০১. দর্শন ও দার্শনিক-পরিচিতি

দর্শন ও দার্শনিক-পরিচিতি

[জ্ঞানযোগে যে-সকল পাশ্চাত্য মনীষীর কথা বারংবার উল্লিখিত হইয়াছে, তাঁহাদের
সংক্ষিপ্ত পরিচয় এইখানে লিপিবদ্ধ হইল—উপাধি-নামের বর্ণানুক্রমে]

কমতে—Auguste Comte (১৭৯৮—১৮৫৭) ফরাসী দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য—Course Of Positive Philosophy(১৮৩০-৪২)।

কমতেকে প্রত্যক্ষবাদ ( Positivism)-এর স্রষ্টা বলা হয়। তিনি ফরাসী সংশয়বাদের (French Scepticism)-এর অন্যতম ধারক। সংশয়-বাদের মধ্যেও যে নির্দিষ্ট (Positive) জ্ঞানের স্থান আছে, ইহাই তাঁহার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁহার মতে—দর্শনে পরাবিজ্ঞানের (Metaphysics) কোন স্থান নাই। বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলি সম্বন্ধে সমালোচনামূলক ব্যাখ্যাই দার্শনিকের কাজ। চিরাচরিত প্রথায় ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে তিনি তাঁহার দর্শন রচনা করিয়াছেন এবং ইহাকে মানবতাবাদের (Humanism) উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন।

জেমস্—William James (১৮৪২—১৯১০) আমেরিকান দার্শনিক। তাঁহার প্রধান রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—The Principles of Psychology(১৮৯০), The Will to Believe(১৮৯৭), Varieties of Religious Experience(১৯০২), A Pluralistic Universe(১৯০৯), The Meaning of Truth(১৯০৯) ইত্যাদি।

ইংলণ্ডের দার্শনিক হিউমের প্রভাব জেমসের দর্শনে খুবই স্পষ্ট। সত্যের প্রকৃতি এবং পরীক্ষা-বিষয়ে জেমস্ প্রয়োগবাদে (Pragmatism) বিশ্বাস করেন এবং তিনিই এই মতবাদের স্রষ্টা। সত্যের প্রকৃতি ও তাহার জ্ঞান সম্বন্ধে জীবনে উপযোগিতার প্রসঙ্গ জেমসের রচনায় একটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। জৈবিক প্রয়োজন ব্যাতীত কোন কিছুই সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। তাঁহার Pragmatism (১৯০৭) নামক গ্রন্থে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতার উল্লেখ করেন।

টিণ্ডাল—John Tyndall (১৮৩০—৯৩) ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী। তাহার প্রণীত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—The Glaciers of the Alps(১৮৬০), Heat as a Mode of Motion(১৮৬৩) ইত্যাদি।

তিনি Royal Institution-এ প্রাকৃতিক দর্শনের অধ্যাপক নিযুক্ত হন (১৮৫৩)। তাপসংক্রান্ত বহুবিধ মৌলিক গবেষণা করেন। বায়ুমণ্ডল ও আলোর পরিক্রমা সম্বন্ধে তিনি অনেক গবেষণা করিয়াছেন।

ডয়সন—Paul Deussen(১৮৪৫—১৯১৯) জার্মান দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—Elements of Metaphysics. বেদান্তশাস্ত্রের উপর তাঁহার দুইখানি রচনা পাওয়া যায়—একখানি ‘বেদান্তদর্শন’ সম্বন্ধে (১৮৮৩), অন্যটি ‘বেদান্তসূত্র’ সম্বন্ধে (১৮৮৭)। হিন্দুদর্শন—বিশেষভাবে বেদান্ত-দর্শনের প্রতি তাঁহার গভীর অনুরাগ ছিল। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তাঁহার পাণ্ডিত্য অসাধারণ।—১০ ম খণ্ডে স্বামীজীর প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।

ডারুইন—Charles Robert Darwin (১৮০৯—৮২) ইংরেজ বৈজ্ঞানিক। তাঁহার রচনা সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—On the Origin of Species by means of Natural Selection or the Preservation of the Favoured Races in the Struggle for Life (১৮৫৯), The Variation of Animals and Plants under Domestication (১৮৬৮)ইত্যাদি।

ডারুইন বিবর্তনবাদ প্রচারের জন্য খ্যাত। তাঁহার মতে প্রাকৃতিক নির্বাচনই (Natural Selection)বিবর্তনবাদের মূলকথা। তিনি যোগ্যতম প্রাণীর বাঁচিবার অধিকারের উপর (Survival of the fittest) বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁহার মতে এই বিবর্তনবাদ একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া।

পিথাগোরাস —Pythagoras(খৃঃ পূঃ ৬০০—৫১০) গ্রীক দার্শনিক। তাঁহার লিখিত রচনা কিছুই পাওয়া যায় না। পিথাগোরীয় সম্প্রদায় হইতেই তাঁহার মতবাদ কিছু কিছু জানা যায়।

পিথাগোরাসকে গ্রীক দর্শনের ইতালীয় শাখার প্রতিষ্ঠাতারূপে বর্ণনা করা হয়। তিনি পুনর্জন্মবাদে (Transmigration of souls)বিশ্বাসী। সংখ্যাতত্ত্বের (Number)মূলবিষয়ে বহু গবেষণা করেন; ইহা হইতেই চরম সত্যের (Ultimate Reality)স্বরূপ নির্ণয় করিবার ইঙ্গিত পাওয়া যায় বলিয়া তিনি বিশ্বাস করেন।

প্লেটো —Plato (খৃঃ পূঃ ৪২৭—৩৪৭) প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক। তাঁহার উল্লেখযোগ্য রচনা—Apllogy; Crito; The Republic; Symposium; Phaedo; Phaedrus; Meno ইত্যাদি।

স্বনামধন্য প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিস্ প্লেটোর শিক্ষাগুরু। প্লেটোর দর্শনে সক্রেটিসের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। দর্শনের সহিত গণিতশাস্ত্রের যে ঘনিষ্ঠ যোগোযোগ আছে, তাহা প্লেটো সর্বপ্রথম তাঁহার দর্শনের মাধ্যমে প্রমাণ করেন। সঙ্গীত ও স্বাস্থ্যচর্চা দর্শনের একটি অপরিহার্য বিষয় বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। তাঁহার মতে আত্মার মধ্যেই প্রজ্ঞাই (reason) আত্মার (soul)আসল রূপ। প্রজ্ঞারূপ আত্মা দেহের সহিত যুক্ত হইলে কামনা ও অন্যান্য বৃত্তির সূচনা হয়। আবার দেহ বিনষ্ট হইলে তাহাদের লোপ হয়। আত্মা অবিনশ্বর এবং তাহাকে জানাই হইল প্রকৃত জ্ঞান(wisdom)।

ফিক্‌টে —Johann Gottilieb Fichte (১৭৬২—১৮১৪) জার্মান দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—Essay toward a Critique of All Revelation (১৭৯২), Introduction to the Science of Knowledge, The Natural Right, Science of Ethics( ১৭৯৬—৯৮) ইত্যাদি।

ফিক্‌টে কাণ্টের দার্শনিক মতবাদ দ্বারা বিশেষবাবে প্রভাবিত। জ্ঞানের উপায় ও স্বরূপ সম্বন্ধে তিনি বৈজ্ঞানিক আলোচনা করিয়াছেন। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের (Scientific Knowledge) মূল সূত্রগুলি ধরিয়া তিনি নীতিশাস্ত্র এবং সমাজতত্ত্বের উপর গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। তাঁহার মতে জীবাত্মার মধ্যে সক্রিয় (active) এবং নিষ্ক্রিয় (passive) এই দুইটি স্তর আছে। মন বা অহং (Ego)চরম তত্ত্ব। নৈতিক জীবনের পরিপূর্ণতার জন্যই অহং নিজেকে বস্তুরূপে বিক্ষিপ্ত করে।

বেন্‌থাম —Jeremy Bentham (১৭৪৮—১৮৩২) ইংরেজ দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—Introduction to the Principles of Morals and Legislation (১৭৮৯), Deontology(১৮৩৪)ইত্যাদি।

প্রাচীন দার্শনিক এপিকিউরাসের (Epicurus) মতবাদকে যথাযথ সংস্কার করিয়া নব্যভাবধারায় পরিপুষ্ট করিয়াছেন। নীতিশাস্ত্রজ্ঞ হিসাবেই বেন্‌থাম সমধিক পরিচিত। সুখী হইবার পন্থার মধ্যে তিনি নীতিশাস্ত্রের মূল সুর আবিষ্কার করিয়াছেন। তাঁহার মতে সর্বজনীন সুখ বা সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক সুখ (greatest happiness of the greatest number)মানুষকে জীবনের চরম মুক্তির পথ লাভ করিতে সাহায্য করে। এই সর্বজনীন সুখ যত তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হইবে, ততই তাহার নৈতিক মূল্য বৃদ্ধি পাইবে।

মিল —John Stuart Mill(১৮০৬—৭৩) ইংরেজ দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমুহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—System of Logic(১৮৪৩), Utilitarianism(১৮৬৩), An Examination of William Hamilton’s Philosophy(১৮৬৫)ইত্যাদি।

জন স্টুয়ার্ট মিল পিতা জেমস্ মিলের দার্শনিক মতবাদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত। দার্শনিক হিসাবে মিল ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক জ্ঞানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়া থাকেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল পদ্ধতি(Methodology of Sciences) সম্পর্কে তিনি অনেক আলোচনা করেন।

ম্যাক্স মূলার —Friedrich Maximillian Muller (১৮২৩—১৯০০) বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ্ জার্মান পণ্ডিত। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য History of Ancient Sanskrit Literature, Sacred Books of the East, Science of languageইত্যাদি। সংস্কৃত ভাষায় তাঁহার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি সায়নাচার্যের ভাষ্য-সহিত ঋগ্বেদের একখানি সংস্করণ প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন।—১০ম খণ্ডে স্বামীজীর প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।

ম্যাসপেরো —Sir Gaston Camille Charles Maspero(১৮৪৬—১৯১৬) ফরাসী মিশরতত্ত্ববিদ্(Egyptologist)। তিনি প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অনেক প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেন।

লেসীং —G. E. Lessing(১৭২৯—৮১) জার্মান দার্শনিক ও সাহিত্যিক। তাঁহার উল্লেখযোগ্য রচনা— Collected Works (6 vol-umes, ১৭৫৩-৫৫);

upon Current Literature(১৭৫৮)। তিনি দার্শনিক স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism)এবং লাইব্ নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের (Individualism) সমন্বয় সাধন করেন। পরবর্তীকালে কবি গ্যেটে এবং শিলার যে ভাবধারায় সাহিত্য-জগৎ সমৃদ্ধ করিয়াছিলেন, লেসীং তাহারই সূচনা করেন।

শোপেনহাওয়ার —Arthur Schopenhour (১৭৮৮—১৮৬০) জার্মান দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমুহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—(On Sight and Colours(১৮১৬) The World as Will and Idea(১৮১৯), The Two Fundamental Problems of Ethics(১৮৪১)ইত্যাদি।

শোপেনহাওয়ার নৈরাশ্যবাদী দার্শনিক। তাঁহার মতে অচেতন ইচ্ছাই (Will) আত্মা। এই ইচ্ছার মাধ্যমেই আত্মার অন্যান্য মানসিক ক্রিয়াগুলি সুসম্বদ্ধ ও পরিপুষ্ট হয়। এই পরিদৃশ্যমান জগৎ আমাদের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশমাত্র।

স্পেন্সার —Herbert Spencer (১৮২০—১৯০৩) ইংরেজ দার্শনিক। উল্লেখযোগ্য রচনা—Principles of Psychology(১৮৫৫), First Principles(১৮৬২), Principles of Biology(১৮৬৪—৬৭), Principles of Ethics(১৮৭৯), Principles of Sociology (১৮৭৬)প্রভৃতি।

হার্বার্ট স্পেন্সার অজ্ঞেয়বাদে (Agnosticism)বিশ্বাসী। তাঁহার প্রণীত First Principles নামক গ্রন্থে তিনি এই মতবাদের অবতারণা করেন। তাঁহার মতে—এই পরিদৃশ্যমান জগতের প্রথম এবং প্রধান কারণ সম্বন্ধে স্পষ্টরূপে কিছুই বলা সম্ভব নয়। তাহাকে তিনি অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়(Unknown and Unknowable) বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।

হাক্সলি —Thomas Henry Huxley(১৮২৫—৯৫) ইংরেজ প্রাণীতত্ত্ববিদ্। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য—On the Anatomy and Affinities of the Family of Medusae; The Origin of Species(১৮৫৯), Man’s Place in Nature(১৮৬৩)

হাক্সলি প্রথমজীবনে চিকিৎসকরূপে রাজ-নৌবহরবিভাগে যোগদান করেন (১৮৪৬)। অতঃপর জলজ জীবদেহসমূহের গবেষণায় তিনি বিশেষভাবে মনঃসংযোগ করেন। জীবনের শেষ দশ বৎসর তিনি দার্শনিক এবং ধর্মীয় সমাস্যাসমূহের আলোচনা করেন। তবে দার্শনিক অপেক্ষা বৈজ্ঞানিক হিসাবেই তিনি সমাধিক পরিচিত।

হিউম —David Hume(১৭১১—৭৬)ইংরেজ দার্শনিক। প্রধান রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—Treatise on Human Nature(১৭৩৪—৩৭), Enquiry Concerning Human Understanding(১৭৪৮), An Enquiry Concerning Principles of Morals(১৭৫১)ইত্যাদি।

তাঁহার দর্শন প্রত্যক্ষবাদ (Empiricism) বলিয়া পরিচিত। তিনি একজন সংশয়বাদী দার্শনিক। তিনি তাঁহার পূর্ববর্তী দার্শনিক লক(John Locke) এবং বার্কলির(bishop Berkeley) মতের কিছু কিছু ত্রুটি সংশোধন করিয়াছিলেন। প্রচলিত কার্যকারণবাদ হিউম অস্বীকার করেন।

হেকেল —Karl Haeckel(১৮৩৪—১৯১৯) জার্মান বৈজ্ঞানিক। তাঁহার প্রধান রচনাসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—Die Radiolarien—(১৮৬২), Deep Sea Medusae(১৮৮২)।

তিনি ডারুইনের বহু মত গ্রহণ করেন এবং তাহার সহিত জার্মান দার্শনিক ওকেনের(Oken)মতবাদগুলির সমন্বয় সাধন করেন। জার্মানিতে ডারুইনের মতবাদ সাধারণের উপযোগী করিয়া প্রচার করিবার ব্যাপারে তিনি বিশেষ অগ্রণী ছিলেন। তিনি জড়বাদমূলক একত্ববাদে (Materialistic Monism) বিশ্বাসী; বিরোধী পক্ষ ইহার তীব্র সমালোচনা করেন।

হেগেল —Georg Wilhelm Friedrich Hegel (১৭৭০—১৮৩১) জার্মান দার্শনিক। তাঁহার প্রধান রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—Phenomenology of Spirit (১৮০৭), Logic(১৮১২), The Outlines of the Philosophy of Right(১৮২১) ইত্যাদি।

হেগেলের মতবাদকে ‘বিজ্ঞানবাদ’ অথবা ‘পরমচেতনবাদ’ বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। হেগেলের মতে মরম চেতন সত্তা(Absolute) সমগ্র বিশ্বের অন্তর্নিহিত সত্য। চিন্তা বা প্রজ্ঞা এই পরমের স্বরূপ। গতিশীলতাই ইহার প্রধান লক্ষণ। দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে হেগেল ধর্ম, শিল্প ও বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করিয়াছেন। হেগেলের মতে এই পরমের মধ্যেই আমরা সত্য, শিব ও সুন্দরের সার্থক অভিব্যক্তি দেখিতে পাই। নয়, প্রতিনয় ও সমন্বয় (Thesis—Antithesis—Synthesis)—এই ত্রিভঙ্গ নিয়মে ইহার গতি হয়।

হেরোডোটাস —Herodotus(খৃঃ পূঃ ৪৮৫—৪২৫) গ্রীক ঐতিহাসিক। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য—History. এই গ্রন্থটি রচনা করিয়া হেরোডোটাস ‘ইতিহাসের জনক’ আখ্যা লাভ করিয়াছিলেন।

হ্যারিসন —Frederick Harrison(1813—)তিনি লণ্ডলের অক্সফোর্ডে শিক্ষালাভ করিয়া কিছুকাল শিক্ষকতা করিবার পর তিনি আইন ও রাজনীতি ক্ষেত্রে যোগ দেন। ধর্মসংক্রান্তবিষয়ে তিনি একজন দৃষ্টবাদী (Positivist) এবং রাজনীতিতে উদারপন্থি(Liberal) ছিলেন, বহু পত্রিকায় ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁহার সুচিন্তিত ও সুলিখিত অভিমত পাওয়া যায়। তাঁহার লিখিত রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য The Meaning of History, Order and progress, Lectures on education, Byzantine History.

 

প্রাচ্য বা ভারতীয় দর্শন প্রধানতঃ দুই ভাগ—বৈদিক (ষড়্ দর্শন) ও
অবৈদিক (নাস্তিক দর্শন); দুইটিই এখানে সংক্ষেপে আলোচিত হইল।

ষড়্‌দর্শনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় : ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, পূর্ব মীমাংসা ও বেদান্ত (উত্তরমীমাংসা)—ভারতীয় দর্শনের এই ছয়টি দর্শনকে একত্র ষড়্‌দর্শন নামে অভিহিত করা হইয়া থাকে। এই ছয়টি দর্শনের প্রত্যেকটিই আস্তিক অর্থাৎ এগুলিতে বেদের প্রামান্য স্বীকৃত হইয়াছে।

(১) ন্যায় ও বৈশেষিক : ন্যায়দর্শন ও বৈশেষিক দর্শন এই উভয় দর্শনকে একত্রে ন্যায়-বৈশেষিক বলা হইয়া থাকে। ন্যায়দর্শনের প্রণেতা মহর্ষি গৌতম এবং বৈশেষিক দর্শনের প্রণেতা কণাদ।

ন্যায়দর্শনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গৌতম-প্রণীত ‘ন্যায়সূত্র’ এবং বৈশেষিক দর্শনের—কণাদের বৈশেষিক-সূত্র। বাৎস্যায়ন ন্যায়সূত্রের ভাষ্য রচনা করিয়াছেন (চতুর্থ শতক)। বৈশেষিক সূত্রের ব্যাখ্যা না করিয়াও প্রশস্তপাদ ভাষ্য রচনা করিয়াছেন (পঞ্চম শতক)। ইহা ব্যাতীত ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের প্রকরণ-গ্রন্থ হিসাবে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চাননের ‘ভাষা-পরিচ্ছেদ’ পাওয়া যায়। ন্যায়দর্শনকে ভিত্তি করিয়া রচিত উদয়নের ‘কুসুমাঞ্জলি’ অতি প্রাচীন এবং বিশেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

বৈশেষিক-দর্শন ন্যায়দর্শন অপেক্ষা প্রাচীন এবং এই দুইটি পৃথকরূপেই রচিত হইয়াছিল। কিন্তু উভয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এক হওয়ায় পরবর্তী কালে ইহারা একত্র আলোচিত হইয়াছে। এই দুইটি দর্শনই বস্তুতন্ত্রবাদী। আবার এই দুইটি দর্শনেই বহুতত্ত্ববাদ স্বীকৃত। বৈশেষিক দর্শনে সপ্ত পদার্থ এবং পরমাণুবাদের সাহায্যে সমগ্র জগৎসৃষ্টির ব্যাখ্যা করা হইয়াছে এবং ইহা ন্যায়দর্শনেও স্বীকৃত হইয়াছে।

ন্যায়দর্শনের বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রমাণভাগই ইহাতে মুখ্যস্থান লাভ করিয়াছে। ন্যায় ও বৈশেষিক এই উভয় দর্শনেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকৃত ও প্রমাণিত হইয়াছে। ‘ন্যায়’ অর্থে আমরা যুক্তিতর্ক বুঝিয়া থাকি। বিচার-বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে বলিয়া এই দর্শনের নাম ‘ন্যায়দর্শন’।

‘বৈশেষিক’ শব্দটি ‘বিশেষ’ হইতে উদ্ভুত। বিশেষ অর্থে নিত্যদ্রব্যসমূহের পরস্পর-ভেদক এক নিত্যপদার্থ বুঝায়। বৈশেষিক দর্শনে আমরা দেখিতে পাই, সমগ্র বিশ্বের মূল তত্ত্ব হিসাবে ঐক্য অপেক্ষা বৈচিত্র্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। ‘বিশেষ’ পদার্থ স্বীকার করা হয় বলিয়া এই দর্শনকে বৈশেষিক দর্শন বলা হয়।

(২) সাংখ্য ও যোগ : সাংখ্য দর্শনের প্রণেতা মহর্ষি কপিল এবং যোগদর্শনের প্রণেতা পতঞ্জলি। সাংখ্যদর্শনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘সাংখ্যকারিকা’ এবং কপিলের ‘সাংখ্যসূত্র’। যোগদর্শনের পতঞ্জলি-কৃত ‘যোগসূত্র’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইহা ব্যাতীত ব্যাস-কৃত ‘যোগ-ভাষ্য’ এবং বিজ্ঞানভিক্ষু-কৃত ‘যোগ-বার্তিক’, বাচস্পতি-কৃত ‘তত্ত্ববৈশারদী’ উল্লেখযোগ্য।

সাংখ্যদর্শনের নামকরণ সম্পর্কে বহুবিধ মত রহিয়াছে। কাহারও মতে ‘সংখ্যা শব্দের অর্থ ‘সম্যগ্ জ্ঞান’ , কাহারও মতে ইহাতে প্রকৃতির চতুর্বিংশতে ‘সংখ্যক তত্ত্ব রহিয়াছে বলিয়া ইহার ঐ নাম।

যোগ-দর্শনে অষ্ট যোগাঙ্গের সাহায্যে মোক্ষ বা সমাধি লাভের পন্থা বর্ণিত হইয়াছে। যোগসাধনার উপর প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে বলিয়া ইহাকে ‘যোগদর্শন’ বলা হইয়া থাকে।

সাংখ্য ও যোগ এই উভয় দর্শনেই দ্বৈতবাদ স্বীকৃত; পুরুষ-সহ পঞ্চ-বিংশতিতত্ত্ব-সাহায্যে জগতের সৃষ্টি ও প্রলয় ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। এই দর্শন দুইটির মধ্যে একমাত্র পার্থক্য—সাংখ্যদর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হন নাই, কিন্তু যোগদর্শনে জ্ঞানীগুরুরূপে ঈশ্বর স্বীকৃত। অপর বিষয়ে এই দুইটি দর্শন সদৃশ বলিয়া যোগদর্শনকে ‘সেশ্বর সাংখ্য’ নামেও অভিহিত করা হয়।

(৩) পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা : পূর্বমীমাংসাসূত্রের প্রণেতা জৈমিনি এবং উত্তরমীমাংসা বা বেদান্তসূত্রের প্রণেতা ব্যাসদেব। জৈমিনির মীমাংসা সূত্রের উপর শবরস্বামী ভাষ্য এবং ভাষ্যের উপর কুমারিল বার্তিক ও প্রভাকর বৃহতী টিকা প্রভৃতি রচনা করেন। আচার্য শঙ্কর রামানুজ প্রভৃতি ব্যাসের বেদান্তসূত্রের ভাষ্য রচনা করিয়াছেন।

মীমাংসা’ শব্দের অর্থ হইল সদ্‌বিচার ও সমস্যার সমাধান। পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা—এই উভয় দর্শনেই জাগতিক দুঃখসমূহের নিরসন করিবার উপায় আলোচিত হইয়াছে। এই উভয় দর্শনেই বেদের স্বতঃপ্রামাণ্য-প্রভাব বিশেষভাবে স্বীকৃত। কিন্তু পূর্বমীমাংসায় বেদের পূর্বভাগ কর্মকাণ্ড অর্থাৎ বেদবিহিত যাগযজ্ঞানুষ্ঠানের উপর প্রাধান্য আরোপিত হইয়াছে। প্রাচীন মীমাংসকগণ বলেন, বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান দ্বারা স্বর্গপ্রাপ্তি হয়, এবং পরবর্তীকালের মীমাংসকদের মত—নিষ্কাম কর্ম ও আত্মজ্ঞান দ্বারা মোক্ষলাভ ঘটে। বেদসমূহের পূর্বভাগ অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের উপর প্রাধান্য আরোপ করার জন্য এই মীমাংসাদর্শনে ‘পূর্বমীমাংসা’বলা হইয়া থাকে। অপর পক্ষে উত্তরমীমাংসাদর্শনে বেদের উত্তরভাগ বা জ্ঞানকাণ্ডকেই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে। আত্মানুভূতিই এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য। এই দর্শনকে ‘বেদান্তদর্শন’ বলা হইয়াছে, কারণ ইহা বেদের অন্তভাগ বা উপনিষদ। উপনিষদই বেদান্ত। আবার কাহারও মতে বেদের সারতত্ত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মের স্বরূপ বেদান্তদর্শনে আলোচিত হইয়াছে বলিয়াই ইহাকে ঐ নামে অভিহিত করা হয়।

মীমাংসা-দর্শনে বেদের প্রামাণ্য পূর্ণরূপে স্বীকৃত হইয়াছে। এই মতে বেদে অপৌরুষেয় ও নিত্য। মীমাংসা-দর্শনে বেদের কর্মকাণ্ডের অর্থবিচার করা হইয়াছে; বেদান্তে বেদের জ্ঞানকাণ্ডের অর্থ আলোচিত হইয়াছে।

বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য বলিয়া স্বীকৃত। জীব, জগৎ ও সৃষ্টিকে ব্রহ্মে অধিষ্ঠিত বলা হইয়াছে। এই মতে ব্রহ্মজ্ঞানলাভই মোক্ষলাভ।

অবৈদিক নাস্তিক দর্শন : চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ এই তিনটি দর্শন বেদ অস্বীকার করে, ইহারা বেদ-বিরোধী।

(১) চার্বাকদর্শন : লোকায়ত দর্শন নামেও পরিচিত—জড়বাদী ও দেহাত্মবাদী। কেহ কেহ ‘বৃহস্পতিসূত্র’কে এই দর্শনেরে মূল বলেন; ইহা পাওয়া যায় না, অন্যান্য গ্রন্থে কিছু কিছু উদ্ধৃতিমাত্র পাওয়া যায়। চার্বাক কোন ঋষির নাম কিনা সন্দেহ, ‘চারু বাক্ যস্য’ এই ভাবেই ‘চার্বাক’ শব্দ নিষ্পন্ন। ‘চর্ব্’ ধাতু হইতেও চর্বক বা চার্বাক শব্দ নিষ্পন্ন হয়।

এই দর্শন অনুসারে ইহজগতের উন্নতিই সব, সুখভোগই পরম-পুরুষার্থ; ‘দেহ-মন-ইন্দ্রিয়’-ব্যতিরিক্ত আত্মা এবং পরলোক অস্বীকৃত; প্রত্যক্ষ ব্যতীত অন্য কোন প্রমাণ নাই। আধুনিক জড়বাদিগণও অনেক দিক দিয়া এই ভাবেরই ভাবুক।

(২) জৈনদর্শন : ঋষভদের প্রভৃতি জিন-প্রবর্তিত, মহাবীর-প্রচারিত; ‘তত্ত্বাধিগমসূত্র’ মূল গ্রন্থ। জৈনদর্শনের উপর বহু গ্রন্থ রচিত হইয়াছে, এখনও পাওয়া যায়। জৈনদের দুই সম্প্রদায়—শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর।

জৈনদর্শনে আত্মা দেহাতিরিক্ত, কিন্তু সাবয়ব, দেহপরিমিত, সঙ্কোচ-বিকাশশীল; ঘাতী (পাপ) কর্ম দ্বারা শরীরে বদ্ধ হয়; পুণ্যকর্ম (সম্যক্‌ চরিত্র) দ্বারা মুক্ত হয়। মুক্তিতে আত্মার দেহবন্ধন চলিয়া যায় এবং অনাবরত ঊর্ধ্বলোকে গতি হয়।

(৩) বৌদ্ধদর্শন : তথাগত বুদ্ধ-কর্তৃক প্রচারিত, তাঁহার পূর্বেও বৌদ্ধমত ছিল; ‘ত্রিপিটক’ বৌদ্ধদের প্রধান গ্রন্থ। বৌদ্ধদর্শন প্রধান চারিটি মতে বিভক্ত—সৌত্রান্তিক, বৈভাষিক, যোগাচার ও মাধ্যমিক বা শূন্যবাদ। প্রথম তিন মতে আত্মা ক্ষণিকবিজ্ঞানস্বরূপ, শেষ মতে আত্মা শূন্য। মাধ্যমিক মতের সহিত অদ্বৈত-মতের কিছু কিছু সাদৃশ্য আছে। তবে অদ্বৈতমতে আত্মা সৎ।