০৮. এচিলীসের মা, তিতিশা

এচিলীসের মা, তিতিশার দেওয়া অস্ত্রগুলি প্রভাতের অরুণ কিরণে ঝক ঝক করছিল। তিতিশার পরী সহচরীরা তা দেখে শিউরে উঠলেন।এচিলীসের মন কিন্তু আনন্দে নৃত্য করতে লাগলো, কারণ সেইসব তীক্ষ্ণধার অস্ত্র দিয়েই সৈন্যদের মাথা কাটা হবে। ত্রয়বাসীরা অন্যায় ও পাপ করেছে, সুতরাং তাদের শাস্তি দিতে এচিলীসের মনে কোনো দুঃখ হচ্ছিল না। কি জন্যে যে এই যুদ্ধ বেধেছে তা তো তোমরা জান।

তিতিশা আজিজের মৃতদেহের পাশে বসে ক্ষত স্থানগুলিতে আরক লাগাতে লাগলেন, যাতে ক্ষতগুলি পচে না ওঠে। এচিলীস বাইরে যেয়ে সকলকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।

গ্রিক সৈন্যরা আনন্দ-উৎফুল্ল মনে বেরিয়ে এলো। আজ মহাবীর এচিলীস যুদ্ধে যাবেন–আর ভয় নেই। আজ গ্রিক সৈন্যের জয়!

ওদেসিজ ও দায়য়ামীদাস খোঁড়াতে খোঁড়াতে (কারণ এখনো তাদের আহত স্থানগুলিতে বেদনা ছিল) বীরবর এচিলীসের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এগামেমননও নতমাথায় তাঁদের পেছনে পেছনে এচিলীসের কাছে এলেন। মন তার চিন্তায় ও বেদনার

ভারে অবসন্ন। এগামেমননকে দেখে এচিলীস হাত বাড়িয়ে তার সঙ্গে মোসাফা করলেন। . অতঃপর সকলকে শুনিয়ে বললেন–বন্ধু এগামেমনন, আমার প্রিয় গ্রিক বীরগণ, কি কুক্ষণে বালিকা ব্রীসাসকে নিয়ে আমাদের ঝগড়া বেধেছিল, তার ফলে আজ শত শত গ্রিক প্রাণ দিয়েছে। যদি আমি এমন করে রাগ করে বসে না থাকতাম, তা হলে শত্রু সৈন্যের এতটা বাড়াবাড়ি সম্ভব হতো না। আজ দেশের জন্যে, গ্রিক জাতির সম্মান ও মঙ্গলের জন্যে, আমার মনের সমস্ত গ্রনি দূর করে এগামেমননকে বন্ধু বলে গ্রহণ করছি।

এগামেমনন এচিলীসকে বললেন–যেদিন থেকে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করেছি, সেদিন থেকে আমার মনস্তাপের সীমা নেই। তোমার ব্রীসাসকে তুমি নাও, আর আমার যদি কোনো অপরাধ থাকে, ক্ষমা কর।

অতঃপর দুই বন্ধুতে কোলাকুলি হল বালিকা ব্রীসাস এতদিন পর এচিলীসের ঘরে ঢুকে আজিজের দেহের পার্শ্বে বসে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। প্রতি ঊষাকালে আজিজ এচিলীসের সঙ্গে নাস্তা করেছেন, একসঙ্গে বেড়িয়েছেন, একসঙ্গে থেকেছেন। তাঁর পতনে যে ব্রীসাসের মনে খেদ হবে সে আর আশ্চর্য কী! আজিজ বড় ভালো লোক–বেঁচে থাকতে তিনি ব্রীসাসকে বড়ই ভালবাসতেন। ব্রীসাসের সঙ্গে তার সখীরাও চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।

কিছু নাস্তা করেই গ্রিক বীরেরা যুদ্ধ ময়দানে নামলেন। আজকের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে লেখনী অসমর্থ, এমন ভীষণ যুদ্ধ কোনো দিন হয় নি, হবেও না।

রাজা প্রিয়ামের এক ছেলে সৈন্যদের সম্মুখবর্তী হয়ে এচিলীসকে আক্রমণ করল। যার সামনে পাহাড় পর্যন্ত কাঁপে, তার সামনে এই ক্ষুদ্র ছেলের দাঁড়ানোটাই আশ্চর্যজনক। একটু আস্ফালন করেই সে পালিয়ে গেল।

