০৪. মন পরীক্ষা করবার জন্যে

মন পরীক্ষা করবার জন্যে একদিন এগামেমনন সৈন্যদেরকে ডেকে বললেন–চল, আমরা দেশে যাই; কেন আর মিছামিছি পরের জন্য লড়াই করে মরি!

সৈন্যেরা আনন্দিত হয়ে বললে–তাই তো! কেন আমাদের এই মাথা ব্যথা? কেন জন্মভূমি ত্যাগ করে সাগরপারে হেলেনের জন্যে প্রাণ দিতে এসেছি? সে শয়তানী গোল্লায় গিয়েছে, তাতে আমাদের কী? এই কথা বলে মহাউল্লাসে তারা জিনিসপত্র ও তাঁবু বেঁধে জাহাজে ওঠা শুরু করলো।

আসলে হেলেনকে রেখে যে গ্রিক বীরেরা দেশে চলে যাবেন, তা তো হতে পারে না, এগামেমননের ইচ্ছে–একবার সকলের মন পরীক্ষা করেন।

অনেক কষ্টে ওদেসিজ সৈন্যদেরকে জাহাজ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। ওদেসিজ বললেন, হে গ্রিসের বীরগণ, তোমরা যে কাপুরুষের মতো দেশে ফিরে যাচ্ছো–দেশের লোকেরা যখন জিজ্ঞাসা করবে, কী করে এলে? তখন কী বলবে? নারীরা যখন জিজ্ঞাসা করবে–হেলেন কই, তখনই বা কী বলবে? রিক্তহস্তে পরাজিত হয়ে ফিরে যাবার জন্য কি তোমরা আস্ফালন করে ত্রয়বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিলে? অসম্মানে বেঁচে থাকা অপেক্ষা মরণই যে শ্রেয়, তা কি তোমাদের মা তোমাদেরকে শেখান নি? প্রতিজ্ঞা কর, হে গ্রিসের সন্তানগণ, যাবৎ না আমরা হেলেনকে উদ্ধার করতে পারি, ঐ ত্রয় নগর যতদিন না আমাদের হয়, ততদিন এখান হতে ফিরে যাবো না। হেলেনের বিয়ের সময় বৃদ্ধ রাজা তানীরজের কাছে তোমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তা কী তোমাদের স্মরণ নেই?

সৈন্যেরা করতালি দিয়ে বললে, গ্রিকজাতি কোনো যুদ্ধে পরাজিত হয় নি, কোনো দিন তারা কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নি। এই বিশাল নগর আমরা জয় করবোই করবো, গ্রিসের জয়পতাকা এখানে উড়াবো।

এগামেমনন বললেন, বেশ, তা হলে সজ্জিত হও, সূর্যাস্তের পূর্বেই আমাদেরকে একটা ভীষণ লড়াই করতে হবে।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সৈন্যশ্রেণী নিয়ে এগামেমনন যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। ওদিক থেকে ক্রয়-বাসীরও বেরিয়ে এলো। যুদ্ধক্ষেত্রে যে কী ভীষণ দৃশ্য হল, তা না দেখলে ঠিক বুঝতে পারা যাবে না।

বৃদ্ধ রাজা প্রিয়াম ছাদের উপর থেকে সে দৃশ্য দেখতে বসলেন।

তিনি উপর থেকে গৃহের আঙ্গিনায় দেখলেন তার নূতন পুত্রবধূ হেলেনকে। হেলেন তার সখীদের সঙ্গে ফুলের মালা গাঁথছিলেন। প্রিয়াম একদৃষ্টে বধূর রূপ দেখে ভাবতে লাগলেন, এ হেন রূপসীর জন্য যে আমার ছেলে পাগল হয়েছে, এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। হেলেনের জন্যে ক্রয় ও গ্রিসে যুদ্ধ বেধেছে–এও আশ্চর্য নয়।

একটা মেয়ে দিয়ে হেলেনের কাছে খবর পাঠিয়ে দিলেন–আমার বধূকে একবার এদিকে আসতে বল।

হেলেন লজ্জাজড়িত চরণে, নত-মাথায় শ্বশুরের কাছে এসে উপস্থিত হলেন।

প্রিয়াম বললেন–মা, একবার যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে চেয়ে দেখ। তুমি গ্রিসের বীরদেরকে নিশ্চয়ই চেন। ঐ যে বিরাট মূর্তি বীর, যিনি আমার পুত্র পেরিসের সঙ্গে সোজা দাঁড়িয়ে আছেন, উনি কে? উনি বোধ হয় কোনো রাজা হবেন, তাঁকে সাধারণ সিপাইদের মতো দেখা যাচ্ছে না।

হেলেন বললেন–আপনার সম্মুখে আসতে আমার লজ্জা করে। আমি পরের বৌ, আপনার ছেলে আমাকে চুরি করে এনেছে, কুলকামিনীর পক্ষে এর চেয়ে অপমান আর কি হতে পারে? আমি অভাগিনী কী বুঝে যে এই সর্বনাশ কাজ করেছি, খোদা জানেন। আমার লজ্জা রাখবার স্থান নেই। হায়, আমরা কপাল! যদি এখানে আসবার আগে আমার মৃত্যু হতো, সেও ভালো ছিল! হেলেন কেঁদে বললেন–আমার স্বামী আছেন, ঘরে আমার সোনার চাঁদ শিশু আছে। যাক আপনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেন এই সব বাজে বকছি? যার পরিচয় আপনি জিজ্ঞাসা করছেন, উনি হচ্ছেন আমার দেবর, এগামেমনন।

প্রিয়াম আবার জিজ্ঞাসা করলেন–আচ্ছা মা, ঐ যে যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ পূর্ব কোণে একটা সাদা ঘোড়ায় চড়ে ত্রয় নগরের দিকে আসছেন, উনি কে? এগামেমননের ন্যায় তার বাহু তত বিশাল নয়, কিন্তু গায়ে যে তার খুব শক্তি রয়েছে, তাতে আর সন্দেহ নেই।

হেলেন বললেন–উনি ওদেসিজ, গ্রিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর।

দাসী বালিকা বললেন–ওকে আমি চিনি। যখন প্রথম হেলেনকে ফিরিয়ে পাবার জন্যে উনি ও আর একজন এসেছিলেন, তখন ওঁকে আমি দেখেছিলাম। ওঁর গলার আওয়াজ বজ্রপাতের মতো ভীষণ ও উচ্চ।

আর একজনের দিকে আঙ্গুল তুলে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন–উনি কে মা?

হেলেন বললেন–উনি আজা, তেলামনের পুত্র। আজাসের কাছে ঐ যে। একজনকে দেখতে পাচ্ছেন, ওঁর নাম ইদিয়মেনাস। ইদিয়মেনাস প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন! আমার স্বামীর সঙ্গে তাঁর খুব বন্ধত্ব ছিল। অনেককেই দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার ভাই দুটিকে তো দেখতে পাচ্ছিনে। তারা কি গ্রিক বীরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে? হায় হায়, লোকসমাজে তাদের মুখ দেখাবার উপায় নেই–আমি হতভাগিনী কুল কলঙ্কিনী যে তাদের বোন! এই কথা বলতে বলতে হেলেন কাঁদতে লাগলেন।

ত্রয়-বাসীরা বীর বিক্রমে গ্রিকদের আক্রমণ করলে মেনেলাস দেখলে, যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে পেরিস। সিংহের ন্যায় তলোয়ার আস্ফালন করতে করতে তিনি পেরিসের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে তাঁর জীবন শত্রুর হৃদয়রক্তে তলোয়ার ভিজাতে পারবেন, এই আশায় তার বাহুতে প্রচণ্ড শক্তি এলো, তার চক্ষু হতে আগুন বের হতে লাগলো। নরপিশাচ পেরিস মেনেলাসের সে ভায়ানক মূর্তি দেখে স্থির থাকতে পারলো না। শরীর তাঁর কাঁপতে লাগলো, কাপুরুষের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে সে সৈন্যদের ভিড়ের মাঝে ঢুকে পড়লো। প্রিয়ামের বড় ছেলে হেকতর তা দেখলেন। তিনি উচ্চস্বরে পেরিসকে লক্ষ্য করে বললেন–ওরে এয়-কলঙ্ক তুই আমাদের মুখে কালি দিয়েছিস। তোরি দুষ্কর্মের জন্য আজ ত্রয় ধ্বংস হতে চললো। পরস্ত্রী চুরি করতে লজ্জা করে না? লজ্জা হয় বুঝি যুদ্ধ করতে? কেবল শৃগালের মতো পালাতে জান? কোন্ কাপুরুষের দল তোমার সঙ্গে বীর মেনেলাসের পত্নীকে চুরি করবার জন্য গ্রিসে গিয়েছিল? ধিক তাহাদেরকে, ধিক তোমাকে! ত্রয়বাসীরা তোমার ন্যায় নরাধমকে যে বহু পূর্বেই মেরে ফেলে নি, এজন্য তাহাদেরকে ধন্যবাদ দাও। পেরিস বললেন, ভাই হেকতর, তুমি আমাকে অন্যায় ভর্ৎসনা কচ্ছো। কিন্তু ভেবে দেখ, অনর্থক এত জীবন নাশের আবশ্যকতা কী? শান্তি ঘোষণা করো। আমি ও মেনেলাস, যারা এই যুদ্ধের প্রকৃত কারণ, সম্মুখযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হই, সকল লোক বসে থাকুক–আমাদের দুই জনার মধ্যে যে জিতবে, সেই হেলেনকে পাবে।

হেকতর পেরিসের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হলেন। অবিলম্বে যুদ্ধ স্থগিত করা হল। রাজধানীতে বৃদ্ধ রাজা প্রিয়ামের কাছে সন্ধি-সংবাদ প্রেরিত হল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হলেন। এগামেমনন ও ওদেসিজ তাঁকে অভ্যর্থনা করতে ক্রটি করলেন না। তখন আর কারো মনে হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। গ্রিস ও ত্রয়ের বীরবৃন্দ একস্থানে সমবেত হয়ে সন্ধি-শর্ত আলোচনা করতে লাগলেন। বৃদ্ধ প্রিয়াম পুত্রের ইচ্ছায় সন্তুষ্ট হলেন, কোনো অনর্থক লোকক্ষয়-যাদের কারণে যুদ্ধ হচ্ছে, তারাই করুক। যে জিতবে সেই হেলেনকে পাবে–এ ন্যায্য কথা।

এগামেমনন যুদ্ধের জন্যে স্থান প্রস্তুত করলেন। হেকতর পেরিসকে যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত করে দিলেন। এদিকে গ্রিকেরা মেনেলাসকে নানাবিধ অস্ত্র দিয়ে মনের মতো করে সাজালেন।

তারপর মেনেলাস ও পেরিসে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ হল। পুত্রের মৃত্যু দৃশ্য দেখতে হবে, এই ভয়ে রাজা প্রিয়াম যুদ্ধক্ষেত্র হতে বাড়ি ফিরে গেলেন। মেনেলাস তার ভীষণ তরবারি তুলে পেরিসকে এরূপ মুহুর্মুহু আঘাত করতে লাগলেন যে, শেষে পেরিস কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়ন করলেন। মেনেলাস তাকে ধরবার জন্যে, জনতার মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন–কিন্তু পেরিসের আর কোনোই পাত্তা পাওয়া গেল না। আসল কথা, পেরিসের সেই বন্ধু পরী, যে ইদা পাহাড়ে সুন্দরী বৌ দিতে চেয়েছিল, সে তাকে মেঘে ডেকে একেবারে বাড়িতে রানী হেলেনের কামরায় এনে তুলে দিল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ‘পেরিস গেল’ বলে চীকার হচ্ছিল, পেরিস তখন হেলেনের কাঁধে মাথা রেখে তাঁর ভয়ে-ভীত অন্তরে শক্তি-সান্ত্বনা খুঁজছিল।

ত্রয়বাসীরা পেরিসকে রক্ষা করবার জন্যে কিছুমাত্র লালায়িত ছিল না। এই হতভাগ্য রাজপুত্রের পাপের জন্যে যে তারা ধ্বংসের পথে ছুটেছে!

এগামেমনন উচ্চকণ্ঠে বললেন–হে সমবেত জনমণ্ডলী, যুদ্ধে কে জিতেছে তা তো দেখতে পেলেন। হেলেন এখন কাঁদের প্রাপ্য, তার বিচার করুন? যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, আর হেলেনকে আমরা চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *