০৩. বসন ভূষণ বিলাস-ব্যসন

একাদশ অধ্যায় । দৈনন্দিন জীবন
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – বসন ভূষণ বিলাস-ব্যসন

কাশ্মীরে গৌড়ীয় বিদ্যার্থী

পূর্বের এক অধ্যায়ে দেশ-পরিচয় প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকপ্রকৃতির কথা বলিয়াছি। এখানে আর তাহার পুনরুক্তি করিব না। শুধু কাশ্মীরী কবি ক্ষেমেন্দ্র তাঁহার দশোপদেশ-গ্রন্থে কাশ্মীর-প্রবাসী গৌড়ীয় বিদ্যার্থীদের যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহার পুনরুল্লেখ করিতেছি একটু সবিস্তারে। দশম-একাদশ শতকে প্রচুর গৌড়ীয় বিদ্যার্থী কাশ্মীরে যাইতেন বিদ্যালাভের জন্য। ক্ষেমেন্দ্র বলিতেছেন, ইঁহাদের প্রকৃতি ও ব্যবহার ছিল রূঢ় এবং অমার্জিত। ইঁহারা ছিল অত্যন্ত ছুঁৎমার্গী; ইহাদের দেহ ক্ষীণ, কঙ্কালমাত্র সার, এবং একটু ধাক্কা লাগিলেই ভাঙিয়া পড়িবেন, এই আশঙ্কায় সকলেই ইঁহাদের নিকট হইতে দূরে দূরে থাকিতেন। কিন্তু কিছুদিন প্রবাসযাপনের পরই কাশ্মীরী জল-হাওয়ায় ইঁহারা বেশ মেদ ও শক্তিসম্পন্ন হইয়া উঠিতেন। ‘ওঙ্কার’ ও ‘স্বস্তি’ উচ্চারণ যদিও ছিল ইঁহাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কর্ম, তবু পাতঞ্জলভাষ্য, তর্ক, মীমাংসা সমস্ত শাস্ত্রই তাঁহাদের পড়া চাই (বোধ হয়, কাশ্মীরী মানদণ্ডে বাঙালীর সংস্কৃতি উচ্চারণ যথেষ্ঠ শুদ্ধ ও মার্জিত ছিল না; ইহারি সম্ভবত ক্ষেমেন্দ্রের বক্রোক্তির কারণ)। ক্ষেমেন্দ্র আরও বলিতেছেন, গৌড়ীয় বিদ্যার্থীরা ধীরে ধীরে পথ চলেন এবং থাকিয়া থাকিয়া তাঁহাদের দর্পিত মাথাটি এদিক্‌ সেদিক্‌ দোলান! হাঁটিবার সময় তাঁহাদের ময়ূরপঙ্খী জুতায় মচ্‌মচ্‌ শব্দ হয়। মাঝে মাঝে তিনি তাঁহার সুবেশ সুবিন্যস্ত চেহারাটার দিকে তাকাইয়া দেখেন। তাঁহার ক্ষীণ কটিতে লাল কটিবন্ধ। তাঁহার নিকট হইতে অর্থ আদায় করিবার জন্য ভিক্ষু এবং অন্যান্য পরাশ্রয়ী লোকেরা তাঁহার তোষামোদ করিয়া গান গায় ও ছড়া বাঁধে। কৃষ্ণ বর্ণ ও শ্বেতদন্তপংক্তিতে তাঁহাকে দেখায় যেন বানরটি। তাঁহার দুই কর্ণলতিকায় তিন তিনটি করিয়া স্বর্ণ কর্ণভূষণ, হাতে ষষ্ঠি; দেখিয়া মনে হয় যেন সাক্ষাৎ কুবের। স্বল্পমাত্র অজুহাতেই তিনি রোষে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠেন; সাধারণ একটি কলহেই ক্ষিপ্ত হইয়া ছুরিকাঘাতে নিজের সহআবাসিকের পেট চিরিয়া দিতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেন না। গর্ব করিয়া তিনি নিজের পরিচয় দেন ঠক্কুর বা ঠাকুর বলিয়া এবং কম দাম দিয়া বেশি জিনিস দাবি করিয়া দোকানদারদের উত্যক্ত করেন।
বিদেশে বাঙালী বিদ্যার্থীর বসনভূষণ সম্বন্ধে আংশিক পরিচয় এই কাহিনীর মধ্যে পাওয়া যায়; কিন্তু তাহার বিস্তৃত পরিচয় লইতে হইলে বাঙলাদেশের সমসাময়িক সাহিত্যগ্রন্থের এবং প্রত্নবস্তুর মধ্যে অনুসন্ধান করিতে হইবে। এই সব সাক্ষ্য হইতে বসনভূষণের মোটামুটি একটা ছবি দাঁড় করানো কঠিন নয়।

 

বসন ও পরিধানভঙ্গি

গ্রন্থারম্ভে এক অধ্যায়ে বলিয়াছি, পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা বস্ত্র পরিধানের রীতি আদিমকালে ছিল না; সেলাইবিহীন একবস্ত্র পরাটাই ছিল পুরারীতি। সেলাই করা জামা বা গাত্রাবরণ মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম ভারত হইতে পরবর্তী কালে আমদানী করা হইয়াছিল; কিন্তু অধোবাসের ক্ষেত্রে বাঙালী অথবা তামিল অথবা গুজ্‌রাতী-মারাঠীরা ধুতি পরিত্যাগ করিয়া ঢিলা বা চুড়িদার পাজামা গ্রহণ করেন নাই। পুরুষের অধোবাসে যেমন ধুতি, মেয়েদের তেমনই শাড়ি। ধুতি ও শাড়িই ছিল প্রাচীন বাঙালীর সাধারণ পরিধেয়, তবে একটু সঙ্গতিসম্পন্ন লোকদের ভিতর ভদ্র বেশ ছিল উত্তরবাসরূপে আর এক খণ্ড সেলাইবিহীন বস্ত্রের ব্যবহার, যাহা ছিল পুরুষদের ক্ষেত্রে উত্তরীয়, নারীদের ক্ষেত্রে ওড়না। ওড়নাই প্রয়োজন মতো অবগুণ্ঠনের কাজ করিত। দরিদ্র ও সাধারণ ভদ্র গ্রহস্থ নারীদের এক বস্ত্র পরাটাই ছিল রীতি, সেই বস্ত্রাঞ্চল টানিয়াই হইত অবগুণ্ঠন।
আজকাল আমরা যেমন পায়ের কুণ্ঠা পর্যন্ত ঝুলাইয়া কোঁচা দিয়া কাপড় পরি, প্রাচীন কালের বাঙালী তাহা করিতেন না। তখনকার ধুতি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে অনেক ছোট ছিল; হাঁটুর নিচে নামাইয়া কাপড় পরা ছিল সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম; সাধারণত হাঁটুর উপর পর্যন্তই ছিল কাপড়ের প্রস্থ। ধুরির মাঝখানটা কোমরে জড়াইয়া দুই প্রান্ত টানিয়া পশ্চাদ্দিকে কচ্ছ বা কাছা। ঠিক নাভির নিচেই দুই তিন প্যাঁচের একটি কটিবন্ধের সাহায্যে কাপড়টি কোমরে আটকানো; কটিবন্ধের গাঁটটি ঠিক নাভির নিচেই দুল্যমান। কেহ কেহ ধুতির একটি প্রান্ত পেছনের দিকে টানিয়া কাছা দিতেন, অন্য প্রান্তটি ভাঁজ করিয়া সম্মুখ দিকে কোঁচার মত ঝুলাইয়া দিতেন। নারীদের শাড়ি পরিবার ধরনও প্রায় একই রকম, তবে শাড়ি ধুতির মতো এত খাটো নয়, পায়ের কব্জি পর্যন্ত ঝুলানো, এবং বসনপ্রান্ত পশ্চাদ্দিকে টানিয়া কচ্ছে রূপান্তরিতও নয়। আজিকার দিনের বাঙালী নারীরা যেভাবে কোমরে এক বা একাধিক প্যাঁচ দিয়া অধোবাস রচনা করেন, প্রাচীন পদ্ধতিও তদনুরূপ, তবে আজিকার মতন প্রাচীন বাঙালী নারী শাড়ির সাহায্যে উত্তরবাস রচনা করিয়া দেহ আবৃত করিতেন না; তাঁহাদের উত্তর-দেহাংশ অনাবৃত রাখাই ছিল সাধারণ নিয়ম। তবে কোন ক্ষেত্রে, বোধ হয় সঙ্গতিসম্পন্ন উচ্চকোটি স্তরে এবং নগরে — হয়তো কতকটা মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রেরণায় — কেহ কেহ উত্তরী বা ওড়নার সাহায্যে উত্তরার্ধের কিছু অংশ ঢাকিয়া রাখিতেন, বা স্তনযুগলকে রক্ষা করিতেন চোলি বা স্তনপট্টের সাহায্যে। কেহ কেহ আবার উত্তরবাস রূপে সেলাই করা ‘বডিস্‌’ জাতীয় এক প্রকার জামার সাহায্যে স্তননিম্ন ও বাহু-ঊর্ধ্ব পর্যন্ত দেহাংশ ঢাকিয়া রাখিতেন। সন্দেহ নাই, এই জাতীয় উত্তরাবাসের ব্যবহার নগর ও উচ্চকোটি স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। নারীর সদ্যোক্ত উত্তরবাস ও তাহার শাড়ি এবং পুরুষের ধুতি প্রভৃতি কোনও কোনও ক্ষেত্রে — সমসাময়িক পাণ্ডুলিপি চিত্রের সাক্ষ্যে এ-তথ্য সুস্পষ্ট — নানাপ্রকার লতাপাতা, ফুল, এবং জ্যামিতিক নক্‌শাদ্বারা মুদ্রিত হইত। এই ধরনের নক্‌শা-মুদ্রিত বস্ত্রের সঙ্গে ভারতবর্ষের পরিচয় আরম্ভ হয় খ্রীষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতক হইতে, এবং সিন্ধু, সৌরাষ্ট্র ও গুজরাত্‌ ছিল গোড়ার দিকে এই বস্ত্র-ব্যবসায়ের প্রধান কেন্দ্র। পরে ভারতবর্ষের অন্যত্রও ক্রমশ তাহা ছড়াইয়া পড়ে। এই নক্‌শা-মুদ্রিত বস্ত্রের ইতিহাসের মধ্যে ভারত-ইরাণ-মধ্য-এশিয়ার ঘনিষ্ঠ শিল্প ও অলংকরণগত সম্বন্ধের ইতিহাস লুক্কায়িত। কিন্তু সে কথা এ-ক্ষেত্রে অবান্তর। যাহাই হউক, নারীদের দেহের সমগ্র প্রাচীন আদি অষ্ট্রেলিয়-পলেনেশিয়-মেলানেশিয় নরগোষ্ঠীর মধ্যে ইহাই ছিল প্রচলিত নিয়ম। বলিদ্বীপ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্যান্য কয়েকটি দ্বীপে সেই অভ্যাস ও ঐতিহ্যের অবশেষ এখনও বিদ্যমান।
সভা সমিতি এবং বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা ছিল। জীমূতবাহন দায়ভাগ-গ্রন্থে সভা সমিতির জন্য পৃথক পোষাকের কথা বলিয়াছেন। নর্তকী নারীরা পরিতেন পায়ের কণ্ঠা পর্যন্ত বিলম্বিত আঁটিসাঁট পাজামা; দেহের উত্তরার্ধে কাঁধের উপর দিয়া ঝুলাইয়া দিতেন একটি দীর্ঘ ওড়না; নৃত্যের গতিতে ওড়নার প্রান্ত উড়িত লীলায়িত ভঙ্গিতে। সন্নাসী-তপস্বীরা এবং একান্ত দরিদ্র সমাজ-শ্রমিকেরা পরিতেন ন্যাঙ্গোটি। সৈনিক ও মল্লবীরেরা পরিতেন ঊরু পর্যন্ত লম্বিত খাটো আঁট পাজামা; সাধারণ মজুররাও বোধ হয় কখনো কখনো এই ধরণের পোষাক পরিতেন; অন্তত পাহাড়পুরের ফলকচিত্রের সাক্ষ্য তাহাই। শিশুদের পরিধেয় ছিল হাঁটু পর্যন্ত লম্বিত ধুতি না হয় আঁট পাজামা, আর কটিতলে জড়ানো ধটি; তাহাদের কণ্ঠে দুল্যমান এক বা একাধিক পাটা বা পদক-সম্বলিত সুত্রহার।

 

কেশবিন্যাস

আজিকার মতো প্রাচীন কালেও বাঙালীর মস্তকাবরণ কিছু ছিল না। নানা কৌশলে সুবিন্যস্ত কেশই ছিল তাহাদের শিরোভূষণ। পুরুষেরাও লম্বা বাব্‌রীর মতন চুল রাখিতেন; কুঞ্চিত থোকায় থোকায় তাহা কাঁধের উপর ঝুলিত; কাহারও কাহারও আবার উপরে একটি প্যাঁচানো ঝুঁটি; কপালের উপর দুল্যমান কুঞ্চিত কেশদাম বস্ত্রখণ্ড-দ্বারা ফিতার মতন করিয়া বাঁধা। নারীদেরও লম্বমান কেশগুচ্ছ ঘাড়ের উপর খোঁপা করিয়া বাঁধা; কাহারও কাহারও বা মাথায় পশ্চাদ্দিকে এলানো। সন্ন্যাসী-তপস্বীদের লম্বা জটা দুই ধাপে মাথার উপরে জড়ানো। শিশুদের চুল তিনটি ‘কাকপক্ষ’ গুচ্ছে মাথার উপরে বাঁধা।

 

পাদুকা

ময়নামতি ও পাহাড়পুরের মৃতফলক-সাক্ষ্যে মনে হয়, যোদ্ধারা পাদুকা ব্যবহার করিতেন; প্রহরী দ্বারবানেরাও করিতেন; এবং সে-পাদুকা চামড়ার দ্বারা তৈরি হইত এমন ভাবে যাহাতে পায়ের কণ্ঠা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে। ব্যাদিতমুখ সেই জুতা ছিল ফিতাবিহীন। সাধারণ লোকেরা বোধহয় কোনও চর্মপাদুকা ব্যবহার করিতেন না, যদিও কর্মানুষ্ঠান-পদ্ধতি ও পিতৃদয়িত-গ্রন্থে পুরুষদের পক্ষে কাষ্ঠ এবং চর্মপাদুকা উভয়ের ব্যবহারেরই ইঙ্গিত বর্তমান। সঙ্গতিসম্পন্ন লোকদের মধ্যেও কাষ্ঠপাদুকার চলন খুব বেশি ছিল। বাঁশের লাঠি এবং ছাতা ব্যবহারও প্রচলিত ছিল। মৃৎ ও প্রস্তর ফলকে এবং সমসাময়িক সাহিত্যে ছত্র ব্যবহারের সাক্ষ্য সুপ্রচুর; লাঠির সাক্ষ্য স্বল্প হইলেও বিদ্যমান। প্রহরী, দ্বারবান্‌, মল্লবীরেরা সকলেই সুদীর্ঘ বাঁশের লাঠি ব্যবহার করিতেন।
সধরা নারীরা কপালে পরিতেন কাজলের টিপ্‌ এবং সীমন্তে সিঁদুরের রেখা; পায়ে পরিতেন লাক্ষারস অলক্তক, ঠোঁটে সিঁদুর; দেহ ও মুখমণ্ডল প্রসাধনে ব্যবহার করিতেন চন্দনের গুঁড়া ও চন্দনপঙ্ক, মৃগনাভী, জাফ্‌রান প্রভৃতি। বাৎস্যায়ন বলিতেছেন, গৌড়ীয় পুরুষেরা হস্তশোভী ও চিত্তগ্রাহী লম্বা লম্বা নখ রাখিতেন এবং সেই নখ রঙ লাগাইতেন, বোধ হয় যুবতীদের মনোরঞ্জনের জন্য। নারীরা নখে রঙ লাগাইতেন কিনা, এ-বিষয় কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় যাইতেছেনা। তবে চোখে যে কাজল তাঁহারা লাগাইতেন, তাহার ইঙ্গিত আছে দমোদরদেবের চট্টগ্রাম-লিপিতে। প্রসাধন-ক্রিয়ায় কর্পূর-ব্যবহারের ইঙ্গিত আছে মদনপালের মনহলি-লিপিতে, এবং রঙ ব্যবহারের ইঙ্গিত আছে নারায়ণপালের ভাগলপুর লিপিতে। ঠোঁটে লাক্ষারস (অলক্তরাগ) এবং ক্ষোঁপায় ফুল গুঁজিয়া দেওয়া যে তরুণীদের বিলাস-প্রসাধরনের অঙ্গ ছিল, এ-কথা সমসাময়িক বাঙালী কবি সাঞ্চাধরও বলিয়াছেন। বিধবা হইবার সঙ্গে সঙ্গে সীমন্তের সিঁদুর যাইত ঘুচিয়া, এ-কথায় ইঙ্গিত পাইতেছি দেবপালের নালন্দা লিপিতে, মদনপালের মনহলি-লিপিতে, বল্লালসেনের অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে গোবর্ধনাচার্যের নিম্নোদ্ধৃত শ্লোকে :

বন্ধনভাজোহমুষ্যাঃ চিকুর কলাপস্য মুক্তমানস্য।
সিন্দূরিত সীমন্তচ্ছলেন হৃদয়ং বিদীর্ণমেব।।

 

প্রসাধন

নারীরা গলায় ফুলের মালা পরিতেন এবং মাথার খোঁপায় ফুল গুঁজিতেন, এ-সাক্ষ্য দিতেছে নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপি এবং কেশবসেনের ইদিলপুর-লিপি। নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপিতে আছে, বুকের বসন স্থানচ্যুত হইয়া পড়াতে লজ্জায় আনতনয়না নারী কথঞ্চিত লজ্জা নিবারণ করিতেছেন তাঁহার গলার ফুলের মালাদ্বারা বক্ষ ঢাকিয়া। বলা বাহুল্য, এ-চিত্র নাগর-সমাজের উচ্চকোটি স্তরের। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষদ-লিপি এবং সমসাময়িক অন্যান্য লিপির সাক্ষ্য একত্র করিলে মনে হয়, এই সমাজস্তরের নারীরা, বিশেষভাবে বিবাহিতা নারীরা প্রতি সন্ধ্যায় নদী বা দীঘিতে অবগাহনান্তর প্রসাধনে-অলংকারে সজ্জিত ও শোভিত হইয়া আনন্দ ও ঔজ্জ্বল্যের প্রতিমা হইয়া বিরাজ করিতেন। বক্ষযুগলে কর্পূর ও মৃগনাভি রচনার সংবাদ পাওয়া যায় বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশস্তিতে। রাজা-মহারাজ-সামন্ত-মহাসামন্ত এবং রাজকীয় মর্যাদাসম্পন্ন নাগর-পরিবারের নারীরা বেশভূষা, প্রসাধন, অলংকার ইত্যাদিতে উত্তরাপথের আদর্শই মানিয়া চলিতেন; অন্তত সদ্যোক্ত বিবরণ হইতে তো তাহাই মনে হয়। রাজমহিষীরা তো ভারতবর্ষের নানা জায়গা হইতেই আসিতেন, আর নাগর-সমাজে রাজপরিবারের আদর্শটাই সাধারণত সক্রিয় হয়। নগরবাসিনী বঙ্গবিলাসিনীদের বেশভূষার একটি সুস্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় সদুক্তিকর্ণামৃতধৃত অজ্ঞাতনামা জনৈক কবির এই শ্লোকটিতে :

বাসঃ সূক্ষ্মং বপুষি ভুজযোঃ কাঞ্চনী চঙ্গদশ্রীর্‌
মালাগর্ভঃ সুরভি মসৃনৈগর্ন্ধতৈলৈঃ শিখণ্ডঃ।
কর্ণোত্তংসে নবশশিকলানির্মলং তালপত্রং।
বেশং কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গবারাঙ্গনাম।।

দেহে সূক্ষ্মবসন, ভুজবন্ধে সুবর্ণ অঙ্গদ (তাদা); গন্ধতৈলসিক্ত মসৃণ কেশদাম মাথার উপর শিখণ্ড বা চূড়ার মতো করিয়া বাঁধা, তাহাতে আবার ফুলের মালা জড়ানো; কানে নবশশিকলার মতন নির্মল তালপত্রের কর্ণাভরণ — বঙ্গবারাঙ্গনাদের এই বেশ কাহার না মন হরণ করে!

চন্দ্রকলার মতো কোমল কচি তালপাতার কর্ণভূষণের কথা পবনদূত-রচয়িতা ধোয়ীও বলিয়াছেন; ‘রসময় সুক্ষ্মদেশ’ নতুন চন্দ্রকলার মতো কোমল তালীপত্র ব্রাহ্মণ-মহিলাদের কর্ণাভরণ হইবার দাবি করিয়া থাকে :

[রসময় সুক্ষ্মদেশঃ] শ্রোত্রাভরণপদবীং ভূমিদেবাঙ্গনানাং
তালিপত্রং নবশশিকলা কোমলং যত্র যাতি।

রাজশেখর তাঁহার কাব্যমীমাংসা-গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে প্রাচ্যজনপদবাসীদের প্রসাধরনের বর্ণনা দিতে গিয়া শুধু গৌড় রমণীর বেশ-প্রসাধনের বর্ণনাই করিয়াছেন; বোধ হয় ইহাই ছিল মানদণ্ড।

আদ্রার্দ্রচন্দন কুচার্পিত সূত্রহারঃ
সীমন্তচূম্বিসিচয়ঃ স্ফুটবাহুমূলঃ।
দূর্বাগ্রকাণ্ড রুচিরাস্বগুরূপভোগাদ্‌
গৌড়াঙ্গনাসু চিরমেষ চকাস্তু রেষঃ।।

বক্ষে আর্দ্রচন্দন, গলায় সূতার হার, সীমন্ত পর্যন্ত আনত শিরোবসন, অনাবৃত বাহুমূল, অঙ্গে অগুরু-প্রসাধন, অঙ্গবর্ণ যেন ‘দূর্বাগ্রকাণ্ড রুচির’, অর্থাৎ দুর্বাদলের মতো শ্যাম — ইহাই হইতেছে গৌড়ঙ্গনাদের বেশ।

 

নগর ও পল্লীবাসিনী

একদিকে এই নগরবাসিনীদের চিত্র, অন্যদিকে সরল, স্বভাবসুন্দর পল্লীবাসিনী নারীর চিত্রও আছে। পল্লী অঞ্চলের লোকেরা নগরবাসিনী বিলাসিনীদের বেশভূষা চালচলন পছন্দ করিতেন না। কবি গোবর্ধনাচার্য বলিতেছেন :

ঋজুনা নিধেহি চরণৌ পরিহর সখি নিখিলনাগরাচারম।
ইহ ডাকিনীতি পল্লীপতিঃ কটাক্ষেহপি, দণ্ডয়তি।।

সখি, সোজা পা ফেলিয়া চল, নাগরাচার সব ছাড়। একটু কটাক্ষপাত করিলেও এখানে পল্লীপতি (গ্রামপতি) ডাকিনী বলিয়া দণ্ড দেন।

পল্লী-সুন্দরীদের প্রসাধন-অলংকরণের কথা বলিয়াছেন কবি চন্দ্রচন্দ্র :

ভালে কজ্জ্বলবিন্দুরিন্দুকিরণস্পর্ধী মৃণালাঙ্কুরো
দোর্বল্লীষু শলাটুফেনিলফলোত্তংসশ্চ কর্ণাতিথিঃ
ধম্মিল্লস্তিলপল্লবাভিষবণস্নিগ্ধ স্বভাবাদয়ং
পন্থান্‌ মন্থরয়ত্যানাগরবধুবর্গস্য বেশগ্রহঃ।।

কপালে কাজলের টিপ, হাতে ইন্দুকিরণস্পর্ধী শাদা পদ্মমৃণালের বালা, কানে কচি রীঠাফুলের কর্ণাভরণ, স্নিগ্ধকেশ কবরীতে তিলপল্লব — অনাগর (অর্থাৎ, পল্লীবাসী) বধূদের এই বেশ স্বভাবতই পথিকদের গতি মন্থর করিয়া আনে।

সাধারণ পল্লী ও নগরবাসী দরিদ্র গ্রহস্থ মেয়েরা গৃহকর্মাদি তো করিতেনই, মাঠে-ঘাটেও তাঁহাদের খাটিতে হইত সংসারজীবন নির্বাহের জন্য, হাটবাজারেও যাইতে হইত, সওদা কেনাবেচা করিতে হইত, আবার স্বামীপুত্রকন্যাপরিজনদের পরিচর্যাও করিতে হইত। এইরূপ কর্মব্যস্ত মেয়েদের একটি সুন্দর বস্তুময়, কাব্যময় চিত্র আঁকিয়াছেন কবি শরণ। তাঁহারা যে একবস্ত্র পরিহিতা সে-কথাও শরণের এই শ্লোকটিতে জানা যায়। অন্যত্র অন্য প্রসঙ্গে এই শ্লোকটি উদ্ধার করিয়াছি; এখানে শুধু একটি মর্মানুবাদ রাখিলাম।

এই যে হাটের কাজ শেষ করিয়া ধাইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে পৌরাঙ্গনারা, তাহাদের দৃষ্টি সন্ধ্যাসূর্যের মতো (অরুণবর্ণ)। দ্রুত ধাইয়া চলিবার জন্য তাহাদের স্কন্ধ হইতে বস্ত্রাঞ্চল স্খলিত হইয়া পড়িতেছে বারবার, আর তাহাই বারবার তাহারা তুলিয়া দিতে চাহিতেছে। ঘরের চাষী সেই সকালবেলা মাঠে কাজে বাহির হইয়া গিয়াছে, এখন তাহার ঘরে ফিরিয়া আসিবার সময় — এই কথা ভাবিয়া মেয়েরা লাফাইয়া লাফাইয়া ছুটিয়া পথ সংক্ষেপ করিয়া আনিতেছে, আর ব্যস্ত হইয়া হাটে কেনাবেচার দাম আঙুলে গুণিতেছে।

বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশস্তিতে নানা প্রকার ক্ষৌমবস্ত্রের একটু ইঙ্গিত আছে। তৃতীয় বিগ্রহপালের আমগাছি-লিপিতে পড়িতেছি, রত্নদ্যুতিখচিত অংশুক বস্ত্রের কথা। সূক্ষ্ম কার্পাস ও রেশম বস্ত্রের কথা তো নানাসূত্রেই পাওয়া যাইতেছে। ইহা কিছু আশ্চর্যও নয়। বাঙলাদেশ যে নানাপ্রকার সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্য ভারতবর্ষ ও ভারতবর্ষের বাহিরে সুবিখ্যাত ছিল, এ-কথা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও গ্রীক পেরিগ্লাস-গ্রন্থ হইতে আরম্ভ করিয়া আরব বণিক সুলেমান (নবম শতক), ভিনিসিয় মার্কো পোলো (ত্রয়োদশ শতক), চীন পরিব্রাজক মা-হুয়ান (পঞ্চদশ শতক) পর্যন্ত সকলেই বলিয়া গিয়াছেন। বস্তুত, অষ্টাদশশতক পর্যন্ত এই খ্যাতি অক্ষুণ্ণ ছিল। চতুর্দশ শতকে তীরভুক্তি বা তিরুহুতবাসী কবি শেখরাচার্য জ্যোতিরীশ্বর নানাপ্রকারের পট্টাম্বরের মধ্যে বাঙলাদেশের মেঘ-উদুম্বর, গঙ্গাসাগর, গাঙ্গোর, লক্ষ্মীবিলাস, দ্বারবাসিনী এবং শীল্‌হটী পট্টাম্বরের উল্লেখ করিয়াছেন। এগুলি বোধ হয় সমস্ত অলংকৃত পট্টবস্ত্র; কারণ ইহার পরই জ্যোতিরীশ্বর বলিতেছেন নির্ভূষণ বঙ্গাল বস্ত্রের কথা। কিন্তু ‘ক্ষৌম’ বা ‘কৌষেয়’, ‘দুকুল’ বা ‘পত্রোর্ণ’ বস্ত্র, অলংকৃত পট্টবস্ত্র বা কার্পাস বস্ত্র যাহাই হউক, সাধারণ দরিদ্র লোকদের এ-সব বস্ত্র পরিবার সুযোগ ও সংগতি কিছুই ছিল না; তাহাদের ভাগ্যে জুটিত মোটা নির্ভূষণ কার্পাস বস্ত্র মাত্র, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহা ছিন্ন ও জীর্ণ। অন্তত কবি বার বং আরও একজন অজ্ঞাতনামা কবি বাঙালী দারিদ্রের যে ছবি আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন, তাহার অন্যতম প্রধান উপকরণ ‘স্ফূটিত’ জীর্ণ বস্ত্র। এই দুইটি শ্লোকই সদুক্তিকর্ণামৃত হইতে একই গ্রন্থেরই অন্যত্র অন্য প্রসঙ্গে উদ্ধার করিয়াছি; বাহুল্যভয়ে এখানে শুধু তাহার উল্লেখ রাখিয়া যাইতেছি মাত্র। সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র শুধু মেয়েরাই বোধ হয় পরিতেন; অনেকে নিজেরাই যে সে কাপড়ের সূতা কাটিয়া পাকাইয়া লইতেন, বিশেষভাবে বির্ধন ব্রাহ্মণগৃহের নারীরা, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় কবি শুভাঙ্কের নিম্নোদ্ধৃত রাজপ্রশস্তি শ্লোকটিতে।

কার্পাসান্থি প্রচয়নিচিতা নির্ধনশ্রোত্রিয়াণাং
যেষাং বাত্যা প্রবিততকুটীপ্রাঙ্গণান্তা বভূবুঃ।
তৎসৌধানাংপরিসরভূবি ত্বৎপ্রাসাদাদিদানীং
ক্রীড়াযুদ্ধচ্ছিদুরযুবতীহারমুক্তাঃ পতন্তি।।

সে-সব দরিদ্র শ্রোত্রিয়দিকের ঝটিকাহত কুটিরের প্রাঙ্গণ কার্পাস বীজের দ্বারা আকীর্ণ ছিল, (হে মহারাজ), এখন তোমার কৃপায় সেখানকার সৌধাবলীর বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে যুবতীদের ক্রীড়াযুদ্ধে ছিন্নহারের মুক্তাসমূহ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে।

 

অলংকরণ

সমসাময়িক সাহিত্য ও প্রত্নবস্তুর সাক্ষ্য হইতে প্রমাণিত হয়, প্রাচীন বাঙালী নারী ও পুরুষ এমন কতকগুলি অলংকার ব্যবহার করিতেন যাহা উভয় ক্ষেত্রেই এক। কর্ণকুণ্ডল ও কর্ণাঙ্গুরী, অঙ্গুরীয়ক, কণ্ঠহার, বলয়, কয়ূর, মেখলা ইত্যাদি নরনারী নির্বিশেষে ব্যবহৃত হইত। নারীরা, সম্ভবত বিবাহিত নারীরা, বিশেষভাবে ব্যবহার করিতেন শঙ্খবলয়। মুক্তাখচিত হারের কথা, মহানীলরক্তাক্ষমালার কথা, বিজয়সেনের নৈহাটি-লিপিতে পাইতেছি এবং দেওপাড়া-প্রশস্তিতেই শুনিতেছি, রাজবাড়ির ভৃত্যের স্ত্রীরাও নাকি হার, কর্ণাঙ্গুরী, মালা, মল এবং সূবর্ণবলয় ইত্যাদি পরিতেন, মূল্যবান পাথরের তৈরী ফুল ইত্যাদিও ব্যবহার করিতেন। মুক্তাখচিত হার পরিতেন, রাজপরিবারের মেয়েরা (নৈহাটি-লিপি)। রামচরিতে পড়া যায়, হীরকখচিত নানা সুন্দর অলংকার এবং রত্নখচিত ঘুঙুরের কথা, মুক্তা, মরকত, নীলকান্তমণি, চূণী, প্রভৃতি রত্নাদি ব্যবহারের কথা। আর, সোনা ও রূপার গহনা তো ছিল। বলা বাহুল্য, এই সব অলংকরণ-বিলাস ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র গ্রহস্থদের নাগালের বাহিরে; বড় জোর শঙ্খবলয়, কচি তালপাতার কর্ণাভরণ, এবং ফুলের মালাতেই তাঁহাদের সন্তুষ্ট থাকিতে হইত। দেওপাড়া-প্রশস্তিতে কবি উমাপতিধর বলিতেছেন, পল্লীবাসী নির্ধন ব্রাহ্ম রমণীরা রাজার কৃপায় নগরে আসিয়া বহুবিভবশালিনী হইলেও তাঁহারা মুক্তা ও কার্পাসবীজে, মরকত ও শাকপাতায়, রূপা ও লাউফুলের, রত্ন ও পাকা ডালিমের বীজে, সোনা ও কুমড়া ফুলের পার্থক্য যে কি তাহা জানিতেন না!
উচ্চকোটিস্তরে বিবাহোপলক্ষে কন্যাকে কী ভাবে সজ্জিত ও অলংকৃত করা হইতে তাহার কিছু বর্ণনা আছে নৈষধচরিতে। প্রসঙ্গত উৎসব-সজ্জায় কিছু বিবরণও পাওয়া যায়। প্রথমেই কুলাচার অনুসারে সধবা ও পুত্রবতী গৃহিণীরা মঙ্গলগীত গাহিতে গাহিতে কন্যাকে স্নান করাইতেন এবং পরে শুভ্র পট্টবস্ত্র পরাইতেন। তারপর সখীরা দয়মন্তীকে কপালে পরাইলেন মনঃশিলার তিলক, সোনার টীপ্‌, কাজল আঁকিয়া দিলেন চোখে, কর্ণযুগলে পরাইলেন দুইটি মণিকুণ্ডল, ঠোঁটে-আলতা, কণ্ঠে সাতলহর মুক্তার মালা, দুই হাতে শঙ্খ ও স্বর্ণবলয়, চরণে আলতা। বিবাহের মাঙ্গলিকানুষ্ঠানে অভ্যস্তা অন্তঃপুরিকারা স্ত্রী-আচারগুলি পালন করিতেন, আর পুরুষেরা ও ব্রাহ্মণেরা বেদোক্ত স্মৃত্যুক্ত কার্যগুলি সম্পাদন করিতেন। বিবাহ-স্থানে আলপনা আঁকা হইত এবং কাজটি করিতেন মেয়েরা। শিল্পীরা নানাপ্রকার রঞ্জিত কাপড় দিয়া তৈরী ফুলে নগরের পথঘাট সাজাইতেন, বাড়ির দেয়ালে নানা ছবি আঁকিতেন। নানা প্রকার বাদ্যের মধ্যে বাঁশি, বীণা, করতাল, মৃদঙ্গ ছিল প্রধান। বরযাত্রাকালে নগরীর নারীরা বরকে দেখিবার জন্য রাজপথের পাশে আসিয়া দাঁড়াইতেন। মঙ্গলানুষ্ঠান উপলক্ষে গৃহতোরণের দুইপাশে কদলীস্তম্ভ রোপণ করা হইত; বাসর ঘরে (কৌতুকগৃহে), আজিকার মতন তখনও চুরি করিয়া চুপি দেওয়া এবং আড়িপাতা হইত (সকৌতুকাগারমগাত্‌ পুরন্ধ্রিভিঃ সহস্র রন্ধ্রোকৃত্মীক্ষিতুংতঃ। অধাত্‌ সহস্রাক্ষতনুত্রমিত্রতাং অধিষ্ঠিতং যত্‌ খলু জিষ্ণুনামুনা।।); বরকন্যার গাঁটছড়াও বাধা হইত। বরযাত্রীদের পরিচর্যা এবং ভোজনে পরিবেশন করিতেন পুরনারীরা এবং তাঁহাদের লইয়া বরযাত্রীরা নানা প্রকার ঠাট্টা-রসিকতা করিতেও ছাড়িতেন না; সেসব ঠাট্টা ও রসিকতা আজিকার দিনে খুব মার্জিত বলিয়া মনে হইবার কারণ নাই। পুরনারীরাও নানাপ্রকারে বরযাত্রীদের ঠকাইতে চেষ্টা করিতেন, আজও যেমন করা হয়। নল-দয়মন্তীর বিবাহ বর্ণনা-সাক্ষ্যে মনে হয়, বিবাহের পরও বর ও বরযাত্রীরা বিবাহবাড়িতে ৪/৫ দিন বাস করিতেন! সেই কয়েকদিনও বরযাত্রীরা বারসুন্দরী বা বাররামাদের সঙ্গলাভ করিতে কুণ্ঠা বোধ করিতেন না! বস্তুত, শৌখিন উচ্চস্তরে যুবকদের মধ্যে বাররামাসঙ্গ বোধ হয় খুব দোষের বলিয়া গণ্য হইত না।
বসন-ভুষণ-প্রসাধন-অলংকার প্রভৃতি সম্বন্ধে নানা টুকরা টাকরা খবর নানাদিক হইতে পাওয়া যায়। ভরতমুনি তাঁহার নাট্যশাস্ত্রে (আনুমানিক তৃতীয় শতক) বলিতেছেন, “গৌড়ীনামলকপ্রায়ং সশিখাপাশবেণিকম” — অর্থাৎ গৌড়ীয় নারীদের মাথায় কুঞ্চিত কেশ, এবং তাঁহাদের চুলের বেণীর শেষাংশ থাকিত শিখার মতো মুক্ত। রাজশেখর (নবম-দশম-শতক) তাঁহার কাব্যমীমাংসাগ্রন্থে অঙ্গ-বঙ্গ-সুহ্ম-ব্রহ্ম-পুণ্ড্র প্রভৃতি প্রাচ্যবাসীদের বেশ (বেষ) বর্ণনা উপলক্ষে গৌড়-নারীর বেশের (বেষের) যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহা একটু আগেই উল্লেখ করিয়াছি।
প্রাচীন বাঙালীর দেহবর্ণ কিরূপ ছিল কিছুটা আভাস পাওয়া যায় ভরতনাট্যশাস্ত্রের নিম্নোদ্ধৃত শ্লোকটি হইতে।

শকাশ্চ যবনাশ্চৈব পহ্লবা বহ্লিকাদয়ঃ
প্রায়েণ গৌরাঃ কর্তব্যা উত্তরাং যে শ্রিতাদিশম।
পাঞ্চালাঃ শূরসেনাশ্চ তথা চৈবোড্রমাগধাঃ
অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গাস্তু শ্যামা কার্যাস্তু বর্ণতঃ।।

(নাটকের) শক-যবন পহ্‌লব-বাহ্লিক প্রভৃতি যে সব (পাত্রপাত্রী) উত্তর দেশবাসী তাহাদের দেহের বর্ণ করিতে হইবে সাধারণত গৌর; পঞ্চাল, শূরসেন, উড্র, মগধ এবং অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গবাসীদের বর্ণ করিতে হইবে শ্যাম।

রাজশেখরও বলিতেছেন,

“তত্র পৌরস্ত্যনাং (প্রাচ্যবাসীদের) শ্যামো বর্ণঃ দাক্ষিণাত্যানাং কৃষঃ, পাশ্চাত্যানাং পাণ্ডুঃ, উদীচ্যানং গৌরঃ, মধ্যেদেশ্যানং কৃষ্ণঃ শ্যামো গৌরশ্চ।”

গৌরাঙ্গনাদের দেহও যে শ্যামবর্ণ, রাজশেখরের এই উক্তি আগেই উল্লেখ করিয়াছি; অন্যত্র তিনি বলিতেছেন,

শ্যবেষ্বঙ্গেষু গৌড়ীনাং সূত্রহারৈহারিষু।
চক্রীকৃত ধনুঃ পৌস্পমনঙ্গো বল্গু বল্গতি।।

এই সব উক্তি হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, গৌড়বাসীদের, তথা প্রাচ্যবাসীদের দেহবর্ণ সাধারণত ছিল শ্যাম, তবে রাজপরিবার এবং অন্যান্য অভিজাত পরিবারের নরনারীদের দেহবর্ণ যে অনেক সময় হইত গোর বা পাণ্ডুবর্ণ, তাহাও রাজশেখর বলিয়াছেন, “বিশেষস্তু পূর্বদেশে রাজপুত্রাদীনাং গৌরঃ পাণ্ডুর্বা বর্ণঃ।”