উক্তি-সঞ্চয়ন—২

১। স্বামীজীকে প্রশ্ন করা হইল, ‘বুদ্ধের মত কি এই যে, বহুত্ব সত্য এবং একত্ব (আত্মা) মিথ্যা? আর হিন্দু (বেদ) মতে তো একত্বই সত্য, বহুত্ব মিথ্যা।’ স্বামীজী বলিলেনঃ হ্যাঁ, এবং এর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এবং আমি যাহা যোগ করেছি, তা এই যে, একই নিত্য বস্তু একই মনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে অনুভূত হয়ে এক ও বহুরূপে প্রতিভাত হয়।

২। একবার এক শিষ্যকে বলিলেনঃ মনে রাখিও জীবাত্মারই বিকাশের জন্য প্রকৃতি, প্রকৃতির জন্য জীবাত্মা নয়—ইহাই ভারতের শাশ্বত বাণী।

৩। পৃথিবী আজ চায় এমন কুড়িজন নরনারী, যাহারা সামনের ঐ পথে সাহসভরে দাঁড়াইয়া বলিতে পারে যে, ভগবান্ ব্যতীত তাহাদের অন্য কোন সম্বল নাই। কে আসিবে? কেন, ইহাতে ভয় কি? যদি এটি সত্য হয়, তবে আর কিসের প্রয়োজন? আর যদি এটি সত্য না হয়, তবে আমাদের বাঁচিয়া কি লাভ?

৪। আহা, পরমাত্মার স্বরূপ যিনি জানিয়াছেন, তাঁহার কাজ কতই না শান্ত! বাস্তবিকপক্ষে লোকের দৃষ্টি খুলিয়া দেওয়া ছাড়া তাঁহাদের অন্য কিছু করণীয় থাকে না। আর যাহা কিছু, তাহা আপনিই হইতে থাকে।

৫। তিনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) এক মহৎ জীবনযাপন করিয়াই তৃপ্ত ছিলেন এবং সেই জীবনের তাৎপর্য-নির্ণয়ের ভার দিয়া গিয়াছেন অপর সকলের উপর।

৬। একজন শিষ্য কোন একটি বিষয়ে স্বামীজীকে সংসারের অভিজ্ঞতাসম্ভূত পরামর্শ দিলে স্বামীজী বিরক্তির সহিত বলিলেনঃ পরিকল্পনা আর পরিকল্পনা! এই জন্যই পাশ্চাত্যবাসীরা কখনও কোন ধর্মমত গঠন করিতে পারে না। তোমাদের মধ্যে যদি কেহ কখনও পারিয়া থাকে, তবে তাহা কয়েকজন ক্যাথলিক সন্ন্যাসী মাত্র, যাহাদের পরিকল্পনা বলিতে কিছু ছিল না। পরিকল্পনাকারীদের দ্বারা কখনও ধর্মপ্রচার হয় নাই।

৭। পাশ্চাত্যের সমাজ-জীবন দেখিতে একটি হাসির হুল্লোড়ের মত, কিন্তু একটু নীচেই উহা কান্নায় ভরা। ইহার শেষ হয় হতাশ ক্রন্দনে। কৌতুক উচ্ছলতা সবই সমাজের উপর উপর, বাস্তবিকপক্ষে ইহা বিষাদে পূর্ণ। এদেশে (ভারতে) আবার বাহিরে হয়তো নিরাপদ ও বিষাদ, কিন্তু ভিতরে গাম্ভীর্য, নিশ্চিন্ততা ও আনন্দ।

আমাদের একটি মতবাদ আছে—ঈশ্বর স্বয়ং লীলাচ্ছলে নিজেকে জীবজগতে রূপান্তরিত করিয়াছেন এবং এই সংসারে অবতারেরা লীলাচ্ছলে দেহধারণ করিয়া জীবন যাপন করেন। সবটাই লীলা, সবই খেলা। যীশু ক্রুশবিদ্ধ হইয়াছিলেন কেন? সেটাও সম্পূর্ণ খেলা। মানব জীবনের সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। উহাও ঈশ্বরের সঙ্গে ক্রীড়ামাত্র। বল, ‘সবই লীলা, সবই খেলা।’ খেলা ছাড়া তুমিও আর কিছু কর কি?

৮। আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি যে, এক জীবনেই কেহ নেতা হইয়া উঠিতে পারে না। তাহাকে শক্তি লইয়াই জন্মাইতে হয়। কারণ সংগঠন বা পরিকল্পনা তেমন কষ্টসাধ্য নয়। নেতার পরীক্ষা—প্রকৃত পরীক্ষা হয় বিভিন্ন ব্যক্তিকে তাহাদের সাধারণ সহানুভূতির সূত্র ধরিয়া, সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া রাখার ক্ষমতায়। চেষ্টা করিয়া নয়, অজ্ঞাতসারেই ইহা হইয়া থাকে।

৯। প্লেটোর ভাববাদ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করিতে গিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘তাহা হইলে তোমরা দেখিতেই পাইতেছ যে, বড় বড় ভাবগুলির ক্ষীণতম বিকাশ এই-সব যাহা কিছু। ঐ ভাবগুলিই সত্য এবং সম্পূর্ণ। একটি আদর্শ ‘তুমি’ কোথাও আছে এবং সেইটি জীবনে রূপায়িত করার জন্যই এখানে তোমার যত চেষ্টা। চেষ্টা হয়তো অনেক দিক্‌ দিয়াই ত্রুটিপূর্ণ হইবে, তবু চেষ্টা করিয়া যাও। একদিন না একদিন সে আদর্শ রূপায়িত হইবে।’

১০। জনৈক শিষ্যা নিজের ভাব ব্যক্ত করিয়া মন্তব্য করিলেন, ব্যক্তিগত মুক্তি—জীবন হইতে নিষ্কৃতি পাইবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অপেক্ষা যে-সকল উদ্দেশ্য সাধন করা আমি শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করি, সেইগুলি সম্পাদন করার জন্য বারবার সংসারে ফিরিয়া আসা আমি ভাল বলিয়া মনে করি। ইহাতে স্বামীজী তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, ‘ইহার কারণ তুমি উন্নতি করিবার ধারণার ঊর্ধ্বে উঠিতে পার না; কিন্তু কোন জিনিষই উন্নততর হয় না। ঐগুলি যেমন তেমনই থাকে। ঐগুলির রূপান্তর ঘটাইয়া শুধু আমরাই উন্নততর হই।’

১১। আলমোড়াতে একজন বয়স্ক লোক স্বামীজীর নিকট আসিলেন। তাঁহার মুখে এমন একটা পরনির্ভরতার ভাব ছিল, যাহা দেখিলেই সহানুভূতি জাগে। তিনি কর্মবাদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলেন, ‘যাহারা নিজ কর্মদোষে দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার দেখিতে বাধ্য হয়, তাহাদের কর্তব্য কি?’ স্বামীজী ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘কেন, সকলকে ঠেঙাইবে, আবার কি? এই কর্মবাদের মধ্যে তোমার নিজের অংশটা তুমি ভুলিয়া যাইতেছ। মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার—বিদ্রোহ করিবার অধিকার তোমার সব সময়ই আছে।’

১২। একজন স্বামীজীকে প্রশ্ন করিলেন, ‘সত্যের জন্য কি মানুষের মৃত্যুকেও বরণ করা উচিত, অথবা গীতার শিক্ষা অনুসারে সর্বদা উদাসীন থাকিতে চেষ্টা করা উচিত?’ স্বামীজী ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ থামিয়া থামিয়া বলিলেন, ‘আমি উদাসীন থাকার পক্ষপাতী।’ তারপর আবার বলিলেন, ‘এটি সন্ন্যাসীর জন্য; গৃহীদের পথ আত্মরক্ষা।’

১৩। সবাই সুখ চায়—এ-কথা ভুল। প্রায় সমসংখ্যক লোক জন্মায় দুঃখকে বরণ করবার জন্য। এস, আমরা ভয়ঙ্করকে ভয়ঙ্কর হিসাবেই পূজা করি।

১৪। আজ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সাহস করিয়া বলিতে পারিয়াছেনঃ ঠিক যে-ভাষায় অপরে কথা বলে ও যে-ভাষা বোঝে, তাহার সহিত সেই ভাষাতেই কথা বলা উচিত।

১৫। নিজ জীবনে কালীকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার পূর্বে তাঁহার সন্দেহ-বিজড়িত দিনগুলিকে লক্ষ্য করিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘কালী ও কালীর সর্বপ্রকার কার্যকলাপে আমি কতই না অবজ্ঞা করিয়াছি! আমার ছ বছরের মানসিক দ্বন্দ্বের কারণ ছিল এই যে, আমি তাঁহাকে মানিতাম না। কিন্তু অবশেষে তাঁহাকে আমায় মানিতে হইয়াছে। রামকৃষ্ণ পরমহংস আমাকে তাঁহার কাছে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন এবং এখন আমার বিশ্বাস যে, সব কিছুতেই মা-কালী আমায় পরিচালিত করিতেছেন এবং তাঁহার যা ইচ্ছা, তাই আমার দ্বারা করাইয়া লইতেছেন। তবু আমি কতদিনই না তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছি। আসল কথা এই, আমি যে শ্রীরামকৃষ্ণকে ভালবাসিতাম; তাহাই আমাকে ধরিয়া রাখিত। আমি তাঁহার অপূর্ব পবিত্রতা দেখিয়াছি। আমি তাঁহার আশ্চর্য ভালবাসা অনুভব করিয়াছি। তখনও পর্যন্ত তাঁহার মহত্ত্ব আমার নিকট প্রতিভাত হয় নাই। পরে যখন আমি তাঁহার কাছে নিজেকে সমর্পণ করিয়া দিলাম, তখন ঐ ভাব আসিয়াছিল। তাহার পূর্বে আমি তাঁহাকে বিকৃতমস্তিষ্ক একটি শিশু বলিয়া ভাবিতাম, মনে করিতাম—এই জন্যই তিনি সর্বদা অলৌকিক দৃশ্য প্রভৃতি দেখেন। এগুলি আমি ঘৃণা করিতাম। তারপর আমাকেও মা-কালী মানিতে হইল। না, যে কারণে আমাকে মানিতে হইল, তাহা একটি গোপন রহস্য, এবং উহা আমার মৃত্যুর সঙ্গেই লুপ্ত হইবে। সে-সময় আমার খুবই ভাগ্য বিপর্যয় চলিতেছিল। … ইহা আমার জীবনে এক সুযোগ হিসাবে আসিয়াছিল। মা (কালী) আমাকে তাঁহার ক্রীতদাস করিয়া লইলেন। এই কথাই বলিয়াছিলাম, ‘আমি তোমার দাস।’ রামকৃষ্ণ পরমহংসই আমাকে তাঁহার চরণে অর্পণ করিয়াছিলেন। অদ্ভুত ব্যাপার! এই ঘটনার পর তিনি মাত্র দুই বছর জীবিত ছিলেন এবং ঐ কালের অধিকাংশ সময়ই অসুস্থ ছিলেন। ছয় মাসের মধ্যেই তাঁর স্বাস্থ্য এবং লাবণ্য নষ্ট হইয়া যায়।

তোমরা জান, গুরু নানকও এই রকম এমন একজন শিষ্যের খোঁজ করিয়াছিলেন, যাঁহাকে তিনি তাঁহার শক্তির উত্তরাধিকারী করিয়া যাইতে পারেন। তিনি তাঁহার পরিবারবর্গের কাহাকেও উপযুক্ত মনে করিলেন না। তাঁহার সন্তানসন্ততিরা তাঁহার কাছে অত্যন্ত অযোগ্য বলিয়া মনে হইল। তারপর তিনি এক বালকের সন্ধান পাইলেন, তাহাকে ঐ শক্তি দিলেন, এবং দেহত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইলেন।

তোমরা বলিতেছ, ভবিষ্যতে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে কালীর অবতার বলা হইবে কি? হাঁ, আমিও মনে করি, কালী তাঁহার কার্য সম্পাদনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের দেহযন্ত্র পরিচালিত করিয়াছিলেন। দেখ, আমার পক্ষে ইহা বিশ্বাস না করিয়া উপায় নাই যে, কোথাও এমন এক বিরাট শক্তি নিশ্চয় আছেন, যিনি নিজেকে কখনও কখনও নারীরূপে কল্পনা করেন এবং তাঁহাকে লোকে ‘কালী’ এবং ‘মা’ বলিয়া ডাকে। আমি ব্রহ্মেও বিশ্বাস করি। আর আসল ব্যাপারটা কি সব সময় ঠিক ঐরূপই নয়? … যেমন সংখ্যাতীত জীবকোষের সমষ্টিতেই ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়, যেমন একটি নয়—বহু মস্তিষ্ক-কোষের সমবায়ে চৈতন্যের উৎপত্তি হয়, ঠিক তেমনি নয় কি? একত্ব মানেই বৈচিত্র্য। ইহাও ঠিক সেইরকম। ব্রহ্ম সম্বন্ধেই বা ভিন্ন ব্যবস্থা কেন? ব্রহ্মই আছেন, তিনিই একমাত্র সত্তা, কিন্তু তবু তিনিই আবার বহু দেবতাও হইয়াছেন।

১৬। যতই বয়স বাড়িতেছে, ততই মনে হয়, বীরত্বের উপরই সব কিছু নির্ভর করে। ইহাই আমার নূতন বাণী।

১৭। ‘কোন কোন সমাজে নরমাংস-ভোজন স্বাভাবিক জীবন-যাত্রার অঙ্গীভূত’—ইওরোপে এই মতের উল্লেখ শুনিয়া স্বামীজী মন্তব্য করিলেনঃ এটা কি সত্য নয় যে, যুদ্ধে হিংসার বশবর্তী হইয়া বা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ছাড়া কোন জাতিই কখনও নরমাংস ভোজন করে না? তোমরা কি ইহা বুঝিতে পার না? সমাজবদ্ধ প্রাণীদের ইহা রীতি নয়, কারণ ইহাতে সমাজ-জীবনের মূলোচ্ছেদ হইবে।

১৮। মৃত্যু বা কালীকে উপাসনা করিতে সাহস পায় কয়জন? এস, আমরা মৃত্যুর উপাসনা করি। আমরা যেন ভীষণকে ভীষণ জানিয়াই আলিঙ্গন করি—তাহাকে যেন কোমলতর হইতে অনুরোধ না করি, আমরা যেন দুঃখের জন্যই দুঃখকে বরণ করি।

১৯। পাঁচ-শ বছর নীতির অনুশাসন, পাঁচ-শ বছর মূর্তিপূজা এবং পাঁচ-শ বছর তন্ত্রের প্রাধান্য—বৌদ্ধধর্মের এই তিনটি যুগ। তোমরা যেন কখনও না ভাব যে, ভারতে বৌদ্ধধর্ম নামে এমন কোন ধর্মমত ছিল, যাহার স্বতন্ত্র ধরনের মন্দির, পুরোহিত প্রভৃতি ছিল; এ-রকম কোন কিছুই ছিল না। বৌদ্ধধর্ম সব সময়ই হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত ছিল। কেবল কোন এক সময়ে বুদ্ধের প্রভাব বিশেষ প্রবল হইয়াছিল, এবং তাহার ফলে সমস্ত জাতিতে সন্ন্যাসের প্রাধান্য ঘটিয়াছিল।

২০। যাঁহারা প্রাচীনপন্থী, তাঁহাদের দৃষ্টিতে আদর্শ বলিতে শুধু আত্মসমর্পণই বুঝায়। কিন্তু তোমাদের আদর্শ হইল সংগ্রাম। ফলে জীবনকে উপভোগ করি আমরাই, তোমরা কখনই পার না। তোমরা সব সময় আরও ভাল কিছুর জন্য তোমাদের জীবনকে পরিবর্তিত করিতে সচেষ্ট, কিন্তু ঈপ্সিত পরিবর্তনের লক্ষ ভাগের এক ভাগ সাধিত হওয়ার আগেই তোমরা মরিয়া যাও। পাশ্চাত্যের আদর্শ হইল—কোন কিছু করা এবং প্রাচ্যের আদর্শ হইল—সহ্য করা। ‘করা’ এবং ‘সহ্য করা’—এই দুইয়ের অপূর্ব সমন্বয়েই পূর্ণ জীবন গড়িয়া উঠিবে, কিন্তু তাহা কখনও সম্ভব নয়।

আমাদের সমাজে এটা স্বীকৃত সিদ্ধান্ত যে, মানুষের সব আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হওয়া সম্ভব নয়। সেজন্যই আমাদের জীবন অনেক বিধি-নিষেধের অধীন। এগুলি সৌন্দর্যহীন মনে হইলেও ইহা শক্তি ও আলোকপ্রদ। আমাদের সমাজের উদারপন্থীরা সমাজের শুধু কুৎসিত দিকটা দেখিয়া ইহাকে দূরে বর্জন করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার পরিবর্তে যাহা প্রবর্তন করিলেন, তাহা তেমনি খারাপ। তারপর নূতন প্রথাগুলির শক্তি লাভ করিতে পুরাতন প্রথাগুলির মতই দীর্ঘ সময় লাগিবে।

পরিবর্তন করিলেই ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় হয় না, বরং উহা দুর্বল ও পরিবর্তনের অধীন হইয়া পড়ে। তবে আমাদের সব সময়েই গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। নিজস্ব করিয়া লওয়ার মধ্য দিয়াই ইচ্ছাশক্তি দৃঢ়তর হয়। আর পৃথিবীতে ইচ্ছাশক্তিই একমাত্র বস্তু, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমরা ইহার প্রশংসা করিয়া থাকি। সতীদাহ-প্রথায় সতীগণ সকলের প্রশংসা অর্জন করেন, যেহেতু এই প্রথার ভিতর দিয়া দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ পায়।

স্বার্থপরতা দূর করিবার জন্য চেষ্টা করিতে হইবে। জীবনে যখনই কোন ভুল করিয়াছি, তখনই দেখিয়াছি, তাহার মূল কারণ হইল আমি আমার স্বার্থবুদ্ধিকে উহার মধ্যে আনিয়াছিলাম। যেখানে আমার স্বার্থ ছিল না, সেখানে আমার সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত হইয়াছে।

স্বার্থবুদ্ধি না থাকিলে কোন ধর্মমতই গড়িয়া উঠিত না। মানুষের নিজের জন্য কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা না থাকিলে তোমরা কি মনে কর যে, তাঁহার এই-সব প্রার্থনা উপাসনা প্রভৃতি থাকিত? হয়তো বা কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য বা অপর কিছু দেখিয়া কখনও কখনও সামান্য একটু স্তুতি করিত, ইহা ছাড়া সে ঈশ্বরের কথা কখনও ভাবিত না। সর্বদা ভগবানের স্তুতি ও প্রার্থনায় রত থাকাই তো উচিত। কিন্তু হায়! আমরা যদি এই স্বার্থবুদ্ধি ছাড়িতে পারিতাম!

যুদ্ধ-বিগ্রহ অগ্রগতির লক্ষণ—এই কথা যখনই ভাব, তখনই তুমি সম্পূর্ণ ভুল কর। ব্যাপারটি মোটেই ঐ রকম নয়। অগ্রগতির লক্ষণ—গ্রহণশীলতা। কোন কিছুকে গ্রহণ করিয়া নিজস্ব করিয়া লওয়া হিন্দুধর্মের বিশেষত্ব। যুদ্ধ-বিগ্রহ লইয়া আমরা কখনও মাথা ঘামাইতাম না। অবশ্য আমাদের নিজ বাসভূমি রক্ষার জন্য কখনও কখনও অস্ত্রধারণ করিয়া থাকিতে পারি, কিন্তু যুদ্ধকে নীতি হিসাবে কোনদিনই আমরা গ্রহণ করি নাই। প্রত্যেক জাতিকেই ইহা শিখিতে হইয়াছে। অতএব নবাগত জাতিগুলি কিছুদিন ঘুরপাক খাইতে থাকুক, অবশেষে সকলেই হিন্দুধর্মের (ভাবের) অঙ্গীভূত হইয়া পড়িবে।

২১। কেবল মানুষ নয়, সমস্ত জীবাত্মার সমষ্টিই হইলেন সগুণ ঈশ্বর। সমষ্টির ইচ্ছাকে কিছুই রোধ করিতে পারে না। নিয়ম বলিতে আমরা যাহা বুঝি তাহা এই; ইহাকেই আমরা শিব, কালী বা অন্য নামে ব্যক্ত করি।

২২। ভীষণের পূজা কর, মৃত্যুর উপাসনা কর। বাকী সবই বৃথা; সমস্ত চেষ্টাই বৃথা। ইহাই শেষ উপদেশ। কিন্তু ইহা কাপুরুষের এবং দুর্বলের মৃত্যুবরণ নয় বা আত্মহত্যাও নয়—ইহা শক্তিমান্ পুরুষের মৃত্যুবরণ, যিনি সব কিছুর অন্তরতম প্রদেশ খুঁজিয়া দেখিয়াছেন ও জানিয়াছেন যে, ইহা ছাড়া দ্বিতীয় কোন সত্য নাই।

২৩। যাহারা তাহাদের কুসংস্কারগুলি আমাদের দেশবাসীর ঘাড়ে চাপাইবার চেষ্টা করে, তাহাদের সঙ্গে আমি একমত নই। মিশর তত্ত্ববিদগণের মিশরের প্রতি কৌতূহল পোষণ করার মত ভারতবর্ষ সম্বন্ধেও লোকের কৌতূহল পোষণ করা সহজ, কিন্তু উহা স্বার্থ-প্রণোদিত।

কেহ কেহ হয়তো প্রাচীন গ্রন্থে, গবেষণাগারে বা স্বপ্নে ভারতবর্ষকে যেমন দেখিয়াছেন, তাহাকে আবার সেইভাবে দেখিতে ইচ্ছা করেন। আমি সেই ভারতকেই আবার দেখিতে চাই, যে-ভারতে প্রাচীন যুগে যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ ভাব ছিল, তাহার সহিত বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ ভাবগুলি স্বাভাবিকভাবে মিলিত হইয়াছে। এই নূতন অবস্থার সৃষ্টি ভিতর হইতেই হইবে, বাহির হইতে নয়।

সেজন্য আমি কেবল উপনিষদই প্রচার করি। তোমরা লক্ষ্য করিবে যে, আমি কখনও উপনিষদ্ ছাড়া অন্য কিছু আবৃত্তি করি না। আবার উপনিষদের যে-সব বাক্যে শক্তির কথা আছে, সেগুলিই বলি। শক্তি—এই একটি শব্দের মধ্যেই বেদ-বেদান্তের মর্মার্থ রহিয়াছে। বুদ্ধের বাণী ছিল অপ্রতিরোধ বা অহিংসা; কিন্তু আমার মতে, সেই অহিংসা শিক্ষা দেওয়ার জন্য শক্তির ভাব, একটি উন্নততর উপায়। অহিংসার পিছনে আছে একটি ভয়ঙ্কর দুর্বলতা; দুর্বলতা হইতেই প্রতিরোধের ভাবটি আসে। আমি সমুদ্রের একটি জলকণিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ লইবার বা ইহাকে এড়াইবার কথা কখনও চিন্তা করি না। আমার নিকট ইহা কিছুই নয়, কিন্তু একটা মশার কাছে এটা বিপজ্জনক। সব রকম হিংসার ব্যাপারেই এই একই কথা—শক্তি এবং নির্ভীকতা। আমার আদর্শ সেই মহাপুরুষ, যাঁহাকে লোকে সিপাহী বিদ্রোহের সময় হত্যা করিয়াছিল এবং যিনি বুকে ছুরিকাহত হইলে মৌন ভঙ্গ করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘তুমিও তিনিই।’

তোমরা জিজ্ঞাসা করিতে পার—এই চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণের স্থান কোথায়? তাঁহার ছিল অদ্ভুত জীবন, এক অত্যাশ্চর্য সাধনা, যাহা অজ্ঞাতসারে গড়িয়া উঠিয়াছিল। তিনি নিজেও তাহা জানিতেন না। তিনি ইংলণ্ড বা ইংলণ্ডবাসীদের সম্বন্ধে—তাহারা সমুদ্রপারের এক অদ্ভুত জাতি—এইটুকু ছাড়া আর কিছুই জানিতেন না। কিন্তু তিনি এক মহৎ জীবন দেখাইয়া গিয়াছেন এবং আমি তাহার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিতেছি। কোনদিন কাহারও একটি নিন্দাবাদ তিনি করেন নাই। একবার আমি আমাদের দেশের এক ব্যভিচারী সম্প্রদায়ের সমালোচনা করিতেছিলাম। আমি তিন ঘণ্টা ধরিয়া বকিয়া গেলাম, কিন্তু তিনি শান্তভাবে সব শুনিলেন। আমার বলা শেষ হইলে বৃদ্ধ বলিলেন, ‘তাই না হয় হল, প্রত্যেক বাড়ীরই তো একটা খিড়কির দরজা থাকতে পারে; তা কে জানে?’

আজ পর্যন্ত যত ভারতীয় ধর্ম হইয়াছে, সেগুলির দোষ এই যে, ধর্মগুলিতে দুটি কথা স্থান পাইয়াছে—ত্যাগ ও মুক্তি। জগতে কেবল মুক্তিই চাই! গৃহীদের জন্য কি কিছুই বলিবার নাই? কিন্তু আমি গৃহীদের সাহায্য করিতে চাই। সকল আত্মাই কি সমগুণসম্পন্ন নয়? সকলেরই লক্ষ্য কি এক নয়? সুতরাং শিক্ষার মধ্য দিয়া জাতির ভিতর শক্তির স্ফুরণ হওয়া আবশ্যক।

২৪। হিন্দুধর্মের সু-উচ্চ ভাবগুলি জনতার কাছে পৌঁছিয়া দিবার চেষ্টা হইতেই পুরাণগুলির উৎপত্তি। ভারতবর্ষে একজনই মাত্র এই প্রয়োজন অনুভব করিয়াছিলেন—তিনি শ্রীকৃষ্ণ, এবং সম্ভবতঃ তিনি মানবেতিহাসে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।

এইরূপে এমন একটি ধর্মের উৎপত্তি হইল, যাহা ক্রমে বিষ্ণুর উপাসনাতে পর্যবসিত হয় এবং ঐ উপাসনাতে আমাদের জীবনরক্ষা ও সাংসারিক সুখ ভোগকেও ভগবান্‌ লাভের উপায়রূপে স্বীকার করা হইয়াছে। আমাদের দেশের শেষ ধর্ম-আন্দোলন হইল শ্রীচৈতন্যদেবের মতবাদ। তোমাদের স্মরণ থাকিতে পারে, ঐ মতবাদেও ভোগের কথা আছে। অন্যদিকে জৈনধর্ম আবার আর একটি বিপরীত চরম ভাবের দৃষ্টান্ত। ইহাতে আত্ম- নিগ্রহের দ্বারা ধীরে ধীরে শরীর ধ্বংস করা হয়। অতএব তোমরা দেখিতে পাইতেছ, বৌদ্ধধর্ম হইল জৈনধর্মের এক সংস্কৃত রূপ এবং বুদ্ধ যে পাঁচজন তপস্বীর সঙ্গ ত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহার প্রকৃত অর্থ ইহাই। একদিকে চরম কৃচ্ছ্রতা, অপরদিকে সম্ভোগ—এই সব বিভিন্ন স্তরের দৈহিক সাধনায় রত ধর্মসম্প্রদায়সমূহ ভারতবর্ষে প্রত্যেক যুগে একের পর এক আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। সেইসব যুগেই আবার এমন কতকগুলি দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছে, যাহাদের কেহবা ঈশ্বর-লাভের উপায়স্বরূপ ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়োজিত করিয়াছে আবার কেহবা উহার জন্যই ইন্দ্রিয়গুলিকে ধ্বংস করিতে উদ্যত। এইভাবে দেখা যায়, হিন্দুধর্মের মধ্যে সর্বদাই যেন দুটি বিপরীত সর্পিলগতি সিঁড়ি (spiral staircase) একই অক্ষ-অবলম্বনে কখনও বা ঊর্ধ্বগামী, কখনও বা অধোগামী হইয়া পরস্পরের অভাব পূরণ করিয়া চলিয়াছেন।

হাঁ, বৈষ্ণবধর্মের মতে তুমি যাহা কিছু করিতেছ সবই ভাল, তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, স্বামী এবং সন্তানের প্রতি এই যে তীব্র ভালবাসা, ইহার সবই ভাল। এগুলির সবই ঠিক, তুমি ভাবিতে পার যে, কৃষ্ণই তোমার সন্তান, আর সন্তানকে যখন কোন খাবার দাও, তখন যদি ভাবিতে পার যে, তুমি কৃষ্ণকেই খাওয়াইতেছে। এই ছিল চৈতন্যের বাণী—‘সব ইন্দ্রিয় দিয়ে তুমি ঈশ্বরেরই পূজা কর।’ ইহার বিপরীত ভাব বেদান্তে বলা       হইয়াছে—‘ইন্দ্রিয়কে সংযত কর, ইন্দ্রিয়কে প্রতিহত কর।’

আমার দৃষ্টিতে ভারত যেন নবযৌবনসম্পন্ন এক জীবন্ত প্রাণী বিশেষ, ইওরোপও যৌবনশালী এবং জীবন্ত। দুইটির কোনটিই তাহাদের উন্নতির এমন স্তরে আসিয়া পৌঁছায় নাই, যেখানে আমরা নির্বিবাদে তাহাদের সমাজের ব্যবস্থাগুলি সমালোচনা করিতে পারি। উভয়েই দুই বিরাট পরীক্ষার মধ্য দিয়া চলিতেছে। কোন পরীক্ষাই এখনও সম্পূর্ণ নয়। ভারতে আমরা পাই সামাজিক সাম্যবাদ, যাহা অদ্বৈতের আধ্যাত্মিক ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত [প্রত্যেকের ভিতরে ব্রহ্ম বিরাজ করিতেছেন]। ইওরোপে সামাজিক দৃষ্টিতে তোমরা ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী, কিন্তু তোমাদের চিন্তাধারা যাহা দ্বৈতমূলক [ব্যক্তি-কল্যাণ চাহিলেও তোমরা সেই সঙ্গে সমাজ-কল্যাণ চাহিতেছ] অর্থাৎ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সাম্যবাদী।

অতএব দেখা যাইতেছে, একদিকে আছে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের বেড়া দেওয়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অপরদিকে আছে সাম্যবাদের বেড়া দেওয়া ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যমূলক সমাজ।

এখন ভারতীয় পরীক্ষা যে-ধারায় চলিতেছে, ঠিক সেই ভাবেই চলিতে আমরা ইহাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করিব। যে-সমস্ত আন্দোলন কোন বিষয়বস্তুকে ঠিক তাহারই দিক্‌ হইতে সাহায্য না করে, সেগুলি সেই হিসাবে ভাল নয়। উদাহরণ হিসাবে ইওরোপে বিবাহ করা এবং বিবাহ না করা—এই উভয় ব্যবস্থার প্রতিই আমি গভীর শ্রদ্ধাশীল। ভুলিয়া যাইও না, মানুষের জীবনকে মহৎ এবং সম্পূর্ণ করিয়া তুলিতে গুণগুলি যতটা কাজে লাগে, দোষগুলি ঠিক ততটা লাগে। অতএব যদি ইহা প্রমাণিতও হয় যে, কোন জাতির চরিত্রে কেবল দোষই আছে, তবুও আমরা যেন ঐ জাতির বিশেষত্বকে একেবারে উড়াইয়া না দিই।

২৫। তোমরা হয়তো বলিতে পার যে, প্রতিমা বস্তুতঃ ঈশ্বর। কিন্তু ভগবানকে শুধু প্রতিমা বলিয়া ভাবিও না (ভাবারূপ ভুলটি সর্বদাই এড়াইয়া চলিতে হইবে)।

২৬। একবার হটেনটটদের জড়োপাসনাকে নিন্দা করার জন্য স্বামীজীকে অনুরোধ করা হইল। তিনি উত্তর দিলেন—জড়োপাসনা বলিতে কি বুঝায়, আমি জানি না। তখন একটি বিবরণ দিয়া তাঁহার সামনে একটি বীভৎস চিত্র অঙ্কিত করিয়া দেখান হইল, কিরূপে একই বস্তুকে পর্যায়ক্রমে পূজা, প্রহার এবং স্তবস্তুতি করা হয়। তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘আমিও তো এই রকম’। কিছুটা বাদেই অবহেলিত এই লোকগুলির প্রতি তাহাদের অসাক্ষাতে এইরূপ অবিচারে ক্ষুব্ধ এবং উত্তেজিত হইয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, ‘তোমরা কি বুঝিতে পারিতেছ না, তোমরা কি দেখিতেছ না যে, জড়োপাসনা বলিয়া কিছুই নাই? দেখ, তোমাদের হৃদয় কঠিন হইয়া গিয়াছে, তাই তোমরা বুঝিতে পার না যে, শিশুরা যাহা করে, তাহাই ঠিক। শিশুরা সব কিছুকেই জীবন্ত দেখে। জ্ঞানী হইয়া আমরা শিশুর সেই দৃষ্টি হারাইয়া ফেলি। অবশেষে উচ্চতর জ্ঞানলাভ করিয়া আমরা আবার সেই দৃষ্টি ফিরিয়া পাই। পাহাড়, কাঠ, গাছ এবং অন্যান্য সব কিছুর মধ্যেই সে একটা জীবন্ত শক্তি দেখে। আর ইহাদের পিছনে কি সত্যই একটা জীবন্ত শক্তি নাই? ইহা প্রতীকোপাসনা, জড়োপাসনা নয়। বুঝিলে কি? সুতরাং ভগবানের নামই সব—তোমরা কি ইহা বুঝ না?’

২৭। একদিন তিনি সত্যভামের ত্যাগ সম্বন্ধে গল্পটি বলিতে গিয়া বলিলেন, কিভাবে একটুকরা পত্রের ওপর ‘কৃষ্ণ’ কথাটি লিখে দাঁড়িপাল্লায় নিয়ে এবং অপর দিকে কৃষ্ণকে বসিয়ে দেওয়ার ফলে দাঁড়িপাল্লা কৃষ্ণনামের দিকে নেমে গিয়াছিল। তিনি আবার বলিলেন, গোঁড়া হিন্দুদের কাছে শ্রুতিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ—সব কিছু। এই জিনিষটি হচ্ছে পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান্ একটি চিরন্তন ভাবের সামান্য বিকাশমাত্র। ঈশ্বর নিজেই এই অনন্ত মনে এই ভাবের একটি স্থূল প্রকাশ। তুমি যে ব্যক্তি, এর চেয়ে তোমার নাম অনন্তগুণ শ্রেষ্ঠ। ঈশ্বর অপেক্ষাও ঈশ্বরের নাম বড়। অতএব বাক্‌-সংযম কর।

২৮। আমি গ্রীকদের দেবতা মানি না। কেননা তারা মানুষ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেবল তাঁদেরই পূজা-উপাসনা করা উচিত, যাঁরা ঠিক আমাদেরই মত, কিন্তু আমাদের অপেক্ষা মহত্তর। আমার ও দেবতাদের মধ্যে যে ব্যবধান, তা গুণগত তারতম্য মাত্র।

২৯। একটি পাথর পড়ে একটি কীটকে গুঁড়িয়ে দিল। সুতরাং আমরা অনুমান করিতে পারি সমস্ত পাথরখণ্ডই পড়ে গেলে কীটদের গুঁড়িয়ে দেয়। এই রকম একটি যুক্তি কেন আমরা সঙ্গে সঙ্গে অপর একটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করব? অভিজ্ঞতা একটি ক্ষেত্রেই হয়েছে, কিন্তু মনে কর—এটি একবারই মাত্র হল। একটি শিশুকে শূন্যে ছুঁড়ে দাও, সে কেঁদে উঠবে। এটা পূর্ব জন্মের অভিজ্ঞতা? কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা কিভাবে এটি প্রয়োগ করব? এর কারণ— কতগুলি জিনিষের মধ্যে একটি প্রকৃত সম্পর্ক—-একটি ব্যাপ্তিশীলতা থাকে। আমাদের শুধু দেখতে হয় যে, গুণ দৃষ্টান্তের চেয়ে খুব বেশী বা কম না হয়ে পড়ে। এই পার্থক্য নিরূপণের উপরই সব মানবিক জ্ঞান নির্ভর করে। [উহাতে যাতে কোনরূপ অব্যাপ্তি বা অতিব্যাপ্তি দোষ না থাকে।]

ভ্রমাত্মক কোন বিষয় সম্বন্ধে এইটুকু স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রত্যক্ষানুভূতি তখনই প্রমাণস্বরূপ গৃহীত হতে পারে, যদি প্রত্যক্ষ অনুভব যে যন্ত্রের মাধ্যমে হয়েছে সেই যন্ত্রটি, অনুভবের পদ্ধতি এবং স্থায়িত্ব-কালের পরিমাপ বিশুদ্ধ হয়। শরীরিক রোগ বা কোনরূপ ভাবপ্রবণতা এই পর্যবেক্ষণকে ভ্রমপূর্ণ করতে পারে। অতএব প্রত্যক্ষ জ্ঞান সিদ্ধান্তে পৌঁছিবার একটি উপায় মাত্র। সুতরাং সব রকম মানবিক জ্ঞান, যাহা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে, তা অনিশ্চিত এবং ত্রুটিপূর্ণ। প্রকৃত সাক্ষী কে? বিষয়টি যার প্রত্যক্ষ-গোচর হয়েছে। বেদসমূহ সত্য, কেননা এইগুলি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিগণের বা আপ্তপুরুষগণের প্রত্যক্ষজ্ঞানের সাক্ষ্য-বিবরণ; কিন্তু এই প্রত্যক্ষ অনুভবের শক্তি কি কোন ব্যক্তির বিশেষ ক্ষমতায় সীমাবদ্ধ? না। ঋষি, আর্য এবং ম্লেচ্ছ সবারই সমভাবে এই জ্ঞান হতে পারে। নব্য ন্যায়ের অভিমত এই যে, এইরূপ আপ্তপুরুষের বাক্য প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অন্তর্গত, উপমা বা হেত্বাভাস যথার্থ অনুমানের সহায়ক নয়। সুতরাং প্রকৃত প্রমাণ বলতে আমরা দুটি জিনিষ পাই—প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং অনুমান।

একদল লোক আছে, যাহারা বহিঃপ্রকৃতির বিকাশকেই প্রাধান্য দেয়, আবার অপরদল অন্তঃপ্রকৃতির বিকাশকে। কোন্‌টি আগে—ডিমের আগে পাখী, না পাখীর আগে ডিম? পাত্রাধার তৈল, না তৈলাধার পাত্র? এই সমস্যার কোন মীমাংসা নেই। ছেড়ে দাও এ-সব। মায়া থেকে বেরিয়ে এস।

৩০। জগৎ না থাকলেই বা আমার কি? আমার মতে তাহলে তো খুব চমৎকার হবে! কিন্তু বাস্তবিক যা কিছু আমার প্রতিবন্ধক, সে-সবই শেষে আমার সহিত মিলিত হবে। আমি কি তাঁর (কালীর) সৈনিক নই?

৩১। হাঁ, একজন বিরাট পুরুষের অনুপ্রেরণাতেই আমার জীবন পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু তাতে কি? প্রেরণা জিনিষটা এই পৃথিবীতে কোন একজনের মাধ্যমে আসেনি। এটা সত্য যে, আমি বিশ্বাস করি—শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব প্রত্যাদিষ্ট (দ্রষ্টা) পুরুষ ছিলেন, সুতরাং আমি নিজেও তাহলে প্রত্যাদিষ্ট হব এবং তোমরাও, তোমাদের শিষ্যেরাও হবে, তারপর তাদের শিষ্যেরাও। এইভাবে বরাবর চলতে থাকবে। তোমরা কি দেখছ না যে, নির্বাচিত কয়েকজনকে উদ্বুদ্ধ করার যুগ আর নেই। এতে ভালই হোক বা মন্দই হোক, সে দিন চলে গেছে, আর কখনও আসবে না। ভবিষ্যতে সত্য পৃথিবীতে অবারিত থাকবে।

৩২। সমস্ত পৃথিবীকে উপনিষদের যুগে উন্নীত করতে হবে—এই রকম চিন্তা করে বুদ্ধ এক মস্ত ভুল করেছিলেন। মানুষের স্বার্থ-চিন্তা সব নষ্ট করেছিল। এ-বিষয়ে কৃষ্ণ ছিলেন বিজ্ঞতর, কারণ, তিনি রাজনীতিজ্ঞ পুরুষ। কিন্তু বুদ্ধ কোন আপসের পক্ষপাতী ছিলেন না। আপস করার জন্য এর আগে কত অবতারের শিক্ষা নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁরা লোক-স্বীকৃতি পাননি, অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বুদ্ধ যদি মুহূর্তের জন্যও আপস করতেন, তবে তাঁর জীবিতকালেই সারা এশিয়াতে তিনি ঈশ্বর বলে পূজিত হতেন। তাঁর উত্তর ছিল কেবল এই—বুদ্ধত্ব একটি অবস্থা-প্রাপ্তি মাত্র কোন ব্যক্তিবিশেষ নয়। বস্তুতঃ দেহধারীদের মধ্যে তাঁকেই একমাত্র প্রকৃত জ্ঞানী বলা যায়।

৩৩। পাশ্চাত্যে লোকে স্বামীজীকে বলেছিল, বুদ্ধের মহত্ত্ব আরও হৃদয়গ্রাহী হত, যদি তিনি ক্রুশবিদ্ধ হতেন। এটাকে তিনি রোমক বর্ররতা বলে অভিহিত করেছিলেন এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কর্মের প্রতি যে আসক্তি, তা হল খুব নিম্নস্তরের এবং পশুসুলভ। এই কারণেই জগতে মহাকাব্যের সমাদর সব সময়ে হবে। সৌভাগ্যবশতঃ ভারতে এমন এক মিল্টন জন্মগ্রহণ করেননি, যিনি মানুষকে সোজাসুজি গভীর অতল গহ্বরে নিয়ে গিয়ে ফেলবেন। ব্রাউনিং-এর একটি লাইন বরং তার স্থানে দিলে ভাল হয়। গল্পটির মহাকাব্যিক চমৎকারিত্বই রোমানদের নিকট হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটাই রোমানদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্মকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার বললেনঃ হাঁ, হাঁ, তোমরা পাশ্চাত্যেরা কাজ চাও। জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির মধ্যেও যে-কাব্য রয়েছে, তা তোমরা এখনও অনুভব করতে পারনি। সেই যে অল্পবয়স্কা মা তার মৃত পুত্রকে নিয়ে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়েছিল, সেই গল্পের চেয়ে চমৎকার গল্প আর কি হতে পারে? অথবা সেই ছাগশিশুর ঘটনাটি? দেখ, মহান্ ত্যাগ যে জিনিষ, তা ভারতে কিছু নূতন নয়। কিন্তু পরিনির্বাণের পর, এখানেও যে একটি কাব্য আছে, তা লক্ষ্য কর।

সেটা ছিল বর্ষার রাত। তিনি বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির মধ্যে সেই গো-পালকের কুঁড়েঘরে চালার নীচে দেওয়াল ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছেন। ক্রমে বৃষ্টি জোরে এল এবং বাতাসও বেড়ে উঠল। ভিতর থেকে জানালা দিয়ে সেই গো-পালককে একজনকে দেখতে পেয়ে চিন্তা করতে লাগল—হাঃ হাঃ কাষায়ধারী, ঐখানেই থাক। ঐ স্থানই তোমার উপযুক্ত। তারপর সে গান ধরলঃ

আমার গরুগুলো সব গোয়ালে আছে, আগুন ভালভাবেই জ্বলচ্ছে। আমার স্ত্রী নিরাপদে রয়েছে এবং শিশুরা সুন্দর ঘুমোচ্ছে। অতএব ওহে মেঘ, তুমি আজ রাতে যত ইচ্ছা বর্ষণ করতে পার।

বুদ্ধও বাইরে দাঁড়িয়ে এর উত্তর দিয়ে বললেনঃ আমার মন সংযত, আমার ইন্দ্রিয়বর্গ সংহৃত করেছি এবং আমার হৃদয় সুদৃঢ়। অতএব হে সংসার-মেঘ, তুমি আজ যত ইচ্ছা বর্ষণ করতে পার।

সেই গো-পালক আবার গেয়ে চললঃ আমার শস্য কাটা হয়ে গেছে, খড়গুলি সব ঘরে আনা হয়েছে। নদী জলে পূর্ণ হয়ে উঠেছে, পথগুলি ভালই আছে। অতএব হে মেঘ, তুমি আজ ইচ্ছামত বর্ষণ কর।

… এইভাবে চলতে লাগল, অবশেষে সেই গো-পালক অনুতপ্ত এবং বিস্মিত হয়ে বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল।

আবার সেই নাপিতের গল্প। তার চেয়ে সুন্দর আর কি হতে পারে?

একজন পবিত্র লোক আমার বাড়ীর ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমি যে নাপিত—আমার বাড়ীর নিকট দিয়ে! আমি ছুটে গেলাম, তিনি ফিরে দাঁড়ালেন এবং অপেক্ষা করলেন। আমি বললাম, ‘প্রভু, আমি কি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ এবং তিনি বলিলেন, ‘হাঁ নিশ্চয়।’ তিনি আমার মত নাপিতকেও ‘হাঁ’ বললেন! তারপর আমি বললাম, ‘আমি কি আপনার অনুসরণ করব?’ তিনি বললেন, ‘করতে পার’। আমি যে সামান্য নাপিত আমাকেও তিনি কৃপা করলেন!

৩৪। বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্মের মধ্যে প্রধান পার্থক্য এইঃ বৌদ্ধধর্ম বলছে—সমস্ত কিছু ভ্রম বলেই জেন; আবার হিন্দুধর্ম বলছে—জেন যে, এই ভ্রমের (মায়া) মধ্যে সত্য বিরাজ করছে। এটি কিভাবে হবে, হিন্দুধর্মে এ-বিষয়ে কোন কঠিন নিয়ম নেই। বৌদ্ধধর্মের অনুশাসনগুলিকে জীবনে প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজন সন্ন্যাস-ধর্মের, কিন্তু হিন্দুধর্মের এই অনুশাসনগুলি জীবনের যে-কোন অবস্থাতেই অনুসরণ করা যেতে পারে। সব পথই সেই একসত্যে পৌঁছিবার পথ। এই ধর্মের শ্রেষ্ঠ এবং মহত্তম কথাগুলির একটি—একজন ব্যাধের (মাংস-বিক্রেতার) মুখ দিয়া বলান হয়েছে; একজন বিবাহিতা নারীর দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তিনি একজন সন্ন্যাসীকে ঐ শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই ভাবে দেখা যায় যে বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসি-সঙ্ঘের ধর্মে পরিণত হয়েছে, কিন্তু হিন্দুধর্ম সন্ন্যাস-জীবনকে সর্বোচ্চ স্থান দিলেও জীবনের প্রাত্যহিক কর্তব্যপালনকে ঈশ্বর-লাভের অন্যতম পথ হিসাবে নির্দেশ করেছে।

৩৫। নারীদের সন্ন্যাস-জীবন-বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে স্বামীজী বললেনঃ তোমাদের জন্য কি কি নিয়ম হবে, তা স্থির কর; তারপর ভাবগুলিকে ফুটিয়ে তোল এবং পারলে তার মধ্যে একটু সর্বজনীনতা রাখ। কিন্তু স্মরণ রেখ যে, কোন সময়েই পৃথিবীতে এই আদর্শ জীবনে গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত এমন লোক আধ-ডজনের বেশী পাবে না। সম্প্রদায় গঠনের যেমন প্রয়োজন, তেমনি সম্প্রদায়গত ভাবের উপরে উঠারও প্রয়োজন। তোমাদের উপায় তোমাদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। আইন তৈরী কর কিন্তু আইন এমন ভাবে কর যে, লোকে যখন আইনের অনুশাসন ছাড়াই চলতে অভ্যস্ত হবে, তখন যেন তারা আইনগুলি দূরে ফেলে দিতে পারে। পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে পূর্ণ কর্তৃত্ব যুক্ত করার মধ্যেই আমাদের বৈশিষ্ট্য নিহিত। সন্ন্যাসী-জীবনাদর্শেও এ জিনিষটি করা যেতে পারে।

৩৬। দুটি ভিন্ন জাতির একত্র মিশ্রণের ফলেই তাদের মধ্যে থেকে একটি শক্তিশালী বিশিষ্ট জাতির উৎপত্তি হয়। এরা মিশ্রণ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে চায় এবং জাতির উৎপত্তি এখান থেকেই। এই আপেলের কথাই ধর। ভাল জাতের যেগুলি, সেগুলি মিশ্রণের দ্বারাই হয়েছে, কিন্তু একবার মিশ্রণ করার পর আমরা সেই জাতটা যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য চেষ্টা করি।

৩৭। মেয়েদের শিক্ষার কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেনঃ দেবতাদের পূজায় তোমাদের জন্য মূর্তি অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এই মূর্তিগুলির পরিবর্তন তোমরা করতে পার। কালীমূর্তি যে সর্বদা একই রকম থাকবে, তার কোন প্রয়োজন নেই। তাঁকে বিভিন্ন নূতন ভাবে যাতে আঁকা যায়, এ বিষয়ে চিন্তা করার জন্য মেয়েদের তোমরা উৎসাহিত কর। সরস্বতীর এক-শ রকম বিভিন্ন ভাব কল্পনা হোক। তাদের ভাবগুলিকে অবলম্বন করে তারা ছবি আঁকুক, ছোট পট-মূর্তি তৈরী করুক এবং রঙের কাজ করুক।

মন্দিরের ভিতর বেদীর সবচেয়ে নীচের ধাপে যে কলসীটা, তা যেন সব সময় জলে পূর্ণ থাকে এবং তামিল দেশে যে মাখনের প্রদীপ, সেগুলি সব সময় জ্বেলে রাখা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে যদি বরাবরের জন্যে উপাসনাদির ব্যবস্থা রাখতে পার, তবে হিন্দুভাবের দিক্‌ থেকে আর বেশী কিছু করার থাকবে না। কিন্তু যে অনুষ্ঠানগুলি পালন করবে, সেগুলি যেন বৈদিক হয়। একটি বৈদিক মতের বেদী থাকবে, যাতে পূজার সময় বৈদিক (যজ্ঞের) অগ্নি জ্বালা হবে। এ-রকম একটি ধর্মানুষ্ঠান ভারতের সব লোকেরই শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবে।

সব রকম জন্তু-জানোয়ার যোগাড় কর। গরু থেকে আরম্ভ করলে ভাল হয়, কিন্তু তার সঙ্গে বেড়াল পাখী এবং অন্যান্য জন্তুগুলিও রেখ। ঐগুলিকে খাওয়ান, যত্ন করা প্রভৃতি কাজ ছেলেমেয়েদের করতে দাও।

তারপর জ্ঞানযজ্ঞ। এটি সবচেয়ে সুন্দর জিনিষ। তোমরা কি জান যে, প্রত্যেক বই-ই ভারতে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়—কেবল বেদই নয়, ইংরেজী ও মুসলমানদের বইগুলিও সবই পবিত্র।

প্রাচীন শিল্পকলার পুনঃপ্রবর্তন কর। জমান দুধ দিয়ে ফলের বিভিন্ন খাবার কিভাবে প্রস্তুত করা যায়, মেয়েদের সে-সব শেখাও। শৌখিন রান্নাবান্না শেলাই-এর কাজ শেখাও। তারা ছবি আঁকা, ফটোর কাজ, কাগজ কেটে বিভিন্ন রকমের জিনিষ তৈরী করা, সোনা রুপোর উপর সুন্দর সুন্দর কাজ করা ইত্যাদি শিখুক। লক্ষ্য রাখ—তারা প্রত্যেকেই এমন কিছু শিখুক, যাতে প্রয়োজন হলে তাদের জীবিকা তারা অর্জন করতে পারে।

মানুষকে কখনও ভুলো না। সেবার দৃষ্টি নিয়ে মানুষকে পূজা করার ভাবটা ভারতে সূক্ষ্মাকারে বর্তমান, কিন্তু এটা কোন দিনই বিশিষ্ট মর্যাদা পায়নি। তোমার ছাত্রেরা এ-বিষয়ে চেষ্টা করুক। এদের বিষয়ে কবিতা রচনা কর, শিল্প সৃষ্টি কর। হাঁ, প্রত্যহ স্নানের পর খাওয়ার আগে কেউ যদি ভিখারীদের পায়ে গিয়ে পূজা করে, তবে তার হাত এবং মাথা দুটিরই আশ্চর্য-রকম শিক্ষা হবে। আবার কখনও কিছুদিন ছোট শিশুদের বা তোমাদের ছাত্রদেরও হয়তো পূজা করলে অথবা কারও নিকট থেকে শিশুদের চেয়ে এনে তাদের খাওয়ালে, পরিচর্যা করলে। মাতাজী১ আমায় যা বলেছিলেন, তা কি?—স্বামীজী, আমি অসহায়, কিন্তু এই যে পবিত্রাত্মা এরা, এদের যে পূজা করি, এরাই আমায় মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে। দেখ, তাঁর ভাব হল যে, একটি কুমারীর মধ্য দিয়ে তিনি উমারই সেবা করছেন। এই ভাবদৃষ্টি এবং তা দিয়ে একটি বিদ্যালয়ের পত্তন করা খুবই আশ্চর্যের বিষয়।

৩৮। সব সময় আনন্দের অভিব্যক্তিই হল ভালবাসা। এর মধ্যে দুঃখের এতটুকু ছায়াও হল দেহাত্মিকতা এবং স্বার্থপরতা।

৩৯। পাশ্চাত্যে বিবাহ জিনিষটা আইনগত বন্ধন ছাড়া আর কিছুর উপর নির্ভর করে না। কিন্তু ভারতে এটি চিরকালের জন্য দুজনকে মিলিত করবার একটি সামাজিক বন্ধন। এই জীবনে বা পর জীবনে তারা ইচ্ছা করুক বা না করুক, তারা দুজন একে অপরকে বরণ করে নেবে। একজন অপর জনের সমস্ত শুভকর্মের অর্ধাংশের অংশীদার হবে। এদের মধ্যে একজন জীবনের পথে যদি পিছিয়ে পড়ে, তবে পরে যাতে সে আবার তার সহযাত্রী হতে পারে, তার জন্য চেষ্টা অপর জনকেই করতে হবে।

৪০। চৈতন্য হচ্ছে অবচেতন মন এবং পূর্ণজ্ঞানাবস্থা—এই দুই সমুদ্রের মাঝে একটা পাতলা ব্যবধান মাত্র।

৪১। আমি যখন পাশ্চাত্যের লোকদের চৈতন্য সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে শুনি, তখন নিজের কানকেই বিশ্বাস করিতে পারি না। চৈতন্য! কি হয়েছে চৈতন্যে? কেন, অবচেতন মনের অতল গভীরতা এবং পূর্ণ চৈতন্যাবস্থার উচ্চতার তুলনায় এটা কিছুই নয়। এ-বিষয়ে আমার কোন দিনই ভুল হবে না, কেননা আমি যে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখেছি, তিনি কোন ব্যক্তির অবচেতন মনের খবর দশ মিনিটের মধ্যই জানতে পারতেন এবং তা দেখে তিনি ঐ ব্যক্তি ভূত ভবিষ্যৎ এবং শক্তিলাভ প্রভৃতি সবই বলে দিতে পারতেন।

৪২। এই-সব অন্তর্দৃষ্টির ব্যাপারগুলি সব গৌণ বিষয়। এগুলি প্রকৃত যোগ নয়। আমাদের কথাগুলির যাথার্থ্য পরোক্ষভাবে নির্ণয় করতে এ-সকলের কিছু কিছু প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। এ বিষয়ের সামান্যতম অনুভূতিতে মানুষ বিশ্বাসবান্ হয় যে, জড়-জগতের পিছনে একটা কিছু রয়েছে। তবুও এই-সব জিনিষ নিয়ে যারা কালক্ষেপ করে, তারা ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়ে। এই-সব যৌগিক শক্তিগুলি বাহ্য ঘটনা মাত্র। এগুলির সাহায্যে কোন জ্ঞান হলে কখনই তার স্থিরতা বা দৃঢ়তা থাকে না। আমি কি বলিনি যে, এগুলি বাহ্য ঘটনা মাত্র? সীমারেখা সব সময় সরে যাচ্ছে।

৪৩। অদ্বৈতের দিক্‌ দিয়ে বলা হয় যে, আত্মা জন্মানও না, মরেনও না। বিশ্বের এই-সব স্তর আকাশ ও প্রাণের বিভিন্ন সৃষ্টিমাত্র। অর্থাৎ সবচেয়ে যে নিম্ন স্তর বা ঘনীভূত স্তর, তা হল সৌরলোক; দৃশ্যমান জগৎকে নিয়েই এর পরিমিতি, এর মধ্যে প্রাণ বা জীবনীশক্তি এবং আকাশ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থরূপে প্রতিভাত। এরপর চন্দ্রলোক—এটি সৌরমণ্ডলকে ঘিরে রয়েছে। এটি কিন্তু চন্দ্র বলতে যা বোঝায়, মোটেই তা নয়। এটি দেবতাগণের আরামভূমি। এখানে প্রাণ জীবনীশক্তিরূপে এবং আকাশ তন্মাত্রা বা পঞ্চভূতরূপে প্রতিভাত। এরপরই আলোকমণ্ডল (বিদ্যুৎ-মণ্ডল)—এটি এমন একটি অবস্থা যে, একে আকাশ থেকে পৃথক্ করা যায় না এবং তোমাদের পক্ষে বলা খুবই অসম্ভব যে, বিদ্যুৎ জড় অথবা শক্তিবিশেষ। এরপর ব্রহ্মলোক—এখানে প্রাণ ও আকাশ বলতে আলাদা কিছু নেই, দুটি একীভূত হয়ে মনে সূক্ষ্মশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রাণ বা আকাশ কিছুই না থাকায় জীব সমস্ত বিশ্বকে সমষ্টিরূপে মহৎ তত্ত্ব বা ‘সমষ্টি মন’রূপে চিন্তা করে। ইনিই পুরুষরূপে বা সমষ্টি সূক্ষ্ম আত্মারূপে আবির্ভূত হন। এখানে তখনও বহুত্ব-জ্ঞান আছে, তাই এই পুরুষ নিত্য নন। এখান থেকেই জীব শেষে একত্ব উপলব্ধি করে। অদ্বৈতমতে জীব—যার জন্ম মৃত্যু কোনটাই নেই, তার কাছে এই পর্যায়গুলিও পর পর ভেসে উঠতে থাকে। বর্তমান সৃষ্টিও সেই একভাবেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সৃষ্টি ও প্রলয় একই পর্যায়ে হয়, একটি ভিতরে চলে যাওয়া এবং আর একটি বাহিরে বেরিয়ে আসা মাত্র।

প্রত্যেকেই এইরূপে তার নিজের জগৎকেই দেখে—এই জগৎ তার কর্মফলেই সৃষ্ট হয়, আবার তার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। অবশ্য অপর যারা বন্ধনগ্রস্ত, তাদের কাছে এর অস্তিত্ব তখনও থাকে। নাম এবং রূপই জগৎ। সমুদ্রের একটি ঢেউ নাম এবং রূপের দ্বারা সীমিত বলেই তার নাম ঢেউ। ঢেউ মিলিয়ে গেলে সমুদ্রই পড়ে থাকে। নাম-রূপও কিন্তু চিরকালের জন্য সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায়, জল ব্যতিরেকে এই ঢেউ-এর নাম এবং রূপ কোনদিনই সম্ভব নয় এবং এই নাম-রূপই জলকে ঢেউ-এ পরিণত করেছে, তবুও নাম এবং রূপ—এরা কিন্তু ঢেউ নয়। ঢেউ জলে মিলিত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারাও বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য ঢেউ বর্তমান থাকায় তাদের নাম-রূপ থাকে। এই নাম-রূপ হল মায়া এবং জল হল ব্রহ্ম। ঢেউটির যতক্ষণ অস্তিত্ব ছিল, ততক্ষণ এটি জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না, তবু ঢেউ হিসাবে এর একটি নাম এবং রূপ ছিল। আবার এই নাম ও রূপ ঢেউকে বাদ দিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াতে পারে না, যদিও জল হিসাবে এই ঢেউ নাম এবং রূপ থেকে অনন্তকাল বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। কিন্তু যেহেতু এই নাম এবং রূপকে স্বতন্ত্র ভাবে দেখা অসম্ভব, অতএব এগুলির কোন বাস্তব সত্তা নেই। অথচ এগুলি শূন্যও নয়। এরই নাম মায়া।

৪৪। আমি বুদ্ধের দাসানুদাসেরও দাস। সেই মহাপ্রাণ প্রভুর মত কেউ কি কখনও হয়েছে?তিনি নিজের জন্য একটি কর্মও করলেন না, তাঁর হৃদয় দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে আলিঙ্গন করেছিলেন। সেই রাজকুমার এবং সন্ন্যাসীর এত দয়া যে, তিনি একটা সামান্য ছাগ-শিশুর জন্য নিজের জীবন দিতে উদ্যত হলেন; তাঁর এত ভালবাসা যে, ক্ষুধিত ব্যাঘ্রীর সামনে নিজেকে সঁপে দিলেন, একজন অন্ত্যজের আতিথ্য গ্রহণ করে তাকে আশীর্বাদ করলেন। আমি যখন সামান্য বালকমাত্র, তখন আমি তাঁকে আমার ঘরে দর্শন করেছিলাম এবং তাঁর পদতলে আত্মসমর্পণ করেছিলাম, কারণ আমি জেনেছিলাম যে, তিনি সেই প্রভু স্বয়ং।

৪৫। শুক হলেন আদর্শ পরমহংস। মানুষের মধ্যে তিনিই সেই অনন্ত সচ্চিদানন্দ-সাগরের এক গণ্ডূষ জল পান করেছিলেন। অধিকাংশ সাধকই তীর থেকে এই সাগরের গর্জন শুনে মারা যান, কয়েকজন মাত্র এর দর্শন পান এবং আরও স্বল্প সংখ্যক এর স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। কিন্তু তিনি এই অমৃত-সাগর থেকে পান করেছিলেন!

৪৬। ত্যাগকে বাদ দিয়ে যে-ভক্তি তার অর্থ কি? এটি অত্যন্ত অনিষ্টকর।

৪৭। আমরা সুখ বা দুঃখ কোনটিই চাই না—এ-দুটির মধ্য দিয়ে আমরা সেই বস্তুর খোঁজ করছি, যা এই দুইয়ের ঊর্ধ্বে।

৪৮। শঙ্করাচার্য বেদের মধ্যে যে একটি ছন্দ-মাধুর্য, একটি জাতীয় জীবনের সুরপ্রবাহ আছে, তা ধরতে পেরেছিলেন। বাস্তবিকই আমার সব সময়ই মনে হয় যে, তিনি যখন বালক ছিলেন, তখন আমার মত তাঁরও একটা অন্তর্দৃষ্টি হয়েছিল এবং এই দৃষ্টি দ্বারাই তিনি সেই সুপ্রাচীন সঙ্গীত-ধারাকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। যাই হোক, তাঁর সারা জীবনের কার্যাবলী বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এটি বেদ ও উপনিষদের মাধুর্যের ছন্দিত স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই নয়।

৪৯। যদিও মায়ের ভালবাসা কোন কোন দিক্‌ দিয়ে মহত্তর, তথাপি পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে ভালবাসা, তা যেন ঠিক পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার সম্পর্কের মত। আদর্শকে এত বেশী জীবন্ত করে তুলতে ভালবাসার মত কিছুই নেই। ভালবাসার ফলে একজনের কল্পনার ছবি অপর জনের মধ্যে বাস্তব হয়ে ওঠে। এই ভালবাসা তার প্রিয়কে রূপান্তরিত করে ফেলে।

৫০। সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে সিংহাসনে বসে সম্পদ্, যশ, স্ত্রীপুত্রাদিকে তুচ্ছজ্ঞান করে জনকের মত হওয়া কি এতই সহজ? পাশ্চাত্যে একের পর এক অনেকেই আমাকে বলেছেন যে, তাঁরা ঐ অবস্থা লাভ করেছেন, আমি কেবল বলছি যে, এমন বিরাট পুরুষগণ ভারতে তো জন্মগ্রহণ করেন না!

৫১। এই কথা তোমরাও ভুলো না এবং তোমাদের ছেলেমেয়েদেরও শিক্ষা দিতে ভুলো না যে, একটি জোনাকি পোকা ও জ্বলন্ত সূর্যের মধ্যে, একটি ছোট ডোবা ও অসীম সমুদ্রের মধ্যে এবং একটা সর্ষের বীজ ও মেরুপর্বতের মধ্যে যে তফাত, গৃহী ও সন্ন্যাসীর মধ্যে ঠিক সেই রকম তফাত।

৫২। সব কিছুই ভয়ান্বিত, ত্যাগই কেবল নির্ভয়। যে সব সাধু জাল (ঠক‍বাজ) বা যারা জীবনে আদর্শ-রক্ষায় অসমর্থ হয়েছে, তারাও প্রশংসনীয়, যেহেতু আদর্শের সঙ্গে তাদের সম্যক্ পরিচয় হয়েছে, এবং এ দ্বারা তারা অপর সকলের সাফল্যলাভে কিছুটা সহায়ক।আমরা যেন আমাদের আদর্শ কখনও না ভুলি! রম‍্তা সাধু বহতা পানি—যে-নদীতে স্রোত আছে সে-নদী পবিত্র থাকে, তেমনি যে-সাধু বিচরণশীল, তিনিও পবিত্র।

৫৩। সন্ন্যাসীর টাকার কথা ভাবা ও টাকা পাওয়ার চেষ্টা করা আত্মহত্যার সামিল!

৫৪। মহম্মদ বা বুদ্ধ মহান্ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু এতে আমার কি? এর দ্বারা আমার কি কিছু ভাল বা মন্দ হবে? আমাদের নিজেদের তাগিদে এবং নিজেদের দায়িত্বেই নিজদিগকে ভাল হতে হবে।

৫৫। এ দেশে তোমরাও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হারাবার ভয়ে খুবই ভীত। কিন্তু ব্যক্তিত্ব বলতে যা বুঝায়, তা তোমাদের এখনও হয়নি। তোমরা যখন তোমাদের নিজ নিজ প্রকৃতি জানতে পারবে, তখনই তোমরা যথার্থ ব্যক্তিত্ব লাভ করবে, তার আগে নয়। আর একটা কথা সব সময় এদেশে শুনছি যে, আমাদের সব সময়ে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত। তোমরা কি জান না যে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যা উন্নতি হয়েছে, সবই প্রকৃতিকে জয় করেই হয়েছে? আমাদের কোনরূপ উন্নতি করতে হলে প্রতি পদক্ষেপে প্রকৃতিকে প্রতিরোধ করতে হবে।

৫৬। ভারতবর্ষে লোকে আমায় সাধারণের মধ্যে অদ্বৈত বেদান্ত শিক্ষা না দেওয়ার জন্য বলে, কিন্তু আমি বলি যে, একটি শিশুকেও এই জিনিষটা বুঝিয়ে দিতে পারি। উচ্চ আধ্যাত্মিক সত্যগুলির শিক্ষা একেবারে প্রথম হইতেই দেওয়া উচিত।

৫৭। যত কম পড়বে, তত মঙ্গল। গীতা এবং বেদান্তের উপর যে-সব ভাল ভাল গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলি পড়। কেবল এইগুলি হলেই চলবে। বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি সবটাই ভুলে ভরা। চিন্তা করতে শেখবার আগেই মনটা নানা বিষয়ের সংবাদে পূর্ণ হয়ে উঠে। মনকে কেমন করে সংযত করতে হয়, সেই শিক্ষাই প্রথম দেওয়া উচিত। আমাকে যদি আবার নূতন করে শিখতে হয় এবং এই বিষয়ে আমার যদি কোন মতামত দেওয়ার ক্ষমতা থাকে, তবে, আমি প্রথমে আমার মনকেই আয়ত্তে আনার চেষ্টা করব এবং তারপর প্রয়োজন বোধ করলে অন্য কোন বিষয় শিখব। কোন বিষয় শিখতে লোকের অনেক দিন লেগে যায়, তার কারণ হল তারা ইচ্ছামত মনকে সন্নিবিষ্ট করতে পারে না।

৫৮। দুঃসময় যদি আসে, তবে হয়েছে কি? ঘড়ির দোলন আবার অন্যদিকে ফিরে আসবে। কিন্তু এটাও খুব একটা ভাল কিছু নয়। যা করতে হবে, তা হল একে একেবারে থামিয়া দেওয়া।