাহিল–“তুমি কি পাগল হলে খোরশেদ? জুতাপেটা করলে কী কেউ জব্দ হয়? তোমার ধর্মের মহিমা কি তুমি এইভাবে প্রচার করবে?”

খোরশেদ কাপিতে কাঁপিতে বলিল–“হিন্দু ঘৃণা করবে মুসলমানকে! সম্পূর্ণ অসম্ভব। মুসলমান হিন্দুকে ঘৃণা করতে পারে।–কী অপমান! ওর কান ধরে আমি জলে চুবাচ্ছি। মুসলমান কি তার গৌরব ভুলে গেছে?”

হামিদ কহিল–“দেখ খোরশেদ, তুমি মুসলমানের মতো কথা বলছে না। মনুষ্যত্বহীন যে, সেই মানুষকে ঘৃণা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। মানুষকে ঘৃণা করা কি খুব প্রশংসার কথা? যারা হীন তারাই এ করে। মনের উন্নতির মাঝখানটাতে এই অহমিকার পরিচয় লোকে দিয়ে থাকে। হিন্দুরা এই দোষে দোষী। তুমি এতে বিরক্ত না হলে তা’দিগকে কৃপার পাত্র মনে করতে পার। তাকে জুতো মেরে কী লাভ? মুসলমানের মহিমা কি হিন্দুকে জুতো মেরে প্রতিষ্ঠিত হবে?”

খোরশেদ অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল–“রাখ তোমার বক্তৃতা। হিন্দুকে জুতোপেটা করাই উচিত। এমন পাজি ও অভদ্র জাত জগতের কোথাও নাই।” হামিদ পুনঃ নম্রভাবেই কহিল–“ছিঃ, তুমি ক্ষেপেছ। হাজার হলেও তারা আমাদের প্রতিবেশী। হিন্দু আমাদের ভাই। ইসলামের গৌরব রক্ষা করবার জন্য হিন্দুকে দেশছাড়া করতে চাও নাকি? তুমি নিজে নামাজ পড়ে থাক। মহাপুরুষ মোহাম্মদের অন্তত বড় বড় আদর্শগুলি প্রতিপালন করে থাক? খাঁটি মুসলমান মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তুমি কি মিথ্যাকে ঘৃণা করে থাক? যথার্থ এসলামের ভক্ত পূর্ণমনুষ্যত্ব লাভের জন্য চেষ্টান্বিত হবে।–তুমি তো করে থাক? তুমি নিজের চরিত্রের মন্দ অংশটুকু ঘৃণা কর। পরের আচার-ব্যবহার নিয়ে মাথাব্যাথা করবার, দরকার কী? আসল কথা, হিন্দু তোমাকে ঘৃণা করে না। তার মনে শক্তি নাই–সে বিবেক ও সত্য অপেক্ষা সমাজকে বেশি ভয় করে। রমেশ ঘাটের মেয়েদের ভয়ে অমন করে আঁৎকে উঠেছে। সে তোমাকে সত্য করে ঘৃণা করে না। ঘৃণা করতে পারে না। কোনো, মুসলমানের কাছে সে কোনো কালে অপমানিতও হয় নাই যে, তোমার উপর আজ শোধ তুলছে। সত্য, মুসলমান হও, জ্ঞানী হও, হিন্দুর কেন, প্রত্যেক হৃদয়বান মানুষের মাথা সম্ভ্রমে তোমার কাছে নত হয়ে পড়বে। লাঠালাঠি করে কোনো ফল হয় না। বুদ্ধি, সৎস্বভাব ও তর্কের দ্বারা মানুষকে জয় করো।”

খোরশেদ কটমট করিয়া হামিদের দিকে চাহিয়া কহিল–“তুমি একটা গরু!”

কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থাকিয়া, বই গুছাইয়া আবার তাহারা বাড়ির দিকে চলিল।

হামিদ প্রহৃত সহপাঠীকে সান্ত্বনা দিতেছিল।

খোরশেদ ক্ষুদ্ধ অপমানের বেদনা লইয়া আগে চলিল। এই সময় একটা হিন্দু-মেয়ে পুকুর হইতে কলসি কাঁখে লইয়া পার্শ্বের পথ হইতে খোরশেদের সম্মুখে আসিল। দুটি পথ যেখানে মিলিত হইয়াছে সেটা পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণা। খোরশেদের গায়ের সঙ্গে কলসির স্পর্শ ঠিক লাগে নাই।

টুপি-পরা খোরশেদকে লক্ষ্য করিয়া বালিকা কহিল–“রাম! মুসলমান ছোঁড়াদের জ্বালায় আর এ-পথ দিয়ে জল নেওয়ার যো নাই।”

একে খোরশেদের মনে তখনও অপমানের রক্ত ক্ষরিত হইতেছিল, তাহার উপর এই দ্বিতীয় আঘাতে সে নিতান্তই ধৈর্যশূন্য হইয়া পড়িল, কহিল–“তুই শ্যামসুন্দরের মেয়ে। ন? মুসলমান ছোঁড়ারা কী এই পথ দিয়ে নূতন গেল! মুসলমানের গায়ে কি গন্ধ! হারামজাদি!”

গিরিবালা কহিল–“কি! ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে মুসলামনের ছেলের এত হাইয়ের কথা! ছোটলোক, দূর হ।” এই কথা বলিতে বলিতে গিরিবালা তাহার কলসির জল ঢালিয়া ফেলিল।

খোরশেদ অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া প্রচণ্ডবেগে গিরিবালার ঘাড় ধরিল। বাম পা দিয়া একটা ভয়ানক পদাঘাতে পিতলের কলসিটাকে পুকুরের মধ্যে ফেরিয়া দিল। তারপর তাহার চুল ধরিয়া খোরশেদ বালিকার পিঠের উপর মুহুর্মুহু আঘাত করিতে লাগিল।

খোরশেদের চক্ষু দিয়া আগুন বাহির হইতেছিল। এই কাণ্ড অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঘটিয়া গেল।

হামিদ দৌড়াইয়া আসিয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কহিল–“খোরশেদ, তুমি পাগল হলে? আজ কি তোমায় ভূতে ধরেছে? সেয়ানা মেয়ের গায়ে হাত দাও! এটা তোমার কি অভদ্রতা নয়!”

খোরশেদ ক্রোধে কহিল–“বটে! আমায় ভুতে ধরেছে? তা ঠিক। কাল ওকে উলঙ্গ হয়ে পথের ধারে বেড়াতে দেখলাম। মেয়েছেলে কি না, সেয়ানা হয়ে ভারি বাহাদুর হয়েছে। ও আমাকে মুচি মোসলমান বলতে একটু দ্বিধা বোধ করলে না। কাফেরের বংশকে পাথর দিয়ে মেরে ফেলা উচিত।”

হামিদ শান্তস্বরে অথচ বিরক্ত হইয়া কহিল–“একই কথা বারে বারে বলা যায় না। ওদের যা আচার পুরুষানুক্রমে চলে এসেছে সেটা ওরা কী করে ভুলবে! যে তাতে রাগে সেই পাগল। তুমি একটু দূর দিয়ে গেলেই পাত্তে। এক হিন্দু অন্য হিন্দুকে ঘৃণা করে তা জান। স্বামী বৌকে ঘৃণা করে। পিতা পুত্রকে ঘৃণা করে। পুরোহিত শিষ্যকে ঘৃণা করে। এক দেশের হিন্দু অন্য দেশের হিন্দুকে ঘৃণা করে। মুসলমান তো দুরের কথা। ঘৃণার দ্বারাই ওরা ওদের স্বতন্ত্র রক্ষা করে আসছে। ওতে যে রাগে সে পাগল।”

পুকুর ঘাটের মেয়েরা তখন কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। তাহাদের হাসি তখন থামিয়া গিয়াছিল। বিলম্ব না করিয়া ভয়ে ভয়ে মেয়েরা যার যার মতো বাড়ি ফিরিয়া যাইতে লাগিল।

হামিদ রমেশকে কানে কানে বলিল–“খোরশেদ বুঝি আজ নেশা করেছে। মাঝে মাঝে তার মাথা খারাপ হয়। তুমি এই মেয়েটিকে নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এস; আমি ওকে নিয়ে বাড়ি যাই।”

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

ওমেদপুরে মৌলবীরা অনেকবার মিলাদ শরিফ পাঠ করিয়াছেন। কিন্তু কেহই তাহার একবর্ণও বুঝিতে পারে নাই। কেবল উর্দু, ফারসি ও আরবি, শ্রোতাদের হৃদয় তাতে কাঁদে নাই–ভক্তি ও রসে মন কাহারো আপুত হয় নাই।

