০৭. আজিজ যুদ্ধ করতে করতে

আজিজ যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিলেন, ত্রয়বাসীরা মৃত সৈন্যদের দেহ উদ্ধার করবার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করছিল, কিন্তু আজিজের বিক্রমের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ান তাদের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।

ক্রমে আজিজ ত্রয় নগরের সিংহ দুয়ারে এসে উপস্থিত হলেন, পেছনে সংখ্যাতীত গ্রিক সৈন্য বিজয় চিৎকারে আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

সহসা আজিজ শুনতে পেলেন, কোণে একটি গায়েবী আওয়াজ, আজিজ, জয় নগরে তুমি প্রবেশ করতে পারবে না। আজিজ, থমকে দাঁড়িয়ে ভাবলেন–এ কার শব্দ? এ যেন আসমান থেকে আসছে।

হেক্‌তর তার রথের পার্শ্বে দাঁড়িয়েছিলেন। কে যেন তার কানেও বলে গেল,–হেক্‌তর দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও না–এ-যে আজিজ এচিলীসের পোশাক পরে তোমাদেরকে ছলনা করছে, অবসন্ন আজিজের সঙ্গে লড়াই কর–সে তোমার হাতেই মরবে।

হের গায়েবি শব্দে চমকে উঠলেন। সারথিকে বললেন–চালাও রথ। রথ আজিজের সামনে আসা মাত্র আজিজ সারথির মাথায় এমন এক আঘাত করলেন যে বেচারা সেই আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল। হেক্‌তর তাঁর প্রিয় সারথির দেহ রক্ষা করবার জন্যে এক লম্ফে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে তলোয়ার নিয়ে আজিজের সামনে খাড়া হলেন–তার পর দুই বীরে লড়াই আরম্ভ হল। হেক্‌তর মেঘের মতো গর্জন করে সিংহের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আজিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। আজিজও সামান্য নন। হেক্তরের সমস্ত বীরত্ব আজিজের সামনে ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু তা হলে কি হয়, হেরের হাতেই আজিজের মরণ লেখা ছিল। হঠাৎ আজিজের তল পেটে হেরের তলোয়ার বসে গেল। আজিজ যন্ত্রণায় চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। আজ এচিলীসের মাথার টুপি বীরদেহের পোশাক ধূলামাটিতে কলঙ্কিত হল–যে পোশাকের অপমান আজ পর্যন্ত কোথায়ও হয় নি।

হের আজিজের বুকের উপর বসে বলতে লাগলেন–আজিজ, কোথায় এখন বীরত্ব? তুমি জয় নগর জয় করতে চেয়েছিলে? ত্রয়-কুমারীকে গ্রিক যুবকদের দাসী করতে চেয়েছিলে? কোন্ জয় কুমারীকে পাবার আশা করেছিলে–এখন যে কাকে-চিলের খোরাক হলে?

আজিজ রুদ্ধ-কণ্ঠে বললেন–হেকতর এখন আমার অন্তিম কাল, যা বলবার বলে যাও’; কিন্তু মনে রোখো শীঘ্রই এর প্রতিফল পাবে। আমার বন্ধু এচিলীসের হাতে তোমার পরাজয় ও মরণ বাধা রয়েছে। ঠিক এই জায়গাতেই তোমার বীর-দেহের অসম্মান হবে। এই কথা বলতে বলতে অজিজ চিরন্দ্রিায় ঘুমিয়ে পড়লেন–যেন এক গোছা সদ্য-ফোঁটা ফুল গাছ থেকে কে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। আজিজ সবে মাত্র যৌবন সীমায় পা দিয়েছিলেন।

হেক্‌তর কুকুরের খোরাকীর জন্য অজিজের মৃতদেহকে গাড়িতে উঠিয়ে নিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ভীমবেগে মেনেলাস এসে মৃত আজিজের দেহের পাশে দাঁড়ালেন; বললেন–খবরদার, এ দেহ কেউ ছুঁতে পারবে না। গ্রিক বীরের দেহ শৃগাল কুকুরের খোরাক নয়।

হেকতরকে সরিয়ে দিয়ে গদাধর নামে এক ত্রয় পালোয়ান সামনে এসে বললে–দুষ্ট মেনেলাস, তুই না আমার ভাইকে মেরে ফেলেছিলি? আজ তার উচিত প্রতিফল পাবি–এই বলেই সেই লোকটি মেনেলাসকে আক্রমণ করলে।

