০৬. ভারতীয় ধর্মচিন্তা

[আমেরিকার ব্রুকলিন শহরে ক্লিণ্টন এভেন্যু-এর উপর অবস্থিত পাউচ্‌ ম্যানসনে আর্ট গ্যালারী কক্ষে ব্রুকলিন এথিক্যাল সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় প্রদত্ত বক্তৃতা।]

ভারতবর্ষ আকারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক হইলেও তাহার জনসংখ্যা ঊনত্রিশ কোটি; অধিবাসীদের মধ্যে মুসলমান, বৌদ্ধ এবং হিন্দু এই তিনটি ধর্মমতের আধিপত্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথমোক্ত ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছয় কোটি, দ্বিতীয়টির সংখ্যা নব্বই লক্ষ এবং প্রায় বিশ কোটি ষাট লক্ষ নরনারী শেষোক্ত ধর্মমতের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হইল এই যে, ইহা ধ্যানাশ্রয়ী ও তত্ত্বচিন্তাশ্রয়ী দার্শনিক মতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বেদের নানাখণ্ডে বিধৃত নৈতিক শিক্ষার উপর স্থাপিত। এই বেদ দাবী করেনঃ দেশের দিক্ হইতে এই ব্রহ্মাণ্ড অসীম এবং কালের দিক্ হইতে উহা অনন্ত। ইহার আদিও নাই, অন্তও নাই। জড়জগতে আত্মার শক্তির, সান্তের উপর অনন্ত শক্তির অসংখ্য বিকাশ ও প্রভাব ঘটিয়াছে; তথাপি অনন্ত অপরিমেয় আত্মা স্বয়ম্ভূ, শাশ্বত ও চির-অপরিবর্তনীয়। অনন্তের বক্ষে কালের গতি কোনরূপ চিহ্নই অঙ্কিত করিতে পারে না। মানবীয় বুদ্ধির অগম্য ইহার অতীন্দ্রিয় স্তরে অতীত বলিয়া কিছু নাই, ভবিষ্যৎ বলিয়াও কিছু নাই। বেদ প্রচার করেন, মানবাত্মা অবিনশ্বর। শরীর ক্ষয়-বৃদ্ধির নিয়মের অধীন—যাহারই বৃদ্ধি আছে, তাহারই বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু প্রত্যগাত্মার সম্পর্ক অন্তহীন শাশ্বত জীবনের সহিত; ইহার কোনদিন আদি ছিল না, আবার কোনদিন অন্তও হইবে না। হিন্দু ও খ্রীষ্টান ধর্মের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্য এই যে, খ্রীষ্টধর্মের মতে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের মুহূর্তকেই প্রত্যেক মানবাত্মার আরম্ভকাল ধরা হয়; কিন্তু হিন্দুধর্ম দাবী করে যে, মানবের আত্মা সনাতন ঐশী সত্তারই বহিঃপ্রকাশ এবং ঈশ্বরের যেমন আদি নাই, আত্মারও তেমনি আদি নাই। সে এক ব্যক্তিত্ব হইতে অপর ব্যক্তিত্বে নিরন্তর গমনাগমনের পথে আধ্যাত্মিক ক্রমবিকাশের মহান্ নিয়মানুসারে অগণিত রূপ পাইয়াছে এবং পূর্ণতা লাভ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রকার রূপ পাইতে থাকিবে; তারপর আর পরিবর্তন ঘটিবে না।

এ-সম্পর্কে এই প্রশ্ন প্রায়ই করা হয় যে, তাহাই যদি সত্য হয়, তবে অতীত জীবনসমূহের কিছুই কেন আমরা স্মরণ করিতে পারি না? আমাদের উত্তর এই যে, আমরা মানস মহাসমুদ্রের শুধু উপরিভাগের নাম দিয়াছি ‘চেতনা’, কিন্তু তাহার অতল গভীরে সঞ্চিত আছে আমাদের সর্বপ্রকার সুখ-দুঃখময় অভিজ্ঞতা। মানবাত্মা এমন কিছু পাইবার জন্যই লালায়িত, যাহা চিরস্থায়ী। কিন্তু আমাদের মন ও শরীর—বস্তুতঃ এই দৃশ্যমান বিশ্ব-প্রপঞ্চের সব-কিছুই নিরন্তর পরিবর্তনশীল। অথচ আমাদের আত্মার তীব্রতম আকাঙ্ক্ষা এমন কিছুর জন্য, যাহার পরিবর্তন নাই, যাহা চিরকালের জন্য পরিপূর্ণতায় স্থিতি লাভ করিয়াছে। অসীম ভূমারই জন্য মানবাত্মার এই তৃষ্ণা। আমাদের নৈতিক উন্নতি যত গভীর হইবে, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ যত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হইবে, এই কূটস্থ নিত্যের জন্য আকাঙ্ক্ষাও ততই তীব্র হইবে।

আধুনিক বৌদ্ধেরা এই শিক্ষা দেন, যাহা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না. তাহার অস্থিত্বই সম্ভব নয় এবং মানবাত্মার কোন স্বতন্ত্র সত্তা আছে—এ-বিশ্বাস ভ্রম মাত্র। অন্যদিকে বিজ্ঞানবাদীরা (Idealist) দাবী করেন, প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্বতন্ত্র সত্তা আছে, এবং তাহার মনোজগতে ধারণার বাহিরে বহির্বিশ্বের বাস্তবিক অস্তিত্ব নাই। এই দ্বন্দ্বের নিশ্চিত সমাধান এই যে, বস্তুতঃ বিশ্ব-প্রপঞ্চ স্বাতন্ত্র্য ও পরতন্ত্রতার—বস্তু ও ধারণার সংমিশ্রণ। আমাদের দেহ-মন বহির্জগতের উপর নির্ভরশীল এবং বহির্জগতের সহিত দেহমনের সম্বন্ধের অবস্থানুযায়ী এই নির্ভরশীলতার তারতম্য ঘটিয়া থাকে। কিন্তু ঈশ্বর যেমন স্বাধীন, প্রত্যগাত্মাও তেমনি মুক্ত, এবং শরীর ও মনের বিকাশ অনুযায়ী তাহাদের গতিকেও অল্পাধিক নিয়ন্ত্রণ করিতে সমর্থ।

মৃত্যু বলিতে অবস্থার পরিবর্তন মাত্রই বুঝায়। আমরা সেই একই বিশ্বের মধ্যে থাকিয়া যাই এবং পূর্বের মত সেই একই নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকি। এই বিশ্বকে যাঁহারা অতিক্রম করিয়াছেন, জ্ঞান ও সৌন্দর্য বিকাশের উচ্চতর লোকে যাঁহারা উপনীত, তাঁহারা তাঁহাদেরই অনুগামী বিশ্বব্যাপী সৈন্যবর্গের অগ্রগামী দল ভিন্ন আর কিছুই নন। এইরূপে সর্বোত্তম বিকাশপ্রাপ্ত আত্মা সর্বনিম্ন অনুন্নত আত্মার সহিত সম্বন্ধ এবং অসীম পূর্ণতার বীজ সকলের মধ্যেই নিহিত আছে। অতএব আমাদের আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুশীলন করিতে হইবে এবং সকলের মধ্যেই যাহা কিছু উত্তম নিহিত আছে, তাহাই দেখিবার জন্য সচেষ্ট থাকিতে হইবে। বসিয়া বসিয়া শুধু আমাদের শরীর-মনের অপূর্ণতা লইয়া বিলাপ করিলে কোন লাভ হইবে না। সমস্ত প্রতিকূল অবস্থাকে দমন করিবার জন্য যে বীরোচিত প্রচেষ্টা, তাহাই আমাদের আত্মাকে উন্নতির পথে চালিত করে। মানব-জীবনের উদ্দেশ্য—আধ্যাত্মিক উন্নতির নিয়মগুলিকে উত্তমরূপে আয়ত্ত করা। খ্রীষ্টানরা এ-বিষয়ে হিন্দুদের নিকট হইতে শিখিতে পারে। হিন্দুরাও খ্রীষ্টানদের নিকট হইতে শিখিতে পারে। বিশ্বের জ্ঞান-ভাণ্ডারে ইহাদের প্রত্যেকেরই মূল্যবান্ অবদান রহিয়াছে।