যে এচিলীসের সামনে পড়েছিল–সে-ই প্রাণ হারাচ্ছিল। অনবরত দুই হাত দিয়ে। শত্রু-সৈন্য কেটে কেটে এচিলীস ত্রয় নগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। রাজা প্রিয়ামের আর এক ছেলে এচিলীসের সম্মুখে পড়তেই সে প্রাণ হারালো। একবার এই সময়ে হেক্‌তর এচিলীসের সামনে পড়েছিলেন, পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন। এচিলীসও গ্রাহ্য করলেন না–এত শীঘ্র তিনি হেক্তরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক না।

জয় সৈন্যেরা হটতে হটতে নগরের নদীর কাছে এসে সারি দিয়ে দাঁড়ালো। এচিলীস ক্রমেই তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ভয়ে ভয়ে কোনো কোনো সৈন্য নদীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, কেউ বা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেবার জন্যে এদিক ওদিক ছুটতে লাগলো। তাদের অনেকে মনে করে ছিল ক্লান্ত এচিলীস নগরের এত নিকটে আসতে কখনও সাহস পাবেন না। কিন্তু যখন তিনি একেবারেই নিকটে এসে উপস্থিত হলেন, তখন নগরের খোলা দুয়ার দিয়ে তারা ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো।

মহাবল নামে এক ত্রয় বীর বুক ফুরিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতঃপূর্বে প্রায় সকলে এচিলীসের সুন্মুখ হতে সরে পড়েছিল–মহাবলকে সম্মুখে পেয়ে এচিলীস তার দিকেই দীর্ঘ বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু মহাবলের ভাগ্যবলেই বর্শা তার গায়ে লাগলো না–নিকটে পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রায় তিন হাত পর্যন্ত পাথরের মধ্যে বসে গেল, পাথর হতে বর্শা খুলে এচিলীস মহাবলের দিকে ধাবিত হলেন।

রাজপ্রাসাদের ছাদের উপর বসে রাজা প্রিয়াম ও রানী আজকার এই ভীষণ যুদ্ধ দেখছিলেন–তাঁরা বুঝেছিলেন, এতকাল পরে কে আজ যুদ্ধে নেমেছে, কার সম্মুখ থেকে ত্রয় সৈন্যদল শৃগালের মতো পালাচ্ছে।

রাজার বড় ছেলে হেক্‌তর তখনও নগরের বাইরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজা তা দেখে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর দুই ছেলেকে ফিরে আসতে না দেখে তিনি বিশেষ সন্দিগ্ধ ও চঞ্চল হয়ে উঠলেন। রাজা উচ্চৈঃস্বরে হেরকে লক্ষ্য করে বললেন–হেকতর আর বাইরে থেকো না ভিতরে ঢুকে পড়ো। এচিলীস যুদ্ধে নেমেছে, আজ আর রক্ষা নেই। তোমার আর দুই ভাই কই? তারা বোধ হয় জন্মের মতো আমাকে ত্যাগ করেছে।

হেক্‌তর তবুও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন–বৃদ্ধ রাজা আবার বললেন হের তুমি আমার বড় ছেলে, তোমার পতন আমি দেখতে পারবো না। বুড়ো বাপের প্রতি কি তোমার দয়া নেই? তুমি মরলে আমাদেরও প্রাণ থাকবে না? শত্রু সৈন্যকে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না। তার পর নিজে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন–হায় অদৃষ্ট! নিজের চোখে সন্তানদের মৃত্যু দেখতে হল, আমার মেয়েদেরকে শত্রুরা দাসী করে বেঁধে নিয়ে যাবে, আমাকে হত্যা করে শত্রুরা কুকুরকে খেতে দেবে।

দুই ছেলের অদর্শনে রানীও কাঁদছিলেন। তিনিও বুক চাপড়ে বললেন, ওরে হেকতর, বাবা আমার, তোকে যে এই বুকে ধরে মানুষ করেছি, জননীর আজ্ঞা অবহেলা করবি? তোর শিশু পুত্রের কথাও কি মনে হচ্ছে না, তোর পত্নীও কি তোর কেউ নয়?

হের তলোয়ারের উঁটি ধরে নগরের প্রবেশদ্বারের কাছে প্রাচীরে হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাহাড়ের ধারে ক্ষুধিত অজগর পথিককে গেলবার জন্যে যেমন তার বিষজিহ্বা বের করে অপেক্ষা করতে থাকে, সাপের নাক দিয়ে যেমন মুহুর্মুহু বিষ নিশ্বাস বের হতে থাকে, হেরের নাক দিয়েও তেমনি করে আক্রোশের আলো বের হচ্ছিল।

হেক্‌তর আপন মনে বলতে লাগলেন–সন্তান স্নেহে মা-বাপ আজ অন্ধ হয়েছেন। কাপুরুষের মতো এচিলীসের সম্মুখ হতে কেমন করে সরে যাব? এর মতো লজ্জা জীবনে আর আমার নেই–মৃত্যুই শ্রেয়। মা-বাপের স্নেহ,পত্নীর ভালবাসা, লাঞ্ছিত জীবনের কালো কলঙ্ক রেখাগুলি শোধরাতে পারে না। . হেকতর এমন করে ভাবছেন, এমন সময় মহাবীর এচিলীস ঝলসিত তলোয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে দৈত্যের বিক্রমে তাঁরে কাছে উপস্থিত হলেন। হেক্‌তর আগে যাই ভাবুক না, এচিলীসের সেই সংহারী মূর্তি দেখে চমকে উঠলেন। দারুণ ভয় এসে মুহূর্তের মধ্যে তার বুক চেপে ধরলো। তিনি আর দাঁড়াতে পারলেন না। বালক যেমন করে ভয়ে ছুটে পালায়, হেকতর তেমন করে দৌড় দিলেন। এচিলীসও তার পিছনে পিছনে ছুটলেন।

নগরের চতুর্দিককার দেওয়াল বেয়ে এচিলীস প্রাণপণে ছুটতে লাগলেন। একবার দু’বার তিনবার তারা নগরে ঘুরে এলেন। দৌড়ান ব্যাপারেও এচিলীস ভায়ানক পটু। যেখানে ত্রয় মেয়েরা স্নান করতেন আর কাপড় ধুতেন সেই জায়গায় এচিলীস হেরের নাগাল ধরে ফেললেন।

অগত্যা হের ফিরে দাঁড়ালেন। বর্শাখানি ছুঁড়ে এচিলীসকে মারলেন, কিন্তু এচিলীসের ঢালের সঙ্গে লেগে সেখানি দুই ভাগ হয়ে ভেঙ্গে গেল। হের চিৎকার করে বললেন–ওগো, কে আছ এখানে? একখানি নূতন বর্শা দাও। কিন্তু কে তাকে বর্শা দেবে? কেউ সেখানে ছিল না।

এচিলীস তলোয়ার তুলে হেকতরের গলার হাড়ের কাছে এক আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভায়ানক চিৎকার করে হেত্তর মাটিতে পড়ে গেলেন। আহা, সে কী শোচনীয় দৃশ্য! ত্রয়বাসীদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর আজ ধরাশায়ী হলেন–এতকালের মহাবৃক্ষ আজ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে গেল! কী পরিতাপ!

হেকতর করুণকণ্ঠে বললেন–বীর এচিলীস! আমি চলোম, আমার সকল গর্ব তোমার হাতে আজ চূর্ণ হয়ে গেল। খোদাতালা তোমার হাতে আমার মরণ লিখেছিলেন। দয়া করে আমার মৃতদেহের উপর অত্যাচার করো না–আমাকে মাটি দেবার ব্যবস্থা করো; আমরা আত্মীয়-স্বজনকে আমার দেহটি দিও।

এচিলীস বললেন–অপদার্থ, যে কিছুক্ষণ আগে আমার পরম বন্ধু আজিজের মরা দেহ নিয়ে এত লড়াই করেছে, সে এই অনুগ্রহ চায় কোন লজ্জায়? তোমার দেহ শৃগাল কুকুরকেই দেওয়া হবে। তোমার মৃতদেহের প্রতি কোন সম্মান দেখানো হবে না, কারণ তুমি ও তোমার দেশের লোক বড়ই হীন। হেক্‌তর করুণ কণ্ঠে বললেন–তোমার নিষ্ঠুর সংকল্পের কোনো নড়চড় হবে না, কিন্তু মনে রেখো, আমার ভাই পেরিস এই হত্যার প্রতিশোধ নেবে।

এই কথা বলেই হেরের মৃত্যু হল।

এচিলীস আপন মনে বললেন–কপালে যদি থাকে তবে তাই হবে।

এচিলীসের মনে হল–বন্ধু আজিজের দেহ এখনও গোর দেওয় হয় নি, তিনি সৈন্যগণকে সে দিনকার মতো ফিরতে বললেন।

হেরের দেহ এচিলীসের রথের চাকার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। এতকালের গর্বোন্নত মাথা ধুলোবালির সঙ্গে আছাড় খেয়ে খেয়ে রথের চাকার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে চললো।

হেকতরের মা সে দৃশ্য দেখে হায় হায় করে উঠলেন–বুকে দুই হাত দিয়ে ছাদের উপর বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন।

হতভাগিনী হেকতর-পত্নী আমেকি তখনও তাঁর এই কপালভাঙ্গার সংবাদ পান নি। তিনি সখীদেরকে নিয়ে তাতে বসে কাপড় বুনছিলেন, হঠাৎ বাইরে চিৎকার শুনে চমকে উঠলেন। বললেন–তোমরা কাজ বন্ধ কর, দেখি কী হল–আমার বুক কেন এমন করে করে কেঁপে উঠছে? আমার স্বামী হেরের তো অমঙ্গল হয় নি?

তাড়াতাড়ি ছাদের উপর উঠে দূরে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে তার মাথা ঘুরে গেল। এচিলীস তার রথের চাকার সঙ্গে স্বামীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। হেতর-পত্নী স্বামীর বোনের কোলের ওপর তখুনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।

অনেক চেষ্টার পর যখন হুঁশ হল তখন কপাল মাটির উপর রেখে তিনি বলতে লাগলেন–ওগো স্বামী, এ হতভাগিনী যে এ দৃশ্য দেখতে পারে না; হায়, তোমার কপালে এত অসম্মান লেখা ছিল! সারা সংসার জ্বালিয়ে দিয়েও তো এ অপমানের প্রতিশোধ হবে না, আমার হৃদয় জ্বালা জুড়োবে না। তোমার শিশু যে আমার সঙ্গেই ভিখারি হল; যে ছিল রাজার ছেলে, সে মানুষের খাবার সময় তাকিয়ে থাকবে, তারা হয়তো স্নেহ পরবশ হয়ে এক টুকরো দেবে; কেউ হয়তো চোখ গরম করে খোকার দিকে চাইবে, যাদু আমার কেঁদে ফিরে আসবে! হায়, সে ব্যথা যে আমার সইবে না। ওগো স্বামী, আমার কী হবে? এ শহরের ধ্বংস সুনিশ্চিত–তুমি যখন গেলে, তখন এ শহরের মান-ইজ্জত কে রাখবে? শত্রুরা কুমারীদেরকে দাসী করে বেঁধে নিয়ে যাবে–আমি যে এয় রাজার পুত্রবধূ। আমাকেও হয়তো শেষকালে কোনো গ্রিক সওদাগরের বাড়ি পানি গরম করতে হবে। হায়, তাতেও দুঃখ ছিল না, কিন্তু আমার এ শিশুর কী হবে?

মাথায় আঘাত করে করে হেত্তর-পত্নী আমেকি এমন করে কাঁদতে লাগলেন–তাঁর সখীরাও কাঁদতে লাগলেন।

এদিকে এচিলীস বাসায় ফিরে বন্ধু আজিজের মৃতদেহের কবর দিলেন, তার পরে সকলে মিলে জয়ের উৎসব করলেন–দৌড়া-দৌড়ি, কুস্তি, দাঁড়টানা, লাফানো প্রভৃতি নানা প্রকারের উৎসব হল। খেলা শেষ হলে সকলে বিশ্রামের জন্য গেলেন। সকলে আনন্দ করলেও এচিলীসের কোনো আনন্দের কারণ ছিল না, সারা রাত্রি তার ঘুম হল না, বন্ধু আজিজের বিরহ-ব্যথা তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল।

পরের দিন সকালবেলা প্রতিশোধের জ্বালা জুড়োবার জন্যে এচিলীস হেক্তরের মৃতদেহ রথের সঙ্গে জুড়ে বন্ধুর কবরের চারিদিকে ঘুরাতে লাগলেন। একদিন দুদিন তিনি।

এমনি করলেন, তবুও তাঁর তৃপ্তি হল না। পাছে ছেলের এই ব্যবহারে খোদা অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিতিশা ছেলেকে এই কাজ করতে নিষেধ করলেন।

সন্ধ্যাকালে প্রিয়াম ছেলের জন্যে নির্জনে বসে কাঁদছিলেন।

হঠাৎ তার কি মনে হল তিনি ভূত্যদিগকে রথখানি সাজাতে বললেন। রানীকে বললেন–ঘরে যত রকমের দামি জিনিস আছে সব বের কর। এইসব দিয়ে আমি একবারে গ্রিকদের কাছে যাবো, টাকা দিয়ে বলে কয়ে কোনো রকমে ছেলের দেহ উদ্ধার করতে পারি কি না চেষ্টা করবো।

রানী কেঁদে বললেন-পুত্র গিয়েছে, সব গিয়েছে, শেষকালে তোমাকেও হারাতে হবে। সেই রাক্ষসের মনে কি দয়া আছে? তোমাকে পেলে কিছুতেই তারা ছাড়বে না! আমি যে নারী, নারী হয়ে কেমন করে এত ব্যথা সইব? আমার তিনটি ছেলেকে তারা মেরে ফেলেছে, এবার স্বামীকেও মারবে। জেনে শুনে কে শত্রুর কাছে ধরা দেয়?

রাজা বললেন–রানী, তুমি যাই বলো, আমি কিছুতেই এ সংকল্প ত্যাগ করবো না। একটি বার আমার বাছাকে বুকের উপর ধরতে চাই, তাতে যদি প্রাণ যায়, আপত্তি নেই। তুমি সত্বর আমার যাবার বন্দোবস্ত করে দাও। তোমার কোনো ভয় নেই–আমারও কোনো ভয় নেই। কে যেন আমার বুকের ভেতর থেকে বলছে–গ্রিক বীরদের কাছে তোমার সন্তানকে ভিক্ষা চাও। তোমার ওপর তারা দয়া করবে?

অনেক রাত্রে বুড়ো রাজা বহুমূল্য উপহার সামগ্রী নিয়ে রওয়ানা হলেন। যখন ঘরের কাছে এলেন, তখন তিনি দেখলেন, একটা লোক সেখানে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

রাজার মনে খুব ভয় হল। ভাবলেন, এ কোনো কঠিন-হৃদয় পাহারাওয়ালা হবে। কী করি? পালিয়ে যাবো না এর হাত ধরে আমার দুঃখের কথা বলবো।

লোকটি রাজাকে ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলে–কে এখানে এত রাতে রথ চালাচ্ছেন?

রাজা বললেন, মহাশয়, আমি ত্রয়ের বুড়ো হতভাগা রাজা, আমি সন্তানহারা। কেন এতরাত্রে এখানে এসেছি, তা কী আপনি দয়া করে শুনতে চান?

লোকটি বললে–আপনার মতলব কী তা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনার অবস্থা বুঝে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। আমার দ্বারা যদি কোনো উপকার হয়, করতে রাজি আছি।

রাজা বললেন–আপনার দয়ার জন্য আপনাকে ধন্যাবাদ। দয়া করে আমাকে বীর এচিলীসের কাছে নিয়ে চলুন। লোকটি বললে–আপনি দুঃখিত হবেন না। হেক্টরের দেহের ওপর কোনো অত্যাচার হয় নি। এচিলীসের কাছে যেয়ে আপনার প্রার্থনা জানান, তিনি আপনার ন্যায় বুড়ো মানুষের মনে কিছুতেই ব্যথা দেবেন না।