মেনেলাস লোকটির ব্যবহারে নিতান্ত বিরক্ত হয়েছিলেন, এহেন ঘৃণিত আক্রমণে এরূপ ক্রুদ্ধ হলেন তা আর কি বলবো।

গদাধরের আক্রমণে মেনেলাসের কিছুই হল না। গদাধর ভেবেছিল, মেনেলাসের মাথাটা কেটে নিয়ে মায়ের কাছে যাবে, তাতে মায়ের শোক অনেকটা কমতে পারে। দুদিন আগেই তার বড় ভাইকে মেনেলাস যুদ্ধক্ষেত্রে মেরে ফেলেছেন। গদাধর বিরক্ত হয়ে মেনেলাসকে আবার আঘাত করলে। মেনেলাস ভাবলেন, এই হতভাগাটিকে আর প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। তলোয়ারখানি উঁচু করে অতি ক্ষিপ্রহস্তে গদাধরের মুখের মধ্যে চালিয়ে দিলেন। আর কি রক্ষা আছে? গদাধর মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল, হুঁ-হুঁ করে তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। দুই এক মিনিটে তার দেহ হতে প্রাণ চলে গেল। কিন্তু এতে মেনেলাসের আনন্দ করবার কিছুই ছিল না, আজিজের মৃত্যুতে তার মন দুঃখে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। অতঃপর আজিজকে তিনি ঘাড়ে করে তুলে নিচ্ছিলেন, এমন সময় বিশ জন ত্রয় সৈন্য তাকে ঘিরে ফেলে। মেনেলাস ভাবলেন, আজিজের দেহ উদ্ধার করতে পারবো না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রাণও যাবে।

আজিজের দেহ ফেলে নিতান্ত অনিচ্ছায় মেনেলাস নিজের দলের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করলেন। পথে বীরবর আজাককে দেখতে পেয়ে আজিজের মরণ সংবাদ দিলেন।

এদিকে হেক্‌তর আজিজের দেহ হতে লোহার পোশাক খুলে ফেল্লেন। কতকগুলি গ্রিক সৈন্য এসে নূতন করে তাঁকে আক্রমণ করলে। হেক্‌তর মরা আজিজকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় তার সঙ্গীরা তাঁকে কাপুরুষ ও ভীরু বলে গালি দিল। তাড়াতাড়ি নিজের পোশাকটি ফেলে এচিলীসের পোশাক–যেটি তিনি এখনি আজিজের গা থেকে খসিয়ে নিয়েছেন, সেইটি পরে নিয়ে ফিলে দাঁড়ালেন। এই পোশাকটি ভারি মূল্যবান, এচিলীসের বাবা বিয়ের দিন তাঁর পরী-শ্বশুরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এই পোশাক গায়ে দিলে দেহে হাজার হস্তীর শক্তি আসে, সামনে কোনো শত্রু দাঁড়াতে পারে না।

যাই হোক, হেক্‌তর ফিরে দাঁড়ায়ে আবার আজিজের মরা শরীরটির কাছে গেলেন, গ্রিক সৈন্যও হেকতরে সেখানে একটা ভয়ানক যুদ্ধ লাগলো। বীরগণ একবার সামনের দিকে এগিয়ে একবার পেছন দিকে পিছিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

এচিলীস জাহাজের উপর থেকে আবার এই যুদ্ধটি দেখছিলেন। তিরি শঙ্কিত হয়ে মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন–খোদা, আমার প্রিয় বন্ধু আজিজের কোনো বিপদ হল না তো? আমি যে তাকে জাহাজ ছেড়ে মাটিতে নামতে নিষেধ করেছিলাম। যদি সে আমার কথা না শুনে থাকে, তা হলে সর্বনাশ হয়েছে।

এমন সময় জনৈক সৈন্য কাঁদতে কাঁদতে এসে এচিলীসকে বলে–হে বীর আপনার বন্ধু আজিজের পতন হয়েছে, গ্রিক সৈন্যের অবস্থা শোচনীয়, বিপক্ষের সামনে তারা কিছুতেই টিকতে পাচ্ছে না। আপনার পোশাকও শত্রু-সৈন্যের হাতে পড়েছে। বহু চেষ্টা করেও সেটির উদ্ধার করতে পারা যায় নি।