আপনারা সন্তান-সন্ততিদের এই শিক্ষাই দিন যে, প্রকৃত ধর্ম ইতিমূলক সৎ বস্তু, নেতিমূলক নয়; এই শিক্ষা দিন যে, শুধু পাপ হইতে বিরত থাকাই ধর্ম নয়, নিরন্তর মহৎ কর্মের অনুষ্ঠানই ধর্ম। প্রকৃত ধর্ম—কোন মানুষের নিকট হইতে শিক্ষাদ্বারা প্রাপ্য নয়, পুস্তকপাঠের দ্বারাও লভ্য নয়; প্রকৃত ধর্ম হইল অন্তরাত্মার জাগরণ এবং এই জাগরণ বীরোচিত পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা সংঘটিত হয়। এই পৃথিবীতে জাত প্রত্যেক শিশুই পূর্ব পূর্ব অতীত জীবন হইতে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা লইয়া জন্মগ্রহণ করে; এই-সকল সঞ্চিত অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট চিহ্ন তাহাদের দেহ-মনের গঠনে লক্ষিত হয়। কিন্তু আমাদের সকলের মধ্যেই যে এক প্রকার স্বাতন্ত্র্যবোধ আছে, তাহা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, শরীর ও মন ব্যতীত আরও কিছু আমাদের মধ্যে বিরাজমান। আমাদের সকলের অন্তরে যে-আত্মা আধিপত্য করে, তাহা স্বাধীন এবং তাহাই আমাদের মনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগাইয়া দেয়। আমরা নিজেরা যদি মুক্ত না হই, তাহা হইলে এই পৃথিবীর উন্নতিসাধনের আশা কিরূপে করি? আমরা বিশ্বাস করি যে, মানবের প্রগতি আত্মার কার্যকলাপের ফলেই সম্ভব হয়। এই পৃথিবী যাহা এবং আমরা যাহা, তাহা আত্মার মুক্তস্বভাবেরই ফল। আমাদের বিশ্বাস—ঈশ্বর এক। তিনি আমাদের সকলের পিতা, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, সর্বশক্তিমান্ এবং তিনি তাঁহার সন্তানদের অসীম ভালবাসার সহিত পরিচালন ও পরিপালন করেন। আমরা খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের ন্যায় সগুণ ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, কিন্তু সেখানেই ক্ষান্ত নই, আমরা আরও অগ্রসর হইয়া বলি যে, আমিই সেই ঈশ্বর; আমরা বলি যে, তাঁহারই ব্যক্তিত্ব আমাদের মধ্যে বিকশিত, আমাদের অন্তরে তিনিই বাস করেন এবং আমরা তাঁহাতেই অবস্থিত। আমরা বিশ্বাস করি, সকল ধর্মেই কিছু না কিছু সত্যের বীজ নিহিত আছে, এবং হিন্দুগণ সকল ধর্মের নিকটই শ্রদ্ধাভরে মস্তক অবনত করেন; কারণ এই বিশ্ব-প্রপঞ্চে ক্রমবৃদ্ধির নিয়মেই সত্য লব্ধ হয়, অবিরাম বাদ দেওয়ার নিয়মে নয়। আমরা ভগবানের চরণে সকল ধর্মের সর্বোৎকৃষ্ট পুষ্পরাশি দ্বারা সজ্জিত একটি স্তবক নিবেদন করিব। আমরা তাঁহাকে ভালবাসিবার জন্যই ভালবাসিব, কোন কিছু লাভের আশায় নয়। আমরা কর্তব্যের জন্যই কর্তব্য করিব, কোন পুরস্কারের প্রত্যাশায় নয়। আমরা সৌন্দর্যের জন্যই সৌন্দর্যের উপাসনা করিব, লাভের আকাঙ্ক্ষায় নয়। এইরূপে চিত্তের পবিত্রতা লইয়াই আমরা ভগবানের দর্শন পাইব। যাগ-যজ্ঞ, মুদ্রা ও ন্যাস, মন্ত্রোচ্চারণ বা মন্ত্রজপ প্রভৃতিকে ধর্ম বলা চলে না। এ-সকল তখনই প্রশংসনীয়, যখন সেগুলি আমাদের মনে সাহসের সহিত সুন্দর ও বীরোচিত কর্ম সম্পাদনের জন্য উৎসাহ সঞ্চার করে এবং আমাদের চিত্তকে ভগবানের পূর্ণতা উপলব্ধি করিবার স্তরে উন্নীত করে।

যদি প্রতিদিন শুধু প্রার্থনাকালে স্বীকার করি যে, ঈশ্বর আমাদের সকলের পিতা, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক মানুষের সহিত ভ্রাতার ন্যায় ব্যবহার না করি, তাহা হইলে কি লাভ? পুস্তক-রচনার উদ্দেশ্য শুধু আমাদের জন্য উচ্চতর জীবনের পথ নির্দেশ করা। কিন্তু কোন শুভ ফলই দেখা দিবে না, যদি না অবিচলিত পদে সেই পথে আমরা চলিতে পারি। প্রত্যেক মানুষেরই ব্যক্তিত্বকে একটি কাঁচের গোলকের সঙ্গে তুলনা করিতে পারা যায়। প্রত্যেকটির কেন্দ্র একই শুভ্র জ্যোতি, ঐশী সত্তার একই প্রকার বিচ্ছুরণ; কিন্তু কাঁচের আবরণের বর্ণ ও ঘনত্বের পার্থক্যে রশ্মিনিঃসরণে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা ঘটিতেছে। কেন্দ্রে অবস্থিত শিখাটির দীপ্তি ও সৌন্দর্য সমান, কিন্তু যে জাগতিক যন্ত্রের মাধ্যমে তাহার প্রকাশ হয়, কেবল তাহারই অপূর্ণতাবশতঃ তারতম্যে প্রতীতি ঘটে। বিকাশের মানদণ্ড অনুসারে আমরা যতই উচ্চে আরোহণ করিতে থাকিব, ততই প্রকাশযন্ত্র স্বচ্ছ হইতে স্বচ্ছতর হইতে থাকিবে।