পাড়ার বৌ-ঝি আর মুরব্বী মেয়েদের অনুরোধে রায়হান বাংলা-ভাষায় মিলাদ পাঠ করিবেন। এই কার্যে নফিসা ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। সুতারাং তাহারই বাড়িতে উৎসবের ব্যবস্থা হইয়াছে।

জোছনালোকে-স্নাত গ্রামখানি সিগ্ধ সৌন্দর্যে ভরপুর। আলো-বাতাসে মহিমা খেলিয়া বেড়াইতেছিল। মৃদু স্নিগ্ধ সমীর ধীরে বহিতেছিল। শ্যাম গ্রাম্য ছবিখানি শুভ্র বসনে কাহার দিকে যেন তাকাইয়াছিল।

সুন্দরীরা গ্রাম্য নির্জন পথ দিয়া ধীরে ধীরে খোরশেদের বাড়িতে আসিয়া সমবেত হইলেন।

ভাইকে লইয়া কর্মীরাও আসিয়াছিলেন। একখানা ধধবে সাদা কাপড় পরিয়া আভরণহীনা করিমা অন্তঃপুরে নফিসাকে যাইয়া সালাম করিলেন।

রায়হান একখানা পাটির উপর ঘরের বারান্দায় বসিয়াছিলেন। গ্রামের কোনো মেয়ে বা বধূ তাহাকে দেখিয়া লজ্জা বোধ করেন না। সকলেই তার আপনার।

হামিদ রায়হানের পার্শ্বে যাইয়া উপবেশন করিলেন।

পুরুষের ভিতর কেবল হামিদ, রায়হান ও খোরশেদ আজিকার এই উৎসবে যোগদানের অধিকারী হইয়াছিল।

রায়হানের পার্শ্বে রেড়ীর তেলের একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল। আর কোথাও কোনো প্রদীপ ছিল না। উঠানের উপর মেয়েরাই প্রশস্ত ফরাস পাতিলেন। ওজু করিয়া তাঁহারা এক এক স্থানে উপবেশন করিতে লাগিলেন।

পূর্বপার্শ্বে ফুলগাছের আড়ালে জোছনালোকে জোছনার মতোই ফুটফুটে মেয়েটি কে?–হামিদ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন–সে আমেনা।

আমেনা এত সুন্দর তা তো হামিদ আগে লক্ষ্য করে নাই? একটা অস্ফুট মৃদু শব্দ হামিদের ওষ্ঠদ্বয় কাঁপাইয়া গেল। তাহার শিরায় শিরায়, তাহার অন্তরের গোপন ঘরে একটা নবীনতার মধুময় ঝিলিক ছুঁইয়া গেল। কিন্তু তৌবা একি? নিঃশব্দে বসিয়া হামিদ রায়হানকে জিজ্ঞাসা করিল–“আর দেরি কি ভাই? আরম্ভ করে দিন।” তাহার পর তাড়াতাড়ি আবার সে জিজ্ঞাসা করিল–“আমাদের আর ওঁদের ভিতরে একটা পরদা হলে ভালো হত না?

রায়হান বলিলেন–“আমাদের মা-বোন ছাড়া তো অপর কেউ নাই।” হামিদ অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল–“যদি কোনো বাজে লোক এসে পড়ে?” রায়হান বলিলেন–“না, ভিতরে আর কেউ আসবে না।”

মেয়েরা ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ে অর্ধ আলো-আঁধারে ফুরাসের উপর বসিয়া গেলেন। তাঁহাদের সম্মুখে একাট মসৃণ ছোট গালিচার উপর বসিয়া রায়হান মহানবীর জীবনী পাঠ আরম্ভ করিলেন।

বামপার্শ্বে একটা উজ্জ্বল আলোক। তাকিয়ার উপর পুস্তক রাখিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া রায়হান একটা আরবি গান গাহিলেন–

“চিন্ময় ওগো, মধু আর প্রেম!
প্রেম-বর্তিকা জ্বাললিয়া দাও।।
রক্ত-লোহিত আত্মার মাঝে
একবার আসি গাহিয়া যাও।
বেদনা-বিধুর মানুষের মনে,
ওগো গেয়ে যাও তুমি গান।।
ভাবুক হৃদয়ে শুষ্ক তাপিত,
প্রভো, তোমার প্রেমের বান;
ওগো, বজ-আঘাতে চূর্ণ হউক,
প্রভো, কালিমা মোদের চিত্তে।।
ফুলে ফুলে হোক গন্ধের মেলা।
প্রভো, তোমার মহিমা বিত্তে।”

গান থামিল। শ্রোতাদের আত্মার শিরায় শিরায় একটা পবিত্র ভাবের ধারা বহিয়া গেল। জগতের সহিত যেন কাহারও কোনো সম্বন্ধ রহিল না। অহঙ্কার ও নীচতা আত্মা হইতে যেন মুহূর্তের জন্য ধুইয়া পুছিয়া গেল।

দূরে এক প্রান্তে করিমা ও আমেনা এ উহার গায়ে হাত দিয়ে বসিয়াছিলেন। দৃষ্টি তাঁহাদের রায়হানের গম্ভীর ভাবময় ললাটের উপর নিবদ্ধ। পলকহীন দৃষ্টি, স্থির চৈতন্য নিথর বপু। এই সামান্য কয়েক মুহূর্তে তাহাদের কাছে মনে হইতেছিল এক যুগ। শত বৎসরের ভিতর দিয়া তাহারা আজ যেন সহসা এক আলোক ও শুদ্ধতার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

রায়হান বলিলেন–আমাদের যেদি ধর্ম সেটি নূতন নহে। যারা বোঝে না তারাই বলে এটা হজরত মোহাম্মদের ধর্ম। ঈশ্বর এক–তিনি মহান-পাপ ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড়াতে হবে–এই চিরন্তন সত্য যুগে যুগে মহাপুরুষেরা প্রচার করেছেন। এইসব মহাপুরুষ, একটা বিরাট বেদনা ও সহানুভূতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মহামানুষ মোহাম্মদ এই মহাপুরুষদের অন্যতম। তিনি সত্যের সংস্কারক মাত্র। ইসলাম নূতন নহে। যাহা সত্য তাহা নূতন নহে–সত্য ছিল, আছে ও থাকবে।

এই মহামানুষ পৃথিবীতে এসেছিলেন মূর্খতা, অন্ধতা ও পাপ হতে মানুষকে রক্ষা করতে। মানুষের দুঃখ তাহার অন্তরকে বাল্যকালেই ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল। মানুষের পাপও দুঃখের কারণ মূর্খতা অন্ধতা। এই মূর্খতা ও অন্ধতা দূর করা ইসলামের শ্রেষ্ঠ নির্দেশ। জ্ঞানের সাধনা উপাসনা সমতুল্য। মুখ সহস্র বৎসর উপাসনারত থাকলেও বিশেষ পূণ্য অর্জন করিতে পারে না। অর্থ না বুঝে ভাব-গদগদচিত্তে পবিত্র কোরান মজিদ পাঠ করলেও পূণ্য লাভ হয় না, কোরান পাঠ করতে পারলেই জ্ঞান লাভ হয় না। কোরানের অর্থ বোধ হওয়া চাই এবং সে অর্থ গ্রহণ করার জন্য বিপুল জ্ঞান লাভ আবশ্যক।

বাহুর শক্তি অপেক্ষা, মনের দৃষ্টির মূল্য বেশি। যে পাপ করে এবং নীচতা,লোভ ও বাচালতার দ্বারা আত্মাকে কলঙ্কিত করে সে এই দৃষ্টি লাভ করতে পারে না।

ইসলামে নারীর সম্মান খুব বেশি। নারীকে যে অপমান করে সে পাপী। নারীর শক্তি জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। পারাধীনতায় মানুষ পশু হয়। নারীকে স্বাধীনতা না দিলে তাহার মনের নীচতা ও সঙ্কীর্ণতা ঘুচবে না। পুরুষ অপেক্ষা নারীর শিক্ষা বেশি দরকার। শিক্ষিতা নারীর জ্ঞান ও চরিত্রশক্তি জাতিকে অতি অল্প সময়ে শক্তি ও আত্মমর্যদা জ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে পারে।

সমস্ত বিশ্ব হতে নারীকে সারাজীবন এক কারাগারে আবদ্ধ করে রাখবার পুরুষের কী অধিকার আছে। পাপের ভয়ে?–নারী কি নিজের মর্যাদা নিজে বুঝে না? সে কি নিজেকে নিজে রক্ষা করবার চেষ্টা করতে পারে না? সে নিজেকে নিজে প্রতিষ্ঠিত করবার অধিকারী হতে জানে না?

আমাদের মহানবী এসেছিলেন মানুষকে পাপ হতে রক্ষা করতে। যে মানুষ আত্মাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করবার চেষ্ট না করে ধর্মকার্যে লিপ্ত হয় সে ভণ্ড। প্রতিদিন পাঁচবার উপাসনা করবার মতো প্রত্যেক মুসলমানকে জ্ঞানলাভের জন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। মূখের। উপাসনার কোনো মূল্য নাই।

ফুলের মতো নিজেকে পবিত্র করবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যে তাহা করে না, এবং শুধু এবাদতের দ্বারা স্বর্গে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে, সে ভুল করে।

প্রায় দুই ঘণ্টা ধরিয়া হজরতের জীবন-মহিমা ও বিশেষত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা হইল। অতঃপর উপস্থিত শ্রোতৃবর্গের উপর এলাহীর করুণা ভিক্ষা করিয়া সকলে মোনাজাত করিলেন। তারপর সভা ভঙ্গ হইল। –প্রায় পঞ্চাশজন নারী সমবেত হইয়াছিলেন। প্রত্যেকেই ইচ্ছাপূর্বক চারি আনা করিয়া চাঁদা দিয়াছিলেন। পুরুষ ভদ্রলোকেরাও মেয়েদের স্বাধীনভাবে কথা বলাবলি করিবার সুযোগ দিবার জন্য চাঁদা দিয়াছিলেন। একুনে পঁচিশ টাকা চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল। এই পঁচিশ টাকা দিয়া পোলাও, গোস্ত ও দধির ব্যবস্থা হইয়াছিল।

মিলাদ অন্তে নফিসা খাতুনের উপদেশ মতো সকলে সারি সারি বসিয়া গেলেন। বৃথা ঝঞ্ঝাট বাড়ানো হইবে ভয়ে মেয়েরা আগেই কিছু পয়সা খরচ করিয়া কলা ও পদ্মের পাতা এবং সোরাই ক্রয় করিয়া আনিয়াছিলেন। শীতল জলে ভর্তি করিয়া সোরাইগুলি মাঝে মাঝে রাখিয়া দেওয়া হইল।

প্রত্যেক পঙক্তিতে বারজন করিয়া বসিলেন। সুতরাং অন্তত চারিজন খাদেম আবশ্যক। রায়হান ও হামিদের উপর পরিবেশন ভার পড়িল। কিন্তু তবুও আরও দুইজন বাকি।

রসনা তখন সকলেই সরস হইয়া উঠিয়াছিল। সরম ও লজ্জায় করিমা ও বালিকা আমেনা বাকি দুইজনের স্থান গ্রহণ করিলেন।

কোনো কারণে আকস্মাৎ হামিদের ললাট স্বেদসিক্ত হইয়া উঠিল। জিহ্বা তাহার শুষ্ক হইয়া গেল। তাহার সহযোগী ঐ সুন্দর হাস্যময়ী লীলামধুর বালিকাটির পানে তাহার ঘৃণিত চিত্ত এমনভাবে লুটাইয়া পড়িতেছে কেন? সহসা নীরবে সে আল্লার নাম লইয়া ভাবিল তাহার চিত্তের এই ভাবপ্রবণতা কি খোদার কাছে ঘৃণিত?–তা বোধ হয় নয়। হউক তাহার চিত্ত এত উন্মনা তাতে কি ক্ষতি?–এটা সম্মান ও শ্রদ্ধা ছাড়া আর কী?

মিলাদ ও তাহার অন্তে রায়হানের বাড়ি যাওয়া হইল না। জমাজমি সংক্রান্ত কোনো কাজে খোরশেদকে সেদিন টাউনে যাইতে হইবে। হামিদকে সঙ্গে লইয়া তাহারা খোরশেদের সহিত শেষ রাত্রিতে গাড়ির জন্য স্টেশনে যাত্রা করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *