৩১-৩৫. আর তো সহ্য হয় না

একবিংশ পরিচ্ছেদ

ফেলী বলিল–“মা, আর তো সহ্য হয় না। চল যাই। থানায় যেয়ে দারোগাকে চারি আনা ঘুষ দিয়ে নাম লিখিয়ে নেই গিয়ে!”

ফেলীর মা। চল আমিও নাম লেখাবো। আমাদের কোথায়ও স্থান নেই। আজ চারিদিন যাবৎ প্রতিবেশীর নিকট হইতে ফেলীর মা আর ফেলী ভাতের মাড় চেয়ে চেয়ে খাচ্ছে। হায়! মানুষের কি এত দুঃখ! এত দারিদ্র্য, এত ঘৃণা, এত অবমাননার ভিতর। মানুষ কি করে ধর্ম রক্ষা করে! মানুষে মুখে বলে পবিত্র হও, ধর্ম কর, কার্যত সে সদাই মানুষকে অধর্ম করিতে বাধ্য করে।

একখানা ভাঙ্গা ঘর, একখানা থালা, স্বামীর থালা, স্বামীর কালের একখানা পাটা তার পুরানো বদনাটা বিক্রি করে, ফেলীর মায়ের হাতে সাত টাকা হল।

দু’খানা নূতন কাপড়; একখানা আয়না, একখানা চিরুণী, এক শিশি সুগন্ধ তৈল, আর এক কৌটা মাজন তারা গ্রাম্য হাটের দিন কিনিয়া আনিল। মা-মেয়ে ঠিক করিল, ইহাতেই তাদের পাপের মূলধন হইবে!

আঁধার তখনও অল্প অল্প ছিল, মা ও মেয়ে এমনি সময় ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া পড়িল। বুক তাদের কাঁপিল না, বরং একটা মুক্তির আনন্দ অনেক দিন পরে তাহাদেরকে মাতাইয়া তুলিল।

সারাদিন হাঁটিয়া তাহারা ঝিনাইদহ মহকুমায় আসিয়া উপস্থিত হইল। পথের অনেক লোক ফেলীর মুখের দিকে অনেকবার চাহিয়াছিল। এর আগে তার মলিন মুখের দিকে

একবারও কেউ ফিরিয়া তাকায় নাই। আজ মুখে গৌরব! কত রূপ! কত আলো।

রাত্রিতে তারা এক হোটেলে রইল। মায়ে-ঝিয়ে হোটেল-স্বামীর কারণহীন অনুগ্রহে খাবার সময় সকলের চেয়ে বেশি ব্যঞ্জন পাইয়াছিল। সকাল বেলা হোটেল-স্বামী সকলের। নিকট হইতে পয়সা গ্রহণ করিল, কেবল লইল না ফেলী আর তার মায়ের নিকট হইতে।

তারা দেশ ছাড়িয়া নদের জেলা চুয়াডাঙ্গা মহুকুমায় যাইবে। একখানা ফেরত গাড়ির ভাড়া ঠিক হইল এক টাকা। গাড়োয়ান আগ্রহের সঙ্গে হেসে ফেলী আর তার মাকে গাড়িতে তুলে নিল। তখন বেলা আটটা।

গাড়ির ভিতর ফেলীকে তার মা বলিল–“ফুলরানী! ব্যাটাকে পান তৈরি করে দে।”

গাড়োয়ান আনন্দাতিশয্যে বলিল–“থাক; থাক।”

পথের মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেছিল, গাড়ি কোথায় যাবে? গাড়োয়ান অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত বলিতেছিল, “বৌ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে।”

নামাইবার সময় ভাড়া তো লাগিলই না, অধিকন্তু গাড়োয়ান ফুলরানীকে একখানা চাটুকদার শাড়ী আর একটি টাকা দিয়ে বললে,–“মনে রেখ। মাঝে মাঝে এসে দেখা। করলে যেন জায়গা পাই।” ফুলরানী মধুর হাসিয়া বলিল–“জীবনে তোমাকে কখনও ভুলব না। তোমাকে দেখা অবধি মন আমার কেমন হারিয়ে গিয়েছে।” গাড়োয়ান তার। মাথাটা ফুলরানীর পায়ের কাছে রেখে খালি হাতে বাড়ি চলে গেল। এই হতভাগাই আজ পাঁচ টাকা জলে ফেলে না দিয়ে পাঁচটি পয়সাও কি ভিক্ষাস্বরূপ দু’দিন তাহাদেরকে দিতে পারে নাই?

.

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

“ওটা কী ভেসে যায় রে?”

নবা বলিল–“তাই তো রে, ওটা কী?”

বিহারী নৌকাখানি একটু এগিয়ে নিয়ে বললে–“একখানা কাপড়। চিলুঘাটের ন্যাকড়া বুঝি?”

“না না, ভালো করে দেখ দেখি। চুলের গোছা দেখা যাচ্ছে।”“চল, একটু এগিয়ে দেখে আসি।”

নৌকাখানি এগিয়ে নিয়ে বিহারী আর নবা দেখতে পেলে একটা আধবয়সী স্ত্রীলোক ভেসে যাচ্ছে।

মানুষ যেমন প্রকৃতিরই হোক না কেন, সে একেবারে চোখের সামনে কাউকে মরে যেতে দেখতে পারে না। উভয়ে ধরাধরি করে মাতৃল্পে দেহটি নৌকার উপর টেনে উঠিয়ে, ফেললো।

বিহারী, চিৎকার করে বলে উঠলো,–“আরে জ্যান্তো মেয়ে মানুষ। নৌকা বেয়ে দে একেবারে বাড়ির ঘাটে।”

।তার পরে তীরবেগে নৌকা বেয়ে দিতে তারা ভিতর বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছল।

বিহারী তার দিদিকে ডেকে তাড়াতাড়ি সৌদামিনীর অসাড় দেহ ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে ফেললো। পেটের ভিতর জল যেয়ে পেট ফুলে উঠেছিলো। বিহারী পেট থেকে জল বের করে দিল। বিহারীর বোন সৌদামিনীর গায়ে সেঁক দেওয়া আরম্ভ করলো।

সারাদিন পরে বৈকাল বেলা সৌদামিনী চোখ খুলে চেয়ে দেখে, সে এক ধীবরের বাড়িতে শুয়ে আছে।

বিহারীর বোন বললে–“কে গো তুমি নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলে? বিহারী ও নবা তোমাকে জল থেকে তুলে এনেছে। কী জাত তুমি?”

সৌদামিনী অতিকষ্টে কহিল–“আমি এখানে কেন? মুনসেফ বাবু কই?” বলিতেই তাহার মনে হইল সেত গোয়ালন্দ স্টীমারঘাটে তার স্বামীর কাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলো।

সৌদামিণীয় চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল।

বিহারীর বোন আবার জিজ্ঞাসা করিল–“তোমরা কী জাত? আমাদের জাতি যায় নাই তো?”

সৌদামিনী কহিল, “না, তোমার জাতি যাইবার সম্ভাবনা নাই আমি ভালো জাত।”

বিহারীর বোন একখানা ঘেঁড়া কাপড় আনিয়া কহিল–“এই খানা পরো।”

সৌদামিনী অতি কষ্টে বিছানা হইতে উঠিয়া কাপড় বদলাইল। সে ভাবিতেছিল–ভগবান এ কি করলে?

স্বামীর প্রেম সম্বন্ধে তাহার দৃঢ় আস্থা ছিল। কিছুক্ষণ পরই সে সকলকে কহিল–সে এক বড় লোকের ঘরণী। স্টীমার থেকে জলের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। স্বামী এতক্ষণে তার সন্ধানে বেরিয়েছেন এবং নিশ্চয়ই তিনি অতিশীঘ্র এখানে উপস্থিত হবেন।

বিহারীর বোন বলিল–“হিন্দুর বৌ তুমি, তোমার তো জাতি গিয়াছে। হিন্দুর মেয়ের কোনো বিপদ হলে জাত থাকে না, তা বুঝি জান না?”

সৌদামিনী বুকের ভিতর একটা দীর্ঘ তীক্ষ্ম শলার মতো কি যেন প্রবেশ করিল। বাহিরে তিনি বলিলেন–“ওসব কোনো কথা নয়, তার স্বামী নিশ্চয়ই তার সন্ধানে বেরিয়েছেন।”

আরও বললেন–“তারা যে কষ্ট স্বীকার করেছে তার জন্য তারা যথেষ্ট পুরস্কার পাবে।”

বিহারী, নবা ও বিহারীর বোন পুরস্কারের নাম শুনিয়া আনন্দিত হইয়া উঠিল এবং তৎক্ষণাৎ বিহারী চিড়ার সন্ধানে বাহির হইল।

শীঘ্র শীঘ্র গ্রামময় রাষ্ট্র হইল, নদী দিয়ে একটি বৌ ভেসে যাচ্ছিল, বিহারী আর নবা তাকে তুলে বাড়ি এনেছে।

বর্ষীয়সী রমণীরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললে–“আহা বউটির জাত গেল, তবে আর বেঁচে থেকে লাভ কি?”

একমাস অতীত হইয়া গিয়াছে তবুও কেউ সৌদামিনীর সন্ধানে এলো না একমাস পরে সৌদামিনী একটা কাল সন্দেহ বুকে নিয়ে একখানা পত্র লিখিল। পত্রখানি এই :

তারিখ … প্রিয়,

কি লিখবো! চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। আমি নদীর উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম। দুইজন ধীবর আমাকে তুলে এনেছিলো! আমি বর্তমানে এখানে আছি। তুমি পত্র পাঠমাত্র এসে আমাকে নিয়ে যাবে। পথের পানে চেয়ে রইলাম।

দাসী সৌদামিনী এক সপ্তাহ পর উত্তর এলো–

প্রিয় সৌদামিনী!

তোমার পত্র পেয়েছি। হাজার দুঃখ হলেও তোমাকে আর আনবার যো নাই। ১০টি টাকা পাঠাইলাম। আরও অনেক পাঠাইব। সেখানে ঘর বেঁধে নিও। সমাজের ভয়ে আমার সেখানে যাবার যো নাই।

ইতি–

শ্যামচরণ।

পত্র পড়ে সৌদামিনী মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ে গেল। এত ভালবাসার এই পরিণাম! সমাজের ভয়ে শ্যামচরণ তার এত বছরের স্ত্রীকে অবাধে ফেলে দিলেন। আপন স্ত্রীর প্রতি এত অবিশ্বাস! স্ত্রী তবে কেমন করিয়া পুরুষকে বিশ্বাস করে? স্ত্রীলোকের কী আত্মা নাই? স্ত্রীলোকেরই জাতি যায়? পুরুষের কী জাতি নাই? একটা আত্মার জন্য, একটা সত্যের জন্য সমস্ত বিশ্বসংসারের সহিত সগ্রাম বাঁধালে কি ক্ষতি? বালা দুগাছি বিক্রি করে সৌদামিনী ধীরদেবরকে ও বিহারীর বোনকে ২০ টাকা দিল। বাকি এক মাসের খাবার খরচ করে কয়েকখানি কাপড়ে ব্যয় হয়ে গেল। সৌদামিনীর কষ্টের অবধি রহিল না। ছোট লোক পয়সার চাকর। সৌদামিনী একেবারে পথের ভিক্ষারিণী হলেন। যার মান-মর্যাদা কিছুই এর পরে রইল না। যাকে ধরে তার এত সম্মান সেই যে তাকে তার বিপদের সুযোগ নিয়ে পথে ফেলে দিচ্ছে। এই কি ধর্ম?

তার কি হয়েছে? কেন তাকে ফিরে নেওয়া যাবে না সহায়-সম্পত্তিহীন হয়ে স্ত্রীলোকের পক্ষে ছোটলোকদের মধ্যে কেমন করে কাল কাটান যায়? গত জীবনের এত ভালবাসা, এত প্রেমের প্রতিজ্ঞা মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল। একটা মানুষের জন্য, একটা সত্যের জন্য মানুষ যারা তারা সমাজ তো দুরের কথা, নিজের জীবন দান করতে আনন্দ বোধ করে। নারীর উপর স্বামীর একি অত্যাচার! ইহাই কি ধর্ম। ইহারি নাম কি জাতিরক্ষা। এই পৈশাচিক ধর্মই কি এতকাল সে পালন করে এসেছে। ধর্মের নামে একি অত্যাচার?

সৌদামিনীর ইচ্ছা হইল, সমস্ত দেবতাগুলোকে তিনি পৃথিবী ছাড়া করেন। সমস্ত হিন্দু সমাজকে তিনি সাগর-জলে ডুবিয়ে মারেন।

তিনি কেমন করে এখানে থাকবেন। এই সব ছোটলোকদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস কী? হায়! এমনি করে বিধাতা তার কপালে আগুন ধরিয়ে দিলেন। কোথায় তার পুত্র হরিচরণ? সে হয়তো তার মাকে এমনি করে ফেলে দিত না। সে সংসার ছাড়তো, সে ধর্ম পরিত্যাগ করতো, কিন্তু তার মাকে সে ফেলতো না। সৌদামিনী হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। তিনি কোনো দিন ভাবতে পারেন নাই, তাঁর স্বামী তাঁর পুত্রের তুলনায় এত ছোট। তিনি চিরকালই ভেবে এসেছেন যে, পুত্রকে তিনি পরিত্যাগ করতে পারেন কিন্তু তার পতি দেবতাকে তিনি কখনও পরিত্যাগ করতে পারেন না।

.

ত্রয়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

লোহারামের স্ত্রী কাদম্বিনীর কাপড় একেবারে ছিঁড়ে গিয়েছে। সাত বছর সে ক্ষুদ-কুঁড়ো খেয়ে বেঁচে আছে। বাড়ির গিন্নীর পনেরখানা কাপড়। চাকরে আর দুই জোড়া কিনে নিয়ে গেল!

বাড়ির কাজেই রাধাগোবিন্দের বাড়ি। রাধাগোবিন্দ গ্রাম্য সম্পর্কে লোহারামের ভাই, সুতরাং কাদাম্বিনীর দেবর। রাধা প্রায়ই কাদম্বিনীর সঙ্গে আলাপ করতো। অনেকবার সে কাদম্বিনীকে কাপড় কিনে দিতে চেয়েছে। কাদম্বিনী গম্ভীরভাবে রাধার অযাচিত দান প্রত্যাখ্যান করেছে।

আজ সন্ধ্যাবেলা রাধা কাদম্বিনীর ঘরে তামাক টানতে টানতে এসে উপস্থিত হল। ঘরে প্রদীপ নাই। তেল থাকলে আলো জ্বলতো।

রাধা অন্ধকারে কাহাকেও না দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“দিদি, বা আছ গা?”

কাদম্বিনী অন্ধকারের ভিতর হইলে বলিল–“এই যে এখানে বস আছি।”

বেদনায় দারিদ্রে কাদম্বিনীর আর মনের জোর নাই। এই দুঃখ ও অভাবের শেষ কোথায়?

কাদম্বিনী একখানি ছেঁড়া ছালা পেতে দিয়ে বললে, “বসো রাধা।”

রাধা তামাক টানিতে টানিতে আবার বলিল–“এমনি করে আর কদিন চলবে দিদি?”

কাদম্বিনী মুদৃ আর্দ্র কণ্ঠে বলিল–“কি করবো। ভগবান কপালে যা লিখেছিল তাই হচ্ছে। কে আছে আমার এ সংসারে?”

রাধা বলিল–“দিদি, অমন কথা বলো না। আমি কি তোমার পর?”

রাধা যে তার কোনো কালের কেউ নয়–কাদম্বিনী তাহা বিলক্ষণ জানিত। তত্রাচ বললে–“না না তুমি পর এমন কথা বলবো কেন?”

“তবে যে আমি কোনো কিছু দিলে তুমি লও না?” কাদম্বিনী কথা বলিল না।

রাধা আবার বলিল–“ও পাড়ার নিমাই ঘোষের ছেলে জামালপুরে গিয়েছিলো। সে যা দেখে এসেছে তা লোকের কাছে বলবার যোগ নাই রাম! রাম!”

কাদম্বিনী আগ্রহান্বিত স্বরে কহিল, “কি খবর রাধা? তার কোনো অমঙ্গল হয়েছে কি?”

রাধা কহিল–“অমঙ্গল! কীসের অমঙ্গল? তুমি যেমন বোকা দিদি! সে ওদিকে নবাবি চলা চেলে তোমার কথা ভুলে মদ আর গাঁজা, আর নিত্য নূতন মেয়ে মানুষ নিয়ে সুখভোগ করছে, আর তুমি উঠতে-বসতে তার নাম করছে!”

কে যেন কাদম্বিনীর গায়ে জ্বলন্ত মশাল ছুঁইয়ে দিল। অন্ধকারে কাদম্বিনীর মুখোনি সহসা অতিমাত্রায় বিস্ময় ও ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো।

কাদম্বিনী আবার কহিল–“নিমাই ঘোষের ছেলে নিজের চোখে দেখে এসেছে?”

সে মিথ্যা আর বলবে কেন? তার কি এতে কোনো স্বার্থ আছে?

সমস্ত রাত্রি কাদম্বিনী ঘুমাইল না।

তার এই সতীত্বের, এই অপেক্ষার এই পরিণাম!

পরদিন হাট থেকে রাধা আট সের চাল, এক জোড়া কাপড় এক বোতল তেল আনিয়া কাদিম্বনীর কাছে পাঠাইয়া দিল। কাদম্বিনী তাহা লইতে আজ অস্বীকার করিল না।

নিমু শেখের শালা মহিউদ্দিন। ছোটকালে তার নাম ছিল মদো। সে গরু রাখত আর পাড়ায়। পাড়ায় তামাকে খেয়ে বেড়াতো।’

কলকাতা থেকে সেবারে এলাম প্রচারকমণ্ডলীর এক মৌলানা এসেছিলেন। এক বিরাট সভা হয়েছিল। দু’দিনের পথ থেকে মানুষ চাল-চিড়ে বেঁধে বক্তৃতাশুনতে এসেছিল।

মদো সেদিন তার মুনিব-বাড়ি গেল না। গরুগুলি মরার গেল বলে কয়েকবার তার মুনিব চীৎকার করতে করতে ডাকতে এলেন; মদো প্রত্যেক বারেই বলিল–তার ভয়ানক মাথা ধরেছে। বিছানা হতে তার ওঠবার যো নাই।

মুনিবের চীকার যখন আর শোনা গেল না তখন সে তার মার কাছ থেকে একটুখানি তেল নিয়ে; মিঞাদের পুকুর থেকে ডুব দিয়ে দুটি পান্তা খেয়ে তুলে–থোওয়া কাপড়খানা পরে, ক্ষারেকাঁচা একপাট্টাটা মাজায় বেঁধে, সাজানো গামছাটা কাঁধে ফেলে চুপে চুপে মৌলানা সাহেবের বক্তৃতা শুনতে চলে গেল। মদো বা মধু দেখলো কত হাজার হাজার লোক। তার রাখাল হৃদয়ে যেন এক অপূর্ব ভাব সে উপস্থিত হল। সে ধুলা ঝেড়ে এক জায়গায় বসে বক্তৃতা শুনতে আরম্ভ করলো। মৌলানা সাহেব কত কথা বললেন। মধুর চোখে কখনো জল এলো, কখনো ক্রোধ তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারলে সে সামান্য জাতি নয়। তার পূর্বপুরুষগণ জগতের বড় বড় লোক ছিলেন। তার মনে প্রশ্ন হল, সে তবে কেন এত ছোট, এত ঘৃণিত?

মৌলানা বললেন–“মানুষকে মরতে হবে। টাকা-কড়ি-ধন-সম্পত্তি কিছুই মানুষকে বড় করে না। বড় করে শুধু বিদ্যায়, আর যার চরিত্র বড় সেই বড়। পদবীতে লোক বড় হয় না। যে কোনো মুসলমান শ্রেষ্ঠ হতে পারে। খোদা কারো মাথায় বড় ছোট বলে ছাপ মেরে দেন নাই। যে বড় চেষ্টা করে সেই বড় হয়!”

মধুর মনে প্রশ্ন হল, সে কেন বড় ও শ্রেষ্ঠ হয় না?

মৌলানা বললেন ”যে মুসলমান বিদ্যা লাভ করে না সে মুসলমান নয়। প্রত্যেক মুসলমানকে বিদ্যা লাভ করতে হবে। মূর্খের উপাসনার কোনো মূল্য নাই! জ্ঞান লাভ করা মুসলমান ধর্মের এক শ্রেষ্ঠ নির্দেশ!”

মধু ভাবিল, সে মুসলমান নয়। যতদিন না সে বিদ্যালাভ করতে পারে ততদিন সে কাফের।

মৌলানা আবার বললেন–খোদাকে ভরসা করে মানুষ যা ইচ্ছা করে তাই হতে পারে।

মধুর প্রাণের ভিতর আগুন জ্বলে গেল। সে সভার মধ্যেই নীরবে প্রতিজ্ঞা করলে, সে যত দিন না লেখাপড়া শিখে একজন মুন্সী হতে পারে ততদিন সে মুসলমান নয়। বাড়ি ফিরে এসে পরদিন অতি প্রত্যুষেই বিছানা থেকে উঠে একেবারে সে শহরে চলে গেল। একখানা প্রথম ভাগ আর একখানা আরবি বই কিনে বাড়ি ফিলে এলো।

আজ দশ বৎসর পরিশ্রম করে মধুর মনস্কাম সিদ্ধ হয়েছে। সে এখন মুন্সী মহিউদ্দিন।

বাঙালা ও আরবি ভাষায় মহিউদ্দীনের যথেষ্ট দখল জন্মেছে। কেউ তাকে তুমি বলে কথা বলতে সাহস পায় না। ভিতরে তার শক্তি জেগেছে, সে একজন খাঁটি মুসলমান হয়েছে। খোদার জন্য সে যে কোনো কাজ করতে পারে। সে কোনো মানুষকে ভয় করে না। খোদা ছাড়া আর কেউ তার প্রভু নয়। ইদানীং ইংরেজি ভাষায় তার ব্যুৎপত্তি জন্মেছে। সে এখন একজন খাঁটি ভদ্রলোক যথার্থ একজন মুসলমান। সে অত্যান্ত বিনয়ী, মান বাড়ানোর জন্য সে বিনয়ী নয়। ভিতরটাই তার বড় হয়ে গিয়েছে। তাকে সম্মান ও নমস্কার করতে প্রত্যেক হৃদয়বান মনে আহ্লাদ হয়। সে একজন চাষার ছেলে এ কথা সে ঢাকে না। সে বলে এতেই তার বেশি গৌরব, এতেই তার বেশি মনুষ্যত্ব।

ভগ্নিপতি নইম শেখের বাড়ি আজ মহিউদ্দিন এসেছেন। ছোটকালের মধুকে দেখে নইমের মনে গৌরব জন্মেছে। তবুও সে আর তাকে মধু বলে ডাকতে সাহস করছে না।

মহিউদ্দিন তার চাষা ভগ্নিপতির মানসিক অবস্থার কথা বুঝতে পেরে বললেন ”আমি সেই মধুই আছি। আমার জন্য কোনো সম্মানের আবশ্যক নাই।”

নইম তার সরল চাষা-প্রাণের অন্তঃস্থল হতে আশীর্বাদ করে বললে,–“খোদা তোমাকে বেহেশত নছিব করে। তুমি আমাদের গৌরব।”

মহিউদ্দিন বললেন–“তোমরাও আমার গৌরব।”

.

চতুত্রিংশ পরিচ্ছেদ

সরযু বা সুরীর মা, আবদার রহমান যে দিন হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসে তার দু’দিন পরেই মুত্যুমুখে পতিত হয়।

সরযু মোহিনীর মৃত্যুর একমাস পরে কলিকাতা চলে আসে। সংসারের সমস্ত সুখ সে বিসর্জন করলে।

সুরীর অর্থের অনটন ছিল না। কিন্তু এত টাকা দিয়া সে কী করবে? নিজের আদৃষ্ট এবং সংসারের দুঃখ ও বিচিত্রতা ভেবে সে ইচ্ছা করলে সারাজীবন পীড়িতের সেবায় কাটাইয়া দিবে। কত লক্ষ লক্ষ রমণী দুঃখে, বেদনায়, অভাবে ও বিপদে পড়িয়া পথে দাঁড়ায়। তাহাদের আর ফিরিবার পথ থাকে না। কত পবিত্র ও সৌন্দর্যের ফুল অকালে শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে। কেহ তাহাদের খোঁজ রাখে না। জীবনে একবার একটা ভুল করিলে তাহার আর অনুতাপ করিবার উপায় নাই। কি অসীম দুঃখ বেদনা কি ভীষণ পাপে লক্ষ লক্ষ রমণীর বুকে চিতা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাদের একটু সরে দড়াবার পথ নেই। কত বড় বড় ঘরের কত সাধ্বী সংসারের অবহেলা ও ঘূর্ণাবর্তে পড়িয়া ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক পথে এসে দাঁড়ান। তাহাদের আঁখিজলের খবর কেউ রাখে না। তাদের বেদনা জগৎকে জানাবার কোনো উপায় নেই। একে দারুণ লজ্জা তার উপর মানুষের ঘৃণা ও অবহেলায় তারা নিবিড় আঁধারের মধ্যেই আত্মগোপন করে।

সরযু ক্যামবেলে ভর্তি হইয়াছে। মানব-সেবার পক্ষে ঔষধের জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

যত মেয়ে-ছাত্রী ছিল, তাদের মধ্যে সরযুই সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্রী। তাহার অনুধাবনশক্তি দেখিয়া কলেজের সকলেই চমৎকৃত। সে প্রতি পরীক্ষায় সুবর্ণ-মেডেল ও বৃত্তি লাভ করে। সমস্ত বৃত্তি সে, আতুর অনাথিনী রমণীগণকে বিলাইয়া দেয়। রমণী হইয়া সে রমণীর দুঃখ ভালো করিয়া বুঝিয়াছিল।

কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের মোড়ে সে একটা ছোট দোতলা বাড়ি লইল।

ভাড়া চল্লিশ টাকা। প্রতিদিন নিজের গাড়িতে চড়িয়া সে স্কুলে যায়। হুগলীর সম্পত্তি হইতে তাহার মাসিক আয় ৩০০ টাকা। এই তিনশত টাকাতেই তার বেশ চলতে লাগলো।

কখনও সে ব্রাহ্ম-মহিলাদের মতো, কখনও মেয়েদের মতো পোশাক পরে।

চাকরের মধ্যে একজন পশ্চিমদেশীয় দারোয়ান। বেতন তার দশ টাকা আর খাই খচর। একজন দাসী, তার বেতন পাঁচ টাকা।

একটু স্পর্শে, একটুখানি ভুলে যে ধর্ম নষ্ট হয়, সেই হিন্দু ধর্মের উপর সে আস্থা হারিয়েছিল। কেহ যেন তাই বলিয়া মনে না করেন সরযুর কোনো ধর্ম ছিল না। জীবন তার অত্যন্ত পবিত্র। সর্বদুঃখহর ঈশ্বরের কারুণ্য ও সর্বনিয়ামক শক্তির উপর তার গম্ভীর বিশ্বাস। মানুষের কাছে কোনো ধর্মের লোক সে, জানাইবার প্রয়োজন হইলে সে কহিত, আমি ব্রাহ্ম। সরযু বুঝিয়াছিল, জগতের কুসংস্কার ও মিথ্যার মাথায় পদাঘাত করিতে বিশ্বের সকল। মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্র পুত প্রেমের শৃঙ্খলে বাধিতে ইসলামই পথ। পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিতরে সে মুখ ফুটিয়া সে কথা প্রকাশ করিতে ভয় পাইত। সে দেখিল, এসলামের অণুকরণের নব গঠিত ব্রাহ্ম ধর্ম ও কুসংস্কার ও ভুলের প্রধান শত্রু। ইহাদিগকে অবাধে মুসলমান বলা যাইতে পারে যদি ও তারা লজ্জা ও ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিবার খাতিরে মুসলমান নাম গ্রহণ করে না। মহাত্মা রামমোহন রায়ের সময় যদি বঙ্গদেশের। মুসলমানের অবস্থা ভালো থাকিত। তবে চিন্তাশীল, উন্নত হিন্দু সম্প্রদায় ব্রাহ্মধর্ম বলিয়া এসলামের নূতন শাখা বাহির করিতেন না।

সরযুর জীবন কী সুখময়! তার কামনা নাই, বাসনা নাই, মানুষের কল্যাণে বাসনা নিয়েই তার জীবন। তার জীবন কত পবিত্র, কত মধুর!

বাড়িতে পড়ে পড়ে তার বাংলা সাহিত্যে বেশ জ্ঞান জন্মেছিল। আরবি শব্দ বাঙ্গালায় পড়ায় সুবিধাজনক নয় দেখিয়া, সে অল্পদিনের মধ্যে দুই তিন খানা ইংরেজি বই পড়িয়া লইল।

কোনো পুরুষ লোকের সহিত সে আলাপ করিত না। স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা আবশ্যক জানিলেও সে স্বাধীনতার অর্থ পুরুষের সহিত মেলামেশা মনে করিত না। পুরুষকে সে। সাধ্যমত দূরে রাখিত। সামনাসামনি হইয়া কখনও সে পুরুষের সহিত কথা বলিত না।

কঠিন পরিশ্রমের ফলে সরযু প্রশংসার সহিত দুই বৎসর অধ্যয়ন করিল, আর এক বৎসর পরেই সে উপাধি লাভ করিবে।

এই পরিশ্রম ও ঔদাসীন্যের ভিতর সে একটা লোকের কথা অত্যন্ত আগ্রহের সহিত ভাবিত। সে যে কলিকাতা আসিয়া এবং ক্যাম্বোল ভর্তি হইয়াছে তাহা যথাসময়ে সে মিস্টার আবদুর রহমানের কাছে লিখিয়াছে। আবদুর রহমানের গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ চিঠি সরযুর মনে একটা মধুর পরিত্রতায় পূর্ণ দাগ ফেলিত।

এই দীর্ঘ দুই বৎসরের মধ্যে অনেকবার মিস্টার রহমানের সহিত সরযুর দেখা হইয়াছে। মিস্টার রহমানকে সে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে।

রহমান সেদিন ও সরযুর হাতের একখানা চিঠি পাইয়াছে। পত্রের প্রতি পঙক্তি সরযুর দেবীভাবের পরিচয় দিতেছে। আবদুর রহমান এমন আশ্চর্য দেবীপ্রতিমা রমণী আর কোথাও দেখে নাই। সে তাহাকে একজন অকৃত্রিম বন্ধু মনে করে। সরযুর ন্যায় মহিলার সহিত আলাপ করিয়া সে গৌরব অনুভব করে। সরযুর জীবন ও সাধনার প্রতি আবদুর রহমানের মনে একটা আশ্চর্য সহানুভূতি জাগিয়া উঠিয়াছে।

সেদিন আব্দুর রহমান সরযুর পত্রে জানিতে পারিয়াছে, সরযু একটা আশ্রম খুলিতে চাহে। সেখানে সহায়-সম্পত্তিহীন রমণীরা নিম্নশিক্ষা করিবে। সরযু, বহু টাকা ও সম্পত্তি এই কার্যে উৎসর্গ করিতে চাহে। সমস্ত জীবন কুমারী থাকিয়া সে তার এই উদ্দেশ্যে কর্মে পরিণত করিতে চেষ্টা করিবে। দেশের স্ত্রীলোকের দুঃখ, পাপ ও সহায়হীনতা তাহাকে দারুণভাবে আঘাত করিয়াছে। এই জন্যই সে ক্যাম্বেলে ভর্তি হইয়াছে।

আবদুর রহমানের সহিত সরযু এই বিষয় লইয়া একবার পরামর্শ করতে চাহে।

ফেরত ডাকে রহমান সরযুকে শত ধন্যবাদ দিয়া পত্র লিখিয়া দিল–শীঘ্র সে একবার তাহার সহিত দেখা করিবে।

কে যেন অতি অস্ফুটস্বরে সেই সময় রহমানের মনের ভিতর বলিয়া গেল, “আহা! সরযু যদি মুসলমান হইক।” রহমান চমকিত হইয়া বলিয়া উঠিল–ছি!

রহমান তখনও অবিবাহিত।

.

পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

সন্ধ্যাবেলা বকুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রমা নিহারের মতো হাত ধরে বললে–“নিহারা! দিদি! বল, তোর মন কি বলে?

“মনে দিন রাত হুহু করে আগুণ জ্বলে। কী করব, তুই বল? আর তো উপায় নাই, অত্যাচারী সমাজ আমাদের বিধবার হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দিয়ে বেঁচে থাকবে না? মুসলমানদের কেমন সুন্দর ব্যবস্থা। কোনো নারীর স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয় না। হিন্দুদের ভিতর পুরুষ একশটা বিবাহ করতে পারে, আর মেয়েরা সারাজীবন আগুনকে বুকের ভিতর পুষে রাখবে। কি ধর্ম! কি অবিচার!”

রমা শূদ্রের মেয়ে। নিহার কায়স্থের মেয়ে। তত্রাচ এদের মধ্যে বাল্যকাল হতে অত্যন্ত ভালবাসা। একজনের ব্যথা অন্যজন প্রাণপণে বুঝিতে চেষ্টা করে। বাল্যকাল হতে তারা। এক জায়গায় খেলা করে, তাহার পর একই সময় তাহারা বিধবা হয়, উভয়ের মানসিক অবস্থা! একই প্রকার ভয়ানক, সুতরাং প্রতিদিন তাহাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্বন্ধ আরও গাঢ় হইয়া উঠিতেছিল।

রমা নিহারের গলা ধরিয়া বলিল–“দিদি, কী করে একটা দীর্ঘ জীবন কাটাবো? প্রাণ যে ফেটে বেরোয়! কেউ আমাদের দুঃখ বুঝে না। আয়, আমরা বিষ খেয়ে মরে যাই।”

“মরতে পারলেও এ জ্বালা জুড়োতো কিন্তু নিজ হাতে কেমন করে নিজের প্রাণ বের করে দেবো?”

“তা তো ঠিক। আমরা মরি না কেন? পোড়া ব্যাধি আমাদেরকে কি চেনে না!”

“আচ্ছা আয়, ঠাকুরের কাছে পাঁঠা মানত করি। ঠাকুরকে বলি–ঠাকুর আমাদেরকে তোমার শীতল ক্রোড়ে আশ্রয় দাও। আমরা দুইবোন জোড়া পাঁঠা দেবো।”

“মরে গেলে কেমন করে ঠাকুরকে পাঠা দেবো?”।

রমা চিন্তা করিয়া বলিল, “তা তো ঠিক, কিন্তু আর যে সহ্য হয় না। অধর্ম ও পাপ করতে পারবো না আমরা, কিন্তু এ আগুন কি করে নিভাবো?”

“দেখো আমাদের আত্মীয়-স্বজন কেউ আমাদের দুঃখের কথা ভাবে না। কেউ আমাদের বেদনার কথা জানে না। সংসারের কাজ চলে যায়। কে খোঁজ রাখে, কার মনের ভিতর কী চিতা জ্বলেছে! সাধু ও জ্ঞানী যারা তারা স্ত্রীলোককে ঘৃণা করেই নাকি এত বড়!”

নিহারের চোখে অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে ছিল। গাছের পাতাগুলি বেদনায় কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।

রমা নিহারকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “দিদি, ভগবান ব্যথিতের বন্ধু, তার উপর আস্থা থাকা আবশ্যক। আমরা যদি মুসলমান হতাম, তাহলে এ নরকের আগুনে পুড়ে মরতে। হতো না। মুসলমানদের হৃদয়ে আছে, তারা দুঃখীর দুঃখ বুঝে; উপাসনা করতে জানে। মৌলভী সাহেবের বিধবা মেয়ে জমিলার সেদিন এক ডেপুটির সঙ্গে বিয়ে হল। জমিলা। দেখা হলেই বলে, তার মৃতস্বামীর স্মৃতি সে মুছে ফেলে নাই। ডেপুটি তার মৃত স্বামীর নতুন মূর্তি পরিগ্রহ করে তাকে ভালবাসে। সে ডেপুটির কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ সে জমিলার এত বড় শোককে একটু লাঘব করতে এগিয়েছে। এরূপ স্বামী পেলে কে দ্বিতীয় বার বিবাহ করতে লজ্জা বোধ করে? মায়ের এক সন্তান মরে গেলে সে তার দ্বিতীয় পুত্রকে টেনে নিয়ে শোক ভুলতে চায়। তাতে কি তার মাতৃত্বের মহিমা কমে যায়?”

নিহার বলিল–“আয় আমরা দুজনেই মুসলমান হই। মুসলমান ধর্ম খুব ভালো ধর্ম। শুনেছিস তো, মৌলবীরা কত সত্য কথা বলে।”

“কি করে মুসলমান হবো?”

“তাহলে খুব ভালো হয়, কেমন?”

‘হ্যাঁ তা ঠিক। বেশ ভালো যুক্তি বটে। মুসলমানদের মধ্যে খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কি করে কি করবো?”

“সে ভার আমি নিচ্ছি। নইমুদ্দিনের দাদা আমাকে আর তোকে খুব ভালবাসে। তাকে সব কথা বলবো। সে কলকাতা ইসলাম মিশনে খরব দেবে। সেখান থেকে মৌলবী এসে আমাদিগকে মুসলমান করে ভালো বিয়ে দেবে। সবার মাঝে নইম দাদা বলবে দুটি হিন্দু রমণী স্বেচ্ছায় মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে চায়। কারো বাধা দেবার ক্ষমতা থাকবে না?”

দু’জনে ঠিক করলো নইম দাদা আশ্রয় গ্রহণ করা কর্তব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *