১২. জ্ঞানযোগ-কথা(১-৯)

জ্ঞানযোগকথা

স্বামীজীর এই আলোচনাগুলি আমেরিকার মিস এস.ই.ওয়াল্ডো নাম্নী
তাঁহার শিষ্যা কর্তৃকলিপিবদ্ধ হয়। স্বামী সারদানন্দ যখন আমেরিকায় ছিলেন (১৮৯৮),
তখন উক্ত শিষ্যার নোটবুক হইতে তিনি এগুলি সংগ্রহ করেন।
তাঁহার কাগজপত্রের মধ্যেই এগুলি পাওয়া গিয়াছে।

ওঁ তৎ সৎ। ওঁকার তত্ত্ব জানাই জগৎ-রহস্য জানা। ভক্তিযোগ ও রাজ-যোগের মতো জ্ঞানযোগের লক্ষ্য একই, তবে সাধনপ্রণালী ভিন্ন। এই যোগ শক্তিমান্ সাধকদের জন্য, অষ্টাঙ্গিক যোগী বা ভক্তের জন্য নয়, যুক্তিনিষ্ঠের জন্য। শুদ্ধ প্রেম ও পরাভক্তি আশ্রয় করিয়া ভক্তিযোগী যেরূপ ভগবানের সহিত একত্ব লাভের পথে অগ্রসর হন , জ্ঞানযোগীও সেইরূপ শুদ্ধ বিচার সহায়ে পরমাত্মা লাভের পথ করিয়া লন। প্রাচীন যুগের যাবতীয় মূর্তির কল্পনা, সব পুরাতন ধর্মবিশ্বাস এবং কুসংস্কার মন হইতে দূর করিবা জন্য তাঁহাকে দৃঢ়চিত্ত হইতে হইবে। ইহামুত্রফলভোগ-কামনা ত্যাগ করিয়া মুক্তির জন্য দৃঢ়সংকল্প হইতে হইবে। জ্ঞান ব্যতীত মুক্তি আমাদের করতলগত হইবে না। স্বরূপ-উপলব্ধিই, আমরা যে জন্ম মৃত্যু ও ভীতির অতীত—এই উপলব্ধিই জ্ঞান। আত্মানুভূতিই পরম কল্যাণ—ইহা ইন্দ্রিয় ও চিন্তার অতীত অবস্থা। প্রকৃত ‘আমি’ ধারণাতীত। ইনি নিত্য জ্ঞাতা (eternal subject), কখনও জ্ঞানের বিষয় (object) হইতে পারেন না, কারণ জ্ঞান আপেক্ষিক বিষয় সম্বন্ধেই প্রযোজ্য, নিরপেক্ষ পুরুষ সম্বন্ধে নয়। সমুদয় ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান সীমাবদ্ধ, সীমাহীন কার্যকারণ-শৃঙ্খলার পরম্পরা মাত্র। আমাদের এই জগৎ ব্যাবহারিক সত্তা—বাস্তবের ছায়া; তবুও সুখ দুঃখ এই স্তরে প্রায় ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলিয়াছে বলিয়া এই পৃথিবীই একমাত্র স্থান, যেখানে মানব আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করিয়া ‘অহং ব্রহ্মস্মি’ জ্ঞান লাভ করিতে পারে।

এই জগৎ প্রকৃতির বিবর্তন, ঈশ্বরের ব্যক্ত অবস্থা, মায়া বা আপাত-প্রতীয়মান জগৎপ্রপঞ্চের আবরণে দৃষ্ট ব্রহ্ম বা নিরুপাধিক পুরুষের মানবীয় জ্ঞানগম্য ব্যাখ্যা মাত্র। এ জগৎ শূন্য নয়, ইহার কিছুটা সত্তা আছে; ব্রহ্ম আছেন বলিয়াই জগৎ প্রতীয়মান হয়।

জ্ঞাতার জ্ঞান কি প্রকারে হইবে? বেদান্ত বলেন—আমরাই সেই জ্ঞাতা; ইনি জ্ঞানের বিষয়ভূত নন, তাই আমরা কখনও ইঁহাকে জানিতে পারি না। আধুনিক বিজ্ঞানও এই কথা বলিতেছে। ইঁহাকে জানা যায় না। তবুও কখন কখন আমরা ইঁহার অস্তিত্বের আভাস পাইয়া থাকি। যখনই একবার এই জগৎস্বপ্ন ভাঙিয়া যায়, তখনই সেই অনুভূতি আমরা ফিরিয়া পাই। তখন আর জগৎ আমাদের চোখে সত্য নয়, আমরা জানিতে পারিব—ইহা মরীচিকা মাত্র। এই মায়া-মরীচিকার ওপারে যাওয়াই সকল ধর্মের লক্ষ্য। এই জীব ও ব্রহ্ম যে এক, সকল বেদ অহরহ এই কথা ঘোষণা করিতেছেন; কিন্তু অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই মায়ার আবরণ ভেদ করিয়া এই চরম সত্য উপলব্ধি করিবার অবস্থায় উপনীত হইতেছেন।

জ্ঞানলাভেচ্ছু ব্যক্তিকে সর্বপ্রথমে ভয় হইতে মুক্ত হইতে হইবে। ভয়ই আমাদের অন্যতম প্রবল শত্রু। তারপর কোন বিষয় সম্যক্ অবগত না হইয়া বিশ্বাস করিও না। সর্বদা বলো—’আমি শরীর নই, মন নই, চিন্তা নই, চেতনাও নই; আমি আত্মা।’ সব কিছু ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলে শেষে শুধু আত্মাই অবশিষ্ট থাকিবেন। জ্ঞানীর ধ্যান দুই প্রকার : (১) আমরা যাহা নই, সেই ভাব অস্বীকার করা, সেই ভাব মন হইতে দূর করিয়া দেওয়া। (২) আমাদের প্রকৃত স্বরূপ ‘আত্মা এক পরমাত্মা, সচ্চিদানন্দ—দৃঢ়তাসহ এই কথা বলা। যথার্থ বিচরমার্গী নির্ভয়ে অগ্রসর হইয়া বিচারের চরম সীমায় উপনীত হইবেন। পথে কোথাও থামিলে চলিবে না, ‘নেতি’-বিচারপ্রণালী অবলম্বন করিলে সব কিছুই দূর হইবে; অবশেষে যাহা অপরিহার্য, যাহা আর অস্বীকার করা যায় না, সেই প্রকৃত ‘আমি’ বা আত্মায় আমরা উপনীত হইব। এই ‘আমি’ জগতের সাক্ষী—অব্যয়, সনাতন, অসীম। অজ্ঞানের মেঘাবরণ স্তরে স্তরে এই আত্মাকে ঢাকিয়া রাখে, আমরা দেখিতে পাই না, আত্মা কিন্তু সর্বদা সমভাবে বিরাজমান।

দুইটি পাখি একই গাছের বিভিন্ন শাখায় উপবিষ্ট। উপরের শাখার পাখিটি ধীর স্থির মহিমময় সুশোভন ও পূর্ণস্বভাব। নিচের শাখার পাখিটি মিষ্টফল খাইয়া কখন হৃষ্ট, আবার তিক্তফল আস্বাদন করিয়া কখন বা বিষন্ন; এইরূপে সে শাখা হইতে শাখান্তরে বিচরণ করিতেছে। একদিন নিয়মিত আস্বদিত ফল অপেক্ষা অতি তিক্ত একটি ফল ভক্ষণ করিয়া সে উপরের শান্ত শোভাময় পাখিটির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া চিন্তা করিল, ‘হায়! আমার প্রাণের আকাঙ্ক্ষা ঐ পাখির মতো হই।’ তারপর কয়েক ধাপ উপরে তাহার দিকে অগ্রসর হইল। শীঘ্রই আবার ঐ পাখিটির মতো হইবার বাসনা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া পুনরায় মিষ্ট ও তিক্ত ফলের আস্বাদনে তুষ্ট ও রুষ্ট মনোভাব লইয়া পূর্বের মতো বিচরণ করিতে লাগিল। আবার ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করিল, আবার শান্ত স্নিগ্ধ মহিমামণ্ডিত উপরের পাখিটির দিকে কয়েকধাপ অগ্রসর হইল। এইরূপ ব্যাপার বহুবার সংঘটিত হইলে অবশেষে উপরের পাখিটির সান্নিধ্য লাভ করিয়া সে দেখিল, উহার পক্ষজ্যোতি তাহার চোখ ধাঁধাইয়া তাহাকে আত্মভূত করিয়া ফেলিয়াছে। পরিশেষে দেখিতে পাইল, কি আশ্চর্য! কেবল একটি পাখিই সেখানে রহিয়াছে— সে নিজেও তো চিরকালই ঐ উপরের পাখি; তবে এই মাত্র এ সত্য সে বুঝিতে পারিল।

মানুষও ঐ নিম্নশাখাবিহারী পক্ষিতুল্য, কিন্তু সর্বোচ্চ আদর্শে উপনীত হইবার জন্য সচেষ্ট হইলে সেও বুঝিতে পারিবে, সেও সর্বদাই সেই আত্মা-রূপেই ছিল, আত্মা ছাড়া যাহা কিছু, সবই স্বপ্ন মাত্র। এই জড় ও জড়ের সত্যতায় বিশ্বাস হইতে নিজেদের একেবারে পৃথক্ করিয়া ফেলাই প্রকৃত জ্ঞান। ওঁ তৎ সৎ—’ওঁ’ই একমাত্র প্রকৃত সত্তা, জ্ঞানী সর্বদা ইহা মনে জাগরূক রাখিবেন। নিরপেক্ষ একত্বই জ্ঞানযোগের ভিত্তি। ইহা দ্বৈতভাব-শূন্য অদ্বৈতবাদ। ইহাই বেদান্তদর্শন-সৌধের ভিত্তিপ্রস্তার, বেদান্তের আদি ও অন্ত। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য বস্তু, আর সব মিথ্যা। ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’—অহরহ এই বাক্য উচ্চারণ করিতে করিতে উহাকে আমাদের স্বভাবের অঙ্গীভূত করিয়া ফেলিতে হইবে। কেবল এই উপায়েই সকল দ্বৈতভাব , ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-নিরানন্দ অতিক্রম করিয়া এক অদ্বিতীয় সনাতন অব্যয় অসীম ও ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্-‘রূপে নিজেকে উপলব্ধি করিতে আমরা সমর্থ হইব।

জ্ঞানযোগীকে সঙ্কীর্ণতম সাম্প্রদায়িকের মতো একাগ্র, আবার আকাশের মতো উদার হইতে হইবে; সম্পূর্ণভাবে চিত্ত সংযত করিয়া বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান হইবার সামর্থ্য অর্জন করিতে হইবে; আর স্বেচ্ছায় এইসব বিভিন্ন ধর্মাভাবের মধ্যে নিজেকে ছড়াইয়া দিয়াও চিরন্তন সমন্বয়ের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা রাখিতে হইবে। নিয়ত অভ্যাস দ্বারাই এই সংযম অর্জিত হইতে পারে। এক হইতেই সকল বৈচিত্র্য উদ্ভূত, কিন্তু কর্মের সহিত আমরা যাহাতে নিজেদের এক করিয়া না ফেলি, আমাদের সেই শিক্ষা লাভ করিতে হইবে। আর সম্মুখে উপস্থিত বস্তু ছাড়া অন্য বস্তু দেখিবার, শুনিবার বা আলোচনা করিবার প্রবৃত্তি যেন আমাদের না থাকে। সমস্ত মনপ্রাণ অর্পণ করিয়া আমাদিগকে একাগ্র হইতে হইবে। দিনরাত্রি নিজেকে বলো—’সোহহং, সোহহং’।

 

বেদান্তদর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা শঙ্করাচার্য। তিনি অকাট্য যুক্তিসহায়ে বেদের সারসত্যগুলি সংগ্রহ করিয়া অপূর্ব জ্ঞানশাস্ত্র রচনা করিয়াছেন, যাহা তাঁহার ভাষ্যের মাধ্যমে শিক্ষণীয়। ব্রহ্মনির্দেশক পরস্পবিরুদ্ধ বাক্যাবলী গ্রথিত করিয়া দেখাইয়াছেন, একমাত্র সেই নির্বিশেষ সত্তাই আছেন।আরও দেখাইয়াছেন , যেমন খাড়াই পথে অগ্রগতি ধীরে-ধীরেই সম্ভব, তেমনি মানসিক ধারণাশক্তির তারতম্য অনুসারে ব্রহ্মনির্দেশক বৈচিত্র্যও অতি আবশ্যক। খ্রীষ্ট তাঁহার শ্রোতাদের যোগ্যতা অনুসারে যে-উপদেশ দিয়াছেন, তাহা কতকটা ইহারই অনুরূপ। প্রথমতঃ তিনি স্বর্গে আসীন ঈশ্বরকে প্রার্থনা জানাইবার উপদেশ দেন। তারপর একধাপ ঊর্ধ্বে উঠিয়া বলেন, ‘আমি দ্রাক্ষালতা; তোমরা শাখা প্রশাখা!’ পরিশেষে চরম সত্য প্রচার করিয়া বলেন, ‘আমিও আমার পিতা এক’, ‘স্বর্গরাজ্য তোমাদের অন্তরেই অবস্থিত।’ শঙ্করাচার্য শিক্ষা দেন : দেবতার শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ তিনটি—(১) মনুষ্যদেহ, (২) ঈশ্বরলাভের ইচ্ছা এবং (৩) জ্ঞানের আলোক দিতে সমর্থ আচার্য। এই তিন বস্তু লাভ করিতে পারিলে মুক্তি আমাদের করতলগত। একমাত্র জ্ঞানই আমাদের মুক্তি দিতে পারে, কিন্তু জ্ঞনোদয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ধর্মগুলি তিরোহিত হইবে।

এক অদ্বিতীয় সত্তাই জগতে বিদ্যমান, প্রত্যেক জীবই সেই পূর্ণ সত্তা, শুধু অংশ নয়—ইহাই বেদান্তের সারমর্ম। প্রতিটি শিশির-কণাতে সূর্য পূর্ণরূপে প্রতিবিম্বিত। ‘দেশ-কাল নিমিত্ত’-আশ্রয়ে সেই সত্তাই মনুষ্যরূপে প্রকাশিত, কিন্তু দৃশ্যজগতের অন্তরালে এক চরম তত্ত্ব বিরাজমান। নিঃস্বার্থতার ভাব দৃঢ় হইলেই কাঁচা ‘আমি’ মন হইতে চলিয়া যায়। আমরা দেহ—এই দুঃখকর স্বপ্ন হইতে মুক্ত হইতে হইবে। ‘আমি ব্রহ্ম’—এই সত্য জানিতে হইবে। আমরা প্রত্যেকেই পূর্ণ অনন্ত মহাসমুদ্র; জলবিন্দু নই যে সাগরে মিশিয়া অস্তিত্ব হারাইব। মায়া বন্ধন হইতে মুক্ত হইলেই এই পূর্ণত্ব ও অসীমত্বের জ্ঞান লাভ করিব। অসীমকে ভাগ করা যায় না, ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’-এর দ্বিতীয় কিছুই নাই, সবই সেই এক ব্রহ্ম। এই জ্ঞান সকলেই লাভ করিবে, কিন্তু এই জীবনেই ঐ জ্ঞানলাভের জন্য আমাদিগকে প্রাণপণ চেষ্টা করিতে হইবে কারণ ঐ জ্ঞান লাভ না করিলে আমরা মনুষ্যজাতির শ্রেষ্ঠ হিতসাধনে সমর্থ হইব না। জীবন্মুক্তই কেবল যথার্থ প্রেম ও প্রকৃত সত্য বিতরণ করিতে—যথার্থ দান করিতে সমর্থ; এবং সত্যই মুক্তি দিতে পারে। বাসনা আমাদিগকে ক্রীতদাসে পরিনত করে। এই বাসনা এক অতৃপ্ত দানব; ইহার কবলে যাহারা পড়ে, তাহাদের শান্তি নাই; কিন্তু জীবন্মুক্ত অদ্বৈত জ্ঞান লাভ করিয়া সব বাসনা জয় করিয়াছেন, তাঁহার কাম্য আর কিছুই নাই।

দেহ, স্ত্রী-পুরুষ-জ্ঞান, জাতি, বর্ণ বন্ধন—এই সব মোহ মনই আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করে, সুতরাং সত্যের অনুভূতি না হওয়া পর্যন্ত মনকে অহরহ এই সত্য বলিতে হইবে : আমরা আনন্দস্বরূপ; যাহা কিছু সুখ অনুভব করিয়া থাকি, তাহা এই আনন্দেরই আভাস; প্রকৃত স্বরূপের সংস্পর্শেই এই কণামাত্র সুখ আমরা লাভ করিয়া থাকি। সেই ব্রহ্ম সুখদুঃখের অতীত, তিনি জগতের সাক্ষিস্বরূপ, জীবনগ্রন্থের অপরিবর্তনীয় পাঠক; তাঁহার তাঁহার জীবনগ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলি একে একে খুলিয়া যাইতেছে।

অভ্যাস হইতে যোগ, যোগ হইতে জ্ঞান, জ্ঞান হইতে প্রেম, প্রেম হইতে আনন্দের উৎপত্তি।

‘আমি ও আমার’ একটি কুসংস্কার; ইহার বেষ্টনে আমরা এত দীর্ঘকাল রহিয়াছি যে, ইহাকে ত্যাগ করা একরূপ অসম্ভব। তবুও অতি উচ্চ অবস্থা লাভ করিতে হইলে এই কুসংস্কার ত্যাগ করিতেই হইবে। আমাদিগকে আনন্দময় ও প্রফুল্ল হইতে হইবে। অপ্রসন্ন মুখভাব লইয়া ধর্মলাভ হয় না। সর্বোৎকৃষ্ট বলিয়া যাবতীয় পার্থিব বস্তু অপেক্ষা ধর্ম অনেক বেশী আনন্দপ্রদ। কঠোর তপশ্চর্যা আমাদিগকে পবিত্র করিতে পারে না। ঈশ্বরপ্রেমিক ও পবিত্রত্মা কেন বিষণ্ণ হইবেন? তিনি হইবেন আনন্দময় শিশুর মতো প্রকৃত ঈশ্বর-সন্তান। অন্তঃকরণকে শুদ্ধ করাই ধর্মের সার; স্বর্গরাজ্য আমাদের অন্তরে, কিন্তু বিশুদ্ধত্মাই সে রাজাধিরাজ-দর্শনের অধিকারী। জগতের চিন্তা করিলে জগৎই থাকিয়া যায়; তিনিই জগৎরূপে প্রকাশিত—এইভাবে চিন্তা করিলে আমরা ঈশ্বরকে লাভ করিব। পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, স্বামী-স্ত্রী, শত্রু-মিত্র, ব্যক্তি বা বস্তু—সকলের উপরেই এই ঈশ্বরভাব আরোপ করিতে হইবে। যদি আমরা জ্ঞানতঃ এই জগৎকে ঈশ্বরময় দেখি—তাঁহাকে ছাড়া আর কিছু অনুভব না করি, ভাবিয়া দেখ, তাহা হইলে এই জগৎ আমাদের চক্ষে কত পৃথকরূপে প্রতিভাত হইবে—তখনই আমাদের সকল দুঃখ, সকল সংগ্রাম সকল যন্ত্রণার চিরতরে অবসান হইবে।

জ্ঞান সাম্প্রদায়িক ধর্মবিশ্বসের ঊর্ধ্বে, তাই বলিয়া জ্ঞান ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়। জ্ঞানলাভ বলিতে বুঝায়, ধর্মমতের ঊর্ধ্বে এক উন্নত অবস্থা লাভ। জ্ঞানী ধ্বংস চান না, পরন্তু সকলকে সাহায্য করিতে চান। নদীর জল যেমন সাগরে মিশিয়া এক হইয়া যায়, যাবতীয় ধর্মও তেমনি জ্ঞানে মিশিয়া একাকার হইয়া যায়।

সকল বস্তুর সত্তাই ব্রহ্মসাপেক্ষ। বাস্তবিকপক্ষে এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইলেই বুঝিতে পারিব, যথার্থ সত্য আমরা কিছু পরিমাণে উপলব্ধি করিয়াছি। বৈষম্য-দৃষ্টি যখন সম্পূর্ণরূপে চলিয়া যাবে, তখনই বোধ হইবে—’আমি ও জগৎ-পিতা অভিন্ন’।

ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ অতি সুন্দর জ্ঞানের উপদেশ দিয়াছেন। এই মহৎ কাব্যগ্রন্থ ভারতীয় সাহিত্যরত্নরাজির চূড়ামণিরূপে পরিগণিত। ইহা বেদের ভাষ্যস্বরূপ। গীতা স্পষ্ট বুঝাইয়া দিতেছেন, এই জীবনেই আধ্যাত্মিক সংগ্রামে আমাদিগকে জয়ী হইতে হইবে। সংগ্রামে পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করিয়া সবটুকু আধ্যাত্মিকতাই গ্রহণ করিতে হইবে। গীতা উচ্চতর জীবন-সংগ্রামের রূপক বলিয়া যুদ্ধক্ষেত্রই গীতা-বর্ণনার স্থলরূপে নির্দিষ্ট। ইহাতে অতি উচ্চাঙ্গের কবিত্ব প্রকাশিত হইয়াছে। বিরুদ্ধ যুযুৎ সুদলের অন্যতম নায়ক অর্জুনের সারথি-বেশে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিষণ্ণ না হইতে এবং মৃত্যুভয় ত্যাগ করিতে উদ্বদ্ধ করিতেছেন; কারণ তিনি তো জানিতেন—তিনি অবিনাশী, আর পরিবর্তনশীল যাহা কিছু, সবই মনুষ্যের প্রকৃত স্বরূপের বিরোধী। অধ্যায়ের পর অধ্যায় ধরিয়া শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অতি উচ্চ দার্শনিক তত্ত্ব শিক্ষা দিতেছেন। এই-সকল উপদেশই গীতাকে পরমাশ্চর্য কাব্যগ্রন্থে পরিণত করিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র বেদান্তদর্শনই গীতায় নিবদ্ধ। বেদের শিক্ষা এই যে, আত্মা অবিনাশী, দেহের মৃত্যুতে আত্মা কোনরূপেই বিকৃত হন না। বৃত্তরূপ আত্মার পরিধি কোথাও নাই, কেন্দ্র জীবদেহে। তথাকথিত মৃত্যু এই কেন্দ্রের পরিবর্তন মাত্র। ঈশ্বর একটি বৃত্ত, এই বৃত্তের পরিধি কোথাও নাই, কিন্তু কেন্দ্র সর্বত্র। যখনই আমরা এই সঙ্কীর্ণ দেহরূপ কেন্দ্র হইতে বাহিরে যাইতে পারি, তখনই আমাদের প্রকৃত স্বরূপ—এই ঈশ্বর উপলব্ধ হন।

বর্তমানকাল অতীত ও ভবিষ্যতের সীমারেখা ভেদ-পরিচায়ক রেখামাত্র, সুতরাং অতীত ও ভবিষ্যত হইতে বর্তমানের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই বলিয়া কেবল বর্তমানই গ্রাহ্য—এ-কথা নির্বিচারে বলিতে পারি না। এই তিন কালই একত্র মিলিয়া এক অখণ্ড সমষ্টি। সময় সম্বন্ধে আমাদের ধারণা এই যে, উহা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির পরিণতির তারতম্য অনুসারে আরোপিত একটি অবস্থা মাত্র।

 

জ্ঞানের শিক্ষা এই যে, সংসার ছাড়িবে; কিন্তু তাই বলিয়া সংসার ত্যাগ করিয়া অন্যত্র প্রস্থান করিবে না। সন্ন্যাসী সংসারে থাকিবেন বটে, কিন্তু সংসারের হইবেন না—তাঁহার সম্বন্ধে এটিই চরম পরীক্ষা। এইরূপ ত্যাগের ধারণা যে-কোন আকারেই হউক, সকল ধর্মেই স্থান পাইয়াছে। আমাদের নিকট জ্ঞানের দাবি এই যে, আমরা শুধু ‘সমত্ব’ দেখিব, সমদর্শী হইব। নিন্দা-স্তুতি, ভাল-মন্দ, এমনকি শীত-উষ্ণও তুল্যরূপে আমাদিগকে গ্রহণ করিতে হইবে। ভারতে এমন অনেক সাধু আছেন, যাঁহাদের দ্বন্দ্বাতীত এই সাম্যভাব বর্ণে বর্ণে সত্য। সম্পূর্ণ অনাবৃতদেহ ও আপাততঃ একেবারে শীত-উষ্ণ বৈষম্য-বোধহীন অবস্থায় তুষারমণ্ডিত তুঙ্গ হিমালয়-শৃঙ্গে অথবা উত্তপ্ত মরুভূমিতে তাঁহারা ভ্রমন করিয়া থাকেন।

আমরা ‘দেহ নই’—দেহ সম্বন্ধে ভ্রান্ত সংস্কার সর্বগ্রে ত্যাগ করিতে হইবে। তারপর ‘মন নই’—মনের সংস্কারও ছাড়িতে হইবে। আমরা মন নই; এই মন ‘রেশমের মতো সূক্ষ্ম’ শরীর মাত্র, আত্মার কোন অংশ নয়। প্রায় সকল পর্দার্থ সম্বন্ধে প্রযোজ্য এই ‘body’ শব্দটি দ্বারা সব কিছুরই একটি সাধারণ নাম বুঝায়। ইহাই অস্তিত্ব। এই দেহ উহার অন্তরালে অবস্থিত চিন্তারই প্রতীক; আবার চিন্তাগুলি স্বয়ং পর্যায়ক্রমে দেহের পশ্চাতে অবস্থিত কোন কিছুরই প্রতীক। সেই কোন কিছুই পারমার্থিক সত্তা, আমাদের আত্মার আত্মা, বিশ্বাত্মা, প্রাণের প্রাণ, আমাদের যথার্থ স্বরূপ। যতদিন পর্যন্ত ঈশ্বর হইতে আমাদের অণুমাত্র পৃথক্ অস্তিত্ব-জ্ঞান থাকিবে, ততদিন ভয় থাকিবে। আবার ঈশ্বরের সহিত একত্ববোধ হইলেই ভয় দূর হইবে। কিসের ভয়? কেবল ইচ্ছাশক্তি-সহায়ে জ্ঞানী দেহমনের অতীত অবস্থা লাভ করিয়া এই বিশ্বকে শূন্যমাত্রে পরিণত করেন। এইরূপে অবিদ্যা নাশ করিয়া তিনি তাঁহার যথার্থ স্বরূপ আত্মাকে জানেন। সুখদুঃখ শুধু ইন্দ্রিয়জনিত, এগুলি আমাদের প্রকৃত স্বরূপকে স্পর্শ করিতে পারে না। আত্মা দেশ-কাল-নিমিত্বের অতীত, সেই হেতু অপরিচ্ছন্ন ও সর্বত্র বিরাজমান।

জ্ঞানী সমস্ত বিধি-নিষেধের গণ্ডির বাহিরে গিয়া, স্মৃতির অনুশাসন ও ধর্মশাস্ত্রের অতীত হইয়া নিজেই নিজের শাস্ত্র হইবেন। বিধি-নিষেধের মধ্যে আমরা জড়ীভূত হইয়া মৃত্যু বরণ করি। তবুও যাহারা শাস্ত্রবিধি অতিক্রম করিতে অসমর্থ, জ্ঞানী তাহাদের দোষ দর্শণ করিবেন না; এমন কি ‘আমি তোমা অপেক্ষা পবিত্র’ অন্যের সম্বন্ধে জ্ঞানী কখন এরূপ মনে করিবেন না।

এইগুলি প্রকৃত জ্ঞানযোগীর লক্ষণ : (১) জ্ঞানী জ্ঞান ব্যতীত আর কিছুই আকাঙ্ক্ষা করেন না। (২) তাঁহার সকল ইন্দ্রিয় সম্পূর্ণ বশীভূত। উন্মুক্ত আকাশতলে অনাবৃত ধরাই তাহার শয্যা হউক বা রাজপ্রাসাদেই তিনি অবস্থান করুন, উভয় অবস্থাতেই তুল্য সুখী হইয়া, অসন্তোষ প্রকাশ না করিয়া সব কিছুই তিনি সমভাবে ভোগ করিয়া থাকেন। যেহেতু আত্ম-ব্যতিরিক্ত সব কিছু হইতেই তিনি মন উঠাইয়া লইয়াছেন, সেইজন্য দুঃখকষ্টের হাত এড়াইবার চেষ্টা না করিয়া সেগুলির সম্মুখীন হইয়াই দুঃখকষ্ট সহ্য করেন। (৩) জ্ঞানী বুঝিয়াছেন—এক ব্রহ্ম ছাড়া সবই অনিত্য। (৪) মুক্তিলাভের জন্য তাঁহার তীব্র আকাঙ্ক্ষা বর্তমান। প্রবল ইচ্ছাশক্তি-সহায়ে মনকে উচ্চ বিষয়ে নিবিষ্ট করিয়া তিনি শান্তির অধিকারী হন। শান্তি লাভ করিতে না পারিলে আমরা পশু অপেক্ষা বেশী উন্নত নই। সর্বকর্মফল বিসর্জনপূর্বক ইহকাল বা পরকালের ফলকাঙ্ক্ষারহিত হইয়া জ্ঞানী পরার্থে ও ঈশ্বরার্থে কর্ম সম্পাদন করেন। আত্মজ্ঞান ব্যতীত জগৎ আমাদিগকে আর কি দিতে পারে? আত্মজ্ঞান-লাভ হইলেই সকল প্রয়োজন সিদ্ধ হইল। বেদের শিক্ষা এই যে, আত্মা এক অখন্ড সত্তা। আমরা জানি , এই আত্মা—মন, স্মৃতি, চিন্তা, এমন কি চেতনারও অতীত। সকলই আত্মপ্রসূত। আত্মারই মধ্য দিয়া অথবা আত্মা আছেন বলিয়াই আমরা দেখি, শুনি, অনুভব করি এবং চিন্তা করি। এই ওঁ—এই অদ্বিতীয় সত্তার সহিত একত্ব-উপলব্ধিই জীবজগতের লক্ষ্য। জ্ঞানীকে সকল ধর্মীয় মতবাদ হইতে মুক্ত থাকিতে হইবে; তিনি হিন্দু বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান কিছুই নন, কিন্তু তিনি একাধারে এই তিন। জ্ঞানী সর্বকর্ম পরিত্যাগ করেন, তিনি ঈশ্বরে শরণাগত; জ্ঞানীকে কর্ম আর বদ্ধ করিতে পারে না। জ্ঞানী কঠোর বিচারবাদী, ‘নেতি’বিচার-সহায়ে তিনি সবই অস্বীকার করেন। তিনি দিবারাত্রি মনে মনে বলেন, ‘ধর্মবিশ্বাস নাই, মন্ত্রতন্ত্র নাই, স্বর্গ-নরক নাই , ধর্মমত নাই , মন্দির নাই-কেবল আত্মাই বর্তমান ‘ সর্ব বস্তু পরিহার করিয়া যে অপরিহার্য পরমতত্ত্ব লাভ হয়, তাহাই আত্মা। সমস্ত ব্যাবহারিক ও সম্বন্ধমূলক ভাবের বিলোপ-অবস্থা,—সেই নির্বাণ-অবস্থা লাভ না হওয়া পর্যন্ত জ্ঞানী কিছুরই অস্তিত্ব স্বীকার না করিয়া শুদ্ধ বিচার ও ইচ্ছাশক্তি দ্বারা সমস্ত বিশ্লেষণ করিয়া থাকেন। এই অবস্থার বর্ণনা বা ধারণাও অসম্ভব। কোন পার্থিব ফলের দ্বারাই জ্ঞানের বিচার হয় না। শকুনি যেমন শূন্যে বহু ঊর্ধ্বে উঠিয়া অদৃশ্য হইলেও সামান্য গলিত দেহ দেখিয়া সবেগে নামিয়া আসিতে সর্বদা উন্মুখ , তেমন হইও না। স্বাস্থ্য বা পরমায়ু বা সম্পদ—কিছুই চাহিও না, কেবল মুক্তিকামী হও। আমরা সচ্চিদানন্দ। সৎ বা অস্তিভাব জগতের শেষ বস্তুনির্দেশক ব্যাপার। তাহাই আমাদের অস্তিত্ব, তাহাই আমাদের জ্ঞান। আর আনন্দ অস্তিত্বের অবিমিশ্র স্বাভাবিক ফল। কখন কখন মুহূর্তের জন্য আমরা সেই পরমানন্দ অনুভব করি; সেই সময় আনন্দ ছাড়া আমরা কিছুই চাহি না, কিছুই দিই না, এবং কিছুই জানি না। তারপর এ আনন্দ অন্তর্হিত হয়, আবার জগতের সমগ্র দৃশ্য চক্ষের সম্মুখে চলিতে থাকে এবং আমরা জানি , এই বিশ্বছবি সর্বাশ্রয় ঈশ্বরেরই উপর বিন্যস্ত শিল্পরচনা মাত্র।’ সংসারে ফিরিয়া আসিলেই দেখিতে পাই—সেই পারমার্থিক সত্তাই ব্যাবহারিক সত্তারূপে প্রতিভাত হইয়াছেন, দেখি—সচ্চিদানন্দকে ‘পিতা, পুত্র ও পবিত্রাত্মা’ এই ত্রিমূর্তিরূপে। সৎ অর্থাৎ সৃজনীশক্তি, চিৎ—পরিচালিকাশক্তি, আনন্দ—আত্মানুভবশক্তি; এই শক্তিই আবার আমাদিগকে সেই এক ব্রহ্মের সহিত যুক্ত করে। জ্ঞান বা চিৎ ব্যতীত ‘সৎ’কে কেহ উপলব্ধি করিতে পারে না। এজন্যই খ্রীষ্টের কথার শক্তি : ‘পুত্রের ভিতর দিয়া ব্যতীত কেহ পরমপিতাকে দর্শন করিতে পারে না।’ বেদান্তের শিক্ষা এই যে, ইহলোকেই এবং এই দেহেই নির্বাণ লাভ করা যায়, নির্বাণ লাভ করিবার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত প্রতীক্ষার প্রয়োজন নাই। নির্বাণ অর্থ আত্মানুভূতি। এক মুহূর্তের জন্যও আত্মানুভূতি লাভ হইলে ব্যক্তিত্ব-ভাবের মরীচিকা দ্বারা আর মুগ্ধ হইতে হইবে না। জগৎ প্রপঞ্চ—চক্ষুযুক্ত আমাদের দৃষ্টিতে পড়িবে, কিন্তু এই জগৎ-রচনার কারণ অবগত হইলেই ইহার যথার্থ প্রকৃতি বুঝিতে পারা যায়। এই জগৎ-রূপ আবরণই অবিকারী আত্মাকে আবৃত রাখিয়াছে। এই আবরণ অপসারিত হইলেই আত্মদর্শণ হয়। পরিবর্তন যাহা কিছু তাহা এই আবরণেই সংঘটিত হয়, আত্মায় নয়। সাধুর নিকট এই আবরণ অতি সূক্ষ্ম, ইহার ভিতর দিয়া বাস্তব সত্তা প্রায় প্রকশিত হইতে পারে, কিন্তু পাপীর নিকট এই আবরণ অতি স্থূল, সুতরাং পাপীর মধ্যে যে আত্মা রহিয়াছেন, তাহা দেখি না এবং সাধুর মধ্যে যে আত্মা আছেন—এই সত্যও সহসা অনুধাবন করিতে পারা যায় না।

একত্বে উপনীত হইলেই সব বিচার সমাপ্ত হয়, সুতরা়ং আমরা প্রথমতঃ বিশ্লেষণ, তারপর সমন্বয় অবলম্বন করিয়া থাকি। বিজ্ঞানের রাজ্যে দেখা যায় একটি অন্তর্নিহিত প্রাকৃতিক শক্তির অনুসন্ধানে বিক্ষিপ্ত শক্তিগুলি ক্রমশঃ সীমাবদ্ধ হয়। চরম একত্বকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করিতে পারিলেই জড়বিজ্ঞান লক্ষে উপনীত হয়। একত্বে পৌঁছিলেই আমাদের বিশ্রাম। জ্ঞানই চরম অবস্থা।

সকল বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ ধর্ম্মবিজ্ঞান বহুপূর্বেই সেই একত্ব আবিষ্কার করিয়াছে, সেই অদ্বৈত-তত্ত্বে উপনীত হওয়াই জ্ঞানযোগের লক্ষ্য। বিশ্বময় একই পরমাত্মা বিরাজ করিতেছেন, ক্ষুদ্র জীবত্মাগুলি তাঁহারই অভিব্যক্তি মাত্র। অতএব পরমাত্মা তাঁহার অভিব্যক্তিগুলি অপেক্ষা অনন্তগুণে বৃহৎ। সবই পরমাত্মা বা ব্রহ্ম। সাধু, পাপী, মেষ, ব্যঘ্র—এমন কি হত্যাকারী পর্যন্ত পরমার্থের দিক দিয়া ব্রহ্ম ভিন্ন আর কিছুই নয়, যেহেতু ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নাই। ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—এক সৎ বস্তুই বিদ্যমান, ঋষিগণ তাঁহাকে বিভিন্নভাবে অভিহিত করিয়াছেন। এই জ্ঞান ব্যতীত উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই, এবং যোগদ্বারা বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তিতেই এই জ্ঞানের আলোক উদ্ভাসিত হয়। যিনি যত বেশী এই যোগ ও ধ্যানের দ্বারা বিশুদ্ধ ও যোগ্য হইয়াছেন, আত্মানুভূতির আলোক তাঁহার নিকট তত বেশী পরিস্ফুট। এই উৎকৃষ্ট জ্ঞান চারি সহস্র বর্ষ পূর্বে আবিষ্কৃত হইয়াছে, কিন্তু অতি অল্প কয়েকজনেরই অধিকারে আসিয়াছে; এখনও ইহা জাতীয় সম্পত্তিরূপে পরিণত হইতে পারে নাই।

 

তথাকথিত মনুষ্যনামধারী সকল ব্যক্তিই প্রকৃত ‘মানুষ’ আখ্যার যোগ্য নয়। প্রত্যেকেই নিজের মন দ্বারা এই জগৎকে বিচার করিয়া থাকে। জগৎ সম্বন্ধে উচ্চতর ধারণা অত্যন্ত কঠিন। অধিকাংশ ব্যক্তির নিকটই তত্ত্ব অপেক্ষা জাগতিক বস্তু বেশী গ্রাহ্য। দৃষ্টান্তরূপে বোম্বাই-এর দুইব্যাক্তি সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। তাঁহাদের মধ্যে একজন হিন্দু, অপরজন জৈন। ঐ নগরের এক ধনীর গৃহে বসিয়া উভয়েই শতরঞ্চ খেলিতেছিলেন। বাড়িটি সমুদ্রের ধারে। খেলাও বহুক্ষণ ধরিয়া চলিতেছে। যেখানে বসিয়া তাঁহারা খেলিতেছিলেন, তাহার নিচে সমুদ্রের জোয়ার ভাঁটা তাঁহাদের দৃষ্টি আকর্ষন করিলে তাঁহাদের মধ্যে একজন জোয়ার-ভাঁটাকে পৌরাণিকভাবে ব্যাখ্যা করিয়া বলিলেন, ‘দেবতারা এই জল একটা গর্তের মধ্যে ফেলিয়া সেখান হইতে আবার ঢালিয়া ফেলিতেছেন। বারবার এইরূপ ঢালাঢালি করিয়া তাঁহারা খেলা করিতেছেন।’ অন্য ব্যক্তি বলিলেন, ‘না, তাহা নয়, এই জল ব্যবহারের উপযোগী করিবার জন্য একটা পর্বতের উপর শোষণ করিয়া তুলিয়া লইয়া আবার ঢালিয়া ফেলিতেছেন।’ সেখানে একটি যুবক ছাত্র ছিল, সে বিদ্রুপ করিয়া বলিল, ‘আপনারা কি জানেন না চন্দ্রের আকর্ষণে এই জোয়ার-ভাঁটা হয়? ইহা শুনিয়া ভদ্রলোক দুইজন ক্রুদ্ধ হইয়া তাহার দিকে ফিরিয়া জানিতে চাহিলেন-সে কি মনে করে যে , তাঁহারা দুইজনেই নির্বোধ, সে কি মনে করে যে, তাঁহারা দুইজনেই নির্বোধ, সে কি মনে করে যে, তাঁহারা বিশ্বাস করিবেন চন্দ্র রজ্জু দ্বারা জোয়ার আকর্ষণ করিয়া থাকেন, আর উহা এত দূরবর্তী চন্দ্রের নিকটে যায়। এরূপ বাজে ব্যাখ্যা মানিয়া লইতে তাঁহারা মোটেই রাজি হইলেন না। এমন সময় গৃহস্বামী উপস্থিত হইলে উভয় পক্ষই মীমাংসার জন্য তাঁহাকে মধ্যস্থ মানিলেন। তিনি শিক্ষিত বলিয়া এ রহস্য অবগত ছিলেন, কিন্তু শতরঞ্চ খেলায় রত দুইজনের এ-বিষয়ে বোধ জন্মানো নিতান্ত কঠিন বুঝিয়া যুবকটিকে নিরস্ত হইতে ইঙ্গিত করিলেন এবং জোয়ার-ভাঁটার কারণ সম্বন্ধে এমন ব্যাখ্যা দিলেন যে, মূর্খ শ্রোতা-দুইজনের তাহা ভাল লাগিল : আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন যে, বহুদূরে মহাসাগরের ঠিক মধ্যস্থলে একটি স্পঞ্জের (sponge) পাহাড় আছে। আপনারা দুইজনেই অবশ্য স্পঞ্জ দেখিয়াছেন এবং আমি যে-বিষয় বুঝাইতে যাইতেছি, তাহা নিশ্চয় বুঝিবেন। এই স্পঞ্জ-পাহাড় সাগরের অধিকাংশ জল শোষণ করিয়া লইলেই ভাঁটার উৎপত্তি হয়; ক্রমে দেবগণ নামিয়া আসিয়া ঐ পর্বতের উপর নৃত্য আরম্ভ করিলে তাঁহাদের দেহের ভারে নিষ্পেষিত হইয়া জল বাহির হইয়া যাইলেই জোয়ারের উৎপত্তি হয়। মহাশয়গণ, এই তো জোয়ার-ভাঁটার কারণ; এই কারণ কেমন সরল ও যুক্তিসঙ্গত, তাহা সহজেই বুঝিতে পারিবেন। চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার-ভাটা হয় শুনিয়া যাঁহারা ঠাট্টা করিয়াছিলেন, স্পঞ্জ-পাহাড় ও তাহার উপরে দেবতাদের নৃত্যের বিষয় শ্রবণ করিয়া তাঁহাদের আর কোন অবিশ্বাস রহিল না। দেবতা তো তাঁহাদের নিত্য-বিশ্বাস সত্য বস্তু, আর স্পঞ্জ তাঁহারা স্বচক্ষেই দেখিয়াছেন। উভয়ের মিলিত ক্রিয়াফলেই যে জোয়ার-ভাঁটা হইয়া থাকে, ইহা খুবই সম্ভব।

‘আরাম’—সত্যলাভের পরীক্ষা নয়; বস্তুতঃ সত্যলাভ ইহার ঠিক বিপরীত অবস্থা। যদি কেহ প্রকৃতপক্ষে সত্যকে জানিতে চান, তিনি যেন আরামে আসক্ত না হন। সমস্ত সুখভোগের কামনা পরিত্যাগ করা কঠিন, কিন্তু জ্ঞানীকে ইহা বর্জন করিতে হইবে। জ্ঞানী বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া সব বাসনা ত্যাগ করিবেন, তাঁহার দেহাত্মবুদ্ধি থাকিবে না—কেবল তখনই উচ্চতর সত্য তাঁহার হৃদয়ে উদ্ভাসিত হইবে। ত্যাগের প্রয়োজন। যজ্ঞ যে ধর্মের অঙ্গ বলিয়া গণ্য হইয়াছে, তাহা এই ক্ষুদ্র স্বার্থগুলির বিসর্জনের অন্তর্নিহিত শক্তি হইতেই হইয়াছে। মিথ্যা অহংভাবের বিসর্জন দ্বারা আমরা উচ্চতর ‘অহং’-জ্ঞান অর্থাৎ আত্মানুভূতি লাভ করিতে পারি। দেবতাদের ক্রোধের উপশমের বা প্রসন্নতার জন্য যে যথার্থ ফলপ্রদ বলি প্রদত্ত হইত, তাহা আত্মজ্ঞান-লাভের উপায় কাঁচা ‘আমি’র বিসর্জনেরই রূপক মাত্র। জ্ঞানী দেহরক্ষার জন্য যত্ন করিবেন না, মনেও ঐ ইচ্ছা পোষণ করিবেন না। বিশ্বের ধ্বংস হইলেও জ্ঞানী সাহসের সহিত সত্য অনুসরণ করিবেন। যাহারা অলীক উত্তেজনার পশ্চাতে ধাবিত হয়, তাহারা সত্য অনুসরণ করিতে পারে না। শুধু এই জীবনে নয়, শত শত জীবন ধরিয়া এই সাধনা করিতে হইবে। অতি অল্পসংখ্যক মানুষই অন্তরে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করিতে সাহস করে—স্বর্গসুখ, সাকার ঈশ্বর-উপাসনা ও ফলাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন করিতে সাহসী হয়। এই জ্ঞানের সাধনের জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প আবশ্যক; সন্দেহে দোদুল্যমান হওয়াও অত্যন্ত দুর্বলতার লক্ষণ। মানুষ নিত্য-পূর্ণই আছে, তাহা না হইলে কিরূপে পূর্ণত্ব লাভ করিতে সমর্থ হইত? কিন্তু তাহাকে এই পূর্ণত্ব প্রত্যক্ষ করিতে হইয়াছিল। মানুষ যদি শুধু বাহ্য কারণগুলির অধীন থাকিত, তাহা হইলে সে কেবল মরণশীলই থাকিয়া যাইত। যাহারা কোন অবস্থার উপর নির্ভর-শীল নয়, তাহাদের সম্বন্ধেই অমৃতত্ব প্রযোজ্য। আত্মাকে কোন কিছু প্রভাবিত করিতে পারে না—এই ভাব সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক; কিন্তু মানুষকে আত্মার সহিত এক হইতে হইবে , দেহ বা মনের সহিত নয়। মানুষ এই জগতের দ্রষ্টামাত্র—এই সত্য সে জানিতে পারিলেই নিয়ত গতিশীল এই জগচ্চিত্র উপভোগ করিতে পারিবে। জ্ঞানী নিজেকে বলিতে থাকুন, ‘আমি বিশ্ব, আমি ব্রহ্ম।’ মানুষ যখন সত্য-সত্যই এক অদ্বিতীয় পরমাত্মার সহিত এক হইয়া যায়। তখন সকল ব্যাপারই তাহার পক্ষে সম্ভব হয় , এবং সকল জড়বস্তু তাহার দাস হইয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলিয়াছেন, ‘মাখন তুলিয়া দুধে রাখো বা জলে রাখো, কিছুরই সহিতই তাহা মিশিবে না। সেইরূপ মানুষ একবার আত্মজ্ঞান লাভ করিলে বিষয়াসক্তি তাহাকে আর স্পর্শ করিতে পারে না।’ ‘বেলুন হইতে যেমন পৃথিবীর ছোটখাট বৈষম্যগুলি চোখে পড়ে না, মানুষেরও উচ্চ অবস্থা লাভ হইলে ভালমন্দ পার্থক্য আর তাহার চোখে পড়িবে না।’ ‘পোড়া ঘটকে আর কোন আকার দেওয়া যায় না; তেমনি যে মন একবার ঈশ্বরকে স্পর্শ করিয়াছে এবং অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছে, তাহা অবিকারী হইয়া থাকিবে।’ সংস্কৃতে ‘ফিলজফি’ শব্দের অর্থ ‘শুদ্ধ দর্শন’, এবং ধর্ম হইতেছে ফলিত দর্শনশাস্ত্র। শুধু তত্ত্বমূলক ‘কল্পনাত্মক’ দর্শন ভারতে বিশেষ সমাদৃত হয় না; সেখানে ভজনালয়, ধর্মমত বা গোঁড়ামি নাই; দ্বৈতবাদী ও অদ্বৈতবাদী—এই দুইটি প্রধান বিভাগ আছে। দ্বৈতবাদী বলেন, ‘মুক্তির উপায় কেবল ভগবৎ-কৃপা। কার্য-কারণ-বিধি একবার গতিপ্রাপ্ত হইলে আর তাহার বিশ্রাম নাই। এই বিধানের অতীত একমাত্র ঈশ্বর কৃপা করিয়া আমাদিগকে এ বিধান ভঙ্গ করিতে সহায়তা করেন।’ অদ্বৈতবাদী বলেন, ‘এই জড়প্রকৃতির অন্তরালে এমন একজন আছেন, যিনি মুক্ত; সকল বিধানের অতীত সেই পুরুষকে লাভ করিয়া আমরা মুক্ত হই। এই বন্ধন-হীনতাই মুক্তি।’ দ্বৈতবাদ মুক্তির একটি দিক মাত্র, অদ্বৈতবাদ জ্ঞনের চরমে পৌঁছাইয়া দিয়। পবিত্র হওয়াই মুক্তিলাভের অতি সহজপথ। আমরা যাহা অর্জন করি, তাহাই আমাদের নিজস্ব। কোন শাস্ত্র-প্রমাণ বা ধর্মবিশ্বাস আমাদিগকে রক্ষা করিতে পারে না। যদি একজন ঈশ্বর থাকেন, সকলেই তাঁহাকে লাভ করিতে পারে। অগ্নির উত্তাপ সমন্ধে কাহাকেও বলিয়া দিতে হয় না , সকলেই অনুভব করিতে পারে। ঈশ্বর সম্বন্ধেও সেইরূপ। ঈশ্বর সকল মানুষেরই প্রত্যক্ষগম্য। প্রতীচ্যবাসীদের ‘পাপ’ সম্বন্ধে যেরূপ ধারণা, হিন্দুগণ সেইভাবে পাপের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। কুকার্য ‘পাপ’ নয়; কুকার্য দ্বারা আমরা কোন শাসক ঈশ্বরের বিরাগভাজন না হইয়া শুধু নিজদেরই অনিষ্ট করিয়া থাকি, এবং সেজন্য আমাদিগকে নিশ্চয়ই শাস্তি ভোগ করিতে হইবে। আগুনে হাত দেওয়া পাপ নয়, কিন্তু যে ঐ রূপ করে, সে নিশ্চয়ই পাপীর মতো যন্ত্রনা ভোগ করিবে। সকল কর্মেরই কিছু ফল আছে, এবং ‘প্রত্যেক কর্মের ফলই কর্তার নিকট ফিরিয়া আসে’। ‘ত্রিত্ববাদ’ ‘একত্ববাদ’ অপেক্ষা উন্নত, একত্ববাদ দ্বৈতবাদ—এই মতে ঈশ্বর ও জীব নিত্য পৃথক। ‘আমরা সকলেই ঈশ্বরের সন্তান’—এই জ্ঞান হইলে বুঝিতে হইবে, ধর্মের উন্নতি আরম্ভ হইয়াছে; একত্বে উপনীত হইলে অর্থাৎ যখন আমরা ব্রহ্মের সহিত অভিন্নতা উপলব্ধি করি, তখনই চরমোন্নতি বুঝিতে হইবে।

 

শরীর কেন চিরস্থায়ী হইতে পারে না?—এই প্রশ্ন তর্কশাস্ত্রের অনুমোদিত নয়, কারণ পরণামী ও অস্থায়ী কতকগুলি মূলপদার্থের সমবায়কে ‘শরীর’ আখ্যা দেওযা হইয়া থাকে। যখন আমরা আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়া যাইব না, তখনই এই তথাকথিত শরীর-ধারণের প্রয়োজন থাকিবে না। দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত পদার্থ আদৌ জড় হইবে না। দেশ ও কাল শুধু আমাদের মধ্যেই বিদ্যমান, আমরা সেই অবিনাশী সত্তা। সব সাকারবস্তুই ক্ষণভঙ্গুর, এই জন্য সব ধর্ম বলে, ‘ঈশ্বর নিরাকার’। গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজা

—————————
১ Trinitarianism,
২ Unitarianism

 

মিনেন্দার ১৫০ খৃ: পূ: এক বৌদ্ধ পরিব্রাজক সন্ন্যাসী কর্তৃক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং তাঁহার নাম হয় ‘মিলিন্দ’। তিনি তাঁহার উপদেষ্টা যুবক-সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বুদ্ধের মতো সিদ্ধপুরুষগণ কি ভ্রান্ত হইতে পারেন অথবা ভুল করিতে পারেন?’ যুবক-সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, ‘সিদ্ধ ব্যক্তি তাঁহার অভিজ্ঞতার গণ্ডির বাহিরে সামান্য বিষয়গুলি সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিতে পারেন, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিবলে তিনি যাহা উপলব্ধি করিয়াছেন, সেই সম্বন্ধে, তাঁহার ভ্রান্তি কখনও সম্ভব নয়। তিনি ইহকালেও এই দেহে অভ্রান্ত। তিনি বিশ্বের সারতত্ত্ব ও গূঢ়রহস্য পরিজ্ঞাত আছেন, কিন্তু দেশ ও কালের আশ্রয়ে শুধু বাহ্য বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া যে সার সত্তা প্রকাশ পাইতেছে, তাহা না জানিতে পারেন। তাঁহার মৃত্তিকাজ্ঞান জন্মিয়াছে, কিন্তু ঐ মৃত্তিকা যে যে আকার ধারণ করিতে পারে, সেগুলির কোন অভিজ্ঞতা তাঁহার নাই। সিদ্ধ-পরুষ আত্মাকে জানিয়াছেন, কিন্তু আত্মার প্রতিরূপ ও অভিব্যক্তির জ্ঞান তাঁহার হয় নাই’। তিনি ইচ্ছামাত্রেই আমাদের মতো ব্যাবহারিক জ্ঞান লাভ করিতে পারিতেন, যদিও অসীম ক্ষমতাবলে এই জ্ঞান আরও অধিক শীঘ্রই লাভ করিতে পারেন। সম্পূর্ণ বশীভূত মনের প্রচণ্ড ‘অনুসন্ধান-রশ্মি’ কোন পদার্থে নিক্ষিপ্ত হইলেই উহা শীঘ্র আয়ত্ত হইবে। ইহা বুঝা অতি আবশ্যক, কারণ ইহা দ্বারা একজন বুদ্ধ বা একজন খ্রীষ্ট কিরূপে সাধারণ জাগতিক ব্যাবহারিক জ্ঞানে অনভিজ্ঞ ছিলেন, সে সম্বন্ধে যে নিরর্থক ব্যাখ্যা করা হয়, তাহা হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। শিষ্যগণ ভুল করিয়া তাঁহাদের যে উপদেশ লিপিবদ্ধ করিয়াছে, এজন্য তাঁহাদের দোষ দেওযা যায় না। শিষ্যগণ-বর্ণিত বাণীর একটি সত্য, অপরটি অসত্য—এরূপ বলা প্রতারণা। সমগ্র বিবরণ হয় মানিয়া লও, নতুবা পরিত্যাগ কর। অসত্য হইতে সত্য কিরূপে বাছিয়া লইব?

একবার যাহা ঘটিয়াছে, পুনরায় তাহা ঘটিতে পারে,। যদি কেহ কখন পূর্ণতা লাভ করিয়া থাকেন, আমরাও তাহা লাভ করিতে পারি। এই পৃথিবীতে ও এই শরীরে পূর্ণ হইতে না পারিলে স্বর্গ বা যে-কোন উন্নত অবস্থাই কল্পনা করি না কেন, কোন অবস্থাতেই আমরা ঐ পূর্ণতা লাভ করিতে পারিব না। যীশু যদি সিদ্ধপুরুষ না হন, তাহা হইলে তাঁহার নামে প্রচারিত ধর্ম ভূমিসাৎ হইত। আর তিনি সিদ্ধ হইয়া থাকিলে আমরাও সিদ্ধ হইতে পারি। আমরা যে-অর্থে ‘জানা’ বুঝি, সেই অর্থে সিদ্ধপুরুষ বিচার করেন না বা ‘জানেন না’, যেহেতু আমাদের জ্ঞান তুলনামুলক, এবং পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে কোন তুলনা বা শ্রেণীবিভাগ করা সম্ভব নয়। বিচার-মূলক জ্ঞান অপেক্ষা সহজজ্ঞান অল্পভ্রমাত্মক, কিন্তু বিচার অপেক্ষাকৃত উন্নত, এবং উহা স্বজ্ঞায় পৌঁছাইয়া দেয়, স্বজ্ঞা আরও উন্নত। জ্ঞান স্বজ্ঞার জনক। এই স্বজ্ঞা সহজজ্ঞানের মতোই অভ্রান্ত, কিন্তু উচ্চস্তরে।

প্রাণিজগতে অভিব্যক্তির তিনটি স্তর বিদ্যমান : (১) অবচেতন—যন্ত্রবৎ, অভ্রান্ত; (২) সচেতন—বিচারময়, ভ্রান্ত; (৩) অতিচেতন বা তুরীয়—স্বজ্ঞা, অভ্রান্ত। এই অবস্থাগুলি যথাক্রমে জন্তুম মানুষ ও ঈশ্বরের প্রকাশিত। কারণ যে মানুষ পূর্ণতা লাভ করিয়াছেন, বোধশক্তির প্রয়োগ ব্যতীত তাঁহার অন্য কিছু থাকে না। তিনি নিজের জন্য কিছু কামনা না করিয়া জীবের মঙ্গলার্থেই জীবনধারণ করেন। যাহা কিছু ভেদ সৃষ্টি করে, তাহাই নাস্তিবাচক বা অভাবাত্মক; যাহা অস্তিবাচক, তাহাই চির-উদার। যাহা আমাদের সাধারণ সম্পত্তি, তাহাই সর্বাপেক্ষা উদার—সেটিই ‘সত্তা’।

‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ হইতেছে জগৎব্যাপারের পারস্পর্য ব্যাখ্যা করিবার একটি মানসিক সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া, কিন্তু বাস্তবিক সত্তারূপে ইহার কোন অস্তিত্ব নাই। এই জগৎপ্রপঞ্চে সংঘটিত কতকগুলি ঘটনাপরম্পরা প্রকাশ করিবার জন্য আমরা ‘নিয়ম’ শব্দ ব্যবহার করি। যাহার নিকট মাথা নত করিতে হইবে, এমন কোন অপরিহার্য বস্তু বা কুসংস্কাররূপে যেন আমরা এই নিয়মকে গণ্য না করি। ভ্রান্তি বিচারবুদ্ধির নিত্যসঙ্গী, তবুও প্রাণপন সংগ্রামের দ্বারা ভ্রান্তিজয়ের প্রচেষ্টাই আমাদিগকে দেবত্বে পৌঁছাইয়া দিবে। আমাদের দেহ হইতে অনিষ্টকর পদার্থ বাহির করিয়া দিবার জন্য প্রকৃতির যে প্রয়াস, তাহাই ব্যাধি। পাপও তেমনি আমাদের অন্তর্নিহিত দেবভাব হইতে পশুভাব দূর করিবার প্রাণপণ চেষ্টা। দেবত্বে উন্নীত হইবার জন্য আমাদিগকে ‘পাপ’ অর্থাৎ ভুল করিতে হইবে।

কাহাকেও কৃপার চোখে দেখিও না। সকলকে তোমার সমান বলিয়া দেখিবে, অসাম্য—মুখ্য পাপ অন্তর হইতে মুছিয়া ফেলো। আমরা সকলেই সমান। ‘আমি ভাল’ তুমি মন্দ; আমি তোমাকে সংশোধন করিবার চেষ্টা করিতেছি’—এই সব ভাব যেন আমাদের মনে উদিত না হয়। সমত্বই মুক্ত মানুষের লক্ষণ। যীশু ঘৃণ্য পাপীদের কাছে গিয়া তাহাদের সহিত বাস করিতেন। তিনি কখনও উচ্চ বেদীতে বসিয়া থাকিতেন না। পাপীরাই কেবল পাপ দেখিতে পায়। মানুষকে মানুষরূপে দেখিও না, তাহার মধ্যে শুধু ঈশ্বরকেই দর্শণ কর। আমরহি নিজেদের স্বর্গ সৃষ্টি করি, এবং নরককেও স্বর্গে পরিণত করিতে পারি। নরকেই পাপীদের দেখিতে পাওয়া যায়। যতদিন আমরা আমাদের আশেপাশে পাপীদের দেখি, ততদিন আমরা নিজেরই নরকে আছি। আত্মা দেশকালের অতীত। ‘আমি সচ্চিদানন্দ, সোহহং’—ইহা উপলব্ধি কর। জন্ম-মৃত্যু উভয় অবস্থাতেই আনন্দে থাকো, ঈশ্বরপ্রেমে সদা মাতোয়ারা হও। দেহের বন্ধন হইতে মুক্ত হও। আমরা দেহের দাস হইয়াছি, শৃঙ্খলকে বুকে জড়াইয়া ধরিতে শিখিয়াছি, এবং দাসত্বকে বরণ করিয়া লইয়াছি। আমরা এতদূর দাস হইয়া পড়িয়াছি যে, এই দেহবন্ধনকে চিরস্থায়ী করিতে ইচ্ছা করি, এবং চিরদিন দেহবুদ্ধি লইয়াই থাকিতে চাই। দেহাত্মবুদ্ধিকে আঁকড়াইয়া থাকিও না। কিছুতেই বর্তমান জীবনের মতো আর একটি ভাবী জীবনের আকাঙ্ক্ষা করিও না। এমন কি অতি প্রিয়জনের দেহও ভালবাসিও না, বা তাহাদের দেহ কামনা করিও না। এই জীবনই আমাদের শিক্ষাদাতা; মৃত্যু সেই শিক্ষা নূতন করিযা আরম্ভ করিবার সুবিধা দেয় মাত্র। এই দেহ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো, কিন্তু আত্মহত্যা কেবল নির্বুদ্ধিতা, ইহা শুধু শিক্ষককে হত্যা করার মতো কাজ। আবার অন্য দেহ ধারণ করিতে হইবে, সুতরাং দেহাত্মবুদ্ধির অতীত অবস্থায় উন্নীত না হইলে বারংবার দেহধারণ করিতেই হইবে; তাই একটি দেহ নষ্ট করিলে অন্যটির আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর নাই। তবুও আমরা যেন কিছুতেই দেহাত্মবুদ্ধি না রাখি, দেহটিকে যেন শুধু পূর্ণতা লাভ করিবার যন্ত্রস্বরূপ মনে করি। রামের ভক্ত হনুমান্ তাঁহার নিজ অনুভূতি এই কয়েকটি কথায় সংক্ষেপে বলিয়াছেন, ‘হে প্রভু, যখন দেহবুদ্ধি থাকে, তখন আমি তোমা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, আমি তোমার দাস। যখন আমার জীব-বুদ্ধি হয়, তখন আমি জ্যোতির্ময় তোমার অংশ, একটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র। কিন্তু যখন আত্মবুদ্ধি হয়, তখন আমি ও তুমি এক।’ তাই জ্ঞানী অন্য কোন আকাঙ্ক্ষা না রাখিয়া শুধু আত্মাকে উপলব্ধি করিবার জন্য সচেষ্ট।

———————
১ Instinct
২ Reason
৩ Intuition

চিন্তা অতি গুরুত্বপূর্ণ, কেন না ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’—যাহার যেমন চিন্তা, তাহার তেমনি সিদ্ধি। জনৈক সাধু বৃক্ষতলে বসিয়া লোককে ধর্মোপদেশ দিতেন। তিনি শুধু দুধ ও ফলমূল আহার করিয়া এবং প্রাণায়ামাদি অভ্যাস করিয়া নিজেকে খুব পবিত্র মনে করিতেন। সেই গ্রামে এক চরিত্রহীনা নারী বাস করিত। স্ত্রীলোকটি দুষ্কার্যের জন্য নরকে যাইবে—এই বলিয়া সাধু প্রত্যহই তাহার নিকট গিয়া তাহাকে সাবধান করিয়া দিতেন। হতভাগিনী তাহার জীবিকা উপার্জনের একমাত্র পথ পরিবর্তন করিতে অক্ষম হইয়া সাধু-কথিত ভয়াবহ পরিণামের চিন্তায় শঙ্কিত থাকিত। নিরুপায় স্ত্রীলোকটি কাঁদিয়া, ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিত। এই সাধু ও ভ্রষ্টা স্ত্রীলোকটির মৃত্যু হইলে দেবদূতেরা আসিয়া সেই স্ত্রীলোকটিকে স্বর্গে লইয়া গেল, আর যমদূতেরা আসিয়া সাধুর আত্মা দাবি করিল। সাধু উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘একি? আমি কি কঠোর সাধুজীবন যাপন করিয়া সকলের মধ্যে ধর্ম প্রচার করি নাই? আমি কেন নরকে যাইব, আর এই ভ্রষ্টা স্ত্রীলোক স্বর্গে যাইবে?’ যমদূতগণ বলিল, ‘স্ত্রীলোটি দেহ দ্বারা পাপ কাজ করিতে বাধ্য হইলেও তাহার মন সর্বদা ভগবানে নিবিষ্ট ছিল এবং সে মুক্তি কামনা করিয়াছিল। সেই মুক্তি এখন সে লাভ করিয়াছে। আর তুমি বাহিরে ধর্ম-কার্য করিয়াছ, তোমার মন কিন্তু অপরের পাপের দিকেই সর্বদা নিবিষ্ট থাকিত। তুমি পাপই দেখিয়াছ, পাপই চিন্তা করিয়াছ; সুতরাং যেখানে কেবলই পাপ, তোমাকে সেই স্থানেই যাইতে হইবে।’ এই গল্পের শিক্ষনীয় বিষয়টি অতি স্পষ্ট : বাহ্য জীবন যাপনের দ্বারা কোন ফলই হয় না। হৃদয় পবিত্র হওয়া চাই; পবিত্রহৃদয় পাপ না দেখিয়া কেব পুন্যই দেখে। মানবজাতির অভিভাবক অথবা পাপীতাপীর উদ্ধারকর্তা সাধুরূপে দাঁড়াইবার চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে উচিত নয়। তাহার পরিবর্তে নিজদিগকে পবিত্র করিতে চেষ্টা করিব। ইহার ফলে আমরা অপরের ধর্মলাভের সহায় হইতে পারিব।

পদার্থবিজ্ঞান উভয় দিকেই অতীন্দ্রিয়বিদ্যা দ্বার সীমাবদ্ধ। যুক্তি সম্বন্ধেও ঠিক তাই—ইহার আরম্ভ অ-যুক্তিতে, সমাপ্তিও অ-যুক্তিতে। অনুভূতি-রাজ্যের গভীরে সন্ধান করিলে অনুভূতির অতীত এক স্তরে আমরা উপনীত হইব। যুক্তি বাস্তবিক সঞ্চিত ও শ্রেণীবদ্ধ অনুভূতি—স্মৃতি দ্বারা সুরক্ষিত। ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে আমরা আর কিছুই কল্পনা বা বিচার করিতে পারি না। যুক্তি বা বিচারের অতীত কোন কিছুই ইন্দ্রিয়-জ্ঞানের বিষয় হইতে পারে না। বিচারশক্তি যে সীমাবদ্ধ, তাহা আমরা বুঝিতে পারি; তবুও ইহা আমাদিগকে এমন স্তরে লইয়া যায়, যেখানে আমরা এক ইন্দ্রিয়াতীত অবস্থার আভাস পাইয়া থাকি। তারপর প্রশ্ন আসে : মানুষের এমন কোন যন্ত্র কি আছে, যাহার সাহায্যে সে বিচার বা যুক্তির অতীত অবস্থা লাভ করিতে সমর্থ? ইহা সম্ভব যে, যুক্তির অতীত অবস্থা লাভ করিবার একটি শক্তি মানুষের আছে। সত্য-সত্যই ঋষিরা সর্বকালেই এই শক্তি দেখাইয়াছেন। কিন্তু অধ্যাত্মভাব এবং অনুভূতিকে স্বভাবতই যুক্তির ভাষায় রূপায়িত করা অসম্ভব। আর এই ঋষিরাই তাঁহাদের প্রত্যক্ষানুভূত আধ্যাত্মিক ভাবগুলি অন্যকে জ্ঞাপন করিবার অক্ষমতা স্বীকার করিয়াছেন। নিশ্চয়ই তাঁহারা ভাষায় কিছু প্রকাশ করিতে পারেন না; অতএব ইহা শুধু বলা যাইতে পারে, এগুলি তাঁহাদের প্রত্যক্ষ অনুভূতি এবং সকলেরই অধিগম্য। শুধু ঐভাবেই অনুভূতিগুলি জানা যায়, কিন্তু কখনও প্রকাশ করা যায় না। যে বিজ্ঞান মানুষের অতীন্দ্রিয় সত্তার মধ্য দিয়া প্রকৃতির অতীত সত্তাকে বুঝিতে চায়, তাহাকেই ধর্ম বলে। মানুষের বিষয় আমরা এ পর্যন্ত অল্পই জানি, সেইজন্য বিশ্বজগৎ সম্বন্ধেও অল্পই জানি। মানুষের বিষয় আরও বেশী জানিতে পারিলে বিশ্ব সম্বন্ধেও সম্ভবতঃ অধিকতর জ্ঞান লাভ করিব। মানুষ সর্ববস্তুর সংক্ষিপ্ত আধার, সমগ্র জ্ঞান মানুষের মধ্যেই আছে। এই বিশ্বজগতের যেটুকু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, সেইটুকুরই আমরা কারণ নির্ধারণ করিতে পারি, মূলতত্ত্বের কোন কারণ নির্ধারণ করিতে আমরা অসমর্থ। কোন বিষয়ের কারণ নির্ধারণ করার অর্থ—উহাকে শুধু শ্রেণীবদ্ধ করা এবং মনের ক্ষুদ্র কক্ষে পুরিয়া রাখা। একটি নূতন বিষয় পাওয়া মাত্র আমরা উহাকে তখনই পূর্ব হইতে বিদ্যমান একটি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করিতে চেষ্টা করি, এই চেষ্টাকেই বিচারবুদ্ধি বলে। এই বিষয়টি কোন এক শ্রেণীর মধ্যে ফেলিতে পারিলেই কিছু পরিমাণ মানসিক তৃপ্তি বোধ হয়; কিন্তু এই শ্রেণীবিভাগ দ্বারা আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অবস্থাও অতিক্রম করিতে পারি না। প্রাচীনকাল এ বিষয়ে সগৌরবে সাক্ষ্য দিতেছে যে, মানুষ ইন্দ্রিয়াতীত অবস্থা লাভ করিতে পারে। পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে উপনিষদ্ ঘোষণা করিয়াছেন যে, ইন্দ্রিয়দ্বারা ঈশ্বরকে কখনও উপলব্ধি করা যায় না। আধুনিক অজ্ঞেয়বাদ এ পর্যন্ত একমত, কিন্তু বেদ নেতিবাচক দিকও অতিক্রম করিয়া স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করিতেছেন যে, মানুষ ইন্দ্রিয়াবদ্ধ জমাট বরফের মতো এই জড়জগৎকে অতিক্রম করিতে পারে এবং অতিক্রম করে। সে যেন এই বরফরাশীর কোনস্থানে একটি ছিদ্র আবিষ্কার করিতে পারে এবং তাহার মধ্য দিয়া অখণ্ড জীবনসমুদ্রে পৌঁছিতে পারে। এইরূপে সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ অতিক্রম করিয়াই তাহার যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করিতে পারে।

ইন্দ্রিয়ের জ্ঞানকে কখনও জ্ঞান বলা যায় না। আমরা ব্রহ্মকে জানিতে পারি না; আমরাই ব্রহ্ম—অংশ নই, পূর্ণব্রহ্ম। যাহার বিস্তার নাই, তাহা কখনও বিভাজ্য নয়। আমরা দেখিতে পাই সূর্য এক, বহু নয়; তবুও সূর্যরশ্মি যেমন লক্ষ লক্ষ শিশিরবিন্দুর মধ্যে প্রতিফলিত দেখা যায়, তেমনি এই প্রতীয়মান বৈচিত্র্য শুধু দেশকালের মধ্যেই প্রতিবিম্বিত। জ্ঞানে উপনীত হইলে বৈচিত্র্য ঘুচিয়া শুধু একত্বই অনুভূত হয়। এ অবস্থায় কর্তা-কর্ম, জ্ঞান-জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, আমি-তুমি-তিনি—কিছুই থাকে না, এক অদ্বিতীয় নির্বিশেষ সত্তামাত্র বিদ্যমান থাকে। সর্বদাই আমরা এই অবস্থায় আছি, একবার মুক্ত হইলেই সদামুক্ত। মানুষ কার্য-কারণ-নিয়ম দ্বারা বদ্ধ নয়। সুখ-দুঃখ মানুষের ভিতরে নাই। সুখ-দুঃখ সঞ্চরণশীল মেঘের মতো, মেঘ সূর্যকে আবৃত করিলে ছায়া পড়ে। সূর্য স্থির, মেঘই সঞ্চরণশীল; মানুষের সুখ-দুঃখও সেইরূপ। মানুষের জন্ম নাই , মৃত্যু নাই ; মানুষ দেশকালের অতীত। এই ভাবগুলি মনের চিন্তা মাত্র, কিন্তু এগুলিকে আমরা বাস্তব সত্ত্বা বলিয়া ভ্রম করি এবং আবৃত সেই মহিমান্বিত সত্যকে দেখিতে পাই না। আমাদের চিন্তার পদ্ধতিকেই ‘কাল’ বলি, কিন্তু আমরা শাশ্বত ‘বর্তমান কাল’। ভাল-মন্দ আমাদের সম্বন্ধে আরোপিত অবস্থামাত্র। একটিকে ছাড়া অন্যটিকে পাওয়া যায় না, কারণ একটি ব্যতীত অন্যটির অর্থ বা অস্তিত্ব নাই। যতদিন আমরা দ্বৈতভাব গ্রহণ করিয়া জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে পৃথক্ ভাবি, ততদিন আমরা অবশ্যই ভাল-মন্দ দেখিব।

কেন্দ্রস্থলে উপনীত হইয়াই, পরমাত্মার সহিত এক হইয়াই আমরা ইন্দ্রিয়ের মোহ হইতে অব্যাহতি পাইব। এই বাসনাজ্বর—এই অস্বস্তিকর অশ্রান্ত উৎকট পিপাসা যখন চিরতরে নিবৃত হইবে, কেবল তখনই ভাল-মন্দ হইতে অব্যাহতি পাইব, কারণ দুই-ই আমরা অতিক্রম করিয়াছি। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি প্রদান করিলে অগ্নি যেমন আরও প্রজ্বলিত হয়, উপভোগের দ্বারা কামও সেইরূপ বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্র হইতে যত দূরে, চক্র ততই দ্রুত চলিতে থাকে, বিশ্রামও তত কম। কেন্দ্রাভিমুখী হও। কামনা দমন কর, উহাকে নির্মূল কর। মিথ্যা ‘অহং’ভাব দূর কর, তাহা হইলে আমাদের দৃষ্টি পরিষ্কার হইবে এবং আমরা ঈশ্বর দর্শন করিব। যে-অবস্থায় উপনীত হইয়া আমরা প্রকৃত স্বরূপে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইতে পারি, তাহা কেবল ইহ-পরলোকের ভোগ বাসনা ত্যাগ করিয়াই লাভ করা যায়। কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা থাকিলেই বুঝিতে হইবে— আমরা এখনও বাসনার দাস। এক মুহূর্তের জন্যও সম্পূর্ণভাবে আশা ত্যাগ কর, দেখিবে কুয়াসা কাটিয়া যাইবে। মানুষ যখন নিজেই সব, তখন তাহার কিসের আকাঙ্ক্ষা? সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া আত্মতুষ্ট ও আত্মরতি হওয়াই জ্ঞানযোগের রহস্য। ‘নাস্তি’ বলিলে ‘নাস্তি’-ভাব লাভ করিবে; ‘অস্তি’ বলিলে ‘অস্তি’-ভাব পাইবে। অন্তরাত্মার অর্চনা কর, আর কিছুরই অস্তিত্ব নাই; যাহা-কিছু আমাদিগকে অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে, তাহা মায়া—ভ্রান্তি।

 

বিশ্বের সবই আত্ম-সাপেক্ষ, কিন্তু সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। ‘আমরা আত্মা’—ইহা জানিলেই আমাদের মুক্তি। মরণশীল জীবরূপে আমরা মুক্ত নই, কখনও হইতে পারি না। মুক্ত মরণশীলতা—স্ববিরোধী শব্দ, কারণ মরণশীলতা পরিণামী এবং শুধু অপরিণামীই মুক্তি লাভ করিতে পারে। শুধু আত্মাই মুক্ত এবং আত্মাই আমাদের প্রকৃত সত্তা। মুক্তির জন্য অন্তরে এই আকাঙ্ক্ষা আমরা অনুভব করি। সকল মতবাদ ও সকল বিশ্বাস সত্ত্বেও আমরা ইহা জানি, এবং আমাদের প্রতি কার্য দ্বারাই প্রমাণিত হইতেছে, আমরা ইহা জানি। ইচ্ছশক্তি স্বধীন নহে; ইহার আপাতপ্রতীয়মান স্বধীনতা প্রকৃত সত্তার ছায়ামাত্র। এই জগৎ যদি অসীম কার্য-কারণ-শৃঙ্খল হইত, মানুষ কোথায় দাঁড়াইয়া সাহায্য করিত? উদ্ধার-কর্তার দাঁড়াইবার একটি স্থান আবশ্যক, নতুবা খর জলস্রোতে মজ্জমান ব্যক্তিকে রক্ষা করা কেমন করিয়া সম্ভব হইবে? যে ধর্মোন্মাদ নিজেকে সামান্য কীট বলিয়া চীৎকার করিতেছে, সেও ভাব সে সাধু হওয়ার পথে চলিতেছে। কীটের মধ্যেও সে সাধু (হওয়ার সম্ভাবনা) দর্শন করিতেছে।

——————-
১ ন জাতু কামঃ কামানাপভোগেন শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।—বিষ্ণুপুরাণ

মানব-জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য দুইটি—যথার্থ জ্ঞান (বিজ্ঞান) ও আনন্দ। মুক্তি ব্যতীত এই দুইটি লাভ করা অসম্ভব। এই দুইটি সকল জীবনেরই স্পর্শমণি। নিত্য একত্বকে এরূপ গভীরভাবে অনুভব করা উচিত যে, আমরা সকল পাপীর জন্য কাঁদিব, আমার বোধ করিব—আমরাই পাপ করিতেছি। আত্মোৎসর্গ চিরন্তন নীতি, আত্মপ্রতিষ্ঠা নয়, সবই যখন এম, তখন কাহাকে প্রতিষ্ঠা করিবে? সবই প্রেমময়, ‘অধিকার’ বলিয়া কিছু নাই। যীশু-প্রচারিত মহান্ উপদেশ অনুসারে জীবন যাপন করা হয় নাই; তাঁহার নীতি অনুসরণ করিয়া দেখ, জগতের উদ্ধার হয় কি না। বিপরীত নীতিই জগতের অনিষ্ট করিয়াছে। স্বার্থপরতা নয়, নিঃস্বার্থতাই এই প্রশ্নের সমাধান করিতে পারে। অধিকারের ভাব একটি সীমাবদ্ধ ভাব; ‘আমার’ ‘তোমার’ বলিয়া বাস্তবিক কিছু নাই, কারণ ‘আমিই তুমি’, ‘তুমিই আমি’। আমাদের ‘দায়িত্ব’ আছে, ‘অধিকার’ নাই। ‘আমি জন্’ বা আমি মেরী’ না বলিয়া ‘আমিই বিশ্ব’ বলা উচিত। এই সীমাবদ্ধ ভাবগুলিই ভ্রান্তি এবং আমাদিগকে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। ‘আমি জন্’—এই চিন্তা মনে উদিত হইবামাত্রই যেন আমি কতকগুলি বাস্তব অধিকার চাই এবং বলিতে থাকি ‘আমি ও আমার’ এবং ক্রমাগত নূতন পার্থক্য সৃষ্টি করি। এরূপে নূতন সর্বগত পার্থক্যের সঙ্গে আমাদের দাসত্ব বা বন্ধন বাড়িতে থাকে এবং আমরা সেই অখণ্ড অনন্ত অভেদ সত্তা হইতে ক্রমশঃ দূরে সরিয়া পড়ি। একমাত্র অদ্বিতীয় পুরুষই আছেন, আমরা প্রত্যকেই সেই। অভেদ-জ্ঞানই প্রেম ও ভয়শূন্যতা; ভেদজ্ঞান ঘৃণা ও ভীতির দিকে লইয়া যায়। অভেদ-ভাব—একত্বই সকল প্রয়োজন মিটাইয়া দেয়। এই পৃথিবীতে বহিরাগত লোকদের বাদ দিয়া আমরা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে চাই। কিন্তু ঊর্ধ্বে—আকাশে আমরা সেরূপ করিতে পারি না। সাম্প্রদায়িক ধর্মও ঠিক ঐরূপ আচরণ করিয়া বলিয়া থাকে—একমাত্র এই পথেই মুক্তি মিলিবে, অন্যান্য পথগুলি ভুল। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য—এইক্ষুদ্র গণ্ডিগুলির লোপ করিয়া উহার সীমারেখা বাড়ানো, যে পর্যন্ত না উপলব্ধি হয়—সকল ধর্মই ঈশ্বরের নিকট পৌঁছাইযা দেয়। এই অকিঞ্চিৎকর ক্ষুদ্র স্বার্থ বলি দিতে হইবে। নব জীবন দীক্ষালাভ , ‘পুরাতন মানুষে’র , মৃত্যু ,নূতন মানুষের জন্ম-মিত্যা অহমিকার নাশ, বিশ্বের একমাত্র সত্তা সেই আত্মার অনুভূতি এই স্বার্থ-বলিদানরূপ সত্যের দ্যোতক।

বেদের দুইটি প্রধান বিভাগ—কর্মকাণ্ড অর্থাৎ যে অংশে কর্মের বিষয় আলোচিত, এবং জ্ঞানকাণ্ড অর্থাৎ যে অংশে শুদ্ধ জ্ঞানের বিষয় আলোচিত। বেদে ধর্মভাবের ক্রমোন্নতির ধারা আমরা লক্ষ্য করি। ইহার কারণ এই—যখন উচ্চতর সত্যের উপলব্ধি হইল, তখনও উচ্চতর সত্যে পৌঁছিবার সোপান-স্বরূপ নিম্নতর সত্যের অনুভূতি রক্ষিত হইয়াছে। নিম্নতর সত্যের অনুভূতি রক্ষা করার কারণ এই : ঋষিগণ বুঝিয়াছিলেন যে, সৃষ্টি নিত্য বলিয়া জ্ঞানের প্রথম সোপানের উপযোগী একদল লোক সর্বদা থাকিবে, এবং সর্ব্বোচ্চ দার্শনিক জ্ঞানের দ্বার সকলের নিকট উন্মুক্ত থাকিলেও তাহা কখনও সকলের বোধগম্য হইবার নয়। অন্যান্য সব ধর্মে কেবল সত্যের চরম অনুভূতির উপায়টিই শুধু রক্ষিত হইয়াছে। স্বভাবতঃ তাহার ফল এই দাঁড়াইয়াছে যে, পূর্বভাবগুলি নষ্ট হইয়া যাওয়ায় নূতন ভাবগুলি অল্পসংখ্যক ব্যক্তির বোধগম্য হইয়াছে এবং এইভাবে ধর্ম ক্রমশঃ বহু লোকের নিকট অর্থহীন হইয়া পড়িয়াছে। আমরা দেখিতে পাই, এই কুফল প্রাচীন রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যগুলির বিরুদ্ধে উত্তরোত্তর বিদ্রোহ-ঘোষণাতেই আত্ম-প্রকাশ করিয়াছে। আধুনিক মানুষ এই প্রাচীন মতবাদগুলি গ্রহণ করা দূরে থাকুক, কেন তাহারা এগুলি গ্রহণ করিবে, তাহার কারণ দর্শন করিবার জন্য স্পর্ধার সহিত দাবি করিতেছি। আধুনিক খ্রীষ্টধর্মের অধিকাংশ মতবাদই প্রাচীন পৌত্তলিকতা ও রীতিনীতিগুলির উপর নূতন নাম ও অর্থের প্রয়োগমাত্র। যদি প্রাচীন মূল সূত্রগুলি রক্ষিত হইত এবং পরিবর্তনের কারণগুলি স্পষ্টরূপে ব্যাখ্যাত হইত, তাহা হইলে অনেক বিষয়ই সুবোধ্য হইত। বেদে ধর্মের প্রাচীন ভাবগুলি রক্ষিত আছে; এই কারণে ভাবগুলি ব্যাখ্যা করিবার জন্য বিপুল ভাষ্য-প্রণয়ন আবশ্যক হইয়াছে, এবং ভাবগুলি কেন রাখা হইয়াছে, এবং ভাবগুলি কেন রাখা হইয়াছে, তাহাও বলা হইয়াছে। অর্থ না বুঝিয়া প্রাচীন মতগুলি দৃঢ়ভাবে আঁকড়াইযা থাকিবার দরুন অনেক কুসংস্কারের সৃষ্টি হইয়াছে। অনেক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপে অধুনা-বিস্মৃত ভাষায় মন্ত্রগুলি উচ্চারিত হইয়া আসিতেছে; এখণ আর ঐ মন্ত্রগুলির কোন প্রকৃত অর্থ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। খ্রীষ্টজন্মের বহু পূর্বেই ক্রমবিকাশবাদ বেদে স্থান পাইয়াছে, কিন্তু ডারুইন এই মতবাদটি সত্য বলিয়া স্বীকার না করা পর্যন্ত, ইহা হিন্দুদিগের একটি কুসংস্কাররূপে পরিগণিত হইত।

প্রার্থনা ও উপাসনার বাহ্য রীতি-নীতিগুলি কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত। নিষ্কামভাবে অনুষ্ঠিত হইলে এবং শুধু বাহ্য আচারমাত্রে পর্যবসিত হইতে না দিলে এগুলি কল্যানপ্রদ। এগুলি চিত্তকে শুদ্ধ করে। কর্মযোগী চায় প্রত্যেকেই তাহার পূর্বে মুক্তি লাভ করুক। অন্যকে মুক্ত হইতে সাহায্য করাই তাহার একমাত্র মুক্তি। ‘কৃষ্ ভক্তদের সেবাই তাহার শ্রেষ্ঠ উপাসনা’।কোন মহাপুরুষ বলিয়াছেন , ‘সমগ্র জগতের পাপ গ্রহণ করিয়া আমাকে নরকে যাইতে দাও, কিন্তু জগতের পরিত্রাণ হউক।’ এই ভাবের প্রকৃত উপাসনা আত্মোৎসর্গে পরিণত হয়। কথিত আছে, একজন মুনি তাঁহার বহুদিনের বিশ্বস্ত কুকুরটি যাহাতে স্বর্গে যাইতে পারে, সেজন্য স্বেচ্ছায় নিজের পুণ্য কুকুরকে দান করিয়া সানন্দে নরকে যাইতে উদ্যত হন।

বেদের জ্ঞানকাণ্ড শিক্ষা দেয় যে, জ্ঞানই একমাত্র পরিত্রাতা; ইহার অর্থ এই—মুক্তিলাভ না করা পর্যন্ত জ্ঞান আশ্রয় করিয়া থাকিতে হইবে। জ্ঞানই প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য, অর্থাৎ জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ, জ্ঞাতা নিজেকেই জানেন। একমাত্র কর্তা আত্মাই নিজেকে প্রকাশ করিবার এবং জানিবার চেষ্টা করে। দর্পণ যতই স্বচ্ছ হইবে, প্রতিবিম্ব ততই স্পষ্ট হইবে। ঐরূপ মানুষও শ্রেষ্ঠ দর্পণ; তাহার অন্তকরণ যত বেশী শুদ্ধ হইবে, তাহার মধ্যে ঈশ্বর তত বেশী প্রতিবিম্বিত হইবেন। মানুষ নিজেকে ঈশ্বর হইতে পৃথক্ মনে করিয়া এবং দেহাত্মবুদ্ধি আনিয়া ভ্রমে পতিত হয়। মায়া হইতে এই ভ্রমের উৎপত্তি। মায়া ঠিক ভ্রান্তি নহে; যে বস্তু প্রকৃতই যাহা , তাহাকে সেইরূপ না দেখিয়া অন্যরূপে দেখাকেই ‘মায়া’ বলে। এই দেহাত্মবুদ্ধি হইতেই ভেদ; ভেদ হইতে দ্বন্দ্ব ও দ্বেষ। এই ভেদবুদ্ধি যতদিন থাকিবে, ততদিন আমরা কখনও সুখী হইতে পারি না। জ্ঞানী বলেন—অজ্ঞানও ভেদদৃষ্টিই সকল দুঃখের দুইটি কারণ। সংসারে আঘাতের পর আঘাত পাইয়া মানুষ মুক্তির জন্য সজাগ হয় এবং জন্মমৃত্যুর ভীষণ আবর্তন হইতে পরিত্রাণ পাইবার উপায় খুঁজিয়া জ্ঞানের পথ আশ্রয় করে এবং স্ব-স্বরূপ উপলব্ধি করিয়া মুক্ত হয়। মুক্তিলাভের পর মানুষ সংসারকে একটি প্রকাণ্ড যন্ত্ররূপে দেখে এবং যাহাতে নিজের হাতটি যন্ত্রের চক্রের মধ্যে না পড়ে, সে বিষয়ে সাবধান হয়। এইরূপে মুক্ত পুরুষের কর্মনিবৃত্তি হয়। কোন্ শক্তি মুক্ত পুরুষকে কর্মে আবদ্ধ করিতে পারে? তিনি লোকের হিত করেন, কারণ ইহা তাঁহার প্রকৃতি; কোন কল্পিত কর্তব্যের প্রেরণায় তিনি পৃথিবীর হিত করেন না। যাহারা এখনও ইন্দ্রিয়ের দাস, তাহাদের সম্বন্ধে এ-কথা প্রযোজ্য নয়। নিকৃষ্ট অহমিকা যিনি অতিক্রম করিয়াছেন, তাঁহার জন্যই এই মুক্তি; তিনি আত্মায় প্রতিষ্ঠিত—কোন নিয়মের অধীন নহেন, তিনি মুক্ত এবং পূর্ণ। তিনি প্রাচীন কুসংস্কারগুলি অতিক্রম করিয়া সংসারচক্রের বাহিরে গিয়াছেন। প্রকৃতি আমাদের নিজেদেরই দর্পণস্বরূপ। মানুষের কর্মশক্তির সীমা আছে, কিন্তু বাসনা অসীম, সেজন্যই আমরা কর্মবিমুখ হইয়া অপরের কর্মশক্তি কাজে লাগাইযা তাহাদের শ্রমের ফল ভোগ করিতে সচেষ্ট হই। কাজের জন্য যন্ত্র আবিষ্কার দ্বারা কখনই মানুষের শ্রীবৃদ্ধি হয় না, কারণ আমরা বাসনার পরিতৃপ্তি করিতে গিয়া বাসনার সৃষ্টি করি; নিঃশেষিত না হইয়া আমাদের আকাঙ্ক্ষা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। অতৃপ্ত বাসনা লইয়া মরিলে বাসনা-পরিতৃপ্তির বৃথা অন্বষণে বারংবার জন্মগ্রহণ করিতে হইবে। হিন্দুরা বলেন, ‘মনুষ্য-শরীর ধারণ করিবার পূর্বে আমাদের আশী-লক্ষ্ যোনি পরিভ্রমন করিতে হইয়াছে।’ বাসনা নাশ করিয়া উহার হাত হইতে পরিত্রাণ পাও—ইহাই জ্ঞানের কথা। ইহাই একমাত্র পন্থা। সব কার্য-কারণ সম্বন্ধ দূর করিয়া আত্মাকে উপলব্ধি কর। শুধু মুক্তিই যথার্থ নীতিজ্ঞান দিতে পারে। শুধু কার্য-কারণ-শৃঙ্খলা অনন্তকাল থাকিলে নির্বাণ লাভ অসম্ভব হইত। এই কার্য-কারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ মিথ্যা ‘অহং’-এর নাশই নির্বাণ। কারণের অতীত হওয়াই মুক্তি। আমাদের যথার্থ স্বরূপ সৎ ও মুক্ত। আমরা শুদ্ধসত্ত্ব, অ-সৎ হওয়া বা অন্যায় কর্ম করা আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ। যখন আমরা চক্ষু বা মন দ্বারা ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করি, তখন ‘ইহা’ বা ‘উহা’ সংজ্ঞা দ্বারা তাঁহাকে অভিহিত করি, কিন্তু বাস্তবিক এক সৎ-বস্তুই আছেন, সব বৈচিত্র্য সেই একেরই ব্যাখ্যা। আমরা কোন-কিছু হই না, আমাদের যথার্থ স্বরূপকেই পুনঃপ্রাপ্ত হই। অজ্ঞান ও অসাম্য সকল দুঃখের কারণ—বুদ্ধের এই সংক্ষিপ্ত সার কথা বৈদান্তিকেরা গ্রহণ করিয়াছেন, কারণ ইহাই শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ও এই মানব-শ্রেষ্ঠর বিস্ময়কর প্রজ্ঞার নিদর্শন। আসুন, আমরা সাহসী ও অকপট হই; তবেই আন্তরিক শ্রদ্ধা লইয়া যে-কোন পথই অবলম্বন করি না কেন, তাহাতেই মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছিব। শৃঙ্খলের পরস্পর-সংযোজক খণ্ডগুলির একটি হাতে আসিলেই ক্রমশঃ একের পর এক করিয়া সমগ্র শৃঙ্খলটি হস্তগত হইবে। মূলে জলসেচন করিলেই সমগ্র বৃক্ষ সিঞ্চিত হইবে। প্রতি পত্রে জলসিঞ্চন দ্বারা সময় নষ্ট হইবে মাত্র, উপকার কিছুই হইবে না। অন্যভাবে বলিতে গেলে বলিতে হয় ঈশ্বরকে লাভ করিবার চেষ্টা কর; তাঁহাকে লাভ করিলেই আমাদের সব পাওয়া হইল। গির্জা, ধর্মমত, পূজাপদ্ধতি—এগুলি ধর্মের অপরিণত চারাগাছকে রক্ষা করিবার বেড়া মাত্র; কিন্তু পরে যাহাতে চারাগাছটি মহীরূহ হইয়া উঠিতে পারে, সেজন্য এই বেড়াগুলি তুলিয়া ফেলিবে। সুতরাং বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়, বাইবেল, বেদ, শাস্ত্র এই ধর্মের চারাগাছের টবের মতো; কিন্তু চারাগাছেকে টবের বাহিরে গিয়া বিস্তার লাভ করিতে হইবে।

আমরা এই পৃথিবী, সূর্যলোক, নক্ষত্রলোক—সব লোকেরই অন্তর্গত, ইহা আমরা সমভাবে অনুভব করিতে শিখিব। আত্মা দেশ ও কালের অতীত; দৃষ্টিসম্পন্ন সব চোখই আমার চোখ; ঈশ্বরের গুণগানে রত সব মুখই আমার মুখ; প্রত্যেক পাপীও আমিই। আমরা কিছুতেই বদ্ধ নই, আমরা বিদেহ। এই বিশ্বই আমাদের দেহ। আমরা স্বচ্ছ ফটিকের মতো সব বস্তুকেই প্রতিবিম্বিত করিতেছি, কিন্তু পূর্বাপর আমরা সেই একই আছি। আমরা যাদুকর, ইচ্ছামত লাঠি ঘুরাইয়া চোখের সামনে নানা দৃশ্য সৃষ্টি করিতেছি, কিন্তু আমাদিগকে এই-সকল দৃশ্যপ্রপঞ্চের অন্তরালে যাইয়া আত্মজ্ঞান লাভ করিতে হইবে। এই বিশ্ব কেটলির মধ্যে ফুটন্ত জলের মতো; প্রথমে একটি, তারপর আর একটি, তারপর বহুবুদ্ধুদের সৃষ্টি হইযা অবশেষে সব জল এককালে ফুটিয়া উঠিবে এবং বাষ্পাকারে উড়িয়া যাইবে। প্রথমতঃ মহান্ আচার্যগণ বুদ্বুদের মতো এখানে একজন, ওখানে একজন আবির্ভূত হইয়াছেন; অবশেষে কিন্তু সকল প্রাণীই বুদ্বুদে পরিণত হইয়া পরিত্রাণ লাভ করিবা। চিরনবীন সৃষ্টি নূতন জল আনিয়া বার বার এই নিয়মের মধ্য দিয়া চলিতে থাকিবে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলি বুদ্বুদের আবির্বাব হইযাছে, বুদ্ধ ও যীশু ইহাদের মধ্যে দুইটি মহত্তম বুদ্বুদ। তাঁহারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ পুরুষ, স্বয়ং মুক্ত হইয়া অপরকে মুক্ত হইতে সহায়তা করিয়াছেন। তাঁহাদের কেহই পূর্ণ ছিলেন না, কিন্তু তাঁহাদের গুণের দ্বারাই তাঁহাদিগকে বিচার করিতে হইবে, দোষের দ্বারা নয়। খ্রীষ্ট পূর্ণতার আদর্শে পৌঁছিতে পারেন নাই, কারণ তিনি সর্বদা নিজের প্রচারিত অতি উচ্চ আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করেন নাই, এবং সর্বোপরি স্ত্রীজাতিকে পুরুষের সমান অধিকার দেন নাই। স্ত্রীজাতি তাঁহার জন্য যথাসাধ্য করিলেও তিনি তাহাদের একজনকেও ধর্মপ্রচারক করেন নাই; সেমিটিক-বংশে তাঁহার জন্মই ইহার নিঃসন্দেহ কারণ। মহানুভব আর্যগণ ও তাঁহাদের মধ্যে বুদ্ধ স্ত্রীলোককে পুরুষের সমান অধিকার দিয়াছেন। আর্যদের নিকট ধর্মে স্ত্রী-পুরুষ জাতিবিচার ছিল না। বেদ ও উপনিষদে নারীরাও চরম সত্যের প্রবক্তা ছিলেন, এবং পুরুষের সহিত সমভাবে পূজা পাইতেন।

 

সুখ ও দুঃখ দুই-ই শৃঙ্খল, একটি সোনার, অপরটি লোহার; আমাদের বন্ধন ঘটাইতে এবং স্বরূপের উপলব্ধি হইতে নিবৃত্ত করিতে দুই-এরই শক্তি কিন্তু সমান। আত্মা সুখ-দুঃখ দুই-এরই অতীত। এই সুখ-দুঃখ অবস্থা মাত্র, এবং অবশ্যই পরিবর্তনশীল। আত্মার প্রকৃতি নিত্য আনন্দ ও শান্তি। এই আনন্দ ও শান্তির অবস্থা আমাদিগকে নূতন করিয়া লাভ করিতে হইবে না। ইহা আমাদের অধিগতই আছে। দৃষ্টির মলিনতা ধুইয়া ফেলিলেই উহা প্রত্যক্ষ করিতে পারিব। আমরা সততই আত্মায় অধিষ্ঠিত থাকিব এবং সম্পূর্ণ প্রশান্তির সহিত এই চঞ্চল বিশ্বপট দর্শন করিব। এ বিশ্বব্যাপার শুধু শিশুর খেলা—ইহা যেন আমাদের চিত্তের প্রশান্তি নষ্ট করিতে না পারে। মন যদি স্তুতিতে হৃষ্ট হয়, নিন্দায় ব্যাথিত হইবে। ইন্দ্রিযের সুখ, এমন কি মনের সুখও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু বাহ্যজগৎ-নিরপেক্ষ যথার্থ বিমল সুখ আমাদের অন্তরেই আছে। এই আত্মার আনন্দই পৃথিবীতে ‘ধর্ম’ নামে অভিহিত। আমাদের অন্তরে যত বেশী আনন্দ, আমরা তত বেশী ধার্মিক। সুখের জন্য যেন আমরা জগতের দিকে চাহিয়া না থাকি।

কয়েকটি গরীব জেলেনী প্রবল ঝড়ের মুখে পড়িয়া এক ধনীর উদ্যান-বাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করিল। ধনী তাহাদিগকে সাদরে অভ্যর্থনা করিয়া আহার করাইলেন এবং মনোহর পুষ্পের সৌরভে আমোদিত এক গ্রীষ্মাবাসে বিশ্রামের স্থান নির্দেশ করিয়া দিলেন। জেলীনীরা এই সুবাসিত উদ্যান-বাটিতে শয়ন করিল বটে, কিন্তু ঘুমাইতে পারিল না। তাহারা যেন আকাঙ্ক্ষিত কোন-কিছু হইতে বঞ্চিত হইয়াছে, সেটি ফিরিয়া না পাওয়া পর্যন্ত সুস্থ বোধ করিতেছিল না। অবশেষে তাহাদের একজন উঠিয়া গিয়া যেখানে মাছের ঝুড়িগুলি রাখা ছিল, সেখান হইতে সেগুলি ঘরে লইয়া আসিল, তখন সেই চিরাভ্যস্ত গন্ধ পাইবামাত্র সকলে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইল।

আমাদের নিকট এই জগৎটি যেন সেই মাছের ঝুড়ির মতো না হয়; আমরা যেন সুখের জন্য ইহার উপর নির্ভর না করি। এটি তামসিক অর্থাৎ তিন গুণের মধ্যে যেটি নিকৃষ্ট, তাহার দ্বারা বদ্ধ হওয়া। ইহার ঠিক উপরের স্তরটি ‘অহং’ভাবপূর্ণ; সেখানে অহরহ ‘আমি’র প্রকাশ দেখা যায়। এই প্রকৃতির লোকেরা সময় সময় সৎকার্য করে এবং ধার্মিক হয়; ইহারা রাজসিক বা কর্মপর প্রকৃতির। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বা সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোকেরা শ্রেষ্ঠ; তাঁহারা শুধু আত্মাতেই বাস করেন। এই তিন প্রকার গুণ অল্পবিস্তর সকল মানুষেই আছে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুণ প্রবল হয় মাত্র। রজোগুণের দ্বারা তমোগুণকে অভিভূত করিবার চেষ্টা করিতে হইবে, এবং পরে দুইটিকেই সত্ত্বগুণে নিমজ্জিত করিতে হইবে।

‘সৃষ্টি’ অর্থে নূতন কিছু গড়া নয়, সাম্যভাব ফিরিয়া পাইবার চেষ্টা। খণ্ড খণ্ড সোলা একপাত্র জলের তলদেশে নিক্ষেপ করিলে তাহারা স্বতন্ত্রভাবে ও একযোগের সবেগে উপরের দিকে উত্থিত হয়; সকল সোলা উপরে উঠিয়া সাম্যভাব লাভ করিলে গতি বা জীবনসংগ্রাম থামিয়া যায়। সৃষ্টিব্যাপারেও এইরূপ। সমত্বে পৌঁছিলে অস্থির ভাবগুলি নিবৃত্ত হয় এবং তথাকথিত জীবনযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। জীবনের সঙ্গে মন্দ জড়িত থাকিবেই, কারণ সাম্যভাব ফিরিয়া পাইলে জগৎ লোপ পাইবে; যেহেতু সাম্য ও ধ্বংস একই বস্তু। দুঃখশূণ্য সুখ বা অশুভশুণ্য শুভ কোনকালেই সম্ভব নয়, কেন না সাম্যভাবের অভাবই জীবন। আমরা চাই মুক্তি; জীবন বা সুখ বা মঙ্গল আমাদের কাম্য নয়। সৃষ্টি নিত্য, ইহার আদি বা অন্ত নাই; ইহা যেন অনন্ত হ্রদের বক্ষে চিরচঞ্চল তরঙ্গপ্রবাহ। এই হ্রদের অনেক স্থল অতলস্পর্শ, অনেক স্থল শান্ত, কিন্তু সদাই তরঙ্গভঙ্গ চলিতেছে, সাম্য অবস্থা লাভের জন্য সংগ্রাম অনন্ত। জীবন ও মৃত্যু একই সত্যের নামান্তর মাত্র, একই মুদ্রার দুই পিঠ। দুই-ই মায়া—এই মুহূর্তে প্রাণধারণের, পরমুহূর্তেই প্রাণত্যাগের দুর্বোধ্য চেষ্টা। এ-সকলের ঊর্ধ্বে আত্মাই প্রকৃত স্বরূপ। আমরা সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করি এবং পরে আমাদের জন্য উহা জীবন্তভাব ধারণ করে। বিষয়গুলি স্বয়ং প্রাণশূন্য, আমরাই তাহাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করি, এবং পরে আমরাই কখন বা বিষয় উপভোগ করি, আবার কখন মূঢ়ের ন্যায় বিষয় হইতে ত্রস্তভাবে পলায়ন করি! এই জগৎ সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়—সত্যের ছায়া মাত্র।

কবি বলিয়াছেন, ‘কল্পনা সত্যের সোনালী আভাস’; অন্তর্জগৎ—প্রকৃত সত্তা—বহির্জগৎ হইতে অনন্তগুণ বড়। বহির্জগৎ প্রকৃত সত্তার ছায়াময় অভিক্ষেপ। রজ্জুদর্শনকালে সর্পদর্শন হয় না, আবার সর্প দৃষ্ট হইলে রজ্জুদৃষ্টি তিরোহিত হয়। একই সময়ে রজ্জু ও সর্পজ্ঞান অসম্ভব। ঠিক তেমনি যখন আমরা জগৎ দেখি, তখন আত্মাকে উপলব্ধি করি না, ইহা কেবল বুদ্ধির ধারণা। ব্রহ্মানুভূতিতে ‘অহং’-জ্ঞান ও জগৎ-বোধ লোপ পায়। আলো কখনও অন্ধকার জানে না, আলোতে অন্ধকার নাই; (ব্রহ্ম ছাড়া কিছু নাই) ব্রহ্মই সব। যখন একজন ঈশ্বর স্বীকার করি, তখন বুঝিতে ইহবে—প্রকৃতপক্ষে আত্মাকেই নিজেদের হইতে পৃথক্ করিয়া লইয়া আমাদের বাহিরে অর্চনা করিতেছি; কিন্তু সর্ববস্থাতেই তিনি আর অন্য কেহ নন—আমাদেরই যথার্থ স্বরূপ, এক অদ্বিত্বীয় পরমেশ্বর।

যেখানে আছে, সেখানেই থাকা পশুর প্রকৃতি; ভালোকে গ্রহন এবং মন্দকে বর্জন করাই মানুষের প্রকৃতি; গ্রহণ বা বর্জন না করিয়া নিত্যানন্দে থাকাই দৈবী প্রকৃতি। আসুন, আমরা দৈবী প্রকৃতি লাভ করি; আমাদের হৃদয়কে সমুদ্রের মতো উদার করিয়া, অকিঞ্চিৎকর পার্থিব বস্তুগুলির অতীত হইয়া জগৎকে শুধু চিত্রের মতো দেখি। কেবল তখনই আমরা সম্পূর্ণ অনাসক্ত-ভাবে জগৎকে উপভোগ করিতে পারি।

জগতে ভালোর সন্ধান কর কেন, এখানে কি তাহা পাইতে পারি? সংসার যত উৎকৃষ্ট বস্তুই দিক না কেন, ইহা ঘোলা জলে খেলিতে খেলিতে শিশুদের কয়েকটি কাচের মালা পাওয়ার মতো; মালাগুলি বার বার তাহাদের হাত হইতে পড়িয়া যায়—আবার অনুসন্ধান চলে। ধর্ম ও ঈশ্বর অসীম শক্তিপ্রদ। মুক্ত অবস্থায় আমরা শুধু আত্মা; মুক্ত হইলেই অমৃতত্বে স্থিতি; ঈশ্বরও মুক্ত হইলেই ঈশ্বরপদবাচ্য।

‘অহং’-সৃষ্ট সংসার-বাসনা ত্যাগ করিতে না পারিলে আমরা কখনও স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিব না; অতীতে কেহ কখনও পারে নাই, ভবিষ্যতেও কখনও পারিবে না। সংসার-ত্যাগের অর্থ সম্পূর্ণভাবে অহংকে ভুলিয়া যাওয়া, ‘অহং’-কে একেবারে না বোধ করা, দেহে বাস করিয়াও দেহের অধীন না হওয়া। এই ধূর্ত অহমিকা সম্পূর্ণরূপে মুছিয়া ফেলিতে হইবে। মানব-জাতির হিত করিবার শক্তি কেবল সেই নীরব কর্মীদেরই আছে, যাঁহারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে মুছিয়া ফেলিয়া পরকে ভালবাসিবার জন্য জীবন ধারণ করেন। তাঁহারা কখনও ‘আমি, আমার’ বলেন না, অন্যের হিতসাধন করিবার যন্ত্রস্বরূপ হইয়াই তাঁহারা ধন্য। তাঁহারা ঈশ্বরের সহিত সম্পূর্ণ এক হইয়াছেন, কোন কিছু আকাঙ্ক্ষা করেন না বা জ্ঞাতসারে কোন কর্মও করেন না। তাঁহারাই প্রকৃত জীবন্মুক্ত—সম্পূর্ণ নিষ্কাম, ক্ষুদ্র ব্যাক্তিত্বের অতীত, উচ্চাকাঙ্ক্ষা-বর্জিত তাঁহারা ব্যক্তিত্বহীন তত্ত্ব মাত্র। ক্ষুদ্র ‘আমি’ যতই বিসর্জন করিব, ততই আমরা ঈশ্বরভাবাপন্ন হইব। চলুন, আমরা ক্ষুদ্র ‘আমি’কে পরিত্যাগ করি, তবেই আমাদের অন্তরে বৃহৎ ‘আমি’ আসিবে। যখন আমাদের মন হইতে ‘অহং’-ভাব সম্পূর্ণ দূর হয়, তখনই আমরা উৎকৃষ্ট কর্মী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি বলিয়া গণ্য হই। বাসনাশূন্য ব্যক্তিদের কর্মই মহৎ ফল প্রসব করে। যাহারা তোমার নিন্দা করে, তাহাদিগকে আশীর্বাদ কর; চিন্তা করিয়া দেখ , তোমার মিথ্যা ‘অহং’ দূর করিতে সাহায্য করিয়া নিন্দুকেরা তোমার কি মহৎ উপকার করিতেছে! যথার্থ ‘আমি’কে আঁকড়াইয়া থাকো, শুধু সৎ চিন্তা কর, দেখিবে ধর্মপ্রচারকদের অপেক্ষা অনেক বেশী কাজ করিতেছ। পবিত্রতা ও নীরবতা হইতেই মহা শক্তিময়ী বাণী আসে।

 

ব্যক্ত ভাব কার্যতঃ অবস্থা বা অধঃপতন, যেহেতু ভাব কেবল অক্ষরের সাহায্যেই ব্যক্ত হয়। তাই সেন্ট পল বলিয়াছেন, ‘অক্ষর ভাবকে নষ্ট করে।’ অক্ষরের মধ্যে জীবন থাকিতে পারে না—অক্ষর ভাবের প্রতিবিম্ব মাত্র। তথাপি ভাব প্রকাশের জন্য ভাবকে জড়ের দ্বারা আবৃত করিতে হইবে। আবরণের মধ্যে আমরা প্রকৃত সত্য দেখিতে পাই না, আবরণকেই প্রতীক না ভাবিয়া যথার্থ সত্য বলিয়া গ্রহণ করি। এই ভ্রম প্রায় সকলেরই হয়। প্রত্যেক মহান্ আচার্য ইহা জানেন এবং সাবধান হন, কিন্তু জনসাধারণ অপ্রত্যক্ষ অপেক্ষা প্রত্যক্ষের পূজা করিতেই বেশী উন্মুখ। ব্যক্তিত্বের পিছনে তত্ত্বের প্রতি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার এবং সময়োপযোগী নূতন ভাব দিবার জন্যই মহাপুরুষদের আবির্ভাব। সত্য চিরদিন অপরিবর্তনীয়, কিন্তু ইহাকে শুধু নূতন আকারে উপস্থিত করা যাইতে পারে, অথবা মানবজাতি তাহাদের উন্নতি অনুসারে যেভাবে গ্রহণ করিতে পারে, সেভাবেই সত্যের প্রকাশ হয়। নাম-রূপ হইতে মুক্ত হওয়াই, বিশেষতঃ যখন সুস্থ-অসুস্থ, সুন্দর-কুৎসিত কোনপ্রকার শরীরধারণেরই প্রয়োজন বোধ করি না, তখনই আমাদের এই সংসার-বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে। ‘অনন্ত উন্নতি’ হইলেই অনন্ত বন্ধনও হইবে। সমস্ত ভেদভাব অতিক্রম করিয়া অনন্ত অভেদভাব, একত্ব বা ব্রহ্মভাব আমাদিগকে লাভ করিতে হইবে। আত্মা সমস্ত ব্যক্তিত্বের মিলনভাব , এবং নির্বিকার ও ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। আত্মা জীবন নন, কিন্তু জীবনধারণ করিয়া থাকেন। আত্মা জীবন-মৃত্যু এবং শুভাশুভের অতীত—নির্বিশেষ একত্ব। নরকের মধ্য দিয়াও সত্যানুসন্ধান করিতে সাহসী হও। নাম-রূপ বা সবিশেষ বস্তু সম্বন্ধে মুক্তি প্রযোজ্য নহে। ‘আমি দেহধারী-রূপে মুক্ত’—এ-কথা কোন দেহবান্ ব্যক্তিই বলিতে পারে না। দেহভাব মন হইতে অপগত না হইলে মুক্তি হইবে না। আমাদের মুক্তি অন্যের ক্লেশকর হইলে আমরা সেখানে মুক্ত নই। আমরা যেন কাহারও ক্লেশের কারণ না হই।

—————————–
১ Letter killeth.—St. Paul

প্রকৃত অনুভূতি এক হইলেও আপেক্ষিক অনুভূতি বহু। সমগ্র জ্ঞানের উৎস আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে, পিপীলিকার মধ্যেও যেরূপ, শ্রেষ্ঠ দেবতার মধ্যেও সেইরূপ। প্রকৃত ধর্ম এক; সকল দ্বন্দ্ব কেবল রূপ প্রতীক ও ‘উদাহরণ’ লইয়া। চক্ষুষ্মানের পক্ষে স্বর্গরাজ্য বা স্বর্ণযুগ চিরকাল বর্তমান। ফলকথা, আমাদের আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছে বলিয়াই আমরা জগৎকে হারাইয়াছি মনে করি। মূঢ়! শুনিতে পাও না কি, তোমার হৃদয়মধ্যেই সেই অনাদি সঙ্গীত—’সচ্চিদানন্দ, সোহহং সোহহং’ অহরহ ধ্বনিত হইতেছে?

ছায়ামূর্তির (phantasm) সাহায্য ছাড়া চিন্তা করিবার চেষ্টা আর অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা একই প্রকার। প্রত্যেক ভাবেরই দুইটি অংশ—মানস ও শাব্দ। এই দুই-ই আমাদের প্রয়োজন। বিজ্ঞানবাদী (idealist) বা জড়বাদী—কেহই জগৎ-ব্যাপারনিরূপণে সমর্থ নয়। এ-বিষয়ে ভাবও অভিব্যক্তি দুয়েরই সাহায্য গ্রহণ করিতে হইবে। দর্পণে নিজের মুখ দেখার মতো জগৎরূপে প্রকাশিত ব্রহ্মের প্রতিবিম্বই আমাদের জ্ঞানের বিষয়। অতএব কেহই স্বীয় আত্মা বা ব্রহ্মকে জানিতে পারে না, কিন্তু প্রত্যেকেই সেই আত্মা; এবং এই আত্মাকে জ্ঞানের বিষয় করিবার জন্য ঐ প্রতিবিম্বরূপেই তাঁহাকে দর্শন করিতে হইবে। দর্শনাতীত তত্ত্বের উদাহরণগুলি দর্শন করাই তথাকথিত প্রতীকোপাসনা—সচরাচর যতটা অনুমান করা যায়, দেববিগ্রহের প্রসার তাহা অপেক্ষা অধিক ব্যাপক।

দারু ও শিলা হইতে আরম্ভ করিয়া খ্রীষ্ট বা বুদ্ধ প্রভৃতি মহাপুরুষ পর্যন্ত ইহা ব্যাপৃত। সাকারোপাসনা সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের সতত বিরুদ্ধভাব হইতেই ভারতে মুর্তিপূজার সূত্রপাত হইয়াছে। বেদে মূর্তিপূজার উল্লেখ নাই; স্রষ্টা এবং সখারূপে ঈশ্বরের অভাববোধের প্রতিক্রিয়া হইতেই শ্রেষ্ঠ আচার্যগণকে মূর্ত মূর্ত ঈশ্বর কল্পনা করিয়া লওয়া হইয়াছে। বুদ্ধদেব ঠিক এইভাবে মূর্ত ঈশ্বররূপে লক্ষ লক্ষ মানুষের দ্বারা অর্চিত হইতেছেন। হিংসামূলক সংস্কার-চেষ্টার দ্বারা প্রকৃত সংস্কার সর্বদাই বাধাপ্রাপ্ত হয়। অর্চনার প্রবৃত্তি প্রত্যেক মানুষেরই প্রকৃতিগত; উচ্চতম দার্শনিকতার সাহায্যেই শুধু শুদ্ধ ভাবময় অবস্থায় আরোহণ করা যায়। কাজেই পূজা করিবার জন্যই মানুষ তাহার ঈশ্বরকে ব্যক্তিভাবাপন্ন করিয়া লইবে। প্রতীক যেরূপই হউক না

কেন, ইহার অন্তরালে স্বয়ং ঈশ্বর আছেন—এইভাবে মূর্তিপূজা অতি উত্তম, প্রতীকের ভাবে নয়।

‘শাস্ত্রে আছে’—শুধু এই বিশ্বাসের কুসংস্কার হইতে সর্বোপরি নিজেদের মুক্ত করিতে হইবে। বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতিকে কোন শাস্ত্রের অনুশাসন মানিয়া লইতে বাধ্য করা অতি ভীষণ অত্যাচার। শাস্ত্রপূজা নিকৃষ্ট পুতুলপূজা। কোন গর্বিত ও স্বাধীনচিত্ত হরিণ তাহার শাবকটিকে কর্তৃত্বের ভাবে বলিতেছিল, ‘আমার দিকে চাহিয়া আমার এই সুদৃঢ় শৃঙ্গ-দুইটি দেখ! ইহাদের এক আঘাতেই আমি মানুষ মারিতে পারি। হরিণ হওয়া কি সুখের বিষয়!’ ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে শিকারীর ভেরীর শব্দ শুনিবামাত্র কোনদিকে না চাহিয়া হরিণ বেগে পলাইতে লাগিল, বিস্ময়াবিষ্ট শাবকটিও তাহার পিছন পিছন ছুটিতে লাগিল। নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়া শাবক জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি এত বলশালী ও সাহসী, তবু মানুষের শব্দ শুনিয়া পলায়ন করেন কেন?’ হরিণ বলিল, ‘বৎস, নিজের বল-বিক্রমের উপর আস্থা থাকিলেও কেন যে ঐ শব্দ শুনিলেই ইচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায়ই হউক, কি-একটা ভাবের বশে পলাইতে বাধ্য হই, তাহা জানি না।’ আমাদের দশাও ঐরূপ। শাস্ত্রনিবদ্ধ বিধির ‘ভেরী-রব’ শ্রবণমাত্রই প্রাচীন অভ্যাস ও সংস্কারগুলি যেন আমাদিগকে পাইয়া বসে এবং ইহা জানিবার পূর্বেই আমরা যেন দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া আমাদের যথার্থ স্বরূপ—মুক্ত অবস্থা বিস্মৃত হই।

জ্ঞান চিরন্তন। আধ্যাত্মিক সত্যের আবিষ্কারককে আমরা ‘প্রত্যাদিষ্ট’ বলি এবং তিনি জগৎকে যাহা দান করেন, তাহা ঐশ্বরিক বাণী। কিন্তু ঐশ্বরিক বাণী বা প্রত্যাদেশও চিরন্তন, সুতরাং ইহাকে শেষ জ্ঞান বলিয়া অন্ধভাবে অনুসরণ করা উচিত নয়। যিনি নিজেকে উপযুক্ত আধাররূপে প্রস্তুত করিয়াছেন, তাঁহার ভিতরেই ঐ ঐশ্বরিক ভাব প্রকাশ হইতে পারে। পরিপূর্ণ পবিত্রতা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন, কেন না ‘যাঁহাদের হৃদয় পবিত্র, তাঁহারাই ঈশ্বর দর্শন করিবেন।’ সকল প্রাণীর মধ্যে মনুষ্যই শ্রেষ্ঠ জীব, আর এই পৃথিবীই শ্রেষ্ঠ স্থান, কারণ এখানেই মানুষ মুক্তিলাভে সমর্থ। মানুষই ঈশ্বর সম্বন্ধে সর্বোচ্চ কল্পনা। যত কিছু গুণ ঈশ্বরে অর্পণ করি, সব অল্পমাত্রায় মানুষেই বিদ্যমান। যখন উচ্চস্তরে আরোহণ করি এবং এইরূপ ঈশ্বর-ধারণার

অতীত হই, তখন দেহ, মন ও কল্পনার বাহিরে গিয়া এ জগৎকে দেখি না। সেই পরম নিত্য ভাবে আরূঢ় হইলে আমাদের পার্থিব সম্বন্ধ থাকে না; তখন সবই বিষয়শূন্য বিষয়ীতে পর্যবসিত হয়। মুক্তিক্ষেদ্র এই জগতে মানুষই শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী। যাঁহারা সমত্ব বা পূর্ণত্ব লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা ‘ঈশ্বরে বাস করেন’ বলিয়া কথিত। ‘আত্মা দ্বারা আত্মাকে হনন’ই ঘৃণা। অতএব প্রেমই জীবনের নীতি। এই অবস্থায় উন্নীত হওয়াই পূর্ণত্ব লাভ করা; কিন্তু আমরা যত বেশী পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হইব, ততই নৈষ্কর্ম্য লাভ করিব। সাত্ত্বিক ব্যক্তি এ-জগৎকে শিশুর খেলা বলিয়া দেখেন ও জানেন এবং ইহা লইয়া মাথা ঘামান না। দুইটি কুকুরছানাকে পরস্পর মারামারি ও কামড়াকামড়ি করিতে দেখিলে আমরা বিশেষ বিস্মিত হই না। আমরা জানি ইহা গুরুতর ব্যাপার নয়। পূর্ণ-মানুষ জানেন এই সংসার মায়ার খেলা। জীবনকে সংসার বলে। বিরুদ্ধ শক্তিগুলির যে ক্রিয়া আমাদের উপর হইতেছে, তাহারই ফল এই জীবন। জড়বাদী বলে—মুক্তির কথা ভ্রমমাত্র। আদর্শবাদী বলে—বন্ধনের কথা স্বপ্নমাত্র। বেদান্ত প্রচার করে—একই কালে আমরা মুক্তও বটে, বদ্ধও বটে। ইহার অর্থ এই যে, জাগতিক স্তরে আমরা কখনও মুক্ত নই, কিন্তু অধ্যাত্ম-স্তরে চিরমুক্ত। আত্মা মুক্তি ও বন্ধন দুইয়ের অতীত। আমরা ব্রহ্মস্বরূপ, আমরা ইন্দ্রিয়াতীত অবিনশ্বর জ্ঞান-স্বরূপ—আমরা পরমানন্দ স্বরূপ।