০০. উপক্রমণিকা

যোগসূত্র-ব্যাখ্যার চেষ্টা করবার পূর্বে, যোগীদের সমগ্র ধর্মমত যে ভিত্তির উপর স্থাপিত, আমি সেই বিরাট প্রশ্নটির আলোচনা করিতে চেষ্টা করিব। জগতের শ্রেষ্ঠ মনীষিবৃন্দ সকলেই এ-বিষয়ে একমত বলিয়া বোধ হয়, আর জড় প্রকৃতি সম্বন্ধে অনুসন্ধানের ফলে ইহা একরূপ প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে যে, আমরা আমাদের বর্তমান সবিশেষ ভাবের পশ্চাতে অবস্থিত এক নির্বিশেষ ভাবের বহিঃপ্রকাশ ও ব্যক্তভাবস্বরূপ; আবার সেই নির্বিশেষভাবে প্রত্যাবৃত্ত হইবার জন্য আমরা ক্রমাগত অগ্রসর হইতেছি। যদি এইটুকু স্বীকার করা যায়, তাহা হইলে প্রশ্ন এই-উক্ত নির্বিশেষ অবস্থা উচ্চতর, না বর্তমান অবস্থা? এমন লোকের অভাব নাই, যিনি মনে করেন এই ব্যক্ত অবস্থাই মানুষের সর্বোচ্চ অবস্থা। অনেক শক্তিমান্ মনীষীর মত-আমরা এক নির্বশেষ সত্তার ব্যক্তভাব, এবং নির্বিশেষ অবস্থা অপেক্ষা এই সবিশেষ অবস্থা শ্রেষ্ঠ। তাঁহারা মনে করেন, নির্বিশেষ সত্তার কোন গুণ থাকিতে পারে না, সুতরাং উহা নিশ্চয়ই অচৈতন্য, জড় ও প্রাণশূন্য। তাঁহারা আরও মনে করেন, এই জীবনেই কেবল সুখভোগ সম্ভব, সুতরাং ইহাতেই আমাদের আসক্ত হওয়া উচিত। প্রথমেই আমরা অনুসন্ধান করিতে চাই, জীবন-সমস্যার আর কি কি সমাধান আছে? এ সন্বন্ধে এক অতি প্রাচীন সিদ্ধান্ত এই যে, মৃত্যুর পর মানুষ পূর্বের মতোই থাকে, তবে তাহার অশুভগুলি থাকে না, কেবল যেগুলি ভাল, সেগুলি সবই চিরকালের জন্য থাকিয়া যায়। যুক্তি বা ন্যায়ের ভাষায় এই সত্যটি স্থাপন করিলে এইরূপ দাঁড়ায় যে, মানুষের লক্ষ্য এই জগৎ। এই জগতেরই কিছু উচ্চাবস্থা এবং ইহার মন্দ অংশ বাদ দিলে যাহা থাকে, তাহাকেই স্বর্গ বলে। এই মতটি যে অসম্ভব ও বালজনোচিত তাহা অতি সহজেই বুঝা যায়; কারণ এরূপ হইতে পারে না। ভাল নাই অথচ মন্দ আছে, বা মন্দ নাই অথচ ভাল আছে-এরূপ হইতেই পারে না। কিছু মন্দ নাই, সব ভাল-এরূপ জগতে বাস করার কল্পনাকে ভারতীয় নৈয়ায়িকগণ ‘আকাশ-কুসুম’ বলিয়া বর্ণনা করেন। আধুনিকাকালে আর একটি মত অনেক সম্প্রদায় কর্তৃক উপস্থাপিত হয়, তাহা এই-মানুষ ক্রমাগত উন্নতি করিবে, চরম লক্ষ্যে পৌঁছিবার চেষ্টা করিবে, কিন্তু কখনও সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিবে না, ইহাই মানুষের নিয়তি। এই মতও আপাততঃ অতি উপাদেয় বলিয়া বোধ হইলেও অসম্ভব, কারণ সরল রেখায় কোন গতি হইতে পারে না। সমুদয় গতিই বৃত্তাকারে হইয়া থাকে। যদি তুমি একটি প্রস্তর আকাশে নিক্ষেপ কর, তারপর যদি তুমি দীর্ঘকাল বাঁচিয়া থাকো ও প্রস্তরটি কোন বাধা না পায়, তবে উহা ঠিক তোমার হাতে ফিরিয়া আসিবে। একটি সরল রেখাকে অসীমভাবে বর্ধিত করা হইলে উহা একটি বৃত্তরূপে পরিণত হইয়া শেষ হইবে। অতএব মানুষ ক্রমাগত উন্নতির দিকে অগ্রসর হইতেছে, কখনও থামে না-এইরূপ মত অসম্ভব। অপ্রাসঙ্গিক হইলেও আমি মন্তব্য করিতে পারি, ‘কাহাকেও ঘৃণা করিও না, সকলকে ভালবাসিও’-নীতিশাস্ত্রের এই মতবাদটি পূর্বোক্ত মতদ্বারা ব্যাখ্যাত হইয়া যায়। যেমন তড়িৎ সম্বন্ধে আধুনিক মত এই যে, ঐ শক্তি বিদ্যুদাধার-যন্ত্র (dynamo) হইতে বহির্গত হইয়া আবার সেই যন্ত্রে প্রত্যাবৃত্ত হয়-ঘৃণা ও ভালবাসা ঠিক সেইরূপ। সমুদয় শক্তিই আবার উৎসমুখে ফিরিয়া আসিবে। অতএব কাহাকেও ঘৃণা করিও না, কারণ যে ঘৃণা তোমা হইতে বহির্গত হয়, তাহা কালে তোমারই নিকট ফিরিয়া আসিবে। যদি তুমি ভালবাসো, তবে সেই ভালবাসাও তোমার নিকট ফিরয়া আসিবে। ইহা অতি নিশ্চিত যে, মানুষের অন্তঃকরণ হইতে যে ঘৃণা বহির্গত হয়, তাহার অণুপরমাণু ফিরিয়া আসিয়া তাহার উপর পূর্ণ বিক্রমে প্রভাব বিস্তার করিবে। কেহই ইহার গতি রোধ করিতে পারে না। একইভাবে ভালবাসার প্রতিটি স্পন্দনও ফিরিয়া আসিবে।

‘অনন্ত উন্নতি’-সম্বন্ধীয় মত যে স্থাপন করা অসম্ভব, তাহা আরও অন্যান্য প্রত্যক্ষের উপর স্থাপিত অনেক যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা যাইতে পারে। প্রত্যক্ষ দেখা যাইতেছে-বিনাশই পার্থিব সকল বস্তুর চরম গতি, অতএব অনন্ত উন্নতির মতটি কোনমতেই টিকিতে পারে না। আমাদের নানাপ্রকার চেষ্টা, আমাদের এই-সব আশা, এত ভয়, এত সুখ-এ-সবের পরিণাম কি? মৃত্যুই আমাদের সকলের চরম পরিণাম। ইহা অপেক্ষা সুনিশ্চিত আর কিছুই নাই। তবে এই সরল রেখায় গতির কি হইল? অনন্ত উন্নতির কি হইল?-কিছুদূর যাওয়া, আবার যেখানে হইতে গতি আরম্ভ হইয়াছিল, সেই স্থানে ফিরিয়া আসা। দেখ-নীহারিকা (nobulae) হইতে সূর্য, চন্দ্র, তারা উৎপন্ন হইতেছে, পরে নীহারিকাতেই ফিরিয়া আসিতেছে। সর্বত্রই এইরূপ চলিতেছে। উদ্ভিদ্ মত্তিকা হইতেই উপাদান সংগ্রহ করিতেছে, আবার যখন সংগঠন ভাঙিয়া যায়, তখন মাটিতেই সব ফিরাইয়া দিতেছে। যাহা কিছু আকার পরিগ্রহ করিতেছে, তাহাই পরমাণু হইতে উৎপন্ন হইয়া আবার সেই পরমাণুতেই ফিরিয়া যাইতেছে।

একই নিয়ম বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে কার্য করিবে, তাহা হইতে পারে না। নিয়ম সর্বত্রই একরূপ। ইহা অপেক্ষা নিশ্চয় আর কিছুই নাই। ইহা যদি প্রকৃতির নিয়ম হয়, তাহা হইলে অন্তর্জগতেরও এ নিয়ম খাটিবে। চিন্তা ইহার উৎপত্তি-স্থানে গিয়া লয় পাইবে। আমরা ইচ্চা করি বা না করি, আমাদিগকে আমাদের সেই আদিতে-পরমসত্তা ঈশ্বরে ফিরিয়া যাইতে হইবে। আমরা ঈশ্বর হইতে আসিয়াছি, আমাদিগকে পুনরায় ঈশ্বরে ফিরিয়া যাইতেই হইবে। তাঁহাকে যে নামেই ডাকো না কেন-তাঁহাকে ‘গড’ বা ঈশ্বর বলো, নির্বিশেষ বা পরম সত্তা বলো, আর প্রকৃতিই বলো, উহা সেই একই বস্তু। ‘যাঁহা হইতে এই বিশ্বজগৎ উৎপন্ন হইয়াছে, যাঁহাতে সমুদয় প্রাণী অবস্থান করিতেছে ও যাঁহাতে আবার সব কিছু ফিরিয়া যাইবে।’ইহা অপেক্ষা নিশ্চয় আর কিছুই হইতে পারে না। প্রকৃতি সর্বত্র এক নিয়মে কার্য করিয়া থাকে। এক স্তরে যে কার্য হইতেছে, অন্য লক্ষ লক্ষ স্তরেও তাহাই পুনরাবর্তিত হয়। গ্রহসমূহে যাহা দেখিতে পাও, এই পৃথিবীতে-সকল মনুষ্যে ও সর্বত্র সেই একই ব্যাপার চলিতেছে। বৃহৎ তরঙ্গ ক্ষদ্র ক্ষুদ্র বহু তরঙ্গের এক মহাসমষ্টি মাত্র। জগতের জীবন বলিতে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র জীবনের সমষ্টিমাত্র বুঝায়। আর জগতের মৃত্যু বলিতে এই-সকল লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র জীবের মৃত্যুই বুঝায়।


১ ‘যতো বা ইমানি ভুতানি জায়ন্তে। যেন জাতানি জীবন্তি। যৎ প্রয়ন্ত্যতিসংবিশন্তি’-তৈত্তি উপ, ৩।১

এখন প্রশ্ন উঠিতেছে-এই ভগবানে প্রত্যাবর্তন উচ্চতর অবস্থা কিনা? যোগমতাবলন্বী দার্শনিকগণ এ কথার উত্তরে দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘হাঁ, উহা উচ্চাবস্থা।’ তাঁহারা বলেন, ‘মানুষের বর্তমান অবস্থা একটি অধঃপতিত অবস্থা।’ জগতে এমন কোন ধর্ম নাই, যাহা বলে-মানুষ পূর্বে যাহা ছিল তদপেক্ষা উন্নত হইয়াছে। ভাবটি এই যে, আদিতে মানুষ শুদ্ধ ও পূর্ণ ছিল, পরে ক্রমাগত অবনত হইতে থাকে, এতদূর নীচে যায়, যাহার নীচে সে আর যাইতে পারে না। পরে এমন এক সময় আসিবেই আসিবে, যখন সে সবেগে আবার উপরে উঠিতে থাকিবে এবং বৃত্ত-গতি সম্পূর্ণ করিয়া পূর্ব স্থানে উপনীত হইবে। বৃত্তাকারে গতি পূর্ণ করিতেই হইবে। মানুষ যত নীচেই নামিয়া যাক না কেন, শেষ পর্যন্ত তাহাকে ঊর্ধ্বগতি লাভ করিয়া আদি কারণ ভগবানে ফিরিয়া যাইতে হইবে। মানুষ প্রথমে ভগবান্ হইতে আসে, মধ্যে সে মনুষ্যরূপ লাভ করে, পরিশেষে পুনরায় ভগবানে প্রত্যাবর্তন করে। দ্বৈতবাদের ভাষায় তত্ত্বটি এইভাবেই বলা হয়। অদ্বৈতবাদের ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয়ঃ মানুষই ব্রহ্ম, আবার ব্রহ্মভাবে ফিরিয়া যায়। যদি আমাদের বর্তমান অবস্থাটিই উচ্চতর অবস্থা হয়, তাহা হইলে জগতে এত দুঃখ কষ্ট, এত ভয়াবহ ব্যাপার সকল রহিয়াছে কেন? আর ইহার অন্তই বা হয় কেন? যদি এইটিই উচ্চতর অবস্থা হয়, তবে ইহার শেষ হয় কেন? যেটি বিকৃত ও অবনত হয়, সেটি কখনও সর্বোচ্চ অবস্থা হইতে পারে না। এই জগৎ এত পৈশাচিক-ভাবাপন্ন-এত অতৃপ্তিকর কেন? এই-বিষয়ে এইটুকু বলা যাইতে পারে যে, ইহার মধ্য দিয়া আমরা একটি উচ্চতর পথে উঠিতেছি। নবজীবন লাভ করিবার জন্যই এই অবস্থার ভিতর দিয়া আমাদিগকে চলিতে হইবে। ভূমিতে বীজ পুঁতিয়া দাও, উহা বিশ্লিষ্ট হইয়া কিছুকাল পরে একেবারে মাটির সহিত মিশিয়া যাইবে, আবার সেই বিশ্লিষ্ট অবস্থা হইতে এক মহাবৃক্ষ উৎপন্ন হইবে। ব্রহ্মভাবাপন্ন হইতে হইলে প্রত্যেক জীবাত্মাকেই ঐ বিশ্লেষণের ভিতর দিয়া যাইতে হইবে। ইহা হইতে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, আমরা যত শীঘ্র এই ‘মানব’-সংজ্ঞক অবস্থাবিশেষকে অতিক্রম করিতে পারি, ততই আমাদের মঙ্গল। তবে কি আত্মহত্যা করিয়া আমরা এ অবস্থা অতিক্রম করিব? কখনই নয়। উহাতে বরং আরও অনিষ্ট হইবে। শরীরকে অনর্থক পীড়া দেওয়া, অথবা জগৎকে গালাগালি দেওয়া, ইহার বাহিরে যাওয়ার উপায় নয়। আমাদিগকে নৈরাশ্যের পঙ্কল হ্রদের দিয়া যাইতে হইবে; আর যত শীঘ্র ইহা অতিক্রম করিতে পারি-ততই মঙ্গল। কিন্তু এটি যেন সর্বদা স্মরণ থাকে যে, আমাদের এই মনুষ্য-অবস্থা সর্বোচ্চ অবস্থা নয়।

ইহার মধ্যে এইটুকু বোঝা বাস্তবিক কঠিন যে, নির্বিশেষ অবস্থাকে সর্বোচ্চ অবস্থা বলা হয়, তাহা অনেক যেরূপ আশঙ্কা করেন-প্রস্তর বা স্পঞ্জ প্রভৃতির অবস্থার মতো নয়। তাঁহাদের মতে জগতে মাত্র দুই প্রকার অস্তিত্ব আছে-এক প্রকার প্রস্তরাদির ন্যায় জড় ও অপর প্রকার চিন্তাবিশিষ্ট। অস্তিত্বকে এই দুই প্রকারে সীমাবদ্ধ করিবার কি অধিকার তাঁহাদের আছে? চিন্তা হইতে অনন্ত গুণ উৎকৃষ্ট অবস্থা কি নাই? আলোকের কম্পন অতি মৃদু হইলে আমরা দেখিতে পাই না, যখন ঐ কম্পন অপেক্ষাকৃত তীব্র হয়- তখনই আমাদের চক্ষে উহা আলোকরূপে প্রতিভাত হয়। যখন আরও তীব্র হয়, তখনও আমরা উহা দেখিতে পাই না, উহা আমাদের চক্ষে অন্ধকারবৎ প্রতীয়মান হয়। এই শেষোক্ত অন্ধকার কি ঐ প্রথমোক্ত অন্ধকারেরই মতো? নিশ্চয়ই নয়। উহারা দুই মেরুপ্রান্তের ন্যায় ভিন্ন। প্রস্তরের চিন্তাশূন্যতা ও ভগবানের চিন্তাশূনতা কি একই প্রকারের? কখনই নয়। ভগবান চিন্তা করেন না; বিচার করেন না। কেন করিবেন? তাঁহার নিকট কি কিছু অজ্ঞাত আছে যে, তিনি বিচার করিবেন? প্রস্তর বিচার করিতে পারে না, আর ঈশ্বর বিচার করেন না-এই পার্থক্য। পূর্বোক্ত দার্শনিকেরা মনে করেন যে, চিন্তার বাহিরে যাওয়া অতি ভয়াবহ ব্যাপার, তাঁহারা চিন্তার অতীত কিছু খুঁজিয়া পান না।

যুক্তিবিচারকে অতিক্রম করিয়া অনেক উচ্চতর অবস্থা রহিয়াছে। বাস্তবিক, বুদ্ধির অতীত প্রদেশেই আমাদের প্রথম ধর্মজীবন আরম্ভ হয়। যখন তুমি চিন্তা, বুদ্ধি, যুক্তি-সমুদয় অতিক্রম করিয়া চলিয়া যাও, তখনই তুমি ভগবৎ-প্রাপ্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ করিলে। ইহাই জীবনের প্রকৃত আরম্ভ। যাহাকে সাধারণতঃ জীবন বলা হয়, তাহা প্রকৃত জীবনের ভ্রূণাবস্থা মাত্র।

এখন প্রশ্ন হইতে পারে যে, চিন্তা ও বিচারের অতীত অবস্থাটি যে সর্বোচ্চ অবস্থা, তাহার প্রমাণ কি? প্রথমতঃ জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ-যাহারা কেবল বাক্য-বায় করিয়া থাকে, তাহাদের অপেক্ষা মহত্তর ব্যক্তিগণ-নিজ শক্তিবলে যাঁহারা সমগ্র জগৎকে পরিচালিত করিয়াছেন, যাঁহাদের চিন্তায় স্বার্থের লেশমাত্র ছিল না, তাঁহারা সকলেই ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন যে, এই জীবন সেই অনন্তস্বরূপে পৌঁছিবার পথে একটি ছোট সোপান মাত্র। দ্বিতীয়তঃ তাঁহারা কেবল এইরূপ বলেন তাহা নয়, পরন্তু তাঁহারা সকলকেই সেই পথ দেখাইয়া দেন, তাঁহাদের সাধন-প্রণালী বুঝাইয়া দেন, যাহাতে সকলেই তাঁহাদের অনুসরণ করিয়া চলিতে পারে। তৃতীয়তঃ আর কোন পথ নাই। জীবনের আর কোন প্রকার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। যদি স্বীকার করা যায় যে, ইহা অপেক্ষা উচ্চতর অবস্থা আর নাই, তবে জিজ্ঞাস্য এই যে, আমরা চিরকাল এই চক্রের ভিতর ঘুরিতেছি কেন? কোন্ যুক্তি দ্বারা এই জগতের ব্যাখ্যা করা যায়? যদি আমাদের ইহা অপেক্ষা অধিক দূরে যাইবার শক্তি না থাকে, যদি আমাদের ইহা অপেক্ষা অধিক কিছু প্রার্থনা করিবার না থাকে, তাহা হইলে এই পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎই আমাদের জ্ঞানের চরম সীমা হইয়া থাকিবে। ইহাকেই অজ্ঞেয়বাদ বলা হয়। ইন্দ্রিয়ের সাক্ষ্যে বিশ্বাস করিতেই হইবে, এমন কী যুক্তি আছে? আমি তাঁহাকেই যথার্থ অজ্ঞেয়বাদী বলিব, যিনি পথে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া মরিতে পারেন। যদি যুক্তিই আমাদের সর্বস্ব হয়, তবে শূন্যবাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া আমরা কোথাও দাঁড়াইতে পারি না। কেবল অর্থ, যশ, নামের আকাঙ্খা ব্যতীত অপর সব বিষযে যদি কেহ নাস্তিক হয়, তবে সে একটি জুয়াচোর মাত্র। ক্যান্ট (Kant) নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়াছেন যে, আমরা যুক্তিরূপ বিরাট পাষাণ-প্রাচীর ভেদ করিয়া তাহা অতিক্রম করিতে পারি না। কিন্তু ভারতীয় দার্শনিকগণের প্রথম কথা : আমরা যুক্তিকে অতিক্রম করিতে পারি। যোগীরা অতি সাহসের সহিত অন্বেষণে প্রবৃত্ত হন এবং এমন এক বস্তু লাভ করিতে সমর্থ হন, যাহা যুক্তির ঊর্ধ্বে, সেখানেই আমাদের বর্তমান অবস্থার কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায়। যাহা আমাদিগকে জগতের বাহিরে লইয়া যায়, এমন বিষয় শিক্ষা করিবার ইহাই ফল। ‘তুমি আমাদের পিতা, তুমি আমাদিগকে অজ্ঞানের পরপারে লইয়া যাইবে।’ ইহাই ধর্মবিজ্ঞান, অন্য কিছু নয়।


১ ‘ত্বং হি নঃ পিতা, যোহস্মাকমবিদ্যায়াঃ পারং পারং তারয়সীতি’-প্রশ্নোপনিষদ্, ৬।৮