৩৮. বারাণসী শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমঃ আবেদন

[১৯০২ খ্রীঃ ফেব্রুআরী মাসে কাশী শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের প্রথম কার্যবিবরণীসহ প্রেরিত একটি পত্র।]

প্রিয় …

ইহার সহিত বারাণসী রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের গত বৎসরের একটি কার্যবিবরণী আপনার জন্য পাঠাইতেছি।

এই শহরে যে-সকল ব্যক্তি, সাধারণতঃ বৃদ্ধ নরনারী দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পড়েন, তাঁহাদের দুঃখ মোচনের জন্য আমরা যে সামান্য চেষ্টা করিতে পারিয়াছি, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ইহা হইতে পাইবেন।

বর্তমান শিক্ষাজাগরণ ও জনমতের ক্রমবর্ধমানের দিনে হিন্দুর তীর্থসমূহ, তাহাদের বর্তমান অবস্থা ও কর্মপদ্ধতি সমালোচকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই। এই তীর্থ হিন্দুদিগের নিকট পবিত্রতম, সেজন্য ইহার সমালোচনাও কঠোরতম।

অন্যান্য তীর্থস্থানগুলিতে লোকে পাপমোচনের উদ্দেশ্যে যায়। সেজন্য তাহাদের সহিত তাহাদের সম্পর্কও সাময়িক—মাত্র কয়েকদিনের জন্য। কিন্তু আর্য-সভ্যতার এই প্রাচীনতম ও সজীব ধর্মীয় কেন্দ্রে—এই নগরে—বৃদ্ধ ও জরাগ্রস্ত নর-নারীগণ বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের ছায়াতলে বসিয়া ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করিয়া যাহাতে চরম মোক্ষ লাভ করিতে পারেন, সেজন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করিতে থাকেন।

ইহা ছাড়াও আর যাঁহারা জগদ্ধিতায় সর্বত্যাগী হইয়াছেন ও তাঁহাদের আত্মীয়স্বজন ও শৈশবের সকল সম্পর্ক হইতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হইয়াছেন, তাঁহারাও এ শহরে বাস করেন। মানুষের সাধারণ নিয়তি—দৈহিক রোগাদির দ্বারা তাঁহারাও আক্রান্ত হন।

শহরের ব্যবস্থাপনায় হয়তো কিছু কিছু ত্রুটি আছে, পুরোহিতবর্গের উপর সাধারণতঃ যে-সকল কঠোর সমালোচনা বর্ষিত হয়, হয়তো তাহাও সত্য। তথাপি ভুলিলে চলিবে না—জনসাধারণ যেমন, পুরোহিতও তেমনি। যদি লোকে জোড়হাতে কেবল একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া থাকে ও দুঃখের এই দ্রুত প্রবাহ—যাহা তাহাদের গৃহের পাশ দিয়া প্রবাহিত হইয়া আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, সন্ন্যাসী ও গৃহীদিগকে অসহায় দুর্ভোগের সাধারণ আবর্তে টানিয়া ফেলিতেছে—কেবল দেখিতে থাকে এবং ঐ প্রবাহ হইতে কাহাকেও বাঁচাইবার চেষ্টামাত্র না করিয়া তীর্থের পুরোহিতকুলের অন্যায় কার্যের শুধু বাগাড়ম্বরপূর্ণ সমালোচনা করে, তাহা হইলে এই দুর্ভোগের এককণাও কমিবে না, এক ব্যক্তিও সাহায্য পাইবে

প্রশ্ন এই—শিবের এই চিরন্তন স্থান মোক্ষলাভের অনুকূল বলিয়া আমাদের পূর্বপুরুষগণ যেরূপ বিশ্বাস করিতেন, আমরাও কি সেই বিশ্বাস পোষণ করিতে চাই? যদি তাই হয়, তবে মরণার্থী ব্যক্তিগণের বৎসরের পর বৎসর এখানে আসিয়া সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে দেখিয়া আমাদের আনন্দলাভ করাই উচিত। দুঃখিগণের মোক্ষলাভের এই চিরন্তন ঐকান্তিক আগ্রহ দেখিয়া আমাদের শ্রীভগবানের নামের জয়গান করাই কর্তব্য।

যে-সব দুঃখার্ত ব্যক্তি এই স্থানে মৃত্যুবরণ করিতে আসে, তাহারা স্বকীয় জন্মস্থানের প্রাপ্য সমস্ত সাহায্য হইতে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে; তাহারা যখন রোগাক্রান্ত হয়, তখন তাহাদের যে কী অবস্থা হয়, তাহা অনুভব করিবার ভার ও হিন্দু হিসাবে আপনারা উহার কি প্রতিকার করিতে পারেন, তাহা ভাবিয়া দেখিবার ভার আপনাদের বিবেকের উপর ন্যস্ত করিতেছি।

ভ্রাতৃগণ! অন্তিম বিশ্রামের প্রস্তুতির এই অদ্ভুত স্থানের আশ্চর্যকর আকর্ষণের বিষয় স্থিরচিত্তে আপনারা কি চিন্তা করিতে পারেন না? মৃত্যুর মাধ্যমে মোক্ষের দিকে অগ্রসর তীর্থযাত্রীদের বহু প্রাচীন বিরামহীন এই স্রোত আপনাদিগকে কি অনির্বচনীয় শ্রদ্ধার ভাবে আবিষ্ট করে না? যদি করে, তবে আসুন আমাদিগের এই কাজের জন্য আপনাদের সদয় হস্ত প্রসারিত করুন।

আপনাদের দান হয়তো অতি সামান্য, আপনাদের সাহায্য হয়তো নগণ্য, তবুও কুণ্ঠাবোধ করিবেন না। প্রাচীন প্রবাদ আছে—তৃণগুচ্ছগুলি একত্র করিয়া রজ্জু প্রস্তুত করিলে সর্বাপেক্ষা মদমত্ত হস্তীকেও উহা দ্বারা বাঁধিয়া রাখা যায়।

বিশ্বনাথাশ্রিত সর্বদা আপনাদের
বিবেকানন্দ