৭৩. বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী

মানুষের অঙ্গভঙ্গী হইতে তাহার ভিতরের অবস্থা বুঝিতে পারা যায়। সকালবেলা তাহার যে আকৃতি থাকে, দিনের শেষে সারাদিনের ক্লান্তিহেতু তাহা পরিবর্তিত হয়। সুখে সে উৎফুল্ল, দুঃখে সে বিবশ। সব জীবজন্তুর মূর্তি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হইতেছে; তাহা কেবল ভিতরের পরিবর্তনজনিত নহে। বাহিরের আঘাতেও তাহার অঙ্গভঙ্গী বিভিন্ন হইয়া যায়। তাড়নায় কুপিতা ফণিনী মুহূর্তেই সংহাররূপিণী হইয়া থাকে।
এইরূপে অহরহ ভিতর ও বাহিরের শক্তির দ্বারা তাড়িত হইয়া জীব বহুরূপী হইয়াছে। ভিতরের শক্তির সহিত বাহিরের শক্তির নিরন্তর সংগ্রাম চলিতেছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাহিরের আঘাতের ফলেই ভিতরের শক্তি দিন দিন পরিস্ফুট হইয়া থাকে।
এক সময়ে ভিতরে কিছুই ছিল না, বাহির হইতে শক্তি প্রবেশ করিয়া ভিতরে সংস্থিত হইয়াছে। যাহা বাহিরে অসীম ছিল, তাহাই ভিতরে সসীম হইল; এবং সেই ক্ষুদ্র তখন বৃহতের সহিত যুঝিতে সমর্থ হয়। সেই ক্ষুদ্র কখনও বাহিরকে বরণ করে, কখনও বা প্রত্যাখ্যান করে। জীবনের এই লীলা বৈচিত্র্যময়ী।
জীবের ন্যায় বৃক্ষের ভঙ্গীও সর্বদা পরিবর্তিত হইতেছে। পাতা কখনও আলোর সন্ধানে উম্মুখ হয়, কখনও প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ হইতে বিমুখ হয়। এই সকালবেলায় বাগানে বেড়াইতে বেড়াইতে দেখিলাম যে, সূর্যমুখীর গাছটি পূর্বগগনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। পাতাগুলি ঘুরিয়া এরূপে সন্নিবেশিত হইয়াছে যে, প্রত্যেক পাতার উপরে যেন সূর্যরশ্মি পূর্ণরূপে পতিত হয়। ইহার জন্য কোনো পাতা উপরের দিকে উঠিয়া থাকে, আর পাশের পাতাগুলি ডান কিংবা বাম দিকে পাক খাইয়া সূর্যকিরণ পূর্ণমাত্রায় আহরণ করে। বৈকালবেলায় দেখিতে পাইলাম, গাছ ও পাতা পশ্চিমগগনোন্মুখ হইয়াছে, ডাল এবং সব পাতাগুলি ঘুরিয়া গিয়াছে। কি শক্তির বলে এই পরিবর্তন ঘটিল? বাহিরের সহিত ভিতরের এ কি অদ্ভুত সম্বন্ধ! সূর্য তো প্রায় পাঁচ কোটি ক্রোশ দূরে, তবে কি রাখীবন্ধনে গাছ দিবাকরের সহিত এইরূপ সম্মিলিত হইল?
উদ্ভিদ-বিদ্যা সম্বন্ধীয় পুস্তকে দেখা যায় যে, সূর্যিমুখীর এই ব্যবহার ‘হীলিওট্রোপিজ্‌ম্’-জনিত। হীলিওট্রোপিজ্‌মের বাংলা অনুবাদ, সূর্যের দিকে হওয়া। সূর্যমুখী কেন সূর্যের দিকে আকৃষ্ট হয়? কারণ ‘সূর্যের দিকে মুর্খ’ হওয়াই তাহার প্রবৃত্তি! যখন কোনো বিষয়ের প্রকৃত সন্ধান না পাইয়া মানুষ উৎকণ্ঠিত হয়, তখন কোনো দুর্বোধ্য মন্ত্রতন্ত্র তাহাকে নিশ্চিন্ত করে। তবে সেই মন্ত্রটি সংস্কৃত, লাটিন, কিংবা গ্রীক ভাষায় হওয়া আবশ্যক। সোজা বাংলায় কিংবা অন্য আধুনিক ভাষায় হইলে মন্ত্রের শক্তি থাকে না। এই জন্যই গ্রীক হীলিওট্রোপিজ্‌ম্ মন্ত্রে সূর্যমুখীর ব্যবহার বিশদ হইল!
সে যাহাই হউক, ইহার পশ্চাতে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। এই সব অঙ্গভঙ্গী অদৃশ্য জীববিন্দুর প্রকৃতিগত কোনো পরিবর্তন দ্বারাই সাধিত হয়। জীববিন্দুর পরিবর্তন অণুবীক্ষণযন্ত্রেও অদৃশ্য। তবে কিরূপে সেই অপ্রকাশকে সুপ্রকাশ করা যাইতে পারে? বহু চেষ্টার পর বিদ্যুৎ-বলে সেই অদৃশ্য জগৎকে দৃষ্টিগোচর করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই বিষয়ে দুই-একটি কথা পরে বলিব।
কেবল সূর্যমুখীই যে আলোক দ্বারা আকৃষ্ট হয়, এরূপ নহে। টবে বসানো একটি লতা অন্ধকার ঘরে রাখিয়া দিয়াছিলাম। রুদ্ধ জানালার একটি রন্ধ্র দিয়া অতি ক্ষুদ্র আলোকরেখা আসিতেছিল। পরের দিন দেখিলাম, সব পাতাগুলি ঘুরিয়া সেই ক্ষীণ আলোকের দিকে প্রসারিত হইয়াছে।
লজ্জাবতী লতাতেও এইরূপ ক্রিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। টবে বসানো লতাটি যদি জানালার নিকটে রাখা যায়, তাহা হইলে দেখিতে পাই যে, সব পাতাগুলি ঘুরিয়া বাহিরের আলোর দিকে মুখ করিয়া রহিয়াছে। টব ঘুরাইয়া দিলে পাতাগুলি পুনরায় নূতন করিয়া ঘুরিয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পাতাগুলি কেবল উঠে এবং নামে তাহা নয়, কোনোগুলি ডান দিকে এবং কোনোগুলি বাম দিকে পাক খায়। পাতার ডাঁটার গোড়ায় যে স্থূল পেশী দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার দ্বারাই পাতাগুলি ঘুরিয়া থাকে, কখনও উঠানামা করে, কখনও ডান দিকে কিংবা বাম দিকে পাক খায়। পূর্বে বিশ্বাস ছিল যে, পাতার গোড়ায় একটিমাত্র পেশী আছে যাহার দ্বারা কেবলমাত্র উঠানামা হয়। কিন্তু আমাদের হাত ঘুরাইতে হইলে অনেকগুলি পেশীর আকুঞ্চন এবং প্রসারণের আবশ্যক। অনুসন্ধান করিতে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, লজ্জাবতীর পাতার মূলে চারিটি বিভিন্ন পেশী আছে, যাহার অস্তিত্ব ইতিপূর্বে কেহই মনে করিতে পারেন নাই। একটি পেশীর দ্বারা পাতা উপরের দিকে উঠে, আর-একটির দ্বারা নীচের দিকে নামে, অন্য একটির দ্বারা ডান দিকে পাক খায় এবং চতুর্থ পেশীর দ্বারা বাম দিকে ঘুরিয়া যায়।
ইহার প্রমাণ কি? প্রমাণ এই যে, পালক দ্বারা উপরের পেশীটুকুতে সুরসুড়ি দিলে পাতাটি উপরের দিকে উঠে এবং সেই ঊর্ধ্বে গতি যন্ত্রের দ্বারা লিখিত হয়। এক নম্বরের বা চারি নম্বরের পেশীকে এইরূপে উত্তেজিত করিলে পাতাটি বাম দিকে বা ডান দিকে পাক খায়, দুই নম্বর বা তিন নম্বরটিকে ঐরূপ উত্তেজিত করিলে পাতা নীচে নামে বা উপরে উঠিয়া যায়। সূর্যের আলো এইরূপে পেশীর নানা অংশে নিক্ষেপ করিলে উক্তবিধ সাড়া পাওয়া যায়। তবে সূর্যের আলোক তো সব সময়ে পত্রমূলে পড়ে না, কারণ পাতার ছায়ায় পত্রমূলটি ঢাকা থাকে। লজ্জাবতীর বড়ো ডাঁটাটির সহিত চারিটি ছোটো ডাঁটা সংযুক্ত, এবং সেই ছোটো ডাঁটার গায়ে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা থাকে। আলো সেই ক্ষুদ্র পাতার উপরই পড়ে। পড়িবামাত্রই দেখা যায় যে পাতা নড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু পাতার নড়াচড়া তো সেই দূরের স্থুল পেশীর আকুঞ্চন-প্রসারণ ভিন্ন হইতে পারে না। তবে ছোটো পাতাগুলি আলোর অনুভবজনিত উত্তেজনায় কি সংকেত কোন্ পথ দিয়া দূরে পাঠাইয়া থাকে? এই বিষয়ে অনুসন্ধানে জানিতে পরিলাম যে, চারিটি ছোটো ডাঁটা হইতে পাতার মূল পর্যন্ত চারিটি বিভিন্ন স্নায়ুসূত্র প্রসারিত। তাহা দ্বারাই খবরাখবর পৌঁছিয়া থাকে। এক নম্বরের ক্ষুদ্র পাতাগুলিকে কোনোরূপে উত্তেজিত করিলে একটি মাত্র সূত্র দিয়া পত্রমূলের এক নম্বর পেশীতে উত্তেজনা প্রেরিত হয়, অমনি পাতাটি বাম দিকে পাক খাইয়া যায়। চারি নম্বরের পাতাগুলিকে ঐরূপে উত্তেজিত করিলে ডান দিকে পাক খায়। দুই নম্বরের পাতাগুলিকে উত্তেজিত করিলে বড়ো পাতাটি নীচের দিকে পড়ে। তিন নম্বরের ছোটো পাতাগুলিকে উত্তেজিত করিলে উপরের দিকে উঠিয়া যায়। সুতরাং দেখা যায়, পাতার বাহির হইতে ভিতরের দিকে হুকুম পাঠাইবার চারিটি রাশ আছে। কে সেই বল্‌গা টানিয়া সংকেত পাঠায়?
কেবল তাহাই নহে। কোনো নির্দিষ্ট দিকে চালিত করিবার জন্য একটা বল্‌গা টানিলে তাহা সাধিত হয় না। নৌকার একটি দাঁড় টানিলে নৌকা কেবল ঘুরিতে থাকে। দিশাহীন তবে এক দিকের টান। অন্ততঃ দুই দিকের দুইটি সমবেত টান দ্বারা গন্তব্যপথ নির্দিষ্ট হয়। এক সময়ে দুইটি দাঁড় টানা আবশ্যক।
পতঙ্গ আলোর দিকে ছুটিয়া যায়। তাহার দুইটি চক্ষুর উপর আলো পড়ে। প্রত্যেক চক্ষুর সহিত তাহার এক-একটি পাখার সংযোগ। একটি চক্ষু অন্ধ হইলে সে আর আলোর দিকে যাইতে পারে না। এক-দাঁড়ের নৌকোর ন্যায় কেবল ঘুরিতে থাকে। যখন দুইটি চক্ষুর উপর আলো পড়ে, কেবল তখনই দুইটি ডানা একসঙ্গে একই বলে আন্দোলিত হয়, এবং সে সোজা পথে আলোর দিকে ধাবিত হয়। আলো যদি পাশে ঘুরাইয়া রাখা যায়, তাহা হইলে উহা কেবল একটি চক্ষুর উপর পড়ে, সেইজন্য একটি পাখা প্রবল বেগে-স্পন্দিত হয় এবং পতঙ্গটি ঘুরিয়া যায়। ঘুরিয়া যখন আলোর সোজাসুজি আলোমুখীন হয় এবং আলো দুইটি চক্ষুর উপর সমানভাবে পড়ে, তখন দুইটি পাখাই সমানভাবে একই শক্তিতে স্পন্দিত হইতে থাকে এবং পতঙ্গ তাহার অভীষ্ট লাভ করে- জীবনে কিংবা মরণে!
দুইটি দাঁড়ের দ্বারা তরণী কেবল নদীবক্ষের উপরই গন্তব্য দিকে ধাবিত হইতে পারে। কিন্তু সর্বদিগ্‌বিহারী জীব কখনও দক্ষিণে কখনও বামে, কখনও ঊর্ধ্বে কখনও বা অধোদিকে ধাবিত হইতে চাহে। এরূপ সর্বমুখী গতি নিরূপণ করিবার অন্ততঃ চারিটি রশ্মির আবশ্যক।
লজ্জাবতী পাতার প্রতি কোষই আলোক ধরিবার ফাঁদ। সেই আলোর উত্তেজনা এক-একটি স্নায়ুসূত্র ধরিয়া পত্রমূলের পেশীতে উপস্থিত হয়। যতক্ষণ-না চারিটি ডাঁটার পত্রসমষ্টি সমানভাবে আলোকমুখীন হয়, ততক্ষণ চারিটি বল্‌গার টানের ইতরবিশেষ হইয়া থাকে। পত্ররথ তখন দক্ষিণে কিংবা বামে, ঊর্ধ্বে কিংবা নিম্নে চালিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *