০৪. রাজযোগের লক্ষ্য

ধর্মজীবনে ধ্যান-ধারণার দিকটিই যোগের লক্ষ্য, নৈতিক দিকটি নয়, যদিও কার্যকালে নীতিবিষয়ক আলোচনা কিছুটা আসিয়াই পড়ে। ভগবানের বাণী বলিয়া যাহা পরিচিত, শুধু তাহাতে পরিতৃপ্ত না হইয়া জগতের নর-নারীর মন সত্য সম্বন্ধে আরও অধিক অনুসন্ধানপরায়ণ হয়। তাহারা নিজে কিছু সত্য উপলব্ধি করিতে চায়। ধর্মের বাস্তবতা নির্ভর করে একমাত্র উপলব্ধির উপর। মনের অতিচেতন ভূমি হইতেই অধিকাংশ আধ্যাত্মিক সত্য আহরণ করিতে হয়। বিশেষ অনুভূতি লাভ করিয়াছেন বলিয়া যাঁহারা দাবী করেন, তাঁহারা যে ভূমিতে উঠিয়াছিলেন, সেই ভূমিতে আমাদেরও উঠিতে হইবে; সেখানে উঠিয়া আমরা যদি একই ধরনের অনুভূতি লাভ করি, তাহা হইলেই আমাদের কাছে সেগুলি সত্য হইয়া দাঁড়াইল। অপরে যাহা কিছু প্রত্যক্ষ করিয়াছে, সবই আমরা প্রত্যক্ষ করিতে পারি; যাহা একবার ঘটিয়াছে, পুনর্বার তাহা ঘটিতে পারে; ঘটিতে পারে নয়, একই পরিবেশে আবার তাহা ঘটিতে বাধ্য। এই অতিচেতন অবস্থায় কিভাবে পৌঁছাইতে হয়, রাজযোগ তাহা শিক্ষা দেয়। সব বড় বড় ধর্মই কোন-না-কোন ভাবে এই অতিচেতন অবস্থাকে স্বীকার করে; কিন্তু ভারতে ধর্মের এই দিকটির উপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। প্রথমাবস্থায় কয়েকটি বাহ্য প্রক্রিয়া এই অবস্থালাভের পক্ষে সহায়ক হইতে পারে; কিন্তু শুধু এই ধরনের বাহ্য প্রক্রিয়া অবলম্বনে কখনও বেশীদূর অগ্রসর হওয়া যায় না। নির্দিষ্ট আসন, নির্দিষ্ট প্রণালীতে শ্বাস-ক্রিয়া ইত্যাদির সাহায্যে মন শান্ত ও একাগ্র হয়; কিন্তু এগুলির অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে পবিত্রতা এবং ভগবান্‌-লাভের বা সত্যোপলব্ধির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকা চাই-ই। স্থির হইয়া বসিয়া একটি ভাবের উপর মন নিবিষ্ট করিবার ও মনকে সেখানে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতে গেলেই অধিকাংশ লোক অনুভব করিবে যে, উহাতে সফল হইবার জন্য বাহিরের কিছু সহায়তার প্রয়োজন আছে। মনকে ধীরে ধীরে এবং যথানিয়মে বশে আনিতে হয়। ধীর, নিরবচ্ছিন্ন এবং অধ্যবসায়যুক্ত সাধনসহায়ে ইচ্ছাশক্তিকে পরিপুষ্ট করিতে হয়। ইহা ছেলেখেলা নয়, একদিন চেষ্টা করিয়া পরদিন ছাড়িয়া দিবার মত খেয়ালও নয়। সারা জীবনের কাজ এইটি; আর যে লক্ষ্য-লাভের জন্য এ প্রচেষ্টা, তাহা পাইবার জন্য যত মূল্যই আমাদিগকে দিতে হউক না কেন, সে মূল্য উহার সম্পূর্ণ উপযুক্ত; কারণ আমাদের লক্ষ্য হইল ভগবৎসত্তার সঙ্গে পূর্ণ একত্বানুভূতি। এই লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি থাকিলে, এবং ঐ লক্ষ্যে আমরা পৌঁছিতে পারি—এই বোধ থাকিলে তাহা লাভের জন্য কোন মূল্যকেই আর অত্যধিক বলিয়া মনে হইতে পারে না।