রাজা এই লোকটির সাহায্যে এচিলীসের তাবুর ধারে এলেন। লোকটি বিদায় গ্রহণ করে কোথায় যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল।

এচিলীস তখন সবেমাত্র আহার শেষ করে বাইরে বাতাসে এসে বসেছিলেন, এমন সময় বুড়ো রাজা সেখানে উপস্থিত হলেন। রাজা জানু পেতে বসে তাড়াতাড়ি এচিলীসের হাতখানি ধরে (যে বাহু ত্রয়বাসীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে) চুম্বন করলেন। এচিলীস এবং উপস্থিত আর আর সকলেই অপরিচিত বুড়োর ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলেন।

রাজা শোকপূর্ণ কণ্ঠে বললেন–আমি কে, তা কি এখনও বুঝতে পারেন নি? ত্রয়ের যে বীরকে আজ আপনি হত্যা করেছেন, আমি তারই পাগল বাপ। আপনি নিজের বাপের কথা চিন্তা করুন–তা হলে বুঝতে পারবেন, কি ব্যথা আজ আমার প্রাণে লেগেছে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, যে আমার ছেলেকে মেরেছে তাঁর দয়া আজ এই গভীর নিশীতে ভিক্ষা করতে এসেছি। যদি আমায় মেরে ফেলতে হয় ফেলুন, কিন্তু আমার ছেলেকে ফেরত দিন। তার মুখোনি শেষ বার দেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো। আমার মনে অপমান-জ্ঞান নেই। আপনি বীর, আমার প্রতি কি আপনি করুণা দেখাবেন না?

যখর রাজা এই সমস্ত কথা বলছিলেন, তখন সহসা বাপের স্মৃতি এচিলীসের মনে জেগে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে রাজার হাত ধরে তাঁকে তুললেন, দুজনার চোখেই তখন পানি।

এচিলীস বললেন–রাজা, কী করে এই গভীর নিশীথে শত্রু-সৈন্যের মাঝখানে আসতে সাহস করলেন? আর কেঁদে কী হবে? যতই কাঁদুন ছেলে আর ফিরে আসবে না। আমি আপনার শোক বুঝতে পাচ্ছি, আমার বাপকেও একদিন আপনার ন্যায় কাঁদতে হবে, কারণ আমি জানি, যুদ্ধে আমাকেও এখানে মরতে হবে। আমার পথ চেয়ে আমার বাপও বসে আছেন। আমার বাপের বহু অর্থ সম্পদ আছে, পরী-রাজার মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন, তাঁর মনে অফুরন্ত আনন্দ ছিল, কিন্তু এবার তার সে সুখে দাগ পড়বে। আমি আমার বাপের একমাত্র ছেলে। একটু নীরব থেকে বললেন–মানুষের ভাগ্যের কী পরিবর্তন–আজ যে রাজা, কাল সে ভিখারি; আজ যাকে হাসতে দেখা যাচ্ছে, কাল হয়তো দেখা যাবে; দুঃখ-বেদনায় তার মুখ কালো হয়ে গেছে–চোখে তার পানি। হায় দুনিয়া,

এখানে যশ-অহঙ্কারের মূল্য কী–আর সুখই বা কোথায়?

অতঃপর এচিলীস বাবুর্চীকে বললেন, বাবুর্চী, রাজার সম্মানের জন্যে একটা বড় মেষ জবাই করো। তিনি আমাদের অতিথি। আর তাঁর বিশ্রামের জন্যে স্থান ঠিক করে দাও একটু গোপন স্থানে দিও, কেউ জানতে না পারে। কাল আঁধার থাকতেই উনি ছেলেকে নিয়ে যাবেন।

রাজা প্রিয়ামকে সান্ত্বনা দিয়ে পুনরায় বললেন–রাজা, আর শোক করবেন না। যখন এখানে এসেছেন তখন আপনাকে কিছু খেতে হবে। এ সংসারে বহু রাজার ছেলে মরেছে, কিন্তু কোনো দিন কেউ না খেয়ে থাকতে পারে নি। এচিলীসের অনুরোধে রাজা চুপ করে রইলেন।

যথাসময়ে এচিলীস রাজার হাত ধরে নিয়ে দস্তরখানায় বসালেন। রাজা এচিলীসের প্রশংসা না করে থাকতে পারলেন না, এচিলীসও রাজাকে বিস্তর প্রশংসা করলেন। ভোজন। ও দেখাশোনায় মানুষের মনে দুর্বলতা আসে–যে শত্রু এমন করে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে তার প্রতি অকস্মাৎ রাজা প্রসন্ন হয়ে উঠলেন।

তখনও অল্প আঁধার ছিল, ঊষার আলো ভালো করে প্রকাশ হয় নি। এচিলীস ভৃত্য দিয়ে হেরের দেহ রাজার সঙ্গে গ্রিক সীমা পার করে দিলেন।

এদিকে নগর দুয়ারে অসংখ্য লোক জমা হয়েছিল। রাজাকে ফিরতে দেখে দুঃখের মধ্যেও তাদের মনে আনন্দের সঞ্চার হল। হেকতরের মা পত্নী উভয়ে মৃতদেহকে পাগলিনীর ন্যায় বুকে চেপে ধরতে লাগলেন। আত্মীয়স্বজন ও নগরবাসীরা সে দৃশ্য দেখে না কেঁদে থাকতে পারলেন না। অতঃপর নগর-দুয়ার হতে হেরকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। পত্নী ও মাতার শোকের শেষ নেই। তারা অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়লেন। হেকতর শিশু কোলে বসে স্তব্ধ হয়ে মায়ের এই অস্থিরতা লক্ষ্য করছিল।

হেক-পত্নী শোক করে বলতে লাগলেন–হে স্বামী, আমাকে অনাথিনী করে তুমি, কোথায় চলে গেলে? আমার প্রাণের ব্যথা বোঝবার বয়স এখনও য়ে এই শিশুর হয় নি। শীঘ্রই গ্রিক সৈন্য এসে আমাকে তোমার শিশুসহ বন্দিনী করে নিয়ে যাবে, তার পর আমরা। কোনো গণ্য গ্রামবাসীর বাড়িতে যাবো। তোমার শিশুকে হয়তো কোনো গ্রিক এসে হত্যা করে ফেলবে। তুমি যখন গিয়েছে, তখন, কেউ আর এ নগর রক্ষা করতে পারবে না। তোমার জন্যে আজ সমস্ত ত্রয়বাসী দুঃখ করছে, কিন্তু আমার মতো কঠিন দুঃখ আর কেউ পায় নি। হায়, মৃত্যুকালে তোমার চোখের পানে শেষ চাওয়া চাইতে পারি নি, তোমার তৃষিত মুখে একটু পানি দিতে পারি নি! হায়, হতভাগিনী আমি! এই কথা বলেই তিনি মূৰ্ছিতা হয়ে পড়লেন। কোলের শিশু ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে কিছুই বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগলো।

শাশুড়ি পুত্রবধূর হাত ধরে পুত্রকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন–হে আমার প্রিয়তম সন্তান, সকল ছেলের চেয়ে তুমি যে আমার অধিক আদরের ছিলে–হায়, তোমাকেই যে আমি প্রথমে পেটে ধরেছিলাম। ওরে হের, তুই যেদিন প্রথম জন্মেছিলি, তোর এই মরণ-বিছানায়ও তোকে সেদিনের মতো তেমনি মধুর, তেমনি সুন্দর, তেমনি হাসি-মাখা দেখতে পাচ্ছি।

তার পর সৌন্দর্যের রানী হেলেনও চোখের পানি ফেলে বললেন–প্রিয় ভাই, আমার সকল দেবরদের চেয়ে তুমিই যে আমায় অধিক স্নেহ করতে। তোমার মুখে কখনও একটা কঠিন কথা শোন নি। তোমার বোন বা আমার কোনো দেবর যখন আমাকে একটুখানি অসম্মান দেখিয়েছে, তুমি ক্রুদ্ধ হয়েছ। বড় ভাইয়ের স্নেহ-মায়া দিয়ে তুমি আমাকে রক্ষা করেছ, আজ তুমি চলে গেলে। তুমি ছাড়া হয় নগরে আমাকে আর কেউ ভালবাসার নেই–আমি যে পাপিনী, অভিশপ্তা হতভাগিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *