০৪. আত্মা কি অমর ?

আত্মা কি অমর?

The New York Morning Advertiser পত্রিকায় এ-বিষয়ে যে আলোচনা হয়, তাহাতে যোগ দিয়া স্বামীজী এই প্রবন্ধ লিখেন।

বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি।—শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা ২/১৭ সংস্কৃত ভাষার সুপ্রসিদ্ধ মহাকাব্য মহাভারতে বর্ণিত আছে—কিরূপে(বকরূপী) ধর্ম কর্তৃক জগতের আশ্চর্যতম বিষয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইয়া ঐ মহাকাব্যের নায়ক যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন : জগতে সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয় এই যে, জীবনের প্রায় প্রতি মুহূর্তে চারিদিকে মৃত্যু ঘটিতেছে দেখিয়াও মানুষের অটল বিশ্বাস যে, সে নিজে মৃত্যুহীন। প্রকৃতপক্ষে ইহাই মানব-জীবনের প্রচণ্ড বিস্ময়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দর্শনে ইহার বিপক্ষে অশেষ প্রকার যুক্তি প্রদর্শিত হইলেও এবং ইন্দ্রিয়গত ও ইন্দ্রিয়াতীত জগতের মধ্যে চিরবিদ্যমান রহস্য-যবনিকা যুক্তিসহায়ে ভেদ করিতে অক্ষম হইলেও মানুষ দৃঢ়নিশ্চয় করিয়া বসিয়া আছে যে, সে কখনও মরিতে পারে না।

আমরা সমগ্র জীবন ব্যাপীয়া অনুশীলন করিতে পারি, তথাপি শেষ পর্যন্ত জন্ম-মৃত্যুর সমস্যাটিকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন যুক্তিমূলক প্রমাণের স্তরেই দাঁড় করাইতে পারি না। মানব-সত্তার স্থায়িত্ব বা অনিত্যতার পক্ষে বা বিপক্ষে আমরা যত খুশি লিখিতে, বলিতে প্রচার করিতে বা শিক্ষা দিতে পারি; ইহার যে কোন পক্ষ অবলম্বন করিয়া আমরা প্রচণ্ড বিরোধে মত্ত হইতে পারি; ইহার পূর্ব নাম অপেক্ষা ক্রমেই শত শত জটিলতর নূতন নূতন নাম আবিষ্কার করিয়া আমরা ক্ষণকালের জন্য আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে এই শান্তি লাভ করিতে পারি যে , আমরা চিরকালের জন্য সমস্যাটির সমাধান করিয়া ফেলিয়াছি; আমরা পূর্ণ উদ্যমে ধর্মরাজ্যের কোন একটি অদ্ভুত কুসংস্কারকে আঁকড়াইয়া ধরিতে পারি, অথবা ইহা অপেক্ষাও অধিকতর আপত্তিজনক কোন বৈজ্ঞানিক কুসংস্কারকে মানিয়া লইতে পারি, কিন্তু অবশেষে দেখিতে পাই—আমরা যুক্তিরূপ এক সঙ্কীর্ণ ক্রীড়াক্ষেত্রে এমন একটি অনন্ত কন্দুক-ক্রীড়ায় লিপ্ত রহিয়াছি, যাহাতে বুদ্ধিরূপ খুঁটিগুলিকে বারংবার দাঁড় করাইতে চেষ্টা করিতেছি, আর পরক্ষণেই উহারা কন্দুকাঘাতে ধরাশায়ী হইতেছে।

কিন্তু এই যে মানসিক শ্রম ও কষ্টভোগ, যাহা বহু ক্ষেত্রে ক্রীড়া অপেক্ষাও অধিকতর সঙ্কট উৎপন্ন করে, উহার পশ্চাতে এমন একটি সত্য আছে, যাহার সম্বন্ধে বাদবিসংবাদ করা চলে না, যাহা সমস্ত বিসংবাদের অতীত। আর ইহাই হইল মহাভারতে উল্লিখিত সেই সত্য—সেই অত্যাশ্চর্য ব্যাপার : মানুষের পক্ষে ধারণা করা অসম্ভব যে, সে শূন্যে বিলীন হইয়া যাইবে। এমন কি আমার নিজের বিনাশের কথা ভাবিতে গেলেও আমাকে সাক্ষিরূপে এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সেই বিনাশক্রিয়াটিকে দেখিতে হইব।

এখন এই অদ্ভুত ব্যাপারের অর্থ বুঝিবার পূর্বে এই একটি বিষয়ে অবহিত হওয়া আবশ্যক যে, সমগ্রজগৎ এই তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। বহির্জগতের সত্তা অপরিহার্যরূপে অন্তর্জগতের সত্তার সহিত বিজড়িত। এই উভয় সত্তার কোন একটিকে বাদ দিয়া এবং অপরটিকে স্বীকার করিয়া জগৎ সম্বন্ধে যে কোন মতবাদ গড়িয়া তুলিলে উহা আপাততঃ যতই বিশ্বাসযোগ্য মনে হউক, ঐ মতবাদের স্রষ্টা নিজেই দেখিতে পাইবেন, অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ—এই উভয় জগতের স্থায়িত্বকে যদি প্রেরণাশক্তির অন্যতম কারণরূপে স্বীকার না করা হয়, তবে তাঁহার স্বকল্পিত প্রক্রিয়া অবলম্বনে একটিও সচেতন ক্রিয়া সম্ভব নয়। যদিও ইহা সম্পূর্ণ সত্য যে, যখন মানব-মন আপন সীমাবদ্ধ ভাব অতিক্রম করে, তখন সে দেখে—দ্বৈত জগৎ এক অখণ্ড একত্বে পরিণত হইয়া গিয়াছে, তথাপি ঐ নিরপেক্ষ সত্তাকে তখন ইহজগতের দৃষ্টিতে দেখা হয়, এবং সমগ্র দৃশ্য জগৎ—অর্থাৎ আমাদের পরিচিত এই জগৎ, জ্ঞাতার জ্ঞেয় বিষয়মাত্ররূপেই জ্ঞাত হয় ও জ্ঞাত হইতে পারে। সুতরাং এই জ্ঞাতার ধ্বংসের কল্পনা করিতে পারার পূর্বে আমাদিগকে বাধ্য হইয়া জ্ঞেয় বিষয়ের ধ্বংস কল্পনা করিতে হইবে।

এ পর্যন্ত তো খুবই সহজ। ইহার পর ব্যাপারটি কঠিন হইয়া পড়িতেছে। সাধারণতঃ আমরা নিজদিগকে শরীর ব্যতীত অন্যকিছু ভাবিতে পারি না। আমি যখনই নিজেকে অমর বলিয়া ভাবি, তখন ‘আমি’ বলিতে দেহরূপ আমাদেরই গ্রহণ করি। কিন্তু শরীর যে সমগ্র প্রকৃতির মতোই অস্থায়ী এবং ইহা সর্বদা বিনাশের দিকেই অগ্রসর হইতেছে, ইহা তো প্রত্যক্ষ সত্য।

তাহা হইলে এই স্থায়িত্ব কোথায় নিহিত?
আমাদের জীবনের সঙ্গে এমন আর একটি আশ্চর্য বিষয়ের সংযোগ রহিয়াছে, যেটিকে বাদ দিলে ‘কে বাঁচিতে পারে, কে এক মুহূর্তের জন্যও জীবনে আনন্দ উপভোগ করিতে পারে?’ —সেটি হইল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

এই আমাঙ্ক্ষাই আমাদের প্রতি পদক্ষেপ নিয়মিত করে, আমাদের গতিবিধি সম্ভব করে, পরস্পরের সহিত আমাদের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। শুধু তাই নয়, ইহা যেন মানবজীবনরূপ বস্ত্রের টানা ও পোড়েন। বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান ইহাকে তিল তিল করিয়া নিজ ক্ষেত্র হইতে হটাইয়া দিতে চায়, ইহার রাজ্য হইতে একটির পর একটি দুর্গ অধিকার করিতে চায়, এবং(মানুষের)প্রতিটি পদক্ষেপ কার্য-কারণের রেলপথের লৌহবন্ধনে আবদ্ধ করে। কিন্তু আমাদের এ-সব প্রচেষ্টায় মুক্তি হাসিয়া উঠে, আর কি আশ্চর্য!মুক্তিকে যদিও আমরা অশেষ বিপুলভার বিধি ও কার্য-কারণের নিয়মের চাপে শ্বাসরুদ্ধ করিয়া হত্যা করিতে চাহিয়াছিলাম, তখাপি সে এখনও নিজেকে ঐগুলির ঊর্ধ্বে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। ইহার অন্যথা কিরূপে হইতে পারে? সসীমকে যদি নিজের অর্থ পরিস্ফুট করিয়া তুলিতে হয়, তাহা হইলে সর্বদাই তাহাকে অসীমের উচ্চতর ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিতে তাহা করিতে হইবে। বদ্ধ কেবল মুক্তের দ্বারাই ব্যাখ্যাত হইতে পারে। যাহা কার্যরূপে পরিণত হইয়া গিয়াছে, তাহা ব্যাখ্যাত হইতে পারে কার্যাতীত বস্তুর দ্বারা। এখানে আবার সেই একই অসুবিধা আসিয়া পড়িল। মুক্ত কে?—শরীর? অথবা মনও কি মুক্ত? ইহা সকলের কাছেই সুস্পষ্ট যে বিশ্বের অন্যান্য যে-কোন বস্তুর ন্যায় এই দুইটিও নিয়মের অধীন।

এখন সমস্যাটি একটি উভয়-সঙ্কটের আকার ধারণ করিতেছে। হয় বলো, সমগ্র বিশ্ব একটি সদা-পরিবর্তনশীল জড়সমষ্টি ব্যতীত আর কিছুই নয়, ইহা কার্য-কারণের অনিবার্য নিগড়ে চির আবদ্ধ, ইহার একটি কণিকারও কোন স্বতন্ত্র সত্তা নাই; অথচ অচিন্তনীয়রূপে ইহা নিত্যত্ব ও মুক্তির এক অবিচ্ছেদ্য প্রহেলিকা সৃজন করিয়া চলিয়াছে। অথবা বলো, এই বিশ্ব ও আমাদের মধ্যে এমন কিছু রহিয়াছে, যাহা নিত্য এবং মুক্ত। ফলে ইহাই প্রতিপন্ন হয়, মানুষের মনে নিত্যত্ব ও মুক্তি সম্বন্ধে যে স্বভাবসিদ্ধ মৌলিক বিশ্বাস রহিয়াছে, তাহা প্রহেলিকা নয়। বিজ্ঞানের কর্তব্য হইল উচ্চতর সামান্যীকরণের সাহায্যে জাগতিক ঘটনাগুলিকে ব্যাখ্যা করা। সুতরাং কোন ব্যাখ্যা-কালে যদি অপরাপর তথ্যের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যার জন্য উপস্থাপিত নূতন তথ্যের কিয়দংশকে নষ্ট করিয়া ফেলা হয়, তবে ঐ ব্যাখ্যা আর যাহা কিছু হউক, বিজ্ঞান-নামধেয় হইতে পারে না।

অতএব যে-কোন ব্যাখ্যাতে এই সদা-বিদ্যমান এবং সর্বদা-আবশ্যক মুক্তির ধারণাকে উপেক্ষা করা হয়, তাহা উপরি-উক্ত প্রকারে ভ্রান্ত, অর্থাৎ অপর তথ্যগুলির ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে উহা নূতন তথ্যের একাংশকে অস্বীকার করে; সুতরাং উহা ভ্রান্ত। অতএব আমাদের প্রকৃতির সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া একমাত্র অপর বিকল্পটি স্বীকার করা চলে, তাহা এই যে—আমাদের মধ্যে এমন কিছু আছে, যাহা মুক্ত এবং নিত্য।

———-

১ কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ। যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ। তৈত্তি. উপ.—২-৭

কিন্তু তাহা শরীর নহে, মনও নহে। শরীর প্রতি মুহূর্তে মরিতেছে, মন নিয়ত পরিবর্তনশীল। শরীর একটি যৌগিক পদার্থ, মনও তাই; অতএব তাহারা কখনও পরিবর্তনশীলতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে না। কিন্তু এই স্থূল জড়বস্তুর ক্ষণিক আবরণের ঊর্ধ্বে, এমন কি মনের সূক্ষতর আবরণেরও ঊর্ধ্বে, সেই আত্মা বিরাজমান, যাহা মানুষের প্রকৃত সত্তা, যাহা চিরস্থায়ী ও চিরমুক্ত। তাহারই মুক্ত স্বভাব মানুষের চিন্তা এবং বস্তুর স্তরের মধ্যে দিয়া অনুস্রুত হইতেছে এবং নামরূপের বর্নাপ্রলেপ সত্ত্বেও স্বীয় শৃঙ্খলহীন অস্তিত্ব ঘোষণা করিতেছে। অজ্ঞানের ঘনীভূত স্তরের আররণ সত্ত্বেও তাহারই অমরত্ব, তাঁহারই পরমানন্দ, তাঁহারই শান্তি, তাঁহারই ঐশ্বর্য উদ্ভাসিত হইয়া স্বীয় অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিতেছে। এই ভয়শূন্য, মৃত্যুহীন, মুক্ত আত্মাই প্রকৃত মানুষ।

যখন কোন বহিঃশক্তি কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না, কোনও পরিবর্তন ঘটাইতে পারে না, তখনই স্বাধীনতা বা মুক্তি সম্ভব। মুক্তি শুধু তাহারই পক্ষে সম্ভব, যে সর্বপ্রকার বন্ধনের—সমস্ত নিয়মের এবং কার্য-কারণের নিয়ন্ত্রনের অতীত। অর্থাৎ অন্য প্রকারে বলিতে গেলে বলা যায়, যে অবিকারী সেই শুধু মুক্ত এবং সেইজন্যই অমর হইতে পারে। মুক্ত অবিকারী ও বন্ধনহীন এই যে জীবাত্মা, এই যে মানবাত্মা, ইহাই মানুষের প্রকৃত স্বরূপ; ইহারই জন্মও নাই, মৃত্যুও নাই।

‘এই মানবাত্মা অজ, অমর, শাশ্বত ও সনাতন।’