এচিলীস উচ্চৈঃস্বরে হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন। পাছে এচিলীস অতি দুঃখে আত্মহত্যা করেন, এই ভয়ে সৈন্যটি এটিলীসের হাত জড়িয়ে ধরলো। সন্তানের গভীর শোকে বিচলিত হয়ে সহসা এচিলীসের পরী-মাতা তিতিশা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন! মা শূন্যে বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে বল্লেন-বাপ, কাঁদছো কেন? এই পরাজয় গ্রিকদের অহঙ্কারের ফল–এ যে তোমারই অভিশাপ। তোমার সঙ্গে তারা কি ব্যবহার করেছে, তা। কি আমার মনে নেই?

এচিলীস মাকে দেখে কিছু শান্ত হলেন। বললেন–মা, তোমার কথা ঠিক; কিন্তু আমি যে আমার প্রাণের বন্ধুটিকে হারিয়েছি, সঙ্গে তোমার দেওয়া পোশাকটিও শত্রু-হস্তে পড়েছে। মা আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, আমি যেমন আমার বন্ধুর জন্যে শোক করছি, শীঘ্রই আমার জন্যেও তোমাকে তেমনি করে শোক করতে হবে। যে অসম্মান আমার বন্ধুর প্রতি হেক্‌তর করেছে, তার প্রতিশোধ যদি না নিতে পারি, তা হলে আর বাড়ি ফিরে যেতে চাই নে।

মা বললেন-বাপ, তোমার অদৃষ্টে লেখা আছে যে তুমি যদি হেরকে হত্যা কর তাহলে তোমাকে মরতে হবে।

এচিলীস বললেন–মা, আমার বাঁচবার সাধ নেই, আমার বন্ধুকে নিয়ে তারা শৃগাল ককুরের আহার যোগাবে, আর আমি এখানে বসে থাকব? এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে যেয়ে এখনই আমাকে মরতে হয়, কোনো ক্ষতি নেই।

মা বললেন–তা হলে আজিকে তুমি অপেক্ষা কর। তোমার লোহার পোশাক এখন হেক্টরের গায়ে। আমি যাচ্ছি, কাল তোমার জন্য ন্তুন পোশাক আনবো, তাই পরে যুদ্ধ করবে–এই কথাগুলি বলে এচিলীসের পরী-মা বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলেন।

বড় আজাক এখন আজিজের মৃতদেহের জন্যে যুদ্ধ করছিলেন। হেক্‌তর মৃতদেহটি পায়ের তলায় চেপে ধরে ত্ৰয় সৈন্যদিগতে অগ্রসর হতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। শকুনের দল যেমন করে মরা দেহের চার পাশে হামলা করে ঘিরে আসে, গ্রিক সৈন্যরাও তেমনি করে অজিজের মৃতদেহের চার পার্শ্বে ঘুরছিল।

সে সৈনিকটি এচিলীসেকে বললে–বীরবর, আপনি থাকতে গ্রিক সৈন্যেরা এমন করে অপ্রস্তুত হচ্ছে?

এচিলীস বললেন–তা আমি কী করবো, আমি যে এখন নিরস্ত্র, আমার অস্ত্র নেই, পোশাক নেই কী দিয়ে যুদ্ধ করবো? আজিজের ঢালখানি পেলেও একবার এগিয়ে দেখা যেতো, কিন্তু সেখানি সে নিজেই ব্যবহার করছে।

সৈনিক বললে–যুদ্ধ না করেন এগিয়ে দাঁড়ান; আপনাকে দেখলে সৈন্যদের মনে উৎসাহ আসবে, ত্রয় সৈন্যরাও ভয় পাবে।

এচিলীস গড় পার হয়ে খোলা যুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্বে যেয়ে দাঁড়ালেন। তিনবার আকাশ কাঁপিয়ে তিনি গর্জন করলেন, সে বজ্র গর্জনে আকাশ কেঁপে উঠল। ত্রয় সৈন্যরাও ভয়ে আজিজের দেহ ফেলে সরে দাঁড়াল, সুযোগ পেয়ে আজিজকে একখানা ঢালের উপর তুলে দ্রুত পিছিয়ে এলো।

সূর্য তখন অস্তমিত হচ্ছিল। আজিজকে দেখে এচিলীস কাঁদতে লাগলেন। প্রতিজ্ঞা করে বললেন–যাবৎ না এ মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারি, তাবৎ আমি আমার বন্ধুকে মাটি দেবো না।

ত্রয়বাসীরা সে রাত্রে যুদ্ধক্ষেত্রেই থাকবে, না নগরে ফিরে যাবে ভাবতে লাগলো। হেক্‌তর বললেন–নগরে ফিরে আর কাজ নেই। অতি প্রত্যুষেই শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে।

তখনও রাত্রি ছিল, এচিলীস বাইরে এসে মায়ের অপেক্ষায় সমুদ্রের দিকে চেয়েছিল। হঠাৎ মা পুত্রের জন্য একটি পোশাক ও একখানা নূতন ঢাল নিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলেন। এচিলীস মাকে সালাম করে বিপুল আনন্দে ঢাল ও পোশাক তুলে নিয়ে বললেন–মা, তোমার ছেলেকে দোয়া কর, আজ হয় মৃত্যু নয় জয়।

পোশাকটি রাত্রির মধ্যেই তৈরি হয়েছিল। ঢালে আকাশ, চাঁদ, সূর্য ও তারামণ্ডলীর চিত্র আঁকা ছিল।

পোশাকে দুটি নগরের চিত্র এঁকে দেওয়া হয়েছিল। এক নগরের অধিবাসীরা বিবাহ উৎসবের মত্ত! তারা কনেকে মাথায় করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চৈঃস্বরে সকলে কনের রূপ, গুণ ও গান করছিল। যুবকেরা বাঁশির তালে তালে পা ফেলছিল। রাস্তার ধারে রমণীরা সেই বিবাহ উৎসবে বাঁশির তালে তালে পা ফেলছিল। রাস্তার ধারে রমণীরা সেই বিবাহ উৎসব দেখছিল!

দ্বিতীয় নগরে লড়াই বেধেছে।

পোশাকে একটা বিস্তীর্ণ মাঠের ছবিও ছিল। কৃষকেরা জমি চাষ করছে; মোড় ঘোরাবার সময় মেয়েরা তাদের হাতে এক পেয়ালা করে মিষ্টি শরবত দিচ্ছিল। চাষ করবার সময় লাঙ্গলের যেমন করে মাটি দু-ধারে গড়িয়ে পড়ে ছবিতেও ঠিক তেমনি করে পড়ছিল, এমন চমৎকার ভাবে সে ছবি আঁকা।

পোশাকে শস্যে-ভরা ক্ষেতের চিত্রও ছিল। বাতাসে দোল খেয়ে শস্যের মাথাগুলি হেলে হেলে পড়ছে। লোকে গান করে করে শস্যের আঁটি বাঁধছিল, আর ছোট ছোট ছেলেরা সেগুলি মাথায় নিয়ে গাড়িতে তুলে দিচ্ছিলো। দূরে তাদের রাজা বসেছিলেন, আনন্দে তার মুখে হাসি ধরে না–রাজ্য তার শস্য-সম্পদে পরিপূর্ণ।

কতকগুলি লোক একটা ষাড় জবাই করছিল; রমণীরা শ্রমক্লান্ত যুবকের জন্যে রান্না করবে।

একটা লতাপাতা ও ফুলে ভরা উদ্যানের ছবিও ছিল! বাগানের পথে যুবক ও মেয়েরা গান করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হৃদয় তাদের শুদ্ধ ও পবিত্র-আনন্দে ভরপুর।

একস্থানে এক পাল গাভীর চিত্র ছিল। গাভীদের সুন্দর দীর্ঘ শিংগুলি কত শুভ্র। দূরে একটা রক্তচক্ষু ক্রুদ্ধ সিংহ এক ষাড় ধরেছে; ষাঁড়ের গলা দিয়ে অজস্র-ধারায় রক্ত পড়ছে, সিংহ সেই রক্ত খাবে। বড় বড় শিকারী কুকুর সিংহকে আক্রমণ করবার জন্যে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তাদের সাহসে কুলোচ্ছে না। একটা পাহাড়ের ধারে এক পাল মেষ চর ছিল। দূরে একটা ধবধবে ঘর। সেখানে কুমারীরা বাঁশি বাজিয়ে গান করছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *