০৩. বেদান্ত -দর্শনের তাৎপর্য ও প্রভাব

[বোষ্টনের টোয়েণ্টিয়েথ সেঞ্চুরী ক্লাবে প্রদত্ত ভাষণ]

আজ যখন সুযোগ পাইয়াছি, তখন এই অপরাহ্ণের আলোচ্য বিষয় আরম্ভ করার পূর্বে একটু ধন্যবাদ প্রকাশের অনুমতি নিশ্চয় পাইব। আমি আপনাদের মধ্যে তিন বৎসর বাস করিয়াছি এবং আমেরিকার প্রায় সর্বত্রই ভ্রমণ করিয়াছি। এখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে এই সুযোগে এথেন্স নগরী-সদৃশ আমেরিকার এই শহরে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিয়া যাওয়া খুবই সঙ্গত। এদেশে প্রথম পদার্পণের অল্প কয়েক দিন পরেই মনে করিয়াছিলাম, এই জাতি-সম্পর্কে একখানি গ্রন্থ রচনা করিতে পারিব। কিন্তু আজ তিন বৎসর অতিবাহিত করার পরও দেখিতেছি যে, এ-সম্বন্ধে একখানি পৃষ্ঠা পূর্ণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীর বহু বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করিয়া আমি দেখিতেছি, বেশভূষা, আহার-বিহার বা আচার ব্যবহারের খুঁটিনাটি সম্পর্কে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, মানুষ—পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষ; সেই একই আশ্চর্য মানব-প্রকৃতি সর্বত্র বিরাজিত। তথাপি প্রত্যেকেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য কিছু আছে এবং এদেশীয়গণ সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতার সার আমি এখানে সংক্ষেপে বিবৃত করিতেছি। এই আমেরিকা মহাদেশে কেহ কোন ব্যক্তিগত বিচিত্র ব্যবহারাদি সম্বন্ধে সমালোচনা করে না। মানুষকে তাহারা নিছক মানুষরূপেই দেখে এবং মানুষরূপেই হৃদয় দিয়া বরণ করে। এই গুণটি আমি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখি নাই।

আমি এদেশে একটি ভারতীয় দর্শনমতের প্রতিনিধিরূপে আসিয়াছিলাম; তাহা বেদান্ত-দর্শন নামে পরিচিত। এই দর্শন অতি প্রাচীন। ইহা বেদ নামে খ্যাত প্রাচীন সুবিশাল আর্য-সাহিত্য হইতে উদ্ভূত। বহু শতাব্দী ধরিয়া সংগৃহীত এবং সঙ্কলিত সেই বিশাল সাহিত্যে যে-সব উপলব্ধি, তত্ত্বালোচনা, বিশ্লেষণ এবং অনুধ্যান সন্নিবিষ্ট রহিয়াছে, ইহা যেন তাহা হইতেই প্রস্ফুটিত একটি সুকোমল পুষ্প। এই বেদান্ত-দর্শনের কয়েকটি বিশেষত্ব আছে। প্রথমতঃ ইহা সম্পূর্ণরূপে নৈর্ব্যক্তিক, ইহার উদ্ভবের জন্য ইহা কোন ব্যক্তি বা ধর্মগুরুর নিকট ঋণী নয়; ইহা কোন ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠে নাই। অথচ যে-সব ধর্মমত ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠে, তাহাদের বিরুদ্ধে ইহার কোন বিদ্বেষ নাই। পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্র করিয়া বহু দর্শনমত ও ধর্মতন্ত্র গড়িয়া উঠিয়াছে—যথা বৌদ্ধধর্ম কিংবা আধুনিক কালের কয়েকটি ধর্মমত। খ্রীষ্ট ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদেরই মত এই-সকল ধর্মসম্প্রদায়েরও প্রত্যেকটির একজন ধর্মনেতা আছেন এবং তাঁহারা তাঁহার সম্পূর্ণ অনুগত। কিন্তু বেদান্ত-দর্শনের স্থান যাবতীয় ধর্মমতের পটভূমিকায়। বেদান্তের সহিত পৃথিবীর কোন ধর্ম বা দর্শনের বিবাদ-বিসংবাদ নাই।

বেদান্ত একটি মৌলিক তত্ত্ব উপস্থাপিত করিয়াছে এবং বেদান্ত দাবী করে যে, উহা পৃথিবীর সব ধর্মমতের মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে। এই তত্ত্বটি হইল এই যে, মানুষ ব্রহ্মের সহিত অভিন্ন; আমরা আমাদের চতুষ্পার্শে যাহা কিছু দেখিতেছি, সকলই সেই ঐশী চেতনা হইতে প্রসূত। মানব-প্রকৃতির মধ্যে যাহা কিছু বীর্যবান্, যাহা কিছু মঙ্গলময় এবং যাহা কিছু ঐশ্বর্যবান্, সে-সবই ঐ ব্রহ্মসত্তা হইতে উদ্ভূত; এবং যদিও তাহা অনেকের মধ্যেই সুপ্তভাবে বিরাজমান, তথাপি প্রকৃতপক্ষে মানুষে মানুষে কোন প্রভেদ নাই, কারণ সকলেই সমভাবে ব্রহ্মের সহিত অভিন্ন। যেন এক অনন্ত মহাসমুদ্র পশ্চাতে বিদ্যমান রহিয়াছে এবং আমি ও আপনারা সকলে সেই অনন্ত মহাসমুদ্র হইতে একটি তরঙ্গরূপে উত্থিত হইয়াছি। আমরা প্রত্যেকেই সেই অনন্তকে বাহিরে প্রকাশ করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছি। সুতরাং সুপ্ত সম্ভাবনার দিক্ হইতে দেখিতে গেলে যে সৎ-চিৎ-ও আনন্দময় মহাসাগরের সহিত আমরা স্বভাবতঃ অভিন্ন, সেই মহাসাগরে আমাদের প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার রহিয়াছে। আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে পার্থক্য, তাহা সেই ঐশী সম্ভাবনাকে প্রকাশ করিবার তারতম্যের দরুন ঘটিয়াছে। অতএব বেদান্তের অভিমত এই যে, প্রত্যেক মানুষ যতটুকু ব্রহ্মশক্তি প্রকাশ করিতে সমর্থ হইয়াছে, সেই দিক্ হইতে বিচার না করিয়া তাহার স্বরূপের দিক্ হইতেই তাহাকে বিচার করিতে হইবে। সকল মানুষই স্বরূপত ব্রহ্ম; অতএব কোন আচার্য যখন কাহাকেও সাহায্য করিতে অগ্রসর হইবেন, তখন নিন্দাবাদ ছাড়িয়া দিয়া ঐ ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ব্রহ্মশক্তিকে জাগাইবার জন্যই তাঁহাকে সচেষ্ট হইতে হইবে।

বেদান্ত ইহাও প্রচার করে যে, সমাজ-জীবনে ও প্রতি কর্মক্ষেত্রে আমরা যে বিশাল শক্তিপুঞ্জের অভিব্যক্তি দেখিতে পাই, তাহা প্রকৃতপক্ষে অন্তর হইতে বাহিরে উৎসারিত হয়। অতএব অন্য ধর্মসম্প্রদায় যাহাকে অনুপ্রেরণা বা ঐশী শক্তির অন্তঃপ্রবেশ বলিয়া মনে করিয়া থাকেন, বেদান্তবাদী তাহাকেই মানবের ঐশী শক্তির বহির্বিকাশ নামে অভিহিত করিতে চান; অথচ তিনি অপর ধর্মসম্প্রদায়ের সহিত বিবাদ করিতে চান না। যাঁহারা মানুষের এই ব্রহ্মত্ব উপলব্ধি করিতে পারেন না, তাঁহাদের সহিত বেদান্তবাদীর কোন বিরোধ নাই। কারণ জ্ঞাতসারেই হউক আর অজ্ঞাতসারেই হউক, প্রত্যেক ব্যক্তি সেই ব্রহ্মশক্তিরই উন্মেষে যত্নপর।

মানুষ যেন ক্ষুদ্র আধারে আবদ্ধ, অথচ সতত প্রসারশীল একটি অনন্ত শক্তিমান্ স্প্রীং- এর মত; পরিদৃশ্যমান সমগ্র সামাজিক ঘটনা-পরম্পরা এই মুক্তি-প্রয়াসেরই ফল। আমাদের আশেপাশে যত কিছু প্রতিযোগিতা, হানাহানি এবং অশুভ দেখিতে পাই, তাহার কোনটাই এই মুক্তি প্রয়াসের কারণ বা পরিণাম নয়। আমাদের একজন প্রখ্যাত দার্শনিকের দৃষ্টান্ত অনুসারে ধরা যাক, কৃষিক্ষেত্রে জলসেচনের নিমিত্ত উচ্চস্থানে কোথাও পরিপূর্ণ জলাশয় অবস্থান করিতেছে; জলপ্রবাহ কৃষিক্ষেত্র অভিমুখে ছুটিতে চায়, কিন্তু একটি রুদ্ধ দ্বারের দ্বারা প্রতিহত হয়। দ্বারটি যেই উদ্ঘাটিত হইবে, অমনি জলরাশি নিজবেগে প্রবাহিত হইবে। পথে আবর্জনা বা মলিনতা থাকিলে প্রবহমান জলধারা তাহার উপর দিয়া চলিয়া যাইবে। কিন্তু এই-সকল আবর্জনা ও মলিনতা মানবের এই দেবত্ব-বিকাশের পরিণামও নয়, কারণও নয়। ঐগুলি আনুষঙ্গিক অবস্থা মাত্র। অতএব ঐগুলির প্রতিকার সম্ভব।

বেদান্তের দাবী এই যে, এই চিন্তাধারা ভারতের ও বাহিরের সকল ধর্মমতের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়; তবে কোথাও উহা পুরাণের রূপক-কাহিনীর আকারে প্রকাশিত, আবার কোথাও প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থাপিত। বেদান্তের দৃঢ় অভিমত এই যে, এমন কোন ধর্ম প্রেরণা এ-যাবৎ প্রকটিত হয় নাই কিংবা এমন কোন মহান্ দেবমানবের অভ্যুদয় হয় নাই, যাঁহাকে মানবপ্রকৃতির এই স্বতঃসিদ্ধ অসীম একত্বের অভিব্যক্তি বলিয়া গ্রহণ করা না চলে। নৈতিকতা, সততা ও পরোপকার বলিয়া যাহা কিছু আমাদের নিকট পরিচিত, তাহাও ঐ একত্বের প্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই নয়। জীবনে এরূপ অনেক মুহূর্ত আসে, যখন প্রত্যেক মানুষই অনুভব করে যে, সে বিশ্বের সহিত এক ও অভিন্ন, এবং সে জ্ঞানে হউক বা অজ্ঞানে হউক এই অনুভূতিই জীবনে প্রকাশ করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়ে। এই ঐক্যের প্রকাশকেই আমরা প্রেম ও করুণা নামে অভিহিত করিয়া থাকি এবং ইহাই আমাদের সমস্ত নীতিশাস্ত্র ও সততার মূলভিত্তি। বেদান্ত-দর্শনে ইহাকেই ‘তত্ত্বমসি’—‘তুমিই সেই’—এই মহাবাক্যে সূত্রাকারে ব্যক্ত করা হইয়াছে।

প্রত্যেক মানুষকে বেদান্ত এই শিক্ষাই দেয়—সে এই বিশ্ব-সত্তার সহিত এক ও অভিন্ন; তাই যত আত্মা আছে, সব তোমারই আত্মা; যত জীবদেহ আছে, সব তোমারই দেহ; কাহাকেও আঘাত করার অর্থ নিজেকেই আঘাত করা এবং কাহাকেও ভালবাসার অর্থ নিজেকেই ভালবাসা। তোমার অন্তর হইতে ঘৃণারাশি বাহিরে নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র অপর কাহাকেও তাহা আঘাত করুক না কেন, তোমাকেই আঘাত করিবে নিশ্চয়। আবার তোমার অন্তর হইতে প্রেম নির্গত হইলে প্রতিদানে তুমি প্রেমই পাইবে, কারণ আমিই বিশ্ব—সমগ্র বিশ্ব আমারই দেহ। আমি অসীম, তবে সম্প্রতি আমার সে অনুভূতি নাই। কিন্তু আমি সেই অসীমতার অনুভূতির জন্য সাধনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি এবং যখন আমাতে সেই অসীমতার পূর্ণ চেতনা জাগরিত হইবে, তখন আমার পূর্ণতা প্রাপ্তিও ঘটিবে। বেদান্তের অপর একটি বিশিষ্ট ভাব এই যে, ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে এই অসীম বৈচিত্র্যকে স্বীকার করিয়া চলিতে হইবে এবং সকলেরই লক্ষ্য এক বলিয়া সকলকেই একই মতে আনয়নের চেষ্টা ছাড়িয়া দিতে হইবে। বেদান্তবাদীর কবিত্বময় ভাষায় বলা যায়, ‘যেমন বিভিন্ন স্রোতস্বতী বিভিন্ন পর্বত-শিখর হইতে উদ্গত হইয়া নিম্নভূমিতে অবতরণ করে এবং সরল বা বক্রগতিতে যথেচ্ছ প্রবাহিত হইয়া পরিশেষে সাগরে আসিয়া উপনীত হয়, তেমনি হে ভগবান্, এই-সকল বিভিন্ন বিচিত্র ধর্মবিশ্বাস ও পথ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী হইতে জন্মলাভ করিয়া সরল বা কুটিল পথে ধাবিত হইয়া অবশেষে তোমাতেই আসিয়া উপনীত হয়।’

বাস্তব রূপায়ণের ক্ষেত্রে আমরা দেখিতে পাই, এই অভিনব ভাবরাশির আধারভূত এই প্রাচীন দার্শনিক মতটি সর্বত্র নিজ প্রভাব বিস্তার করিয়া প্রত্যক্ষভাবে পৃথিবীর প্রথম প্রচারশীল ধর্মমত বৌদ্ধধর্মকে অনুপ্রাণিত করিয়াছে এবং আলেকজান্দ্রিয়াবাসী, অজ্ঞেয়বাদী ও মধ্যযুগের ইওরোপীয় দার্শনিকের মাধ্যমে খ্রীষ্টধর্মকেও প্রভাবিত করিয়াছে। পরবর্তী কালে ইহা জার্মান-দেশীয় চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করিয়া দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটাইয়াছে। অথচ এই অসীম প্রভাব প্রায় অলক্ষিতভাবেই পৃথিবীতে প্রসারিত হইয়াছে। রাত্রির মৃদু শিশিরসম্পাতে যেমন শস্যক্ষেত্রে প্রাণ সঞ্চারিত হয়, ঠিক তেমনি অতি ধীর গতিতে এবং অলক্ষ্যে এই অধ্যাত্মদর্শন মানবের কল্যাণার্থ সর্বত্র প্রসারিত হইয়াছে। এই ধর্মপ্রচারের জন্য সৈন্যগণের রণযাত্রার প্রয়োজন হয় নাই। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান প্রচারশীল ধর্ম বৌদ্ধধর্মে আমরা দেখি, প্রথিতযশা সম্রাট্ অশোকের শিলালিপিসমূহ সাক্ষ্য দিতেছে, কিরূপে একদা বৌদ্ধধর্ম-প্রচারকেরা আলেকজান্দ্রিয়া, আণ্টিওক, পারস্য, চীন প্রভৃতি তদানীন্তন সভ্য জগতের বহু দেশে প্রেরিত হইয়াছিলেন। ঐ শিলালিপিতে খ্রীষ্টের আবির্ভাবের তিনশত বৎসর পূর্বে তাঁহাদিগকে সাবধান করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, তাঁহারা যেন অপর ধর্মকে নিন্দা না করেন। বলা হইয়াছিল, ‘যেখানকারই হউক, সকল ধর্মেরই ভিত্তি এক; সকলকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে চেষ্টা কর, তোমার যাহা বলিবার আছে, সে-সকলই শিক্ষা দাও, কিন্তু এমন কিছু করিও না—যাহাতে কাহারও ক্ষতি হয়।’

এইরূপে দেখা যায়, ভারতবর্ষে হিন্দুদের দ্বারা অপর ধর্মাবলম্বীরা কখনও নির্যাতিত হয় নাই; প্রত্যুত এখানে দেখা যায় এক অত্যাশ্চর্য শ্রদ্ধা, যাহা তাহারা পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মমত সম্বন্ধে পোষণ করিয়াছে। নিজেদের দেশ হইতে বিতাড়িত য়াহুদীদের একাংশকে তাহারা আশ্রয় দিয়াছিল; তাহারই ফলে মালাবারে আজও য়াহুদীরা বর্তমান। অপর এক সময়ে তাহারা ধ্বংসপ্রায় পারসীক জাতির যে অংশটুকু সাদরে গ্রহণ করিয়াছিল, আজও তাঁহারা আমাদের জাতির অংশরূপে, আমাদের একান্ত প্রিয়জনরূপে আধুনিক বোম্বাই-প্রদেশবাসী পারসীকগণের মধ্যে রহিয়াছেন। যীশুশিষ্য সেণ্ট টমাসের সহিত এদেশে আগমন করিয়াছেন বলিয়া দাবী করেন, এইরূপ খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরাও এদেশে আছেন; তাঁহারা ভারতে বসবাস করিতে এবং নিজেদের ধর্মমত স্বাধীনভাবে পোষণ করিতে অনুমতি পাইয়াছিলেন; তাঁহাদের একটি পল্লী আজও এদেশে বর্তমান। পরধর্মে বিদ্বেষহীনতার এই মনোভাব আজও ভারতে বিনষ্ট হয় নাই, কোন দিনই হইবে না এবং হইতেও পারে না।

বেদান্ত যে-সব মহতী বাণী প্রচার করে, সেগুলির মধ্যে ইহা অন্যতম। ইহাই যখন স্থির হইল যে, আমরা জানিয়া হউক বা না জানিয়াই হউক একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হইতেছি, তখন অপরের অক্ষমতায় ধৈর্যহারা হইব কেন? কেহ অপরের তুলনায় শ্লথগতি হইলেও আমাদের তো ধৈর্য হারাইয়া কোন লাভ হইবে না, তাহাকে আমাদের অভিশাপ দিবার অথবা নিন্দা করিবারও প্রয়োজন নাই। আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হইলে, চিত্ত শুদ্ধ হইলে দেখিতে পাইব—সর্বকার্যে সেই একই ব্রহ্মশক্তির প্রভাব বিদ্যমান, সর্বমানব-হৃদয়ে সেই একই ব্রহ্মসত্তার বিকাশ ঘটিতেছে। শুধু সেই অবস্থাতেই আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্বের দাবী করিতে পারিব।

মানুষ যখন তাহার বিকাশের উচ্চতম স্তরে উপনীত হয়, যখন নর-নারীর ভেদ, লিঙ্গভেদ, মতভেদ, বর্ণভেদ, জাতিভেদ প্রভৃতি কোন ভেদ তাহার নিকট প্রতিভাত হয় না, যখন সে এই-সকল ভেদবৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সর্বমানবের মিলনভূমি মহামানবতা বা একমাত্র ব্রহ্মসত্তার সাক্ষাৎকার লাভ করে, কেবল তখনই সে বিশ্বভ্রাতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। একমাত্র ঐরূপ ব্যক্তিকেই প্রকৃত বৈদান্তিক বলা যাইতে পারে।

ইতিহাসে বেদান্ত-দর্শনের বাস্তবিক কার্যকারিতার যে-সকল সাক্ষ্য পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে কয়েকটি মাত্র এখানে উল্লিখিত হইল।