০৫. পঞ্চম পাঠ

প্রত্যাহার ও ধারণা। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘যে যে-পথ দিয়েই সন্ধান করুক, সকলেই আমার কাছে পৌঁছবে-সকলেই আমার কাছে পৌঁছবে।’ প্রত্যাহার হচ্ছে মনকে গুটিয়ে এনে ঈপ্সিত বস্তুতে কেন্দ্রীভূত করবার চেষ্টা। এর প্রথম ধাপ-মনকে ছেড়ে দিয়ে তার উপর নজর রাখা এবং দেখা-মন কি ভাবে। যখনই কোন চিন্তার উপর বিশেষ নজর দেবে, অমনি সে চিন্তা বন্ধ হয়ে যাবে; কিন্তু চিন্তাগুলিকে জোর ক’রে বন্ধ করবার চেষ্টা ক’রো না, কেবল সাক্ষী হয়ে দেখে যাও। মন তো আর আত্মা নয়, মন হচ্ছে জড়ের একটু সূক্ষ্ম অবস্থামাত্র। স্নায়ুশক্তি দিয়ে একে আয়ত্ত ক’রে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মনকে কাজে লাগানোর উপায় শিখে নিতে পারি।

দেহ হচ্ছে মনের (ব্যক্তিভাবের)বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু আমরা আত্মা, দেহ-মনের অতীত; আমরা অনন্ত, অপরিবর্তনীয় সাক্ষিস্বরূপ আত্মা। দেহটা চিন্তারই ঘনীভূত রূপ।

যখন বাম নাসা দিয়ে নিঃশ্বাস পড়বে তখন বিশ্রামের সময়, যখন দক্ষিণ নাসা দিয়ে পড়বে তখন কাজের সময়, যখন দুই নাসা দিয়েই পড়বে তখন ধ্যানের সময়। যখন দেহ-মন শান্ত হয়ে আসবে আর দুই নাসা দিয়েই সমানভাবে নিঃশ্বাস পড়বে, তখন বুঝতে হবে ঠিক ঠিক ধ্যানের অবস্থা হয়েছে। প্রথমেই জোর ক’রে মনকে একাগ্র করবার চেষ্টা ক’রে কোন লাভ নেই। চিন্তার নিয়ন্ত্রণ আপনিই হবে।

অঙ্গুষ্ঠ ও অনামিকার সাহায্যে বহুদিন এই প্রাণায়াম অভ্যাস করবার পর, কেবল চিন্তার মধ্য দিয়ে ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই ঐরকম করা যেতে পারে।

প্রাণায়ামের এইবার একটু পরিবর্তন দরকার। যে-সব সাধক ইষ্টমন্ত্র পেয়েছে, তারা রেচক ও পূরকের সময় ‘ওঁ’কারের পরিবর্তে ইষ্টমন্ত্র এবং কুম্ভকের সময় ‘হুঁ’ মন্ত্র জপ করবে।

কুম্ভকের সময় যখন ‘হুঁ’ মন্ত্র জপ করবে, তখন মনে মনে কল্পনা করবে, সেই ধৃত নিঃশ্বাস পুনঃপুনঃ কুন্ডলিনীর মাথায় আঘাত করছে এবং তার দ্বারা তিনি যেন জাগরিত হচ্ছেন। শুধু ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন মনে কর। ধ্যান করবার কিছুক্ষণ পরে আমরা বুঝতে পারবো যে, চিন্তাগুলি আসছে; কি ক’রে চিন্তাগুলি উঠছে আর আমরা কি-ই বা চিন্তা করতে যাচ্ছি, তাও বুঝতে পারবো। জাগ্রত অবস্থায় যেমন আমরা তাকিয়ে দেখতে পাই যে, একটা লোক আসছে, এও অনেকটা তেমনি। যখন আমরা মন থেকে আত্মাকে পৃথক্ করতে পারবো, যখন আমরা বুঝতে পারবো যে, আমরা ও আমাদের চিন্তা সম্পূর্ন আলাদা জিনিস, তখনই আমরা ঐ অবস্থায় পৌঁছেছি। চিন্তাগুলি যেন তোমাকে পেয়ে না বসে; সর্বদা তাদের পাশ কাটাবে, তা হলেই তারা আপনি বিলীন হয়ে যাবে।

সৎ চিন্তাগুলি অনুসরণ কর; তাদের সঙ্গে সঙ্গে যাও। যখন তারা স্তিমিত হয়ে যাবে, তখন সর্বশক্তিমান্ ভগবানের শ্রীচরণ দেখতে পাবে। এই হচ্ছে অতিচেতন অবস্থা। ভাব যখন স্তিমিত হয়ে আসবে, তখন তার অনুসরণ কর, আর সঙ্গে সঙ্গে তুমিও বিলীন হয়ে যাও।

দ্যুতি হচ্ছে অন্তর্জ্যোতির প্রতীক, যোগী তা দেখতে পান কখন কখন এমন


১ ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম’-গীত, ৪।১১

একখানি মুখ আমরা দেখতে পাই, তা যেন জ্যোতি দিয়ে ঘেরা, তার মধ্যে আমরা চরিত্র পাঠ ক’রে নির্ভুল সিদ্ধান্ত করতে পারি। ভাবচক্ষে হয়তো ইষ্টমূর্তি আমাদের সামনে আসতে পারেন, সহজেই তাঁকে প্রতীকরূপে গ্রহণ ক’রে আমরা মনকে সম্পূর্ণরূপে একাগ্র করতে পারি।

যদিও আমরা সকল ইন্দ্রিয় দ্বারাই কল্পনা করতে পারি, তথাপি চোখ দিয়েই বেশির ভাগ কল্পনা করি। এমন কি, কল্পনা পর্যন্ত অর্ধেক জড়। আর এক ভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, মানসিক চিত্র ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। পশুরা চিন্তা করে ব’লে বোধ হয়, কিন্তু তাদের যখন ভাষা নেই, তখন মনে হয়-ভাব ও প্রতীকের মধ্যে কোন বিশেষ অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ নেই।

যোগের সময় কল্পনাকে ধ’রে রাখবার চেষ্টা করবে, কিন্তু সাবধান, তা যেন পবিত্র হয়। আমাদের প্রত্যেকেরই কল্পনাশক্তির বৈশিষ্ট আছে; তোমার পক্ষে যে পথ খুব স্বাভাবিক, তাই অনুসরণ কর; সেটাই তোমার পক্ষে সব চেয়ে সোজা হবে।

পূর্ব পূর্ব সব জন্মের কর্মের শেষ ফল আমাদের এই বর্তমান জীবন। বৌদ্ধেরা বলেন, ‘এক প্রদীপ থেকে আর এক প্রদীপ জ্বলে ওঠে।’ প্রদীপ আলাদা, কিন্তু আলো সেই একই। সর্বদা প্রফুল্ল ও সাহসী থাকবে, রোজ স্নান করবে; ধৈর্য, পরিত্রতা, অধ্যবসায়-এই সব থাকলে তবে ঠিক ঠিক যোগী হ’তে পারবে। কখনও তাড়াতাড়ি ক’রো না। অলৌকিক শক্তি এলে মনে করবে ওগুলি বিপথ; তারা যেন তোমায় লুব্ধ ক’রে আসল পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে না যায়। তাদের দূরে সরিয়ে দিয়ে তোমার যে একমাত্র লক্ষ্য -ভগবান্, তাঁকেই ধ’রে থাকবে। কেবল সেই চিরন্তনকে খোঁজ, যাঁর সন্ধান পেলে আমাদের চিরবিশ্রাম লাভ হয়। পূর্নত্ব লাভ করবার পর আর কিছুই কাম্য থাকে না, যার জন্য চেষ্টা করতে হবে; তখন আমরা চিরমুক্ত-সত্তাস্বরূপ।

সৎস্বরূপ,চিৎস্বরূপ,আনন্দস্বরূপ।